উপহার - পর্ব ০৮ - সুলতানা পারভীন - ধারাবাহিক গল্প


১৫!! 

মেহেরের ডাকে হুঁশ হল মাইশার৷ এতো ভেবে বৃথাই সময় নষ্ট করছে সেটাও বুঝতে পারছে। সবাই এক রকম না সেটা তো ওকে যেভাবেই হোক মানিয়ে নিতেই হবে। রাতুল ছলনা করেছে বলে ধ্রুবও যে ছলনা করবে এমনটা তো না ও হতে পারে! তবু মনটায় একটা খচখচানি ঠিকই থেকে যাচ্ছে। আর এই খচখচানিটা কিছুতেই ইগনোর করতে পারছে না মাইশা। কথায় আছে-ঘর পোড়া গরু শিঁদুরে মেঘ দেখে ভয় পায়।। মাইশারও কি সেরকমই কিছু হচ্ছে?

-এই ভাবিইইইইইই---?

-হুম? কি মনি?

-কি ভাবো এতো? কখন থেকে ডাকছি!

-বলো না মেহেরমনি---।

-তোমার গিফ্টগুলো অসাম হয়েছে। একসাথে এত্তোগুলা গিফ্ট! হি হি।

-তোমার পছন্দ হলেই হল বাবু--।

-ভাবি? তোমার সারপ্রাইজ পাওয়া শেষ--। এখন আরেকজনকে সারপ্রাইজ দেয়া যাক? কি বলো?

-কা-কার-কার কথা বলছ?

-হি হি হি---৷ তুমি যার নাম চিন্তা করে তোতলাচ্ছ তার কথাই বলছি আমিও--। হি হি।

-বড্ড দুষ্টু হয়েছ না?

-হি হি। একটু---। চলো চলো?

-কো-কো-কোথায়!

-আরে আগে আসো-। নিজেই দেখে নিও--।

-হুম----।

মেহের হাত ধরে টেনে নিয়ে চলেছে। দোতলার একটা রুমের দিকে। রুমের সামনে আসতেই আস্তে আস্তে প্রায় নিঃশব্দে রুমের দরজাটা খুলল। তারপর মাইশাকে ইশারায় ডুকতে বললো। মাইশা চোখ বড় বড় করে মেহেরের দিকে তাকাতেই মেহের হাসছে মুখ টিপে।

-ভাবি? শোনো? ভাইয়া আজকে আমাকে উইশও করে নি--। কোন গিফ্টও দেয় নি। তুমি কিন্তু বকে দিবা ভাইয়াকে। আর আমার ডাবল গিফ্ট না দিলে কিন্তু আর এমন সারপ্রাইজ দিব না সেটাও বলে দিবা--। হি হি----। 

মেহের প্রায় ঠেলেই মাইশাকে রুমটাতে ঢুকিয়ে দিয়ে আবার নিঃশব্দে দরজাটা টেনে দিয়ে গেল। মাইশা রুমের দিকে তাকাতেই অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। হালকা এ্যাশ কালারে রাঙা রুমটার চারপাশের দেয়ালগুলো। মাঝারি সাইজের একটা বেডে সাদা রঙের বেডকাভার। বালিশে দেয়া কাভারগুলো ধবধবে সাদা। সাদা চাদর গায়ে বিছানায় শুয়ে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে ধ্রুব। বাম পাশে কাঁত হয়ে সাদা কাভার লাগানো কোলবালিশটা জড়িয়ে ধরে আছে ধ্রুব। ওকে দেখামাত্রই মাইশার হার্টবিট যেন হঠাৎই একটু বেড়ে গেল। ধ্রুবকে দেখে মনে হচ্ছে মেঘের রাজ্যে এসে ঘুমন্ত মেঘকুমারকে দেখছে। দেখে যেন অন্য দুনিয়ায় চলে যাচ্ছে মাইশা।

মাইশা ধ্রুবর দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে অন্য পাশে তাকাল। ধ্রুবর ঘুমন্ত মুখটা দেখতে দেখতে ঘোর ঘোর লাগছে মাইশার। সাথে হার্টবিটের ছন্দবদ্ধ লাফালাফি তো আছেই। বুক ভরে বাতাস টেনে হালকা করে শ্বাস ফেলে একটু স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলো মাইশা। বুকের ধুকপুকানির স্বাভাবিক হলে ধ্রুবর দিকে না তাকিয়ে রুমের বাকি জিনিসগুলো দেখায় মন দিল মাইশা। এই লোকের দিকে তাকানো মানেই নিজের পায়ে কুড়ুল মারা। তাই মনযোগ অন্য কিছুতে দেয়া যাক!

বিছানার ডান পাশে রুমে ঢুকার দরজাটা। আর বাম পাশে বারান্দা। আর ঠিক অপজিটে ওয়াশরুম। বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতেই মাইশা দেখলো এটা যেন বারান্দা নয়- ফুলের বাগান! কতো রকমের ফুল যে ফুটে আছে! এদের বেশিরভাগের নাম জানে না মাইশা। কি আশ্চর্য না! তবে আসলেই নীল অপরাজিতা ফুলটা আসলেই নেই। 

আবার রুমে এসে দাঁড়ালো মাইশা। বিছানার পাশেই বেড সাইড টেবিল, রুমের একপাশে একটা কাউচ, ছোটখাটো একটা বুকশেল্ফ, একটা মোটামুটি বেশ বড় সাইজের আলমারি। আর কিছু নেই। রুমটা অনেকটা বড়। তাই বেশ ফাঁকাফাঁকা লাগছে। বেশ ভালো লাগছে মাইশার। দেখতে দেখতে কখন বিছানার একদম কাছে চলে এসেছিল খেয়ালই নেই মাইশার। হুঁশ ফিরল হাতে টান পড়ায় যখন গিয়ে হুড়মুড় করে শুয়ে থাকা ধ্রুবর গায়ের উপর গিয়ে পড়ল তখন। ভয় পেয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল মাইশা। একটু পরে সাহস করে চোখ খুলল।

ধ্রুবর একদম গায়ের উপরে পড়ে আছে মাইশা। আর দু হাতে মাইশাকে জড়িয়ে ধরে একেবারে কাছে টেনে নিয়েছে ধ্রুব। মাইশা কি করবে কি বলবে বুঝতে না পেরে কোনমতে উঠার চেষ্টা করছে।

-আজকে তো সারাদিন দেখতে পাবো না মেঘপরীটাকে--। একটু কল্পনায় দেখেই মন ভরাই--। এতো ছটফট করো না প্লিজ---।

মাইশা চোখ বড় বড় করে ভাবছে এই লোকটা কি পাগল হয়ে গেল! কল্পনা করছে মানে কি! ও তো বাস্তবেই সামনে আছে! ঘুম ভেঙে কি মাথা খারাপ টারাপ হয়ে গেল নাকি?

-তোমাকে কিন্তু আজকের এই কলাপাতা রঙের শাড়িতে দারুণ লাগছে মাইশা-। সব সময় তো সাদাপরী হয়ে আসো--। আজ কি মনে করে এই নেশা ধরানো রূপের ডালা মেলে ধরলে সামনে--হুম?

------------------------------

এভাবে মানুষটার গায়ের উপর পড়ে থাকতে অস্বস্তি লাগছে মাইশার। কি করবে? সরতেও পারছে না বেচারি। এতো শক্ত করে জাপটে ধরে আছে যে ধ্রুব নিজে না ছাড়লে মাইশার উঠতে পারারও কোন সম্ভবনা নেই। চিন্তাটা মাথায় আসতেই ঢোক গিলল মাইশা। কি করবে এখন! এদিকে ধ্রুবও এক হাতে মাইশার কোমড় জড়িয়ে ধরে অন্য হাতে মাইশার মুখটা তুলে ধরে একদম নিজের মুখের কাছাকাছি নিয়ে এল। দুজনের নিঃশ্বাসগুলো একে অন্যের সাথে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসছে। ধ্রুব মাইশাকে আরেকটু কাছে টেনে ঠোঁটের দিকে ঠোঁট নিয়ে আসলো। ধ্রুব মাইশার ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়ার ঠিক আগ মূহুর্তে মাইশার চোখ থেকে এক ফোঁটা পানি ধ্রুবর গালে এসে পড়ল। ধ্রুবও অবাক চোখ মাইশার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। 

১৬!! 

গালে পানি পড়তেই ধ্রুব চমকে মাইশার মুখের দিকে তাকাল। তারপর বালিশে মাথাটা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে দুমিনিট দম নিল। মাইশাকে জড়িয়ে ধরে আছে এখনো। মেয়েটা সত্যি এসেছে নাকি মনের কল্পনা সেটা নিয়েই নিজের মনের সাথে তুমুল যুদ্ধ চলছে ধ্রুবর। মন বলছে গত তিন বছর ধরে মাইশা তো প্রতিদিনই তার কল্পনায় আসছে। এ আর নতুন কি! আজও এসেছে। আর ব্রেইন বলছে মাইশা আজকে সত্যি সত্যিই এসেছে। কিভাবে সেটা সম্ভব সেটা ধ্রুবর মাথায় আসছে না। তবে কল্পনা হলে হাতটা সরালেই জাদুর মতো ভ্যানিশ হয়ে যাবে। আর যদি সত্যি আসে! ব্যাপারটা মাথায় আসতেই ঢোক গিলল ধ্রুব। কি ভাববে মাইশা ওকে! ভাববে নাকি অলরেডি ফালতু একটা মানুষ ভাবছে! ইশ! মেয়েটার কাজল কালো চোখজোড়া দেখলে কেন যে এতো ঘোর লেগে যায় ওর!

ধ্রুব একটু সাহস করে মাইশার মুখের দিকে তাকাল। আলতো করে বাঁধনটা আলগা করে মাইশার মুখটা দুহাতে তুলে ধরল।

-মাইশা--? আ'ম সরি--। আসলে আমি বুঝতে পারি নি---। কি হতে কি হয়ে যাচ্ছিল-----। সরি---।

------------------------------

-আসলে----। হয়েছে কি---। 

মাইশা ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছে৷ এই মানুষটা পাগলের মতো ভালোবাসে ওকে-মাইশা সেটা জানে। তার চোখে ঘোর লাগানো উদভ্রান্ত দৃষ্টিটাও দেখেছে মাইশা। কিন্তু মানুষটা কাছে আসতেই রাতুলের কথাটা মাথায় ঘুরছিল মাইশার। তাই এক ফোঁটা জল আপনাআপনিই চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়েছে। অভিমানের কান্না নয়- দোষারোপের কান্না নয়। অথচ তবুও এক ফোঁটা অশ্রু ঠিকই গড়িয়ে পড়েছে। কেন!

-আমি এসেছি বেশ অনেকক্ষণ হয়েছে----।

-কার সাথে এলে! আর হঠাৎ?

-আজকে একটা স্পেশাল দিন---।

-স্পেশাল! কি?

ধ্রুব একটু সরে আসতেই মাইশাও উঠে বসল খাটের উপর। ধ্রুবর মাথা এখন ঘুরছে। অহেতুকই মেয়েটাকে কাঁদিয়ে ফেলেছে ভাবতেই খারাপ লাগছে ওর। তবে মাইশা এখানে এল কেন আর কি করে সেটাই বুঝতে পারছে না।

-আজকে মেহেরের বার্থডে--।

-ওহ শিট!

-হুম? কি হল?

-আমার একদমই মনে ছিল না৷ আজকে আমার কপালে দুঃখ আছে নিশ্চিত----। কিন্তু তুমি এলে কি করে?

-মেহের গাড়ি পাঠিয়েছিল---।

-ও আচ্ছা--। আমি তো জানতাম না--। অফ ডে তাই ঘুমাচ্ছিলাম--।

-এখন তো উঠুন---?

-হুম---। তুমি দু মিনিট বসো এখানে আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি এক্ষুণি---।

-হুম----।

ধ্রুব আলমারি থেকে জামা কাপড় নিয়েই ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ল। মাইশাও গিয়ে বারান্দায় দাঁড়াল। বারান্দাটা ভিষণ পছন্দ হয়েছে ওর। একটা সোফা বা রকিং চেয়ার থাকলে ভালো হত। দুজনে একসাথে এক চেয়ারে বসে বিকেলে কফি খাওয়া যেত৷ ব্যাপারটা চিন্তা করতেই মাইশা লজ্জা পেল। মাঝে মাঝে যে কিসব উল্টাপাল্টা খেয়াল আসে মাথায়! 

ধ্রুব একেবারে ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়েই বের হয়েছে ওয়াশরুম থেকে। এসে দেখল মাইশা রুমে নেই৷ মেয়েটা কি রাগ করে চলে গেল! গেলেও অবশ্য অবাক হবে না ধ্রুব। যা করতে যাচ্ছিল! ভাবতে ভাবতেই ধ্রুবর চোখ পড়ল বারান্দার দিকে৷ বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে মাইশা। কলাপাতা রঙা শাড়ির আঁচলটা বাতাসে হালকা হালকা উড়ছে। মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছে নাকি বুঝতে পারছে না ধ্রুব। তবে বেশ লাগছে দেখতে। 

ধ্রুব গিয়ে মাইশার পাশে এসে দাঁড়ালো। বাতাসের দাপটে মাইশার চুলগুলো উড়ে এসে ধ্রুবর মুখে এসে পড়ছে। দুজনেই টের পাচ্ছে সেটা। ব্যাপারটা দুজনেই উপভোগ করছে চোখ বুজে। কিন্তু একটা কথাও বলছে না। দুজনের মনেই একটা প্রশ্ন খেলা করছে। সামনের মানুষটা কি ভাবলো?

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন