অলকানন্দা - পর্ব ০২ - আনিকা রাইশা হৃদি - ধারাবাহিক গল্প

!!০৪!!

"মানুষের মাংস খাবেন বুবু? খুব মজা! দেখেন বুবু দেখেন লাল লাল তরতাজা মাংস। এত স্বাদ! একটু খান না বুবু। কচি মানুষের মাংস। একটু মুখে দেন না বুবু।"

সাদা এলোমেলো শাড়ি পরনে পাগলীটা দু হাতে কয়েকটা মাংসের টুকরো নিয়ে এগিয়ে আসছে মাহার দিকে। তার মুখের একপাশ দিয়ে মানুষের তরতাজা রক্ত মিশ্রিত লালা পড়ছে। চোখ দুটো ভয়ানক লাল। হঠাৎ একহাত থেকে মাংসের টুকরো গুলো ফেলে খপ করে হাত ধরে ফেললো মাহার। মাহা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। পা থেমে গিয়েছে তার। গলায় আওয়াজ নেই। পাগলী হু হা করে হেসে এক টুকরো মাংস জোর করে মাহার মুখে ঢুকিয়ে দিলো
"আল্লাহ!" বলে চিৎকার করে উঠলো মাহা। হন্তদন্ত হয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো চৈতি। মাহা ভয়ে কাঁপছে। ফর্সা মুখ ঘামে একাকার। 
"এই কি হয়েছে তোর?"
"পা পা পা...নি।"

মাহার কণ্ঠ কাঁপছে। পাশের টি-টেবিলের উপর থেকে পানির জগ তুলে কাঁচের গ্লাসে পানি ঢাললো চৈতি। ভোরবেলা। বাইরে পাখির কিচিরমিচির আওয়াজ ভেসে বেড়াচ্ছে। বাকি সব নিরব। কাঁচের গ্লাসে পানি পড়ার আওয়াজটাও কত ভয়ানক শুনালো যেন। অদ্ভুত সম্মোহনী আওয়াজ। যা বর্ণনা করা যায় না। কেবল অনুভব করা যায়। যে আওয়াজে শরীর ক্ষণেক্ষণে কেঁপে উঠে। কেমন যেন সম্মোহীত হয়ে দুজনেই গ্লাসে পানি পড়ার আওয়াজ শুনছিলো এমন সময় ক্রিং ক্রিং ক্রিং। 

হাতটা কেঁপে উঠলো চৈতির। কাঁচের গ্লাসটা ছিটকে পড়লো নিচে। আঁতকে উঠলো দুজনেই। চৈতি হন্তদন্ত হয়ে নিচে বসে গেলো। মাহা তখনো খাটে হেলান দিয়ে বসে। হাঁড় কাঁপানো শীতের মাঝেও তার কপালের দুইপাশ বেয়ে সূক্ষ্ম ঘামের রেখা বেয়ে যাচ্ছে। 
"ইস! গ্লাসটা ভেঙে গেলো। এটার আবার জরিমানা দিতে হবে।"
চৈতির কন্ঠে হতাশা। অতঃপর ভাঙা গ্লাসের টুকরোগুলো উঠাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো সে। কলিং বেল বেজে চলেছে। মাহা ভয় ঝেড়ে বললো,
"কে... কে এসেছে? চৈতি?"
"তুই বস। আমি দেখছি। তুই জগ থেকে পানি খেয়ে নে। রুমানার আসার কথা ছিলো।"
"আচ্ছা।"

কাঁচের গ্লাসের ভাঙা টুকরোগুলো ডাস্টবিনে ফেলে দরজার কাছে এগিয়ে গেলো চৈতি। ওদের রুমটা ছোট। দুই বেডের। পাশাপাশি দুই বেড। মাঝে ছোট টি-টেবিল। তারউপরে একটা ল্যাম্পসেড। নীল রঙা দেয়াল। দেয়ালে কতক ছবি টানানো। একটা অর্ধবৃত্ত আঁকা। মাহা তাকিয়ে আছে ছবিটার দিকে। ছবিটা জানি কেমন। চতুস্তল কালো রঙের মাঝে সাদা অর্ধবৃত্ত। 
"টুকি।"

রুমানার ডাকে বাস্তবে ফিরে মাহা। কাঁধ সমান চুলগুলো এলোমেলো, অবিন্যস্ত। চুলগুলো ঠিক করার বৃথা চেষ্টা করে সে বলে,
"আন্টি কেমন আছেন?"
"ভালো।"

বলতে বলতে মাহার বেডে বসে রুমানা। চামড়ার খয়রী ব্যাগটা কাঁধ থেকে নামিয়ে রাখে পাশে। চৈতি বসেছে তার বেডে। মাহা সামনে আসা চুলগুলো সরাতে নিজের বামহাতটা কম্বলের নিচ থেকে বের করে চুলগুলো কানে গুঁজে দিলো আবার। প্রথমে খেয়াল না করলেও এবার বিষয়টা চোখ এড়ালোনা রুমানার। 
"টুকি, তোর হাতে এসব কিসের লালদাগ?"

আবারো কেঁপে উঠছে মাহার হৃদপিণ্ড। কাঁপা শরীরটা বিছানায় হেলিয়ে দিয়ে চোখ বুজলো সে। মাহার এমন রিয়েকশন দেখে যারপরনাই অবাক হয়েছে রুমানা। কালো রঙা মুখে ঈষৎ সন্দেহের আভাস। 
"টুকির কি হয়েছে রে কোকিল?"

রুমানার প্রশ্ন চৈতির কাছে। হলদে গাঁয়ের রঙে অভূতপূর্ব মায়াবতী চৈতি। তেমনই অভূতপূর্ব, হৃদপিণ্ড থমকে দেওয়া কন্ঠ তার। তার উচ্চারিত শব্দগুলো কানে কেমন যেন গানের মত শোনায়। তাই তাকে কোকিল বলে সম্বোধন করে রুমানা। এমন অদ্ভুত নাম প্রথমে অপছন্দ ছিলো তার। তবে সময়ের পরিক্রমায় মানিয়ে নিয়েছে।

!!০৫!!

"মালনীছড়ায় এক পাগলী ধরেছিলো। হাতে খামচি দিয়ে একাকার করে ফেলেছে হাতটা।"
"আল্লাহ বলিস কি?"

আঁতকে উঠলো রুমানা। মাহার অবাক দৃষ্টি তার দিকে।
"রুৎবা পাগলী যাকে ধরে সে কিছুদিনের মধ্যে হয়তো মারা যায় নয়তো গায়েব হয়ে যায়।"
"আবোল তাবোল বলিস না। বর্তমান যুগে এসবও হয়!"

চৈতির কন্ঠে অবিশ্বাস। এমন অদ্ভুত কথা যেন সে ইহজন্মেও শুনেনি। মাহা হেলান দিয়ে ছিলো খাটে। তন্মধ্যে কেঁপে উঠলো সে।
"বিশ্বাস করছিস না তো। শাহিনূর খালাও এরকম করতো জানিস।"
"কাহিনী কি খুলে বলতো?"
চৈতির প্রশ্নে তার দিকে ফিরে রুমানা। লালচে বাদামী চাদরটার একপ্রান্ত হাতের মুঠে পুরে বলে,
"পাগলীর স্বামীকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে সেই ২০১২ র দিকে। তখনকার সময় সিলেটি সিরিয়াল কিলারের ১০১ খুনের খবর তোদের মনে আছে?"
"হুম, শুনেছিলাম বোধহয়। মাতব্বর না কি যেন নাম ছিলো?"
"মাতব্বর শরীফ। পুলিশের মতে মাতব্বর শরীফ সেই সিরিয়াল কিলার। এখনো জেল হাজতে আছে। উপযুক্ত প্রমাণ মেলেনি তাই ফাঁসিও কার্যকর হচ্ছেনা। তবে আমার কি মনে হয় জানিস?"
"কি মনে হয়?"
"শরীফ চাচাকে ফাঁসিয়ে ব্যাপারটা সাময়িক ধামাচাপা দিয়েছে পুলিশ। যদিও তারপর থেকে ছিন্ন পা আর কোনো লাশ পাওয়া যায়নি। জানিস শরীফ চাচা লোকটা খুব ভালো মানুষ ছিলেন।"
"পাগলী কি উনার স্ত্রী?"
"হুম। কত সুন্দর সংসার ছিল দুজনের। রুৎবা চাচিও ভালো মানুষ। আমাদের মাজার রোডের সবাই একনামে চিনতো তাদের। গলির মোড়ে চা পান বিক্রি করতো দুজন মিলে।"
"স্বামীকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর থেকেই এমন হয়ে গিয়েছেন মহিলা?"
"না। একটা ছেলে ছিলো ফয়সাল নামে। ইন্টারমিডিয়েটে পড়তো সিলেট ইমপেরিয়াল কলেজে। ছেলেটা জাফলংয়ে বন্ধুদের সাথে ঘুরতে গিয়ে চোরাবালি তে ডুবে প্রাণ হারালো। তখন থেকেই আধপাগলা মতন হয়ে গেছিলেন। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে কিসব আবোল তাবোল বকতেন। চাচা কতবার শিকল পড়ায় রাখছেন! চাচাকেও পুলিশ ধরে নিয়ে গেলেন। তারপর থেকে মালনীছড়ায় থাকেন রুৎবা পাগলী।"
"শাহিনূর খালার ব্যাপারটা কি?"
"শুধু যে শাহিনূর খালা তা না রুৎবা পাগলী এখন পর্যন্ত যার হাতই ধরেছেন সেই গায়েব হয়ে গেছে। মালনীছড়ায় স্থানীয় কেউ ভয়ে তার কাছে যায়না। তার ছোঁয়া অশুভ। শাহিনূর খালাকে ছোঁয়ার কিছুদিনের মাথায় আগুন পাহাড় থেকে পোড়া দেহ পাওয়া গেছিলো তার। পরে আবার....

মাহা বারেবারে কেঁপে উঠছে। চৈতি চোখের ইশারায় রুমানাকে থামতে বললো। এমনিতেই মাহার অবস্থা খারাপ। রুমানা থতমত খেয়ে চুপ করে ব্যাপারটা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টায় বললো,
" ধুর। আমি মজা করছি আর তোরা বিশ্বাস করে নিলি? কেমন ভয় দেখালাম বল?"

হু হা করে হাসার চেষ্টা চালালো রুমানা। চৈতিও ঈষৎ হাসিতে যোগ দিয়ে বললো,
"তুইও না রুমানা। এভাবে কেউ ভয় দেখায়?"
"তোরা তো বাড়িতে আসলি না। চাচি তোদের জন্য খাবার রান্না করে পাঠিয়েছে।"

বলে খাবারের বক্সগুলো খয়রী রঙা চামড়ার ব্যাগ থেকে বের করলো রুমানা। 
"টুকি, তোর না গরুর মাংস খুব পছন্দ? দেখ চাচি লাল লাল করে বেশি ঝাল দিয়ে ভুনা করে দিয়েছে? খেয়ে দেখ।"

!!০৬!!

বলেই খাবারের বক্সটা মাহার সামনে ধরলো রুমানা। মাহা একবার মাংসের বক্সটার দিকে তাকিয়ে আরেকবার তাকানোর সাহস পেলোনা। যা খেয়েছিলো রাতে সব বেরিয়ে আসতে চাইছে তার। মুখ চেপে ধরে বিছানা থেকে উঠে দৌঁড়ে বাথরুমে চলে গেলো মাহা। ঘটনাটা এতটা দ্রুত ঘটলো যে উপস্থিত কারোই মাথায় আসেনি হচ্ছে কি। যখন ধ্যান ভাঙলো দুজনের তারাও পিছনে ছুটে বাথরুমের দিকে এগুলো। মাহা বমি করে ভাসিয়ে ফেলেছে বাথরুম। আঁশটে গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। কেমন ঘিনঘিনে ব্যাপার। রুমানা, চৈতি কেউই ভিতরে প্রবেশ করলোনা। পানির কলটা ছেড়ে দিয়েছে মাহা। আস্তে আস্তে বাথরুমটা পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। 

মাহা যখন বেরুলো বাথরুম থেকে তখন অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে দুজোড়া নেত্র। মাহা চোখের ভাষা পড়েও প্রতুত্তর না করে নিজের বেডে বসে পড়েছে। ফ্যাকাশে হয়ে গেছে তার মুখ। চৈতি, রুমানা পাশে এসে দাঁড়িয়েছে তার। মুখ খুললো রুমানা।
"টুকি, ঠিক আছিস?"
"হুম।"
"শরীর কি বেশি খারাপ লাগছে?"
"না। মাথা ঘুরাচ্ছে একটু।"
"খাবারটা খেয়ে নে। ভালো লাগবে।"

আঁতকে উঠলো মাহা। নিজের চমকিত ভাবটা লুকিয়ে বললো,
"মাংস খেতে ইচ্ছে করছেনা। আর কিছু এনেছিস?"
"হুম। সবজি ভাজি আছে।"

তিনজনে মিলে খাওয়া সেরে নিয়েছে। মাঝে কোনো কথাই হয়নি। কেমন যেন শ্মশানঘাটের মতো নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে হোটেল মুসাফিরের ৩০৩ কক্ষে। নিরবতা ভাঙলো চৈতি।
"আজকে খাসিয়া পল্লী ঘুরে এলে কেমন হয়?"

রুমানা প্রতুত্তরে বললো,
"ঘন্টা দুয়েকের পথ। টুকি জার্নি করতে পারবে? শরীর দুর্বল তো ওর।"
"পারবো। আমারও খাসিয়া পল্লী দেখার ইচ্ছে।"

সকল ক্লান্তিকে, ভয়কে ঘুচিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করতে চাচ্ছে মাহা। আদোও কি এতো সহজে স্বাভাবিক হওয়া যায়? মানুষ মৃত্যুকে কখনো স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারেনা। এই পৃথিবীতে মৃত্যু চরম সত্য। মৃত্যুর ভয় একবার মানুষকে ঝেঁকে ধরলে তা ছাড়ানো দায়। চাইতেও কিংবা না চাইতেও অদ্ভুত খেলার জটিল অংশে গুটি মাহা। চৈতি, মাহা সব হলো নামের খেলা। নামে পরিচয়, নামে বিনাশ। কিছু খেলা বড় করুণ। ভাগ্য অলৌকিক ভাবে সব মিলিয়ে দেয়। খেলা রচনাকারী যাদের নিয়ে খেলছে সে কি জানে তার গুটি তাকে নিয়ে খেলছে? এটা একটা বিস্তৃত মাঠে অদেখা চোরাবালির মতন। মাঠের এপাড়ের লোক আর ওপাড়ের লোক দুজনেই স্থান বদলাচ্ছে। চোরাবালির অতলে কে হারায় দেখার বিষয়। চিকচিকে চোরাবালির প্রেমের দহন যন্ত্রণা। চোরাবালির প্রেমে পড়লে তাতে ডুবতে হয় অতলে। গভীর থেকে গভীর অতলে। সেই অতল থেকে সৃষ্টি হয় নতুন গল্প, নতুন প্রেক্ষাপট। যা অহর্নিশের মধ্যভাগের মতন খা খা। নিশ্চল। বড় নিশ্চল।

খাসিয়া পল্লীতে কি অপেক্ষা করছে তাদের জন্য? 
.
.
.
চলবে...........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন