মন বাড়িয়ে ছুঁই - পর্ব ৩৪ - ফাবিয়াহ্ মমো - ধারাবাহিক গল্প


অন্ধকার গ্যারেজের দিকে পা চালাতে দেখে প্রচণ্ড ভয় পেলো মেহনূর, সাথে-সাথে মাহতিমের শক্ত হাতের বাহুবন্ধনে ছটফট শুরু করলো। মাহতিম শক্ত চাহনি দিয়ে একপলক ভয়ার্ত মুখটার দিকে তাকালো, এরপর চোখ ঘুরালো গ্যারেজের দিকে। মেহনূর যেভাবে নড়াচড়া শুরু করেছে এতে মস্তিষ্কের ভেতর টগবগ করছে ওর। রাগে ইচ্ছে করছে এখুনি কিছু একটা ঘটিয়ে ফেলতে, এখুনি নিজের জঘন্যতম রূপটা দেখিতে দিতে, কিন্তু মেহনূর সেটা সহ্য করতে পারবে কিনা সন্দেহ। মাহতিম নিজের ভয়ানক রাগটা দাঁতে চেপে পেশিবহুল হাতদুটো আরো কঠোর করে নিলো, ওমনেই মেহনূরের ছোট্ট দেহটা মাহতিমের শক্ত হাতের বলয়ে গুটিশুটি হয়ে গেলো, বুকের সাথে কাঁদো-কাঁদো মুখটা ঠেকে গেলো তৎক্ষণাৎ। আসন্ন বিপদ নিয়ে ভাবনা হতেই অশান্তধারায় দুচোখের অশ্রু ছেড়ে দিলো মেহনূর, মাহতিমের সাদা কলারটা আর শক্ত করে ধরলো না। ডানহাতের পাঁচটি আঙ্গুল দিয়ে সাদা কলারটা ধরেছিলো, ধীরে-ধীরে সেখান থেকে হাত নামিয়ে ফেললো মেহনূর। চোখের সামনে আর কোনোকিছু দেখতে পেলো না। সূর্যের শেষ আলোটা চোখ থেকে সরে যেতেই অন্ধকার নেমে এলো সর্বত্র। কানে শুধু শুনতে পেলো গ্যারেজের দরজাটা ' ক্যাচ-ক্যাচ ' শব্দ করে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। 

.

বাড়িতে সবার অবস্থা বিমর্ষ হয়ে আছে। বিষণ্ণতায় ডুবে আছে সবার চিন্তাচেতনা। মাহতিম এই মূহুর্তে কি করবে, কি করছে সেটা নিয়ে কারোর বিশেষ মাথাব্যথা নেই। আপাতত একটাই চিন্তা বাড়িতে খুব শীঘ্রই রজনী মামী আসছে। রজনী মামী ভোর ছয়টার ট্রেনে চেপে রওনা দিয়ে ফেলেছে। দুপুর বারোটা-কি-একটার মধ্যে এখানে সশরীরে উপস্থিত হবে। এই মহিলার ব্যাপারে কেউ আজ পযর্ন্ত গলা চড়িয়ে কথা বলতে পারেনি। কারো দুঃসাহস নেই রজনী ইবনাতের সাথে ঝগড়া বা তর্ক করার। মহিলার আসল পরিচয় তিনি একজন বিধবা, মাহতিমের মরহুম মামার স্ত্রী। স্বামী ইন্তেকালের পর তার মধ্যে কোনো বিশেষ পরিবর্তন আসেনি। পরিবর্তন হয়নি তার রুষ্ট স্বভাবের আচরণে। বিধবা হিসেবে সাদামাটা পোশাক-আশাক পড়াটা বাহুল্য বলা চলে, কিন্তু রজনী ইবনাতের ক্ষেত্রে সবটাই উলটাপালটা দেখা যায়। কঠোর মেজাজের মহিলা হিসেবে সমাজের সর্বত্র তার পরিচিতি ছড়িয়ে গেছে, মাঝে-মাঝে মারজাও তার কাছে চুপচাপ হয়ে যায়। বড় ভাইকে যথেষ্ট সম্মান করতো বলেই ভাবীর প্রতি সমীহ দেখায়। মারজা ছোট থেকেই হান্নান শেখের পরিবারে ভালো সখ্যতা গড়েছিলো, আলাদা প্রীতিপূর্ণ টান ছিলো সবার প্রতি। কিন্তু বড়ভাই যেমন শৌখিন চিন্তার ছিলো তেমনি ছিলো উগ্রপ্রকৃতির। জাকির মেশকাত শহরের হাওয়ায় বেড়ে উঠেছিলো, শহরের যতো বিধ্বংসী চিন্তা-চেতনা থাকতে পারে সবটাই সে ধারণ করেছিলো। দু'ভাইবোনের মধ্যে এতোটাই দূরত্ব ছিলো মারজা কখনো ভাইয়ের কাছে যেতে চাইতো না। জাকির পড়ালেখার টানে শহরেই থাকতো, সেই শহরেই ব্যবসার ঘাঁটিটা স্থাপন করে ফেলে। দিনকে-দিন ফুলে-ফেপে ওঠে তার ব্যবসার বিস্তার, নাম-সুখ্যাতি ছড়িয়ে পরে দিগ্বিদিক। মারজা যখন প্রথম সন্তানের সুখবর নিয়ে অন্তঃসত্ত্বা হলো, তখনই জাকির ধুমধাম করে বিয়ে করলেন রজনী ইবনাতকে। শ্বশুড়ের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের যৌতুক নিয়ে বিদেশেও ব্যবসার প্রসার ঘটাতে থাকলেন, কিন্তু ভাগ্যের চূড়ান্ত সত্যের কাছে হেরে গিয়ে দুনিয়া ত্যাগ করলেন তিনি। ফুসফুসের রোগকে জয়ী করে রূহ ছাড়লেন একদিন। তাসের খেলাঘরের মতোই উনার সব ব্যবসা ধূলোর মতো ভেঙ্গে গেলো, চর্তুদিকে ঋণ-কর্জ বাধিয়ে রজনীকে যখন একা ফেলে গেলেন তখন মাহতিমের বাবা নিজের উদারতার পরিচয় খোদাই করে বিধবা মহিলাকে আশ্রয় দিলেন। মারজাও স্বামীর সিদ্ধান্তে যুৎসই রাজি ছিলো, তখন থেকেই রজনীকে পরিবারের সদস্যরূপে গ্রহণ করে সবাই। সবকিছু বহুবছর যাবৎ ঠিকঠাক থাকলেও মাহতিমের বাবা যখন পরগামী হলো তখন থেকেই দেখা গেলো আসল চরিত্র। মারজার সাথে যথেষ্ট অমায়িক সম্পর্ক রজনীর, মনে-মনে মিল হলে সম্পর্ক যেমন মধুর হয় ঠিক তেমনটাই বলা উচিত। বিশ্বাসের স্থানটা কঠোরভাবে আয়ত্ত করেছে মহিলা, মাঝে-মাঝে মাহতিমের চেয়েও রজনীর প্রতি বিশ্বাস কাজ করে প্রবল। মাহতিম এ নিয়ে আগে থেকেই ক্ষুণ্ণ অনুভব করে, কিন্তু মা'কে কষ্ট দিয়ে বাক্য খরচ করেনি সে। রজনীর আসল চরিত্র নীতি-প্রীতিদের কাছে বহু আগেই ধরা পরেছে, তার সুবাদে একে-একে ধরা পরেছে সবার কাছে। মাহতিমের বিচক্ষণ বুদ্ধির কাছে রজনী কখনো নিজেকে ধরা দিতে দেয়নি। মহিলা সবসময় জানতো, মাহতিম তার বাবার চেয়েও কয়েক ধাপ বেশি চতুর, চালাকির প্রতিযোগিতা ছাড়াই মাহতিমকে তিনি বিজয়ী ঘোষণা করতে বাধ্য। তিনি খুব সর্তক থাকেন মাহতিমের জন্য, বিশেষ করে মাহতিম যখন ছুটি কাটাতে বাড়িতে আসে তখন তিনি ইচ্ছে করেই নিজের ভাইয়ের বাড়িতে বেড়াতে যান। এবারের ঘটনা আগের মতো সোজাসাপ্টা নয়, মাহতিম এবার পরিবার নিয়ে গ্রামে ঘুরতে গিয়েছে এটা নিয়েও চিন্তাগ্রস্থ সময় কাটিয়েছে রজনী। মাহতিম যদিও বিয়েঘটিত সম্পর্কের দিকে আকৃষ্ট নয়, মেয়েদের প্রতিও তার ইন্দ্রিয় সংযত থাকে তাই তিনি চিন্তামুক্ত ছিলেন বলা চলে। নিজের একমাত্র ভাতিজির সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক করার চিন্তা সেই শৈশব থেকে ছিলো উনার। মাহতিমের আচার-আচরণ ছোট থেকেই উনার বিশেষভাবে পছন্দ। বয়সের সাথে-সাথে আচারনিষ্ঠ হওয়ার পাশাপাশি সৌষ্ঠব্য দেহের মাহতিম মেয়েদের নজরে সর্বত্রভাবে আর্কষণীয়। নিজেকে বাধা-ধরা নিয়মের মধ্যে না রাখলেও মেয়েদের সংস্পর্ষে আসার সুযোগ হয়নি। সেনাবাহিনীর বয়েজ স্কুলগুলোতে কড়া নিয়মের মধ্যে বড় হয়েছে সে, বাবার নীতিতত্ত্বকে মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে শিক্ষার প্রতিটি স্তর পার করেছে। আজ সেই রজনীর জন্য কারো মনে শান্তি নেই। রজনী নিশ্চয়ই মেহনূরকে দেখে প্রফুল্ল বোধ করব না, মাহতিমের অনুপস্থিতিতে কি ধরনের আচরণ দেখাতে পারেন সেটা নিয়ে সংশয়ে ভুগছে সবাই। নীতি কল্পনা করার চেষ্টা করলো, রজনী মামী মেহনূরকে পুরো বাড়িতে একা পেয়ে -----, চোখ বন্ধ করে ফেললো নীতি। সম্পর্কের দিক দিয়ে মেহনূর যতই বড় হোক, বয়সের অঙ্কটা চিন্তা করলে মেহনূরের প্রতি মায়া লাগে। গ্রামের ভদ্র পরিবার থেকে নরম স্বভাবের মেয়েটা সত্যিই ভেতর থেকে কোমল। তার মধ্যে কোনো খাদ নেই, খুঁত নেই, খুসখুসে স্বভাবও নেই। একবার যদি মাহতিম নামক বীজটি মনের ফসলী জমিতে বপন করা হয়, তাকে শেষ নিশ্বাস পযর্ন্ত যত্ন করবে মেহনূর। ভালোবাসায় অনভিজ্ঞ মেহনূর একটু-একটু করে মাহতিমের সৌহার্দ্যে নিজেকে অভিজ্ঞ করতে শিখছে, ধীরে-ধীরে মন বাড়িয়ে ছুঁচ্ছে, অনুভূতির জগতে পা ফেলে নব ফুলের মতোই পরিস্ফুটিত হচ্ছে। নীতি ছোট্ট একটা নিশ্বাস ছেড়ে চোখদুটো মেললো, পিঠের পেছন থেকে সোফার কুশন নিয়ে কোলে রাখলো। শান্তসুরে উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললো, 

  - আমাদের হাতে কিছুই করার নেই। এই মূহুর্তে রজনী মামীর আসাটা যেমন আশ্চর্যজনক, তেমনি চিন্তার বিষয়। আমার শুধু চিন্তা হচ্ছে মেহনূরের জন্য। মেয়েটা গ্রাম থেকে এসেছে, ও শহরের কিচ্ছু চেনেনা-জানেনা-দেখেনি। ওর শেফালী চাচীটা মাহতিম ভাইয়ের জন্য আগাতে পারেনি, কিন্তু রজনী মামীর বেলায় কি ঘটবে সেটা আর বলার ইয়ত্তা রাখেনা। মামী যেনো একাই আসুক সেই দুয়া করো, যদি উনার ভাইয়ের মেয়েকে সঙ্গে আনেন তাহলে কিন্তু বিপদ। মেহনূরকে একদম জ্বালিয়ে মারবে। মেয়েটা চিলতে খানি স্বস্তি পাবে না। 

সবাই ড্রয়িংরুমের সোফায় উদভ্রান্তের মতো বসে আছে। চিন্তিত মুখে কারো কোনো হাসি নেই। সবাই নিজেদের চিন্তাভাবনা নিয়ে ব্যাপকভাবে মশগুল। মাহদি চুপচাপ সোফায় বসে সবার দিকে তাকিয়ে আছে। নীতির কথা শুনে আবারও উদাস দৃষ্টিতে সদর দরজার বাইরে তাকালো। থমথমে পরিবেশে ছেদ ঘটিয়ে সামিক বলে উঠলো, 
  - একটা ব্যাপার বলতো, মাহতিম ভাই সিভিল ড্রেস না পরে ইউনিফর্ম পরেছে কেন? সবসময় তো সিভিল ড্রেসেই যেতে দেখতাম। ভাই কি ডিরেক্ট হেড অফিসে যাবে নাকি? 

সামিকের উত্তরটা দেওয়ার জন্য বিরসমুখে বললো তৌফ, 
  - মাহতিমের ছুটি যে কালই শেষ, এই ব্যাপারে জানোস কেউ? জানোস না। ওর ডিউটি আজকে থেকে শুরু। বিকেল চারটার মধ্যে ওর হাজিরা দেওয়া লাগবো। না দিতে পারলে ওর জন্য কেমন ব্যাপার হইবো ওইটা একবার ভাবিস। 

তৌফের কথা শুনে চকিতে তাকালো সবাই। কপালে অসংখ্য ভাঁজ ফেলে আশ্চর্য হয়ে গেলো। বলে কি! যদি আজকে থেকে মাহতিমের ডিউটি শুরু হয় তাহলে ও এখনো রওনা দেয়নি কেনো? ও কখনো কাজ নিয়ে দেরি করেছে কিনা কেউ চেষ্টা করেও মনে করতে পারলো না। না-জানি মেহনূরেরক পালে কি ধরনের শনি আছে! ওর জন্যই তো যাওয়া নিয়ে বাধা খেয়েছে। তৌফের কথার প্রেক্ষিতে ফারিন বলে উঠলো, 
  - ভাইয়া লেট করলে সমস্যা নেই। সমস্যা হলো রজনী মামীর প্রেসেন্স নিয়ে। ভাইয়ার নিজের অফিশিয়ালি কাজগুলো স্মার্টলি হ্যান্ডেল করতে পারবে। এখন জাস্ট প্রে করো রজনী মামীর ভাতিজি যেনো না আসে। 

ফারিনের কথায় নিরবে সম্মতি জানালো সবাই। রজনীকে ট্যাকেল দেওয়াটা কঠিন হলেও তার ভাতিজিকে সহ্য করা দুঃসাধ্য ব্যাপার। ওই মেয়ে যদি একবার এই বাড়িতে পা ফেলে তাহলে সহজে এখান থেকে যেতে চায় না। নিজেকে উচ্চবংশের মেয়ে ভাবতে-ভাবতে মনের ভেতর ভালোই অহংকার জন্মে গেছে। ছোট থেকেই বাড়ি-গাড়ি-মান-যশ নিয়ে আলাদা ধরনের গর্ব রয়েছে। রজনীর ইচ্ছেতে তার ভাতিজি দিনের-পর-দিন, মাসের-পর-মাসও এ বাড়িতে পরে থাকে তবুও মারজা এতে আক্ষেপ বোধ করে না। অনেকক্ষণ পর নিজের চিন্তাজগত থেকে বের হলো সিয়াম। সকলের দিকে একবার-একবার করে চোখ ঘুরাতেই বিচক্ষণ ব্যক্তির মতো বলতে লাগলো, 

  - আল্লাহ যা করেন সব মঙ্গলের জন্য করেন। রজনী মামী যদি মেহনূর ভাবীর ক্ষতি করে, মাহতিম দেশের যেপ্রান্তেই থাকুক ডাইরেক্ট এ্যাকশন নিতে দেরি করবো না। আমি ওরে নেংটাকাল থেকে চিনি, ওর ভিতরে কি বাস করে এইটা বাইরের কেউ আন্দাজ করতে পারবো না। ওর তেজের পরিমাণ যদি বাড়ে রে... থাক আর কইলাম না। খালি একটা কথাই বলুম, ওর জিনিসে যদি কেউ হাত দেয়, তাহলে মামা ইন্নালিল্লাহ জপা লাগবো। তরুণের পা কিন্তু জীবনেও ঠিক হইবো না। আর ওর টুনটুনিতে খালি একটা লাত্থি মারছিলো, ওমনেই শা'লার ব্যাটাগিরি জন্মের লিগা শেষ, বাকি জীবন যদি বাঁচে তাহলে ওর জীবনে সুখ-ফুখ নাই। উদাহরণ খালি একটা দিলাম, আরো যদি শুনতে চাস তাহলে কিন্তু ফ্ল্যাশব্যাকে যাওয়া লাগবো। 

থমথমে পরিবেশে তপ্তকর হাওয়া বয়ে গেলো। সবার মধ্যে যে ঔদাসীণ্যতা দেখা যাচ্ছিলো, সেটা এখন বিন্দু পরিমাণ নেই। ঠোঁটে-মুখে অদ্ভুত ভঙ্গির হাসি ঝুলছে সবার, চকচক করছে চক্ষুজোড়া। মাহতিমের পুরোনো দিনের ঘটনাগুলো স্মৃতিচারণ করতেই তৃপ্তিসূচকের হাসি ঝুলছে সবার। 

.
অন্ধকার গ্যারেজের ভেতর ফিসফিস ধ্বনির শব্দ শোনা যাচ্ছে। শব্দটা দেয়ালে-দেয়ালে বারি খেয়ে বারবার প্রতিধ্বনি হচ্ছে। গ্যারেজে আলো-বাতাস না থাকার জন্য শব্দ করে নিঃশ্বাস টানছে মেহনূর। গলায় শুকিয়ে শুকনো কাঠের মতো খড়খড়ে লাগছে, ডানহাতটা এখন মাহতিমের ঘাড়ের উপর রাখা। মাহতিম যে জিপের উপর বসিয়ে নিরবঘাতির জোর খাটাচ্ছে সেটা ধরতে পেরেছে মেহনূর। কোনোপ্রকার গর্হিত কাজ না করলেও একটু পরপর প্রচণ্ড জোরে শব্দ হচ্ছে। সেই শব্দটা কিসের শব্দ সেটা অন্ধকারের জন্য ধরা যায়নি। মেহনূরের একবার মনে হয়েছিলো মাহতিম হয়তো কিছু একটা ভাঙ্গছে, আবার মনে হয়েছিলো কিছু একটাতে ঘুষি মেরেছে, কিন্তু আসল ঘটনা কি সেটা পরিষ্কারভাবে ধরার সুযোগ নেই। মেহনূর কান্নার জন্য চোখ মেলে তাকাতে পারছেনা, চাপা-কান্নার জন্য চোখের পাতা ভারি হয়ে ফুলে গেছে, নাক দিয়ে নিশ্বাস টানতে হিমশিম খাচ্ছে খুব। মনকে শক্ত করে মাহতিমের উদ্দেশ্যে কাঁপা-কাঁপা সুরেই বলতে লাগলো, 

  - আপনি আমার উপর জোর খাটালে খুশী হন? কেনো এভাবে ধরে রেখেছেন? 

কথাটা যেনো গায়ে লাগলো মানুষটার। মেহনূরের হাতটা ঘাড় থেকে ঝটকা মেরে সরিয়ে দিলো। মূহুর্ত্তের মধ্যে শক্ত জুতার আওয়াজ হতেই মেহনূর বুঝতে পারলো মাহতিম কয়েক কদম পিছিয়ে গিয়েছে। একটু অবাক হলো মেহনূর। মুখে কিছু বললো না। অন্ধকারের মধ্যেই অবুঝ দৃষ্টিতে ড্যাবড্যাবে করে তাকিয়ে রইলো। মাহতিমের উপস্থিতি, মেজাজের অবস্থা, মুখের দশা, কোনোটাই মেহনূর আচঁ করতে পারলো না। বাঁহাতের উল্টোপিঠে ভেজা-ভেজা চোখদুটো মুছলো, গালটাও হাতের তালুতে খানিকটা মুছৈ নিলো। নাক টেনে পিটপিট করে তাকাতেই আকস্মিকভাবে সমস্ত দেহের উপর রোমান্ঞ্চকর অনুভূতির শিহরণ বয়ে গেলো। নিশ্বাসের উত্তাপ বেড়ে উঠলো দ্রুত, চান্ঞ্চল্যকর হৃদয় চনমনিয়ে উঠলো। দুটো হাতের মুঠো যেনো আঁকড়ে ধরলো ঘাড়টা। নখদর্পণে খামচে ধরলো ঘাড়ের চামড়ার স্তর। চোখে জমা অশান্ত অশ্রুগুলো নিঃশব্দে গাল বেয়ে পরতে লাগলো মেহনূরের, চোখদুটো বন্ধ করে রাখলো কয়েক চোখে জমা অশান্ত অশ্রুগুলো নিঃশব্দে গাল বেয়ে পরতে লাগলো মেহনূরের, চোখদুটো বন্ধ করে রাখলো কয়েক মূহুর্ত। নিচের ঠোঁটটা শক্ত করে দাঁতে কামড়ে রাখলো মেহনূর, একপর্যায়ে বাঁহাতটা ঘাড় থেকে নামাতে লাগলো আস্তে-ধীরে। প্রশস্ত কাধটার উপর হাত রেখে আবার মুঠোবন্দি করে খামচে ধরলো মেহনূর, ওমনেই ঠোঁট ভেদ করে অস্ফুট সুরে কঁকিয়ে উঠলো। তবুও খামচানো হাতটা কাধটাকে ছাড়লো না, আগের মতোই দৃঢ়তার সাথে আকঁড়ে ধরলো। কাধে থাকা সিলভার রঙের স্টারগুলো মেহনূরের বাঁহাতের তালুতে বিঁধে যাচ্ছে, হাতটা ক্রমশ রক্তাক্ত হচ্ছে। মাহতিমের জেলমাখা চুলগুলো মেহনূরের চোয়ালের সাথে স্পর্শ হচ্ছে বারবার। অদম্যভাবে মেহনূরের গলায় গাঢ় চুম্বনের উষ্ণতা ছাপিয়ে যাচ্ছে তখন। মেহনূর বিবশ হয়ে পরছিলো মাহতিমের উষ্ণ-সাহচর্যে, ধাক্কা দিয়ে সরানোর মানসিকতাও কাজ করছিলো না যেনো। ভয়াবহ ক্ষোভটাও ধূলিসাৎ হয়ে উবে যাচ্ছিলো মেহনূরের। ডানহাতটা ঘাড় থেকে নামাতে-নামাতে ক্লিন শেভের হালকা ধারালো গালটায় পরম মায়ায় রাখলো। ওই মূহুর্ত্তেই সকল আদরটুকু সমাপ্ত করে ঝড়ের মতোই ছেড়ে দিলো মেহনূরকে, দ্রুতগতিতে মুখ ঘুরিয়ে চলে গেলো গ্যারেজের বদ্ধ দরজার দিকে। মেহনূর শব্দ উৎসের দিকে কপাল কুঁচকে তাকাতেই তৎক্ষণাৎ চোখে আলো লাগলো ওর। সাথে-সাথে চোখ খিঁচুনি দিয়ে মাথা নুয়াতেই কিছুক্ষণের মধ্যে আলোর ভেতর চোখ সইয়ে ফেললো। স্বাভাবিক ভাবে চোখ পিটপিট করে তাকাতে নিলে হঠাৎ সৎবিৎ ফিরে পাওয়ার মতো সামনের দিকে তাকালো মেহনূর। তখনই দেখতে পেলো, গ্যারেজের দরজা খোলা, আর সূর্যের আলোটা ঢুকে যাচ্ছে সম্পূর্ণভাবে। এবার স্পষ্ট চোখেই দেখতে পেলো সাদা গাড়িটা গেইট পেরিয়ে চলে যাচ্ছে, সেটা আর ফিরে আসার ভঙ্গিতে নেই। মেহনূর জিপে বসা অবস্থায় হতবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে পরক্ষণে চোখ নামিয়ে কোলের দিকে তাকালো। নিজের ব্যথাযুক্ত ডানহাতটা আসলে বেশ খানিকটা কেটে গিয়েছে। সাদা ইউনিফর্মের দুকাধে সিলভার রঙের স্টার লাগানো ছিলো, কাধটা যখন অজ্ঞতাবশত খামচে ধরেছে তখনই স্টারের পাঁচটা চোখা মাথা নরম হাতের তালুতে ঢুকে গেছে। বেশ রক্ত ঝরছে এখন। তরতাজা লাল রক্তগুলো গলগল করে বের হতেই কবজি বেয়ে কনুইয়ে চলে এসেছে। রক্তের অবস্থা দেখে একটুও ভয় পায়নি সে। যেই জিপ থেকে নামতে নেবে ওমনেই আৎকে উঠলো মেহনূর, বিস্ফোরিত দৃষ্টি নিয়ে তাড়াতাড়ি জিপের ডেবে যাওয়া জায়গাটা হাত দিয়ে ছুঁলো। গোলাকার হয়ে ডেবে গেছে খানিকটা, সজোরে ঘুষি মারার জন্য এমনটা হয়েছে। তার মানে ---, আর ভাবতে পারলো না মেহনূর। অস্থির হয়ে জিপ থেকে নেমে গেলো, রক্তাক্ত হাতের দিকে বেখেয়ালী হয়ে আবার অশ্রুচোখে জায়গাটা স্পর্শ করতে লাগলো। মাহতিমের হাত কি ক্ষত হয়নি? মেহনূর অজান্তেই ' না ' সূচকে পাগলের মতো মাথা নাড়াতে লাগলো। ঠোঁট নাড়িয়ে একটাই শব্দ বলতে লাগলো, ' না, না, না, না, না, না ---- '। রক্তাক্ত হাতে জায়গাটা অনবরত স্পর্শ করছিলো মেহনূর, বর্ষণের মতো অশ্রু ঝরিয়ে মাথাটা নাড়াতে-নাড়াতে ' না, না ' উচ্চারণ করেই যাচ্ছিলো। হঠাৎ দৃষ্টি থমকে হাত স্থির হয়ে গেলো মেহনূরের, ঠোঁটদুটো খোলা রেখেই নিশ্বাস চালাচ্ছিলো সে। ভালো হাতটা দৃষ্টিলব্ধ বস্তুটার দিকে কাঁপা-কাঁপা ভঙ্গিতে এগিয়ে আস্তে করে মুঠোয় পুড়ে নিলো। বস্তুটা দূর থেকে কাছে এনে চোখের সামনে অন করলো। পাওয়ার বাটনটা অন করতেই সবার আগে নোটিফিকেশনের বার্তা দেখতে পেলো। নির্বাকভাবে সেটায় ক্লিক করতেই চোখের সামনে লেখাগুলো ভেসে উঠলো, 

  - তোমায় কোলে তুলেছিলাম মেহনূর। রাগটা দমন করার জন্য তোমার ঠোঁটদুটোতে চুমু খেতে চেয়েছিলাম। পারলাম না। গলার স্পর্শটা সাময়িক ব্যথা দিবে, কিন্তু আমাকে দেখার আর সুযোগ দিবে না। চলে যাচ্ছি।
.
.
.
চলবে...............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন