উমাকে ভেঙ্গে পড়তে দেখে শাশ্বত বলে,
“চিন্তা করো না উমা, সব ঠিক হয়ে যাবে।“
শাশ্বতের শান্তনা আদিক্ষেতা ঠেকলো রুদ্রের কাছে। সে তাকে কিছু বলার পূর্বেই ডাক্তারের আগমন ঘটলো। চিন্তিত মুখে তিনি দাঁড়ালেন পরিবারের লোকের সামনে। ডাক্তারকে দেখে রুদ্র এগিয়ে গেলো তার কাছে। উৎসুক কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
"রোগী কেমন আছে?"
ডাক্তার মুখোভাব অপরিবর্তনীয় রেখে উত্তর দিলো,
"ভালো না, হার্টের ব্যামো। অনুমান করছি, হার্ট এট্যাক করেছে। রিপোর্ট আসতে দুদিন লাগবে। তত সময় না হয়, হাসপাতালেই থাকুক। আমাদের পর্যবেক্ষনে থাকলে বোধ করি খারাপ কিছু হবে না। তবে বলি কি, শহরের দিকে নিতে হবে। হার্টের ব্যাপার গুলো কিছুই বলা যায় না৷ তাই আপনাদের সিদ্ধান্ত ই সব কিছু। চেয়ারম্যান সাহেবের উপস্থিতিতে বলি, অবস্থা কিন্তু ভালো নেই।"
ডাক্তারের কথায় রতী চাপা আর্তনাদ করে উঠলো৷ রাজশ্বী উমার হাত চেপে ধরলো। উমা নীরব কাতর দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো রুদ্রের দিকে। মস্তিষ্ক ফাকা ফাকা লাগছে। বুকটা ভারী হয়ে আসছে তার। কিন্তু সে কাদলে ছোট ভাই বোনগুলোর কি হবে! তাদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভাবতেই সারা শরীর হিম ধরে যাচ্ছে। তাই ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকে রাখলো সে। রুদ্র একবার উমার পানে চাইলো। তারপর ডাক্তারের সাথে একান্তে কিছু কথা বলার জন্য এগিয়ে গেলো। এদিকে অভিনব সিংহ এবং লক্ষী দেবী এগিয়ে এসে উমার কাছে দাঁড়ালেন। অভিনব সিংহ গম্ভীর স্বরে বললেন,
"বউ মা আমাদের যেতে হবে। বিকেল হতে চললো। এখন না বের হলে রাত হয়ে যাবে। রুদ্র এবং শাশ্বত তো আছেই। তারাই দেখে নিবে। বলি কি! ভাইবোন এবং মাকে নিয়ে না হয় তুমি আমাদের সাথে চলো।"
"আমি যাবো না বাবা, বাবাকে এই অবস্থায় রেখে আমি কি করে যাই। শুধু শুধু ছটফট করবো। এর চেয়ে বরং আমি থেকে যাই উনার সাথে। আপনার বরং মাদের নিয়ে যান। এতো মানুষের তো এখানে কাজ নেই।"
উমার কথায় মোটেই রাজী হয় না রতী৷ সে নিখিলকে ছেড়ে যাবে না। বলা তো যায় না কখন কি হয়। বিধানা না করুক যদি কিছু হয়ে যায় শেষ দেখাটাও মিলবে না। উমা তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে,
"বাড়ি যাও মা, ভগবানের কাছে প্রার্থনা করো। দেখবে সুস্থ হুয়ে বাবা ফিরবে। কেঁদো না, কেঁদে কি হবে বলো। বিধাতা যা ঠিক করে রেখেছেন সে তো হবেই তাই না? গোপালটার মুখটা মলিন হয়ে গেছে। বেঁচারার পেটে কিছু পড়েছে কি না সন্দেহ। তুমি বরং ওদের নিয়ে বাড়ি যাও, বুঝলে। কেঁদো না মা। আমি আছি তো।"
এই প্রথম মায়াময়ী চাহনীতে রতী উমার দিকে তাকায়। উমার কথাগুলো যেনো মনে এক অনন্য শক্তি সঞ্চার করলো৷ মনের আঙ্গিনায় নিভু প্রদীপখানা যেনো তেজ পেলো। অবশেষে রাজশ্বী, গোপালকে নিয়ে অভিনব সিংহের সাথে গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো রতী। উমা হাসপাতালের বারান্দায় বসে রইলো৷
