অচেনা অতিথি - পর্ব ২১ - সিজন ২ - নাফিসা মুনতাহা পরী - ধারাবাহিক গল্প


তিতির রুক্ষ শুষ্ক মাটির বুুকে পড়ে আছে। ওর চোখ দু'টি সম্পূর্ন খোলা। অদুরেই অতিথী পড়ে কাটা মুরগির মত ছটপট করে চলছে। মাথা ফেটে গড়গড় করে রক্ত বেয়ে শুষ্ক মাটি ভিজে একাকার হয়ে যাচ্ছে। মানুষ জন আসতে আসতেই অতিথীর দেহ নামক খাঁচা থেকে ওর প্রান পাখিটা বের হয়ে যায়। তিতির স্থির হয়ে পুরো ঘটনা দেখে। তার পর জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে থাকে।

রাস্তার ধারে আরো কয়েকটা গাড়ী পার্ক করা ছিল। বিপরীত দিক থেকে অন্য একটা প্রাইভেট কার এসে প্রচন্ড গতিতে তিতিরদের গাড়ীটিকে ধাক্কা দেয়। চোখের পলকে এমন একটা ঘটনা ঘটে যাবে সেটা কেউ কল্পনাই করেনি। মনে হয় বেলুনওয়ালা সবার জন্য আজারাঈল হয়ে রাস্তার ধারে দাড়িয়ে ছিল।

গাড়ীটিও ছিটকে গিয়ে আরও পাশাপাশি পার্কিং করা কয়েকটা গাড়ীর সাথে ধাক্কা খায়। ঘটনাস্থলে গাড়ীর ডাইভার, অতিথী এবং ধাক্কা দেওয়া গাড়ীর ডাইভার সহ তিনজন ঘটনাস্থলেই মারা যায়। আর বাঁকি গাড়ীগুলোর অবস্থাও বেশ খারাপ। প্রাথমিক ধারনা করা হয় গাড়ীর ব্রেকফেল হওয়াতে এতগুলো হতাহত হয়।

.

কামরান সাহেব হন্তদন্ত হয়ে অফিস থেকে ছুটে বের হয়ে যাচ্ছেন। কিছুক্ষন আগে দুর্ঘটনার খবরটি এসেছে। পাগলের মত ছুটছেন তিনি। দ্রুত গাড়ীতে উঠে ঘটনাস্থলে রওনা দিলেন। তিতির কে হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছে।  ওর অবস্থা আরও ক্রিকিটাল। এর আগে এধরনে আরো ২বার এক্সিডেন্ট হয়েছিল ওর। মরতে মরতে বেঁচে ফিরেছে। সেই একই জায়গায় আবার আঘাত পেয়েছে। 

সাবিনার শোক কাটতে না কাটতেই আবার এত বড় একটা দুর্ঘটনা। ফুয়াদ সেখানেই আছে। বাসার সবাই হসপিটালে এসেছে। এখানে অতিথী সহ সব নিহত ব্যাক্তিদের ডেটবডি রাখা হয়েছে। ফুয়াদ সব ফরমালিটি পুরুন করছে মন একদিকে রেখে। ও নিজে ওদের গাড়ীতে তুলে দিয়েছিল। আধাঘন্টা না পেরুতেই খবরটা ওর কাছে যায়। বেচারা গোলাব একবার দৌড়ে তিতিরের কেবিনে যাচ্ছে আবার দৌড়ে একবার অতিথীর কাছে যাওয়ার চেষ্টা করছে। মাহাদকে জানানো হয়নি। কিভাবেই জানাবে। জানানোর কোন সুযোগও নেই। কত খুঁশি মনে ও একটা কাজে গিয়েছে তাও বাহিরের দেশে। হঠাৎ এমন কথায় ওর যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে সব শেষ। তাছাড়া ও এখনো পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠেনি। তবুও কামরান সাহেব একটা মাসেজ করলেন। দ্রুত বাসায় ফিরে আসার জন্য অনুরোধ করা হল।

অন্যদিকে সাদের পরীক্ষারত অবস্থায় একটা ম্যাম এসে অন্য ম্যামকে কিছু বলল। তারপর সাদের কাছে এসে বই পত্র গুছিয়ে ওকে নিয়ে গেল ক্লাসরুম থেকে। ও ম্যামকে বার বার বলছে, ম্যাম আমার এক্সাম তো শেষ হয়নি। তাছাড়া আমার মা তো আমাকে নিতে আসবেন। আপনি আমাকে এই সময় বাসায় নিয়ে যাচ্ছেন কেন?

সাদের টিচার কোন জবাব দিতে পারলোনা। শুধু ছলছল চোখে সাদকে বলল-

~" সাদ, আমাকেই আজ তোমার বাসায় তোমাকে পৌছে দিতে হবে।"

সাদ আর কথা না বাড়িয়ে শিক্ষকের সাথে রওনা দিল।

.

তিতিরের অবস্থা খুবই খারাপ। মাথার স্কাল্পে চির ধরেছে। এখনো জ্ঞান ফিরেনি। আইসিইউতে মৃত্যুর প্রহর গুনছে সে। এর আগে অপেরেশন হয়েছে পেসেন্টের। তাই তারা ভয়ে ২য় দফায় অপারেশন করতে ভয় পাচ্ছে। যদি সেন্স না ফিরে আসে! তাহলে পেসেন্টকে আর বাচানো যাবেনা। 

অতিথীর লাশ বাসায় নিয়ে আসা হয়েছে। ১৮ ঘন্টা পর মাহাদের সাথে যোগাযোগ করা যাবে। যদি মাহাদ যোগাযোগ করে তবেই সম্ভব। তাছাড়া মৃতদের বেশিক্ষণ রাখতে নেই। যতদ্রুত কবর দেওয়া যায় ততই উত্তম। মাগরিবের নামাযের পর কবর দেওয়া হবে। এমনই সিদ্ধান্ত নিলেন কামরান সাহেব। কবরের স্থান নির্বাচন করা হলো সেই ছোট্ট বকুল তলাতেই।

বাসায় অনেক মানুষ এসেছে। সাদ জানেনা কেন এত মানুষ এসেছে। বাবা তো নেই কিন্তু মা আর ছোট বোন কোথায়! সে কাউকে কিছু না বলে মা আর বোনকে খুঁজেই চলছে। নিসা সাদকে কোলে নিয়ে আছে। বড় মাকে সে যথেষ্ট ভয় পায়। তাই কিছু বলার সাহসও পাচ্ছেনা। কোন কাজে বড়মা চলে গেলে দৌড়ে নিজেদের রুমে গিয়ে মাকে খুঁজছে। শেষে ওর দাদীর কাছে গিয়ে কাঁদো কাঁদো স্বরে বলেই ফেলল-

~" দাদীজান, মা কোথায়! অথি কোথায়! ওনারা কই গিয়েছেন আমাকে একা ফেলে? আমার কষ্ট হচ্ছে।"

লাবীবার চোখ দিয়ে টপটপ করে অশ্রু ঝড়ছে। দ্রুত চোখ মুছে বলল-

~" একটা কাজে বাহিরে গেছে সাদ। সময় হলে চলে আসবে। চল তোমাকে খাবার দেই।"

~" না দাদীজান, মা আসুক।"

কথাগুলো বলেই দাদীর বুকে মুখ লুকিয়ে ফুফিয়ে কেঁদে উঠলো সাদ। সেই সকালে মাকে দেখেছে। এখন পর্যন্ত এলোনা! আর বাসায় এত মানুষ কেন!

এভাবে আরও সময় কাটলো কিন্তু মা বা অতিথী কেউ এলোনা। ওতো আর জানেনা, ওর আদরের অতিথী আর নেই। সাদ রুমে একা। কাজের মেয়ে কুসুম কি যেন কাজে বাহিরে গেছে। এই ফাকে সাদ রুম থেকে বের হয়েই নিচে দেখলো, আরও মানুষ এসেছে। ও ধীর পায়ে সিড়ি দিয়ে নেমে লোকজনের ভিড়ে ওর মাকে খুজতে লাগলো। এমন সময় কেউ যেন বলে উঠলো, অতিথীকে ঐ রুমে রাখা হয়েছে। সেটা শুনেই সাদ খুঁশি হয়ে সে রুমের দিকে পা বাড়ালো। সবাই নিজেদের কাজে ব্যস্ত। তাই ঐ রুমে কে গেল আর না গেল সেটা কেউ দেখলোনা। 

অতিথীকে গোসল করে কাফন পড়িয়ে রাখা হয়েছে। সাদ বুঝতে পারলোনা সেটা কি। তার বোন কই! সে বের হয়ে এসে দাদাকে খুজতে লাগলো। এদিকে কুসুমও পাগলের মত সাদকে খুজেই চলছে। বড় আম্মা যদি জানে সাদকে পাওয়া যাচ্ছেনা তাহলে আমাকে মেরেই ফেলবে। বলবে তোর আর বাঁচারই অধিকার নেই। একসময় দেখলো, সাদ ওর দাদাজানের আঙ্গুল ধরে আছে। হাফ ছেড়ে বাঁচলো কুসুম। দ্রুত এগিয়ে যেতেই ফুয়াদ এসে সাদকে কোলে নিয়ে বলল-

~" বাবা চল মাগরিবের সালাত আদায় করি।"

সাদকে নিয়ে ফুয়াদ চলে গেল। সাদ খুব কম কথা বলে। তবুও মাকে না পেয়ে অসহ্য হয়ে বলেই উঠলো- 

~" বড়বাবা, আমার মা কই! অথিও নাই।" 

ফুয়াদ কথার কোন জবাব না দিয়ে ওকে নিয়ে নামায আদায় করতে গেল। নামায পড়েই কবর দেওয়া হবে। বড়বাবার সাথে সালাত আদায় করেই দু'হাত তুলে আল্লাহকে নালিশ জানালো, আল্লাহ্ আমার মা কোথায়! তিনি কোথায় গেছেন। এতটুকু বলেই দ্রুত বের হয়ে এসে সামনে রাখার খাটিয়ার কাছে যায়। কারন ও শুনেছিল ওর ভিতর অতিথী কে নাকি রাখা হয়েছে। সাদ মৃত্যুর সাথে একদম পরিচিত না। জিবনে প্রথম এতবড় দোলনা দেখলো সে। খাটিয়াকে দোলনায় ভাবলো। সবাই মাগরিবের সালাত আদায় করতে ব্যস্ত আর এই সুযোগে ও জুতা খুলে খাটিয়াতে উঠে পাশে বসে কাপড় সড়িয়ে দেখলো সত্যিই অতিথী ঘুমিয়ে আছে। যেমনটা ও দোলনাতে সুয়ে থাকে। অথি, আজ থেকে তো তোমার সাথে আমিও ঘুমাতে পারবো। অনেক বড় তোমার দোলনা। কথাগুলো বলেই ছোট বোনকে ওর কোলের উপর রেখে গালে কয়েকবার চুমু খেয়ে বলল-

~" আমি তোমাকে কত খুঁজেজি জানো! মা কোথায় আছে তুমি জানো? মাকে তো আমি খুঁজেই পাচ্ছিনা।"

এরা দুই ভাই-বোনই আজ বাবা-মা ছাড়া যেন একেবারে অসহায়। আপন বলে আশেপাশে কাউকে খুঁজে পাচ্ছেনা। কিন্তু সাদ ভাবলো অতিথী তো ঘুমিয়ে আছে। সে বোনের গালে আবার চুমু খেয়ে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে খাটিয়ার মধ্যই বসে রইলো। কেউ নেই আসে-পাশে। তারমানে তাকেই তার বোনকে দেখে রাখতে হবে। মা তো নেই অথি। তুমি আর কতক্ষন ঘুমিয়া থাকবা আপু!

হঠাৎ একটা লোক খাটিয়ার ভিতর সাদকে দেখে ভয়ে এত জোড়ে চিৎকার দিলো যে বাসার সবাই যে যেখানে ছিল সেখানে এসে দাড়িয়ে সাদকে ঐ অবস্থায়  দেখলো। ফুয়াদের তো পুরো শরীরে হিমশিতল বাতাস বয়ে গেল। সাদতো তার সাথেই ছিল তাহলে এখানে ও কেমন করে আসলো। আর জানলোই বা কেমন করে এখানে অতিথীকে রাখা হয়েছে।
কামরান সাহেব দৌড়ে এলো। সাথে আরও দু'জন এলো। সাদ অতিথীকে ছেড়ে দাও বলতেই দু'জন লোক ওর কোল থেকে অতিথীকে নিল। সাদ এবার কেঁদেই উঠলো, অথিকে কই নিয়ে যাচ্ছেন?

কামরান সাহেব এসে সাদকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে দ্রুত সেখান থেকে সড়ে পড়লো। 

সমস্যা হলো জানাযার সময়। মাহাদ নেই, একমাত্র সাদ আছে। ওর পরিবার থেকে এই একজনই পুরুষ রয়েছে। তাই ওকেও জানায়ায় শামিল করা হলো। কারন সে উত্তমরুপে সালাত আদায় করতে পারে। সাদের কাছে বোনও নেই মাও নেই। তাই নিঃশব্দে কেঁদেই চলছে সাদ। সে বুঝতেই পারছেনা, তার ঘুমন্ত বোনটাকে নিয়ে এরা কোন খেলায় মেতে উঠেছে। অতিথী কে যখন কবরে নামানো হল তখন সাদ ছটপট করতে লাগলো। বার বার দাদা জানের কোল থেকে নামার চেষ্টা করলো। একসময় কামরান সাহেব নিচে নেমে দিতেই সাদ কিছু না ভেবেই কবরে নেমে পড়ে আধা চিৎকার দিয়ে ডুকরে উঠে বলল-

~" দাদাজান, অথিকে এখানে রাখছেন কেন? ওকে ঘরে নিয়ে চলেন। ও এখানে থাকলো তো ওর কষ্ট হবে!"

চোখের পলকে এমন একটা কাহিনী ঘটে যাবে সেটা কেউ ভেবেও দেখেনি। একটা লোক ওকে টেনে তুলতেই ফুয়াদ এসে ওকে ধরে জোড়ে একটা ধমক দিলো। সাথে সাথে সাদ ভয় পেয়ে থেমে গেল। ফুয়াদ ওর হাতে ৩ মুঠ মাটি দিয়ে অতিথীর কবরের দিয়ে ওকে নিয়ে সরে পড়লো দ্রুত।
.

সাদের সাথে ঘটা কাহিনীগুলো বাতাসির কানে যেতেই বাতাসি সবার সামনে চিৎকার দিয়ে বলল-

~" দুই জন দামড়া মরদ, ক্যালা ছাওয়ালরেই আটকে রাকতে পারেনা। তোরা পুরুষ না মাগী-ছাগীর দল!"

ফুয়াদ কোন কথার জবাব না দিয়ে সাদকে নিয়ে গিয়ে নিজেও গোসল দিল সাদকেও দিয়ে দিল।
সাদ আর কথা বলেনি ওর বড়বাবার সাথে।
একসময় না খেয়েই ফুয়াদের বুকে ঘুমিয়ে পড়ে।


পরের দিন  মাহাদ ওর গন্তব্য স্থলে পৌছালো। জিবনে এতবার জার্নি করেছে কিন্তু এমন অস্বস্তিকর জার্নি ও কোনদিনও করেনি। প্লেনে বুকের ভিতর সমস্যা হয়েছিল। সেখানেই ওর প্রাথমিক চিকিৎসাও করা হয়েছিল। মোবাইল ফোন ফ্লাইট মোডে ছিল। তাই কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি। নতুন সিম ভরে ডাটা অন হতেই একের পর এক মাসেজ এসে ভির জমালো। সবার একটাই কথা, দ্রুত যেন ব্যাক করা হয় বাসায়। কি এমন হলো যে বাসায় ব্যাক করতে বলছে! এমন সময় ফুয়াদের কল আসলো। তারমানে এরা কতবার ট্রাই করেছে  শুধু মাত্র মাহাদের সাথে যোগাযোগ করার জন্য। 
মাহাদ কল রিসিভ করতেই ফুয়াদ বলল-

~" তুই কি পৌছে গেছিস?"

মাহাদ সেই কথার জবাব না দিয়ে সরাসরি বলল-

~" ভাইয়া তিতির কেমন আছে? আর বাসার সবাই ভালো আছে?"

ফুয়াদের কথা বন্ধ হয়ে গেল। কি কানেকশন তিতিরে  সাথে মাহাদের। এক নিমিষেই ধরে ফেলেছে, তিতির ভালো নেই হয়ত। কিন্তু ফুয়াদের কোন রেসপন্স যখন পেলোনা মাহাদ তখন ও নিচু গলায় বলল-

~" ভাইয়া, আমার মন বলছে খুব বড় একটা অঘটন ঘটে গেছে আমার সাথে। কিছুতো বলো! আমি এত স্ট্রেস নিতে পারছিনা। সত্যিটা বলে দাও।"

~" তুই বাসায় ব্যাক কর। এলে সব জানতে পারবি।"

মাহাদের গলা ধরে আসলো। ও ছলছল চোখে বলে উঠলো-

~" ভাইয়া, তিতিরের যদি কিছু হয়ে থাকে তাহলে দ্রুত ড. রফিককে ইনর্ফম করো। কারন তিতিরের শরীরের সমস্যার সমস্ত বিষয় ওনার থেকে কেউ ভালো জানেনা। এর আগের এক্সিডেন্টে উনিই ওর সার্জারি করেছিলেন। তাই যাকে তাকে ওর দায়িত্ব দিওনা।"

ফুয়াদ চমকে উঠলো এমন কথা শুনে। এত কনফিডেন্সের সাথে ও এসব কথা কি করে বলতে পারলো! নিসা মরে ভুত হয়ে গেলেও মনে হয় আমার এভাবে ফিলিংস হতোনা। ফুয়াদ কান্না কণ্ঠে বলে উঠলো-

~" সব কিছু যদি বুঝেই যাস আগে থেকে তাহলে এটা কি বুঝতে পারিসনি, অতিথী আর নেই! তিতিরের জিবন প্রদ্বীপও এখন নিভু নিভু করছে।"

মাহাদ কথাগুলো শুনে একদম স্থির হয়ে গেল। বুকের ভিতর ব্যাথার তীব্রতা বেড়েই চললো। দ্রুত কলটা কেটে ওখানকার পুলিশের সাথে যোগাযোগ করলো। পুলিশ অফিসারকে সব কিছু খুলে বলতেই অফিসারই অবাক হয়ে রইলো কিছুক্ষন।  একজন পিতা এই পরিস্থিতে কিভাবে এতোটা শান্ত থাকতে পারে! উনিই সব ব্যবস্থা করলো। মাহাদ চুপ করে মাথা নিচু করে শুধু বসেছিলো।

.

মাহাদের দেওয়া ঠিকানা অনুযায়ী  ড.রফিকের সাথে যোগাযোগ করা হলো। তিনি খবর শুনে আর এক মুহুত্ত্বও দেরী করেননি। ড. রফিক আসাতে অন্য সব ডাক্তারটা একটু ক্ষোভ প্রকাশ করলো। আমরা দেশের এত বড় ডাক্তার চিকিৎসারত থাকা অবস্থায়  অন্য ডাক্তারকে কেন ডাকা হলো! কিন্তু ড. রফিক এতে কোন প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে সোজা অপেরেশন থিয়েটারে ঢুকে গেলেন। লাইভ কনফারেন্সে ড.আলিম তার স্ত্রী আর লন্ডন থেকে আসমার স্বামী ড. ওয়াহিদও যোগদান করলো একসাথে। অনেক বেশি লেট হয়ে গেছে। আগের ডাক্তারগন ধরতেই পারেনি আসল সমস্যা।
প্রায় ৭ ঘন্টা অপেরেশন চলল। তারপর ড.রফিক বের হয়ে এসে বললেন, দোয়া করেন সবাই। আমার চিন্তা হচ্ছে মেয়েটা বেঁচে গেলেও ওর কিছু একটা শারিরীক দিক দিয়ে ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। বিশেষ করে মাথায় ৩ বার বড় ধরনের আঘাত পেল। এর প্রভাব তো পড়বেই। জ্ঞান ফিরতে দেরী হবে। আল্লাহর ইশারা ছাড়া এত জটিল অবস্থা থেকে পরিত্রান পাওয়া সমম্ভ নয়। লম্বা সময় পর তিতিরে  সেন্স তো ফিরল কিন্তু ও আর স্বাভাবিক হলোনা।


৭ দিন পর মাহাদ দেশে আসতে সক্ষম হয়। কাগজপত্রের জটিলতা সহ সব কিছু ঠিকঠাক করতে ওর সময় লেগে যায়। তার ভিতর করোনার সময় আরও জটিলতা দেখা দেয়। সব বাধা পেরিয়ে ও আসতে সফল হয়।
এই সাতদিনে মাহাদ তিতিরের সাথে অনেক কথা বলার চেষ্টা করেছে কিন্তু ও কোন কথাই বলেনি। মানুষিক রোগী হয়ে গেছে সে। শুধু বুকের কাছে অতিথীকে খোঁজে। অজান্তেই মেয়েকে ফিডিং করাতে যায়। চোখের নিচে কালো দাগ পড়ে গেছে। তেমন কোন হুসও থাকেনা। দিন-রাতের বেশিভাগ সময় ঘুমিয়েই থাকে। এখনো হসপিটালেই রয়েছে। সেদিন ফুয়াদ এসেছিল ওকে দেখতে। ফুয়াদকে দেখেই মাহাদ ভেবে জড়িয়ে ধরতে গিয়েছিল। লাবীবা সাথে সাথে তিতিরকে ধরে ফেলে। লজ্জায় ফুয়াদ আর সামনেই আসেনি। তিতির সাদকেও যেন আর চিনেনা। সাদ যে ওর আর একটা সন্তান সেটা ওর মধ্যে কোন ফিলিংসই নেই। 

.

মাহাদকে নেওয়ার জন্য ফুয়াদ নিজে গাড়ী নিয়ে উপস্থিত হয় ইয়ার্পোটে। মাহাদ সালাম দিয়ে গাড়ীতে উঠে নিজেই ড্রাইভ করতে লাগলো। ফুয়াদ বার বার নিষেধ করলো তবুও শুনলোনা। মাহাদের চোখের পানি আর কোনই বাঁধ মানছেনা। চোখ উপচে পানি পড়ছে। মাহাদ বাম হাতে গাড়ী ড্রাইভ করছে আর অন্য হাত দিয়ে বার বার চোখের পানি মুছছে। ফুয়াদ অনেক কথা বলল কিন্তু মাহাদের কানে কোন কথাই গেলোনা। চেহারায় উশকো খুশকো একটা ভাব এসেছে। দাড়ীগুলো কাটা হয়নি। চোখ দুটি জবা ফুলের মত লাল হয়ে গেছে। লাল ঠোট আরও লাল টকটকে হয়ে গেছে। বার বার চোখের পানি মুছছে কিন্তু কোন শব্দ করছেনা। ওর ভিতরে যে কি হয়ে যাচ্ছে শুধুমাত্র ও নিজে আর ওর আল্লাহই ভালো জানে।

একসময় তারা বাসায় চলে আসে। ফুয়াদ বার বার বলছে তিতিরের কাছে চল! ওকে তোর খুব প্রয়োজন। কিন্তু মাহাদ কোন কথা না শুনে বাসায় চলে এলো।

দাড়োয়ান গেট খুলতেই ওখানেই মাহাদ গাড়ী ব্রেক করলো। বাসার ভিতর গাড়ী  না ঢুকিয়েই গাড়ী থেকে  নেমে পড়লো মাহাদ। এরপর দ্রুত গেট পেরিয়ে প্রায় আধা দৌড়ে অতিথীর কবরের কাছে চলে এলো।
তারপর হাটু ভাজ করে বসে জোড়ে জোড়ে কাঁদতে লাগলো আর পাগলের মত দু'হাতে কবরের মাটি খুড়তে লাগলো।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন