নিভৃতে যতনে - পর্ব ২০ - আসফিয়া ইসলাম জান্নাত - ধারাবাহিক গল্প


৩৯!! 

ফাল্গুনের মাতাল হাওয়ায় মাতোয়ারা পরিবেশ। সিঁদুর রাঙ্গা পলাশগাছের কার্নিশের বসে হাওয়ায় সুর তুলছে কোকিলের দল। শৈত্যপ্রবাহের দাপট কমে এসেছে খানিকটা। হাওয়ায় ছড়িয়েছে ফুলের মাদকতা। বন্ধুমহলের সাথে টিএসসির মোড়ে বসে হাতে এক কাপ চা নিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে আছি। সকলের আড্ডার মাঝে থেকেও যেন আমি নেই৷ কেন না, আমার মন যে পড়ে আছে কাঙ্ক্ষিত মানুষটির তীরে। আজ পাঁচদিন হতে চললো মানুষটার সাথে আমার খাপছাড়া ভাব। দরকারবিহীন কথা হয়না একটিও। আমি কথা বলি না রাগ-অভিমানে কিন্তু সে কেন বলে না তা আমার জানা নেই। বেশিরভাগই এখন দেখা যায় তাকে আপন ভাবনায় বিভোর থাকতে। সর্বদাই কপালে পড়ে থাকে সুক্ষ্ম ভাঁজ। মাঝে মধ্যে পরিলক্ষিত হয় তাঁর হাতের ভাঁজে এক অনাকাঙ্ক্ষিত জিনিস। তিনি যে কোন পীড়াপীড়িতে আছেন তা আমার নিকট স্পষ্ট। এই নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিও বহুত বার কিন্তু মানুষটা যে বলতে অনিচ্ছুক। মানুষটার বুক ফাঁটবে কিন্তু মুখ ফুটবে না। তাই আমিও এখন হাল ছেড়ে দিয়েছি। নিরব হয়ে গেছি তাঁর মতই। নিভৃতেই অভিমানের পাল্লা ভারি করছি ক্ষণে ক্ষণে। হঠাৎ আদিবের ডাকে আমার ধ্যান ভেঙ্গে যায়। গোলগাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে ওর দিকে। 

-- কি রে সিয়া? কার ভাবনায় এতটা মশগুল যে আমাদের ডাক তোর কানেই যাচ্ছে না?

আমি স্মিত হেসে বলি,

-- আরেহ তেমন কিছু না। 

সুরাইয়া পিঞ্চ করে বলে,

-- তো কেমন কিছু শুনি?

স্নেহা হেসে বলি,

-- আরেহ বুঝিস না কেন। জামাই কিছু। 

আমি মুখ শক্ত করে বলি,

-- লেগপুল করা হয়েছে তোদের? 

ইফতি ভ্রু কুঁচকে বলে,

-- আরেহ রাগছিস কেন? মজা করছে তো ওরা। 

আমি কিছু বলতে যাব তার আগেই পাশ থেকে নূর বলে উঠে,

-- হয়ে থাম। এই বিষয়ে নিয়ে পরে কথা বলিস এখন উঠ তোরা। ক্লাসের জন্য দেরি হয়ে যাচ্ছে তো। চল জলদি! 

নূরের কথায় সকলেই একবার সময়ের দিকে দৃষ্টি বুলিয়ে নিল। আসলেই সময় পেরিয়ে যাচ্ছে বিধায় সকলে বিনাবাক্যে উঠে পড়লো আড্ডা থেকে। ওরা হয়তো কিছু বলতে যাচ্ছি কিন্তু আমি তার আগেই রওনা দিলাম ক্লাসের উদ্দেশ্যে। ভালো লাগছে না আর এইখানে থাকতে। অসহ্য লাগছে সবকিছুই। 
______________________

