যদি তুমি জানতে - পর্ব ১৯ - ইসরাত জাহান তানজিলা - ধারাবাহিক গল্প


সাহেলা বেগম আর আজিজ চৌধুরী বাসায় ফিরে গেলো। বাসায় গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লো সাহেলা বেগম। নিঃসন্তান সাহেলা বেগমের কান্নায় সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পেলো না আজিজ চৌধুরী। সাহেলা বেগমের কান্না দেখে তুরানের উপর আজিজ চৌধুরীর আক্রোশ বাড়ছে ক্রমশ। মনে হচ্ছে সব কিছু্র জন্য তুরানই দায়ী। 
আজিজ চৌধুরী সাহেলা বেগমের পাশে বসে রইলো চুপচাপ। অনেকক্ষণ পর কান্না থামিয়ে সাহেলা বেগম বললো,
-'অনেক রাত হয়েছে খেয়ে নেও তুমি।'
আজিজ চৌধুরী নড়েচড়ে বসে বললো,
-'তুমি খাবে না?'
-'উঁহু।'
আজিজ চৌধুরী উদাস হয়ে বসে রইলো। সন্তান না থাকার ব্যাথা অনুভব করছে নতুন করে। সাহেলা বেগমের কান্নায় সন্তান না থাকার ব্যাথা জড়িয়ে রয়েছে।
আজিজ চৌধুরী নিচু গলায় বললো,
-'আমাদের সন্তান নেই বলেই হয়ত রুপা কে শাসন করতে পারি নি ঠিক ভাবে। কোনটা সঠিক কোন সঠিক নয় সে জ্ঞান ও বোধ হয় রপ্ত করতে পারিনি এব্যাপারে।'
আজিজ চৌধুরী কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বললো,
-' মন খারাপ করে কেঁদে কি হবে বলো? রুপা অন্যের মেয়ে । আজ হোক কাল হোক আমাদের ছেড়ে চলেই যেত। আমাদেরও ফল্ট ছিলো কিছু্। ও প্রায়ই তুরানের কথা বলতো আমরা সেভাবে কেয়ার করতাম না। ওর জন্য কাঁদা নিছক বোকামি ছাড়া কিছু না।'
সাহেলা বেগম কান্না থামিয়ে আজিজ চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে রইল। আজিজ চৌধুরী চিন্তা ভাবনা গুলো সবই বাস্তবিক। সংসার জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে সাহেলা বেগম আজ বুঝতে পারলো আজিজ চৌধুরী সব সময়ই সঠিক এবং তার চিন্তা ভাবনা গুলোও। যে কোন বিষয়ে আজিজ চৌধুরী যখন যা বলেছে আজ হোক কাল হোক তাই হয়েছে। 
সাহেলা বেগম কে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে আজিজ চৌধুরী বললো,
-'কি হলো তাকিয়ে রয়েছো কেন? কি ভাবছো?'
সাহেলা বেগম বললো,
-'কিছু না। আচ্ছা তুমি সব কিছু সঠিক ভাবো কিভাবে সব সময়?'
আজিজ চৌধুরী ফিকে হেসে বললো,
-'আমি জীবনের একটা খারাপ সময় পার করেছি। তাই আমার চিন্তা গুলো বাস্তবিক,আবেগের ঠাঁই নেই। কিন্তু তুমি তো খারাপ সময় পার করো নি। তাই ছোট ছোট বিষয় গুলো নিয়েও ইমোশনাল হয়ে যাও। যা হওয়ার তা আজ হোক কাল হোক হবেই। সেটা মেনেই আমাদের জীবন চালাতে হবে। আচ্ছা তোমার কি মনে হয় রুপার জন্য আমার খারাপ লাগছে না? রুপা এত লম্বা সময় আমাদের কাছে ছিলো!'
আজিজ চৌধুরী দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে আবার বললো,
-' রুপার জন্য আমারও কষ্ট হচ্ছে কিন্তু প্রকাশ করছি না। কষ্ট প্রকাশ করতে আমার ভালোলাগে না । কারন কষ্ট প্রকাশ করলেই কষ্ট গুলো তীব্র হয়ে যায়, প্রখর হয়ে যায়। যা আরো যন্ত্রণাময়। শুয়ে পড়ো তুমি অনেক রাত হয়েছে।'
সাহেলা বেগম নির্লিপ্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
-'খাবেনা তুমি?'
-'উঁহু!'
সাহেলা বেগম শুয়ে পড়লো। আজিজ চৌধুরী ডাইনিং রুমে গিয়ে এক গ্লাস পানি খেলো। তারপর কিছুক্ষণ বারান্দায় পাঁয়তারা করলো। কেন জানি অস্থির লাগছে খুব। রাত গভীর হতে লাগলো। ব্যস্তময় শহরের ব্যস্ততা কমতে লাগলো। আজিজ চৌধুরী বারান্দায় দাঁড়িয়ে চারপাশ টা দেখছে। কিছুক্ষণ পরে রুমে এসে দেখলো সাহেলা বেগমের শরীর কাঁপছে। কান্নায় থামানোর চেষ্টা করছে তাই হয়তো শরীর কাঁপছে। আজিজ চৌধুরী বললো,
-'এখনো ঘুমাও নি?'
-'উঁহু।'
আজিজ চৌধুরী লাইট অফ করে শুয়ে পড়লো। শরীর বড্ডো ক্লান্ত লাগছে আজিজ চৌধুরীর। বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুমিয়ে গেলো। 
.
গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেলো রুপার। চারদিকের সুনসান নীরবতায় রুপা বুঝতে পারলো গভীর রাত এখন। চোখ খুলে তাকিয়ে দেখলো অন্ধকার, চোখ বুঁজলেও অন্ধকার। এত অন্ধকারের ভিতরও জায়গা টা অপরিচিত মনে হতে লাগলো রুপার । যেন এই অন্ধকার গুলোই অপরিচিত। রুপার হঠাৎ মনে হতে লাগলো হসপিটালের কথা, সাহেলা বেগম আর আজিজ চৌধুরীর কথা। রুপা বুঝতে পারলো না কোথায় আছে ও? রুপা বেড সাইডে হাত দিলো লাইট অন করার জন্য। কিন্তু সুইচ কিছু পেলো না। রুপার ভয় করতে শুরু করলো। কিছুতেই বুঝতে পারলো না কোথায় আছেও? চারদিকে ভালো করে তাকাতে লাগলো। অন্ধকার ছাড়া কোথায়ও কিছু নেই। এক ফালি আলোও কোথায়ও নেই। রুপা চিৎকার করতে শুরু করলো। রুপার ভয় ক্রমশ বাড়তে লাগলো। নিজেকে খুব বেশি অসহায় মনে হচ্ছে। তুরানের কথা ভাবতেই রুপার কষ্ট গুলো আরো প্রখর হতে লাগলো। রুপা গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিতে লাগলো। কোথায়ও কারো সাড়া পাওয়া গেলো না। এমন তো কখনো হয়নি। যতই রাত হোক রুপা চিৎকার করলেই মূহুর্তের মধ্যেই ছুটে আসতো সাহেলা বেগম। তবে কি সাহেলা বেগম সত্যিই রুপা কে ওঁদের সাথে দিয়ে দিলো? এতটা স্বার্থপর সাহেলা বেগম! তুরানের সাথে কতদিন দেখা হয়না। রুপার মন শূন্যতায় ছেয়ে যাচ্ছে। কিভাবেই দেখা হবে তুরানের সাথে? কোথায় খুঁজে পাবে তু্রান কে? তুরান কি খুঁজছে না রুপা কে? হাজার প্রশ্ন রুপার মাথায় ঘোরপাক খেতে লাগলো। এমন অন্ধকারে দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগলো রুপার। তুরানের নাম ধরে চিৎকার করতে লাগলো। রুপা বুঝতে পারছে না এখানে কি কোন মানুষ নেই? থাকলে ছুটে আসছে না কেন রুপার ডাকে? সাহেলা বেগমে কোথায় রেখে গেলো রুপা কে? তুরান ছুটে আসছে না কেন রুপার ডাকে? রুপার বড্ড অভিমান হতে লাগলো। এত জ্বর ছিলো রুপার গায়ে,এত অসুস্থ ছিলো রুপা। তুরান কেন একবারও দেখতে আসলো না? 
রুপার অসহ্য রকমের কষ্ট হচ্ছে এই ঘন অন্ধকারে। ভয়ে , কষ্টে, একাকিত্বে বিলীন হয়ে যেতে লাগলো রুপা। অসহায়ত্ব গ্রাস করতে লাগলো রুপা কে। রুপা নিজের মাথায় আঘাত করতে লাগলো। মরে যেতে ইচ্ছে করছে রুপার। অন্ধকারে আন্দাজ করে পা ফেলে খাট থেকে নামলো রুপা। অন্ধ মানুষের মত অনুমান করে পা বাড়ালো রুমের দিকে। শেষে দেয়ালের সাথে এসে ঠেকলো। রুপা হাত দিয়ে খুঁজতে লাগলো কোন দরজা জানালা আছে কিনা। রুপা জানালা খুঁজে পেলো, জানালা টা আটকানো। রুপা খুলতে চেষ্টা করলো। কিন্তু পারলো না, জানালা টা খুব শক্ত করে লাগানো। যেন অনেকদিন ধরে আটকানো জানালা, তাই বোধ হয় খুলতে পারছে না। অনেক কষ্ট করে জানালা টা খুললো রুপা। জানালা খুলতেই এক ফালি আলো এসে পড়লো রুমে। আবছা আলোতে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে রুমটা দেখতে লাগলো রুপা। 
রুপা একদম অপরিচিত। আগে বোধ হয় কখনো দেখে নি হয়ত বা দেখছে। রুপা রুমের দরজাটাও খুললো তারপর লাইট অন করলো। পা টিপে টিপে রুম থেকে বের হলো। রুপা যে রুমে ছিলো সে রুমের পাশেই আরেকটা রুম ,রুপা জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখলো রুমের ভিতর। কিন্তু রুমে কোন মানুষ আছে কিনা স্পষ্ট বুঝা গেলো না। রুপা এ পর্যায়ে বুঝতে পারলো সাহেলা বেগম রুপা কে রুপার বাবা-মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে। এই বাসায় আরো কয়েকবার রুপা কে জোর করে এনেছিলো তারা। সেজন্যই জায়গাটা এখন কিছুটা পরিচিত মনে হলো রুপার। কিন্তু অন্ধকারে সবটা অপরিচিত মনে হয়েছিল।
রুপা ফ্লোরে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। সাহেলা বেগম কেন করলো এমনটা? তুরান কে ছাড়া থাকা কোন কিছুতেই সম্ভব না। 


একটা নির্ঘুম রাত পার করলো রুপা। ফ্লোরেই শুয়ে রইলো এলোমেলো ভাবে। তুরানের কথা ভাবতেই কেঁপে উঠছে রুপা। তুরান কে ছাড়া কিছুতেই থাকা সম্ভব না.. কিছুতেই না। 
সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে পূজা রায় রুপার রুমে যায়। রুপার এমন বেহাল অবস্থা দেখে বিগড়ে যায়। হাঁটু গেড়ে রুমের পাশে বসে। কি হলো রুপার কিছুই বুঝতে পারছে না। পূজা রায়ের চিৎকার, চেঁচামেচি শুনে রুপার বাবাও রুপার রুমে আসে । ভয়ার্ত কন্ঠে বললো,
-'কত করে বললাম আমরা দুজন সারারাত ওর পাশে বসে থাকি তুমি শুনলে না।'
-'আমি কি বুঝতে পেরেছি ও এমন করবে? নিশ্চয় চিৎকার করেছে খুব।'
রুপার বাবা চিন্তিত মুখে বললো,
-'আমরা তো চিৎকার শুনলাম না। ওর অবস্থা কিছুই বুঝতে পারছি না, তার চেয়ে বরং সাহেলা কে কিছুদিন এখানে থাকতে বলো।'
পূজা রায় নিঃশব্দে কাঁদছে। রুপা কে ফ্লোর থেকে তুলে খাটে শুইয়ে দিলো। রুপার মাথার পাশে বসে রুপার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। তারপর আর্তনাদ করে বললো,
-'আমার মেয়েটা কি কখনো স্বাভাবিক হবে না? কেমন হয়ে গেছে আমার শতরুপা! একদম অপরিচিত,একদম অচেনা।'
রুপার বাবা রাজীব রায়ের চোখও ছলছল করছে। পূজা রায়কে সান্ত্বনা দিয়ে বললো,
-'কেঁদে আর কি হবে? কতই তো কেঁদেছি।'
পূজা রায়ের কান্নার শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো রুপা। মাথা প্রচুর ব্যাথা করছে, চোখ ফুলে আছে রুপার। শোয়া থেকে উঠে বললো রুপা। পূজা রায়ের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। কেন কাঁদছে এই মানুষটা কে জানে? 
-'আমি সাহেলা আম্মুর বাসায় যাবো। কেন এনেছো আমায় এখানে? বলেছিনা আমার এখানে অসহ্য লাগে।'
পূজা রায়ের কান্না আরো বেড়ে গেলো। রাজীব রায় মেয়েকে নরম গলায় বুঝিয়ে বললো,
-'দেখো আম্মু তোমার এখান থেকে এখানেই থাকতে হবে। আমরা কি তোমায় ভালোবাসি না? আর বকবো না তুমি যা ইচ্ছে করবে, যত ইচ্ছে ভাঙচুর করবে। ইচ্ছে হলে পুরো বাসায় আগুন ধরিয়ে দেও, অন্তিম কে যত ইচ্ছে মারো। তবুও একটুও বকবো না।'
রুপা জোর গলায় বললো,
-'এখানে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব না বুঝতেছো না কেন তোমরা? আমি এক্ষুনি যাবো ওই বাসায়।‌ যদি বাধা দেওয়ার চেষ্টা করো খারাপ হবে, মরে যাবো আমি একদম।'
রুপার পাগলামির কাছে অবশেষে হার মানলো রুপার বাবা-মা। রুপার বাবা রুপার মা'কে ডেকে রুমের বাইরে নিয়ে বললো,
-'ও যখন যেতে চাচ্ছে যাক। আবার বুঝিয়ে নিয়ে আসবো। ওর সাথে জোর করে কি কিছু হবে বলো?'
রুপার মা রুপার বাবার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকায়। খানিক বাদে তাঁরা রুপা কে নিয়ে রওয়ানা হয় সাহেলা বেগমের বাসার উদ্দেশ্যে। রুপা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। সাহেলা বেগমের বাসায় গেলেই তুরানের সাথে দেখা হবে ভাবতেই প্রশান্তি অনুভব করে রুপা। রুপার সব অসহায়ত্ব সব কষ্ট , মূর্ছনা যেন নিমিষেই মুছে গেলো। রুপা এক রাশ প্রশান্তির সহিত নিঃশ্বাস ফেলছে। ইস! কতদিন দেখছে না তুরান কে। তুরান টাও বড্ডো স্বার্থপর! এতদিনে কিভাবে থাকলো রুপা কে ছেড়ে? ভাবতেই অভিমানে ভরে উঠে রুপার মন।
.
তুরানের বাবা-মা গ্রামের বাড়ি চলে যাচ্ছে। তুরান তাঁদের কে এগিয়ে দিতে বাসস্ট্যান্ডে যাচ্ছে। তুরানের বাবা-মা তেমন কথা বলছে না তুরানের সাথে। নিজেকে খুব বেশি অপরাধী মনে হচ্ছে তুরানের। অন্যদিকে রুপার কথা ভাবতেই তুরানের বুকের ভিতর কেঁপে উঠে। কবে ভাত খেয়েছে তা ভুলে গেছে তুরান! কবে ঘুমিয়েছে তাও মনে নেই। যে করেই হোক রুপা কে খুঁজে বের করবে। আবার যাবে সাহেলা বেগমের বাসায়। যে মানুষ টার সাথে প্রতি মিনিটে মিনিটে দেখা হতো সে মানুষ টার সাথে একবার দেখা করার জন্য আজ কত প্রচেষ্টা। যে মানুষ টা সব সময় চোখের সামনে সামনে থাকতো আজ সে মানুষ টা কে হাজারো খুঁজে পাচ্ছে না। তুরান যেন কষ্টে পাথর হয়ে যাচ্ছে! কষ্টের বহিঃপ্রকাশও করতে পারছে না। কি যে নিদারুণ কষ্ট, যন্ত্রণা বয়ে বেড়াচ্ছে প্রতিনিয়ত তা কে জানে? কে বোঝে?
তুরান তুরানের বাবা-মা কে বাসে বসিয়ে দিলো। বাস ছাড়তে এখনো আধা ঘন্টা দেরী। তুরান বাবা-মায়ের চোখে চোখ রাখতে পারছে না কিছুতেই। অপরাধ বোধ, সংকোচ, দ্বিধা কাজ করছে খুব।
তুরানের মা ক্ষীণ গলায় বললো,
-'তুইও চল আমাদের সাথে গ্রামে। কয়েকদিন থেকে আসবি।'
প্রত্যুত্তরে তুরান একটু ফিকে হাসলো। তুরানের বাবা ছলছল চোখে বললো,
-' বাপ যা করিস ভেবে চিন্তে করিস। শুধু মনে রাখিস পুরো পরিবার টা তোর দিকে তাকিয়ে আছে। তুই সবার আশা, ভরসা। যা হওয়ার হয়েছে তবে এমন কিছু করিস না যাতে আমাদের আরও কষ্ট পেতে হয়।'
তুরানের বাবা আর কিছুই বললো না । বাস ছাড়ার সময় হয়ে গেছে। তুরান দাঁড়িয়ে আছে এক পাশে। জানালার ফাঁক দিয়ে তুরানের মা তু্রানের দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে রইল। তুরান অপরাধীর ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইলো । বাস আপন গতিতে চলতে শুরু করলো। তুরান এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল যতক্ষন বাস দেখা গেছে। অনেকক্ষণ উদাস ভাবে তাকিয়ে থেকে হাঁটতে শুরু করলো তুরান। 
.
রুপার বাবা-মা আর রুপা কে দেখে অবাক হয়ে গেছে সাহেলা বেগম। রুপা শুধু তুরানের রুমের দিকে তাকাচ্ছে। ছটফট করত লাগলো রুপা। সাহেলা বেগম রুপার বাবা-মা কে দেখে আজিজ চৌধুরী কে ডাক দিলো। আজিজ চৌধুরী ও তাঁদের দেখে অবাক হয়ে গেলো। পূজা রায় সব কিছু বললো সাহেলা বেগমের কাছে । সাহেলা বেগম নিরাশ হয়ে বললো,
-'কি করবি তো এখন?'
পূজা রায় দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
-'জানি না। তুই একটু রুপা কে বুঝিয়ে বল। আর আমরা সামনের মাসেই রুপা কে নিয়ে দেশের বাইরে চলে যাবো। প্রনয়ও আসবে।'
সাহেলা বেগম খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে রুপার কেন এই বাসার প্রতি এত টান। সাহেলা বেগম কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
-'রুপা কই গেলো?'
তুরানের রুমের দরজায় তালা ঝুলানো দেখে নিরাশ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো রুপা। তুরান কি ভার্সিটি তে গেলো? রুপার চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগলো। কতদিন দেখা হয় না তুরানের সাথে। তু্রান কি একটু খোঁজও করে নি রুপার?
রুপা কে না দেখে বারান্দায় এসে সাহেলা বেগম দেখলো তুরানের রুমের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদছে রুপা। সাহেলা বেগম যা সন্দেহ করেছিলো রুপা কে না দেখে তাই হলো।
সাহেলা বেগম রুপা কে ডাক দিলো। রুপা হকচকিয়ে উঠে চোখ মুছে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে বললো,
-'আসছি।'
রুপা দ্রুত পায়ে সাহেলা বেগমের কাছে গেলো। রুপার বাবা-মা আর আজিজ চৌধুরী সোফায় বসে কথা বলছে। রুপা কে নিয়ে সাহেলা বেগমও সেখানে আসলো। রুপা সাহেলা বেগম কে উদ্দেশ্য করে বললো,
-'তুরান কোথায় গেছে আম্মু? উনাকে যে দেখছি না?'
সাহেলা বেগম হেসে বললো,
-'তুরান বাসা ছেড়ে দিয়েছে। বিয়া করেছে তো! শ্বশুর বাড়ি থেকে ফ্ল্যাট দিয়েছে সেখানে থাকে।'
রুপার মাথায় যেন বাজ পড়লো। কি বলছে সাহেলা বেগম এসব? রুপা পাগলের মত চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো, বিলাপ করতে লাগলো। রুপার বাবা-মা বুঝতে পারলো না রুপা কেন এমন করছে। সোফার কাছে থাকা ফুলদানিটা দিয়ে নিজের শরীরে আঘাত করে রুপা। তারপর ফ্লোরে ঢলে পড়ে।
রুপার শরীর থেকে রক্ত ঝড়ছে। রুপার মা চিৎকার করে গিয়ে রুপা কে জড়িয়ে ধরে। রুপার বাবা থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। 
আজিজ চৌধুরী চাপা কন্ঠে সাহেলা বেগম কে বললো,
-'কি নন সেন্স এর মত কাজ করলা তুমি? কি সব বললা ওকে!'
সাহেলা বেগম ক্ষীণ শ্বাস ফেলে বললো,
-'এছাড়া কি বলতাম?'
রুপার বাবা রুপা কে ফ্লোর থেকে তুলে নিয়ে খাটে শুইয়ে দিলো। কি কারনে রুপা হঠাৎ এমন করলো কিছুই বুঝতে পারছে না তাঁরা। এখন ওসব বুঝার চেষ্টাও করছে না। 
রুপার জ্ঞান ফিরতেই আবার তুরান বলে চিৎকার করতে লাগলো। উত্তাল হয়ে চিৎকার করছে রুপা। রুপার বাবা-মা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। বিস্ময় কাটিয়ে সাহেলা বেগমের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-'তুরান কে? কি বলছে রুপা এসব? কেন এমন করছে রুপা?'
রুপার মা গম্ভীর গলায় বললো,
-'পাশের ফ্ল্যাটে যে তুরান নামে একটা ছেলে থাকতো না?'
সাহেলা বেগম কোন জবাব দিচ্ছে না। রুপা যেন পাগল হয়ে গেছে। কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না এসব। রুপা চিৎকার কাঁদতে কাঁদতে বললো,
-'তুরান এমন কখনোই করতে পারে না আমি বিশ্বাস করতে পারিনা।'
রুপার বাবা-মা কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেললো। তুরানের সাথে কি রুপার সম্পর্ক ছিলো? তাঁরা দুজনই বিস্ময়ে ফেটে পড়ছে। সাহেলা বেগম কে একটার পর একটা প্রশ্ন করেই যাচ্ছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন