৩৯!!
পরের কয়েকটা মাস প্রায় নির্ঝঞ্ঝাটেই কেটেছে কিশোর আর তামান্নার। আহমাদ খান যে একেবারেই তামান্নার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেন নি, তেমনটাও না। তিনি তার যথাসম্ভব চেষ্টা চালিয়ে গেছেন তামান্নাকে এটা বোঝাতে যে তিনি এই বৃদ্ধ বয়সে নিজের সমস্ত কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত এবং তার শাস্তির তিনি পাচ্ছেন। আর তাই এখন তামান্নাকে তার অধিকারটুকু বুঝিয়ে দিয়ে শান্তিতে নিজের শেষ নিঃশ্বাসটা ত্যাগ করে নিজের পাপের বোঝাটা হালকা করতে চান। তবে তার এতো আবেগী কাহিনীতেও যখন তামান্নার মন গললো না তখন তিনি অন্য রাস্তার খোঁজ শুরু করলেন। কথায় আছে সোজা আঙ্গুলে ঘি না উঠলে আঙ্গুল বাঁকাতে হয়। তাই আহমাদ খানও আঙ্গুল বাঁকানোরই ব্যবস্থা করবেন ভাবলেন।
এদিকে চৌধুরী ম্যানশনে বেশ কাটছে কিশোর তামান্না আর দীপ্তির সংসার। দীপ্তি ঘুমিয়ে গেলে ওরা রাতের তারা ভরা ছাদে চন্দ্রবিলাস করে। কখনো কিশোর তামান্নাকে চমকে দেয়ার জন্য আরো নতুন নতুন সব ব্যবস্থা করে রাখে। আর তামান্না কিশোরের পাগলামিভরা ভালোবাসায় জীবনটাকে নতুন করে উপলব্ধি করে। কিশোরের পিড়াপিড়িতেই আজকাল দু একদিন পর পর গিয়ে দীপশিখার অফিস সামলাতে হয় তামান্নার। ওর নিজের আশ্রম নিজে না সামলালে চলে! কিশোরও আজকাল দিনের বেশির ভাগ সময়টাই নতুন অফিসের কাজ গোছাতেই ব্যস্ত থাকে। তাই তামান্নাও সেই সময়টা অন্তত নিজের কাজে ব্যস্ত থাকবে।
যাই হোক। গত রাতেও বেশ রাত পর্যন্ত জেগে ওরা দুজনে ছাদে বসে গল্প করেছে। তাই সকালে ঘুম ভাঙতেই কিশোর ঘুমাচ্ছে দেখে তামান্না নিজে ফ্রেশ হয়ে এসে দীপ্তিকে উঠিয়ে ফ্রেশ হতে পাঠিয়ে দিলো। তারপর কিশোরের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে একটু ঝুঁকে কপালে চুমো খেল তামান্না। তারপর উঠে রান্নাঘরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো তামান্না। দীপ্তির জন্য নাস্তা বানাতে হবে। নইলে স্কুলে যেতে দেরি হলে না খেয়েই যেতে হবে মেয়েটাকে। এসব ভাবতে ভাবতেই হাতে হালকা টান অনুভব করলো। বিছানার দিকে মুখ ফেরাতেই কিশোরের ঘুমুঘুমু মুখে ঠোঁটের কোণে হাসিটা দেখতে পেল। তামান্না একটা হাসি দিয়ে কিশোরের দিকে প্রশ্নভরা চোখে তাকিয়ে রইলো।
-এই যে ম্যাডাম? কোথায় চললেন? আজকে আপনার কোথাও যাওয়া চলবে না। চুপচাপ রেস্ট করুন--। আমিই দীপুকে স্কুলে-----।
কথাটা বলতে বলতে একবার ভারি গলায় হাই তুললো কিশোর। তামান্না সেটা দেখে হেসে ফেললো এবারে। কিশোর একবার ভ্রু কুঁচকে তামান্নার দিকে তাকালো। তামান্না এগিয়ে এসে কিশোরের পাশে বসে কিশোরের মোবাইলটা হাতে নিয়ে সেটায় সাইলেন্ট মুড অন করে দিলো। কিশোর আবারো ভ্রু কুঁচকে তামান্নার কাজ দেখলো।
-তুমি এখন ঘুমাবা--। কোন কথা বলবা না। আমি একদম ঠিক আছি।
-কেমন ঠিক আছো দেখছি তো আমি। রাতেও দেখলাম ঠিক মতো খেতে পারলে না। কেমন টায়ার্ড দেখাচ্ছিল তোমাকে-। ইভেন এখনো--।
-ওসব কিছু না। তুমি আজ কোথাও যাবা না। চুপচাপ ঘুমাও। আজকে নো অফিস ডে জনাব, ওকে?
-তমা? আচ্ছা অফিস যাবো না। সারাদিন ঘুমাবো। এখন তুমি ব্রেকফাস্ট করে একটু রেস্ট করো-। আমি দীপুকে স্কুলে দিয়েই সোজা বাসায় এসে আবার ঘুম দিবো একটা--। প্রমিস--।
-না না না---।
-তমা? এতো জেদ করছো কেন? শরীরটা ভালো না তোমার---। কোথায় আবার সেদিনের মতে মাথা ঘুরে যাবে---।
-----ওসব কিছু না বললাম না! উফফফফ। নিজের দিকে খেয়াল আছে আপনার? এ কয়টা দিন এতো কাজ করছো, তার উপরে কাল এতো রাত জেগেছো-। চুপচাপ ঘুমাও এখন---।
-সে তো কাল তুমিও রাত জেগেছো--। তাহলে আসো একসাথে ঘুমাই? আরে! এভাবে তাকানোর কি আছে?
-তুমি! অসভ্য লোক একটা! ঘুমাও। আর একটাও কথা না। আমি দীপুকে স্কুলে দিয়ে একটু দীপশিখা থেকে ঘুরে আসবো। এর আগে যদি উঠো তুমি দেখবা---।
-যাব্বাবা!! আমার শান্ত শিষ্ট লাজুক বউটা আজ হঠাৎ রণচন্ডী রূপ ধারণ করলো কেন?
-কি বললা তুমি?
-কই! কিচ্ছু না বউ। এইতো ঘুমাচ্ছি আমি বাবা। তুমি সাবধানে যাও। আর তাড়াতাড়ি এসো---।
তামান্না দীপ্তিকে স্কুলে দিয়ে দীপশিখায় যাওয়ার পথে একটা ল্যাব থেকে আগের দিনে করানো টেস্টের রিপোর্টটা নিয়ে নিলো। এই রিপোর্টটা নিতে আসবে বলেই কিশোরের সাথে এতোক্ষণ অহেতুক চোটপাট করে এসেছে তামান্না। গাড়িতে দীপশিখার দিকে যাওয়ার পথেই তামান্না রিপোর্টটা একবার কাঁপা কাঁপা হাতে খুলে দেখে নিলো। আর রিপোর্ট দেখেই অজান্তেই তামান্নার চোখের কোণে কয়েক বিন্দু পানি চিকচিক করে উঠলো। দীপশিখায় গিয়ে বড় আপাকে রিপোর্টটা দেখাতেই বাকি সব আপারাও ওদের ঘিরে ধরে হাসি তামাশায় মাতলো। আর তাদের এক একজনের রসিকতায় তামান্না লজ্জায় লাল হয়ে গেল। বেচারি শুধু পারছে না এদের সবার সামনে থেকে ছুটে পালাতে। বড় আপা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে সবাইকে চোখ রাঙিয়ে থামালেন।
-তামান্না এই সময়টা তোমার রেস্ট করা উচিত। এদিকে কোন দরকার পড়লে আমরা নাহয় কিশোরকে কল করে জানিয়ে দিবো। তুমি আপাতত কয়েকটা মাস নিজের আর আরেকজনের খেয়াল রাখো---।
-জি আপা----।
-আর হ্যাঁ কিশোর সাহেবকে বলো এবার মিষ্টি আমরাই নাহয় উনাকে খাওয়াবো---। এখন বাড়ি ফিরে তাকে খুশির সংবাদটা দাও গে যাও। নাকি সেই খবরটাও আমাদেরকেই দিতে হবে?
-না আপা। আমিই---। আমি যাই?
-যাই বলতে হয় না তামান্না। বলো আসি।
-আসছি আপা। আপনারাও ভালো থাকবেন----।
তামান্না ব্যাগে রিপোর্টটা ঢুকিয়ে রেখে গাড়িতে এসে বসলে ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট করলো। পনেরো বিশ মিনিট মতো পর তামান্নার মোবাইলটা ভাইব্রেট হয়ে উঠলো। স্ক্রিনে ভেসে উঠা নাম্বারটা দেখে তামান্নার মুখে এক রাশ বিরক্তি ফুটে উঠলো। তবু শেষমেশ কি মনে হতে কলটা রিসিভ করলো তামান্না। ফোনের অপরপাশ থেকে মানুষটার ডুকরে কেঁদে ওঠার শব্দ শুনে তামান্না একটু ইতস্তত করে কি বলবে ভাবতে লাগলো। এর মধ্যেই অপর পাশ থেকে মানুষটার ভারি কণ্ঠস্বরটা শুনতে পেল তামান্না।
-মা তামান্না? বাবাকে ক্ষমা করে দে মা। আমি হাত জোড় করছি, তোর পায়ে পড়ছি---।
-কি বলছেন? আর কতবার বলবো আমি আপনাকে ক্ষমা করে দিয়েছি--।
-তুই বাবার কাছে এসে কটা দিন থেকে যা মা। এই অসুস্থ বাবার শেষ ইচ্ছেটা পূরণ কর মা---।
-শেষ! শেষ ইচ্ছে মানে!!
-ভেবেছিলাম তোকে কথাটা বলবো না মা--। আমার আর বেশিদিন নেই। ক্যান্সার লাস্ট স্টেজ চলছে---। ডাক্তার বলেছে হসপিটালে এডমিট হতে--। কখন কি হয় বলা যায় না----।
-কি!! কি বলছেন এসব??
-কটা দিন না থাক অন্তত পাঁচটা মিনিটের জন্য আয় মা। তোকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে----।
-আমি------। আমি কিশোরকে জিজ্ঞেস------।
-আজ একবার আসবি মা? একটু তোকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে যে। কালকের সকালটা দেখবো কি না কে জানে-।
-আচ্ছা। আমি আসছি--৷ তবে পাঁচ মিনিটের জন্যই শুধু---। আপনাকে দেখেই চলে আসবো--।
-হ্যাঁ মা। তুই যা চাস তাই হবে---।
তামান্না নিজের চোখ মুছে আহমাদ খানের বাড়ির দিকে নিতে বললো ড্রাইভারকে। আর কিশোরকে বেশ অনেকগুলো কল দিলো। কিন্তু একবারও কল রিসিভ হলো। নিজের উপরেই রাগ হচ্ছে তামান্নার। আজকেই ওর কিশোরের মোবাইলটাকে সাইলেন্ট করতে হয়েছিল! ধুর। তারপর আরো কয়েকবার বাড়ির ল্যান্ডলাইনে কল করলো তামান্না। কে রিসিভ করলো তামান্না সেটা বুঝতে পারলো না। তামান্নার 'হ্যালো' বলার সাথে সাথেই বারবার কলটা কেটে গেল ল্যান্ডলাইনেও। শেষে বিরক্ত হয়ে তামান্না কিশোরকে ছোট্ট একটা মেসেজ করে দিলো। কথা না হোক পরে অন্তত মেসেজটা দেখবে মানুষটা। তামান্না ডান হাতটা আলতো করে পেটে ছুঁইয়ে দিয়ে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে ভাবার চেষ্টা করছে। কাজটা কি ঠিক হচ্ছে! মনের মধ্যে কেমন একটা ভয় ভয় করছে তামান্নার৷ পর মূহুর্তে ভাবলো শুধু পাঁচ মিনিটই তো। গিয়ে মানুষটাকে দেখেই চলে আসবে। আর কিছু না। অন্তত বাবা নামক মানুষটার শেষ ইচ্ছেটা তো পূরণ হবে!
৪০!!
প্রায় বারোটার দিকে কিশোরের ঘুম ভাঙ্গলো। ঘুম ভাঙতেই আড়মোড় ভেঙে উঠে বসে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে একটু ভ্রু কুঁচকে গেল কিশোরের৷ ভর দুপুর হয়ে গেল তবুও তামান্না ওকে জাগাতে আসে নি ব্যাপারটা কেমন একটু অস্বাভাবিক ঠেকলো কিশোরের কাছে৷ পরে আবার ভাবলো হয়তো তামান্না এসে ডেকে গেছে, কিশোর নিজেই টের পায় নি৷ এই মূহুর্তে মেয়েটা নিশ্চয়ই রান্নাঘরে ব্যস্ত৷ কথাটা ভাবতেই কিশোরের ঠোঁটের কোণে একটা দু্ষ্টু হাসি ফুটে উঠলো। বহুদিন ব্যস্ততার তামান্নাকে এভাবে বিরক্ত করার সুযোগ হয়ে উঠে নি৷ আজকে তো কিছুতেই এই সুবর্ণ সুযোগটা মিস করা চলবে না। এসব ভেবে তাড়াতাড়ি উঠে ফ্রেশ হয়ে নিচে রান্নাঘরে এলো কিশোর। কিন্তু রান্নাঘরে তামান্নার দেখা মিললো না। তামান্না থাকতে পারে ভাবতে ভাবতে ড্রইং রুমে এলো কিশোর। মেয়েটা মায়ের রুমে? নাকি অন্য কোথাও কাজ করছে! এসব ভাবতে ভাবতেই ফালেহা চৌধুরীর ডাকে হুঁশ হলো কিশোরের।
-কিশোর? দীপ্তির স্কুল থেকে কল করেছে। দীপুকে আনতে আজ গাড়ি যায় নি---৷ মেয়েটা একা স্কুলে বসে আছে----।
-সে কি! তামান্না কোথায় মা?
-বউমা তো ফিরে নি এখনো--। বলে গেল দীপশিখায় যাবে--৷ একটু কাজ আছে---।
-ওহ!! আচ্ছা। আমি নাহয় দীপুকে নিয়ে আসছি--।
-যা---। তামান্নাকে নিয়ে আসিস। মেয়েটাকে সকালেও দেখলাম কেমন টায়ার্ড দেখাচ্ছিল--।
-আচ্ছা মা--।
কিশোর স্কুল থেকে দীপ্তিকে নিয়ে দীপশিখায় এলো। সেখানে সবার মুখে তামান্নার অনেকক্ষণ আগে চলে যাওয়ার খবর পেয়ে মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। দীপ্তিকে বাড়িতে রেখে সারাদিন পাগলের মতো তামান্নাকে পুরোটা দিন খুঁজেছে কিশোর। তামান্নাকে খুঁজে না পেয়ে শেষে ক্লান্ত শ্রান্ত শরীরে বাড়ি ফিরেছে কিশোর। তাও সন্ধ্যা নামার অনেক্ষণ পর। রুমে এসে অনেকক্ষণ পায়চারি করলো কিশোর। কোথায় যেতে পারে তামান্না সেটাই মাথায় ঢুকছে না কিশোরের৷ কাউকে কল করার জন্য মোবাইলটা বের করতে গিয়ে না মোবাইলটা না পেয়ে রুমে খুঁজে দেখতে গিয়ে মোবাইলটা পেল কিশোর৷ মোবাইলটা হাতে নিয়েই চমকে গেল কিশোর৷ তামান্নার নাম্বার থেকে দশ বারোটা মিসড কল উঠে আছে৷ সেটাও প্রায় সাড়ে দশটার সময় কলগুলো করা হয়েছিল। আর সাথে একটা মেসেজ।
"আমি একটু বাবার কাছে যাচ্ছি। একটু পরেই ফিরবো।"
মেসেজটা দেখামাত্রই কিশোরের মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল৷ কোন সাহসে মেয়েটা ওই শয়তান লোকটার বাড়িতে গেছে! একবার বাসায় আসুক তারপর এই মেয়ের কাজের শাস্তি দিবে। কিন্তু ওই বাড়িতে মেয়েটা কি করছে কে জানে৷ তার উপরে তামান্নার মোবাইলটাও বন্ধ। কিশোর একবার চিন্তা করলো। আগে গিয়ে তামান্নাকে ফিরিয়ে আনা যাক। তারপর ওকে দেখে নিবে কিশোর৷ এসব ভাবতে ভাবতেই কিশোর নেমে আসার সময় রান্নাঘর থেকে একটা মোবাইলের রিংটোনের শব্দ শুনে থমকে গেল। রান্নাঘরে কে আছে সেটা দেখার জন্য এগিয়ে গেল কিশোর। রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে কারো একটা চাপা একটা কণ্ঠস্বর শুনতে পেল কিশোর৷
-হ্যালো ম্যাডাম?---জি ম্যাডাম। স্যার বাসায় চলে এসেছে। --- না ম্যাম---৷ জি আচ্ছা ম্যাম--। রাখছি ম্যাম--৷ জি ম্যাম টাকাটা পাঠিয়ে দিবেন---। ওকে ম্যাম৷ ধন্যবাদ--। জি ম্যাম আপনাকে জানাবো কিছু ঘটলে--।
মেয়েটা কলটা কেটে ঘুরে দাঁড়াতেই কিশোরকে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একেবারে থতমত খেয়ে গেল৷ কিশোরকে দেখে ভয়ে কেঁপে উঠতেই হাত থেকে মোবাইলটা পড়ে গেল মেয়েটার৷ কিশোর মেয়েটার হাত ধরে টেনে এনে ড্রইংরুমের মাঝখানে এনে প্রায় ছুঁড়ে ফেললো। মেয়েটাও ভয় পেয়ে 'ছাড়ুন স্যার' বলে হাত পা ছুঁড়ছিল। আর শব্দ শুনে ফালেহা চৌধুরী, দীপ্তি আর সব কাজের লোকেরা জমা হয়েছে ড্রইংরুমে জমা হয়ে গেছে। ফালেহা চৌধুরী কিশোরকে এভাবে রেগে যেতে দেখে ভয় পেয়ে গেলেন৷ দীপ্তিও ভয় পেয়ে ফালেহা চৌধুরীর পিছনে লুকিয়ে পড়লো।
-কি হলো কিশোর? তুই এমন করছিস কেন? আর তামান্নাই বা কোথায়? আর এই মেয়েটা এভাবে চিৎকার চেঁচামেচি করছিল কেন?
-সেটা তুমি মিস নয়নাকেই জিজ্ঞেস করো মা। উনি মোবাইলে কাকে এ বাড়ির খবর পাঠাচ্ছিলেন----। জিজ্ঞেস করো উনাকে---।
-কিশোর কি বলছে এসব নয়না? তুমি কাকে কি খবর দিচ্ছো? বলো? চুপ করে আছো কেন?
নয়না ভয়ে কাঁপছিল। ধরা পড়ে গিয়ে এবার কি বলবে সেটা বুঝতে না পেরে ভয়ে চুপ করে আছে ও। কিশোর এসব ভাবার পিছনে সময় নষ্ট করলো না আর৷ মায়ের কাছে এগিয়ে গেল।
-মা আমি তমাকে আনতে গেলাম। তুমি এই মেয়েকে আপাতত পুলিশে দেয়ার ব্যবস্থা করো--৷
-কিন্তু ও কি করেছে আমি--। আর তামান্নাই বা কোথায় আছে?
-মা আমি তমাকে আগে নিয়ে আসি।
-আচ্ছা যা--৷ বউমাকে নিয়ে আয়--।
কিশোর তাড়াহুড়ো করে গাড়ি নিয়ে বের হলো। পথে যেতে যেতেই পুলিশে খবর দিলো। আহমাদ খানের বাড়ির সামনে আসতেই দেখলো পুলিশের গাড়ি অপেক্ষা করছে। কিশোর পুলিশের অফিসারকে নিয়েই বাড়ির ভিতরে ঢুকলো। আর কিশোরের সাথে পুলিশ দেখে আহমাদ খান রেগে গিয়ে তেড়ে আসলো। আর সুপ্তিও রেগে গিয়ে অনেকক্ষণ বাঁধা দেয়ার চেষ্টা করলো৷ কিন্তু মহিলা পুলিশের কয়েকজন সুপ্তিকে ধমকে সোফায় বসিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে৷ আর কিশোরও বাড়ির রুমগুলোয় পাগলের মতো খোঁজ শুরু করলো। নিচতলায় তামান্নাকে না পেয়ে দোতলায় চলে এলো কিশোর। দোতলায় একটা রুমের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করা দেখে কিশোর সেটা খুলতেই তামান্নাকে দেখতে পেল। তামান্না হাঁটুতে মুখ ডুবিয়ে কাঁদছিলো। কিশোরকে দেখেই এক ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো তামান্না। কিশোরও হালকা করে তামান্নাকে বুকে জড়িয়ে নিলো।তামান্না কিছু একটা বলার জন্য মুখ তুলে কিশোরের দিকে তাকালো।
-কিশোর----। আমি-----।
-একটা কথাও বলবা না তুমি---।
-আমি বলছিলাম যে----।
-একটা কথাও না তমা---।
কিশোরের রাগ দেখে তামান্না আর একটা কথাও বলতে পারলো না। তামান্না ঠিক করে দাঁড়িয়ে থাকতেই পারছে না দেখে কিশোর আলতো করে তামান্নাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে নিচে নেমে এলো। তামান্না গুটিশুটি হয়ে কিশোরের বুকে মুখ লুকিয়ে রইলো। নিচে ততক্ষণে তামান্নাকে দেখে পুলিশের লোকজন আহমাদ খান আর সুপ্তিকে আরো কড়া করে জিজ্ঞাসাবাদ করা শুরু করে দিয়েছে। আর কিশোরও পুলিশ অফিসারের সাথে কথা বলে তামান্নাকে নিয়ে বেরিয়ে এলো বাড়ি থেকে। কিশোর তামান্নাকে গাড়িতে বসিয়ে দিয়ে নিজে ড্রাইভিং সিটে বসে বাড়ির দিকে চললো। তামান্না অনেক্ষণ ধরে কিশোরের সাথে কথা বলার চেষ্টা করলো৷ কিন্তু কিশোর এতোটাই রেগে আছে যে তামান্নার একটা কথাও শুনলো না৷ আর তামান্নাও কিশোরের রাগী চোখ দেখে ভয়ে চুপ হয়ে গেল।
কিশোর চুপচাপ গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফিরে গাড়ি থেকে নামতেই তামান্নার গাড়ির ড্রাইভার কে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে গেল। সারাদিনে এই লোকটাকেও কিশোর সমানে খুঁজেছে। কিন্তু লোকটার হাতে মাথায় ব্যান্ডেজ দেখে বুঝতে পারলো কিছু একটা হয়েছিল লোকটার সাথে৷ কিশোর ড্রাইভারের দিকে এগিয়ে গেলো।
-স্বপন? তুমি? তোমার এ অবস্থা কেন?
-স্যার আমি সব আপনাকে খুলে বলছি--। কিন্তু ম্যাডাম বাড়ি ফিরে এসেছে---?
-এই তো ওকে নিয়েই ফিরলাম--। এবার বলো তো তোমার কি কোন এক্সিডেন্ট হয়েছে? আর----।
-না স্যার--। সকালে আমি তামান্না ম্যাডাম আর দীপ্তি মামনিকে নিয়ে বেরিয়েছিলাম। দীপ্তি মামনিকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে তামান্না ম্যাডাম ল্যাবে গিয়ে একটা রিপোর্ট নিয়ে আসেন। তারপর আবার দীপশিখায় যাই ম্যাডামকে নিয়ে---।
-কিসের রিপোর্ট? আর কোন ল্যাবে! কেন! তামান্না আমাকে কিছু বলে নি যে ও--।
-স্যার--। আমার যতটুকু ধারণা উনি আপনাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলেন---।
-সারপ্রাইজ!!
-আপনি রিপোর্টটা দেখলেই বুঝতে পারবেন---। ম্যাডাম দীপশিখা থেকে সোজা বাসায়ই ফিরছিলেন। একটা কল এলো তখন। ম্যাডাম যেতে চাইছিলেন না। তবে মনে হয় ওপাশ থেকে কেউ অনেক অনুরোধ করেছিল। মরে যাবে, শেষ ইচ্ছে এসব বলছিল একজন বয়স্ক মানুষ। ম্যাডাম আপনাকেও অনেকবার কল করেছিল জানানোর জন্য। পরে আপনি কলটা রিসিভ করছেন না দেখে আমাকে বললেন আহমাদ খান স্যারের বাড়িতে যেতে---। বাড়ির সামনে নেমে ম্যাডাম আমাকে বললেন পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ফিরে আসবেন। আর আসতে দেরি হলে আমি যেন উনাকে ডেকে আনি---।
-তারপর কি হলো? তামান্না আসে নি?
-ম্যাডাম বাড়িতে ঢোকার একটু পরেই রেগে গিয়ে বেরিয়ে আসেন। গাড়িতে উঠতে যাবেন এর মধ্যেই সুপ্তি ম্যাডাম আর আহমাদ স্যার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন। আর আমার মাথায় কেউ খুব জোরে কিছু একটা দিয়ে মারে---। অজ্ঞান হওয়ার আগে দেখলাম ম্যাডামকে উনারা টানতে টানতে আবার বাড়ির ভিতরে নিয়ে যাচ্ছে। আমি একবার বাধা দেয়ারও চেষ্টা করেছিলাম। তারপর মাথায় আর পায়ে আরো কয়েকটা রডের বাড়ি পড়লো। এরপর আর মনে নেই স্যার--। হসপিটালে জ্ঞান ফেরার পরে কয়েকবার কল করেছিলাম বাড়ির নাম্বারে--। লাইন এঙ্গেইজড আসছে--। তাই কোনরকমে বেরিয়ে এলাম---।
-উফফফ--। স্বপন তুমি রেস্ট করো। আমি ডক্টরকে খবর দিচ্ছি--।
-আমি ঠিক আছি স্যার--।
-চুপচাপ নিজের কোয়ার্টারে যাও। কেমন ঠিক আছো দেখছি আমি।
কিশোরকে তামান্নার পার্সটা দিয়ে স্বপন নিজের কোয়ার্টারে চলে গেল। আর কিশোরও ডাক্তারকে কল করে আসতে বলে গাড়ির দরজাটা খুলে ভিতরে তাকালো। তামান্না সিটে হেলান দিয়ে গভীর ঘুমে অচেতন। মুখটা শুকিয়ে আছে। দেখেই কিশোর আবার আলতো করে তামান্নাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকলো। বাড়ির সবাই কিশোরকে দেখে এগিয়ে এলো। কিশোর তাদেরকে ইশারায় চুপ থাকতে বলে তামান্নাকে রুমে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিলো।
ঘন্টাখানেক পর তামান্নার ঘুম ভাঙতেই নিজেকে ওদের বেডরুমে কিশোরের বুকে আবিষ্কার করলো। কিশোর একহাতে তামান্নাকে বুকে জড়িয়ে রেখেছে৷ আরেকটা হাত তামান্নার পেটে। ব্যাপারটা খেয়াল হতেই তামান্না লাজুক হেসে কিশোরের বুকে মুখ ডুবালো। কিশোরও চোখ বুজে ছিলো। তামান্নার নড়াচড়ায় বুঝতে পারলো জেগে গেছে। কিশোরও এবার তামান্নাকে দুহাতে নিজের বুকে জড়িয়ে নিলো। তারপর তামান্নার মুখটা তুলে ধরে কপালে চুমো খেল।
-কংগ্রাচুলেশনস ম্যাডাম--। আর এতো বড় একটা সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য অনেক অনেক অনেকগুলো থ্যাংকস---।
-তুমি---।
-ইয়েস মিসেস চৌধুরী---। জুনিয়র চৌধুরী আসার খবরটা পেয়ে গেছি--। আর এই? তোমাকে আমি বলেছিলাম না এই লোক আর উনার মেয়ের নাটকে বিশ্বাস করতে না? তবু কেন গেলে ওই বাড়িতে? সাহস বেড়েছে না খুব তোমার?
-আম সরি---। আমি আসলে বুঝতে পারি নি উনি আমাকে বাড়িতে নেয়ার জন্য ওভাবে মিথ্যে নিজের মৃত্যুর কথাটা বলবে-। বলেছিল শেষবারের মতো আমাকে দেখতে চায়--। আমি কি করে জানবো---।
-ওরা নিজের ফায়দার জন্য আরো অনেক নিচে নামতে পারে তমা--। বলেছিলাম তো নাকি? তবু---।
-তুমি এভাবে বকছো কেন? আমি তোমাকে কল করেছিলাম বলার জন্য--। বাড়িতেও কল করেছিলাম--। কেউ বার বার কলটা কেটে দিচ্ছিলো--। আর পরে আর কল যাচ্ছিলোই না---।
-জি--। নয়না এখানে থেকে ওদের হয়ে টিকটিকিগিরি করছিলো--। ওটাকেও পুলিশে দিয়েছি--। এখন আর কোন চিন্তা নয়--। ওকে? আর ভুলেও যদি এমন ভুল করো তাহলে তোমার একদিন আর আমার একদিন--। মনে থাকবে?
-হুম---। দীপু কোথায়? আর মা?
-আছে---। তুমি একটু ওয়েট করো--। আমি খাবারটা নিয়ে আসছি--। আর দীপু আর মাকেও আসতে বলছি---।
-এই না---। খাবো না প্লিজ??
-তমা?
দেখতে দেখতে দিনগুলো কেটে গেছে। কিশোর আজও একবার হসপিটালে ওটির বাইরে পায়চারি করছে। প্রায় ছয় সাত বছর পর আবার একই অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে কিশোর। বুকের ভিতরে কিসের একটা অজানা ভয় কাজ করছে ওর। নিজের মনেই প্রার্থনা করছে। দীপ্তি আর ফালেহা চৌধুরীও ওটির সামনেই ওয়েটিং সিটে বসে আছে। প্রায় ঘন্টাখানেক পর ওটিতে থেকে সূক্ষ্ম কান্নার আওয়াজ ভেসে আসতেই কিশোর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেল দরজার সামনেই। আরো কিছুক্ষণ পর ওটির দরজাটা খুলে গেল৷ আর ডাক্তারও হাসি মুখে বেরিয়ে এলো।
-কংগ্রাচুলেশনস মিস্টার কিশোর। আপনি দুটি ফুটফুটে সন্তানের বাবা হয়েছেন--। একটি ছেলে আর একটি মেয়ে--। বেবিরা সুস্থই আছে। আর আপনার ওয়াইফও--।
-টুইন বেবি! ম্যাডাম আমি কি আমার ওয়াইফের সাথে একবার দেখা করতে পারি?
-হ্যাঁ অবশ্যই---। উনাকে এখনই কেবিনে দেয়া হবে--। ওখানেই দেখা করতে পারবেন--। আর মিষ্টি চাই কিন্তু---।
-জি ম্যাডাম---।
একটু পরে নার্স এসে বেবিদের নিয়ে এলো। কিশোর একটা বেবিকে কোলে তুলে নিলো। আর ফালেহা চৌধুরী অন্য বেবিটাকে কোলে নিলেন। নার্স তামান্নার কেবিন দেখিয়ে দিতেই কিশোর পকেটে হাত দিয়ে যত টাকা পেল সবগুলোই নার্সকে ধরিয়ে দিলো মিষ্টি খাওয়ার জন্য বলে। তারপর তামান্নার কেবিনে এলো। কিশোর বেবিকে কোলে নিয়েই তামান্নার বেডের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। দুটো বেবিকেই তামান্নার পাশে শুইয়ে দিয়ে তামান্নার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো কিশোর৷ তামান্নারও চোখ বেয়ে দু ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো।
-দেখো তমা? আল্লাহ আমাদের ঝুলিতে আরো দু টুকরো খুশি দিয়ে দিয়েছেন---। আমি কিন্তু মেয়ের নাম ঠিক করে ফেলেছি---৷ আমার লক্ষী ছোট্ট মা টার নাম হবে তৌশিদা।
-আর আমার বাবাইটার নাম?
-সেটা তুমি জানো--। আমি জানি না---।
কিশোর কথাটা শেষ করার আগেই পাশে থেকে দীপ্তি গাল ফোলালো।
-মামনি বাবাই---। আমি ভাই আর বোনের নাম রাখবে--। তোমার আমাকে ভাই আর বোনকে দেখতেই দিচ্ছ না--। আমি রাগ করবো কিন্তু--।
দীপ্তির কথায় কিশোর, তামান্না আর ফালেহা চৌধুরী তিনজনেই হেসে ফেললো। কিশোর দীপ্তিকে তামান্নার পাশেই বসিয়ে দিলো। দীপ্তি ঝুঁকে দুটো বাবুকেই চুমো খেয়ে খেলা করতে শুরু করলো।
-তা দীপুসোনা তার ভাই বোনদের কি নাম রাখবে?
-বোনের নাম তো বাবাই রেখে দিলো। ওটা থাক--। তৌশিদা--। আর ভাইয়ের নাম হবে--। কুশান-। আর কুশান পুতুল আর তৌশিদা পুতুল--। হি হি---।
দীপ্তির কথা শুনে আবার কিশোর তামান্না দুজনেই হেসে ফেললো। তামান্না একবার হাত বাড়িয়ে দীপ্তিকে আর বাবুদেরকে ছুঁয়ে দিয়ে কিশোরের দিকে তাকালো। ওর ছোট্ট ছোট্ট স্বপ্নগুলো পূরণ হয়েছে যে মানুষটার জন্য সেই মানুষটার স্বপ্নটাও আজ তামান্না পূরণ করতে পেরেছে। আর ওর এতোদিনের #অস্পষ্ট_প্রেমাবেগ গুলোও যেন নিজেদের স্পষ্টতা খুঁজে পেয়েছে। আর ওদের এই অস্পষ্ট প্রেমাবেগের স্পষ্টতাই হলো এই তিনটি নিষ্পাপ মুখ-দীপু, তৌশিদা আর কুশান।
***(সমাপ্ত)***