শাশ্বত অভিনব সিংহ দের এগিয়ে দিতে গেলো। রাজশ্বী ফুপিয়ে উঠছিলো বলে তাকে একটা মাম পানির বোতল কিনে দিলো শাশ্বত। রাজশ্বী নতজানুতে গ্রহন করলো সেটা। শ্যাম মুখখানা কে বেশ পরিশ্রান্ত লাগলো শাশ্বতের কাছে। শ্যাম মুখখানা যেনো আরো বেশি কালো লাগছে, চোখজোড়া কোঠরে চলে গেছে। অবশ্য হৃদয় যখন বেদনাচ্ছন্ন হয়ে থাকে তখন চেহারায় মলিনতা ফুটে উঠবে এটাই স্বাভাবিক। শাশ্বত স্মিত হাসি দিয়ে বললো,
"পেত্নীরা মানসিকভাবে এতোটা দূর্বল হয় জানা ছিলো না। এতোটা ভেঙ্গে পড়লে চলবে কি করে?"
রাজশ্বী অবাক নয়নে তাকালো শাশ্বতের দিকে। লোকটির কথায় খানিকটা লজ্জাও পেলো সে। শাশ্বত যে তার দিদির দেবর হবে সেটা ভাবে নি সে। রাজশ্বীর নত মুখখানা দেখে শাশ্বত নীরব থাকলো। যাবার পূর্বে নীচু কন্ঠে একটাই কথা বললো রাজশ্বী,
"দিদির দিকে খেয়াল রেখেন"
কথাটা খুব ধীর হলেও শাশ্বতের কর্ণকুহরে ঠিক পৌছালো। শাশ্বত স্মিত হাসির বিনিময়ে সম্মতি জানালো। রাজশ্বীদের বিদায় দিয়ে হাসপাতালে ফিরলো সে। উমা তখনো বসে আছে বারান্দায়৷ তার দৃষ্টি শূণ্য। অশান্ত লাগছে। মনটা হাসফাস করছে তার। শাশ্বত এসে তার পাশে বসলো। কিন্তু তাতে উমার কোনো ভ্রুক্ষেপ হলো না। সে আগের ন্যায় স্থির রুপেই বসে রইলো। হাসপাতালের বারান্দায় এক ভয়ংকর নীরবতা বিরাজমান। এই নীরবতার গাঢ়ত্ব যেনো বাড়ছে সময়ের সাথে সাথে। এক অদ্ভুত জায়গা এই হাসপাতাল, সুখ দুঃখগুলো মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। কারোর চাপা আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে তো কারোর খুশির কল্লোল। একজনের কিছুক্ষণ পূর্বে পুত্র সন্তান হয়েছে তো একজনের স্ত্রী মাত্র শ্বষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো। বারান্দা থেকে শব্দ গুলো কানে আসছে উমার। অপ্রকাশ্য এক অনুভূতি যেনো তাকে ঘিরে রেখেছে। চোখ থেকে নোনা জল গড়াচ্ছে না, কিন্তু বুকের বিষাদের কালো ঢেউ উঠছে। উমা তাকিয়ে রইলো মোজায়িকের মেঝের দিকে। মনে মনে এক আকুল নিবেদন ই করলো,
"বাবাকে সুস্থ করে দাও ঠাকুর।"
রুদ্র ফিরলো ডাক্তারের সাথে কথা বলে। শাশ্বত তখন উমার জন্য কিছু খাবার কিনে তার হাতে ধরালো। মেয়েটির মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে কিছু খায় নি। তাই রুদ্র ফেরার পূর্বেই শাশ্বত ই তার জন্য খাবার কিনে আনলো। কিন্তু গলা দিয়ে রুটির টুকরোটা যেনো নামছে না উমার। সে ধীর স্বরে বললো,
"খাবো না শাশ্বত বাবু, জোর করবেন না দয়া করে।"
"এ বললে হবে? দুপুরে খেয়েছো বলে তো মনে হলো না। এখন বিকেল চারটে বাজে। এই বনরুটিখানা খেয়ে নাও।"
"গলা দিয়ে যে কিছুই নামবে না। ভয়ে গলাটা কাঠ হয়ে আসছে। উনি ফিরুক, শুনি ডাক্তার বাবু কি বললো!"
"বেশ, রুটিখানা রাখলুম। খেয়ে নিও।"
শাশ্বতের সাথের উমার কথাবার্তা সহ্য হচ্ছে না রুদ্রের। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে কোনো কান্ড করতে বিবেকে বাধছে। রুদ্র এগিয়ে গিয়ে উমার সম্মুখে দাঁড়াতেই উমা ব্যস্ত হয়ে উঠলো। আবেগী গলায় বললো,
"ডাক্তার কি বললো?"
রুদ্র কিছুক্ষণ নীরব থেকে বললো,
"অবস্থা সুবিধার নেই। আমি আইসিউ তে রাখতে বলেছি। ওয়ার্ডে রাখাটা বুদ্ধিমানের হবে না। কিন্তু এখানে সেটা নেই। তাই আমার মনে হয় ঢাকায় নেওয়া উচিত। এখানের ডাক্তারের চামড়া মোটা, গরজ কম। হার্টের ব্যাথা ক্ষণে ক্ষণে উঠছে। পড়ে সময় দিবে না। হুট করে কিছু হয়ে গেলে আমাদের করার কিছুই থাকবে না।"
"অতদূর নিবেন কি করে?"
"এম্বুলেন্সে বেশি সময় লাগবে বলে মনে হয় না। ফেরিতে রোগী দেখালে ছেড়ে দেয়। আমি বলি কি, আজ রাত এখানে থাক। সকালেই ব্যাবস্থা করি। আমি বলে এসেছি৷ রিপোর্ট ওরা সকালেই পেয়ে যাবে। এখান থেকে মোটামোটি চিকিৎসা দিয়েই সকালে নিয়ে যাবো। কিন্তু আমার চিন্তা সেটা না। হুট করে এমন টা হলো কেনো? উনার কি আগে সমস্যা ছিলো?"
"বুকে ব্যাথা ছিলো, ঔষধ খেতো। কিন্তু এতোটা সাংঘাতিক হবে বুঝতে পারি নি।"
"তুমি চিন্তা করো না। আমরা সকল চেষ্টা করবো। বিধাতা চাইলে ঠিক সুস্থ হয়ে যাবেন তিনি৷ তুমি খেয়ে নাও। আমি একটু শাশ্বতের সাথে কথা বলে আসছি।"
উমা মাথা নাড়ালো। রুদ্র শাশ্বতের উদ্দেশ্যে বললো,
"একটু শুনে যা তো"
শাশ্বত কথা না বাড়িয়ে রুদ্রের পিছু পিছু গেলো। উমা থেকে অনেকটা দূরে দাঁড়ালো তারা। শাশ্বত অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
"হুট করে ডাকলি যে? ওখানেই বলতি। উমা তো ওখানে একা। ডাক্তার ডাকলে তখন সমস্যা হবে।"
"আমার বউ এর প্রতি এতো দরদ দেখাবার তো প্রয়োজন নেই। কেনো করছিস এগুলো। ভাবিস না আমি কিছু বুঝি না"
"কি বুঝিস?"
"এই লুকিয়ে লুকিয়ে বই দেওয়া, হেসে হেসে কথা বলা আমি দেখি না ভাবছিস? সবই দেখি। আমার সাথে লড়বি সরাসরি লড়। ওকে ভায়া করছিস কেনো? আমার কোনো গোপন খবর ই উমা তোকে দিবে না।"
শাশ্বত কিছুক্ষন চেয়ে রইলো রুদ্রের দিকে। রুদ্রের মুখিটা লাল হয়ে আছে ক্রোধে। শাশ্বত একটি তাচ্ছিল্যময় হাসি হাসলো। তারপর বললো,
"তাহলে তুই বলে দে, মামা মশাই এর পুলিশে ধরাবার পেছনে কি তোর হাত ছিলো?.......
—————
শাশ্বত কিছুক্ষন চেয়ে রইলো রুদ্রের দিকে। রুদ্রের মুখিটা লাল হয়ে আছে ক্রোধে। শাশ্বত একটি তাচ্ছিল্যময় হাসি হাসলো। তারপর বললো,
"তাহলে তুই বলে দে, মামা মশাই এর পুলিশে ধরাবার পেছনে কি তোর হাত ছিলো? আমি তো পুলিশকে কোনো খবর দেই নি, তবে এতোটা নিখুঁত খবর দিলোটা কে? মামা মশাই এর একজন ই বিশ্বস্ত কুকুর রয়েছে সে হলো তুই”
শাশ্বতের প্রশ্নে ঈষৎ বিস্মিত হলো রুদ্র। কিন্তু বিস্ময়ের কোন সুক্ষ্ণ রেখাও আনলো না মুখোভাবে। উলটো বিদ্রুপের হাসির প্রলেপ একে বলল,
“তোকে কি খবরের কাগজের দপ্তর থেকে ছাটাই করে দিয়েছে? দেখি তো বাড়িতেই বসে থাকিস, তা কি বাড়ি বসে বসে কি বোমকেশ হবার সখ জেগেছে নাকি? আবল তাবল বকছিস তাই”
“আমি আবল তাবল বকছি?”
“বকছিস না? ছেলে হয়ে বাপ কে কেউ জেলে দেয়?”
“তোদের বাপ ছেলের কি সম্পর্কের টান বলে কিছু আছে? তোরা তো শুধু সুযোগ খুজিস, কিভাবে অন্যকে চুষে নিজের ফয়দা করা যায়। ভুল বললাম? তুই খুব ভালো করেই জানিস মামা মশাই তোকে কোনোভাবেই নিজের পথের কাঁটা হতে দিবেন না। তাই তো তুই মামা মশাইকে শাহাদাতের কেসে ফাসালি। শাহাদাতকেও হাসপাতালে পাঠানোর পেছনে তোর হাত আছে। মামামশাই ভেবেছিলো ছেলেতো তার শত্রুতে শাস্তি দিয়েছে। তাই দুপুর হতে না হতে তিনি শহরে ছোটেন। তিনি আসলে কিশোরগঞ্জ গিয়েছিলেন। কিন্তু এখানে ছেলে তো তাকেই নিজের রাস্তা থেকে সরাতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। তুই ভালো করেই জানিস, মামা মশাই এর নামে অপবাদ দিলে তাকে পার্টির লোকেরা এবার অন্তত দাঁড়াতে দিবে না। সেও খানিকটা ভয় পাবেন। সেই সুযোগে তোর হাতে খড়ি হবে পার্টিতে। ঠিক না?“
রুদ্র কিছুক্ষণ সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো শাশ্বতের চোখের দিকে। শাশ্বতের কথায় এক অন্য আত্নবিশ্বাস রয়েছে। সে নির্ভীক, তার চোখে ভয়ের ক্ষীন রেখাও নেই। রুদ্র এবার শব্দ করে হেসে উঠে। তারপর হাসি থামিয়ে বলে,
“তুই তাহলে আমার পেছনে গুপ্তচর লাগিয়েছিস? আমি ত ভেবেছিলাম তুই শুধু রকিবুল মাস্টারের সাথে হাত মিলিয়ে বাবার পর্দা ফাঁশ করার ধান্দায় এসেছিস। এখন তো দেখছি আমাকেও ছাড়ছিস না। ভালো ভালো। তবে এতোক্ষন যা বললি, তুই সেটা প্রমান করতে পারবি না। কারন আমি বাবার ন্যায় কাঁচা খেলোয়ার নই। শোন আমি কি বলি, অহেতুক আমাদের পেছনে লাগিস না। কর্ম কর, ভালো সাংবাদিক তুই অথচ আমাদের পেছনে হাত পা ধুয়ে পড়েছিস। সত্যি বলছি সময় নষ্ট। কারণ আমি থামছি না, আমার খেলায় যে আসবে হয় তাকে সরে যেতে হবে নয়তো আমি সরিয়ে দিবো।“
বেশ ঠান্ডা কন্ঠে কথাগুলো বললো রুদ্র। শাশ্বত চোখ কুচকে তাকিয়ে রয়েছে রুদ্রের দিকে। রুদ্রের মতো জেদী মানুষের দ্বারা এমন কথা বলা অস্বাভাবিক নয়। কথা শেষ হবার পর শাশ্বতের উত্তরের অপেক্ষা করলো না সে। উমার কাছে যাবার জন্য পা বাড়ানোর সাথে সাথে শাশ্বত পেছন থেকে বলে উঠলো,
“তুই য়ার মামা মশাই এর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই জানিস তো। একেবারে বাপের বেটা কি না”
কথাটা শুনে পেছনে ঘুরে তাকায় রুদ্র,। তার ভ্রু যুগল কুঞ্চিত হয়ে আসে। তীর্যক দৃষ্টি প্রয়োগ করে শাশ্বতের দিকে। কিন্তু শাশ্বত তা উপেক্ষা করে শক্ত কন্ঠে বলে উঠে,
“ ভাবিস না তুই আর মামা মশাই আলাদা, ক্ষমতার জন্য যেমন মামা মশাই সকলকে ব্যাবহার করেন ঠিক তেমন ই তুই ও করিস। যেমনটা এখন উমাকে করছিস। আমি তোকে হাড়ে হাড়ে চিনি রুদ্র। শুধু নিজের লাভের জন্য ই তুই উমাকে ব্যাবহার করছিস। এই ষোড়শী মেয়েটি কেবল ই তোর দাবার গুটি। সুযোগ এলে ওকে বলি দিতেও দুবার ভাববি না।“
রুদ্রের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। শাশ্বত তার পাশ কাটিয়ে চলে যায় বারান্দার দিকে। শাশ্বতের শেষ কথাটা কর্নকুহরে ঝংকার তুলছে। সত্যি কি সে তার বাবার মত? সত্যি কি সময় আসলে সে উমাকে ও বলি দিবে? প্রশ্নগুলো সময়ের জন্যই তোলা থাক। সময় সব প্রশ্নের উত্তর এক এক করে দিয়ে দিবে।
রাত ঘন হচ্ছে, ঘুমের ঔষধ দেবার কারণে ঘুমোচ্ছেন নিখিল বাবু। তার ঠিক পাশে বসে আছে উমা। রোগীদের একজন কে তার পাশে থাকতে দিচ্ছে। তাই উমাই থাকছে আজ রাত্রি। শাশ্বত এবং রুদ্র উভয় ই বাহিরের বেঞ্চিতে অপেক্ষারত। দুজন দুজনকে সহ্য না করলেও উমার খাতিরে মুখ বুঝে একই সাথে রয়েছে। রোগীদের জন্য রাত্রী খুব বিপজ্জনক। বেশিরভাগ অঘটন এই কালো রাত্রীতেই ঘটে। তাই রাত্রী সজাগ এবং সচার থাকাটা জরুরী। উমার দুপুর থেকে পেটে কিছুই পড়ে নি, রুদ্র জোর করে হাতে ঠান্ডা বনরুটি ধরিয়ে দিয়েছে। ঠান্ডা বনরুটিখানা দাত দিয়ে কাটতে চাচ্ছে না। তবুও পে্টের ক্ষুদা এক অসহনীয় যন্ত্রনা। উমা খানিকট জোর করেই খেলো রুটিটা। নিখিল নাকে অক্সিজেন লাগিয়ে ঘুমিয়ে আছে। উমা শান্ত দৃষ্টিতে বাবার দিকে চেয়ে রইলো। কাঁচা পাকা চুল গুলোয় ক্ষনে ক্ষনে হাত ঘুরিয়ে দিচ্ছে। মেয়ে বড় হলে পিতা হয়ে যায় পুত্র। উমার ক্ষেত্রেও সেটাই, তার অচেতন পুত্রকে ক্ষনে ক্ষনে আদর করে দিচ্ছে সে। তার বারে বারে চোখজোড়া ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে তার। অসহায় মুখখানি দেখলেই কান্নার বেগ বাড়ছে। হ্যা্, নিখিল মানুষ হিসেবে অত্যন্ত অপদার্থ, কিন্তু সে একজন পিতা। আর সন্তানের কাছে পিতা যেমন হোক না কেনো সে তার সর্বোমূল্যবান ব্যাক্তি। উমা ও ব্যতিক্রম নয়, তাই তো পিতার এই দূর্সময়ে তার হাত খানা ধরে ক্লান্ত মেয়েটি অশ্রুসিক্ত নেত্রে রাত্রীযাপন করছে। হুট করেই নড়ে উঠলো হাতখানা, উমাও নড়ে উঠলো। মিহি কন্ঠে বলল,
“বাবা কিছু লাগবে?”
নিখিল চোখ খুললো। প্রথমে কিছুক্ষন শুন্য দৃষ্টিতে চাইলো, হয়তো ঠাহর করতে পারে নি। উমা ধীর স্বরে বলল,
“আমি উমা, আমাকে চিনতে পারছো?”
নিখিলের চোখ অশ্রুসিক্ত হলো। কাঁপাহাতে উমারহাত খানা আকড়ে ধরলো। কিছু অস্পষ্ট শব্দ শোনা গেলো ঠিক ই কিন্তু বোঝা গেলো না। শ্লেষ্মা জড়ানো গোঙ্গানি বুঝতে পারলো না উমা। সে এগিয়ে গেলো। মুখের কাছে কান ঠেকালো। নিখিল গো গো করছে, উমা বুঝতে পারলো বাপের কষ্ট হচ্ছে। তাই মৃদু স্বরে বললো,
“কথা বলো না বাবা, কষ্ট হবে”
কিন্তু নিখিল থামলো না, সে কাঁদছে এবং গোঙ্গাচ্ছে। বারে বারে মাস্ক খোলার জন্য মরিয়ে হয়ে উঠছে। এক অস্থির অস্থিরতা কাজ করছে তার মধ্যে। যেনো এখন কথাখান না বললে তার শান্তি নেই। উমার বুকটা হুট করেই কেঁপে উঠলো। যেনো এক অদ্ভুত শক্তি তার আসে পাশে ঘিরে আসছে। প্রান যাবার সময় কি এমনটা হয়? নিখিলের অস্থিরতা বাড়লো। উমা সময় ব্যয় না করে হাক দিল রুদ্রকে,
“শুনছেন, বাবা যেনো কেমন করছে।“
রুদ্রের চোখ বুঝে আসছিলো। উমার ডাকে ঘুম পালিয়ে গেলো। সে ছুটে গেল উমার কাছে, শাশ্বত ডাক্তার ডাকতে গেলো। সরকারি হাসপাতালে এই এক সমস্যা, ডাক্তার পাওয়া যায় না। নার্স এলো হেলেদুলে। নিখিল যথারীতি হাসফাস করছে। গো গো আওয়াজটা বাড়ছে। নার্স তার অবস্থা দেখে একটা ইঞ্জেকশন দিলো। কিন্তু কাজ দিলো না। নার্সের মুখে চিন্তা দেখা গেলো। সে ওয়ার্ড বয়কে ডাকলো। উমা এদিকে ভয়ে ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। বুকটা লাফাচ্ছে, এক অজানা অস্থিরতা কাজ করছে। নিঃশ্বাস যেনো আটকে আসছে। চোখ থেকে অনবরত পানি পড়ছে। কি করলে বাবাকে ঠিক করবে তার জানা নেই। রুদ্র উমার হাত শক্ত করে ধরলো। কঠিন সত্যের জন্য সে প্রস্তুত কিন্তু তার ষোড়শী নয়। বেঁচারি নিজ পিতার এমন শেষ মূহুর্তটি ঠিক নিতে পারবে কি জানা নেই। ওয়ার্ড বয় এলো, বুকে বেশ কিছুবার আঘাত করলো। প্রায় আধা ঘনটা যমে কোস্তাকোস্তি করলো, অবশেষে……………