!!০১!!
"আমার স্বামী ছোট বাচ্চাদের মাংস খায়। ও বুবু শোনেন বুবু আমার স্বামী ছোট বাচ্চাদের মাংস খায় যে। হি হি হি।"
বলেই খপ করে মাহার হাতটা ধরলো সাদা এলোমেলো শাড়ি পরনে এক মহিলা। চুলগুলো জমাট বাঁধা, মুখের একপাশ দিয়ে লালা বেরুচ্ছে। ঈষৎ কালচে বদনের রঙ। ছিপছিপে পাতলা গড়নে শরীর। আহা! কি বিভৎস!
"আল্লাহ!" বলে চিৎকার করে উঠলো মাহা। তার হাতটা খামচে ধরেছে পাগলী। মাহার আকস্মিক চিৎকারে চা কিনা ফেলেই সেদিক পানে দৌড়ে এলো চৈতি। লোকজনের আনাগোনা নেই বললেই চলে। মধ্যাহ্ন পেরিয়ে গেছে অনেক আগেই। চৈতিকে দেখে চিৎকার দিয়ে উঠলো মাহা।
"চৈতি, চৈতি আমাকে বাঁচা। দেখনা আমার হাতটা খামচে ধরেছে। আর কিসব বলছে।"
পাগলীটা হু হা করে হেসে উঠলো। তবে মাহার হাতটা ছাড়লোনা। বিকট হাসি থামিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লো সে।
"ও বুবু, আপনার বিপদ আছে যে। আমার স্বামী মেয়েদের মাংসও খায় যে।"
চৈতি এগোনোর চেষ্টা করলো তাদের দিকে। পাগলী চৈতির দিকে ফিরে ক্ষিপ্ত গলায় বললো,
"এই একদম কাছে আসবিনা।"
ব্যথায় কুঁকিয়ে উঠলো মাহা। খামচির কারণে ফর্সা হাত রক্তে ভরে যাচ্ছে। মাহা কান্নামাখা সিক্ত গলায় চৈতির দিকে ফিরে বললো,
"দোস্ত বাঁচা আমাকে। অনেক ব্যথা পাচ্ছি হাতে।"
চৈতি কি করবে কিছুই বুঝতে পারছেনা। আশেপাশে লোকজন কম। চায়ের দোকানের মালিক দেখেও এগিয়ে আসছেন না। ব্যাপারটা বোধহয় উনার কাছে অনেকটা স্বাভাবিক। আশেপাশে নিজেদের গাইডকে খুঁজলো চৈতি। গাইডও পাশে নেই। হঠাৎ করেই আ আ চিৎকার।
চা বাগানের চৌকিদার একটা মোটা লাঠি নিয়ে তেড়ে এসে পাগলীকে আঘাত করেছে। পাগলী নিচে ছিটকে পড়লো। চৌকিদার খাজার শক্তপোক্ত শরীর। ইয়া বড় গোফ। পরনে লুঙ্গি, শার্ট আর উপরে কালো চাদর। মাহা ছাড়া পেতেই চৈতিকে জড়িয়ে ধরলো। আসরের আজান দিয়ে দিয়েছে দূরে। শীতকাল হওয়ায় ঠান্ডা হাওয়া বইছে চারদিকে। পাগলী উঠে তেড়ে আসতে চাইলো চৌকিদারের পানে। চৌকিদার আবার আঘাত করলো পাগলীর শরীরে। পাগলী চা বাগানের মাটিতে গড়িয়ে চিৎকার করছে। মাহা আর চৈতি ভয়ে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে আছে। পাগলীর দিকে একটা তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চৌকিদার এগিয়ে এলেন তাদের দিকে। শুদ্ধ বাংলায় বললেন,
"আপনাদের গাইড কোথায়?"
মাহা তখনো ভয়ে কাঁপছে। চৈতি মাহাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
"আমরা ঠিক জানিনা। উনি অনেকক্ষণ হলো একটা কাজ আছে বলে গিয়েছেন।"
"আসরের আজান দিয়ে দিয়েছে। একে তো পর্যটক তার উপরে মেয়ে মানুষ মালনীছড়া কতটা ভয়ংকর জানেন।"
চৌকিদারের ধমকে দুজনেই কেঁপে উঠলো। চাদরে ঢাকা মুখ চৌকিদারের। বয়স আটত্রিশ না আটান্ন ঠাউর করা দায়। কালো কুচকুচে বদন। হাতটা পেশিবহুল। হাতে মোটা লাঠি। চৈতির মনে হলো গ্রিক মাইকোলজির কোনো অজানা শোষক রাজা যেন এই চৌকিদার।
"আপনারা কোন হোটেলে...
চৌকিদার বলতে বলতেই পাগলী তেড়ে এলো চৌকিদারের পানে। মুখভর্তি লালা মিশ্রিত থু থু নিক্ষেপ করলো চৌকিদারের মুখে। চৌকিদারের চোখ দুটো হিংস্র হয়ে উঠলো।
" শু*রের বাচ্চা। খা*কির বেটিরে..
বলে পুরুষালী শরীরের জোরে মোটা লাঠি দ্বারা আরেকটা আঘাত করলো পাগলীর শরীরে। চোখের সামনে এসব নজির দেখে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে চৈতি। মাহারও কান্না থেমে গিয়েছে।
!!০২!!
পাগলী আবার মাটিতে পড়ে গোঙাচ্ছে। একবার উঁচু কাঁপা গলায় বললো,
"তোর মুখে আমি মুতি রে খাজা।"
একটা অশ্লীল, উচ্চারণে অযোগ্য গালি দিলো চৌকিদার। মুখের নিক্ষিপ্ত থুতুটা কালো চাদরের প্রান্ত দিয়ে মুছে আবার মাহাদের পানে তাকালো চৌকিদার। চারিদিকে ঝিঁঝি পোকার ডাক ভেসে বেড়াচ্ছে। কয়েকটা কাক কা কা করে দল বেঁধে উড়ে বেড়াচ্ছে আকাশে। চৌকিদার বললো,
"চলুন আপনাদের রিকশা করে দেই। কোন হোটেলে উঠেছেন?"
চৈতির কেনো জানি আসল তথ্য দিতে ইচ্ছে করলোনা। সে কাঁপা গলায় বললো,
"হোটেল ফরচুন। আর আমাদের গাইড?"
"আরে রাখেন আপনার গাইড। ঐ বেটা ভাগছে। এমন অনেক ঘটনা আছে। টাকা নিয়ে গাইড ভাগে। কালো, লম্বা মতন ছিলোনা ছেলেটা?"
"হুম।"
"মানিক্কায় হবে। সে এমনই। আপনারা চলেন। এখানে আর থাকাটা সুবিধাজনক না।"
শীতকালের বিকেল। ঠিক বিকেল না আর কিছুক্ষণ পর আকাশ চিড়ে অন্ধকার নামবে। হৃদপিণ্ডে হিম লাগানো অন্ধকার। চা বাগানের চারিপাশটা কেমন জানি নির্জন, নিরব। শীতকালে পর্যটক এমনিতেও কম থাকে। তবে এতোটা কম হবে চৈতি, মাহা কখনো ভাবেনি। তারা যখন চৌকিদারের পিছনে আসছিলো তখন পাগলী চিৎকার করে বলছে,
"লম্বা বুবু তোর বিপদ। অনেক বিপদ।"
লম্বা গড়ন মাহার। পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি। চৈতি মাহা থেকে দুই, তিন ইঞ্চি খাটো। মাহা কুঁকড়ে আছে ভয়ে। হাত থেকে গলগল করে রক্ত পড়ছে। চৈতির ডান হাতটা শক্ত করে ধরে আছে সে।
"পাগলীর কথায় কিছু মনে করবেন না। মাথা খারাপ মানুষ। উল্টাপাল্টা বকে। স্বামী ছিলো দাগী আসামী। পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। এরপর থেকেই এমন পাগলামি করে।"
বলে হাসার চেষ্টা করলেন চৌকিদার। যা অনেকটা বিভৎস দেখালো।
রিকশায় উঠে বসলো চৈতি আর মাহা। রিকশা চলছে মাজার রোডের দিকে। মাহা চুপ করে চৈতির কাঁধে মাথা রেখে বসে আছে। ক্ষণেক্ষণে কেঁপে উঠছে সে। চৈতি একহাতে জড়িয়ে ধরে রেখেছে তাকে। সকালেও কতটা খুশি ছিলো তারা! চোখ বুজে সকালের ঘটনাগুলো মনে করার চেষ্টা করলো চৈতি।
!!০৩!!
সিলেটে পৌঁছে হোটেল মুসাফিরে উঠেছে আতিয়া জামান চৈতি আর মাহা হোসেন। জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স তৃতীয় বর্ষে পড়াশোনা করছে দুজনে। সমাজবিজ্ঞান অনুষদে সেরা বান্ধবী যুগল বলে বেশ খ্যাতি তাদের। সিলেটে আসার পিছনে যদিও একটা কারণ আছে তবে সেটা স্বীকার করতে চায়না মাহা। চৈতি জানে মাহা তার প্রিয় অচেনা মানুষটার সাথে দেখা করতেই সিলেট এসেছে। সেই বহু আকাঙ্খিত মানুষ। গত ছয়টা মাস ধরে যার কথা মাহার মুখে শুনতে শুনতে পাগল হওয়ার উপক্রম ছিলো চৈতির।
"আমরা কোথায় যাচ্ছি আজ?"
চৈতির প্রশ্নে মাহা মিষ্টি হেসে বলে,
"লাক্কাতুরা চা বাগান তারপরে মালনীছড়া।"
"খুব খুশি মনে হচ্ছে আপনাকে? হুম? ব্যাপার কি?"
"ব্যাপার কিছুই না।"
চৈতির অদ্ভুত তাকানোতে মাহা আবার লাজুক হেসে বললো,
"ও বলেছে পরশুদিন দেখা করবে আমার সাথে।"
"বাহ্বা, তাই আমাদের লাজুকলতা এতো লজ্জা পাচ্ছে বুঝি?"
"চৈতি, ভালো হবেনা কিন্তু। কেন লজ্জা দিচ্ছিস।"
খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো চৈতি। মাহাটা না বড্ড লাজুক।
বেলা বারোটায় সকল ক্লান্তি ঘুচিয়ে দুজনে মিলে রওনা দিলো লাক্কাতুরার পথে। তাদের সিলেটি বান্ধবী রুমানা খুব করে বলেছিলো তার বাসায় উঠতে তবে তারা হোটেলেই উঠেছে। রুমানার মা অসুস্থ হওয়ায়ও সেও ওদের সাথে সিলেট এসেছিলো। আজ ঘুরতে আসতে পারেনি বলে বার কয়েক মাফও চেয়েছে। হালকা কুয়াশা চারদিকে। এখনো সাদা, ধূঁয়াটে কুয়াশা কাটেনি। রিকশা করে লাক্কাতুরা যাওয়ার পথে দুইপাশে ঘন সবুজ চায়ের বাগান। টিলা গুলোর উপরে স্তরে স্তরে সাজানো চায়ের বাগানে কাজ করছে কত মানুষ।
লাক্কাতুরা পৌঁছে গেট দিয়ে ঢুকার সময় কয়েকটা কিশোর বয়সী ছেলে চাঁদাবাজি করে। তাদের কিছু টাকা দিয়ে পরে ঢুকতে হয়।
"দেখলি চৈতি কেমন বেয়াদব ছেলেগুলো। ওদের কাছে কোনো কার্ড আছে! আমরা কেন টাকা দিবো ওদের?"
"তবুও তোর ঝগড়া করাটা ঠিক হয়নি।"
"তুই সারাজীবন ভীতুই থাকবিরে চৈতি।"
"হ্যাঁ, আর আপনি সাহসী মহারাণী।"
"তা অবশ্য বলতে পারিস। আমি মাইন্ড করবোনা।"
মাহার কথার ধরনে খিলখিলিয়ে হেসে উঠে চৈতি। আজ দুজনে গোলাপি রঙের উপর নীল ডোরাকাটা থ্রি-পিছ পড়েছে। উপরে নিয়েছে কাশ্মীরী চাদর। মাহাকে বেশি সুন্দর লাগছে বলাই বাহুল্য। সাদা ফর্সা বদনের রঙ। লম্বাও অনেক। সব দিক দিয়ে পারফেক্ট। চৈতি অনেকটা হলুদ ফর্সা। মাহার মতন আগুন সুন্দরী না হলেও বেশ মায়াবী।
"আপা, গাইড লাগবো?"
লাক্কাতুরা ঘুরার সময় পিছন থেকে বলে উঠে একজনে।
"এই মাহা শুন?"
"কি?"
"মালনীছড়ায় শুনেছি অনেক প্যাঁচানো পথ। গাইড নিয়ে নেই?"
ছেলেটার আড়ালে কথোপকথন চালিয়ে আড়াইশত টাকায় গাইড ঠিক করে নিলো তারা। মালনীছড়া এক অসাধারণ জায়গা। মাঝে মেঠোপথ। দুইপাশে কাঠবাগান। রাবার বাগান। অদ্ভুত রাবার সংগ্রহ করার কৌশল । যেদিকে তাকায় কেবল চা বাগান আর চা বাগান। মাহা আর চৈতি অবাক নয়নে উপভোগ করলো সেই অপরূপ দৃশ্য। সবুজের সায়রে ভেসে বেড়ালো দুজনে। ছবি তুললো।
"এই চৈতি ঐ যে কেমন দু টুকরো কাপড় পরে চা পাতা তুলছে মহিলারা। এদের লজ্জা করেনা?"
"এসব বলতে নেই। এরা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী। এই কাপড়কে বলা হয় ফতা। এসব পোশাকই ওদের সংস্কৃতি।"
"তা অবশ্য ঠিক বলেছিস।"
মাহা, চৈতি যখন প্রকৃতি উপভোগে ব্যস্ত তখন সুযোগ বুঝে গাইড ছেলেটা বললো,
"আপা, আমি একটু আসতেছি।"
"মানে কই যাবেন আপনি। আমরা আরো ঘুরবো তো।"
মাহার উচ্চকণ্ঠ। ছেলেটা কাচুমাচু হয়ে বলে,
"ইয়ে মানে একটু..
ইঙ্গিত ধরতে পেরে চৈতি বলে,
" মাহা যেতে দে।"
অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পরেও ছেলেটার খোঁজ নেই। মাহা তো পুরো রাগে গজগজ করছে। চৈতি তখন চা আনতে গেলো পাশের দোকান থেকে। তারপর......
হঠাৎ থেমে যায় চৈতিদের রিকশা। মাহা ঘুমিয়ে পড়েছে চৈতির কাঁধে। চৈতির ডান হাতটা শক্ত করে ধরা। রোডের ধারে হালকা সোডিয়াম বাতির আলোয় মাহার মুখটা দেখে বুকটা কু ডেকে উঠলো চৈতির। কি হতে যাচ্ছে সামনে!
.
.
.
চলবে............................