যদি বলি ভালোবাসি - পর্ব ০৫ - ফাবিয়াহ্ মমো - ধারাবাহিক গল্প



-খুব সাহস বেড়ে গেছে তাই না! থার্ড ক্লাস মেয়ে কোথাকার! কলার ছাড়!

 মুগ্ধ ভাইয়া আমার কলার ধরা হাতে নখ বসিয়ে দিলেন। আমি হাতে নখের ব্যথা পেয়ে "আহ্" করে ছেড়ে দিলে উনি কলার ঠিক করতে থাকেন। চুলগুলোতে হাত লাগিয়ে সামনে থেকে পেছনে টেনে আমার দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকালেন। আমি হাতে ফু দিচ্ছি...জ্বালা করছে খুব...মুগ্ধ ভাইয়া আমার সামনে ট্রাউজারের পকেটে হাত ঢুকিয়ে...অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে গম্ভীর স্বরে বলে উঠলেন-

-ইউ নো? তোর মতো হাজারটা মেয়ে মুগ্ধের পিছনে মাথা ঠুকে...বাট আমি তাদের এক সুতা পরিমান পাত্তা দেইনা! তোকে যেমন ঘাড়ে তুলেছিলাম ওমনেই এক আছাড় মেরে মাটিতে ফেললাম। কি ভেবেছিস ছেলেরা তোর পেছনে ঘুরঘুর করবে? ওহ্ প্লিজ! তোর ছায়াও আমার লাইফে টোলারেট করবো না! তোর এই থার্ড ক্লাস মাইন্ড এন্ড চেহারা নিয়ে গেট লস্ট! আই সেড লিভ!

মুগ্ধ ভাইয়ার কথা শুনে পাশ থেকে মেয়েটা হোহো করে করতালি বাজিয়ে হাসছে...উনি আবারো আমাকে কুৎসিত বলে অপমান করলেন, ভেতরে কান্না জড়িয়ে আসছে..আমি হাত মুষ্টিবদ্ধ করে শক্ত হয়ে আছি।। থম মেরে দাড়িয়ে থাকলে ভাইয়া পকেট থেকে হাত বের করে একটু কাছে আসলেন আমার....মনেমনে আশার আলো খুজছি..প্লিজ ভাইয়া যেন বলে উঠেন এসব উনি নাটক করেছেন, এগুলো মিথ্যে অভিনয়, ভুতনি মেয়েটা উনার কেউ না! কেউ না মানে কেউ না! মুগ্ধ ভাইয়া সামনে এসে "ঠাসসস" করে আমার গালে চড় মেরে দিলেন। মেয়েটা হাসি থামিয়ে তালি দেয়া বন্ধ করে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে....আমি গাল ধরে কান্নায়, লজ্জায় কাপছি। আজ পযর্ন্ত আম্মু আব্বু ভাইয়া ভুলেও আমার উপর হাত তোলেনি! আর উনি আমায় চড়........
আমি কান্নায় ছলছল চোখে উনার দিকে তাকালে মুগ্ধ ভাইয়া আঙুল তুলে বলে উঠলেন-
-তুই এটার যোগ্য! আন্ডারস্টেন্ড!তুই আমার থাপ্পড়ের যোগ্য! আর যদি আমার সামনে আসতে দেখি, রাস্তায় টেনে আবিরের সামনে তুখোড় ইনসাল্ট করবো!বেরিয়ে যা এখান থেকে! আই সেড লিভ !

আমি অতি কষ্টে ঢোক গিললাম...কান্নায় গলা বসে যাচ্ছে...গাল গড়িয়ে পানি....আমি কাদছি ভাইয়া সেটা একদম তোয়াক্কা করছেননা। মুগ্ধ ভাইয়া আমায় যেতে বলে এক সেকেন্ডও থামলেন না.. আমার হাত টেনে ছাদের গেট থেকে ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দিলেন। মুখের উপর ধাম করে দরজা লাগিয়ে দিলেন। আমি গালে হাত দিয়ে দাড়িয়ে আছি...চরম ধাক্কায় পড়ে গিয়েছি...কখনো আমি বিনোদনের পাত্রী হইনি...সবাই আমার দিকে চোখ তুলে তাকাতে পযর্ন্ত হিমশিম খায়, আমার রাগের কাছে সবাই হার মানে...উনি আমায় রাগ দেখিয়ে, অপমান করে, থাপ্পর মেরে, তাড়িয়ে দিলেন? কিছুক্ষন ওভাবে বন্ধ দরজার কাছে দাড়িয়ে থেকে সিড়িতে পা ফেলে চলে আসতে নিলাম। গাল হাত রেখে সিড়ি দিয়ে নামছি...চোখ থেকে বড় ফোটায় পানি ঝরছে...চিৎকার করে কাদতে পারলে মনের কোনায় শান্তি পেতাম...শান্তি।। কাদতে কাদতে নিচতলায় নামলে রাফিয়া এক ভাড়াটিয়া মহিলার সাথে কি বিষয়ে যেন আলাপ করছিল। আমাকে দেখে দুজনেই চুপটি হয়ে গেলেন...আমি আস্তে আস্তে সিড়িতে পা ফেলে নামছি, গালে হাত, চোখের পলক ফেলা স্থির, পানি পড়ছে সময়ে সময়ে.....রাফিয়া আমার দিকে তাকিয়ে ভাড়াটিয়া মহিলাকে দরজা লাগিয়ে দিতে বলল। আমি ততক্ষনে রাফিয়াকে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছি। আলাপ স্থগিত করে রাফিয়া আমার রাস্তা আটকে জিজ্ঞেস করলো-
-মম আপু কি হয়েছে তোমার? এই কাদছো কেন? আপু? গালে কি হয়েছে? আপু তুমি শুনছো? 

আমি এখনো চুপচাপ নিরবতা পালন করে কাদছি। রাফিয়া তার প্রশ্নের জবাব না পেয়ে আমার দুই বাহু ঝাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো-
-আপু তুমি চুপ করে আছো কেন? মম আপু তুমি এখানে? তোমায় কেউ কিছু করেছে? দেখো তুমি একবার বলো আমি ওর ঠাট ফাটিয়ে দিয়ে আসবো। মম আপু বলো না...

আমি গাল থেকে হাত সরিয়ে অস্ফুট কন্ঠে বলে উঠলাম-
-রারাফিফিয়া.... থাপপপ্পর..
রাফিয়াকে কিছু বলতে যেয়ে থেমে গেলাম। কি বলবো? মুগ্ধ ভাইয়া এক বাইরের মেয়ের সামনে আমাকে বেজ্জতি করলেন? থাপ্পড় মারলেন?কি বলবো? কিছু না বলে বাসার দিকে চলে আসতে নিলাম। রাফিয়া পেছন থেকে অনেক বার জিজ্ঞেসা করেছে কি হয়েছে, কেন কাদছি...আমি আমার মতোই হেটে চলে আসলাম বাসায়। 

.
.
বাসায় এসে রুমে ঢুকে ফ্লোরে বসে আছি। হাটু তুলে মাথা লাগিয়ে নিচের দিকে ঝুকে আছি। গোলাপি কামিজটা চোখের পানিতে ভিজে গেছে...আম্মু অনেকবার দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য ডাকলেও যাইনি। খাওয়ার ইচ্ছে নেই। চোখ বন্ধ করে শান্তি খুজে পাচ্ছিনা বারবার সেই অপমানকর অবস্থা ভেসে উঠছে...মুগ্ধ ভাইয়া ছোটবেলায় অনেক হাত তুলতেন কিন্তু সবার সামনে এভাবে অপমান করে কথা শুনাতেন না...ভুলটা আমারই ছিলো কাল উনাকে পার্সেল নিয়ে ওভাবে কথাগুলো না বললেও পারতাম। উনি খুব আত্মসম্মানবোধ মানুষ আমার ঘিলুতে মনে ছিলো না। তাহলে আজ থেকে উনার সামনে যাবো না? উনিও কি সামনে আসবে না? সামনে না আসলে রাগ দেখাবো কার সাথে? কেন এমন হতে গেল? সিনেমা এবং বাস্তবজীবনে দেখেছি..  ছেলেরা মেয়েদের মন জয় করে সম্পর্কে জড়ায়, রাস্তা ধরে এক পলক দেখার জন্য দিনরাত এক করে, মেয়েদের ফলো করে....আরো কত কি!! কিন্তু উনি তো প্রথম ধাপেই আমাকে সরিয়ে দিলেন? অভিমানের বাধ না ভাঙিয়ে উনি আরেকজনের দম্ভে চলে গেলেন? এটাই কি শেষ? শেষটা এমন জঘন্য হবে? জানি না.....

সন্ধ্যা সাতটা। ভাইয়া দরজা ভেঙ্গে আমার রুমে ঢুকার চেস্টা করছেন। আমি এখনো দুপুরের ঘটনার পর সেই যে রুমে ফ্লোরে বসেছি...একবিন্দু নড়েচড়ে বসেনি। ভাইয়া দরজার ওপাশ থেকে চেচাচ্ছেন-

-সিনু শয়তান দরজা খোল! আমি দরজা ভেঙ্গে ঢুকলে তোর খবর আছে! দরজা খোল! তুই দুপুরে না খেয়ে বসে আছিস!খোল সিনু!কোন আকাম করে আসছিস বদমাইশ! কিরে খুলতে বলছিনা!  

ভাইয়ার সাথে আম্মুও চেচাচ্ছেন। কিন্তু আম্মুর গলার স্বর নরম বিধায় কিছু শোনা যাচ্ছেনা মিরা আপুও ভাইয়ার সাথে "দরজা খোল মম" বলে ধাক্কাচ্ছেন। আমি দরজা না খুললে শেষে ভাইয়া দরজা থেকে চলে যান। ভাইয়ার আওয়াজ এখন নেই...আম্মু আপুর হুংকার শোনা যাচ্ছে। আমি চুল ছড়িয়ে বসে আছি। ভেজা চুলে বসেছিলাম চিড়ুনি লাগিয়ে আচড়ানোর ধ্যান নেই। হঠাৎ ধুপ করে জানালার ওখান থেকে শব্দ হলো। আমি মাথা উঠিয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে দেখি ভাইয়া হাত ঝারছেন। আমার দিকে তাকিয়ে হাত ঝেড়ে পাশে ফ্লোরে বসে পড়লেন। আমার হাতে হালকা একটা ঘুষি মেরে সামনের চুল সরিয়ে বলে উঠলেন-

-বদমাইশ হাদা বান্দর! সকালে কি না কি খেয়েছিস আবার দুপুরে না খেয়ে বসে আছিস! কুটনি কোথাকার! তোকে না বলছি না খেয়ে রুমে বসে থাকবিনা! অফিস থেকে এসেই শুনি ঘরের কুকাম বদমাইশের হাড্ডি না খেয়ে বসে আছে!

ভাইয়া আমার সামনে বিপরীত হয়ে বসলেন। আমার মুখের উপর থেকে চুল সরিয়ে লম্বা চুলের মুঠো আকড়ে খোপা পেচিয়ে দিলেন। মাগরিবের আযান দিচ্ছে চারদিক থেকে। রুম অন্ধকার। ভাইয়া লাইট জালিয়ে জানালায় পর্দা টেনে আবার সামনে এসে বসলেন। চোখের পানি মুছিয়ে টেনে উঠিয়ে বিছানায় বসিয়ে বললেন-

-সিনু তুই যে কাদছিস আমি জানতাম। রুমে দরজা আটকে কাদার স্বভাব আছে তোর। এখন বল কি হয়েছে...রাফিয়া এসে আমার কানে বলে গেছে তুই কাদছিলি। কি হয়েছে ঝটপট বল,
ভাইয়া আমার সামনে বসে কারন জানতে চাচ্ছেন। আমি কোন মুখে বলব..যাকে সহ্য করতে পারিনা বলে দূরে থাকতে বলেছিলাম..আজ তার কাছে আমি নিজেই চলে গেছি??? ভাইয়া কাল রাতে আফসোসের কথা বলছিলেন...সত্যি আমি চরম আফসোস করছি। নিজের অজান্তে করা পাকনামির আফসোস...

-ভাইয়া আমি মুগ্ধ ভাইয়ার বাসায় গিয়েছিলাম, উনি এক পেত্নীর সাথে লুতুপুতু করছিলেন...আমি যেয়ে অনেক কথা শুনালে উনি থাপ্পড় মেরে অপমান করেন...আমাকে ধাক্কা মেরে তাড়িয়ে দেন ভাইয়ু...এই দেখো আমার হাতে নখ বসিয়ে দিয়েছে.....
আমি ফুপিয়ে কাদলে ভাইয়া আমার হাত ধরে দেখতে লাগলেন...নখ বসানো জায়গাটা চাদের মতো চিকন আকার ধারন করে রক্তিম হয়ে আছে... রক্ত জমে টুসটুসে। ভাইয়া এক শ্বাস ছেড়ে বলে উঠলেন-
-সিনু আমি আগেই বলেছিলাম তুই আফসোস করবি...আজই আফসোস করবি অবাক লাগছে। একটা কথা বলি মন দিয়ে শোন, ছেলেরা মেয়েদের পিছে ঘুরলে মেয়েরা ভাব দেখাবে এটা যেমন সত্য...মেয়েরা মনের কোথাও আঘাত করলে ছেলেরা মুখ ঘুরিয়ে নিবে এটাও কঠিন সত্য। তুই ওকে কষ্ট দিয়েছিস...কি বলেছিস আমি এখনো শুনিনি। শোনার ইচ্ছে নেই। কিন্তু কাল রাতে আড্ডা শেষে কাধে হাত রেখে রিকুয়েস্ট করেছিলাম তোর থেকে যেমনেই হোক দূরে থাকতে। তোকে থাপ্পড় মেরে অপমান করে দূরে পাঠাবে.............
এক দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লেন ভাইয়া। আযান শেষে আমার রুমে একটা বেশি শব্দ নেই....ভাইয়াও চুপ, আমি একটু বেশি চুপ। ভাইয়া চুপ থেকে বলে উঠলেন-
-নামাজ পড় যা। আযান দিয়েছে। আমি মসজিদে যাচ্ছি। মুগ্ধ ওর কথা ও কাজে এককেন্দ্রিক....তোর সামনে আসবে কিনা তা নিয়ে আমার সন্দেহ হচ্ছে। আমি তোর ভাই হিসেবে অনুরোধ করলে সম্ভবত মুগ্ধ বন্ধু হিসেবে প্রতিজ্ঞা দিয়ে দিবে...আমার হাত বাধা সিনু....যা ওজু করে নে...

ভাইয়া বিছানা থেকে উঠে দরজার কাছে চলে গেলেন। আমি কান্না চোখে তাকিয়ে দেখছি। আবির ভাইয়া নিরুপায়....উনি বন্ধুত্ব এবং ভাইয়ের বন্ধনে ফেসে আছেন।ভাইয়া দরজার সিটকিনি খুলে মাথা ঘুরিয়ে বাকা হেসে বলে উঠলেন-

-সিনু কেউ বলেছিলো, এভ্রিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ এন্ড ওয়্যার.....আশাকরি বুঝেছিস।।

ভাইয়া দরজা খুলে বাইরে গেলে আম্মু আপু দরজা খোলার  শব্দ শুনে ভাইয়াকে ঘিরে ধরে। ভাইয়া উনাদের নিয়ে চলে গেলেন। কানে আসলো, "সিনুর মুড সুইং একা ছাড়ো, ঠিক হয়ে যাবে"। ভাইয়ার লাস্ট কথাটা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, "এভ্রিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ এন্ড ওয়্যার"....প্রেম(ভালোবাসা) এবং যুদ্ধে সব জায়েজ। সব জায়েজ....হঠাৎ প্রথম ওয়ার্ডটায় মগজ আটকালো..."প্রেম"। প্রেম মানে ভালোবাসার শেষ পর্ব। ব্যস জবাব পেয়ে গেছি!....কি করা উচিত ভাইয়া ইনিয়ে বিনিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন। নখ বসানো হাতটা চোখের সামনে এনে আরেকহাতে চোখ মুছে নিলাম....প্রাপ্য জিনিসটা পাওয়ার জন্য যুদ্ধ চালিয়ে জয়ী হতে হবে!! এটাই তো নিয়ম তাইনা??তবে সেটাই চলুক.... বিছানা থেকে আমিও নেমে ওয়াশরুমে গেলাম..ওজু করে নামাজ পড়তে হবে তো!! আল্লাহ চাইলে এই জনমসহ পরবর্তী জনমেও প্রাপ্যটা পেতে পারবো!!

নামাজ শেষে সোফায় বসে আছি। ভাইয়া পাশে প্লেট হাতে নিজেও খাচ্ছেন আমাকেও খাইয়ে দিচ্ছেন। অফিস থেকে এসে আমার জন্য অপেক্ষা করতে করতে বেচারা মাত্র পেটে খাবার তুলার জো পেলেন। আজ দুজন বসে ফ্লিম দেখছি, তামিল এ্যাকশন রোমান্স ফ্লিম। ভাইয়া আমার মুখে খাবার তুলে বলে উঠলেন-
-সিনু নায়কটা দেখছিস পুরাই কামলা আর নায়িকাটা যা ঝাক্কাস! এমন একটা ভাবি খুজিস তো...গার্লফ্রেন্ড ছাড়া পুরাই তেজপাতা হয়ে আছি। 

আমি খাবার মুখে নিতেই মিরা আপু পাশের রুম থেকে কাশতে লাগলেন। জোরে কাশছেন....কাশির আওয়াজ যে কমবে তা না উনি রীতিমতো পানি খেতে ডয়িংরুমের পাশ দিয়ে ডাইনিং রুমে চলে গেলেন... একবার আমার দিকে,  আরেকবার ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে যক্ষ্মা রোগীর মতো কাশাকাশি শুরু করলেন...ইশশশ..গলায় পানি দেওয়ার বড্ড প্রয়োজন যে...ভাইয়া বলে উঠল-
-কিরে মিরা গলায় মরিচের টুকরা গেলো নাকি...যা যা পানি খা...তুই তো কাশতে কাশতেই অক্কা পাবি...

আমার তো মিরা আপুর কাশির মধ্যে  অন্য রোগের গন্ধ লাগছে...উহুউহু.... যক্ষ্মা রোগের কাশি না বাচ্চু এটা যক্ষ্মা রোগের কাশি না...মিরাপু তুম ভি গ্রেট হো!! আমি মুখভর্তি লোকমা নিয়ে টিপেটিপে হাসছি...ভাইয়া চোখ বলদা ইলিশের মতো পলকহীন ভাবে তাকিয়ে আছে। আমি হাসি থামিয়ে খাবার চিবিয়ে সুন্দর করে গিলে বত্রিশ দাতের দুইপাটি দন্তের ভেটকি মেরে বললাম-

-ভাইয়ু তলে তলে কি চলে??? উম?? নায়িকা নায়িকা??? কুতু কুতু???

-তোর দাত দেখাইস না বদমাইশ! ব্যাকাত্যাড়া দাত দেখলে কুত্তা দুপায়ে দাড়ায়া থাকবো!
-ভাইইইইইইই... আমার ত্যাড়াব্যাকা দাতই ভালো বুঝছো! তোমার মতো মাইনকা চিপার রাস্তা মাপি না!
-তুই কোন গাছের ধোয়া তুলছি পাতাটা ওইটাতো একটু আগে রুমের মধ্যেই দেখলাম...
-তুমি যে লজ্জাবতী গাছের চিপা পাতাটা ওইটাও এখন দেখলাম!!! হি হা হা!!
-খাওয়া শেষ কর শয়তান! রুমে যা!
.
.
রাতের খাবার কিছুক্ষণ আগে শেষ করে আসলাম। একমাত্র ভাইয়া আর আব্বুর জবরদস্তিতে গলা সমান খাবার খেয়ে এসেছি...পেট ফুলে শেষ...গরমের জন্য কামিজ পাল্টে টিশার্ট পড়ে বিছানায় শুলাম। ফোন নিয়ে ফেসবুকে ঢুকার আগে চিন্তা করছি কি করা উচিত। ভাইয়ার কথানুযায়ী এক ডোজ দিবো নাকি! রাতের ঘুমটা একটু বাজিয়ে দিলে বেস্ট হয়! শয়তানি হাসি মেরে ফোনে ডায়াল করলাম নাম্বারটা...স্ক্রিন ভেসে উঠলো "Mugdho"।এই ফোনটা ভাইয়ার।। কালকের ভিডিওটার পর থেকে আমার ফোন উনার কাছে... উনার ফোন আমার কাছে থাকে। সেইফটি নিয়ে ভাইয়া কাজটা করেছেন। ফোন রিসিভ....মুগ্ধ ভাইয়া ঘুমের ঢলে কথা বলছেন-

-হ্যা আ..বির....বল...
-..............................(আমি চুপ)
-হাবলু ঘুমের বারোটা বাজিয়ে কল করলি কেন! জানিস না আমার হসপিটালে যেতে হবে!
আহা বেচারা!! হসপিটালে যাওয়ার প্ল্যান এখনি করে নিচ্ছে। বলে রাখি মুগ্ধ ভাইয়া একজন ডক্টর। অতি ট্যালেন্টটেড মানুষ হলে যা হয় আরকি...বিদেশ থেকে পড়াশোনা করে দেশে এসে ডাক্তারি!!

-আবির আমি রাখবো?
-.........................(আমি চুপ করে শুনে মুখ ঢেকে হাসছি)
-আবির!
-......................
-সিনু! থার্ড ক্লাস! ক্যারেক্টারলেস বজ্জাত! সোজা হবি নাতো! ওয়েট এন্ড ওয়াচ... থার্ড ক্লাস মেয়ে! তোর অবস্থা যদি শেষ না করি!

-এই দাড়ান ফোন কাটবেন না!আমি কোনো শব্দ বা টু আওয়াজ করিনি আপনি বুঝলেন কিভাবে? আপনি নজর রাখছেন?
-তুই কি কোনো ভিআইপি? নিজেকে কোন দেশের নায়িকা ভাবছিস যে নজর রাখবো? আঙ্কেল আন্টি এই শিক্ষা দিয়েছে? রাতেরবেলা ছেলেদের ধরে কথা বলবি! ইয়াক!
-বাজ....
কিছু বলতে যাব মুগ্ধ ভাইয়া ফোন কেটে দিলেন। উনি একটু বেশি করছেন না? আমাকে কথা শুনাবেন ভালো কথা....আমার বিহেভিয়ার নিয়ে আম্মু আব্বু তুলে কথা বলবেন? আমি কি আঙ্কেল আন্টি নিয়ে কথা শুনিয়েছি? উনি রক্তাক্ত হয়ে উনার বাসায় না যেয়ে আমার রুমে এসেছিলেন...থাপ্পর, গালে-গালে টাচ, হাত চেপে ধরা, মাথায় ঠোট ছুয়িয়ে দেয়া- আমি তো উনার বাবা মা তুলে কথা বলিনি!আমাকে থার্ড ক্লাস বলে দিলেন? আমিও ফোন রেখে কাথা টেনে শুয়ে পড়লাম। আর চিন্তা না....

জানালার পর্দা ঠেলে সকালের রৌদ্রতপ্ত বাতাস আসছে। মিস্টি হলুদের রোদময় সকাল আমার বদ্ধ চোখের পাতায় এসে জাগরন বোঝাচ্ছে....ঘুম থেকে উঠা উচিত।। আমি ঘুম চোখে কাথা সরিয়ে বসে নিলাম...জানালার ওপাশে পরিস্কার আকাশে তাকালাম... মুচকি হেসে মনেমনে বললাম, আপনি আছেন তো? আমি জানি জানি আর কেউ পাশে থাকুক বা না থাকুক আপনি থাকবেন। আপনি দুনিয়ায় বান্দাদের বেশি ভালোবাসেন....আমার আব্বু-আম্মু থকেও বেশি। আলহামদুলিল্লাহ।।

হাতমুখ ধুয়ে টিশার্ট পাল্টে নিলাম। জানালার পর্দা সরিয়ে দিয়ে ফোনটা অন করে দেখি মেসেজ এসেছে।নাম মুগ্ধ। আমি মুগ্ধ ভাইয়ার মেসেজ দেখেই ফটাফট মেসেজে ক্লিক!

আমার সামনে আসবি না। যদি সামান্য পরিমানে লজ্জাবোধ থেকে থাকে কলও করবিনা। সেদিন তোর বাসায় আসার জন্য আমি দুঃখিত। আর কক্ষনো তোর বাসায় আসবো না। রাতে গরমের মধ্যে কাথা গায়ে ঘুমাবি না...ঘামে ভিজে ঠান্ডা লেগে যাবে। বায়!

এটা কেয়ার ছিলো নাকি হুমকি? উনি কি রাতে রুমে এসেছিলো? প্রথম দিক পড়লে হুমকি শেষের দিক পড়লে কেয়ার...মাঝখানে আমি দুই নৌকায় পা!নো! যতকিছুই হোক আপনার দূরে থাকার মোর আমি ঘুরাবই। আপনিও জানেননা আমি কি জিনিস!আপনি গাছের ডালে চড়লে আমিও চলবো পাতায় পাতায়!!

মুগ্ধ ভাইয়া নাকি সকাল দশটার মধ্যে হসপিটালে চলে যায়। আঙ্কেলও বাসায় নেই...অফিসে। আমি ফিটফাট রেডি হয়ে আম্মুর সামনে দাড়ালাম। উনি টিভি দেখছেন-
-আম্মু আমি একটু বাইরে গেলাম...সামনে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে কোন কোচিং করবো দেখতে যাচ্ছি। ঘন্টাখানিকের মধ্যেই চলে আসব।
-মনিরা যাবে?
-আরে মনিরা কেন যাবে। ও কর্মাসের মানুষ.....সাইন্সের সাথে কি করবে?
-একা একা কোন জায়গায় কোচিং দেখতে যাবি? মিরাও বাসায় নেই...তোকে একা ছাড়তে ভয় করে..দিন আজকাল ভালো না।।
-চিন্তা করো কেন? তোমার মেয়ে কি কম নাকি? আমি যাই প্লিজ বাধা দিও না। বেশিক্ষন টাইম নিচ্ছিনা এসে পড়ব।
-যাবি ভালো কথা কারোর হাত পা ভাঙার খবর যেন না আসে...
-আরে তুমি কাসুটি জিনদেগি নিয়ে চিল মারো...আমি আসতেছি...আল্লাহ হাফেজ।।।
.
.

মুগ্ধ ভাইয়ার গাড়ি থেকে কিছু দূরে  দাড়িয়ে আছি। উনি কিছুক্ষণের মধ্যেই স্টাইল মেরে বেরুবেন...আমিও ঠুস করে উনার গাড়িতে উঠে...পাশের সিটটা দখল করবো। ঘড়ি দেখছি কখন বের হবেন। পাচমিনিট ঘোড়ার মতো দাড়িয়ে থাকলে উনি বেরিয়ে আসেন। হালকা নীলের শার্ট...কালো জিন্স, কোমরে বেল্ট, পায়ে সুজ।কপালের বামদিকে ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজ লাগানো। শার্ট ইন করা। গলায় আইডি কার্ডের ফিতা ঝুলিয়ে বামপাশে শার্টের পকেটটায় কার্ডটা ভরে রেখেছে। বাম হাতে ঘড়ি। ডানহাতে এফ্রন। হাত বাড়িয়ে গাড়ির দিকে রিমোট টাইপ কি যেন নিয়ে "টুট টুট" দুইবার শব্দ করে ড্রাইভিং সিটের দরজা খুলছেন। উনি সিটে বসলে আমিও সুযোগ বুঝে দৌড়ে উনার পাশের সিটে দরজা খুলে বসে পড়লাম। মুগ্ধ ভাইয়া হা হয়ে আছেন। আমি উনার দিকে তাকিয়ে মুখ বন্ধ করতে বললাম। উনি ফের অপমান করার জন্য মুখ খুলতে নিলে আমি আগেই উনার মুখ চেপে ধরি। একহাত উনার চুলে ঢুকিয়ে  আরেক হাত দিয়ে উনার মুখ চেপে..বলে উঠি-

-চুপচাপ যেখানে যেতে বলব ওখানে যাবেন! কথা মতো না চললে বাসায় যেয়ে কেলেঙ্কারি বাজিয়ে দিবো....আপনি আমায় বদ নজরে দেখেয়েছেন....এরপর আঙ্কেল আন্টি................

উনি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। ছুটাছুটি না করে শান্ত হয়ে বসে আছেন। যাক বাবা শান্তিপূর্ণ ভাবে হরতাল সংঘটিত হলেই বাচি!
-মুগ্ধ ভাইয়া আমি জানি আমি সুন্দর...এভাবে তাকিয়ে থাকলে শরম করে বুঝলেন!! এনিওয়ে বেশি রোমান্টিক হয়ে গেলে বিপদ!! হারি আপ! গাড়ি চালানো শুরু করুন...

মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিলাম...ভাইয়া নরমাল হয়ে গাড়ি স্টার্ট দিতে লেগে পড়লেন। আমি সিটে ঠিকঠাক মতো বসে উনার দিকে তাকালাম....মুগ্ধ ভাইয়া "হাই ডোজ ভাব" নিয়ে বসে আছেন। এই বান্দা প্রথমদিন যেই রোমান্টিক ছিলো এখন একটা কচুপাতার লতা  হয়ে গেছে! মানুষের পদোন্নতি হয়! আর এই ব্যক্তির পদোন্নুত! আমি মানতে বাধ্য কোনো মেয়ে রাদিফ আবরার মুগ্ধকে দেখলে ফিট হয়ে যাবে!! উনি সুন্দর খুব....ধ্যাত! আমি আবার  প্রশংসা শুরু করছি, ও মাবুদ!!! ভাইয়া গাড়ি স্টার্ট মারলে আমি তাল সামলাতে না পেরে সামনে ঝুকে মাথায় ব্যাথা পাই। ভাইয়া গাড়ি চালাচ্ছেন আমার ব্যাথা পাওয়ার দিকে উনার ভ্রুক্ষেপ নেই। কেমন র্নিবিকচিত্তের মানুষ! আমি মরলেও বুঝি চল্লিশা খেতে আসবে না! মাথায় হাত ছুয়িয়ে জানালার বাইরে তাকাই। ছোটবেলায় বায়না ধরতাম, "ভাইয়া গাড়ি চালিয়ে ঘুরতে নিয়ে যাবেন?"....উনি উত্তর দিতেন, "আগে তুই বড় হ তারপর ইচ্ছামতো যেখানে মন চায় সেখানে ঘুরব"। এখন বড় হয়েছি কিন্তু উনি বায়নার কথা ভুলে গেছেন। যাওয়ার আগেরদিন রাতেও আমাকে জানিয়ে যান নি..."উনি কাল এব্রোর্ড চলে যাচ্ছেন"। পরদিন সকালে উনার চলে যাওয়ার সংবাদটা সাইক্লোনের মতো ভয়াবহ ছিলো...আমি ভুলতে পারিনি। হঠাৎ ভাইয়া গাড়ি থামিয়ে দিলেন। আবারো মাথায় আঘাত পেলাম....একইভাবে একই জায়গায়। উনি উনার গায়ের উপর থেকে বাকাভাবে লাগানো কি যেন একটা রশিটাইপ খুলে নিলেন। ছবিতে দেখেছি এটা বেল্ট না কি না বলে...উনি আমার দিকে ঝুকে চোখের দিকে তাকিয়ে সিটের পাশ থেকে টেনে কোনায় কিছু আটকে দিলেন। আমি উনার চোখের দিকে তাকিয়ে আছি....ভাষা বলছে.. রাগ, জিদ, অভিমানের আড়ালে লুকানো আদরটা ঢেকে গেছে। উনি উনার কাজ শেষে আবার আগের মতো ওই বেল্ট বেধে গাড়ি চালানো শুরু করলেন। নিজের দিকে তাকিয়ে দেখি উনি আমাকেও ওই বেল্টটা বেধে দিয়েছেন। গাড়ির এসি লিখা অপশনটায় কয়েকবার চেপে দিলেন। আস্তে আস্তে পুরো গাড়ি ঠান্ডা হতে লাগল। আমি ব্যাগ থেকে ইয়ারফোন আর  ফোনটা বের করে  গান শুনতে লাগলাম। কানে ইয়ারফোন, সাথে পছন্দের গান, পাশে দুনিয়ায় সবচেয়ে জঘণ্যতম ব্যক্তি। মোমেন্টটা আমার জন্য বেশশশ.......হুট করে মুগ্ধ ভাইয়া আমার কান থেকে ইয়ার টান মেরে উনার সিটের নিচের ফেলে দিলেন। ফোনটা নিয়ে পিছনের সিটে ছুড়ে মারলেন। আমি শক! কি করলেন আবার? উদ্দেশ্য কি গান শুনতে বাধা দেয়া নাকি? উনি উনার পকেট থেকে ডানহাতে ফোন বের করলেন...বামহাতে ড্রাইভিং করছেন। ফোনটা নিয়ে এসির স্ক্রুটার নিচে একটা বাটনে ক্লিক করলেন....ফোনে কিছু করে দিলে গাড়িতে ফুল স্পিডে গান বাজতে শুরু করে। ফোন পকেটে রেখে আপনমনে গাড়িচালাচ্ছেন...বাতাসের বেগে চুলগুলো উড়ছে উনার...মুগ্ধ আসলেই একটা মুগ্ধ! নামে নামে মিল!! আমি মাথা ডানেবামে নাড়িয়ে হাসছি। রাগ দেখাচ্ছেন আবার আনলিমিটেড কেয়ার!! কি আজব রে খোদা!!

সিটে হেলান দিয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে দেখছি....উনি হাইওয়ের রাস্তা ধরেছেন। বাসা থেকে দূর....হসপিটাল থেকে দূর...গাড়ির ভেতরে ঠান্ডা এসির হাওয়ায় হালকা গানের সমাবেশ....চোখ বন্ধ করে গানে ডুবে গেলাম...ভাবতে লাগলাম রোমান্ঞ্চকর মূহুর্ত গুলো....

"প্রেমে পড়া বারন
কারনে অকারন, 
আঙুলে আঙুল রাখলেও
হাত ধরা বারন🥀♥(উনার এবং আমার গালে গাল স্পর্শ করার মূহুর্ত)

       প্রেমে পড়া বারন
       কারনে অকারন, 
       আঙুলে আঙুল রাখলেও
       হাত ধরা বারন.....

তোমায় যত গল্প বলার ছিলো, (মুগ্ধের সেই চলে যাওয়ার কারন জানার মূহুর্ত)

তোমায় যত গল্প বলার ছিলো

সব পাপড়ি হয়ে গাছের পাশে
ছড়িয়ে রয়ে ছিলো🥀🍁 (উনি কাছে এসে কিছু বলতে চাইলে প্রতিবার আমার ফিরিয়ে দেওয়ার মূহুর্ত)

দাও নি তুমি আমায় সেসব
কুড়িয়ে নেওয়া কোনো কারন♥" (আমি সুযোগ দিলে উনার মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার মূহুর্ত)

প্রেমে পড়া বারন
কারনে অকারন,
ওই মায়া চোখে চোখ রাখলেও
ফিরে তাকানো বারন♥ (সিটবেল্ট বাধার সময় চোখে চোখ রাখার মূহুর্ত)

চোখ বন্ধ করে কিছু সময়ের জন্য মূহুর্ত গুলো মিলিয়ে নিচ্ছিলাম গানের পঙক্তিতে....গান ছিলো না এটা....না বলা অনেক কিছুর লুকিয়ে চলার টান ছিলো...যে টানে আমিও লুকাচ্ছি...কিছুটা উনিও লুকাচ্ছেন...

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন