সকাল থেকে সবাই ব্যস্ত। আম্মু আমি মিরা আপু রান্নাঘরে কাজ করছি। আপু মাংস কুটছেন, আম্মু কোরমা বসিয়েছেন। আমি পেয়াজের থালা ঠিক করে সব হাতের নাগালে রেখে চলছি। সব ঠিক চলছে কিন্তু একটা জিনিস মাথায় ঢুকেনি, এতো বড় দাওয়াতের আয়োজন কেন করা হলো। উনারা আহামরি দূরের কেউ না এভাবে পসরা সাজিয়ে নিমন্ত্রণ করতে হবে। আবির ভাইয়া অফিস থেকে ছুটি নিয়ে টিভির রুমে বসে আছেন। আব্বু দই মিষ্টি আনতে বাইরে গিয়েছেন। সকাল থেকে খেটেখুটে দুপুরের আযানে রুমে ফিরলাম ফিটফাট হয়ে মেহমান আপ্যয়ন করতে হবে বলে। আম্মু আমার রুমে মিরা আপুকে পাঠিয়ে দিল।উনার হাতে দুইটা শাড়ি। মিরা আপু এবং আমি অনেকটা কৌতুহল হয়ে আম্মুকে জিজ্ঞাসা করলাম-
--আম্মু রাবেয়া আন্টি আসবে ভালো কথা, শাড়ি কেন পড়তে যাব? তাও আবার আমরা দুইবোন কেন পড়বো?
পাশ থেকে মিরা আপু আম্মুকে বলে উঠল-
--কাকি মম নাহয় শাড়ি পড়লো আমার কি দরকার শাড়ি পড়ার? আমি শাড়ি পড়ে কি করবো?
আম্মু আমাদের দুইজনের হাতে দুইটা শাড়ি ধরিয়ে হাসিমুখে বলে উঠলো-
-আমি শাড়ি পড়বো, ভাবলাম আমার সাথে তোরাও একটু সঙ্গ দে। কতদিন হয়েছে তোদের শাড়ি পড়ুয়া দেখিনা, চোখটা আমার জুড়িয়ে যায় জানিস....যখন তোদের শাড়ি পড়া দেখি।
আম্মু দরজা চাপিয়ে আমাদের একত্রে রেখে হাটা দিলেন বাইরে। মিরা আপু উনার নীল শাড়িটা নিয়ে বিছানায় যেয়ে চিন্তা ভাবনা করতে বসলো। ভাবনার বিষয় হয়তো এটা আম্মু কেন শাড়ি পড়তে বললেন।আমিও কিছুটা চিন্তায় পড়ে গেলাম আসলে ঘটনা কি!! আপু এখনো গভীর ভাবে পরিস্থিতি বোঝার প্রক্রিয়া চালাচ্ছেন। আমি আমার শাড়িটা বিছানায় রেখে আপুর পাশে গিয়ে বসলাম, জিজ্ঞাসা করলাম-
-আপু কি ভাবছো? শাড়ি নিয়ে কিছু উত্তর পেয়েছো? আপু আমার না ভয় করছে। আম্মুর ব্যবহারটা আমার উটকো লাগছে আপু...কেন জানি ভালো কিছুর আভাস পাচ্ছিনা....
আপু একটা বড় ঢোক গিলল। আমার দিকে তাকিয়ে ভয় জড়ানো গলায় বলে উঠলো-
--মম, আমার মনে বসে যাচ্ছে। হুটহাট মুগ্ধ ভাইয়ার পরিবার ডেকে নেমন্তন্ন করে শাড়ি পড়ার অনুনয় করা, কাকির ব্যবহার।।।আমার অন্যকিছুর ঘাপলা ঠেকছে।। হঠাৎ কাকির শাড়ি দেওয়ার কারন ওটা ভাববো কি???...
--কি কারন হতে যাবে? তুমি কি বোঝাচ্ছো?....এই আপু... আমি যা ভাবছি তুমি কি তাই ভাবছো!!
--দেখ মম, উত্তেজিত হবি না। তুই যা ভাবছিস আমিও সেটাই ভাবছি। বিয়ের সম্বন্ধ আসলে তোর জন্য মুগ্ধ ভাইয়ার সম্বন্ধ আসবে। আমারটা কার জন্য আসবে? আমি কার জন্য শাড়ি পড়ব?
