১১!!
বড়দের কথা আর হাসাহাসির শব্দে আয়ান আর মায়রার হুঁশ হলো। দুজনেই বাড়িটার ভিতরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। আর গাড়ির পাশে তিথি দাঁড়িয়ে আছে। আয়ান মায়রা কথা বলছিলো বলে আরও সামনে এগিয়ে যায় নি। মনের খুশিতে দাঁত দিয়ে নখ কাটছে আর চারপাশে টুকটুক করে তাকাচ্ছে। তিয়াশ গাড়ি থেকে নেমে ভ্রু কুঁচকে তিথির কান্ড দেখতে লাগলো। সামনের দিকে এগোতে গিয়েই হাতে বাধা পেয়ে তিথির দিকে ফিরলো। আলতো করে তিথির হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিলো।
-জি? বলুন?
-আপনি আপনি করেন কেন সারাদিন?
-যা বলার বলে ফেলুন তাড়াতাড়ি--।
-কেন? আমার সাথে কথা বললে কি আপনাকে বাঘে খেয়ে ফেলবে--?
-------------------------------
-এতো রস কস হীন একটা মানুষ! উফফ---। দেখছেন না ভাইয়া আর ভাবি কথা বলছে? আপনি এখন ওদের ডিস্টার্ব করতে কেন যাচ্ছেন?
-আমি তো ডিস্টার্ব করবো না। আমি বাড়ির ভিতরে যাচ্ছিলাম---।
-হুহ---। কমনসেন্স নেই আপনার? ওদের সামনে দিয়ে এখন গেলে ওরা তো কথাই বলতে পারবে না--।
-জি মহাপণ্ডিত ম্যাডাম--। ওরা তো চলে গেছে বাড়ির ভিতরে--। এখনো দাঁড়িয়ে থাকতে হবে?
-কি বললেন আপনি?
-যা শুনলেন আপনি। না শুনলে কানের ডাক্তার দেখাবেন শহরে গিয়ে--। ওকে? আসি? বায়।
তিয়াশের যাওয়ার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে রইলো তিথি। রাগ করে ভাইয়ার গাড়ির চাকায় একটা লাথি মারলো। পরে ভাইয়ার গাড়ির খেয়াল হতেই তড়িঘড়ি করে আশেপাশে তাকালো। এই লোকটা এতো পচা কেন? এতো ভাব নেয়ার কি আছে! তিথি কলেজে গেলে ওর সাথে কথা বলার জন্য লাইন ধরে ছেলেরা এমন একটা অবস্থা হয়। আর এই ফাজিল ছেলেটা ওকে পাত্তাই দেয় না। তার উপরে কথায় কথায় এটা ওটা নিয়ে বাঁশ দেয় সবসময়। খারাপ লোকটাকে একটা উচিত শিক্ষা দিয়েই ছাড়বে ও। হুহ।
আয়ান, মায়রা, তিয়াশ, তিথি সবাই মিলে বাড়ির ভিতরে গিয়ে একেবারে হা হয়ে গেল। বাড়ির ভিতরে ঘর গুলো চক্রাকারে সাজানো। প্রায় ১০-১২ টা রুম বাড়িটাতে। থরে থরে সাজানো বাড়িটা যেন। এক পাশে বিশাল একটা উঠোনের মতো খোলা জায়গা। সেখানেই রান্নার সমস্ত জোগাড় করা হয়েছে। কিন্তু সমস্যা হলো গ্যাসের ব্যবস্থা নেই। কাঠ খড় জ্বেলে রাঁধতে হবে। তবে এখনও কাঠের ব্যবস্থা হয় নি। তিথিও সুযোগ পেয়ে লাফিয়ে উঠে বললো ওরা চারজনে কাঠ কুড়িয়ে আনতে যাবে৷ সেটাই ঠিক হলো শেষমেশ। বাইরে এসে তিয়াশ আয়ানের সাথে যেতে চাইলেই চোখ পাকিয়ে তাকালো তিথি।
-তোমরা দুজন বাম দিকে যাও ভাইয়ু। আমি আর বেয়াই ডান দিকে যাই বাগানের।
কথাটা শেষ করে আয়ানের দিকে মিষ্টি করে একটা হাসি দিয়ে তিথি তিয়াশের হাত ধরে টানতে টানতে বাগানের ডান দিকে হাঁটা ধরলো। কি হচ্ছে বুঝতে কয়েক মিনিট লাগলো তিয়াশের। এই মেয়েটার মুখটা দেখলেই অজানা একটা ফিলিংস হচ্ছে তিয়াশের। বেচারা সেটাই মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করে যাচ্ছে সমানে। কিন্তু এই মেয়েটা বারবার হুটহাট উল্টাপাল্টা কাজ করে কাজটা আরো কঠিন করে তুলছে। এসব ভেবেই বিরক্ত হয়ে গেল তিয়াশ। হাতটা ঝাঁকি দিয়ে ছাড়িয়ে নিলো তিথির হাত থেকে। তিথিও ভ্রু কুঁচকে তাকালো।
-কি সমস্যা?
-তোমার কি সমস্যা? বারবার সবার সামনে এভাবে হাত ধরে টানাটানি লাগাও কেন? লজ্জা লাগে না? আয়ান ভাইয়া কি ভাবলো?
-ওই ওই? আজাইরা কথা কম বলেন। কে কি ভাববে? আর গাধার মতো আবার ওদের দুজনের মাঝখানে আসছিলেন কেন হ্যাঁ? এতো এতো পানসা হয় কেমনে মানুষ! আমি চাইছি কিভাবে ওরা দুজনে একটু কথা বলবে, নিজেদেরকে সময় দিবে, আর ইনি মহাশয় সব ভন্ডুল করে দেয়ার পণ করেছে---। হুহ।
-তো? সেরকম হলে আমি আন্টি, আঙ্কেলদের কাজে হেল্প করতাম। আমাকে এখানে ধরে আনার মানে কি?
-আমি একা একা বোর হয়ে যেতাম তাই এনেছি--। হুহ। সেটাই ভুল হয়েছে-----।
-আপনি বোর হবেন সেটার দায় কি আমার?
-আপনি একটা চূড়ান্ত পর্যায়ের অসভ্য লোক---। কথাই বলবো না আপনার সাথে।
-জি ধন্যবাদ। দয়া করে এই কৃপাটি বজায় রাখবেন----।
তিথি গজগজ করতে করতে ছোট ছোট ডাল কুড়াতে লাগলো। তিয়াশও আশপাশ থেকে কাঠ কুড়িয়ে নিলে দুজনে মিলে রওনা দিলো। আয়ান মায়রাও নিজেরা কথা বলতে বলতে অনেকগুলো ছোট্ট ছোট্ট শুকনো ডাল পালা জমা করে আসছিলো। চারজনে মিলে বেশ অনেকটাই কাঠ জমা করেছে। আজকের দিনটা এতেই চলে যাবে। ফিরে এসে সবাই মজা করে রান্না করলো। খাওয়া দাওয়া করলো। বেশ সন্ধ্যা পর্যন্ত ওরা চারজন আর আয়ান মায়রার বাবা মা আটজনে মিলে আড্ডা দিলো। বাড়িটা একেবারে গ্রাম এলাকায়। তার উপরে এখানে ইলেকট্রিসিটিরও কোন ব্যবস্থা নেই। তাই সন্ধ্যা হওয়ার একটু পরেই সবাই মিলে রাতের খাবার খেয়ে নিলো। তারপর যে যার ঘরে চলে গেল। তিথি আর মায়রা একটা রুমে। তিয়াশ আর আয়ান একটা রুমে। আর আয়ানের বাবা মা এক রুমে, মায়রার বাবা মা এক রুমে বাকি রুমগুলোর ধূলোবালি ঝাড়া হয় নি। তাই এই ব্যবস্থা।
রাতে শুয়ে শুয়ে এপাশ ওপাশ করেও কারোই ঘুম আসছে না। না তিথির না মায়রার। এদিকে তিয়াশ আর আয়ানেরও একই অবস্থা। এতো তাড়াতাড়ি ঘুমের অভ্যেস নেই। গড়িতে আটটাও বাজে নি। এতো তাড়াতাড়ি ঘুমানো যায়! তিথি বিরক্ত হয়ে মায়রার হাত ধরে নাড়া দিলো।
-এই ভাবি? উঠো না? ঘুম আসছে না তো---।
-আমারও আসছে না।
-চলো বাইরে যাই---?
-বাবা মা বকা দিলে?
-আরে ধুর--। উনারা সবাই এতোক্ষণে ঘুমিয়ে কাদাকাদা হয়ে গেছে---। চলো চলো?
-হুম? আচ্ছা চলো----।
-আরে ভয় নেই-। ভাইয়াকেও ডেকে নিবো--। নো চিন্তা। হি হি।
তিথির কথা শুনে মায়রাও লাজুক হাসলো। মানুষটাকে ভিষণ মিস করছিলো মায়রা। কিন্তু সেটা তো আর বলা যায় না। তিথি আর মায়রা বাইরে এসে দেখলো আয়ান আর তিয়াশও বের হচ্ছে রুম থেকে। একজন অন্যজনকে দেখে নিজেরাই হেসে ফেললো ওরা৷ তারপর পা টিপেটিপে বাইরে উঠোনে বেরিয়ে এলো। আকাশে সুন্দর ইয়া বড় একটা চাঁদ উঠেছে। সম্ভবত পূর্ণিমার এক দুদিন বাকি। চাঁদের আলোয় পরিবেশটা একেবারে স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে। আয়ান আর মায়রা একটু পর পর একে অন্যকে দেখছে। কিন্তু তিথি আর তিয়াশ থাকায় কথা বলতে পারছে না৷ ব্যাপারটা তিথি বুঝতে পেরে একটু হাসলো।
-এই ভাইয়া? গাড়ির চাবিটা দে না? আমি একটু আশপাশটা দেখে আসি?
-এখন?
-দে না দে না দে না? প্লিজ? এই ভাবি বলো না গো দিতে?
-আচ্ছা বাবা দিচ্ছি---। তিয়াশ ভাইয়া আপনিও সাথে যাচ্ছেন তো?
-উনি কেন যাবে?
-তোকে যেন আমি একা ছাড়ছি?
তিয়াশ আর কি করবে! তিথির সাথেই গাড়ি নিয়ে বের হলো। তিয়াশ ড্রাইভিং করছে আর পাশে তিথি গাল ফুলিয়ে বসে আছে। সেই কখন থেকে রাগ করেছে লোকটার উপর৷ আর সে কিনা একটা বারও সরি বলতে আসে নি। সরি তো দূরে থাক একটা কথাও বলে নি। হুহ। এতো ভাব নেয়ার কি আছে! হতেই পারে লোকটা দেখতে খারাপ না। খারাপ না বললে ভুল হবে। দেখতে স্মার্ট লোকটা। কালো টিশার্টটা আরো বেশি মানিয়েছে ফর্সা চেহারার সাথে। বয়সে সম্ভবত আয়ানের কাছাকাছি হবে। হুহ৷ বুইড়া ব্যাটা এতো ভাব নাও কেন তাও আবার আমি তিথির সাথে! তিথির একদৃষ্টিতে তিয়াশের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলো কথাগুলো।
-এই যে ম্যাম? এভাবে কি দেখেন আমার দিকে?
-আপনি কি এমন লোক যে আপনাকে দেখতে হবে?
-কেউই না বুঝলাম--। তো তাকিয়ে ছিলেন কেন এমন ভ্যাবলার মতো?
-কি বললেন? আমি ভ্যাবলা! আপনি একটা মস্ত খারাপ লোক---। থামান গাড়ি। থামান। আমি হেঁটেই চলে যাবো। তাও আপনার সাথে এক মিনিট ও বসবো না আর। ধুর---।
-আরে! তিথি?
তিথি প্রায় চলন্ত গাড়ির দরজা খুলে ফেলেছে দেখে তিয়াশ তিথির একটা হাত ধরে ফেলে গাড়ি ব্রেক করলো। তিথি হাত ছাড়িয়ে নিয়ে নেমে হাঁটা ধরলো বাড়ির পথে। আর মরে গেলেও এই লোকের সাথে একটা কথাও বলবে না। ভুলেও না। কিছুতেই না। বদ লোক একটা। খালি খালি অপমান করে ওকে। হুহ। আর কথা বলবে না মানে বলবেই না।
১২!!
রাগের চোটেই কেঁদে ফেলেছে তিথি। আয়ান সারাদিন এতো জ্বালালেও এই অনুভূতিটা কখনো হয় নি তিথির। যতটা না এই অসভ্য লোকটার রাগ ভাঙাতে না আসায় হচ্ছে তিথির। তার উপরে ও বারবার যেচে এই ছেলেটার সাথে কথা বলতে গেলেও ছেলেটা বারবার ওকে হয় ইগনোর করে, নয় তো অপমান। কেন রে? আমি তোর কোন পাকা ধানে মই দিয়েছি? একটু মিষ্টি হেসে কথা বললে কি হয়? জাত যায়? অসভ্য, বেয়াদপ, ফাজিল লোক। লোক না। বুইড়া বেটা৷ মনে মনে তিয়াশকে আরো গুনে গুনে ১০০ টা গালি দিলো তিথি। তবুও রাগটা কমলো না একটুও। আবার এটাও বুঝতে পারলো না লোকটা ওর সাথে কথা বলছে না দেখে ওর রাগটা হচ্ছে কেন। নাই বলতে পারে কথা। তাতেই বা কি! লোকটার চুপ করে থাকাটাই বা ওকে এতো পোড়াচ্ছে কেন?
ভাবতে ভাবতে তিথি খেয়াল করে নি সামনে থেকে হাসাহাসি করতে করতে কয়েকটা বখাটে টাইপের ছেলে আসছিল। তিথিকে এতো রাতে একা আসতে দেখেই ছেলেগুলো আশেপাশে তাকিয়ে শিস মারতে মারতে নিজেরা আজেবাজে কথা আলোচনা করতে লাগলো। তিথি হঠাৎ এসব খেয়াল হতেই চমকে গেল। উল্টোদিকে ঘুরে একটা দৌঁড় লাগালো। কিন্তু বাঁক ঘুরতেই উজ্জ্বল একটা আলো চোখে এসে পড়তেই ভয় পেয়ে থমকে দাঁড়িয়ে গেল। গাড়িটাও শেষ মূহুর্তে ব্রেক করে ফেললো তিথিকে দেখতে পেয়ে। তিথি ভয় পেয়েই থপ করে রাস্তায় বসে পড়লো ধূলোর মধ্যেই। ছেলেগুলোও দৌঁড়ে তিথির দিকে আসতে লাগলো। সেটা দেখে তিথির জান যায় যায় অবস্থা।
ছেলেগুলো তিথির কাছাকাছি আসার আগেই তিথি কারো হাতের টানে রাস্তা থেকে উঠে দাঁড়ালো। মুখ তুলতেই তিয়াশকে দেখে জড়িয়ে ধরে ফেললো। ছেলেগুলোও ততক্ষণে ওদের কাছাকাছি চলে এসেছে।
-এই যে ভাই? কি হচ্ছে এসব? আমাদের গ্রামে এসব অবিচার কিছুতেই মানবো না আমরা। একে তো আরেকটু হলেই তো এক্সিডেন্ট করছিলেন। এখন মেয়ে দেখে একেবারে বুকে জড়িয়ে ধরে-।
-আরে? জাস্ট শাট আপ---। ও রাগ করে গাড়ি থেকে নেমে হাঁটা ধরেছিল বাড়ির দিকে--। হঠাৎ দৌঁড়ে এসে পড়লো কেন গাড়ির সামনে? আপনারাই বা কোত্থেকে এলেন? নাকি ওকে তাড়া করছিলেন?
--------আমরা! তাড়া! আর মশাই এখনো জড়িয়ে ধরে আছেন যে? কে হয় আপনার--?
-সি ইজ মাই ওয়াইফ--। এই তিথি? ব্যথা লাগে নি তো কোথাও? কোথায় লেগেছে বলো না প্লিজ? এই?
তিয়াশের মুখে ' সি ইজ মাই ওয়াইফ' কথাটা শুনে চমকে মুখ তুলে তাকিয়েছে তিথি। কথাটা সত্য নয়। তবু কেন জানি তিথির ভিতরে কাঁপন ধরিয়ে দিলো। কাঁপনের জোরে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না বেচারি। হেলে পড়ছে দেখে তিয়াশও তিথিকে জাপটে ধরে ফেললো। বেচারা ভেবেছে মেয়েটা সাঙ্ঘাতিক ব্যথা ট্যথা পেয়েছে কোথাও। বারবার জিজ্ঞেস করছে কোথায় ব্যথা লেগেছে, ডাক্তারের কাছে নিতে হবে কিনা, পানি খাবে কিনা। আর তিথি তবু থ মেরে আছে। কি হচ্ছে বেচারি নিজেও বুঝতে পারছে না। ওর ফ্রেন্ড আরিয়ান সবার সামনে ওকে 'বউ বউ' করে জ্বালাতন করে। তবু কখনো তো ফিলিংসটা হয় নি। তবে আজ কি হল! নাকি তিয়াশ বলেছে বলে!
তিয়াশ একবার ছেলেগুলোর দিকে তাকিয়ে তিথিকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে আস্তে করে গাড়িতে বসিয়ে দিলো। তারপর ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসে শা করে বাড়ির দিকে গাড়ি ছোটালো। মেয়েটার উপরে প্রচন্ড রাগ হচ্ছে তিয়াশের। মেয়েটা এতোরাতে বের হওয়ার বায়না না ধরলে এতোকিছুই হতো না। না ওরা বের হতো, না তিয়াশের তিথিকে ইগনোর করার চেষ্টা করতে হতো, আর না মেয়েটা রাগ করে গাড়ি থেকে নেমে যেত, আর না এতোগুলো বখাটেগুলোকে দেখে ভয় পেয়ে পালাতো, আর না এভাবে গাড়ির সাথে ধাক্কা লেগে ব্যথা পেত। ব্যথা কোথায় পেয়েছে সেটাও বলছে না। ঠান্ডা পড়ছে। রাতে ব্যথাটা আরো বাড়লে তখন কি হবে! মেয়েটা যে কেন এক দন্ড শান্তি দেয় না ওকে!
-তিথি? কোথায় লেগেছে বলো না প্লিজ?
-নাহ৷ ব্যথা পাই নি৷
-দাঁড়াতেই পারছিলে না তখন--। আবার বলে ব্যথা লাগে নি?
-------------------------------
-বলো না? দেখি কোথায় লেগেছে দেখাও? পা মচকে গেছে নাকি কেটে গেছে? চুপ করে কেন আছো? বলছ না কেন কিছু?
-আমার জন্য এতো হাইপার হতে হবে না আপনাকে। আমি কে যে আমার জন্য এতো চিন্তা করছেন? কেউই তো না--। আমি তো বাজে বাজে ভিষণ বাজে একটা মেয়ে--।
-আর একটা আজাইরা কথা বলবা ধরে থাপ্পড় লাগাবো---। কি সমস্যা তোমার?
-কোন সমস্যা নেই আমার। আপনাকে বিরক্তও করবো না আর। ভাইয়া বলেছে বলে এলেন-নইলে তো আসতেনই না তাই না? অনেক দয়া করেছেন এসে--। আর লাগবে না--।
-সবসময় এমন ছেলেমানুষি করলে হয় না তিথি। এতো রাতে বের হওয়ারই বা কি দরকার ছিল সেটাই বুঝি না আমি---। এখন বলো কোথায় লেগেছে?
-বললাম তো এতো ভাবতে হবে না--।
-সেটাই তো। ভাবতে হবে না। সেটাই করার চেষ্টা করছি। পারছি না।
-কি?
-একেবারে মনের মধ্যে ঢুকে বসে আছো। এখন কি মাথায়-মগজে ঢুকে যেতে চাও?
-কি?
কথাটা শেষ হতে তিয়াশ নিজেই জিভ কাটলো। কি বলে ফেললো। এই বাচ্চা মেয়েটা কি ভাববে এখন!
-হুহ----। ভালোই--। মনের মধ্যে ঢুকে বসে আছি! তাই সমানে ইগনোর করে--। সমানে পচা কথা বলে---। চিন্তা করতে হবে না। আপনার সামনেই আর আসবো না আমি---। একবারও আর ডাকবো না। একটা কথাও বলবো না---।
-কেন কই যাবা?
-যেখানে ইচ্ছা যাই সেটা আপনাকে চিন্তা করতে হবে না।
-এভাবে হুটহাট করে বের হয়ে আবার কোন ঝামেলায় পড়তেন, তাই না ম্যাডাম?
-সেটাও আপনাকে ভাবতে হবে না। আপনার সামনে না আসলেই তো হলো? তাই না? আসবো না। ভয় নেই। তিথির মুখটা আর জীবনেও আপনাকে দেখতে হবে না---।
-তিথি?
তিয়াশ তিথির কথাটা শুনেই গাড়িটা ব্রেক করলো। তিথি মাথা নিচু করে কাঁদছে। কেন কাঁদছে নিজেও জানে না। আর মনে মনে ইচ্ছে মতো বকছে। তিয়াশ আলতো করে তিথির গাল ছুঁয়ে দেয়ার চেষ্টা করতেই তিথি সরে গেল। আবার ফোঁপাতে লাগলো।
-তিথি? আমি তোমাকে হার্ট করতে চাই নি। কেন বুঝতে পারছ না পিচ্চিটা?
-বুঝবো না বুঝবো না বুঝবো না।
-তিথি? -----ওয়েট এ মিনিট। আমি তোমাকে কেন এতো কনভিন্স করছি! সাফাই কেন দিব তোমাকে! সাফাই দিতে হলে গার্লফ্রেন্ডকে দিবো। বউকে দিবো। তোমার মতো পিচ্চিকে কেন সাফাই দিবো?
-খুন করে ফেলবো অন্য কোন মেয়ের দিকে তাকালেও--। ফাজিল লোক--। নির্লজ্জ একটা ছেলে--।
তিথি রেগে গিয়ে তিয়াশের টিশার্টের কলার চেপে ধরেছিল। দুজনেই চমকে তাকাতেই চোখাচোখি হয়ে গেল। মেয়েটার মনে কি চলছে এক মিনিট চুপ করে বোঝার চেষ্টা করলো তিয়াশ। যেটা তিয়াশ ফিল করছে সেই একই ফিল কি তিথিরও হচ্ছে? এভাবে এই পিচ্চির দিকে আকৃষ্ট হওয়া কতোটা যুক্তিযুক্ত! তবে মেয়েটাকে ইগনোর করেও শান্তি পাচ্ছে না তিয়াশ। তিথিকে কাঁদতে দেখেও ওর বুকের ভেতরটা যেন দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। এটা কি ভালোবাসা? নাকি মায়া! নিজের ছোট বোনের ভাবি ননদের উপরে এমন মায়া হওয়া কি উচিত হচ্ছে! নাকি ভালোবাসা উচিত! তিথি রেগে গিয়ে তিয়াশের টিশার্টের কলার আরো জোরে চেপে ধরলো।
-কথা বলেন না কেন হ্যাঁ? অন্য কোন মেয়ের দিকে তাকালেও খুন করে ফেলবো বলে দিলাম--। চোখগুলো তুলে বল বানাবো বলে দিলাম। আমার সাথে বাঁদরামি? আমি থাকতে সে কিনা------?
-কেন? আমি আমার গার্লফ্রেন্ডের দিকে তাকাতেই পারি--। যার দিকে ইচ্ছে হয় তাকাবো। তোমার কি?
-বললাম না? মারি ফেলবো বেয়াদ্দপ ছেলে আরেকবার এই কথা বললে------।
তিথি কথাটা বলেই তিয়াশের বুকে এলোপাথাড়ি কিল বসাতে লাগলো। তিয়াশের সেদিকে হুঁশ নেই। তিয়াশ তিথির মুখের দিকে তাকিয়ে দেখছে। মেয়েটার চোখে মুখে কিছু হারানোর ব্যথা ফুটে উঠেছে। কার হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে মুখটা এতো ছোট হয়ে গেছে? তিয়াশের? তিয়াশ শক্ত করে তিথির হাতটা চেপে ধরলো। তিথিও রাগী চোখে তিয়াশের দিকে তাকালো।
-কেন বলো তো? তুমি আমার কে হও হ্যাঁ?
-যা ইচ্ছা হই--। তাকাবেন না মানে তাকাবেন না। সোজা হিসাব--।
-ইশ! বয়েই গেল আমার তোমার কথা শুনতে-। আমার মিষ্টি একটা গার্লফ্রেন্ড আছে। ওর কথাই শুনবো--। তোমার না। ওকে?
তিথি রাগ করে তিয়াশকে ধাক্কা মেরে সরে এসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। তিয়াশ হেসে ফেললো ওর রাগ দেখে। পিচ্চিটার কাজ দেখে হাসি পাচ্ছে। খুব করে ওর পাগলামি দেখতে ইচ্ছে করছে আরো। তাই গার্লফ্রেন্ডের কথা বলে দেখতে চাইছে কি করে।
-তোমাকে বুঝসো আমার গার্লফ্রেন্ডের সাথে পরিচয় করিয়ে দিব---। ওকে?
-ঘোড়ার ডিম গার্লফ্রেন্ড। কিসের গার্লফ্রেন্ড! হ্যাঁ? আমি বলেই আপনার মতো খারুস আকড়ু লোককে এতো পাত্তা দিচ্ছি--। ইগনোর করার পরও ছুটে আসছি। আর কেউ এই খারুস, আনরোমান্টিক লোককে ২ মিনিট ও সহ্য করবে? অসম্ভব৷ প্রেম তো বহু দূরের কথা---।
-কি বললা? আমি আনরোমান্টিক না?
-জি জি জি----।
-দাঁড়াও তোমাকে দেখাচ্ছি---।
তিয়াশ তিথিকে এক ঝটকায় কাছে টেনে নিয়ে ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো। তিথিও চোখ তিয়াশের টিশার্টের এককোণা খামচে ধরে সেই স্পর্শে হারিয়ে গেল। বেশ খানিকটা সময় পর তিয়াশ একটু সরে এসে তিথির মুখের দিকে তাকালো। মেয়েটা এখনো চোখ বুজে আছে। ঠোঁট জোড়া আলতো করে কাঁপছে, আর ঠোঁটের কোণে ঝুলে আছে মিষ্টি একটা হাসি। তিয়াশ আরেকবার আলতো করে তিথির ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে শক্ত করে নিজের সাথে তিথিকে জড়িয়ে নিলো। এই পাগলিটার থেকে দূরে থাকা অসম্ভব হয়ে গেছে তিয়াশের জন্য। কি করে যে এই বাচ্চা মেয়েটাকে ভালোবেসে ফেলেছে নিজেও জানে না তিয়াশ। তবে খুব করে চাইছে মেয়েটা ওর দিকটাও একটু বুঝুক। হয়তো সময় লাগবে ওর সেই ম্যাচিউরিটি আসতে। তবু সেটা ভাবতেও ভালো লাগছে তিয়াশের। পিচ্চিটাকে নিজের মতো করে গড়ে নেয়ার একটা সুযোগ তো পাবেই। আর অফুরন্ত ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে দেয়ার চান্স তো আছেই।