২৫!!
তামান্না দীপ্তিকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় কিশোর এক ফাঁকে রুম থেকে বেরিয়ে গেছে। তামান্না সেটা খেয়াল করলেও কিছু বললো না। দীপ্তির স্কুল ড্রেসটা চেইঞ্জ করিয়ে দিয়ে হাত মুখ ধুইয়ে দিল ভালো করে। দীপ্তির স্কুল ড্রেসটা বেশ বালিতে মাখামাখি করে নোংরা হয়ে গেছে। তামান্না তাই দীপ্তিকে রুমে একটু অপেক্ষা করতে বলে ইউনিফর্মটা ধুয়ে দেয়ার জন্য ডিটারজেন্ট দিয়ে ভিজিয়ে এলো। দীপ্তিকে হালকা নাস্তা খাইয়ে দিয়ে এসে ধুয়ে দিবে। এসব চিন্তা করে রুমে এসে কিশোরকে বসা দেখে পুরো হা হয়ে গেল তামান্না। কিশোরের হাতে ধরা একটা প্লেটে বেশ অনেক খাবার। দীপ্তি তামান্নাকে দেখেই ছুটে এসে তামান্নার পিছনে গিয়ে লুকালো।
-ও মামনি? বাবাই কি করছে দেখো না? আমি একা এতো খাবার খেতে পারবো? আমি--। আমি খাবো না--। তুমি বলো না বাবাইকে---।
-আচ্ছা--। যতটুকু পারে ততটুকু খাবে আমার লক্ষী বাচ্চাটা। কেমন?
-ইয়েএএ। মামনি বলে দিয়েছে বাবাই। আমি যতটুকু পারবো ততটুকু খাবো। এই যে এট্টুক--।
দীপ্তি হাতের ইশারায় কতটুকু খাবে দেখাতেই হেসে ফেললো কিশোর আর তামান্না দুজনেই। কিশোর তামান্নার দিকে তাকালো।
-দীপু? এতো খাবার তো তুমি একলা খাবে না মা--। আরেক জনও খাবে তো--। তাই তোমার চিন্তা করতে হবে না--।
-কে খাবে বাবাই?
-তোমার মামনি---।
-ওকে। তাহলে ঠিক আছে---।
কিশোরের কথা শুনে তামান্না হতভম্ব হয়ে কয়েক সেকেন্ডের জন্য বুঝতেই পারলো না কি বলবে। পরে হুঁশ ফিরতেই তাড়াতাড়ি মাথা নাড়ালো।
-আমি খেয়ে নিব ---। আপনি দীপু----।
-আপনারা দুজনেই আমার সামনে এসে বসুন। তাড়াতাড়ি--। খেয়েই বের হবো আমরা---।
-আমি----।
-দীপু? আমরা আজ একটা জায়গায় বেড়াতে যাবো। কেমন? এখন তোমার মামনি কথা শুনছে না। কি করা যায় বলো তো?
-স্কুলে মিস বলেছে কথা না শুনলে পানিশমেন্ট পেতে হয়---।
-ম্যাডাম? আপনি কি চাইছেন আমি মেয়ের সামনে আপনাকে পানিশমেন্ট দেই?
-কিসের পানিশমেন্ট?
-সেটা তো বললে হবে না ম্যাডাম। আগেভাগে বলে দিলে পানিশমেন্টের মজা আর কি থাকবে বলুন?
-আপনি একটা---!!
-কোন ব্যাপার না। তা আপনি নিজে থেকে আসছেন নাকি আমি উঠবো এবার?
-না না না--। এসো দীপু?
-হি হি হি। মামনি ভয় পাইসে বাবাইকে। হি হি--।
-দীপু?
দীপ্তি খিলখিল করে হাসছে দেখে কিশোরও হেসে ফেললো। আর তামান্না মুখ কালো করে দীপ্তিকে নিয়ে খাটের উপরে বসলো। কিশোর এক লোকমা করে খাবার একবার দীপ্তির মুখে তুলে দিচ্ছে, আরেকবার তামান্নার মুখে। তামান্নার চোখের কোণে পানি চিকচিক করলেও মাথা নিচু করে সেটা সামলে নিলো তামান্না। এভাবে এতো স্নেহের সাথে কখনো ওকে কেউ মুখে তুলে খাবার খাইয়ে দেয় নি। অনুভূতিটা একদম নতুন তামান্নার কাছে। কেমন আবেগে গলা বুজে আসতে চাইছে তামান্নার। কিশোর খেয়াল করলো ব্যাপারটা। কিন্তু কিছু বললো না। চুপচাপ খাইয়ে দিতে লাগলো তামান্না আর দীপ্তি দুজনকেই।
একটু পরেই দীপ্তি খাওয়া শেষ বলে লাফাতে লাফাতে রুম থেকে ছুটে পালালো। তামান্না দীপ্তির পিছনে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াতেই কিশোর প্লেটটা হাত থেকে বিছানায় রেখে বাম হাতে তামান্নার হাত টেনে ধরলো।
-তমা? ওর খাওয়া হয়ে গেছে। যেতে দাও--।
-কিন্তু কোথায়----??
-মায়ের রুমেই গেছে। আর কোথায় যাবে? তুমি খাও---। হা করো?
-আমি আর----।
-চুপচাপ খান ম্যাডাম--। এখন কিন্তু দীপুও রুমে নেই--। সো কিছু বলার আগে একটু সামলে বলুন--।
-আমি খাবো না আর--৷ হুহ--।
-শিউর তো?
-১০০ বার---। আপনি? আপনি এমন সামনে আসছেন কেন?
-সোজা করে বললাম। আপনি তো মানলেন না। তাই আমি আমার মতো করে খাওয়াবো এখন---।
-এই--। না না না--।
-আপনি নিজে থেকে খেয়ে নিলে তো আর আমাকে এই কষ্টটা করতে হতো না বলুন?
-আমি-। আমি খাচ্ছি--। আপনি- আপনি সরুন---।
-ইশ! এটা কিন্তু ঠিক না তমা। আমি ভাবলাম একটু----।
-আপনি ভিষণ খারাপ---।
-তাই? খারাপের কিছুই তো করি নি ম্যাডাম। তবে এবার করবো--।
-কি! কি করবেন?
-আরে! এতো ঘাবড়াচ্ছ কেন? কি করবো সেসব পরে দেখা যাবে--। এখন খাও--।
-হুম---।
তামান্না ভয়ে আর কথা বাড়ানোর সাহস পেল না। কিশোর খাইয়ে দিচ্ছে আর ও চুপচাপ খেয়ে নিচ্ছে। কিশোর তামান্নার মুখটা দেখে মিটিমিটি হাসছে। তামান্না না কিছু বলতে পারছে না চুপ করে থাকতে পারছে। কিছু বললে মানুষটা কি করে বসবে সেটা বলাই মুশকিল এখন। বদলে গেছে লোকটা ভিষণ। তবে এই বদলটার কারণ না জানলেও তামান্নার ভিষণ ভালো লাগছে। কিন্তু একটা ভয় তামান্নার মনের কোণে বারবার খোঁচা দিয়ে যাচ্ছে। সবকিছু পেয়ে আবার হারিয়ে ফেলবো না তো?
২৬!!
কিশোর তামান্নাকে খাইয়ে দেয়া শেষ হলে পানি খাইয়ে দিয়ে হাত ধুতে ওয়াশরুমে ঢুকলো। ওয়াশরুমে একটা বালতিতে দীপ্তির স্কুল ড্রেস ডিটারজেন্ট দিয়ে ভেজানো দেখে ভ্রু কুঁচকে গেল কিশোরের। হাত ধুয়ে রুমে এসে তামান্নার মুখটাও ধুয়ে মুছিয়ে দিলো। তারপর তামান্নাকে নিজের হাতের প্লেটটা ধরিয়ে দিলো।
-যাও। এটা রেখে দীপ্তিকে নিয়ে গিয়ে নিচে ওয়েট করো--। আমি আসছি--।
-আমার একটু কাজ আছে--।
-কি কাজ?
-দীপুর স্কুল ড্রেসটা ধুয়ে---।
-নিজেকে কি এখনো দীপ্তির গভর্নেসের জায়গাটা থেকে বের করতে পারছো না তুমি?
-আপনি? আপনি রেগে যাচ্ছেন কেন?
-সাধে রাগ করছি না। আপনার কাজে রাগ হচ্ছে আমার----।
-আম---। দীপুর স্কুল ড্রেসটা বেশি নোংরা হয়ে গেছিলো তাই---।
-বাড়িতে কি একটাও কাজের লোক নেই কাজটা করার জন্য?
-আমি তো----।
-চুপচাপ দীপুকে নিয়ে নিচে যাও তমা---। অযথা আমাকে রাগিও না বলে দিচ্ছি---।
-আমি কি করলাম?
-আপনাকে আমি এতো কাহিনী করে রেডি করিয়ে দিয়েছি এখন কাপড় ধুয়ে শাড়িটা ভিজিয়ে চৌদ্দটা বাজানোর জন্য নয়--। আপাতত আসার সময় এই একটাই শাড়ি এনেছি আমি---।
-ভিজবে না সত্যি---।
-হ্যাঁ তো। ভিজবে না। আর ভিজলে? তখন আপনি আবার সেই---। সেই শাড়িটাই পড়বেন। সেটা হচ্ছে না--। আমি ছিলাম না৷ এতোদিন পড়েছ পড়েছ। এখন আর সেটা হবে না৷ বুঝেছেন ম্যাডাম?
-কেন!?
-আমি মানা করেছি তাই---। খুশি? এবার যাও??
-হুম----।
-ও আচ্ছা--। একটু সাজগোজ করে নিতে পারো--। যদিও বেশি কিছু আনি নি--। আমি তো জানি না তুমি কোন ব্রান্ডের কি ইউজ করো-।
-না না। আমার এসব লাগবে না--।
-আচ্ছা--।
তামান্না কিশোরের সামনে থেকে সরে পড়তে পারলেই বাঁচে এমন অবস্থা। তাই কিশোর ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়াতেই তামান্না রুম থেকে বেরিয়ে পড়লো। দীপ্তিকে খুঁজতে ফালেহা চৌধুরীর রুমে এসে দেখলো দাদী নাতনিতে কথা বলছেন আর হাসাহাসি করছেন। তামান্নাও শাশুড়িকে বিদায় জানিয়ে দীপ্তিকে নিয়ে নিচে নেমে এলো। কিশোরের আসতে কতক্ষণ লাগবে সেটা বুঝতে না পেরে তামান্না দীপ্তিকে নিয়ে বাগানে হালকা পায়চারি করছে আর আশেপাশের গাছগুলো দেখছে। হঠাৎ কিছু একটা ঝাড়ার শব্দে তামান্না উপরের দিকে তাকালো। বাগানের এই দিকটার ঠিক উপরে কিশোরের রুমের বারান্দাটা। আর কিশোর সেখানে দাঁড়িয়ে ভেজা কাপড় ঝেড়ে বারান্দায় মেলে দিচ্ছে। ব্যাপারটা দেখামাত্রই তামান্নার বুকের ভিতরে ধ্বক করে উঠলো। কয়েক মিনিটেই কিশোর দীপ্তির ভেজা স্কুল ড্রেসটা বারান্দায় মেলে দিয়ে সরে গেছে। তামান্নাদেরকে সে খেয়াল করে নি। কিন্তু কিশোরের কাজটায় তামান্নার মধ্যে ছোটখাটো একটা ঝড় বইয়ে দিয়ে গেছে। উনি দীপ্তির স্কুল ড্রেসটা ধুয়ে দিয়েছে! কেন?
কিশোর একটু পরে একেবারে রেডি হয়ে নিচে নেমে এলো। পড়নে তামান্নার সাথে ম্যাচিং করেই রয়েল ব্লু রঙা একটা শার্ট, কনুই থেকে স্লিভ ফোল্ড করা। আর নেভি ব্লু রঙের জিনস। কিশোরকে দেখে তামান্না একটু অবাক হয়েই তাকিয়ে রইলো। কিশোর ঠোঁটের কোণে একটা হাসি ফুটিয়ে তামান্নার জন্য গাড়ির দরজাটা খুলে ধরলো। তামান্না তখনো কিশোরের দিকে অবাক চোখে তাকিয়েছিল। এবারে একটু লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠে বসলো। আর দীপ্তিও সুযোগ পেয়ে সোজা তামান্নার কোলে উঠে বসলো। কিশোরও হেসে ড্রাইভারের সিটে এসে বসে গাড়ি স্টার্ট দিলো।
-আমরা কোথায় যাচ্ছি?
-যেখানেই যাই গিয়ে তো দেখতেই পাবে--।
-বললে কি হয়?
-বিশেষ কিছুই হয় না--।
-তাহলে বলছেন না কেন?
-আমার ইচ্ছে তাই ম্যাডাম---।
-হুহ---।
-কিন্তু আপনার একটা কাজ করতে হবে ম্যাডাম--।
-কি কাজ!!
-আমমম---। সেটা আরেকটু পরে বলবো---।
তামান্না একবার মুখ বেঁকিয়ে বাইরের দিকে তাকালো। কতোদিন পরে এভাবে বের হয়েছে। সাথে কিশোর আর দীপ্তি দুজনেই আছে৷ নিজেকে কেন যেন পূর্ণ মনে হচ্ছে তামান্নার। এই মানুষটা পাশে থাকলেই মনের মধ্যে কোথাও একটা ভালো লাগা কাজ করে। আর এই মানুষটার পাগলামি, কেয়ারিংগুলোও বেশ লাগে তামান্নার। ইচ্ছে করে মানুষটাকে কোথাও যেতে না দিয়ে সারাক্ষণ সামনে বসিয়ে রেখে দেখতে। কাউকে চেয়ে চেয়ে দেখার মধ্যেও যে এতো সুখ আছে সেটা তামান্না কখনো কল্পনাতেও ভাবতে পারে নি। এসব ভাবতে ভাবতেই তামান্না একটু পর পর আড়চোখে তাকাচ্ছে। আর সাথে সাথে কিশোরের সাথে চোখাচোখিও হয়ে যাচ্ছে। লোকটা গাড়ি চালাতে চালাতেও যে ওকেই দেখছে, বুঝতে পেরে তামান্নার মুখে রক্তিম আভা ফুটে উঠলো।
কিশোরও তামান্নার লাজুক লাল টুকটুকে মুখটা দেখে গাড়ি চালানোয় মন দিলো। বেশ অনেকক্ষণ ধরে কোন কথা হলো ওদের দুজনের। দীপ্তি তামান্নাকে রাস্তার পাশে থাকা বাড়ি, আকাশ, মেঘ, দোকান-পাট সব দেখিয়ে দেখিয়ে বক বক করেই চলেছে। তামান্নাও একটু হেসে মেয়ের কথায় কখনো সায় দিচ্ছে, বা কিছু বলছে। এমন একটা সময় কিশোর হুট করে গাড়িটা ব্রেক করলো। তামান্না একটু ঘাবড়ে গিয়ে কিশোরের দিকে তাকালো। আশেপাশে কিছু নেই। কিশোর এমন মাঝ রাস্তায় কেন গাড়ি থামিয়েছে সেটাই বুঝতে পারলো না তামান্না।
-তমা? শোনো না?
-হুম?
-একটু কাছে এসো। কথা আছে--।
-কি!!
-আরে শোনো না?
-হুম----।
তামান্না একটু ইতস্তত করে একটু সামনের দিকে এগিয়ে আসলো। কিশোরও এগিয়ে আসছে দেখে তামান্না চোখ বুজে ফেললো। আর সাথে সাথেই টের পেল ওর চোখ জোড়া কাপড় জাতীয় কিছু একটায় বাঁধা পড়েছে। তামান্না চমকে গিয়ে চোখের বাঁধন খোলার জন্য হাত তুলতেই কিশোর তামান্নার হাত ধরে ফেললো।
-খুলো না প্লিজ? দশটা মিনিট এভাবে থাকো প্লিজ তমা?
-কে-কেন?
-প্লিজ? প্লিজ প্লিজ? তমা প্লিজ?
-আচ্ছা---। ঠিক আছে। খুলবো না-।
-থ্যাংক ইউ--।
কিশোর খুশির চোটে তামান্নার গালে পাশ থেকে একটা চুমো দিয়ে ফেললো। তামান্না থতমত খেয়ে মুখ নামিয়ে নিলো লজ্জা পেয়ে। কিশোর নিজেও একটু বিব্রত হয়ে গাড়ি চালানোয় মন দিলো। দীপ্তি ব্যাপারটা দেখে নিজে থেকে কিশোরের দিকে গিয়ে ' বাবাই আমাকেও আদর দিতে হবে' বলে বায়না শুরু করে দিলো। আর তাতেই তামান্না লজ্জায় প্রায় কুঁকড়ে যাওয়ার অবস্থা। কিশোর সেটা খেয়াল করেই দীপ্তির কপালে চুমো খেয়ে দীপ্তিকে ইশারা করে তামান্নাকে দেখিয়ে দিলো। দীপ্তি এবার 'মামনি' বলে তামান্নার গলা জড়িয়ে ধরে গালে চুমো খেয়ে কোলে বসে রইলো। আর তামান্না লজ্জায় লাল নীল হয়ে কোন রকমে প্রায় দম বন্ধ করে বসে রইলো। আর ভাবতে চেষ্টা করলো ওরা যাচ্ছে টা কোথায়।