--সেটা আমিও বুঝতে পারছি না। আর মুগ্ধ ভাইয়া বিয়ের বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত নেননি। আচ্ছা আবির ভাইয়া কি কিছু বলেছে? নাকি আবির ভাইয়া তোমাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার বুদ্ধি এটেছে??
--না। এটা হতে যাবেনা মম। তোর ভাইয়া বলেছে আগে তোর বিয়ে হবে তারপর ও আমাদের বিয়ের কথা তুলবে। এখন আমার শাড়ি পড়া নিয়ে বিরাট গোলমাল লাগলো কিনা....বুঝতে পারছিনা।
--আচ্ছা আপাতত শাড়ি পড়ো। মাথা থেকে চিন্তা ঝারো, উনারা আসুক সব জানতে পারবো।
আপু শাড়ি পড়ে রেডি হতেই আম্মুর কাজে ডাক পড়লো। আমি এখনো রেডি হইনি শাড়ির কুচি ঠিক করতে ঝামেলা লাগছে। আপু সাহায্য করতে চেয়েছিলো কিন্তু ডাক পড়েছে বিধায় চলে যেতে হলো। আমি শাড়ি পড়ে রেডি হয়ে আয়নার সামনে দাড়ালাম। ছিপছিপে লাগছে গায়ে। আমি শাড়িতে কম্পর্ফটেবল না। তার উপর ফুলহাতা ব্লাউজের গেটআপ। আম্মু আমাকে শাড়ি পড়া বেশভূয়ায় বেশ পছন্দ করেন। আব্বু হলে তো কথাই নেই!! উনি আমাকে সঙ্গে করে ঘুরতে পযর্ন্ত নিয়ে যান। ঠোটে হালকা লাল লিপস্টিক দিয়ে চুল আচড়াতে চিরুনি নিতেই ভাইয়া দরজা নক করে ভেতরে ঢুকলো। আয়নার মধ্যে উনার প্রতিচ্ছবি দেখছি সাথে চুল আচড়াচ্ছি। ভাইয়া দরজা ঠেলে আমার পাশে এসে দাড়িয়ে বললো-
--বদমাইশ শোন তো, আম্মু তোদের শাড়ি পড়তে বলল কেন? মিরাও দেখি নীল পরী সেজে আন্টিদের খাবার সার্ভ করছে।
--ভাইয়ু আমি কিছু জানি না। আমাকে শাড়ি পড়ার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে কোনো লাভ হবেনা, যা জানার সব আম্মু জানে। আচ্ছা সবার খাওয়া চলছে? নাকি শেষ পর্যায়ে?
--শেষ পর্যায়ে। কিন্তু মুগ্ধ এখনো আসেনি। রাফিয়া, রাফিন ভাই, আঙ্কেল আন্টি আসছে। আম্মুরে জিজ্ঞেস করছিলাম বুঝলি, আম্মু কোনো সলিড উত্তর দিলো না। ভাবলাম তুই জানিস এজন্য আসছি।
-আরে উনি আমাকে এক ফোটা এ বিষয়ে কিচ্ছু জানায় নি। চলো বাইরে চলো।
আমি চুল আচড়ানো শেষ করে। ডান সাইডে সিথি তুলে কোমর অবধি চুল ছেড়ে দিলাম। চিড়ুনি রেখে আমিও ভাইয়াকে নিয়ে বেরিয়ে আসলাম রুম থেকে। ডাইনিং রুমের কাছাকাছি পৌছতে অট্টহাসির শব্দ আসছে। সবাই ওখানে খাওয়া পর্ব সারছেন। ক্লান্ত চোখ, আমার মুগ্ধ ভাইয়াকে খুজছে। কিন্তু উনি নাকি আসেননি। কেমন অবস্থা? দরজার পাশ ধরে দাড়াতেই দেখি সবার খাওয়া শেষ। দইয়ের পিরিচে চামচ ডুবিয়ে সবাই দই খাচ্ছে। আঙ্কেল, আন্টি, রাফিয়া আরেকজন ছেলে বসে আছেন। সম্ভবত ইনি রাফিন ভাই। দেখতে ভালো। আঙ্কেল আমাকে দেখতেই মুখে হাসি টেনে বলে উঠলো-
--আরে টুকটুকি দেখছি....এতো দেরি হলো কেন, আমি অপেক্ষা করতে করতে শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম। ভাবছিলাম একসাথে খাবো!!কিন্তু তোমার বাবা আমাকে অপেক্ষা করতে দিলো না টুকটকি!!
আমি মুচকি হাসলাম। আন্টি দইয়ের চামচ তুলে বলে উঠলো-
--ওগো দেখছো, সামিনার ঘরে আজ লাল নীল পরীর খেলা চলছে। দুই দুটো চাদের টুকরো!! বাইরে যাস না আবার!! ছেলে ধরে নিয়ে যাবে!!
আন্টির কথায় সবাই একগাল হাসলো। রাফিন ভাইয়া খুব চাপা স্বভাবের, ছোট থেকেই দেখেছি। কারো সাথে কথা নেই, বার্তা নেই কিছু নেই। উনি রুমে থাকা না থাকা এক সমান। আমি ওখান থেকে সরে ড্রয়িংরুমে যেয়ে সোফায় বসলাম। সোফায় বসে টিভি অন করবো কোত্থেকে মিরা আপু হুরহুরিয়ে সামনে এসে আমাকে একদম গা ঘেষে বসলো। আপু আমার কানে আস্তে করে বলে উঠলো-
-মম রাফিন ভাইয়ের কাছ থেকে দূরে থাক। উনার তাকানো আমার কাছে ভালো লাগছে না। দইয়ের চামচে কম তোর দিকে তাকাইছে বেশি। সাবধান করে দিচ্ছি দূরে থাক।
আপু কানে কথাটা বলেই আবার স্বাভাবিক হয়ে রুমের বাইরে চলে গেল। মাঝখান দিয়ে আমি বোকার মতো থ মেরে আছি। আপু কি বললো? রাফিন ভাই লুইচ্চা? বাহ! লুইচ্চা হলে সমস্যা নেই স্যান্ডেল দিয়ে থাবড়িয়ে ইজ্জত মেরে দিব!আমাকেও চিনে না! হঠাৎ কলিংবেল বেজে উঠলো। আমি একবার মেইন দরজার দিকে তাকিয়ে আবার টিভি অন করতে রিমোটে ক্লিক করলাম।
--আন্টি আসসালামুয়ালাইকুম, সবাই ভেতরে? সরি আন্টি আমার আসতে দেরি হয়ে গেল। হসপিটালে পেশেন্ট নিয়ে হেলা করতে পারিনি সরি, একটু লেট করে ফেললাম।
আমি মুগ্ধ ভাইয়ার কন্ঠ শুনে রিমোট ফেলে বাইরে দৌড়! দরজার পর্দা ধরে দাড়িয়ে আছি ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়েও তাকাচ্ছেননা। উনি আম্মুর সাথে সাফাই দিতে ব্যস্ত।
--মুগ্ধ চলো খেয়ে নেও, রাবেয়াকে সেই কখন থেকে তোমার আসার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছি!! বলার বাইরে!! আসো, আসো,
--আন্টি....কিছু কথা ছিলো, আর্জেন্ট
আমি পর্দা ছেড়ে আম্মুর পাশে গিয়ে দাড়ালাম। ভাইয়ার মুখে নকল হাসি। উনি কথা বলতে যেয়েও কথা বলতে হিমশিম খাচ্ছেন।
--আন্টি মমর পায়ে চোট লেগেছিলো না? ওই চোটটা একবার চেক করতে হসপিটালে নিতে হবে। ভেতরে কোনো ইনফেকশন হলো নাকি দেখার জন্য।
আমি মুগ্ধ ভাইয়া কথা শুনে এই বুঝি আকাশ থেকে ঠাস করে পড়লাম। আমার পা দিয়ে আমি নেচেহেলে দৌড়ে কাজ করছি আর উনি কিনা ইনফেকশন চেক করতে হসপিটালে নেবেন। আমি অবাকের চেয়েও বেশি অবাক হচ্ছিলাম উনার মিথ্যে কথা শুনে! আম্মু আমার পায়ের দিকে তাকিয়ে আমার মুখের দিকে তাকালেন। শান্ত গলায় বললেন-
--তোর কি পায়ে এখনো ব্যাথা করে?চুলকোয় কোনো?
আমি আম্মুর দিকে একবার তাকিয়ে মুগ্ধ ভাইয়ার দিকে করুন দৃষ্টিতে তাকালাম। উনি মিথ্যে বলার জন্য সায় দিচ্ছেন। ঠোট নাড়িয়ে একবার বললেন, 'প্লিজ সিনু'। আমি হালকা শ্বাস ছেড়ে আম্মুকে বললাম-
--হুম আম্মু, বুড়ো আঙ্গুলের মাথায় যন্ত্রণা করে। অনেক সময় বুড়ো আঙুল সোজা করতে পারিনা।
--তুই আগে বলবিনা? ব্যাথা চেপে বসে থাকলে যন্ত্রণা কমবে?.....মুগ্ধ নিয়ে যাও তো, দেখো কোনো ইনফেকশন হলো কিনা।। তুমি আগে খেয়ে যাও,তারপর নিয়ে যেও,
--না আন্টি, এখন না। এসে খাচ্ছি।
আমাকে চোখ ঘুরিয়ে সাথে আসতে বললেন মুগ্ধ ভাইয়া। আমি উনার পিছু পিছু বাইরে যেয়ে গাড়িতে উঠলাম। উনি ড্রাইভিং সিটে হেলান দিয়ে বসে আছেন। আমি কপালে ভাজ ফেলে রাগে কটমট করছি। আমাকে বাইরে নিয়ে যাওয়ার তাড়া উঠলো কেন? আমি কি চলে যাচ্ছি নাকি উধাও হচ্ছি!ঝাঝালো গলায় প্রশ্ন করলাম-
--আমি কি ল্যাংড়া! পা কি ঠিক নাই!ভেতরে সবাই কি ভাববে বলুন তো! নিজেকে ডক্টর বলে দাবি করেন অথচ হিতাহিত জ্ঞান টুকু নেই! কি হলো চুপ করে আছেন কেন! কথা বলার জবান নেই!
মুগ্ধ ভাইয়া আমার দিকে নিরব দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। চুলগুলো অগোছালো অবস্থা। স্বল্প গতিতে লালচে ঠোট দুটো কেপে কেপে উঠছে, শ্বাস ছাড়ছেন ঠোটজোড়ার সাহায্যে। উনি আমার কাছে এসে কিছুটা ঝুকে কপালে আলতো চুমু দিয়ে দিলেন। আমার সিটবেল্টটা বেধে উনি ঠিক করে বসে গাড়ি স্টার্ট দিলেন। ঠোটে ঠোট চেপে ড্রাইভ করছেন কিন্তু আমার প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন না। কিছুক্ষণ পর চাপা হাসির রেশ ফুটিয়ে বলে উঠলেন-
--স্যাক্রিফাইস করেছিস কখনো? ত্যাগস্বীকার? করেছিস?
--হ্যা কত করলাম, আবির ভাইয়ার জন্য রিমোটের কত ব্যাটারি বলিদান দিয়ে দিছি, জানা নেই।
উনি একটু হাসলেন। কিছুটা থেমে আবার বলে উঠলেন-
--তোকে দেখে আমার বিয়ে করতে মন চাচ্ছে, পাকনি!!লাল টুকটুকে খয়েরী শাড়ি পড়ুয়া ছোট্ট পাকনিটা আমার পাশে অপ্সরী সেজে বসে আছে!! তুই একটা রেড ভেলভেট কেক বুঝলি!! কাছে টেনে গপ করে খেয়ে....
--এই এই....চোখ নিচে! চোখ নিচে! তাকাবেননা একদম! লুইচ্চামি বন্ধ না করলে ধাক্কা মেরে বাইরে ফেলে দিব!
--ইশশ...কাবিননামায় আমার নামটা লিখার সুযোগ থাকলে গাল টেনে শেষ করতাম!!বায় গড!
--কি শুরু করছে আল্লাহ!! রক্ষা করো! এই কি বললেন? সুযোগ থাকলে মানে? কি বললেন এটা?
--ককই ননাতো...ককিছু বললিনি,
--আপনি একটু আগে 'সুযোগ থাকার' কথা বলেছেন! কথার মানে কি? বিয়ে করবেন না আমায়? আপনার নাম থাকবেনা?
আমার কথায় উনি মলিন হাসি দিলেন। যে হাসির ভাবার্থ আমি মিলাতে পারলাম না। উনি গাড়ির ব্রেক কষে অতঃপর আমার দিকে তাকালেন।
--বিয়ে হবে কি হবে না সেটা তো আল্লাহ জানেন রাইট? আমার নাম তোর পাশে থাকবি কিনা সেটাও উনার ভরসায় রেখে দে। ভাগ্যে থাকলে অবশ্যই তোর হবো।না হলে...... একটা ব্যাপার মাথায় রাখবি মম, মৃত্যু কখনো বলে কয়ে আসেনা। তাই আমি আজ আছি হয়তো কাল নেই....মরেও যেতে পারি, বাচার এবিলিটি নেই মেবি,