পড়ার টেবিলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এসাইনমেন্টের কাগজপত্র। সামনেই মোটা তাজা একটা বই হা করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে । কাগজের ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে পেন্সিল, রাবার ও রঙিন কলম। আমি চেয়ারে বসে কলম কামড়াচ্ছি আর একটা কাগজে চোখ বুলাচ্ছি। মাঝে মধ্যে আড়চোখে রোয়েনকেও পর্যবেক্ষণ করছি। কোলে ল্যাপটপ নিয়ে কি যেন করছেন আর বার বার বিরক্তিতে 'চ' শব্দ উচ্চারণ করার মত শব্দ করে উঠছেন। কপালে পড়েছে সুক্ষ্ম ভাঁজ। ভাঁজটা চিন্তার নাকি বিরক্তির বলা দুষ্কর। মাঝে মধ্যে বা হাতের তর্জনী দিয়ে কপাল চাপছেন।  মুখে গম্ভীরতা বিরাজমান। তাকে জিজ্ঞেস করতে বড্ড ইচ্ছে করছে, 'কি হয়েছে আপনার? আপনি ঠিক আছেন তো?' কিন্তু অভিমান নামক বস্তুটি পুরো হৃদয় জুড়ে বসে থাকার কারণে কিছু বল হয়ে উঠলো না আর। সব দেখেও নিরব থেকে গেলাম আমি। মনোযোগ দিলাম নিজের কাজে। হঠাৎ তাঁর ফোন বেজে উঠতে আমি সচকিত দৃষ্টিতে রোয়েনের দিকে তাকাই৷ রোয়েন ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠা নাম্বারটা দেখমাত্র কোল থেকে ল্যাপটপটা নামিয়ে দ্রুত পায়ে চলে যান বারান্দায়। মূহুর্তেই আমার ভ্রু কুটি কুঞ্চিত হয়ে আসে। এই নিয়ে চতুর্থবার তিনি ফোন আসামাত্র উঠে বারান্দায় চলে গিয়েছেন। হয়তো তিনি আমার সামনে কথা বলতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন না অথবা হয়তো তিনি চাইছেন না আমি তাঁর কথপোকথন শুনি। ক্ষণেই বুক চিরে বেরিয়ে আসে দীর্ঘ নিঃশ্বাস। আমি চুপচাপ উঠে বইটা বন্ধ করে, কাগজগুলো গুছিয়ে নিতে থাকি। আমার থাকাতে হয়তো তাঁর কথা বলাতে ব্যাঘাত ঘটছে, তো কি দরকার এইখানে থাকার? আমি সবকিছু গোছাচ্ছি এমন সময় রোয়েনের নিস্তেজ কন্ঠ কর্ণধারে এসে বারি খায়। 

-- এমন তো নয় আমি হাত গুটিয়ে বসে আছি। আমি তো আপ্রাণ চেষ্টা করছি সবদিকে সামাল দেওয়ার। 

এরপর নীরবতা। না চাইতেও কৌতূহলবসত আমি বারান্দার দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াই। পুনরায় শোনা গেলো তাঁর কন্ঠ। তিনি বলছেন,

-- সকলের সাথেই আমি কথা বলেছি। কেউ রাজি হচ্ছে না। 

এরপর কিছুক্ষণ নিরবতা। অতঃপর তিনি আবার বলে উঠেন,

-- যা হওয়ার তাই হবে, এখন আমার করার আর কিছুই নেই। রাখছি। 

কথাটা বলে তিনি ক্ষোভে রেলিং-এর গায়ে একটা বারি দেন। চাপা কন্ঠে বলে উঠেন, 'ড্যাম'। আমি নীরবে দরজার কাছ থেকে সরে এসে দাঁড়াই। চুপচাপ চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে থাকি। ভাবতে শুরু করি তাকে নিয়ে,রোয়েন তো শান্ত মেজাজের মানুষ। কখনো কোন তুচ্ছ বিষয় নিয়ে রেগে যান না তিনি। কারো উপর নিজের রাগ প্রকাশও করেন না। এতটুকু তো চিনেছি আমি তাঁকে। কিন্তু এইবার তিনি তাঁর স্বভাবের একদম বিপরীত আচরণ করছেন। এমন তো হওয়ার কথা না। তাহলে কি এর পিছনের কারণটা বৃহৎ? যার ফলে তিনি এতটা উগ্র আচরণ করছেন? এতদিন বিষয়টা ধরতে না পারলেও আজ পারছি। যার দরুন রোয়েন রুমে আসা মাত্র আমি সকল অভিমান দূরে ঠেলে দিয়ে তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়াই। নির্লিপ্ত দৃষ্টি তাঁর দিকে নিক্ষেপ করে জিজ্ঞেস করি,

-- কি হয়েছে আপনার? কোন সমস্যা?

রোয়েন আমার পানে কিছুক্ষণ নীরব দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে আমার পাশ কাটিয়ে চলে যেতে যেতে বলেন,

-- কিছু হয়নি। 

রোয়েন বিছানায় গিয়ে বসতেই আমি পুনরায় তার সামনে গিয়ে দাঁড়াই। বিচলিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করি,

-- বলুন না কি হয়েছে আপনার? কয়েকদিন ধরে দেখছি আপনায়, কেমন উগ্র আচরণ করছেন। ঠিক মত খাচ্ছেন না,ঘুমাচ্ছেন না। সারাক্ষণ কোন এক চিন্তায় মগ্ন হয়ে আছেন। বলুন না কি হয়েছে আপনার? 

তিনি এইবার রুদ্ধ কন্ঠে বলে উঠেন,

-- বললাম তো কিছু হয়নি আমার। আর আমার বিষয়ে নাক গোলাতে হবে না তোমায়। যাও নিজের কাজ করো তুমি। 

-- তাই করছি। আপনি আজ যত যাই বলুন না কেন আমি আপনার সমস্যা না জানা পর্যন্ত হাল ছাড়ছি না। আজ আপনায় বলতেই হবে হয়েছেটা কি? এতটা চিন্তিত কেন আপনি? 

আমার কন্ঠের তেজ শুনে রোয়েন নীরব বনে যান। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন আমার মুখ পানে। আমি তাঁর চোখে চোখ রাখতেই বুঝতে পারি  তাঁর চাহনি আজ বড্ড অগোছালো। কিছু তো একটা তিনি বলতে চাচ্ছেন আমায় কিন্তু পারছেন না। হয়তো আড়ষ্টতা কাজ করছে। আমি এইবার নরম সুরে বলি,

-- আপনাকে বুঝার দায়িত্ব আমার ঠিকই কিন্তু আপনি খুলে সব না বললে বুঝবো কিভাবে বলুন? আপনার সুখের ভাগিদার যেমন আমি তেমনই আপনার কষ্টের ভাগিদারও হতে চাই আমি। যদি নিজের বরের কষ্টের ভাগই বসাতে না পারি তাহলে কেমন স্ত্রী আমি বলুন তো? 

রোয়েন কিছু না বলে তপ্ত নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। হাঁসফাঁস করতে থাকে কিছুক্ষণ। বুঝাই যাচ্ছে তিনি চেয়েও বলতে পারছেন না। হয়তো তিনি ইন্ট্রোভার্ট বলেই তাঁর সমস্যা গুলো প্রকাশ করতে এতটা আড়ষ্টতা কাজ করে। আমি তাঁর দিকে আরেকটু এগিয়ে গিয়ে বলি,

-- প্লিজ বলুন না কি হয়েছে? এমন কি হয়েছে যার দরুণ বাজে অভ্যাসগুলো আয়ত্ত করে নিয়েছে? আমাকে দূরে সরিয়ে রাখছেন? বলুন না। 

রোয়েন মুখ ঘুরিয়ে বলেন,

-- তোমাকে কোন রকম টেনশনে ফেলতে চাই না আমি। 

আমি শ্লেষের হাসি হেসে বলি,

-- তা এখন বুঝি আমি টেনশনে নেই? জানেন আপনার এই উগ্র ব্যবহার কতটা পোড়াচ্ছে আমায়? দূরত্ব সৃষ্টি করছেন আপনি আমাদের মাঝে। বুঝতে পারছেন বিষয়টা? কথাগুলো অন্তরে চাপিয়ে না রেখে আমার নিকট প্রকাশ করে দিন। দেখবেন নিজেকে বড্ড হালকা লাগছে। 

রোয়েন কিছু না বলে হুট করে আমার কোমর জড়িয়ে ধরে। আমি ক্ষনিকের জন্য ভড়কে গেলেও নিজেকে সামলে নেই। ধীর গতিতে তাঁর চুলের মাঝে হাত গলিয়ে দেই। শীতল কন্ঠে জিজ্ঞেস করি,

-- আমার কাছে এতটা ইন্ট্রোভার্ট হলে চলে? আমি কি পর নাকি? আপনার আপন মানুষই তো আমি। আপনি নিরদ্বিধায় বলতে পারেন আমায় সব। 

রোয়েন কিছুটা প্রহর চুপ থেকে বলেন,

-- কখনো যদি শুনো,আমার চাকরি নেই আমি তোমার ভরণপোষন করতে হিমশিম খাচ্ছি। সেই শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমার পাশে থাকতে পারবে তো? করতে পারবে তো আমায় ভরসা? থাকতে পারবে আমার পাশে?

আমি বিস্মিত সুরে বলি,

-- আপনার চাকরির সাথে আমার থাকার বা না থাকার কি সম্পর্ক? বিয়ে তো আমি আপনাকে করেছি, আপনার চাকরিকে নয়। 

রোয়েন মাথা তুলে আমার দিকে নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন,

-- বাস্তবতা কিন্তু তোমার কথাগুলোর মত এত সহজ না। অনেক কঠিন বুঝলে। তোমাকে ভালো রাখা দায়িত্ব আমার। কিন্তু যখন দেখবে আমি তোমায় ভালো রাখতে পারছি না, কষ্টের জীবনযাপন করতে হচ্ছে তোমায় তখন আর তোমার আমার সাথে থাকতে ইচ্ছে করবে না। এখনকার কথাগুলো তখন লাগবে নিছক হাস্যকর। কষ্ট এমন এক জিনিস যা কেউ চায় না, সবাই এই ধরণীর বুকে সুখী থাকতে চায়।

আমি ছোট ছোট চোখ করে বলি,

-- সুখ কষ্ট মিলিয়ে তো জীবন নাকি? ভালো সময় আসলে, খারাপ সময়ও আসবে। এইটাই নিয়ম। এখন সেই সময় কে কতটা শান্ত আর শক্ত থাকে এইটাই দেখার বিষয়। 

-- এখন এইগুলো বলছো কারণ এখনো  বাস্তবতার মুখোমুখি হও নি কিন্তু যখন হবে তখন বুঝবে। 

আমি রোয়েনের কাছে হাটু মুড়ে বসে তাঁর হাত দুটি আমার হাতের মাঝে নিয়ে শীতল কন্ঠে বলি,

-- এমন আধা-উধা কথা না বলে কি পুরো কথা বলা যায় না আমায়? পুরো ঘটনাটা খুলে বলুন না আমায়। 

রোয়েন দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে বলেন,

-- এক সপ্তাহ আগে ফ্যাক্টরিতে কিভাবে যেন আগুন লেগে যায়। এতে প্রায় কয়েক'শ হাজার কোটি টাকার পণ্য আগুনে বিনষ্ট হয়ে যায়। বেশিরভাগ সকল মেশিনও নষ্ট হয়ে যায়। বেশ আগেই কোম্পানির শেয়ারগুলো নেমে এসেছিল। যার দরুন আমাদের সকলের দুই মাসের বেতন আটকে ছিল। কোম্পানির সুনাম ফিরে পেতেই নতুন এক প্রজেক্টের কাজ চলছিল। যার জন্য অনেক টাকার ঋণ নেওয়া হয়েছিল। প্রজেক্টটা কমপ্লিট হলেই কোম্পানির নিজের অবস্থান ফিরে পেত। কিন্তু ফ্যাক্টরিতে আগুন লেগে যাওয়ায় এখন কোম্পানি পুরো লসে ডুবে গিয়েছে। সেই সাথে কোম্পানির করুন অবস্থা দেখে শেয়ারহোন্ডাররাও হাত গুটিয়ে নিয়েছে। কোম্পানি এখন দেউলিয়া প্রায়। যখন তখন কোম্পানি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। আর যদি কোম্পানি বন্ধ হয়ে যায় তাহলে.....

কথাটার ইতি টানার আগেই রোয়েন দীর্ঘ নিশ্বাস নেন। আমি চোখ ছোট ছোট করে বলি,

-- আপনার কি মনে হয়? আপনার জব না থাকলে আমি আপনাকে ছেড়ে চলে যাব? এত তুচ্ছ আপনি? আর আমি যেতে চাইলেই আপনি যেতে দিবেন? এই আপনার অধিকারবোধ? 

রোয়েন আমার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন,

-- মানুষ সব জায়গায় ধরা না খেলেও পরিস্থিতির নিকট একটা না একটা সময় ধরা খেয়েই যায়। আর সেটাই হয় তাঁর জীবনের সবচেয়ে কঠিনতম সময়। 

-- আপনার হাত এই জন্য ধরেনি যে বিপদ বা পরিস্থিতির মুঠোয় পড়ে তা ছেড়ে দিব। যে মানুষটা আমার জীবনের অধিকাংশ জুড়ে তাকে কি এইভাবেই ছুড়ে ফেলা যায়? বলুন? যত যাই হোক, আপনাকে মৃত্যুর আগপর্যন্ত ছাড়ছি না আমি। 

রোয়েন স্মিত হেসে বলেন,

-- বুঝে শুনে বলছো তো নাকি আবেগের বসে বলে যাচ্ছ? যখন আমি পারবো না তোমার আবদার পূরণ করতে, তোমার পড়াশোনার খরচ বহন করতে, তোমায় ভালো পোশাক-আশাক,খাবার দিতে খাওয়াতে, কাজের মানুষ রাখতে,সুনিশ্চিত জীবন দিতে তখনও কি বলতে পারবে এই কথা গুলো?

--  হ্যাঁ পারবো। আর দুমুঠো ভাত হলেই হবে আমার। বাদ বাকি আমি গুছিয়ে নিব। আর ভুলে যাবেন না হোস্টেলেই বড় হয়েছি আমি। পরিবার থেকে দূরে একা একা থেকেছি আমি। সেই ছোট বয়স থেকে নিজের কাজ নিজেই করতে জানি আমি। কষ্ট কি তাও ভালো করেই আমি জানি। তাই এইসব নিয়ে ভাববেন না। 

রোয়েন কিছু না বলে আমার পানে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। আমি তাঁর পানে তাকিয়ে থেকে মনে মনে বলি,

-- যে হাতটি আমায় আমার কঠিন সময়ে আগলে রেখেছিল সেই হাতটি আমি কিভাবে ছাড়ি বলুন? আপনাকে ছাড়া আমার পক্ষে সম্ভব না। একদমই না! 

কথাটা ভেবেই তপ্ত নিঃশ্বাস ত্যাগ করলাম আমি। হঠাৎ উঠে রোয়েনের কপালে ভালোবাসার ছোট পরশ এঁকে দিয়ে মিষ্টি হাসি দিয়ে বলি,

-- চিন্তা করবেন না সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি আছি আপনার পাশে। 

৪০!! 

কথায় আছে, 'বিপদ যখন ঘরে আসে ভালোবাসা তখন জানাল দিয়ে পালায়।' কথাটা শতভাগ সত্য নাহলেও, মিথ্যেও নয়। আমাদের চারপাশে এমন অনেক দাম্পত্য আছে যারা বিপদের সময় একে অপরের পাশে দাঁড়াতে পারে না। হতে পারে না সুখ-দুঃখের সঙ্গী। বরং টাকার মোহে জড়িয়ে বিলাসিতার পিছেই ছুটে যায় অনেকেই। যার দরুন সুখ নামক পাখিকে ধরতে গিয়েই হ্রাস হয়ে যায় অজস্র সম্পর্কের স্থায়ীত্ব। অথচ মানুষ বেমালুম ভুলেই যায় যে, সুখ হচ্ছে মরীচিকা। একে যেই ধরতে যাবে সেই মুখের উপর থুবড়ে পড়বে। আর এইটাই বাস্তবতা। তাই 'চাই! চাই!'-- না করে যা আছে তাতেই সন্তুষ্ট থাকা শ্রেয়। এতে অল্পেই প্রকৃতি সুখের দেখা মিলে। 

রোয়েনের কোম্পানি বন্ধ হয়ে গিয়েছে আজ প্রায় দুই মাস হতে চললো। তথাকথিত সমাজের নজরে এখন তিনি বেকার। আর তাঁর এই বেকারত্ব জীবনে একান্ত সঙ্গী আমি। এই দুই মাসে অনেক কিছুই বদলেছে। বদলেছে আমাদের জীবনের গতানুগতিক ধারা। খানিকটা  ভিন্নতা এসেছে সম্পর্কে, সেই সাথে এসেছে ম্যাচুরিটি। প্রগাঢ় হয়েছে একে অপরের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস। হাতের বাঁধন মজবুত হয়েছে শতগুণ। 
কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার কারণে রোয়েন তাঁর ন্যায্য বেতন পাননি। তার মোট চার মাসের দিনমজুর পাওনা হলেও পেয়েছিলেন দুইমাসের। অবশ্য সকলে মিলে নিজের ন্যায্য দাবী করেছিল ঠিকই কিন্তু কাজ হয় নি। আপাতত রোয়েনের সেভিং আর বেতন দিয়ে চলছে আমাদের সংসার। বেশ হিসেব করেই চলছি আমরা দুইজন। অহেতুক খরচ প্রায় কমিয়ে দিয়েছি। পলি আন্টিকেও না করে দিয়েছি আমি। কেন না মাস শেষে তাকে মোটা অংকেরই বেতন দিতে হয় যা আপাতত দেওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। প্রথমে অবশ্য তিনি যেতে চাননি, এতবছর ধরে কাজ করার দরুন মায়া জন্মে গিয়েছে আমাদের প্রতি। সেই মায়ার টানেই থেকে যেতে চেয়েছিলেন। তাকে আমি আমাদের অবস্থা বুঝিয়ে-টুঝিয়ে বিদায় করেছি আর আস্থাও দিয়েছি, পরিস্থিতি ঠিক হলে তাকে আবার নিয়োগ করবো আমরা। পলি আন্টি যাওয়ার পর ঘরের সকল কাজ রোয়েন আর আমি মিলে ভাগাভাগি নেই। 
 ফ্ল্যাটটা ছিল ব্যাংক লোনে নেওয়া। এতদিন তিনি কিস্তিতে পরিশোধ করছিলেন ঋণটা। কিস্তি প্রায় শেষের দিকে বলে রোয়েন ব্যাংকের সাথে বোঝাপড়া করে সময় নিয়ে নেন। মূলত গ্যাস,পানি,বিদ্যুৎ বিল আর খাওয়া-দাওয়া, যাতায়াতের খরচই টানতে হচ্ছে আমাদের। সেই সাথে মাস শেষে বাবা-মার জন্যও নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা তো আছেই। মাঝে মধ্যে হিসাবে গড়মিল হলেও সামলে নেই দুইজনে মিলেই। 
কিন্তু এইসবের মাঝেও রোয়েন নিজের বেকারত্বের কথা জানাননি কাউকে। এমনকি বাবা-মাকেও না। তার ভাষ্যমতে, বর্তমান পরিস্থিতির কথা জানার পর সকলেই করুণা করতে চাইবে। অহেতুক সান্ত্বনা ছুড়ে মারবে যখন তখন। হয়তো কেউ অনুগ্রহ করে টাকা দিয়ে সাহায্য করতে চাইবে। যা রোয়েনের একদমই সহ্য হয়-না। তিনি না খেয়ে মরবেন তাও কারো নিকট করুণার পাত্র হতে রাজি নন। অবশ্য মানুষটা বেশ আত্মসমপর্ণ। কারো নিকট সে সাহায্য নিতে বা অনুগ্রহের পাত্র হতে রাজি নন। এমনকি টাকা নিতেও তার আত্মসম্মানে লাগে। তখন না বুঝলেও এখন বুঝি এই স্বভাবের দোষেই তিনি বিয়ের পর আমার বাড়িতে গিয়ে ওসমান সাহেবের থেকে টাকা নেননি। রোয়েনের এই আত্মসম্মানই তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধ আরও বারিয়ে দেয়। 

 তিক্ত হলেও সত্য এইটাই,  'টাকা ছাড়া দুনিয়া চলে না।' এই ভূপৃষ্ঠে বাঁচতে হলে টাকা আবশ্যক। 

একমাস হতে চললো বিল্ডিংয়ের মধ্যেই দুটো টিউশনি নিয়েছি। সেই যে ছাদে একবার মুসকানের সাথে কথা হলো এরপরই ওর আর ওর আম্মুর সাথে ভালো সখ্যতা গড়ে উঠেছিল আমার। যার দরুন আমি টিউশনি খুঁজছি তা জানামাত্র মুসকানের আম্মু মানে জাবিন আন্টি মুসকান ও তার বড় ছেলেকে পড়ানোর দায়িত্ব আমায় দিয়ে দিলেন। আমার টিউশনি করানো নিয়ে উনার কোন আপত্তি না থাকায় আমিও সাচ্ছন্দ্যে দুইজনকে পড়ানোর দায়িত্ব নিয়ে নিলাম। আজই সেখান থেকে প্রথম স্যালারি পেলাম। জীবনে প্রথম আয় আমার। হোক স্বল্প কিন্তু তাও আমার জন্য এইটা অনেক। এই মূহুর্তে আমি কেমন বোধ করছি তা ভাষায় প্রকাশ্য নয়। শুধু এতটুকু জানি আমার জীবনের উপার্যিত প্রথম আয় আমি রোয়েনের হাতে তুলে দিতে চাইছি। আমি পড়ানো শেষ করে দ্রুত বাসায় চলে আসি। চঞ্চল ভঙ্গিতে চাপতে থাকি ডোরবেলের সুইচ। কিছু প্রহর অতিবাহিত হতেই রোয়েন এসে দরজা খুলে দেন। আমি হাসি মুখে ভিতরে প্রবেশ করি। ড্রয়িংরুমে আসতেই দাঁড়িয়ে পড়ি আমি। মিষ্টি হাসি হেসে রোয়েনকে উদ্দেশ্য করে বলি,

-- একটু এইদিকে আসুন তো। 

রোয়েন বিনাবাক্যেই আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। নির্লিপ্ত কন্ঠে বলেন,

-- কি?

আমি ব্যাগ থেকে টাকা বের করে রোয়েনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলি,

-- আমার প্রথম আয়। আমি চাইছি টাকাটা সর্বপ্রথম আপনাকে দিতে। 

রোয়েন ভ্রু কুটি কুঞ্চিত করে বলেন,

-- আমি টাকা দিয়ে কি করবো?

-- আপনার কাছে রাখবেন। 

রোয়েন মুখ ঘুচে বলেন,

-- প্রথম আয় তোমার। এইটা নিজের কাছে রাখ আর নিজের মত ইনভেস্ট করো। আমার কাছে রাখতে হবে না। 

আমি রোয়েনের হাত টেনে তাঁর হাতে টাকাটা গুঁজে প্রসস্থ হাসি হেসে বলি,

-- আমার একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাংক হচ্ছেন আপনি। যার নিকট কি-না আমি পুঁজি জমা রাখাবো আর সেটা ইনভেস্ট করে মুনাফা দেওয়ার দায়িত্ব হবে আপনার। বুঝলেন! 

রোয়েন কিছু না বলে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ঠোঁটের কিনারে স্মিত হাসি ঝুলিয়ে বলেন,

-- সবকিছুতে আমাকে না জড়ালে হয়না?

--  আপনি না বলেছিলেন আপনারই অংশবিশেষ আমি। তাহলে আপনাকে জড়ালাম কিভাবে বলুন? আমি আর আপনি তো একই সত্ত্বার দুইটি বাস। 

রোয়েন হালকা হেসে আমার কপালে ভালোবাসার এক পরশ একে দিতেই লজ্জায় মিইয়ে যাই। নিজের লজ্জা রাঙ্গা চেহারা লুকাতে মুহূর্তেই জড়িয়ে ধরি তাকে। মুখ লুকাই তাঁর বুকের কোনে। এতে রোয়েন কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলেও নিজেকে সামলে নেন। এক হাত গলিয়ে দেন আমার পিঠে। হঠাৎ নাকে দগ্ধ পোড়া গন্ধ এসে বারি খেতে চট জলদি সরে দাঁড়াই আমি। ক্রোধিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করি রোয়েনের দিকে।  কাঠ কাঠ গলায় বলে উঠি,

-- আপনি আবার সিগারেট খেয়েছেন? 

আপনার প্রশ্নে যে রোয়েন অপ্রস্তুত বা সংকোচিতবোধ করলেন তা কিন্তু না। উল্টো অকপটে স্বীকারোক্তি করলেন,

-- হ্যাঁ খেয়েছি। 

-- কিন্তু কেন? আপনাকে না মানা করেছি ওইসব ছাইপাঁশ খেতে? তাও এত ত্যাড়ামো কেন করেন?

রোয়েন নির্লিপ্ত কন্ঠে বলে,

-- সবসময় তো আর খাই না। 

-- যখন টেনশনে থাকেন তখনই খান তাই তো? কিন্তু তাও খেয়েছেন তো। একবার এইটার নেশা লেগে কি হবে? 

-- কিছুই হবে না। 

আমি আদেশের সুরে বলি,

-- কিছু হবে কি হবে না সেটা পরের বিষয়। আপনি এইসব খাবেন না, ব্যস। আপনার জন্য এইসব নিষিদ্ধ। 

-- আচ্ছা। 

আমি এইবার কিছুটা নিভে যাই। আলতো স্বরে বলি,

-- এত টেনশন কেন করেন আপনি? কিছু না কিছু একটা হয়েই যাবে। এমন তো নয় হাত গুটিয়ে বসে আছেন আপনি। বিভিন্ন জায়গায় ইন্টারভিউ তো দিচ্ছেই আপনি। একটা না একটা জায়গায় জব হয়েই যাবে। 

-- যতটা সহজ মনে করছো বিষয়টা ততটা সহজ বিষয়টা না। এই চাকরির বাজারে ভালো মানের একটা চাকরি পাওয়া মুখের কথা নয়। যোগ্যতা থাকলেও অনেক সময় টাকার সামনে হার মানতেই হয়। 

কথাটা শুনে আমি চুপটি মেরে দাঁড়িয়ে থাকি। কথাটা সত্য যে এখনকার পলিসিই হচ্ছে, 'টাকা পকেটে তো চাকরি হাতের মুঠোয়।' সাধারণ পদের চাকরিতে জয়েন হতেও এখন বড় অংকের ডোনেশন দিতে হয়। আবার সকল জায়গায় যোগ্যতা অনুযায়ী পদও পাওয়া যায় না। এই জনবহুল দেশে জনসংখ্যার পরিমাণ বৃহৎ হলেও কর্মসংস্থানের পরিমাণ জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ। ক্ষণেই বুক চিরে বেরিয়ে এলো দীর্ঘনিশ্বাস। আমি ব্যথিত চোখে রোয়েনের দিকে তাকাতেই দেখতে পাই তাঁর মলিন চাহনি। মুহূর্তেই বুকটা দুমড়ে-মুষড়ে যায় আমার। এই চাহনির পিছে যে নিজের প্রতি কতটা ক্ষোভ আর ব্যর্থতা লুকিয়ে আছে তা আমার অজানা না। আমি পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার জন্য ঠোঁটের কোনে সরু হাসির রেখা ফুটিয়ে বলি,

-- আমি ফ্রেশ হয়ে আসি তারপর রান্না করে নিচ্ছি। 

-- আমি রান্না করে ফেলেছি। তুমি ফ্রেশ হয়ে আসো আমি খাবার সাজাচ্ছি। 

আমি দীর্ঘ এক হাসি হেসে সম্মতি জানিয়ে চলে যাই ফ্রেশ হতে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন