যদি বলি ভালোবাসি - পর্ব ১৮ - ফাবিয়াহ্ মমো - ধারাবাহিক গল্প



শাড়ি পাল্টিয়ে গোসল করে সারাদিন পর ফ্রেশ হলাম। উনি পান্জাবী পাল্টিয়ে টিশার্ট, ট্রাওজার পরে খাবারের প্যাকেট খুলছেন। রাফিন সকালে কোন্ ঝামেলা করে জানি না, উনি আমাকে টেনশন মুক্ত থাকতে বলেছেন। খাবারের ডলা পাকিয়ে আমার মুখে তুলে বললেন-
--আগে খেয়ে নে তো!! পরেরটা পরে পরে দেখিস।সারাদিন না খেয়ে তোর মুখটা পুরো চুপসে গেছে দেখছিস! কত খারাপ আমি!! সারাদিন আমার পাকনিটাকে না খাইয়ে রেখেছি। 

খাবারের লোকমা নিয়ে মুখ ফুলিয়ে চিবুচ্ছি। উনার অসুস্থ মুখখানাটা বদলে গেছে। গালটা লাল হয়ে আছে অনেকক্ষন ধরে। রাফিনের চড় আর আব্বুর চড় মিলে গালের পরিনাম লাল অবস্থায় এসেছে। কপালে হাত রাখলাম...গরম খুব। উনি চুপ করে ভেতরে চেপে বসে আছেন। 

খাওয়া শেষে বিছানায় শুয়ে আছি। উনি জানালার পর্দা টেনে বারান্দার দরজা লাগিয়ে দিচ্ছেন। আমার পায়ের কাছে ব্যান্ডেজের হালচাল দেখে শুয়ে পড়লেন পাশে। মাথার নিচে হাত দিয়ে উনি ঘুমিয়ে পড়েছেন, আমার লাগছে রাগ! হাসবেন্ড এখন, বিয়ে হয়েছে আমাদের,আমাকে বুকে নিবেন উনি! অথচ আমার ঘুমানোর প্রতি খেয়ালই নেই উনার! চেক করলাম। নাহ্ ঘুমিয়ে গিয়েছেন, শরীরের টেম্পেরেচার কম একটু। অন্যপাশ হয়ে শুয়ে পড়লাম, চোখে এখনো ঘুম নেই, মাথায় ঢের টেনশন রাফিনের হুমকি পেয়ে। হঠাৎ কাধের কাছে উষ্ণ ছোয়া টের পাচ্ছি, মাথার তালুতে একইরকম ছোয়ার প্রতিকর্ম। আমার পিঠের সাথে কিছু লেগে আছে বুঝতে পারছি। উনার দিকে ঘুরতে যাব, উনি পেটের উপর হাত রেখে জড়িয়ে ধরলেন।

--সরি আমি ঘুমাইনি। দেখলাম শুধু তুই কি করিস। বউটা আমার জ্বর দেখে বিরক্ত করা বন্ধ করে দিয়েছে আমার ব্যাপারটা হজম হচ্ছেনা...
মাথায় নাকটা ঘষে পিছন থেকে উনি জড়িয়ে ধরে আছেন। আমি আসলেই কিছু করা বন্ধ করে দিয়েছি। আব্বু আম্মুর ব্যবহারগুলো আমার ঘুম কেড়ে নিয়েছে...উনাকে থাপ্পর দেওয়া, অপমান করা, রাফিনের মার, আমি সত্যিই জানিনা মুগ্ধ ও আমার ভবিষ্যত লেখনীতে কি মিশে আছে। চোখের কান্না গড়িয়ে পড়লেও নিরবতা পালন করে চলছি। উনি নরম গলায় বলে উঠলেন-

--আমি মরে গেলে কি করবি? 

কান্নার উপর ধরফর করা কলিজা কাপানো কথা একটা ফেললেন উনি। চিপে আছে মনের কোনা। পেটের উপর থেকে উনার হাত সরিয়ে ঘুরে শুলাম উনার দিকে। উনি ঘুমাননি, তাকিয়ে আছেন। ঘাড়ের পিছনে হাত ঢুকিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন উনি, আরেকহাত পিঠে উপর। উনার কপালটা আমার থুতনি টাচ করছে। উনি আবার বলে উঠলেন-
--বললি না যে?

নিশব্দতার সঙ্গী হয়ে চুপ করে কাদছিলাম, আম্মু আব্বুর কথা ও কাজে পরিস্কার বোঝা গেছে উনারা মরলেও আমাকে মেনে নিবেননা। শ্বশুড়বাড়িতে স্থান পেলেও রাফিনের জন্য থাকা হবেনা। উনি মরে যাওয়ার কথা বলছেন....আমার আসলেই কি হবে, কি করবো আমি...সব অজানা। উনার নরম ঝরঝরে কালো চুলের মাথায় গভীর করে ঠোট ছুয়িয়ে দিলাম। বন্ধ চোখের দুই পাতা থেকে দুই ফোটা জল গড়িয়ে উনার চুলের ধার ঘেষে তীরতীর করে চুলের গোড়ায় যেয়ে পৌছলো। 

-কাদছিস? কষ্ট হচ্ছে? আমারো কষ্ট হবে পাকনি। আমি নিজের জন্য চিন্তার সাগর না গড়লেও তোর জন্য আমি ভীতু বনে আছি। আচ্ছা বায় এনি চান্স কোনো কার এক্সিডেন্টে আমার মৃত্যু হলে তোর কি হবে? তোকে কার ভরসায় রেখে যাব? তোকে পরিচর্যা করতে ধৈর্য্য সম্পন্ন মানুষ লাগবে রে পাকনি। সবাই তোকে দেখে রাখতে পারবে না। মরে গেলেও তো শান্তি পাবো না.....

চুলটেনে উনার মাথায় ঠোট লাগিয়ে ফুপিয়ে কাদছি....চোখের অশ্রুফোটা বড় হয়ে পড়তে লাগলো, শরীরে আমার এনার্জী লেভেল কমে আছে, তবুও শক্তি দিয়ে চেপে ধরে আছি উনাকে। "মৃত্যু" একটা কঠিন তিক্ত বাস্তব শব্দ। বুলেটের কোনো আঘাত থেকে যে যন্ত্রনা উপভোগ হতে পারে তার চেয়ে কয়েকস্তর বেশি 'মৃত্যু' শব্দের যন্ত্রনা মানুষকে খেয়ে ফেলতে পারে। আমাদের জীবন কাহিনী নাটক সিনেমার মতো তুলে ধরলেও একটা বাক্যের জন্য আমি সিনেমাকে সবসময় দোষী সাব্যস্ত করি। "মৃত্যু কখনো আলাদা করতে পারবেনা প্রিয়তমা, আমি তোমার জন্য মৃত্যুর দুয়ার থেকেও লড়ে আসব প্রিয়তমা", একটু ভাবুন তো? সত্যি কি তাই হয়? যতই বড় বড় কথা বলি, একটা দুই অক্ষরের ভয়ানক ওয়ার্ডের কাছে আপনিও অক্ষুন্ন থাকতে পারবেননা। কষ্ট হবে আপনার। অসহনীয় ব্যথা যন্ত্রনায় ভুগবেন আপনি। দেখার কেউ থাকবেনা, বোঝার কেউ থাকবেনা। সব আমলে নিবেন শুধু উপরওয়ালা... যিনি আমাকে আপনাকে সৃষ্টি করে নির্দিষ্ট সময় শেষে ফিরিয়ে নিবেন ভিন্ন দুনিয়ায়। মুগ্ধ আমার জীবনের সাথে ঠিক কেমন করে জড়িয়ে আছে একটা সাধারণ উপমায় বলি? কুয়োভর্তি পানির ব্যবহার সবাই করলেও কুয়োর যত্ন নেন শুধু একজন, ধরুন সেদিন যত্ন নেওয়া মানুষটা না ফেরার দেশে গমন করলো তখন কি হবে কুয়োর অবস্থা??? 

উনার টেনে ধরা চুলগুলো ছেড়ে আঙ্গুল বুলিয়ে ছুয়িয়ে দিচ্ছি। কপালের কাছে উনাকে ঠোট ছুয়িয়ে বললাম-
--আমি যাকে মান্য করে আপনাকে বিয়ে করেছি, আমি তার ভরসায় দিন পার করবো মুগ্ধ। যিনি আপনাকে আমার জন্য বানিয়েছেন, আমার কাছ থেকে দূরে নেওয়ার অধিকার তো তারই। আমি কিভাবে প্রকৃতির নিয়ম ভঙ্গ করে অসন্তুষ্ট থাকবো? একটা মিনিটের জন্য হলেও আমি আপনাকে পেয়েছি, এর চেয়ে বড় প্রতিদান সত্যি আমার  লাগবেনা মুগ্ধ। পরিবার আমাকে ত্যাজ্য বানিয়ে দিল, নষ্টা বলে তাড়িয়ে দিল, সব মায়া কাটিয়ে পর করে দিল তাদের কাছে আমার মরার পরও মূল্য হবেনা। কখনো না মুগ্ধ...

উনি আমার পিঠে দশ আঙ্গুলের প্রায়োগিক চাপে গলায় মুখ লুকিয়ে কেদে দিয়েছেন। উনার জীবনে উনিও কোনো সুখের আবিষ্কার করতে পারেননি। পরিবার থেকে নয় নয়টা বছর দূর, এমন এক জায়গায় যেখানে আপন বলার কেউ ছিলোনা। মানুষটা প্রাণোচ্ছল ছিলেন...কেন উনাকে হুট করেই বিদেশে পাঠিয়ে দিল...একদিন সব জবাবের ডায়েরী খুলে আশাবাদী হয়ে বসবো। 

সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি সাড়ে বারোটা বেজে গেছে। মুগ্ধ পাশে নেই। বিছানা থেকে উঠে রুমের দরজার নব ঘোরাচ্ছি কিন্তু খুলছে না। লক করা দরজা। রুমের দরজা যদি ভেতর থেকে লক করা থাকে তাহলে মুগ্ধ গেল কিভাবে? জানালায় গ্রিল বসানো, বারান্দার দরজা ভেতর থেকে লাগানো। হঠাৎ উনার ডেস্কের দিকে খেয়াল হলো মগের নিচে কাগজ রেখে গেছেন, সাথে একটা চাবি। চাবিটা নিয়ে দেখলাম, তারপর কাগজটা নিয়ে পড়লাম-

শুভ সকাল পাকনি
আমার বদঅভ্যাসের মধ্যে একটা জটিল অভ্যাস আছে, আমি কখনো লেট করে হসপিটালে যেতে পারিনা। একচুয়েলি সময় মেনটেন করে চলি। আমাকে যেতে হচ্ছে সরি। রুমের দরজা লক করে গিয়েছি, একটা এক্সট্রা চাবি টেবিলের উপর মগের ডানদিকটায় রেখেছি। ঘুম থেকে উঠলে ফোন করিস। আ'ম ডিসপ্যারেটলি ওয়েটিং ফর দ্যা কল বউ!!!

ফোন? আমার ফোন কোথায়? ফোন তো আমি সাথেই আনিনি! কল করবো কিভাবে? একরাশ মন খারাপ নিয়ে ডেস্কের চেয়ারে বসলাম উনার। কাগজটা নিয়ে তিরিংবিরিং চেয়ারে পা ঠকে ৩৬০ ডিগ্রি এঙ্গেলে বৃত্তাকার একপাক ঘুরলাম আমি। মজাই লাগে এমন গোলগোল পাক দেয়া চেয়ারগুলোতে। ওটা কি? ফাইলের উপর কি রাখা ওটা??পাক দেওয়া থামিয়ে ফাইলগুলোর উপর থেকে জিনিসটা নিলাম। আরে একটা সেলফোন! এটা কোত্থেকে আসলো? এটা তো মুগ্ধের ফোন না ! কার ফোন?

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন