মেঘফুল - পর্ব ৩২ - মিশু মনি - ধারাবাহিক গল্প


সকালে আড়মোড়া ভেঙে হাস্যজ্জ্বল মুখে ভায়োলেট বলল, 'আজকের দিনটা খুব ভালো কাটবে আপু।'
জাহ্নবী জানালার পাশে দাঁড়িয়ে সূর্যরশ্মি গায়ে মাখছিল। ভায়োলেটের কথা শুনে বিস্মিত সুরে জানতে চাইলো, 'তুই কিভাবে বুঝলি?'
'আজকের সকালটাই অন্যরকম মনে হচ্ছে। তাছাড়া আমার ভালো ঘুম হয়েছে তো। মনটা দারুণ ফ্রেশ। দেখো তুমি, দিনটা খুব ভালো যাবে।'

জাহ্নবী বিছানায় এসে বসল। ভায়োলেটের আদুরে চিবুকে ঘুমের দাগ স্পষ্ট। ওকে দেখতে বেশ বিশুদ্ধ লাগছে। শ্যাম্পু করা ভায়োলেটের ঝলমলে চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে জাহ্নবী বলল, 'তুই অনেক সুন্দর রে। রুশো এমনি এমনি প্রথম দর্শনেই পাগল হয় নি।'

ভায়োলেট মুচকি হেসে বলল, 'আরও কত লোকে পাগল হয়েছে সেই খবর কী রাখো? চা খেতে যাবো চলো।'
'কোথায়?' 
'নিচের দোকানে। "when tea meet toast" এ। চা খেয়ে আমি চলে যাবো।'
'কী বলিস? আজকের দিনটা এত সুন্দর। আমারও অফ ডে। আজকে আমরা একটু মজা করতে পারতাম।'

ভায়োলেট হাই তুলতে তুলতে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল। হাতমুখ ধুয়ে এসে বলল, 'তুমি রেডি হয়ে নাও। আজকে সারাদিন আমরা বাইরে ঘুরবো।'
'সত্যি!' 
বিস্ফারিত হল জাহ্নবীর চোখ। ভায়োলেটের সঙ্গে সারাদিন বাইরে ঘুরবে মানেই তো দারুণ একটা দিন কাটবে তার। সে দ্রুত ছোটাছুটি করে তৈরি হতে লাগল। 

"When tea meet toast" এ শুক্রবার সকালের চা'য়ের আলাদা বিশেষত্ব আছে। এদিন শুধু টোস্ট নয়, চায়ের সঙ্গে গরম গরম লুচি তরকারিও পাওয়া যায়। জাহ্নবী'র ধারণা ছিল আজ বোধহয় দোকান পুরোদস্তুর ফাঁকা থাকবে। শুক্রবার মানেই তো দেরী করে ঘুম থেকে ওঠা। সকাল নয়টায় নিশ্চয়ই লোকজন চা খেতে হাজির হবে না। কিন্তু তার ধারণাকে উলটে দিয়ে আজকে দোকানে প্রচুর ভীড়ের সমাগম হয়েছে। জাহ্নবী ভেতরে ঢুকেই বলল, বাবারে! আমরা বসার জায়গা-ই তো পাবো না। যা ভীড়!
ভীড়ের রহস্য বুঝতেও তাদের খুব বেশী সময় লাগল না। প্রত্যেক টেবিলে ধোঁয়া ওঠা তরকারির সঙ্গে গরম গরম ফুলকো লুচি। দম্পতিরা আড্ডা দিতে দিতে আয়েশ করে লুচি খাচ্ছে। সাথে এক কাপ মালাই চা, আহা! এমন দৃশ্য দেখেই তো জিভ ভিজে যায় জলে। 

ওরা বসার জায়গা পাচ্ছিল না। বেয়ারাকে ডেকে ভায়োলেট জানতে চাইলো, 'কোনো টেবিল ফাঁকা হবে কিনা দেখুন না।'
'দেখছি ম্যাডাম।'
মিনিট খানেক ঘুরে এসে বেয়ারা জানালো, 'সরি ম্যাডাম, কিছুক্ষণ ওয়েট করতে হবে।'
' ঠিক আছে, আমরা ওদিকে দাঁড়াচ্ছি। টেবিল ফাঁকা হলে বলবেন।' উত্তর দিলো ভায়োলেট। 

হঠাৎ জাহ্নবীর বামপাশের টেবিল থেকে একজনের গলা শোনা গেল, 'আপনারা চাইলে এখানে বসতে পারেন। যদি সমস্যা না থাকে।'

আগন্তুকের দিকে তাকালো দু বোন। ভদ্রলোকের আমন্ত্রণে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল ভায়োলেট। তাদের বেঞ্চে দুজন অনায়াসে বসা যাবে। বড় আপু বসবে কিনা সেটা জানার জন্য জাহ্নবীকে জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল সে। খেয়াল করে দেখল জাহ্নবীর দৃষ্টিতে মুগ্ধতা, মুখে লাজুক হাসির আভাস। তাকে ভীষণ অপূর্ব দেখাচ্ছে হঠাৎ করেই। যেন স্বর্গ থেকে ভেসে আসা কোনো আলোয় আলোকিত হয়েছে জাহ্নবী। 
আলোকিত তো হতেই হবে তাকে। পান্নাবাহার স্বয়ং তাদেরকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে! জাহ্নবী লাজুক হেসে চেয়ে রইল তার দিকে।

জাহ্নবী'র মতোই বিস্ময় নিয়ে পান্নাবাহারকে দেখছে তার বাকি তিন বন্ধু। তাদের টেবিলে সম্ভবত কখনো বাইরের কাউকে যোগ দিতে বলা হয় নি।

পান্নাবাহার বন্ধুদেরকে বলল, 'উনি আমার পরিচিত।'
বন্ধুদের মধ্য হতে একজন উঠে অপরপাশের বেঞ্চিতে গিয়ে বসল। এই বেঞ্চিতে শুধুমাত্র পান্নাবাহার বসা। জাহ্নবী'র হৃদস্পন্দন বাড়তে শুরু করেছে। পান্নাবাহারের বেঞ্চিতে তারা বসবে! এ যেন বিভ্রম অথবা নিছক স্বপ্ন।

পান্নাবাহার তাকে বলল, 'আমাকে চিনতে পেরেছেন? আমি নাদিরের কাজিন। গতকাল একটা ফাইল দিতে আপনার অফিসে গিয়েছিলাম।'
জাহ্নবী হাসিমুখে বলল 'হ্যাঁ।' 

হাসিমুখের অন্তরালে সে কতটা বিস্মিত তা টের পেলো না কেউই। সবাই ধরে নেবে জাহ্নবী হয়তো অপরিচিত কারও আমন্ত্রণে অবাক হয়েছে। কিন্তু এইমুহুর্তে সে মনে মনে ভাবছে, 'আমার জগতটা খুব ছোট্ট জনাব পান্নাবাহার। এ জগতে কেউ নেই আমার পরিবার ছাড়া। কিন্তু আমার এই ছোট্ট জগতে আপনি আছেন। আপনাকে চিনবো না, সেটা কী কভু হতে পারে!

ভায়োলেট বলল, 'আপু, বসবে?'
জাহ্নবী বলল, 'ওনাদের অসুবিধা হবে না তো?'

পান্নাবাহারের একজন বন্ধু উত্তর দিলেন, 'আজ তো পুরা হাউজফুল। কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবেন? আরে বসুন তো।'
ভায়োলেট জাহ্নবীকে ইশারায় ভেতরে যেতে বললে জাহ্নবী অপ্রস্তুত বোধ করল। ইতস্তত করতে করতে পান্নাবাহারের পাশে বসে পড়ল সে। 

পান্নাবাহার বেয়ারাকে ডেকে বলল, 'আরও দুজনের লুচি তরকারি দেবেন।'

বন্ধুরা তাদের স্বাভাবিক কথোপকথন চালিয়ে গেল। পান্নাবাহার তার এত কাছে, সেই ভেবেই জাহ্নবী শিহরিত হয়ে উঠছে। তার পাশে বসে কথা বলছে পান্নাবাহার! তার গলার স্বরের ওঠানামা স্পষ্ট বুঝতে পারছে জাহ্নবী। পান্নাবাহারের পরনে একটা কুঁচকানো পলো শার্ট। খুব সম্ভবত ঘুম থেকে উঠেই চলে এসেছে এখানে। জাহ্নবী টেবিলের দিকে তাকিয়ে তার হাতের দিকে খেয়াল রাখছে। কথা বলতে বলতে পান্নাবাহারের হাত নাড়ানোর ভঙ্গী দেখছে সে।

নিজের জড়তা আষ্ঠেপৃষ্ঠে চেপে ধরে আছে জাহ্নবীকে। সবার সঙ্গে সহজে মিশতে না পারার কষ্টটা তার বহু বছরের। এখানে বন্ধুরা আড্ডা দিচ্ছে, ভায়োলেট চেষ্টা করছে তাদের কথায় তাল মেলাতে। সে একান্তই জঙ্গলে সামুদ্রিক মাছ সেজে বসে থাকবে, নিজের কাছে নিজেকে বিব্রতকর লাগছে জাহ্নবীর।

অনেক্ষণ চেষ্টা করে জাহ্নবী মনেমনে একটা কথা গুছিয়ে নিলো। এটা বলতে পারলে অন্তত কিছুটা সামাজিকতা রক্ষা করতে পারবে সে। কিন্তু কথাটা যেন বলাই হয়ে উঠছে না। সকলের কথার ফাঁকে সুযোগই পাচ্ছে না সে। 

হঠাৎ ভেতর থেকে সাহস সঞ্চার করে পাশে বসা পান্নাবাহারের দিকে তাকালো জাহ্নবী। এত কাছ থেকে মানুষটাকে দেখে তার দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম। জাহ্নবী ঘামতে শুরু করেছে। তবুও অনেক কষ্টে দ্রুত শ্বাস ফেলতে ফেলতে জাহ্নবী বলে ফেলল, 'নাদির স্যার কেমন আছেন এখন?'

কথাটা বলেই জাহ্নবী মাথা ঘুরিয়ে দৃষ্টি সংযত করে নিলো। দ্রুত শ্বাস পড়ছে তার। চোখ বন্ধ করে নিজেকে সামলে নিলো জাহ্নবী।
পান্নাবাহার উত্তর দিলো, 'ভালো আছে। আজকে সেলাই খুলে দেবে। কিন্তু শুনুন, আমার সামনে নাদিরকে স্যার বলবেন না তো। ও আমার ছোট ভাই। ওকে স্যার ডাকলে নিজেকে কেমন অকর্মা অকর্মা লাগে।'
বাকিরা হেসে উঠল। জাহ্নবীও হাসির মাধ্যমে সহজ হওয়ার চেষ্টা করল। এর আগে অনেক অপরিচিত মানুষের সঙ্গে প্রয়োজনের খাতিরে তাকে কথা বলতে হয়েছে। অর্ণবের সঙ্গেও টুকটাক কথা বলেছে সে। কিন্তু কই, আগে তো এমন লাগে নি তার! বুকের ভেতর এমন উথালপাথাল হয়নি তো আগে, কখনো তো কারও দিকে তাকাতেও এমন সাহসী হতে হয়নি। তবে এই মানুষটার জন্য তার এমন কেন লাগে! উনি কী এমন কেউ, ভায়োলেট যেমন রুশোর কেউ ছিল? 

জাহ্নবী আবারও অবাক চোখে এক পলক তাকালো পান্নাবাহারেরর দিকে। 

পান্নাবাহার তার এক বন্ধুকে বলল, 'সংসার জীবন কেমন চলছে বন্ধু রাহুল?'
'আরে আমার বউ আজকে আসতে চাইছিল। তোরা বলবি যেখানে যায় বউ নিয়ে যায়, সেই জন্য আমি নিয়ে আসলাম না। এখন মনে হচ্ছে নিয়ে আসলেই ভালো করতাম।'

অন্য একজন উত্তর দিলো, 'তার মানে আমরা যদি বলি, ছি ছি, রাহুল একটা ছেলে হয়ে একটা মেয়ের সঙ্গে ঘুমায়। তাহলে কি তুই তোর বউকে রেখে আলাদা ঘুমাবি?'
রাহুল বলল, 'অবশ্যই বন্ধু। আমি তখন অচীন দ্বীপে চলে যাবো। হাজার হলেও আমার বন্ধুরা বলেছে।'
পান্নাবাহার হেসে বলল, 'কোন দ্বীপে যাবি? শাটার আইল্যান্ডে?'

হেসে উঠল বাকিরা। পান্নাবাহার ভায়োলেট ও জাহ্নবীকে উদ্দেশ্য করে বলল, 'আপনারা আমাদের কথায় বিরক্ত হচ্ছেন না তো?'

ভায়োলেট হাসিমুখে বলল, 'না ভাইয়া। বরং আপনাদের আড্ডা উপভোগ করছি।'

একজন ছেলে উত্তর দিলো, 'আমাদের সকালে ঘুম থেকে উঠে দৌড়ে দৌড়ে এখানে আসাটা তাহলে সার্থক। কেউ আমাদের আড্ডা উপভোগ করছে।' 

বলেই হেসে উঠল সে। হাসি থামিয়ে বলল, 'আমি তূর্য। আপনার নামটা জানতে পারি?'
'আমি ভায়োলেট।'
'ভায়োলেট! মানে বেগুনী? আপনি কি তাহলে পিয়াজু? সরি পিয়াজুর ইংরেজি জানিনা।' জাহ্নবী'র দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলো তিনজনের মাঝখানের ব্যক্তিটি। 

বাকিরা তখন হাসছে। পান্নাবাহার বলল, 'আপনারা কিছু মনে করবেন না। আমরা বন্ধুরা একসঙ্গে হলে একটু বেশীই হাসি আড্ডা হয়। ছোট বড় কাউকে মানেনা ওরা।'
তূর্য বলল, 'আরে বেগুনী আপু তো বললেনই উনি আমাদের আড্ডা উপভোগ করছেন। আপনারা নিশ্চয়ই দুবোন?'
জাহ্নবী এবার কথা বলার চেষ্টা করল, হ্যাঁ। তবে আমার নাম পিয়াজু নয়, আমি জাহ্নবী।'
'সুন্দর নাম।'

খাবার চলে এলো। গরম গরম ফুলকো লুচি ছিঁড়ে মজাদার তরকারি দিয়ে সবাই আয়েশ করে খাচ্ছে। লজ্জায় খেতে পারছে না জাহ্নবী। ভায়োলেট এক টুকরো লুচি জাহ্নবী'র মুখে তুলে দিয়ে বলল, 'খাও আপু।' 
জাহ্নবীও লজ্জা ভুলে ভায়োলেটকে খাবার তুলে খাওয়ালো। চা শেষ করে ভায়োলেট বলল, 'আপু, চলো আমরা উঠি।'
তূর্য বলল, 'বসুন আরও কিছুক্ষণ। আমাদের অসুবিধা নেই তো।'
'ধন্যবাদ ভাইয়া। আমাদেরকে এক জায়গায় যেতে হবে তো।'

ব্যাগ কাঁধে নিয়ে উঠে পড়ল জাহ্নবী। পান্নাবাহারকে 'ধন্যবাদ' জানাতে গিয়েও জড়তার কারণে কথা বলতে পারল না। ভায়োলেট ই বিদায় নিলো সবার কাছ থেকে। 

রাস্তায় বেরিয়ে একটা রিকশা নিলো ভায়োলেট। জাহ্নবী'র মনটা ভীষণ ফুরফুরে। সতেজ বাতাসে নিজেকেও আজ বড্ড চনমনে লাগছে। ভায়োলেটের পছন্দের একটা জায়গায় সে নিয়ে যাবে আজ। হাওয়ায় রিকশার ছেঁড়া পলিথিন ফতফত করে উড়ছে৷ জাহ্নবী'র ইচ্ছে করছে খুশিতে ভায়োলেটকে জড়িয়ে ধরে রাখতে। 

রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আইসক্রিম খেল ওরা। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের হৈ হুল্লোড় চোখে পড়ল। কেউবা ফুটপাতে বন্ধুরা মিলে বসে গিটারের সুরের সঙ্গে গান ধরেছে। কোথাও আবার বসেছে আড্ডার আসর। আজকের দিনটা রঙিন, ভীষণ ঝলমলে। 

হঠাৎ ভায়োলেটের ফোনে কল এলো সামারের নাম্বার থেকে। ফোনে কানে ধরতেই শুনতে পেল সামারের উদ্বিগ্ন গলা, 'ভায়োলেট, আমার সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে। অর্ণবের বাবা মা এসেছে। কিন্তু আম্মুর কথাবার্তা আর ওই মহিলার আচার আচরণ দেখে আমার মনে হচ্ছে আমার আর অর্ণবের বিয়ের ব্যাপারে কথা হচ্ছে। মাথা খারাপ হয়ে গেছে আমার। কখন আম্মুকে গালিগালাজ শুরু করবো বুঝতে পারছি না। অর্ণবের বাবাকে বলতে শুনলাম রেজিস্ট্রি নিয়ে কথা হচ্ছে। ওরা কি আজকেই আমার সঙ্গে ওনার ছেলের বিয়ে দিতে চায় নাকি? সব ভেঙে চুড়ে ফেলবো আমি। নয়তো পালাবো বাসা থেকে। তুই বাসায় আয়।'

ভায়োলেট ধীরগলায় বলল, 'শান্ত হ আপু। ভুলভাল কিছু করিস না। আমি এসে মাকে বোঝাচ্ছি।'

কল কেটে দিয়ে একটা নিশ্বাস ফেলে ভায়োলেট বলল, ' ঠিক যে ভয়টা পেয়েছিলাম, সেটাই হল।'

জাহ্নবী উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানতে চাইলো, 'কী হয়েছে?'
'আমাদেরকে এক্ষুনি বাসায় যেতে হবে আপু।'
.
.
.
চলবে........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp