ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে রুপা। চুল গুলো মৃদু বাতাসে উড়ছে। উদাস হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। তুরানের বাসার ঠিকানা থাকলে বা পথ চেনা থাকলে বোধ হয় এক্ষুনি চলে যেতো। তুরান এখনো ফিরছে না কেন? কখন ফিরবে? রুপার চোখ আবার ছলছল করছে। কোন কিছুতে মন বসছে না। ইচ্ছা করছে সব কিছু ভেঙে চুরমার করে দিতে। তুরানের উপর দারুন রাগ হচ্ছে রুপার। তুরান কি জানেনা ওকে ছাড়া রুপার খুব বেশি কষ্ট হয়? একটু তাড়াতাড়ি ফিরতে পারে না? রুপা লুকিয়ে চোখ মুছে। ঠোঁট কামড়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করছে।
সাহেলা বেগম রান্না করছে তড়িঘড়ি করে। আজ রান্নায় খুব দেরি হয়ে গেছে। রুপার মা সাহেলা বেগমের কাজে সাহায্য করছে। দুই জন মিলে এক রাজ্যের গল্প জুড়ে দিলো।
সাহেলা বেগম মাংস ধুয়ে নিতে নিতে বললো,
-'তুই কিন্তু বেশ কয়েকদিন থাকবি। এত তাড়াতাড়ি যেতে পারবি না। আর রুপার আব্বুকেও আসতে বল।'
রুপার মা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
-' রুপা কে কয়েক দিনের জন্য বাসায় নিয়ে যেতে চাই। ও তো এখন প্রায় সুস্থ শুধু...!'
রুপার মায়ের কথা শেষ হওয়ার আগেই থামিয়ে দিয়ে সাহেলা বেগম বললো,
-' তোর বাসার সব কিছুই অপরিচিত রুপার কাছে। ও যদি স্বেচ্ছায় যায় তাহলে যাক। জোর করলে প্রবলেম হতে পারে।'
রুপার মায়ের মুখ টা মূহুর্তেই ফ্যাকাশে হয়ে যায়। চোখে পানি ছলছল করছে। চোখের পলকেই হয়ত পানি ফোঁটা গড়িয়ে পড়বে।
সাহেলা বেগম আবার বলল,
-' মন খারাপ করলি? কি করার বল? আমি যদি না থাকতাম তাহলে তো রুপা কে মেন্টাল হসপিটালে রাখা লাগতো। তোর মন খারাপের কি আছে এখানে? রুপা তো আমার বাসায়ই থাকে। ও কি এখানে অযত্নে থাকে? আর যে কোন হসপিটালে ওর সুস্থ হতে যত সময় লাগতো, এখানে অর্ধেক সময়ই লাগে নি।'
রুপার মা উদ্বিগ্ন হয়ে বললো,
-' আচ্ছা রুপা তো মানসিক ভাবে সুস্থ হলেও তো সম্পূর্ণ সুস্থ না। ওকে সম্পূর্ণ সুস্থ করতে দরকার হলে দেশের বাইরে নিয়ে যাবো। প্রনয় তো কয়েক মাস বাদে আসছে।'
এসব নিয়ে আলোচনা করতে করতে রান্না শেষ হয় সাহেলা বেগমের। রান্না শেষ করে টেবিলে খাবার সাজাচ্ছে সাহেলা বেগম। খাবার সাজানো শেষে যায় রুপার রুমে। রুপা রুমে নেই। সাহেলা বেগম আজকাল রুপার হাবভাব বুঝতে পারছে না। কেমন মনমরা হয়ে থাকে রুপা। প্রয়োজন ছাড়া কথাও বলে না । কোন একটা কারনে হয়ত মন খারাপ রুপার।
রুপার মা রুপা কে দেখতে এর আগে যতবার ই এসেছে ততবারই রুপা খারাপ আচরণ করছে। শুধু এই বারই ব্যতিক্রম হচ্ছে। রুপা বোধ হয় ধীরে ধীরে সুস্থ হচ্ছে, মিউচুয়াল হচ্ছে।
রুপার রুমের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এসব ভাবছে রুপা। এর ভিতর ডাইনিং রুম থেকে আজিজ চৌধুরী ডাক আসলো। সাহেলা বেগম দ্রুত পায় ডাইনিং রুমে যায়।
.
মেয়ের মানসিক উন্নতি দেখে খুশি তে আত্মহারা হয়ে যায় রুপার মা। সাহেলা বেগমের প্রতি কৃতজ্ঞতা দ্বিগুণ বেড়ে যায়। দুই জনের ধর্ম আলাদা হলেও বন্ধুত্বের সম্পর্ক টা কঠোর শক্ত। বোনের চেয়ে কোন অংশেই কম না। এমনকি অনেকে এদের দুই জনকে বোন ভাবে।
রুপার চুল গুলোর কথা ভেবে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে রুপার মা। কত লম্বা চুল ছিল! প্রতিদিন রুপা ঘুমাতে যাওয়ার আগের বেনী গেঁথে দিতো রুপার মা। হঠাৎ একটা এক্সিডেন্টে কি থেকে কি হয়ে গেলো! রুপার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ টা ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। আচমকা ঝড়ে সব কিছু তছনছ হয়ে গেলো। এসবের সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েছে রুপার মা। প্রতিনিয়ত এই কষ্ট বহন করে চলে। রুপার বাবা, ছোট ভাইটা কারো কষ্টই কম না। রুপা আবার একদম স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে। সেই প্রত্যাশায় দিন গুনছে সবাই। সবার প্রতিক্ষা রুপা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে। আগের রুপা হয়ে যাবে।
.
দুপুর পেরিয়ে বিকাল হয়ে গেলো। রুপার মা আসছে তাই আজিজ চৌধুরী আর সাহেলা বেগম কেউই অফিসে যায় নি। তিন জনে বসে বসে খোশগল্প করছে। রুপাও খাটের এক কোনায় বসে আছে। এই আড্ডার আসরে কোন রকম মন নেই রুপার। রুপা শুধু অপেক্ষা করে যাচ্ছে কখন তুরান আসবে? রুপার এমন উদাসীন ভাব ভাবাচ্ছে সাহেলা বেগম কে।
-' রুপা আমার সাথে বাসায় যাবে আম্মু? তোমার বাবা যেতে বলেছে। তোমার সব পছন্দের খাবার খাওয়াবো। নারকেল এর নারু বানিয়েছি অনেক তোমার জন্য।'
রুপার মা একটার পর একটা কথা বলেই যাচ্ছে। রুপা শুধু দায়সারা ভাবে হ্যাঁ, হুঁ বলে যাচ্ছে বা মাথা ঝাঁকিয়ে উত্তর দিচ্ছে। রুপা কিছুতেই রুপার মায়ের সাথে যাবে না। তুরান কে ছেড়ে কোথায়ও যাবে না। তাই এখান থেকে কোথায় যাওয়ার কথা প্রশ্নেই আসে না।
তুরান দেশের বাড়ি গেলো দুই দিন হয়ে গেলো এখানো আসছে না। রুপার পাগল প্রায় অবস্থা। মুখে কোন কথা নেই, ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়াও করছে না। রুপা রুপার মায়ের উপর বিরক্ত হচ্ছে খুব। মহিলা টা এখনো যাচ্ছে না কেন? আগে আসলে একটু থেকে চলে যেত। আর এবার ঘাপটি মেরে রয়েছে। কোথাকার কি সব গল্প জুড়ে দেয় রুপা বিরক্তিতে কপাল ভাঁজ করে ফেলে। রুপার মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে। কাউকে সহ্য হচ্ছে না। এসব ভাবতে ভাবতে বারান্দায় যায় রুপা। গেটের দিকে তাকাতেই দেখে তুরান এসেছে। রুপা আনন্দে চিৎকার করে উঠে। রুপার আনন্দ ধ্বনি তুরানের কানে গিয়ে পৌঁছলো। তুরান বারান্দার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে দেয়। তুরানের মা-বাবা দুজনেই এসেছে। তুরান ওর অসুস্থ বাবাকে ধরে বাসার দিকে নিয়ে আসছে। রুপা দৌড়ে সেখানে গেলো।
কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলো না কারন তুরানের বাবা-মার কারণে। রুপা কে দেখেই হেসে দেয় তুরানের মা। রুপাকে প্রথমে চিনতে অসুবিধা হলো তুরানের মায়ের কারন এর আগে যখন রুপা কে দেখেছে তখন রুপার চুল গুলো হাঁটু অব্দি ছিলো।
তুরানের মা খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো,
-' রুপা না তুমি? চুল গুলোর এই অবস্থা কেন? ইস কত বড় চুল গুলোর এই অবস্থা হলো কিভাবে!'
তুরানের মা রুপার চুল নিয়ে রিতিমত আফসোস শুরু করলো। তুরানের মা'কে রুপার বেশ লাগে। সহজ সরল ভঙ্গিতে কথা বলে তুরানের মা। রুপা উনাদের সাথে বাসা অব্দি গেলো। দুই জন দুই জনের দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে কিন্তু তেমন কিছু বলতে পারছে না। এমন অবস্থায় রুপার দাম বন্ধ হয়ে আসছে। তুরান শুধু বললো,
-' কেমন আছো রুপা?'
রুপা মাথা ঝাঁকিয়ে উত্তর দিলো। তুরান ভালো করেই বুঝতে পারছে রুপার এই দুই দিনে কষ্ট হয়েছে বেশ। চোখ গুলো ফুলে আছে রুপার। চেহেরায়ও বিষাদের ছাপ। রুপা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। তুরানের মা রুপা কে বসতে বললো । রুপা বাধ্য মেয়ের মত বসলো।
খানিক বাদেই তুরান আবার বাসা থেকে বের হলো হসপিটালের উদ্দেশ্য তুরানের বাবাকে নিয়ে। রুপার সাথে একান্তে আর কথা হলোনা। রুপার একাকিত্বের গল্পও শোনা হলো না। তুরানের মা একা বাসায় রইলো।
রুপার নিরুপায় হয়ে বসে বসে তুরানের মায়ের সাথে গল্প করছে। উনার সাথে গল্প করতেও মন্দ লাগছে না রুপার। কিন্তু মনে মনে তুরানের উপর চাপা অভিমান হচ্ছে। কিন্তু তুরানের বা কি করার? অনেক সময় সব বুঝে শুনেও আমরা প্রিয় মানুষটার উপর রাগ করি। এটাই বুঝি প্রেম?
রুপার বেশিক্ষণ গল্প করতে পারলো না। সাহেলা বেগম ডেকে পাঠিয়েছেন রুপা কে। রুপা চরম বিরক্ত হয়ে হনহন করে চলে গেলো।
রুপার মা আর সাহেলা বেগম বসে আছে সোফায়। রুপা কে দেখেই রুপার মা রাগি গলায় বলললো,
-' কোথায় গিয়েছিলে?'
রুপা নাকমুখ কুঁচকে বললো,
-' যেখানে ইচ্ছা গিয়েছিলাম।'
রুপার মা আর কথা বাড়ায়নি । কথা বাড়ালেও তাতে বিশেষ কোন লাভ হবে না।রুপা এমন উল্টাপাল্টা জবাবই দিবে।
রুপা রুমে চলে গেলো। রুপা রুমে চলে যাওয়ার পর সাহেলা বেগম বললো,
-' তুরান দের বাসায় গিয়েছিলো বোধ হয়। তুরানের বাবা-মা এসেছে।'
রুপার মা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
-' তুরান কে?'
-' এখানে ভাড়া থাকে। ইঞ্জিনিয়ারিং ফাইনাল ইয়ারে পড়ে ছেলেটা। খুবই ভালো ছেলে।'
-' রুপা কে একটু চোখে চোখে রাখিস। ওই বাসায় যেন বেশি না যায়। যত যাই হোক একটা ছেলের প্রতি একটা মেয়ের বা একটা মেয়ের প্রতি একটা ছেলের আকর্ষণ হতে কতক্ষন।'
সাহেলা বেগমের এসব নিয়ে ভাবা হয়নি তেমন। বিষয়টা আসলেই গুরুত্বপূর্ণ। নিজের সন্তান নেই বলে বোধ হয় এসব চিন্তা ভাবনা মাথায় আসেনি।
—
কয়েকদিন যাবৎ তুরান খুব ব্যস্ত। তুরানের বাবাকে হসপিটালে ভর্তি করানো হয়েছে। তুরানের বেশি ভাগ সময়ই কাটে হসপিটালে। রুপার সাথে ব্যস্ততার জন্য কয়েকদিন যাবৎ তেমন কথা হয় নি। মাঝে মধ্যে টুকটাক কথা হয়েছে। রুপা যে ভীষণ মন খারাপ করে আছে তা তুরান বুঝতে পারছে। হসপিটালে আসার সুবাদে তুরান এটাও জেনেছে যে সাহেলা বেগম একজন সাইকিয়াট্রিস্ট। রুপার মেন্টাল প্রবলেম এটাও বুঝতে পেরেছে তুরান। রুপার এই প্রবলেম টার জন্যই রুপার প্রতি ইমপ্রেসড হয়েছে তুরান। তাই এটা নিয়ে তুরানের কোন প্রকার প্রবলেম নেই। উপরন্তু তুরানের মনে হয় যে রুপার এই পাগলামি গুলোর জন্য সাইকিয়াট্রিস্ট কেন? থাকুক না এমন পাগলামি সারা জীবন। কিন্তু এই পাগলামির শুরুর কারন আর কবে থেকে শুরু এটা অবশ্যই জানতে হবে তুরানের। কিন্তু হসপিটালে সারাদিন দৌড়াদৌড়ির উপর আছে তুরান। রুপা বলেছিল ওর আম্মু এসেছে। তুরানের সাথে দেখা হয় নি । তুরানের ইচ্ছা ছিল রুপার মা নামক মানুষ টা কে দেখা। আর তুরান জানে রুপা ওর মা-বাবা কে সহ্য করতে পারে না। কিন্তু এবার বুঝি একটু চেঞ্জ হয়েছে রুপা। তাছাড়া রুপা আগের মত পাগলামিও করে না। রুপা এর আগেও অনেকবার বলেছে যে ওর আম্মু আসছিলো কিন্তু তুরানের সাথে কখনো দেখা হয় নি।
কালকে তুরানের বাবাকে বাসায় নিয়ে যাওয়া হবে। তুরানের বাবা এখন প্রায় সুস্থ। অন্যদিকে তুরানের টিউশনি, ভার্সিটি সব অফ। এ মাসে বেশ বন্ধ দিয়েছে টিউশনি। গার্ডিয়ানদের কথাও শুনতে হয়েছে, এখন আবার শুনতে হবে।
রুপার সাথে কবে যে আবার ভালোভাবে কথা হবে কে জানে? রুপা তো রাগের পাহাড় জমিয়ে রেখেছে। তাছাড়া রুপা কে নাকি এখন বেশ চোখে চোখে রাখে। তুরানের বাবা-মাও এখানে তাই কথা বলার সুযোগ হয়ে উঠেনা। তুরানের দম বন্ধ হয়ে আসছে।
.
রুপার মা আজ চলে যাবে। রুপার ছোট ভাই আর ওর বাবাও এসেছে । রুপার মন এখন বিষন্নই থাকে। সব কিছু আগের মত হয়ে যায় না কেন? রুপা একটা বিষয় বুঝতে পারছে যে রুপার বাবা-মা,ভাই নামক মানুষ গুলোকে আজকাল তেমন অসহ্য লাগে না । রুপা বাবা-মা চাচ্ছে কয়েকদিনের জন্য রুপা কে নিয়ে যেতে কিন্তু রুপা নারাজ। কিছুতেই এখান থেকে যাবে না। রুপার বাবা-মাও তেমন জোর করছে না। কারন তাঁরা চায় রুপা সব ভুলে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসুক। তাই ওর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু না করাই ভালো।
রুপার ছোট ভাই অন্তিম বার বার কাঁদো কাঁদো গলায় বলছে,
-' বাসায় চলো না দি। কতদিন তুমি বাসায় থাকো না। তোমায় অনেক বেশি মিস করি।'
বলতে বলতে চোখ গড়িয়ে পানি পরে অন্তিমের। রুপা শুধু অপরিচিত ভঙ্গিতে তাকায়। কি বলা উচিত বুঝে উঠে পারে না। যাওয়ার সময় রুপার বাবা-মা , অন্তিম সবাই কাঁদলো। এঁদের কান্না দেখে সাহেলা বেগমও না কান্না আটকিয়ে রাখতে পারলো না। রুপা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিরব দর্শকের মত সব কান্ড দেখছে। এতসব কান্নাকাটির মানেই বুঝতে পারছে না আর কারনও খুঁজে পাচ্ছে না।
.
রুপার মা-বাবা চলে গেলো। রুপার মন কেন জানি বিষন্নতায় ভরে গেলো। খুব একাকিত্ব অনুভব করছে রুপা। তুরানও আগের মত সময় দিচ্ছে না। সবকিছু অসহ্য লাগছে রুপার, চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। রুপা ড্রেসিং টেবিলের কাছে রাখা ফুলদানিটা ফ্লোরে আচরে ফেললো। বিকট শব্দ গিয়ে পৌঁছেলো সাহেলা বেগমের কানে। সাহেলা বেগম দৌড়ে রুপার রুমে আসলো।রুপা কে নানা ভাবে বুঝিয়ে শান্ত করলো।
কিন্তু রাতের বেলায় ভীষণ জ্বর আসলো রুপার গায়ে। জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে। সাহেলা বেগম রুপার পাশে বসে কপালে জলপট্টি দিচ্ছে। হঠাৎ এমন জ্বর আসার কারন খুঁজে পেলো না সাহেলা বেগম। রাত প্রায় বারোটা বেজে গেলো। রুপা ঘুমাচ্ছে না শুধু জ্বরে কাঁপছে। সাহেলা বেগম রুপার মাথার কাছে বসে রইলো। আজিজ চৌধুরীও অনেকক্ষণ সজাগ ছিলো। ধৈর্য হারা হয়ে শেষে ঘুমিয়ে পড়লো।
সাহেলা বেগম রুপার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে পরম আদরে। রাত একটার দিকে ঘুমিয়ে পড়লো রুপা। সাহেলা বেগম রুপার কপালে আলতো করে চুমু খেলো। রুপার পুরো রুমটা অগোছালো। সাহেলা বেগম দক্ষ হাতে নিঃশব্দে রুম গোছাচ্ছে।
হঠাৎ ড্রেসিং টেবিলের ফাঁকে একটা টিনের বক্স চোখে পড়ে। সাহেলা বেগম কৌতুহলী মনে বাক্সটা খুলে দেখলো। কতগুলো টুকরো টুকরো কাগজ। সাহেলা বেগম কাগজ গুলো খুলে দেখতে লাগলো। সাহেলা বেগমের মাথায় যেন বাজ পড়লো। বিস্ময়ে চোখমুখ কুঁচকে ঘামতে লাগলো। ধপ করে চেয়ারে বসে পরলো।
প্রথম যে কাগজটার ভাঁজ ভাঙলো সেটায় লেখা-
‘ ভার্সিটি যাচ্ছি আমি, তুমি খেয়ে নিয়ো কিন্তু, পাগলামি করো না কোন রকম।’
সাহেলা বেগম আবার একটা কাগজের ভাঁজ ভাঙলো! সেটায় লেখা-
‘ওই কালো শাড়ি টা আর নুপুর জোড়া পরে ছাদে এসো। কপালে ছোট্ট একটা টিপ দিয়ো।’
সাহেলা বেগম যেন হতবাক,নির্বুদ্ধি হয়ে যেতে লাগলো। আবার একটা কাগজের হাতে নিলো। সেটায় লেখা-
‘ মায়াময়ী আমি ভার্সিটি তে যাচ্ছি। লেট হয়ে যাচ্ছে আমার।’
সাহেলা বেগম হতভম্ব হয়ে বসে রইলো। এরকমটা কখনো ভাবতেও পারিনি। সাহেলা বেগম ভিমড়ি খেয়ে বসে রইলো। নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। রুপার বাবা-মা কে কি জবাব দিবে। তাঁরা এসব জানলে কি বলবে সাহেলা বেগম? এসব কখনো কি সম্ভব? ভুল পথে পা বাড়িয়েছে দুইজন। দুই জনের পথ এক হওয়া কখনোই সম্ভব না।
সাহেলা বেগম একে একে সবগুলো কাগজ পড়লো। তারপর ধীর পায়ে হেঁটে নিজের রুমে গেলো। আজিজ চৌধুরী ঘুমাচ্ছে। সাহেলা বেগম আজিজ চৌধুরী কে ঘুম থেকে জাগালো। হঠাৎ ঘুম ভাঙার কারনে থ মেরে বসে রইলো আজিজ চৌধুরী। সাহেলা বেগম এক গ্লাস পানি এনে আজিজ চৌধুরীর হাতে দিলো চোখে দেওয়ার জন্য। সাহেলা বেগম কে খুব বেশি অস্থির দেখাচ্ছে।
আজিজ চৌধুরী চোখে পানি দিয়ে বললো,
-' কি ব্যাপার ? পাগল হয়ে গেছো নাকি? এমন অস্থির দেখাচ্ছে কেন তোমাকে?'
সাহেলা বেগম হতাশ ভঙ্গিতে আজিজ চৌধুরীর পাশে বসলো। তারপর নিচু গলায় বললো,
-' ঘুম গেছে তোমার? জরুরি কথা ছিল?'
-' এত রাতে কি জরুরী কথা যে এভাবে ঘুম থেকে উঠালে? সকালে বলা যেতো না?'
খানিকটা বিরক্ত হয়ে কথা গুলো বললো আজিজ চৌধুরী। সাহেলা বেগম চিন্তিত গলায় বললো,
-'না এক্ষুনি বলতে হবে। আমার মাথায় কিছুই খেলছে না। কি করা উচিত আমার?'
আজিজ চৌধুরী এবার বুঝতে পারলো নিশ্চয় সিরিয়ার কিছু হয়েছে। নয়ত সাহেলা বেগম এমন করতো না। আজিজ চৌধুরী নড়েচড়ে বসে বললো,
-' কি হয়েছে বলো? চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন তোমায়?'
সাহেলা বেগম কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
-' রুপার সম্পর্ক চলে তুরানের সাথে।'
আজিজ চৌধুরীর চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো। কনফিউজড হয়ে বললো,
-' তোমার কিছু ভুল হচ্ছে মনে হয়। তুরানের মত মিউচুয়াল ছেলে রুপার সাথে সম্পর্কে জড়াবে? আর ওদের সাথে সম্পর্ক সম্ভব নাকি? তুরান কি জানেনা রুপা হিন্দু? আর তুরান সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসা ছেলে। কোন দিক থেকে ওদের সাথে যায়? তাছাড়া প্রনয়..।'
সাহেলা বেগম আজিজ চৌধুরী কে থামিয়ে দিয়ে বললো,
-' উফ! চুপ করো তুমি। এসব যাওয়া না যাওয়ার হিসেব বাদ দেও। আমাদের সতর্ক থাকা উচিত ছিলো।'
দুই জনই কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। নিরবতা ভেঙে আজিজ চৌধুরী বললো,
-' এখন তুমি কি করতে চাচ্ছো?'
সাহেলা বেগম হতাশ হয়ে বললো,
-' এসব যদি পূজার কানে যায় আমি কি করবো বলো?'
আজিজ চৌধুরী কিছুক্ষণ ভেবে বললো,
-'ওই ছোট লোকের বাচ্চায় আর মেয়ে খুঁজে পেলো না। ব্যাচেলর ছেলে ভাড়া দেই না। ছেলেটার ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে দয়া করে ভাড়া দিয়েছি। কি কান্ড টা করলো! ওরে ডেকে আনো। এক্ষুনি বেরিয়ে যেতে বলো সকাল হওয়ার আগে। রাতেই সব ঝামেলার মিটমিট হয়ে যাক। রুপা কিছু জানবে না।'
আজিজ চৌধুরীর আইডিয়া টা মন্দ না। সাহেলা বেগম বললো,
-' কিন্তু তুরান তো বাসায় না। ওর বাবার সাথে হসপিটালে। কালকের মধ্যে ওদেরকে বাসা থেকে বের করার ব্যবস্থা করো। আমি নয়ত ওরে পুলিশে দিবো। মানুষ সুযোগ সৎ ব্যবহার করবে এটাই স্বাভাবিক।'
তারপর দুই জন আবার চুপ করে রইলো। সাহেলা বেগমের এখনো এসব বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। বিস্ময়ে ফেটে পড়ছে। রুপা কে কত চেষ্টা করে এই পর্যায়ে এনেছে। আবার এই আঘাত কি রুপা সহ্য করতে পারবে? এসব রোগীরা এমনিতেই খুব সেনসেটিভ হয়। রুপা আবার কি পাগলামি শুরু করবে? চিন্তায় মাথায় ধরে যাচ্ছে সাহেলা বেগমের।
সেদিন যদি তুরানকে বাসা ভাড়া না দিতো তাহলে এইদিন দেখতে হতো না। সাহেলা বেগম চিৎকার করে উঠে বললো,
-' হসপিটালে ফোন দেও। ওদের এলাকা ছাড়তে বলো। হসপিটাল থেকেই যেন চলে যায়। ওদের সব মালামাল ঘর থেকে ফেলে দিতে বলো। ওরা যেন এই বাসার কাছে আর না আস্তে পারে সেই ব্যবস্থা করো। দরকার হলে পুলিশের সহায়তায় নেও।'