জীবন সংগ্রাম by তামান্না চৌধুরী |
মানুষের জীবন সুখ দুঃখের বাহিরে নয়, সুখের পরে দুঃখ আসবে এইটাই প্রকৃতির নিয়ম। প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে আমার জীবনেও এক সময়ের সুখের স্থানে এখন দুঃখের সাগর। আমি জান্নাতুল তুরবা। বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। আমার বাবা আনাফ মাহমুদ একজন সরকারী চাকুরীজিবী আর মা আনিশা মাহমুদ একজন স্কুল শিক্ষিকা। ছোটবেলা থেকেই অনেক আদরে বড় হয়েছি। দুঃখ কষ্ট আমাকে তেমন ভাবে ছুঁতে পারেনি। মা রাগী থাকার কারণে মায়ের থেকে বাবার সাথে ছিল আমার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। আমার সকল কথা বাবার কাছে নির্দ্বিধায় বলতাম। অনার্স প্রথম বর্ষের পড়াকালীন হঠাৎ একদিন বাবা আমার রুমে আসলো। দরজায় দাঁড়িয়ে বাবা বললো মা রে কিছু করছিস, আমি বললাম না বাবা তেমন কিছুই করছি না, তুমি হঠাৎ আমার রুমে আমাকে ডাকলেই হতো আমি চলে যেতাম তোমার কাছে। বাবা রাগ করার অভিনয় করে বললো কেনো একদিন কি আমি তোমার রুমে আসতে পারি না। এইভাবে বলছো কেন বাবা, অবশ্যই তুমি আমার রুমে আসতে পারো। বাবা হঠাৎ একটু সিরিয়াস হয়ে বললো তো যে কারণে তোমার রুমে আসা তোমার সাথে আমার কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে ভালোভাবে শুনবে ভাববে তার পর উত্তর দিবে। আমি বললাম ঠিক আছে বাবা তুমি বল। বাবা আমাকে একটা ছবি দিলো আর যা বললো তার জন্য আমি এই মুহূর্তে একদমই প্রস্তুত ছিলাম না।
বাবা আমাকে একটা ছবি দিলো আর বললো দেখোতো ছেলেটা কেমন। এই ছেলের সাথে তোমার বিয়ের কথা চলছে। বাবার এই মুহূর্তে এমন অপ্রত্যাশিত কথা আমি একদমই আশা করিনি। বাবা বললো ছেলে ডক্টর, আদ্রিক মেডিকেলের (ছদ্মনাম) বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে। কিছুক্ষণ থেমে আবার বললো তুমি ভেবে আমাকে জানিও এখন খেতে নিচে আসো এই বলে বাবা আমার রুম থেকে চলে গেলেন আর আমাকে রেখে গেলেন চিন্তার সাগরে। দেখতে দেখতে বিয়ের দিন চলে আসলো যথারীতি আমার আর বাবার পছন্দের ছেলের সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেলো। বিয়ের আগে অনেকবার আমার সাথে দেখা করতে চেয়েছিলো কিন্তু আমি করিনি এক প্রকার বাবার সাথে রাগ করেই করা হয়ে উঠেনি। বিদায়ের সময় বাবা মা অনেক কান্না করলো কিন্তু আমি একেবারেই চুপ ছিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাবার বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে স্বামীর বাড়িতে চলে এলাম। এইবার আমার স্বামীর পরিচয়ে আসা যাক আমার স্বামী ডক্টর তাইরান রহমান, একজন হার্ট সার্জন। প্রথম প্রথম তাইরানের সাথে ঠিক মতো কথা বলতাম না কিন্তু একসময় এই মানুষটাই আমার কিভাবে যে আপন হয়ে গেলো বুঝতেই পারলাম না। আমাদের সংসার দিন দিন ভালোই চলছিল। একদিন খবরে দেখলাম চীনের করোনা ভাইরাসের কারণে মানুষ মারা যাচ্ছে তা বাংলাদেশেও ছড়িয়ে পড়ছে দিন দিন বহু মানুষ মারা যাচ্ছে বাংলাদেশে। তাইরান দিন দিন ব্যাস্ত হয়ে পড়ছে বেশির ভাগ সময়ে হাসপাতালই থাকতে হয়। আমি যেনো বাড়িতে তাইরানের চিন্তায় চিন্তায় শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম। এর মধ্যে খুশির খবর এলো আমি মা হবো। কি যে আনন্দ হয়েছিলাম তখন আমার থেকেও বেশি আনন্দ তাইরানের ছিল বাচ্চাকে নিয়ে যে তার কতো স্বপ্ন ছিলো তা সে সময় পেলেই আমার সাথে গল্প করতো। কিন্তু সে আর না আমি কেউই ভাবতে পারিনি তার এই স্বপ্ন পূরণ হবে না। আমার পাঁচ মাসের সময়ে হুট করেই সে করোনা আক্রান্ত হলো আমি তার কাছে বহুবার যেতে চেয়েছি সে আমাকে তার কাছে যেতে দেয়নি। আমার নয় মাসের করোনা আক্রান্ত হয়ে জীবন যুদ্ধের কাছে হেরে না ফেরার দেশে চলে যায় তাইরান। বাবা মা অনেক সান্ত্বনা দিলো, কিন্তু আমার শ্বশুর শ্বাশুরি আর তাদের আত্মীয় স্বজন আমাকে অপয়া অলক্ষী বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বললো। বাবা, মা তাদের কাছে নিয়ে আমাকে রাখলো। এমনিতে স্বামী হারানোর শোক, শ্বশুরবাড়ির লোকজনের এমন কথা তার ওপর প্রেগনেন্সির দুর্বলতা আমার শরীরের অবস্থা খুব বেশি ভালো ছিলো না। আর এক মাস পরে সিজার করে আমি আমার সন্তানকে পৃথিবীতে নিয়ে আসি। ছেলেটা দেখতে ঠিক তার বাবার মতোই হয়েছে। শ্বশুরবাড়ির কেউ আমার ছেলেটাকে দেখতে আসলো না, খুব খারাপ লাগলো তাদের ব্যাবহারে। কিছু মাস যাওয়ার পরে সমাজের মানুষের কথায় বাবা আমাকে আর আমার ছেলেকে চলে যেতে বলে। আর বললো টাকা পাঠাবে আমি যেনো তা দিয়ে চলি, কিন্তু বাবার চলে যাওয়ার কথা বলাতে আমি আমার ছেলেকে নিয়ে আমার আর তাইরানের একটা ফ্ল্যাট ছিলো যা বাবু হওয়ার খবর শুনে তাইরান আমাকে উপহার দিয়েছিলো। সেই ফ্ল্যাটে উঠি, এইখানের ঠিকানা কেউ জানে না। তাইরানের কিছু জমানো টাকা থাকে যা এই ফ্ল্যাটে আসার পর জানতে পারি ওই টাকা বাবুর পড়াশুনার জন্য রেখে দেই। অনার্স শেষ না হওয়ার কারণে ভালো কোনো চাকরি পাই না। শেষমেস একটা কিন্ডার গার্ডেনে চাকরি হয়। আমার শুরু হয় জীবন সংগ্রাম। যা বেতন পেতাম তা দিয়েই কোনো মতে মা ছেলের চলে যেতো এখন আমার ছেলে ডক্টর। ডক্টর তাইবার রহমান, সেও একজন হার্ট সার্জন। মা ছেলে ভালোই আছি এখন। সমাজ মানুষকে আপন মানুষদের থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। জন্মদাতা বাবা জন্মদাত্রী মা ও সমাজের কটু কথা থেকে বাঁচতে সন্তানকে দূরে সরিয়ে দেয়। আর আমরা এই সমাজে জীবনের সাথে সংগ্রাম করে বেঁচে থাকতে চেষ্টা করি।
***(সমাপ্ত)***