!!১৯!!
আস্তে আস্তে চোখ মেলে তাকালো মাহা। শূন্যে ভাসছে সে। মাথাটা ঝিমঝিম করছে তার। আশপাশে অন্ধকার। তড়িৎ গতিতে চোখ বন্ধ করে আবার খুললো সে। সে কারো কোলে! মস্তিষ্ক সচল হচ্ছে তার। এতক্ষণ তাহলে যা দেখেছিলো সব স্বপ্ন ছিল। সরু রাস্তা, চৈতি, ট্রেন, ভূট্টা ওয়ালা, হাওয়াই মিঠাই ওয়ালা, শসা বিক্রেতা, ছোট বাচ্চাটা সব স্বপ্ন ছিল! তাহলে এতটা বাস্তব লাগলো কেন!
"আমরা কোথায়?"
অনেক কষ্টে কম্পিত ঠোঁট জোড়া দিয়ে প্রশ্নটা করে মাহা। সার্থক তাকে কোলে নিয়ে একটা বৃহৎ গাছের পিছনে লুকিয়ে আছে। চতুর্দিকে আঁধার। তখন হঠাৎ করেই মেয়েটাকে অজ্ঞান হতে দেখে ভরকে যায় সার্থক। দূর থেকে শুকনো পাতা আর ডাল-পালার শব্দ শুনেই বুঝতে পারে কেউ হয়তো আসছে এদিকটায়। আবারো মেয়েটাকে কোলে তুলে এলোমেলোভাবে জঙ্গলের আরো গহীনে প্রবেশ করে সে।
"কি হলো বলুন?"
"চুপ। কথা না। আশেপাশে মানুষ আছে।"
ভয়ে আবারো সিটিয়ে গেলো মাহা। একেবারে লেপ্টে গেলো সার্থকের বুকের মাঝে। হঠাৎ মনে হচ্ছে তার শীত লাগছেনা কেন! অতঃপর ভালোভাবে তাকিয়ে দেখে তার গায়ে ফায়রাজ সার্থক নামক ছেলেটার কালো হুডিটা। আর ছেলেটার গায়ে পাতলা একটা টি-শার্ট! অনেকটাই অবাক হয়েছে মাহা। মাহার শীত দূর করতে তবে কি ফায়রাজ সার্থক নামক ছেলেটা এই হাড়কাঁপানো শীতের রাতে নিজের হুডি খুলে দিয়ে দিয়েছে! হঠাৎ কান্না পেলো মাহার। বরফ শীতল কপোলের উপর চোখের উষ্ণ ধারা প্রবাহিত হচ্ছে অনবরত। নিজেকে দমাতে পারছেনা মাহা। মা মারা যাওয়ার পর এতটা কখনো তাকে নিয়ে কেউ ভাবেনি। রুমানা আর চৈতিও না!
মাহার হঠাৎ ফুঁপিয়ে উঠার শব্দে তার মুখে দিকে তাকালো সার্থক। এই তো কিছুক্ষণ আগে যখন সে এলোমেলো পথ পাড়ি দিচ্ছিলো তখনই দেখে মেয়েটা তার কোলে ঠকঠক করে কাঁপছে। আর কিসব যেন বিড়বিড় করে বলছে। নিজেকে থামিয়ে সেখানে বসে কালো হুডিটা খুলে মেয়েটার গাঁয়ে পরিয়ে দিলো সার্থক। যদিও মেয়েটার গাঁয়ে হুডিটা অনেক বড় হয়েছে। অহংকারী, কুঁকড়া চুলের, হলদে ফর্সা শরীরে তার বৃহৎ হুডিটা কল্পনা করেই হাসি পেলো সার্থকের। যদিও সময়টা হাসির নয়। অতঃপর আবার পায়ের শব্দে এই বড় গাছটার পিছনে আশ্রয় নিয়েছে সে। ডাকাতের দল তো এতদূর আসার কথা না! তাহলে কি এটা জঙ্গলে বসবাসরত আদি বাসিন্দাদের পায়ের আওয়াজ! মেয়েটা এত কাঁদছে কেন!
"প্লিজ। একটু চুপ করো।"
সম্বোধনটা আপনি থেকে কখন যেন তুমিতে চলে গিয়েছে। অবশ্য সার্থকেরও দোষ নেই। মেয়েটা তার থেকে বয়সে অনেক ছোটই হবে।
"আরে! তুমি এমন ভাবে কান্না করছো কেন! আজ রাতটুকু একটু কষ্ট করো। আমি আছি তো!"
সার্থক জানেনা সে এই কথাটা কেন বললো। বলতে ইচ্ছে করেছে তাই বলেছে। মনে কথা চাপিয়ে রাখতে সে পারেনা।
"আমি আছি তো!"
বাক্যটা শুনে নিজের অজান্তেই কান্না থেমেছে মাহার। চেনা নেই, জানা নেই ট্রেনে দু'ঘন্টার জার্নিও তারা একসাথে করেনি। ঝাঁকড়া চুলের, ফর্সা ছেলেটা। অদ্ভুত কালো চোখের মণিওয়ালা ছেলেটা বলছে,
"আমি আছি তো!"
কই বাবাতো কোনোদিন মা মারা যাওয়ার পর বলেনি, "আমি আছি তো!"
"বাবা!" শব্দটা উচ্চারণ করেই মাহার মনে পড়লো সে তো বাবার জন্য ঢাকা ফিরে যাচ্ছিলো। মাহিন, তার সৎ ভাই ফোন দিয়ে বলেছিল বাবা হসপিটালে! কেমন আছেন বাবা? সার্থকের বুকে লেপ্টে কথাগুলো ভাবছিলো মাহা। সার্থকের চোখ, কান তখন ঘুরাঘুরি করছে আশেপাশে।
!!২০!!
পশ্চিমদিক আর উত্তর কোনের দিকে খসখস আওয়াজ হচ্ছে। এটা কোনো প্রাণীর আওয়াজ নয়। মানুষের পায়ের আওয়াজ।
"আপনি আমাকে নামিয়ে দিন। আমি হাঁটতে পারবো। আমার এভাবে ভালো লাগছেনা।"
মেয়েটা এত কথা বলে কেন। জীবন মরণের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়েও আজাইরা কথা না বললে মেয়েজাতের হয়না!
"চুপ! আর একটা কথা না।"
"আজব তো! এভাবে কথা বলছেন কেন আপনি!"
"এই মেয়ে চুপ। দয়াকরে চিৎকার করোনা। আশেপাশে কয়েকজন আছে। যারা আমাদের উপস্থিতি টের পেয়েছে। ধরতে পারলে চিবিয়ে খাবে। তুমি কারো খাবার হতে চাও, মেয়ে?"
এহেন কথাবার্তায় থতমত খেলো মাহা। চিবিয়ে খাবে মানে কি! সে কি খাবার বস্তু নাকি যে চিবিয়ে খাবে। অন্ধকারে মুচকি হাসলো সার্থক। মেয়েটা তো অনেক ভীতু। ভয়ে আবারো লেপ্টে গেলো তার বুকের সাথে। হঠাৎ পিঠে একটা দাঁড়ালো কিছু ঠেকলো সার্থকের। তড়িৎ গতিতে উঠে দাঁড়ালো সে। দৌড় দিতে পারলোনা। আশপাশ ঘিরে ফেলেছে হারিকেন হাতে কয়েকজন মানুষ। সবার হাতে বর্শা। এত স্ট্রেস নিতে না পেরে আবারো জ্ঞান হারায় মাহা। সার্থক স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আস্তে আস্তে আলোয় সয়ে আসছে তার চোখ। না, এদের দেখে তো আদিবাসী মনে হচ্ছেনা। এদের সবার পরনে সাদা লুঙ্গি হাঁটু পর্যন্ত, সাদা ফতুয়া আর কোমড়ে, মাথায় গামছা বাঁধা। কিছুক্ষণ নিরবতা চললো। তাদের মধ্য থেকে একজন লোক এগিয়ে আসলেন। শুদ্ধ ভাঙা ভাঙা বাংলায় বললেন,
"আপনারা কি হারিয়ে গেছেন বাবু?"
বাংলা শুনবে আশা করেনি সার্থক। নিজেকে সামলে উত্তর দিলো,
"জ্বি।"
"আমি কানু। সাঁওতাল উপজাতি। আমরা সবাই রাতে জঙ্গল পাহাড়া দেই। পাশেই আমাদের গ্রাম।"
ভরসা খুঁজে পেলো সার্থক। যদি আজ রাতটা কোনোভাবে কাটানো যেতো।
"আমাদের আজ রাতটুকু আশ্রয় দিতে পারবেন?"
কনু হঠাৎ করেই কিছু বললোনা। তাদের ভাষায় কিছু পরামর্শ করে নিলো।
"আপনারা কি স্বামী-স্ত্রী আছেন?"
"হ্যাঁ।"
মিথ্যা বললো সার্থক। এছাড়া আর কোনো উপায় নেই। মেয়েটা বারেবারে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে। একটু পানি পান করানো প্রয়োজন। তাছাড়া রাত এখনো অনেক বাকি। সারারাতে নির্ঘাত মেয়েটার জ্বর চলে আসবে।
"আপনারা কি মুসলমান বাবু?"
"জ্বি, আমরা মুসলমান।"
"ঠিক আছে। চলুন বাবু। কিছুদূর হাঁটলেই আমাদের গ্রাম। আপনার বিবির কি হয়েছে?"
"আসলে ও একটু ভয় পেয়েছে।"
সাঁওতাল উপজাতিদের সাথে মাহাকে কোলে নিয়ে যাচ্ছে সার্থক। হারিকেনের হালকা আলোয় আলোকিত হয়েছে চারপাশ। বিশাল বড় বড় গাছপালা। কত প্যাঁচানো ডালপালা! মাটিতে জমেছে শীতকালীন শুকনো পাতার দল। তাদের উপর লেপ্টে আছে শীতের শিশির ফোঁটা। এক-দুটো বাদুড় ঝুলছে কয়েকটা গাছে। হঠাৎ মাহার মুখের দিকে তাকিয়ে হৃদপিণ্ডের একটা স্পন্দন মিস করলো ডক্টর ফায়রাজ সার্থক। হারিকেনের আলোয় অভূতপূর্ব লাগছে মেয়েটাকে। হালকা ঠোঁট জোড়া কাঁপিয়ে কি যেন উচ্চারণ করছে মেয়েটা। অনেক পাতলা মেয়েটা। কিছু কি খায়না নাকি। একেবারে তুলোর মতো। এতক্ষণ যাবৎ কোলে নিয়ে রেখেছে সার্থক তার একটুও কষ্ট হচ্ছেনা। একটুও না।
!!২১!!
অবশেষে জঙ্গল পেরিয়ে লোকালয়ের দেখা মিললো। পাহাড়ি উপত্যকায় ছোট জনপদ। মাটির ছোট ছোট ঘর। প্রত্যেক ঘরের সামনে মশাল জ্বলছে। সামনে মাঝারি আকৃতির একটা মাঠ।
"আমরা ঠিক কোথায় যাচ্ছি?"
কানুকে প্রশ্ন করে সার্থক।
"আমাদের প্রধানের কাছে, বাবু। তিনি অনুমতি না দিলে আমরা আপনাদের জায়গা দিতে পারবোনা।"
অন্যান্য মাটির ঘর থেকে এই ঘরটা তুলনামূলক বড়। চারপাশে কলাপাতার বেড়া দেওয়া। সুন্দর, ছিমছাম, পরিষ্কার বাড়ি। সাঁওতালরা পরিষ্কার জাতি বলে জানতো সার্থক। তারা পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন থাকতে পছন্দ করে। আজ নিজ চোখে দেখেও নিলো। ছয়জনের একটা দল কানুরা। বাড়ির সামনে দাঁড়িয়েই হাঁক ছাড়লো কানু। সার্থকও তাদের সাথে দাঁড়িয়ে। ধুতি, ফতুয়া পরনে বেরিয়ে এলেন এক বৃদ্ধ ব্যাক্তি। ঘরের দুপাশে বড় বড় মশাল জ্বলছে। সার্থক খেয়াল করলো সাঁওতাল পুরুষ সকলের হাতেই উল্কার ছাপ।
বৃদ্ধ এসে এক নজর তাকালেন তার দিকে। অতঃপর নিজেদের ভাষায় কানুর সাথে কথা চালালেন। তাদের ভাষার নাম সান্তালী ভাষা। অস্ট্রো-এশীয় ভাষা পরিবারের অন্তর্গত মুন্ডা উপপরিবারের একটি ভাষা, এবং হো এবং মুন্ডারি ভাষার সঙ্গে সম্পর্কিত। তাদের বসতে দেওয়া হলো বাঁশের তৈরি মাচায়। এত এত পুরুষের মাঝে মাহাকে রাখতে ভালোলাগছেনা সার্থকের। সবাই কেমন করে তাকিয়ে আছে। একটা চিনচিনে রাগে মাথার একদিকটা ব্যথা করছে তার। হুডির ক্যাপটা মাহার মাথায় তুলে দিলো সে। যতটা আড়াল করা যায়। সে বসেছে ডানপাশে। বামপাশে বসেছে কানুদের দলের সবাই। মাঝে একটা রাজকীয় মেহগনি কাঠের চেয়ারে বসেছেন সাঁওতাল প্রধান।
কানু দাঁড়িয়ে বললো,
"বাবু, উনি হলেন আমাদের প্রধান। জগত মুর্মু।"
অনিচ্ছা সত্ত্বেও হেসে বৃদ্ধের দিকে তাকালো সার্থক। এত নাটকের কি আছে শীতের রাতে। এতগুলো ঘর আছে এখানে। একটা রাতের জন্য একটা ঘর দিলে কি এমন হয়ে যাবে! বিরক্ত লাগছে তার। মেয়েটা কি ঘুমিয়ে গেলো না অজ্ঞান হলো আল্লাহই জানেন।
জগত মুর্মু সান্তালী ভাষায় কি যেন বললেন কনুকে। কানু মুখটা কাঁচুমাচু করে বললো,
"বাবু, আপনারা কি সত্যিই স্বামী-স্ত্রী?"
"জ্বী।"
একবার তো বললোই। বারবার বলার কি প্রয়োজন। অদ্ভুত লোকজন। আবারো সবার মাঝে নিজেদের ভাষায় কথোপকথন চললো।
"বাবু, আপনারা যে স্বামী-স্ত্রী তার প্রমাণ আছে কি?"
"আজব তো! আমরা কি কাবিননামা নিয়ে ঘুরবো নাকি!"
রেগে গেলো সার্থক। এখানে আসাটাই উচিত হয়নি। এসব পরীক্ষার চেয়ে ভালো ছিলো জঙ্গলে রাত কাটানো।
"দয়াকরে রাগবেন না, বাবু। এমন অনেক মানুষই আছেন যারা বাড়ি থেকে পালিয়ে আসে। আমরা তো না জেনে আপনাদের জায়গা দিতে পারিনা। আপনারা স্বামী-স্ত্রী নাও তো হতে পারেন।"
এসব কোলাহলে জেগে উঠলো মাহা। চোখ খুলে আলোর তীক্ষ্ণতায় আবার চোখ বন্ধ করে ফেললো সে। আস্তে আস্তে আবার চোখ মেললো। সার্থক কারো সাথে, না না কাদের সাথে ঝগড়া করছে। আশেপাশে তাকিয়ে আরো অবাক হয়ে গেলো মাহা। এটা তো জঙ্গল না লোকালয়!
"দেখেন বাবু। আপনারা তো বিবাহিত তাহলে আবার বিয়ে করতে নিশ্চয়ই কোনো সমস্যা নেই?"
"বিয়ের প্রশ্ন আসছে কেন? আমার কথা কি বিশ্বাস হয়না আপনাদের?"
"বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের কথা না বাবু। আমরা আপনাদের চিনিনা। এভাবে আপনাদের রাত কাটাতে দিলে আমাদের দেবতা রুষ্ট হবেন।"
"তাহলে আমাদের কি করতে হবে এখন?"
"আমাদের এখানে একজন হুজুর আছেন। আমাদের জাতির নয়। আমাদের সাথেই থাকেন। তিনি এসে আপনাদের বিয়ে পড়াবেন।"
সার্থক হা করে কথাগুলো গিললো। এতটা ফ্যাসাদে সে কখনো পড়েনি। স্তম্ভিত হয়ে কেবল একটা শব্দই শুনলো মাহা। "বিয়ে!"
শব্দটা মৌমাছির ডাকের মতো কানের চারপাশে বাজছে তার। সে ছটফট করছে নামার জন্য। বিয়ে মানে! সে কেনো অজানা, অচেনা কাউকে বিয়ে করবে!
.
.
.
চলবে.............................