০৩!!
-জানিস ভাইয়া? সপ্তাহ খানেক আগে কলেজের গেইটের সামনে আপুকে ফুসকা খেতে দেখে আমারও ভিষণ ফুসকা খেতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু আমার মরার বান্ধবী একটাও রাজি হলো না। উল্টো বলে কিনা 'রাস্তার ফুসকা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বানায়' তারা নবাবের বেটিরা নাকি রেস্টুরেন্টে গিয়ে ফুসকা খাবে--। আমার কি রাগ হচ্ছিলো জানো! এদিকে আমি বাসায়ও পার্সটা ফেলে গিয়েছি ভুল করে--। আসার সময় তো গাড়িতে চলে আসবো তাই পার্সের আর খেয়ালও ছিল না--। আর এদিকে ফুসকা খেতে না পেরে আমার এতো এতো কান্না পাচ্ছিলো জানিস!
-হা হা হা----।
-এই হাসবি না একদম-। বলবই না আমি ধুর--।
-আরে না না--। বল পরে কি হলো?
-জানিস আপুটা আমাদের কলেজে কোন একটা সাবজেক্টে অনার্স করছে। আমাকে মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমাকে ডেকে বললো ফুসকা খেতে৷ আমি যখনই বললাম টাকা নেই আপুটা হেসে দিয়ে বললো সে টাকা দিয়ে দিবে--। হিহি।
-কেউ ফুসকা খাওয়ালো আর তুইও খেলি? যদি মেয়েটা কোন কিডন্যাপার হতো?
-উফফফ---। আমি তো এমনি এমনি খাই নি--। আপুটা এত্তোগুলা সুইট--। তাই ফুসকা খেতে খেতে আপুটার ঠিকুজিকোষ্ঠী সব জেনে নিয়েছি---।
-কি!
-আরে ঠিকানা আর কি বাবা! আপুটা ফুসকাওয়ালা মামাকে টাকা দিয়ে আস্তে আস্তে হেঁটে হেঁটে চলে গেল। আমিও বাসায় এসে আব্বু আম্মুকে বলেছি আপুর কথা--৷ আর আব্বু সব খোঁজ খবর নিয়েছে--। বুঝলি?
-জি ম্যাডাম বুঝলাম--।
-এখন শোন---। আমি তোর বিয়ের ঘটকালি করছি--। বকশিস দে----।
-দিবো একটা--। তাকে নাকি বকশিস দিবো--। হাহ!
-হুহ--। মায়রা আপুর বাসায় গিয়েও তোমার সেই আমাকেই দরকার হবে ভাইয়ু---। তখন আমিও দেখে নিবো তোমাকে--।
-আরে যা যা---।
মায়রাদের বাসায় পৌঁছাতে বেশিক্ষণ লাগলো না। সবার সাথে কুশলাদি বিনিময়ের পর আয়ান আর তিথি বাবা মায়ের সাথে বসলো সোফায়। পাঁচ মিনিট মতো পরে মায়রাকে ড্রইং রুমে নিয়ে এলেন ওর মা। মায়রা সবাইকে সালাম দিলে তিথি মায়রার হাত ধরে টেনে একটা সোফায় বসাল আয়ানের মুখোমুখি করে। তিথিকে দেখে প্রথমে চমকে গেলেও পরে একটু হাসলো মায়রা৷ তিথিও মায়রার সাথে ফিসফিস করে কিছু বলাবলি করছে। আয়ানও মায়রার দিকে তাকিয়ে থ হয়ে গেল। মেয়েটা আজকে নীল রঙের একটা জামদানি শাড়ি পড়েছে। হাত ভর্তি করে নীল কাঁচের চুড়ি, গলায় কানে সম্ভবত ওর মায়ের গয়না, কপালে ছবির মতো ছোট্ট নীল টিপ আর ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক। আয়ানের মনে হচ্ছে মায়রাকে সকালে দেখা ছবির চেয়েও বেশি সুন্দর লাগছে সামনাসামনি। মায়রা তিথির সাথে কথা বলতে বলতে মুখ তুলে তাকাতেই আয়ানের সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল। আর প্রায় সাথে সাথেই আয়ান খেয়াল করলো মেয়েটার মুখে লাল একটা আভা ছড়িয়ে পড়েছে।
তিথির গলা খ্যাঁকারির শব্দে হুঁশ হতে আয়ান তিথির দিকে তাকালো। দেখলো তিথি মিটিমিটি হাসছে মায়রার পাশে বসে। আয়ানের বাবাও ছেলের দিকে তাকিয়ে একবার হাসলেন। তারপর মায়রার বাবার দিকে তাকালেন।
-ভাই সাহেব? আমরা তো অনেকক্ষণ আছি--। ওরা নিজেরা নাহয় আলাদা করে একটু কথা বলুক। কি বলেন?
-জি জি--। তিয়াশ যা তো বাবা ওদেরকে একটু ছাদের দিকে নিয়ে যা---।
-না না--। আঙ্কেল আমি নিয়ে যাই?
-তুমি যাবে? আচ্ছা মা যাও---।
-চলো আপু? এই ভাইয়া আয়?
আয়ান চোখ পাকিয়ে তিথির দিকে তাকালেও তিথি সেটা পাত্তা না দিয়ে মায়রার হাত ধরে হাঁটা ধরলো। আয়ান বেচারাও আর কি করবে মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে ওদের পিছন পিছন ছাদের দিকে পা বাড়ালো। ছাদে এসে আয়ানের মনটা ভরে গেল। রেলিং ঘেষে অনেক রকমের ফুল আর ফলের গাছ। মাঝামাঝিতে বসার জন্য টেবিল চেয়ারেরও ব্যবস্থা আছে। আর বসার জায়গাটার উপরে ছাউনি করে দেয়া৷ রোদ বা বৃষ্টি কোনটাতেই সমস্যা হবে না৷ সুন্দর আড্ডা দেয়ার জায়গা। মায়রা, তিথি, আয়ান তিন জনই চেয়ারে বসে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলো। একটু পরেই তিথি তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়ালো।
-কি রে? কোথায় যাচ্ছিস?
-আমমম--। আমি না মোবাইলটা আনতে ভুলে গেছি--। তোমরা কথা বলো? আমি মোবাইলটা নিয়েই চলে আসছি----।
তিথি কথাটা বলে আয়ানের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে হাসতে হাসতে ছুট লাগালো নিচে৷ আয়ানও বুঝতে পারলো পিচ্চিটা ওদের কথা বলার সুযোগ করে দিতেই এই মিনি ড্রামাটা করলো। ড্রামা কুইন আর কাকে বলে!
-হ্যালো? আমি আয়ান---।
-আসসালামু আলাইকুম। আমি মায়রা---।
-ওয়ালাইকুম আসসালাম। বাই দা ওয়ে। আপনাদের ছাদটা ভিষণ সুন্দর।
মায়রা মুখ নিচু করে একটু হাসলো। আয়ান অপলকে মায়রার হাসি মুখটা দেখছে। মায়রা ব্যাপারটা টের পাচ্ছে বলেই হয়তো মুখ তুলে তাকাচ্ছে না। লজ্জা পেয়ে লাল হয়ে যাচ্ছে।
-আর আপনিও ভিষণ সুন্দর---।
মায়রা একটু চমকে উঠে আয়ানের দিকে তাকালো। আবার সাথেই চোখ নামিয়ে নিয়ে শাড়ির আঁচলে আঙুল প্যাঁচাতে লাগলো। সাদা ফর্মাল শার্টের হাতা কনুই থেকে ফোল্ড করা, মুখে খোঁচা দাঁড়ি, আর পিছন দিকে ব্রাশ করা চুল। এসব তো গেল ভদ্রলোকের গেটআপ। মায়রার কথা বন্ধ হয়ে গেছে লোকটার ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা হাসিটা দেখে৷ হাসিটায় দুষ্টুমি, মায়া, ছেলেমানুষি সব যেন একসাথে খেলা করছে৷
-রাগ না করলে একটা কথা বলবো?
-জি--। বলুন?
-আপনার এই লাজুক হাসিটার প্রেমে পড়ে গেছি---। আর আপনার মায়াবী চোখ জোড়ার চাহনি তো একেবারে ঘায়েল করে দিয়েছে সেই কখনই---। সারাজীবন এই হাসি আর চোখের প্রেমে ডুবে থাকতে চাইলে কি রাগ করবেন?
আয়ানের কথাগুলো শুনেই মায়রার চোখে পানি চলে এলো। এভাবে এতোটা স্নেহভরা কণ্ঠে কবে কে ওর সাথে কথা বলেছে সেটা ওর মনেই নেই। আজ সকালেও ওই মানুষগুলো দেখতে আসবে শুনে দরজা বন্ধ করে কি কান্নাটাই না কেঁদেছে। না, কাউকে চায় বলে নয়। আজ পর্যন্ত কেউই এতোটা অবাক হয়ে ওকে দেখেছে বলেও মায়রার মনে পড়ে না। কান্নাটা অন্য কারণে। একটু ভয়, আর কিছুটা দ্বিধার কান্না। আর এই মূহুর্তে মায়রার কান্না পাচ্ছে মানুষটার কথা শুনে। কি সাবলীল, সহজ স্বীকারোক্তি মানুষটার। এই মানুষগুলো সত্যি ওর জীবনে আসতে চলেছে, ব্যাপারটা নিছক স্বপ্নের মতো লাগছে মায়রার কাছে। মনে হচ্ছে ঘুমটা ভাঙলেই এই সুন্দর স্বপ্নটাও হারিয়ে যাবে৷ চাইলেও ধরে রাখতে পারবে না এই মানুষটর চোখে মুখের সেই মুগ্ধ কৌতূহলটা। আয়ান একটা সামনে এসে মায়রার চোখের সামনে তুড়ি বাজালো।
-এই যে ম্যাডাম? রাগ করলেন?
-না মানে!
-উত্তরটা কিন্তু পেলাম না আমি--।
-যদি আপনার বাসার কারো আমাকে পছন্দ না হয়? কিছু তো জিজ্ঞেসও করলো না উনারা আমাকে---।
-হুম? জিজ্ঞেস করবেও না। কারণ সবার আপনাকে ভিষণ পছন্দ হয়েছে।
-যদি আমার বাসা থেকে বিয়ে দিতে রাজি না হয়?
-উমমমম--। তাহলে আপনি রাজি থাকলে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে নিবো--। কি বলেন? নাতি নাতনী দেখে তো বিয়েটা এক সময় না এক সময় মেনে নিবেই---।
-হি হি---। মজা করছেন?
-উহু---। একদমই না--। আপনি রাজি থাকলে আজই বিয়ে করে ফেলতে পারি-। করবেন বিয়ে?
মায়রা লজ্জা পেয়ে আবার শাড়ির আঁচলে আঙুল পেঁচাতে লাগলো। এই লোকটা এমন করে কথা বলছে যেন কতোদিন ধরে একে অন্যকে ভালোবাসে। আর বিয়ের জন্য যেন তার তর সইছে না। এমনটাও হয়! প্রথমবার দেখেই ভালো লাগা সম্ভব এতোটা! অবশ্য লোকটাকেও মায়রার ভিষণ ভিষণ ভালো লেগেছে। আর কিছু ভাবার আগেই তিথি আবার ছুটে এসে মায়রাকে জড়িয়ে ধরলো।
-হ্যালো হবু ভাবি? কথা বলা শেষ?
-জি আপু----।
-আরে? কি মুশকিল! আমি তো তিথি---। পিচ্চি তিথি--। আমাকে খবরদার আপু টাপু বলবা না---।
-আচ্ছা পিচ্চি তিথি আপুটা---।
-হি হি----। কায়দা করে আবার আপু বললা না? হইসে হইসে এখন চলো চলো? নিচে যাবা-।
-তিথি তুই যা--। আসছি---।
-উহু----। আমার চকলেট দাও নি তুমি পচা লোক-। আমি ভাবিকে নিয়েই যাবো--। হুহ--।
-যা না একটু লক্ষী বোন? বাসায় যাওয়ার সময় অনেক গুলো চকলেট নিয়ে দিবো--। দরকার হলে পুরো চকলেটের দোকান কিনে দিবো আজকে--। যা না বোন? প্লিজ?
-হি হি--। আচ্ছা মনে থাকে যেন। এই ভাবি তুমি কিন্তু সাক্ষী---।
তিথি সিঁড়ি ঘরের বাইরে যেতেই আয়ান মায়রার সামনে এসে দাঁড়ালো।
-এই যে ম্যাডাম? একটু মুখটা তুলে তাকান--?
-জি?
আয়ানের কথা শুনে মায়রা মুখ তুলতেই আয়ান মায়রার কয়েকটা ছবি তুলে নিলো নিজের মোবাইলে। মায়রাও লাজুক হেসে মানুষটার কাজগুলো দেখছে। ছবি তোলা শেষ হতে আয়ান হালকা গলায় কিছু বললো।
-একটা লাজুক পরীকে ক্যামেরায় বন্দী করলাম---। কতো দিন এই ছবিগুলো দেখে কাটাতে হবে কে জানে!---চলুন?
মায়রা মুচকি হেসে ছাদের সিঁড়ি ঘর থেকে বের হতেই তিথিকে দেখতে পেল৷ তিথিও মায়রার হাত ধরে বকবক করতে করতে নামতে লাগলো। আর আয়ান ওদের পিছনে আসতে আসতে মায়রার লাজুক মুখটা দেখছে। আর আনমনে নিজেই হাসছে।
০৪!!
ড্রইংরুমে ফিরে এসে আয়ান মায়রা দুজনেই অবাক হয়ে গেল। ওরা ছাদে ছিল বড় জোর ২০ মিনিট। এই ২০ মিনিটে কিভাবে কিভাবে যেন বসার ঘরের পরিবেশটা বেমালুম বদলে গেছে। কি বদলেছে সেটা চিন্তা করার আগেই মায়রার মা হাসি হাসি মুখ করে এসে মায়রাকে ধরে সোফায় বসালো ওর বাবার পাশে। মায়রা বেচারি বুঝতেই পারছে না এবার কি হতে যাচ্ছে। তবে এই প্রথমবার মা, বাবা আর ভাইয়া তিনজনই ওর দিকে হাসি মুখে তাকিয়েছে, এতো যত্ন করছে দেখে মায়রা শুধু অবাক নয় মোটামুটি ভিষণ রকমের অবাক হলো। বাসার সবার এতো খুশির কারণ কি? বিনা পরীক্ষায় বিয়ে নামের জীবন সংগ্রামে পাশ করে গেছে সেই খুশি? নাকি মেয়েকে ঘাড় থেকে নামাতে পারছেন বলে খুশি? কোনটা?
তিথিও টেনে আয়ানকে মায়রার পাশে বসিয়ে দিলো। মায়রা একটু লাজুক হেসে আয়ানের দিকে তাকিয়ে আবার বাবার দিকে তাকালো। এবার কি করবে ভাবছে এমন সময় মায়রা হাতে আয়ানের ছোঁয়া পেল। একবার কেঁপে উঠে আয়ানের দিকে তাকাতেই টের পেল আয়ান মায়রার বাম হাতের অনামিকায় একটা আংটি পড়িয়ে দিয়েছে। মায়রার মাও কোথা থেকে একটা আংটি নিয়ে এসে মায়রাকে ধরিয়ে দিয়ে ইশারায় পড়িয়ে দিতে বললো আয়ানকে। মায়রা মায়ের দিকে থেকে আয়ানের দিকে তাকিয়ে আস্তে করে আয়ানের ডান হাতের অনামিকায় আংটিটা পড়িয়ে দিলো। তিথি খুশিত জোরে জোরে হাততালি দিচ্ছে দেখে সবাই হেসে ফেললো। মায়রাও হেসে ফেললো মেয়েটার পাগলামি দেখে।
পাশাপাশি দুটো পরিবারকে দেখছে মায়রা। একটা তার নিজের পরিবার। যেখানে সে ছোট্ট থেকে বড় হয়েছে। পাওয়া না পাওয়ার ভিড়েও হাজারটা অভিযোগ জমা আছে মায়রার এদের সবার জন্য। আজকের এই খুশির মূহুর্তেও ছোট্ট একটা কথা কান্না হয়ে মায়রার গলা আটকাচ্ছে বারবার। মা, বাবা, অথবা ভাইয়া কেউ কি একবারও পারতো জিজ্ঞেস করতে ছেলেটাকে তার পছন্দ হয়েছে কিনা? বা এই বিয়েতে তার মত আছে কিনা! জীবনের বাকি ঘটনাগুলোর মতই আজকের দিনটাতেও তারা তাদের ইচ্ছেটাই ওর উপরে চাপিয়ে দিল। কেন! মেয়ে বলে? আয়ানকে তো ওরও পছন্দ হয়েছে। ভিষণ ভিষণ পছন্দ হয়েছে। কিন্তু উল্টোটাও তো হতে পারতো! তখন!
কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই মায়রার চোখে পানি এসে যাচ্ছিলো। কোনমতো চোখ বুজে চোখের পানি চোখের ভিতরে চালান করে দিয়ে মুখ তুলতেই আয়ানের সাথে চোখাচোখি হলো। আয়ান ইশারায় জিজ্ঞেস করছে কোন সমস্যা কিনা। মায়রা আলতো করে ইশারায় না জানিয়ে মুচকি হাসলো। আয়ানের পরিবার ওকে কতটা ভালোবেসে গ্রহণ করছে সেটা মায়রা দেখেই টের পাচ্ছে। পিচ্চি মেয়েটাও পর্যন্ত ওকে পেয়ে এতো খুশি যে মনে হচ্ছে দামি কিছু পেয়েছে। আর উনার বাবা মায়ের কথা কি বলবে! কেন জানি মায়রার মনে হচ্ছে এই দুটো মানুষও খুশি। তাদের চোখে মুখে অন্যরকম খুশি খেলা করছে। আর? এই ভদ্রলোকটির খুশির কথা কি আর আলাদা করে বলে বোঝাতে হবে! সবার সামনে বসেও একটু পর পর মায়রাকে দেখছে। তিথির কনুইয়ের গুঁতো খেয়ে একটু অন্যদিকে তাকাচ্ছে। তারপর আবার সেই অপলক চাহনি। কি এতো দেখছে এই লোকটা কে জানে! এতো দেখার কি আছে বাপু! তাও সবার সামনে!
-মায়রা মা? সবাইকে সালাম করো?
মায়রা আর আয়ান উঠে এসে একে একে সবাইকে সালাম করলো৷ সবাই অনেক দোয়া করলেন ওদের দুজনকেই। একটু মিষ্টি মুখ করা শেষ হলে সবাই মিলে খেতে বসলো। তিথি, তিয়াশ, আয়ান সবাই এটা ওটা নিয়ে কথা বলছে। বড়রাও হালকা গলায় কথা বলতে বলতে খাওয়া শেষ করলো। মায়রাই কোন রকমে খেয়ে উঠলো। মুখ তুললেই কেন জানি বারবার আয়ানের সাথেই চোখাচোখি হচ্ছে। ব্যাপারটায় মায়রার লজ্জা লাগছে প্রচন্ড। কিন্তু মানুষটর চাহনিতে কিছু একটা আছে। কি সেটা!
খাওয়া শেষ করে বড়রা বসে কথা বলছে এটা ওটা নিয়ে। এর মধ্যে তিথি মায়রার হাত ধরে উঠে গেল।
-আমি বাপু এতো বড়দের আড্ডায় নেই--। আমি পিচ্চি মানুষ৷ তাই আমি আমার ভাইয়া ভাবির সাথেই যাই---। কারো কোন আপত্তি আছে?
-আরে নাহ নাহ--। যাও মা তোমরা--।
-এই যে ভাবির ভাই? জনাব বেয়াই সাহেব? আপনি কি আসবেন?
-না না--। আপনারাই যান---।
-আপনি একটা পানসা পাবলিক--। হুহ--। এই তোমরা আসো না কেন?
তিথি মায়রার সাথে রুমে এলো। আয়ান দরজায় দাঁড়িয়ে থেকে কি করবে ভেবে না পেয়ে নিজেও রুমে ঢুকে দাঁড়ালো দেয়ালে হেলান দিয়ে। ছোট্ট একটা রুম মায়রার। একটা খাট আর পাশেই আলমারি। একপাশে পড়ার টেবিল আর জানলার পাশে ছোট্ট একটা বুকশেলফ। ছোট হলেও রুমটা বেশ গোছানো। মায়রা খাটের এক কোণে মাথা নিচু করে বসে আছে। রুমটায় যে দুজন মানুষ এসেছে তারা কদিন পরে ওর জীবনের বিশেষ অংশ হয়ে উঠবে। কিন্তু এই মানুষগুলোকে বসতে দেয়ার মতো জায়গাও যে ওর ছোট রুমটাতে নেই।
-এই ভাইয়া শোন?
-হুম?
তিথি আয়ানের হাত ধরে দরজার কাছে আনলো। ব্যাগ থেকে বের একটা র্যাপিং করা বক্স ধরিয়ে দিলো।
-এটা কি?
-নতুন মোবাইল---।
-কেন?
-আরে! উফফফ--। আপুর কাছে তো ফোন নেই রে বাবা--। তুই আপুর সাথে কথা বলবি না? বিয়ে তো আর কালই হয়ে যাবে না--। মিনিমাম এক মাস পরে বিয়ে--। হুহ।
-ওহ শিট! কি বলিস!
-হুম--।
-বাট--। আমি মোবাইলটা দিলে কেমন দেখায় না? তুই দিস--?
-আচ্ছা ঠিক আছে--। শোন আমি বাইরে দাঁড়িয়ে হিসাব করছি তুই আমাকে কয়টা ট্রিট দিবি- আর কয়টা ড্রেস গিফ্ট করবি তোর বিয়েতে--। তুই ততক্ষণে ভাবির সাথে কথা বলে নে---।
-ওক্কে মেরি মা---।
আয়ান রুমে এসে দরজাটা হালকা করে চাপিয়ে দিয়ে এসে মায়রার পাশে এসে খাটে আয়েশ করে বসলো। মায়রা একবার ওর দিকে তাকিয়েই আবার মুখ নিচু করে নিলো।
-তিথি কোথায়?
-ও একটু হিসেব করছে--। শুনুন ম্যাডাম আর ফর্মালিটি দেখাতে পারছি না--। তুমি করেই বলছি। ওকে?
-জি--। সমস্যা নেই--।
-তার আগে একটা কথা জিজ্ঞেস করে নিই। কেউ তো জিজ্ঞেস করলো না৷ বাট আমি আপনার মুখ থেকে শুনতে চাই---। একটু বলবেন প্লিজ?
-জি বলুন?
-আমাকে কি পছন্দ হয়েছে? বিয়ে করবেন?
মায়রা একটু চুপ করে গেল। যে প্রশ্নটা ওর পরিবার ওর কাছে জানতে চায় নি। সেই প্রশ্নের উত্তরে এই মানুষটাকে কি বলবে ও?
-হ্যালো? মিস লাজুক পরী? কোথায় হারিয়ে গেলেন? দেখুন বিয়ে না করলে কিন্তু আগেভাগে বলে দিন---।
-কেন? মানা করলে বুঝি নতুন কাউকে খুঁজে নিবেন?
-আরে পাগল নাকি? না করলে এখন যাওয়ার সময় তুলে নিয়ে যাবো। সোজা বিয়ে--। এক মাস সময় নষ্ট করার প্রশ্নই আসে না--।
-এটা কেমন কথা? আর বাবা মা যেখানে বিয়ে দিবে সেটাই মেনে নিবো --।
-যদি কাল আপনার বাবা মা আমার সাথে বিয়ে দিতে না চায়? তখন? যাকে বলবে তাকে বিয়ে করবেন তখন?
-সেরকম হলে তো আপনি আছেন। তাই না? উঠিয়ে নিয়ে বিয়ে করে ফেলবেন---।
-হা হা---। ভালো বলেছ মিস লাজুক পরী--। একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
-হুম----।
-মন খারাপ কেন পরীটার? সেই কখন থেকে দেখছি চোখের কোণটা চিকচিক করছে--। মনে হচ্ছে এক্ষুণি কেঁদে ফেলবে--। বিয়েতে মত নেই? নাকি পছন্দ হয়নি বর?
-না না--। আসলে--। তেমন না ব্যাপারটা---।
-তাহলে কেমন? বলতে পারো আমাকে--। সমস্যা নেই--।
-না মানে---। আসলে!
-আমার সামনে বলতে সমস্যা হচ্ছে? উমমম--। ওকে--। রাতে বলো। কেমন?
-রাতে কি করে বলবো!
-আমি ভূত হয়ে আসবো রাতে--। তখন বলবা আর কি--।
-কি?
-হা হা--। ভয় পেলে? কল করবো-। রাতে কথা হবে-। এখন কথা বলা যাচ্ছে না ঠিক করে---।
-কিন্তু আমি তো মোবাইল ইউজ করি না---।
-সেটার চিন্তা করতে হবে না ম্যাডাম-। আপনার ননদিনী সুপার ফাস্ট মেয়ে--। ব্যবস্থা হয়ে গেছে সব---।
-ওহ----।
-এই যে ম্যাডাম? বই পড়তে বুঝি খুব ভালোবাসো?
-হুম---। মন খারাপ হলেই বই পড়ি--। আপনি পড়েন?
-উহু--। সময় হয় না--। তবে তোমার মন খারাপ করতে হবে না--। তোমার পড়ার ব্যবস্থা করে দিবো--। ওকে?
-সত্যি!
-জি ম্যাডাম সত্যি----।
বেশ অনেকক্ষণ গল্প করার পর তিথির ডাকে ওরা আবার ড্রইং রুমে এলো। আয়ানরা এখন বের হবে৷ মায়রা এক কোণে দাঁড়িয়েছিল। আরেকবার সবাইকে এসে সালাম করলো। আয়ানের মা আর বাবা মায়রাকে অনেক আদর করে দিয়ে দোয়া করলেন। আয়ানের মা তো একেবারে মায়রাকে বুকে জড়িয়ে ধরলো।
-দেখেন ভাবি--। আমি আমার মেয়েকে কিন্তু আর এক মাসের জন্য রেখে যাচ্ছি--। এক মাস পরে কিন্তু মেয়েকে নিয়ে যাব---।
সবার কথার ফাঁকে তিথি এসে মায়রাকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর হাতে মোবাইলের র্যাপিং করা বক্সটা ধরিয়ে দিলো।
-এই মোবাইলটা আমার সোনা ভাবিটার জন্য--। যাতে আমি প্রতিদিন ভাবির সাথে কথা বলতে পারি--৷ আর ভাবি আর আমি ডেইলি একসাথে কলেজে যাবো কাল থেকে---। কি মজা! কেউ রাগ করলেও শুনবো না আমি কিন্তু----।
তিথির কথায় সবাই হেসে ফেললো। আয়ানও সবার থেকে বিদায় নিয়ে এক নজর মায়রার দিকে তাকিয়ে বেরিয়ে এলো। সবাই চলে গেলে মায়রা নিজের রুমে এসে দরজাটা বন্ধ করে ছোট্ট খাটটাতে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লো। এতোক্ষণ যা ঘটলো তা কি স্বপ্ন নাকি সত্যি! বাস্তব নাকি কল্পনা! কল্পনা হলেও আপত্তি নেই মায়রার। এই সুখের কল্পনার রেশ ধরেই হয়তো সুখে মরে যেতে পারবে মেয়েটা। আর বাস্তব হলে তো কথাই নেই।