সিঁদুর রাঙা মেঘ - পর্ব ০৩ - সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি - ধারাবাহিক গল্প


নাকে-মুখে খাবার খাচ্ছে চিত্রা। মিজান সাহেব বললেন,,
---" মা আস্তে খা। এতো তারা কিসের?
চিত্রা খাবার মুখে নিয়ে বলল,,
--" কাজ আছে বাবা! একটা পড়া কমপ্লিট করতে হবে।"
---" পরেও পড়া যাবে আস্তে খা। আচ্ছা তোর সাথে আমার কথা ছিল।"
--" বলো বাবা!"
--" নাওয়াজের সম্পর্কে কি ভাবলি?"
চিত্রা পাতে তরকারি নিতে নিতে বলল,,
--"কোন নাওয়াজ বাবা?"
মিজান সাহেব ভ্রুকুটি কুচকালেন। চিত্রা দাঁতে জিভ কাটলো। একদম ভুলে গেছিলো সেই লোকটির কথা। সে খাবার প্লেটে হাত নাড়তে নাড়তে বলল,,
--"বাবা তোমাকে কিছু বলার ছিল!"
---"বল"
---"বাবা আমি তাকে বিয়ে করতে চাই না। ইনফ্যাক্ট এখন কাউকেই বিয়ে করতে চাই না। আমি চাই পড়াশোনা শেষ করতে। তার পরও তুমি যদি চাও, তাকে বিয়ে করি! তাহলে আমি অমত করবো না।"
খাবার ছেড়ে উঠে গেল চিত্রা। মিজানের মাথায় চিন্তার ভাজ পড়লো এক মাত্র মেয়ে তার। আগে-পিছে কেউ নেই। তার উপর শরীরটা ভাল থাকে না বেশি কবে দু চোখ বুঝে যায় আল্লাহ জানেন। তাই একটা গতি করে যেতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু মেয়ের অমতে এক পা বাড়াবেন না ।

চিত্রা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে স্ব স্ব বাতাসে শীত শীত করছে তবুও সরতে ইচ্ছে করছে না তার। নাওয়াজ ছেলেটিকে একদম তার ভাল লাগে না। গায়ে পড়া লাগে বরাবর তাকে। কিন্তু বাবাকে এভাবে মুখের উপর না বলাতে কষ্ট লাগচ্ছে তার। ইশশ! আজ যদি তার মা বেঁচে থাকতো? মনের কথা সব শেয়ার করতে পাড়তো। 
বাতাসের দমকা হাওয়ায় টেবিলে পড়ে থাকা ডায়রির পেইজ গুলো উল্টে পাল্টে যেতে লাগলো। চিত্রা সেদিকেই তাকালো। এখন এসব চিন্তা বাদ দিয়ে ডায়রি পড়াটাই শ্রেয়  মনে করলো।

কনকনে শীতের রাতে ইউসুফ এসে হাজির হয় কুহুর রুমে।পরনে তার কালো টি শার্ট, উপরে কালো জ্যাকেট  আর পায়ে  কের্ডস।  কুহু তখন পড়ছিল।ইউসুফকে দেখে অবাক হয়ে গেল। সুদর্শন ও সুঠামো দেহী ইউসুফ এমনিতেই সুন্দর, কালোতে আরো মাত্রাতিরিক্ত সুন্দর লাগছে। কুহুর শ্বাস আটকে আসলো। এত সুদর্শন ক্যান তার ইউসুফ ভাই?  উফ!কুহু হা করে তাকিয়ে রইলো শুধু। ইউসুফ তখন কুহুর মাথায় টোকা দিয়ে বলল,,
---" হা করে গিলে খাচ্ছিস কেন? মুখ বন্ধ কর মশা ঢুকবে।"
বলেই তর্জনী ও মধ্যমা আঙ্গুল দুটি দিয়ে মুখ বন্ধ করে দিলো।কুহুর তখন হুশ ফিড়লো। বাসার সবাই খেয়ে দেয়ে সেই কখন শুয়ে পড়েছে। অসময়ে কুহু মোটেও ইউসুফকে আসা করেনি। যদি কেউ দেখে ফেলে কি হবে? কুহু ফিসফিস করে বলল,,
---" আপনি এখানে কেন ইউসুফ ভাই?"
ইউসুফ বলল,,
--"বুঝতে পারছিস না বের হব? "
--"তাহলে এখানে কেন?" ভ্রু কুচকে বলল কুহু!
ইউসুফ কুহুর কাছে এসে আচমকা কোলে তুলে নিলো। আর হাঁটা ধরলো।কুহু চেঁচাতে নিয়েও মুখ হাত দিয়ে ফেলল। ফিসফিস করে আবার বলল,,
--" কই নিয়ে যাচ্ছেন? "
ইউসুফ চোখ টিপে বলল,, 
--"রোমান্স করতে!"
কুহু লজ্জা পেলো। গাল দুটি টমোটের মতো লাল হয়ে গেল। ইউসুফ লোভ সামলাতে না পেরে টুস করে চুমু খেয়ে ফেলল তার গালে। বলল,,
---"ইয়াম্মি! "
কুহুর এবার লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করলো। ইউসুফের বুকে মুখ গুঁজে ফেলল। ইশশ! কি লজ্জা। এত লজ্জা কেন দেয় তার ইউসুফ ভাই!

ইউসুফ কুহুকে গাড়িতে বসিয়ে সে পাশে বসে পড়লো। গুন গুন করে গান গাইতে গাইতে ড্রাইভ করতে লাগলো। কুহু আবার প্রশ্ন করলো,,
--" আমরা কই যাচ্ছি?"
ইউসুফের নির্বিকার উত্তর,,
--" প্রেম করতে!"
কুহু এবার আবার লজ্জা রাঙ্গা হয়ে গেল। কিন্তু তা ইউসুফকে বুঝতে দিলো না কপাট রাগ দেখিয়ে বলল,,
---" মশকরা করছেন কেন?"
---" মশকরা কই করলাম? সত্যি বলছি। আজ প্রেম করবো রাতের আকাশের নিচে চাঁদ, তারাকে সাক্ষী রেখে ।"
---" আপনি পাগল হয়ে গেছেন ইউসুফ ভাই? "
ইউসুফ গাড়ি সাইড করে রাখলো। কুহুর দিক ঘুরে বলল,,
---" হে তোর প্রেমে পাগল হয়ে গেছি আমি। যেদিন তুই আমার বাসায় পা রাখলি সেদিন তুই আমার মনের মনি কৌঠায় জায়গা করে নিলি। "
ইউসুফ অপলক তাকিয়ে রইলো কুহুর দিক। কুহুও তাই। যেন কিছু খুঁজচ্ছে সে চোখ জোড়ায়। বলল,,
---" এ চোখের মায়ায় পড়েছিলাম আমি। তোর চোখে সেদিন নিজের সর্বনাশ দেখে ফেলেছিলাম রে।"
গাড়ির সীটের সাথে হেলে পড়লো ইউসুফ।যেন অনেক ক্লান্ত সে। কুহুর বাম হাতটা বুকের মাঝে ধরে বলল,,
---" ব্যথা হয় এখানে খুব ব্যথা। তোকে ছাড়া কিছু ভাবলেই তীব্র ব্যথা ঝেকে বসে এখানে আমার। কেন এমন হলো বলতো? মাঝে মাঝে মনে হয় কি জানিস? তোকে মেরে  ফেলি!"

কুহু চমকে তাকলো। ইউসুফের দৃষ্টি তখন বাহিরে। স্টেডিয়াম লাইটের হলদে আলোয় তার চোখের কোনে কেমন চিক চিক করছে পানি টুকু। তার ইউসুফ ভাই কি কাঁদচ্ছে? কিন্তু কেন? কুহু বলল,,
---" ইউসুফ ভাই আপনি কাঁদচ্ছেন কেন?"
ইউসুফ জবাব দিল না। উল্টো গাড়ি থেকে বের হয়ে ড্যাশবোর্ড এর সাথে লেগে দাঁড়ালো। ইশারায়  কুহুকেও বের হতে বলল। কুহু বের হয়ে তার পাশে দাঁড়ালো। আকাশে আজ অনেক বড় চাঁদ উঠেছে তার সাথে তাল মিলিয়ে ফেরি লাইটের মত মিটমিট করে জ্বলছে তারামণ্ডল । ইউসুফ সেদিকে তাকিয়ে রইলো।কুহু আজ অবাক হয়ে দেখছে ইউসুফকে।ইউসুফ তার বাম হাত কুহুর কোমরে ধরে কাছে টেনে নিয়ে আসলো । ইউসুফের স্পর্শে সারা শরীর শিরশির করে উঠলো।  ইউসুফ খুব শক্ত করে ধরে আছে তাকে। কুহুর কাছে আজ ইউসুফকে অন্যরকম লাগছে।  কিন্তু কেন?কুহু বলল,,
---" আপনার কি মন খারাপ?"
ইউসুফ ম্লান হাসলো।  বলল,,
---" একটা প্রশ্ন করি তোকে?"
---" হুমম!"
---" তুই কতটা ভালবাসিস আমাকে!"
কুহু চকিতে জবাব দিলো,,
---" যতটা ভালবাসলে তাকে ছাড়া শ্বাস নিয়া যায় না। আপনি আমার অক্সিজেন ইউসুফ ভাই। "
ইউসুফ তাকালো কুহুর মায়া মায়া মুখখানির দিক। এক গালে হাত রেখে কাঁপা, কাঁপা কন্ঠে বলল ইউসুফ,,
---" কথা দে তাহলে অন্য কারো কখনো হবি না। আমায় ছেড়ে কখনো দূরে যাবি না। লুকেয়ে থাকবি আমার বুকের মাঝে!"
ইউসুফ তার হাত উঁচু করলো। কুহু হালকা হেসে তার হাতে হাত রাখলো। ইউসুফ তা মুষ্টিবদ্ধ  করে বন্ধ করে ফেলল। তারপর কুহুর হাতে উল্টো পাশে চুমু খেয়ে বলল,,
---" ভালবাসি বাবুইপাখি। "
কুহু এবার লাজুক হাসি দিল।প্রতিবারে ইউসুফের মুখে "বাবুইপাখি " ডাক শুনলে আলাদা শিহরণ খেলে উঠে শরীরে।এবার ইউসুফ কুহুকে নিয়ে হাটা ধরলো। মধ্য রাতে খালি রাস্তার পাশ ধরে হাটছে তারা। ল্যাম্পপোস্টের আলো গুলোতে শুধু তাদের কালো ছায়া দেখা যাচ্ছে।  মাঝে মাঝে রাস্তার সাইডে একটি দুটি গাড়ি চলে যাচ্ছে। ইউসুফ  কুহুর হাত ধরে আনমনেই হেটে যাচ্ছে। কুহু বলল,,
  ---" ভাইয়া আপনার কি হয়েছে? আজ অন্যরকম লাগছে আপনাকে!"
ইউসুফ দাঁড়িয়ে পড়লো। দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো,,
---" তোর থেকে দুটো বছর দূরে থাকতে হবে। বহু দূর! সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপারে।এত দূর চাইলেও আর তোকে ছুঁয়ে দেখতে পারবোনা । ভেবেই বুক ফেটে যাচ্ছে রে আমার।"
 মুহূর্তে মন খারাপ হয়ে গেল তার। কিছু সেকেন্ডের ব্যবধানে তার চোখ সিক্ত হয়ে উঠলো। ক্রন্দনরত কণ্ঠ বলল,,
---" কি বলছেন এ সব! আপনি আমায় ছেড়ে চলে যাবেন? আমি কিভাবে থাকবো আপনাকে ছাড়া?? প্লীজ যাবেন না!"
কুহু কাঁদতে লাগলো। ইউসুফ বলল,,
---" যেতে হবেরে বাবুইপাখি! হায়ার এডুকেশন এর জন্য। "
কুহু কি বলবে! ইউসুপের বাবা-মার ছোট থেকেই স্বপ্ন ছেলেকে বিদেশে পড়াবে। আর এখন তা পূরণ হচ্ছে। সে তো বাঁধা দিতে পারেনা। তাহলে তার বাবা-মার এত দিনের কষ্ট,  স্বপ্ন চুরমার হয়ে যাবে। সে পাড়বেই না এত স্বার্থপর হতে! কিন্তু সে কিভাবে থাকবে? দুটি বছর চলছে তাদের সম্পর্কের।  লোকটির ভালবাসার জালে এভাবে ফেঁসেছে যে মুক্ত হতেই পাড়বে না। সব থেকে বড় কথা সে চায় না মুক্ত হতে।

ইউসুফের বুকেও এক রাশ কষ্টের ভার এসে জমা হল। কুহুর চোখের পানি দেখে তার দম আটকে আসতে চাইল।  কুহুকে শক্ত করে বুকের মাঝে আঁকড়ে ধরল। কুহুও ধরলো। ইউসুফের বুকে মাথা রেখে হু হু করে কাঁদতে লাগলো।কিছু মুহূর্ত তেমন ভাবেই কেঁটে যেতেই ইউসুফ হুট করে বলে উঠলো,,
---" চল আইসক্রিম খাবো।  
কুহু এই মুহূর্ত এমন কথা শোনে বিস্মিত হলো। ভুল শুনেছে ভেবে বুক থেকে মাথা তুলে চোখ মুছে বলল,,
---" কি!"
---" আইসক্রিম! "
কুহু খুশিতে গদগদ হয়ে গেল। কারণ কুহুর ঠান্ডার ভাব বেশী। তাই ইউসুফের করা নির্দেশ কুহু ঠান্ডা জাতীয় কিছু খাবে না। একদম না। আজ সেই ব্যক্তি স্বয়ং অফার করছে আইসক্রিম খাবারের জন্য ভাবা যায়?

কুহু আর ইউসুফ আইসক্রিম পার্লারের সামনে এলো। ইউসুফ এত এত আইসক্রিম অর্ডার করে বসলো। কুহু হা হয়ে বলল,,

---" আপনিকি সত্যি আমার ইউসুফ ভাই? "

ভ্রূকুটি কুচকে ইউসুফ টেনে টেনে  বলল,,

---" মোটেও না..! আমি এলিয়েন !"

কুহু মুখ গুঁজা করে বলল,,

---" আপনি সব সময় আমার সাথে মজা করেন!"
মুখ ফিরিয়ে নিলো সে। ইউসুফ কুহুর মুখ তার দিক ঘুরিয়ে বলল,,

---" কেন মনে হচ্ছে আমি অন্য কেউ? ভুলে যাচ্ছিস? আমি তোর। শুধুই তোর।"

কুহু লজ্জুক হাসলো মাথা নত করে। ইউসুফ বলল,,

---"আমার সবটা জুড়ে তুই। আর তোর সবটা জুড়ে আমিই থাকতে চাই।"

বলে কুহুকে আইসক্রিম  খাইয়ে দিলো। কুহুর মন আজ পুলকিত হলো। অপলক তাকিয়ে রইলো সামনে এই সুদর্শন বিলাই চোখ ওয়ালা পুরুষের দিক। ইউসুফ ঠিক সেই মুহূর্ত এক অভাবনীয় কাজ করে বসে। কুহুর ঠোঁটের কোনে লেগে থাকা আইসক্রিম টুকু নিজের জিভ দ্বারা চেটে নেয়। কুহুর শরীরে ঠিক সেই মুহূর্তে ১৮০ বোল্ডের বিদ্যুৎ ঢেউ খেলে যায়। লজ্জায় আর সে তাকাতেই পারে না। এদিকে ইউসুফ কুহুর লজ্জা রাঙ্গা মুখখানি দেখে মিটমিট করে হেসে বলে উঠে,,

----"এই টুকুতেই এই হাল? বিয়ে পর..."

কথার মাঝেই কুহু ইউসুফের মুখে আইসক্রিম ঢুকিয়ে দেয়। এ লোকের একটু ও লজ্জা নেই। একটুকুও না।এক প্রকার ছুটে বের হয়ে আসে সেখানে থেকে।

---" কি হলো কোথায় হারিয়েছিস? খাচ্ছিস না কেন?"

মিশুর কথায় ধ্যান ভাঙ্গে কুহুর দুষ্ট-মিষ্টি কিছু স্মৃতিতে হারিয়ে গেছিলো আইসক্রিম খেতে এসে! কুহুর এখানে আসার এক বিন্দু ইচ্ছে ছিল না। মিশু এক প্রকার টেনে টুনে নিয়ে এসেছে। কুহু সামনের দিক তাকালো। ইউসুফের পাশে হুর নামের মেয়েটি কুহুর হাত জড়িয়ে দাঁড়িয়ে।  হাসি হাসি মুখে কথা বলছে নুশরা-বুশরা আর মিহুর সাথে। কি সুন্দর মানিয়েছে তাদের। মনে মনে আবার কোথাও হিংসে হচ্ছিল।  তার ভালবাসার মানুষ নাকি অন্য কারো বাহুডোরে! কথাটি ভাবতেই বুকের ভিতর হু হু করে উঠে কুহুর। নিজেকে খুব কষ্টে সামলে দাঁড়িয়ে থাকে কুহু। কিন্তু তখনি লোকচক্ষুর আড়ালে হুর ইউসুফের গালে টুস করে চুমে খেয়ে বসলো।তা কুহুর চোখে এড়ায় না।  ইউসুফও অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো হুরের এহেন কান্ডে।  এ এক দৃশ্য কুহুর বুকে ফেঁটে হাসতে চাইলো। সে আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না।  মিশুকে বলল,,

---"মিশুপি আমার খুব খারাপ লাগচ্ছে আমি ফিরে যাচাছি। "

মিশু হাত ধরে বলে,,

---" পাগল তুই? এত রাতে একা যাবি? একটু ওয়েট কর। এক সাথেই যাবো।"

কুুহু এবার মিনতি সুরে বলল,,

---" মিশুপি প্লীজ আমি পারবো যেতে।যেতে দাও!"

মিশু একা ছাড়তে চাইছেই না। এ সময় এলকার রাস্তা থাকে বড্ড শুনশান।  তার উপর গাল কাঁটা রমিজ আর তার দল জেল থেকে ফিরেছে। এরা গলিতেই আড্ডা দেয় মধ্যরাত পর্যন্ত। এদের বেড রেকর্ড আছে বহুত।  কিছু দিন আগেই একটি মেয়েকে রেপ করে মেরে লাশ গুম করে দিয়েছিল।  তাদের বিপক্ষে কোন প্রুফ না পেয়ে  তাদের ছেড়ে দেয়। মিশু বলল,,

---"বোন বোঝার ট্রাই কর এই রাস্তা ভাল না। অনেক ডেঞ্জারাস। "

কুহুর এ মুহূর্ত কেন জানি কোনো কিছুই মাথায় ঢুকছিল না। সে যাবেই। এদিকে ইউসুফ কুহুর দিক তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তাকিয়ে আছে। রাগে তার গা জ্বলছে। এ মেয়েটিকে দেখার পর থেকেই হুট হাট কার তার মাথা রাগ চড়ে বসে। এ মুহূর্তে এমন ফালতু ঢং দেখে গা তার রি রি করছে। দু গালে দুটো থাপড় বসিয়েও দিতে ইচ্ছে করছে। ইউসুফ রাগ আর দমালো না। ধমকে উঠলো। তার ধমকে কুহু সহ সকলেই কেঁপে উঠলো।

---"এখানে কি ঢং করতে এসেছিস? রাস্তায় দাঁড়িয়ে  টানা হেচরা শুরু করেছিস? এসব কি ভদ্র মেয়েদের কাজ! আর ওকে আটকাচ্ছিস বা কেন? বড় হয়েছে,  জ্ঞান বুদ্ধি হয়েছে, নিজের  ভাল-মন্দ  বুঝে। এমনকি নিজের মতামত নিজে নিতে জানে!  ছাড় ওকে যেতে দে। আর তুই! কে বলেছিল ঢেং ঢেং করে আমাদের সাথে আসতে। এখনে এসেই ন্যাকামো শুরু করেছিস। দূর হ আমার চোখের সামনে থেকে। যতবস বালের সমস্যা।  একটু শান্তি নেই!"

ইউসুফের কথায় সকলেই পুরো বিস্মিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কুহুর সাথে ইউসুফে হুট করে এমন ভাবে কথা বলবে ভাবেনি কেউ। এখানে সব থেকে বিস্মিত  দেখালো মিশুকে। সে অবাক হয়ে বলল,,

---" ভাইয়া তুমি কি বলছো এসব? তুমি জানো না এ রাস্তা সুবিধার নয়? কুহুর বিপদ হতে পারে?"

ইউসুফ তখন খেঁকিয়ে বলে,,

---" তা আমাকে বুঝাচ্ছিস কেন? ও যদি যেচে পড়ে বিপদ টেনে আনতে চায়, আমাদের কি করার আছে?"

বলেই ইউসুফ সামনের দিক এগিয়ে গেল। মিশু হতাশ হয়ে পাশে তাকাতেই দেখে কুহু নেই। খানিকটা চেঁচিয়ে বলে উঠে মিশু,,

---" ভাইয়া!  কুহু নেই!"

ইউসুফ চকিতে তাকায়।সত্যি নেই। রাগ আরো বাড়তে থাকে ইউসুফে এ মেয়েটির কি আর বুদ্ধিশুদ্ধি হবে না,  নাকি? যা ইচ্ছে হোক জাহান্নামে যাক। ইউসুফ ডোন্ট কেয়ার ভাব করে গাড়িতে উঠে পড়ে। সকলকে হুকুমের সুরে বলে,,

---" এক্ষুনি গাড়িতে উঠবি সব কটা। নয়তো তোদের ফেলে চলে যাবো।"

মিশু তখন অসহায় চাহনিতে চেয়ে থাকলো ইউসুফের দিক। ইউসুফ তখন রাগে তার চুল টেনে ধরে চেঁচিয়ে বলল,,

---"একদম ন্যাকা কান্না করবি না।  সামনে থেকে তুলে নিবো চল।"

তখন নুশরা-বুশরা বলে উঠলো,,

---"ভাইয়া আমরা আর ঘুড়বো না? তুমি না বললে ঘুরাবে?"

ইউসুফ তখন বাজখাঁই ধমক দিয়ে বলল,,

---" একটা কথা বলবি না এখন কেউ। সব কটা চুপ করে বসে থাকবি। ঘুরতে যাবে!"

ইউসুফের পাশে হুর বসেছিল। ইউসুফের এমন ব্যবহারের সাথে  অপরিচিত। তার মন আজ ক্ষুন্ন হলো অনেক। কুহু মেয়েটিকে তার প্রথম দেখাতেই ভাললাগেনি। সে ইউসুফের কাঁধে হাত রেখে বলল,,

---"ওই মেয়েকে এতটা ইম্পর্টেন্ট দিচ্ছো কেন? ওর জন্য এদের খুশি মাটি করছো কেন? দেখ মুখটা কত খানি ছোট করে রয়েছে!"

তার কথার মাঝেই মিশু বলল,,

---" কি বলছো ভাবি? আমাদের বোন?  ওকে এভাবে একা ফেলে আমরা ঘুরতে চলে যাবে? ওটা কিভাবে সম্ভব?  আর তার উপর শরীর খারাপ তার বলছিল!"

মিশুর কথা হুরে পছন্দ হয়নি মোটেও। সে এত রাতে ইউসুফের সাথে কিছুটা সময় কাঁটাতেই এসেছিল। ইউসুফ কখনো একা তার সাথে যাবে না বলে এই পুচকে মেয়েদের আনতে হলো।নয়তো সে কখনই আনতো না। তার পুরো প্ল্যানিং ভেস্তে গেলো। সে কিছুটা রেগেই বলল,,

---"তোমার বোন মোটেও ছোট বাচ্চা না! ফাইনাল ইয়ারে পড়ুয়া মেয়েরা অবশ্যই নিজের খেয়াল রাখতে জানে। "

---"আপু তুমি সামন্য..."

মিশুর কথা কেঁটে ইউসুফ শক্ত কন্ঠে বলল,,

---" নো মোর  ওয়ার্ডস।  আমরা এখন বাসায় যাবো ব্যস।"

ইউসুফ গাড়ি স্টার্ট করল।  মনে মনে তারো চিন্তা হচ্ছে। যতই হোক তার ভালবাসা সে!

কুহু ইউসুফের খোঁটা বেশ বুঝতে পাড়চ্ছিল। তার বলা সেদিনের কথা রিপিট করেছে আজ। কথা দিয়ে আঘাত করা ইউসুফের কাছে বড় কোনো ব্যাপার না। সে ঠান্ডা মাথায় কথার মাঝে যে কোনো মানুষকেই জুঁতা মারতে জানে। কথায় বলে না জুতা মেরে গরু দান ঠিক তেমন। ইউসুফের কথা গুলো সুইয়ের মতো গুতাচ্ছিল ঠিক বুকে ভিতরে। একেতো ওই হুরের সাথে দেখে সহ্য করতে পারছিল না তার উপর ইউসুফের তিক্ত কথা হজম করতে পাড়ছিল না। কুহু চোখ মুছলো। শরীরটা সত্যি খারাপ লাগচ্ছে। পুড়ো জায়গার ফোস্কাটা গলে গেছে। যার জন্য জয়গাটা আরো জ্বলছে। কুহু হালকা ফু দিতে লাগলো। তখনি মনে হলো কেউ তার পিছু নিয়েছে। তখন তার হুশ ফিরলো। শুনশান রাস্তা।  চারিদিকে কুয়াশার জন্য ঘুটঘুট অন্ধকার ল্যাম্পপোস্টের আলোতেও যেন অন্ধকার দূর করতে অক্ষম। কুহু আশাপাশে তাকালে মানুষ কেন কুকুর বিড়াল ও নেই। কুহু ভয় করতে লাগলো। নিজেকে মনে মনে গালিও দিতে লাগলো। হুট করে রাগের মাথা চলে আসা উচিত হয়নি। কুহু একটা পাতলা চাদর গায়ে জড়ানো ছিল। কুহু টেনে নিলো। দোয়া ইউনুস পড়তে পড়তে এগিয়ে যেতে লাগলো। ঠিক তখনি  চোখে সামনে অন্ধকার হয়ে গেল। শুধু মাথায় চিন চিন ব্যথা অনুভব করতে পারলো। মুহূর্তেই কুহু মাটিতে লুটিয়ে পড়তে নিতেই কয়েকটি হাত ধরে ফেললো তাকে। তা কুহু ভালই অনুভব করতে পাড়লো স্পট। আর তখনি জ্ঞান হারালো সে।

—————

চিত্রা এবার পেইজ উল্টাতেই হতভম্ব। পরের পেইজ গুলো খালি। চিত্রার মাথা আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। কুহুর সাথে কি হয়েছিল? এখন কিভাবে জানবে? চিত্রা ঘড়ির দিকে তাকালো রাত--- ০৩ঃ২০ বাজে। চিত্রা উঠে দাঁড়ালো। ভাবলো, আরো একটি ডায়রি নিশ্চয় আছে! সে আবার লাইব্রেরি রুমে গেল। হন্তদন্ত হয়ে বইয়ের প্রতিটা তাক খুঁজতে থাকলো, পেল না। শেষ-মেষ হতাশ হয়ে চেয়ারে বসে পড়লো। কি ভেবে আবার টেবিলের ড্রয়ার চেক করলো। খুশিতে তার চোখ চকচক করছে। ডায়রিটা পেয়ে গেল।সে ডায়রিটা হাতে নিলো। খুলতেই আবারো দেখতে পেল,গোটা গোটা অক্ষরে লিখা " সিঁদুর রাঙ্গা মেঘ ২"
চিত্রা এবার খুশিতে কেঁদেই ফেললো যেন। সে আবার পড়তে শুরু করলো.....।

ইউসুফরা সবাই বাসায় ফিরে এলো। সারা রাস্তা তারা দেখতে দেখতেই এসেছে কুহুকে আর পায়নি। ভেবেছে হয়তো চলে এসেছে সে। কিন্তু তাড়াতাড়ি আসার কথা না। ইউসুফ এসব ভাবতে ভাবতে উপরে উঠার জন্য সিঁড়িতে পা বাড়ায়। তখন মিশু বলে উঠে,,
---" মা কুহু এসেছে?"
হল রুমে তখন সবাই বসা। মিশুর কথায় কে কি উত্তর দেয় তা জানার জন্য ইউসুফ দাঁড়ালো।  মাইশা তখন বাসার সবার সাথে বসে গল্প গুঁজব করছে। উনি হেসে বলল,,

---" না তো! তোদের সাথে না গেল? আবার চলে আসবে কেন?"

ইউসুফের মাথায় চিন্তার ভাজ পড়লো। এতখনে চলে আসারি কথা? মিশু আবার বলল,,

---" না মা ও আগেই বের হয়েছিল। ওর নাকি শরীর খারাপ লাগছিল। আমরা রাস্তায়ও দেখতে দেখতে আসলাম কিন্তু পেলাম না।"

এবার সবার মুখে চিন্তার ছাপ ফুঁটে উঠলো। ইউসুফ উপরে না গিয়ে এবার তার মার পাশ ঘেষে বসলো আর ফোন টিপতে লাগলো। তারো চিন্তা হচ্ছে এবার। কুহু না আসা পর্যন্ত সে উপরে যেয়ে শান্তিতে বসতেও পারবে না। 
--" মা আমি আবার যেয়ে দেখে আসচ্ছি! "
মিশু বাহিরের দিকে পা বাড়াতেই মাইশা ধমকে উঠলো,,
---" তুমি এত রাতে বাহিরে যাবে না।"
---" মা আমার টেনশন হচ্ছে!"
পাশ থেকে হুর বলে উঠে,,
--" আন্টি ও তো বাচ্চা না তোমরা এত টেনশন কেন করছো। ও একা আসবে ডিসিশন নিয়েছে। না বুঝে তো নেয় নি? আর ছোট খুকিও না হারিয়ে যাবে!এতো টেনশেনের তো কিছু দেখছি না।"
মিশুর রাগ লাগলো খুব। হুর কেমন কথা বলছে এসব? এমনিতে তো তাদের জন্য এত কেয়ার করে আর কুহুর কথা যতবার আসচ্ছে তার যেন সহ্যই হচ্ছে না। মিশু একটু শক্ত কথায় বলল,,
---" কুহু আমাদের বোন ভাবি। তোমার কিছু হয় না তাই তোমার গায়ে লাগচ্ছে না। মেয়ে মানুষ এত রাতে এখনো বাসায় আসেনি। আমরা টেনশন করবো না? এ কেমন কথা বলছো তুমি?"
মিশু আর হুরের মাঝে এক প্রকার তর্কই বাঁধতে শুরু হয়। এদিকে ইউসুফের রাগ উঠতে থাকে। মেয়েটি সত্যি বড় অসভ্য হয়ে যাচ্ছে।  এবার পেলে সত্যি গাল ফাটিয়ে দিবে। ভেবেই উঠে দাঁড়ালো, সেই খুঁজবে এখন। অবস্থা খারাপ বুঝতে পারে আয়শা। সুমিও ততখনে ডুকরে উঠে।তখন আয়শা বলল,,

---" ইউসুফ বাবা দেখে আয় না কুহু কই?

আয়শার কথা শেষ হতেই ইউসুফ মাথা নাড়িয়ে বেড়িয়ে যায়। হুরুরে তখন রাগে পিত্তি জ্বলে উঠে। দু টাকার মেয়ের জন্য এত কিসের আদিখ্যেতা ওদের? শুনেছে তার বাবা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। আর থাকে ছোট শহরে। ছোট শহরে মানুষ গুলোই হয়তো এমন ন্যারো মাইন্ডের হয়? আচ্ছা এ মেয়ে ইউসুফকে আবার কেড়ে নিবে না তো? নুশরার কাছে সে শুনেছিল। চারবছর আগে ইউসুফের সাথে বিয়ে কথা ছিল। বিয়ের দিন নাকি পালিয়েও গেছিলো বিয়ে করবে না বলে!এ কথা শুনার পর থেকেই ইনসিকিউর ফিল করছে সে। তাইতো সহ্য হচ্ছে না তার কুহু নামের ব্যক্তিটিকে।  হুর রাগ থামাতে পাড়লো না।  সে মাইশাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
---" আন্টি তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।"
বলে উঠে গেল হুর। গম্ভীর মুখ খানা হুরের দেখেই মাইশা কিছু আন্দাজ করে ফেললো। মিশুরও বুঝতে বাকি নেই কিছু। ওর কাছে এখন হুরকে হিন্দি সিরিয়ালের কুটনি বউদের মতো লাগচ্ছে।মুখ ভেঙ্গচালো মিশু।

ইউসুফ সদর দরজায় আসতেই দেখতে পেল কুহু একটি ছেলের সাথে ভিতরে আসচ্ছে। ইউসুফের কঁপালের রগ দাঁড়িয়ে গেল যেন। হাতের আঙ্গুল গুলো মুষ্টিবদ্ধ  করে দাঁড়িয়ে রইল।আগে এমনিতেই রেগে ছিল। এখন একটি ছেলের সাথে দেখে আরো গা জ্বলে উঠলো তার। মুহূর্তেই অগ্নিমূর্তি ধারণ করে ফেললো একেবারে।

কুহু ইউসুফকে দেখে খানিকটা ভয় পেয়ে গেল। তবু ধীরে পায়ে হেটে ইউসুফকে ক্রস করতেই। ইউসুফ তীব্র ক্রোধের সাথে বলল,,

---" হাতে পায়েই বড় হয়েছিস? বুদ্ধিশুদ্ধি কি হয় নি? লজ্জা-হায়ার সাথে সাথে বুদ্ধিও খেয়ে ফেলেছিস?রাত-বিরাতে এখন ছেলেদের সাথে সময় কাঁটাতেও দ্বিধা হচ্ছে না তোর?"

কুহু চকিতে তাকলো।
--ভাইয়া..!

 ইউসুফের এমন তিক্ত কথায় কান গরম হয়ে গেল তার।চোখ দিয়ে নোনা জল গড়িয়ে পড়তে লাগলো  মুখ ফুঁটে কিছু বলতেও পাড়লোনা। ইউসুফের কন্ঠে শুনতে পেয়ে সকলেই বের হয়ে আসে বাসা থেকে। সদর দরজায় কুহুকে দেখে এক গাদা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় সবাই।

---" আসসালামু আলাইকুম।"

পিছন থেকে একটি পুরুষালি কন্ঠে সবাই পিছনে তাকায়।হাসি হাসি মুখে একটি সুদর্শন ছেলে দাঁড়িয়েছে। সবাই অবাক হয়ে সালামের উত্তর নিল।  কুহুর সাথে এই ছেলে কে? তখন সবার চিন্তা ধারার ভুল করে দিয়ে হুর বলে,,

---" ভাইয়া কোথায় ছিলে?"

সবাই এখন হুরের দিক তাকিয়ে। আয়শা বলল,,
---"তোমার ভাই!"
হুর মাথা নাড়ায়,,
---"হে।  আমার চাচার ছেলে। আজ এসেছে থাইল্যান্ড থেকে। তা ভাইয়ে তোমার দেড়ি হলো কেন?
তূর্য বলল,,
---"আমিতো আসচ্ছিলামিরে বনু। রাস্তায় এই আপুটিকে পাই।  কিছু ছেলে উনার মাথার পিছনে আঘাত করে কোথায় যেন নিয়ে যাচ্ছিল। আমাকে আসতে দেখে পালিয়ে গেল। আর এদিকে উনার হুশ ছিল না। কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। আশাপাশে যাদের পেলাম তাদের জিগ্যেস করলাম উনাকে কেউ চিনে কিনা বা ঠিকনা জানে কি না,  কেউ বলতেই পাড়লনা। একা ফেলে আসার সাহসও পাচ্ছিলাম না। তাই মোড়ের চায়ের দোকানে তাকে বসাই আর চোখে মুখে পানি দিতেই হুশ ফিরে।তখন জানতে পারি এই বাসার মানুষ তাই নিয়ে এলাম সাথে।"

সবাই এবার তূর্যকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। কুহুকে সাহয্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ দিলো। কিছুক্ষণ বসে কথা বলে তূর্য হুরকে নিয়ে বিদায় হলো। এদিকে কুহুর অবস্থা খারাপ।  দাঁড়িয়ে থাকা দায়। শরীরে তাপমাত্রা যেন অস্বাভাবিক ভাবে বাড়চ্ছে। তখন ছেলে গুলো মাথায় বাড়ি দেয়াতে কিছুটা ফেঁটে গেছিল। তূর্য তখন ব্যান্ডেজ করিয়ে দিয়েছে।  কুহু আর বসে থাকতে পাড়লো না রুমে চলে আসলো। পরনের কাপড় চেন্জ করে খাটে বসতেই সুমি রুমে এলো।হাতে তার কিছু মেডিসিন। কুহুকে তিনি মেডিসিন দিয়ে কাঠ গলায় শুধু এটুকু বললেন,,

---"ইউসুফের থেকে দূরে থাকবি।"

কুহু অবাক হয়ে সুমির দিকে তাকালো। সুমি আর দাঁড়ালো না চলে গেল। কুহু এবার কেঁদে দিল। আজ কুহুর সাথে এত বাজে একটি ঘটনা ঘটতে ঘটতে বাঁচলো এতে কারো কোনো হেলদুল নেই? অথচ এমন একদিন ছিল,  যেদিন কুহু মরতে মরতে বেঁচে ছিল। আর এই বাড়ির মানুষ গুলো যেন পাগল পাগল হয়ে গেছিল আর আজকে?

কুহু মনে করতে লাগলো সেই দিনটির কথা,,

স্কুলে গণ্ডি পেরুতেই কুহুকে পাঠিয়ে দিল ময়মনসিংহ মামা  বাড়ি। ছোট থেকে কুহুর বাবার শখ তিনি তার দুই মেয়েকে প্রতিষ্ঠিত করবে। এবিষয়ে না খোশ ছিল সুমি।  স্বামির সাথে এ নিয়ে ঝগড়াও করেছেন বহুত। তার মতে,,

---" মেয়ে যথেষ্ট বড় হয়েছে। আর পড়াতে হবে না। এত টাকা খরচ করে কি করবে? মেয়েতো শ্বশুর বাড়ি যাবে! শুধু শুধু টাকা নষ্ট!"

তখন আসাদ তার বউয়ের কথার প্রতিবাদ করে বলেছিলেন,,
--" আমি চাই না আমার মেয়েরা সারা জীবন চুলো গুঁতোক। আমি চাই তারা পড়াশোনা করে নিজে পায় দাঁড়াক। স্বাবলম্বী হোক। বিয়ের পর তাদের স্বামি কেমন হবে কে জানে? পড়াশোনা শিখা থাকলে অত্যন্ত  নিজে কিছু করে খেতে পাড়বে। "
আসাদের এমন লজিক দেখিয়ে কথা বর্তার সাথে সুমি কখনো পারেন না। তাতে তার ক্ষোভ থেকেই যায়।সেই কারণে তিনি কুহুকে শহরে দিতে আসেন নি। আসাদ আসেন,  মেয়েকে নিয়ে।  মূলত  তিনি মেয়ে হোস্টেলে রাখতে চাইছিলেন কিন্তু তাতে নাহর খুব রাগ করে।তার মতে,,
---"আমার এতে বড় বাড়ি থাকতে নাতনী আমার হোস্টেলে উঠবে? অসম্ভব। "
 শাশুড়ির সাথে কথা না পেরে  কুহুকে এখানেই রেখে যায়। এবং ভর্তি করিয়ে দেয় ইউসুফের ভার্সিটির সামনের কলেজে। মূলত সেই কলেজটি সেই ভার্সিটির আন্ডারে।

ছোট থেকেই ইউসুফকে কুহু ভয় পেত। ইউসুফও কুহুকে তার মেজাজের উপর রাখতো! কুহুকে এ বাসায় পা রাখার পর থেকেই যেন ইউসুফের পার্মানেন্ট কাজের লোক হয়ে উঠলো। কুহুর প্রথমে রাগ উঠতো। পরে তা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেল।

একদিন ইউসুফ খেতে বসে বলল,,
---"কুহু কাল কলেজে যাস না।"
কুহু ভ্রু কুচকালো,,
--"কেন ইউসুফ ভাই?"
--"আমি না করেছি তাই!"
কুহুর রাগ লাগলো। কাল তার এক বান্ধবীর জম্মদিন। সে কথা দিয়েছে কুহু আসবে। কুহু রেগে বলল,
--" আপনি বললেই হলো? আমি যাবো তো যাবোই। আপনি বলার কে?
ইউসুফ তখন বাম হাতে কুহুর পিঠে পড়ে থাকা বেনুনীটা টেনে হাতে পেঁচিয়ে কিছুটা টান দিলো। কুহু ব্যথায় কুকিয়ে উঠে মুখ দিয়ে "আহ্" শব্দ বেড়িয়ে এলো। ইউসুফ সেদিকে পাত্তা না দিয়ে বলল,,
--" বেশি কথা শিখে গেছিস না। গেলে একেবারে ঠেঙ্গ ভেঙ্গে হাতে ধরিয়ে দিবো।"
বলেই খাবারের মাঝেই হাত ধুয়ে উঠ গেল। এদিকে কুহু কান্না করার অবস্থা। মনে মনে ভাবলো। ইউসুফ কাল বের হয়ে গেলেই পড়ে সে বের হবে।

যেইভাবা সেই কাজ। ইউসুফ পরের দিন বের হতেই। কুহুও বেড়িয়ে গেল। ভার্সিটির এক নাম্বার গেট পার করতেই কুহু এক জটলার মাঝে পড়ে গেলো। এখানে দু দলের ঝগড়া চলছিল তখন। ঝগড়ার এক পর্যায় মারামারি লেগে যায়। তখন বাহিরের কিছু লোক এসে দোকান পাঠ আর রিকশা এসব ভাঙ্গা শুরু করে। কুহু তখন রিকশা ওয়ালাকে ফিরিয়ে যেতে বলল। কিন্তু ততখনে খুব দেড়ি হয়ে গেছে।
কুহুদের রিকশায় হামলা করে বসেছে তারা। রিকশা ওয়ালা রিকশা ছেড়েই পালিয়েছে। কুহু তখন হতবুদ্ধি। কি করবে ভেবেই এক লাফে নেমে রাস্তার এক কর্ণারে চলে আসলো। তখনি দেখতে পেল সেই রিকাশাটিতে এক দল আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। কুহু এবার ভয় আত্মকে উঠলো। ব্যগ থেকে কোনো রকম ফোন বের করে তার সেই বান্ধবীকে কল করতেই সে জানালো আজ ভার্সটির রাস্তায় গন্ডোগোল তাই তারা আসে নি। কুহু  যেন বেকুব বসে গেল। মনে পড়লো ইউসুফের বলা কথা। তখন না শুনে যে ভুল করেছে তার মাশুল এটা। কুহু এবার হাটা ধরলো। কিন্তু লাভ হলো না।  পুলিশ আসতেই তাদের সাথে শুরু হলো আরেক দফা হানাহানি। কুহু কি করবে এখন? ভেবে ইউসুফকে ফোন দিয়া শ্রেয় মনে করলো। পড়ে আবার ভাবলো ইউসুফ জানলে তাকে আস্ত রাখবে না কি করবে এখন? কুহুর এসব ভাবতে ভাবতে ইউসুফের ফোনে মিসড কল চলে গেছিলো। সেকেন্ডই কল দিলো সে। কুহু ফোন তুলে কেঁদে দিল। অপাশ থেকে ইউসুফ বিচলিত হয়ে বলল,,
---" বাবুইপাখি  কাঁদচ্ছিস কেন? কি হয়েছে? আর তুই কই এত চিল্লাচিল্লি হচ্ছে কেন?  কথা বলছিস না কেন??

কুহু কিছুই যেন বলতে পারছে না কান্না গুলো সব দলা পাইকিয়ে গলায় আটকে আছে যেন। তবুও খুব কষ্টে 
 কাঁপা-কাঁপা কন্ঠে বলে উঠলো,,

---" ভাইয়া আমি কলেজে এসেছিলাম আর...!"

কুহু তার কথা আর শেষ করতে পাড়লো না শুরু হলো ইউসুফের ঝাড়ি। নিরবে কুহু শুধু হজম করে অসহায় গলায় এইটুকু বলল,,

---" প্লীজ হেল্প মি ইউসুফ ভাই।"

ওপাশে তখন ইউসুফ চুপ হয়ে গেল কুহুর কাতর কন্ঠে। কিন্তু কিছু মিনিট অতিবাহিত হতেই শুনতে পেল কুহু গগনবিদারী চিৎকার।  

ইউসুফ সেখানেই থমকে গেল যেন। কি হয়েছে তার বাবুইপাখির সাথে ভাবতেই মাথা ফাকা হয়ে যাচ্ছে তার। কোনো রকম ঘটনাস্থলে পৌঁছাতেই দেখতে পেল কুহুর নিথর দেহ এম্বুলেন্সে উঠানো হচ্ছে। ইউসুফের যেন মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। পায়ের নিচ থেকে যেন মুহূর্তেই মাটি সরে গেল। কুহুর শরীরে লাল রক্ত গুলো দেখে ইউসুফের শরীরে শিরা-উপশিরা ঠান্ডা হয়ে উঠলো বরফের নেয়।ইউসুফ যেন নড়তেই পাড়ছিল না। ইউসুফ তখন হেলে পড়তেই তার সাথে আসা দুই বন্ধু জায়েদ আর সাবিত ধরে ফেললো। কুহুর তখন যেন হালকা হুশ ছিল দূর থেকে ইউসুফকে দেখে হাত উঁচু করে ডাকলো। ইউসুফ  তখন যেন শরীরে সব ভার ছেড়ে দিয়েছে। নিজের ভালবাসার মানুষটিকে এমন রক্তাক্ত অবস্থা দেখে ইউসুফের যেন কলিজা ছিঁড়ে যাচ্ছে। কোনো রকম ভাড় শরীর টা টেনে বন্ধুদের সাহায্য কুহুর কাছে পৌঁছালো। কুহু তখন কাঁদচ্ছিল। চোখ গুলো বুজে বুজে আসচ্ছিল যেন! ইউসুফ  যেন পাথর হয়ে রয়েছে। কুহু শুধু ইশরায় একটি বাচ্চাকে দেখিয়ে বলল কোনো রকম,,

---" ওর বাবা-মার কাছে পৌঁছে..."

আর কিছু বলতে পারে না কুহু জ্ঞান হারায়। কুহুর আর সাড়া শব্দ না পেয়ে ইউসুফ পাগলের মতো চিৎকার করে উঠে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন