মায়াবতী (পর্ব ১২)


২৩!! 

-ভাবিনি যা ভেবেছি ভুল হবে সবই,
করতে পারনি তুমি আমাকে অনুভবই।

মায়ার বলা কথাটার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে না পেরে রাহাত একটু অবাক হয়েই মায়ার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। কথাটা দিয়ে মেয়েটা কি বুঝাতে চাইছে? মায়া এবারে একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে রাহাতের মুখের দিকে তাকিয়ে আরেকবার হাসার চেষ্টা করলো। মেয়েটার মনে কি চলছে সেটা হয়তো রাহাত কল্পনাও করতে পারছে না। এদিকে দ্বীপকে পুলিশের লোকেরা টানতে টানতে নিয়ে যেতে দেখে মায়ার মা প্যান্ডেলের একটা চেয়ারে ধপ করে বসে পড়লো। মায়াদের কয়েকজন প্রতিবেশী উনাকে সামলানোর চেষ্টা করছে। আরো কয়েকজন নিজেদের মধ্যে কথা বলাবলি করছে যেগুলো এতোক্ষণে রাহাতের কানেও এসে পৌঁছেছে। রাহাত মায়ার দিক থেকে এবার এই কৌতূহলী জনতার দিক একনজর তাকিয়ে আবার মায়ার দিকে ফিরে তাকালো। সেদিনের সেই বয়স্ক দাদী মায়ার কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন এবারে। তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে তিনি মায়ার আজকের কাজটা ঠিক মেনে নিতে পারেন নি। মায়ার দিকে কয়েক মিনিট কটমট করে তাকিয়ে থেকে হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন বৃদ্ধা।

-কাজটা একদম ঠিক করলি না মায়া। এইভাবে নিজের জীবন বরবাদ করতে কেন উঠে পড়ে লেগেছিস বল দেখি নি। এই নিয়ে পর পর দুবার তোর বিয়েটা ভেঙ্গে গেল। এখন তোকে কোন রাজপুত্তুর এসে বিয়ে করবে বল দেখি? সমাজ বলেও তো একটা বস্তু আছে নাকি? তোর মাকে নাহয় আমরা সবাই মিলে সামলে নিবো। কিন্তু তুই? এভাবে কদ্দিন চলবে? তোর ওই বড়লোক বাপের ব্যাটা তো আর এসে তোকে বিয়ে করে নে যাবে না। আর এতোসব শোনার পর আর কে আসবে বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে বল দেখি? বল আমারে।

বৃদ্ধা দাদীর চোখে মোটা চশমা থাকলেও চোখে খুব একটা দেখতে পান না। তাই পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রাহাতকে উনি ঠাওরাতে না পেরে তার হাত চেপে ধরেই আবার নিজের কথায় মশগুল হয়ে গেলেন।

-তুই বল দেখি নি ভাই। ছেলেটা নাহয় একটু ভুলভাল কিছু বলে ফেলেছিল, তাই বলে গায়ে হলুদের দিন এভাবে তাকে তুই পুলিশে দিবি? একটু আক্কেল জ্ঞান নেই তোর? এবার এই আইবুড়ি মেয়েকে কে বিয়ে করবে? 

-মায়ার বিয়েটা যদি এতোই জরুরি হয় তাহলে আমিই ওকে বিয়ে করবো দাদী। এবং এবারে স্বেচ্ছায়-----।

রাহাত নিজেও জানে না হঠাৎ কেন মায়াকে বিয়ে করার কথাটা বলে ফেলেছে। কিন্তু বিয়ের কথাটা শুনে আশেপাশের লোকজন গুঞ্জন থামিয়ে এগিয়ে এসে ঘটনা শোনার জন্য আসতেই মায়া নিজেই হেসে ফেললো। হাসির দাপটে মেয়েটার চোখে পানি চলে এসেছে তবু তার হাসি থামছেই না। পাশ থেকে দাদী মায়াকে ধমক দিয়ে থামানোর বৃথা চেষ্টা করলেও মায়া তখনও হেসেই চলছে। বেশ কিছুক্ষণ পর নিজেকে সামলে নিয়ে রাহাতের একদম সামনে এসে দাঁড়ালো মায়া। একটু আগ পর্যন্ত মায়ার মুখে এই জেদটা দেখতে পায় নি রাহাত। রাহাতও অবাক চোখে মায়ার এই নতুন রূপের রহস্যটা খোঁজার চেষ্টা করছে। পাশ থেকে কেউ একজন মায়াকে কিছু বলার চেষ্টা করতেই মায়া এবারে হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিয়ে আবারো রাহাতের চোখে চোখ স্থির করলো।

-আপনারা কি ভাবেন বলুন তো? মেয়ে হয়ে জন্মেছি বলে আমার কোনো ফিলিংসই নেই? যার যখন ইচ্ছে আমাকে রিজেক্ট করবে, আবার যখন ইচ্ছে দয়া দেখিয়ে গ্রহণ করবে? মিস্টার রাহাত? আপনাকে পাগলের মতো চেয়েছিলাম জানেন? একটু আগে পর্যন্ত আপনার জন্য এই সাজানো আসরে আমি অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু অন্য একজনের নামের হলুদটা ছুঁইয়ে দিয়ে আপনি সেই জায়গাটা হারিয়েছেন আজকে। আজকের পর থেকে মায়ার মনে আপনার জন্য কোনো জায়গা নেই রাহাত। 

-মায়া?

-প্লিজ? লেট মি ফিনিশ। আপনি এখনও যে আমাকে ভালোবেসে বিয়ে করতে রাজি হচ্ছেন তাও তো না রাহাত স্যার। হয়তো ভাবছেন একটা বেচারি অসহায় মেয়েকে বিয়ে করে অপমানের হাত থেকে বাঁচাচ্ছেন। বিয়েটা হলে হয়তো আপনিও সারাজীবন নিজের সিদ্ধান্ত নিয়ে আফসোস করবেন, আর আমিও। যে সম্পর্কটা শুধু সমাজের ভয়ে, তাদের কথার ভয়ে একটা সমঝোতা টাইপের ডিল হিসেবে কাগজে কলমে নাম পাবে, সেই সম্পর্কে আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই মিস্টার রাহাত। আর রইলো পড়ে আমার সমাজের কথা? যে সমাজ একজন লম্পট দুশ্চরিত্র লোকের হয়ে সাফাই গায়, যে সমাজ একটা মেয়েকে লোকের ভয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে দেয় না; যৌতুক, ধর্ষণ এসবের জন্য একটা মেয়েকেই দায়ী করে অথচ অন্যায়কারীরা বুক ফুলিয়ে যে সমাজে ঘুরে বেড়ায়-সেই সমাজে আমিও থাকতে চাই না। সন্তান হিসেবে আমার মায়ের দায়িত্ব আমি নিজেই নিতে পারবো। তবু সমঝোতা করবো না কোনো অন্যায়ের সাথেই। না কোনো লম্পটকে বিয়ে করে, না কারো দয়ার পাত্রী হয়ে---। 

আশেপাশের লোকজনের মুখ দিয়ে একটা টু শব্দও বের হচ্ছে না। রাহাত নিজেও কি বলবে বুঝতে না পেরে চুপ করে আছে। মায়াবতীটাকে এর আগে এতোটা অচেনা লাগে নি রাহাতের। রাহাত কিছু বলার আগেই মায়ার মোবাইলে টুং করে একটা মেসেজ আসতেই মায়া মোবাইলের দিকে একবার তাকিয়ে প্যান্ডেলের গেইটের দিকে তাকিয়ে রাহাতের একটা হাত চেপে ধরে সামনের দিকে পা বাড়িয়ে আবার থেমে গেল। কিছু একটা ভেবে পিছনের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসে ভিড়ের অবাক হওয়া মানুষগুলোর দিকে তাকালো।

-বিয়ে, গায়ে হলুদ কিছুই হবে না আর এখানে। আমার জন্য এতো কষ্ট করে আপনারা যে এই স্টেজ, প্যান্ডেল সাজিয়েছেন তার জন্য অসংখ্য অসংখ্য ধন্যবাদ সবাইকে। খাবারের আয়োজনটা কেমন হয়েছে বলতে পারবো না। তবে আশা করি খেয়ে যাবেন সবাই। আমাদের আরেকজনের সাথে দেখা করা বাকি এখনো আসুন স্যার?

একের পর এক এতোগুলো শক পাবে রাহাত আশাও করে নি। তাই মায়া ওর হাত ধরে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে সেসব নিয়ে এক বিন্দুও মাথা না ঘামিয়ে মায়ার সাথেই পা বাড়ালো রাহাত। আর কার আসার কথা সেটা জানার অদম্য ইচ্ছেটা বেশিক্ষণ চেপে রাখতে হলো না রাহাতকে। কয়েক পা এগিয়ে যেতেই তিনজন মানুষকে দেখতে পেয়ে মায়া রাহাতের হাত ছেড়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল সেখানেই। এদের একজন রাহাতের ভিষণ পরিচিত মুখ, বি.এস.এম. কোম্পানির সেক্রেটারি, মিস্টার শওকত, যার সাথে প্রায় ছয়মাস একটা প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করেছে। রাহাতকে দেখে সেও কিছুটা অবাক হয়ে হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলো। 

-হোয়াট এ প্লেজেন্ট সারপ্রাইজ মিস্টার চৌধুরী! আপনিও আজকের প্রোগ্রামে ইনভাইটেড নাকি? স্যার? আপনার সাথে তো মিস্টার রাহাত চৌধুরীর পরিচয়ও হলো না এখনও। এই সেই ভদ্রলোক যার ডিজাইন, প্রপোজাল, আর তত্ত্বাবধানে আমরা আমাদের প্রজেক্টটা সময়ের আগেই শেষ করতে পেরেছি। এন্ড মিস্টার রাহাত? মিট আওয়ার সি.ই.ও. মিস্টার আহমাদ খান স্যার। আশা করি কিছুদিনের মধ্যে আমরা আমাদের নতুন প্রজেক্টের ব্যাপারে মিটিং করতে পারবো।

-ইয়া! হ্যালো স্যার? কিন্তু আপনারা এখানে?

সেক্রেটারির পাশে থাকা ষাটোর্ধ বলিষ্ঠ ভদ্রলোকটির দিকে হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়ে রাহাত বেশ অবাকই হলো। এতোক্ষণে তাদের সাথে আসা তৃতীয় ব্যক্তিটির দিকে চোখ পড়লো রাহাতের। রাহাত লোকটাকে দেখে যতটা না অবাক হয়েছে সম্ভবত ততটা অবাক লোকটাও হয়েছে। বয়স রাহাতের কাছাকাছিই হবে হয়তো। লোকটাকে কোথায় দেখেছে কিছুতেই মনে করতে পারছে না রাহাত। কিছুটা কনফিউশান নিয়েই রাহাত লোকটার দিকে হাত বাড়িয়ে দিতেই সেও চমকে সাথে হ্যান্ডশেক করলো। 

-মিস্টার রাহাত? ইনি হলেন মিস্টার আমাদের কোম্পানির বর্তমান এম.ডি। আপনার সাথে হয়তো আলাপ হয়নি উনার। উনি কিছুদিন হয় বাইরে থেকে ফিরেছেন---।

-মিস্টার শওকত! এখানেও বিজনেস নিয়ে চলে এলেন? আমরা একটা প্রোগ্রাম এটেন্ড করতে এসেছি এখানে। রিমেম্বার?

মিস্টার খানের সেক্রেটারির কথাটা শেষ হওয়ার আগেই তৃতীয় ভদ্রলোকটি তাকে থামিয়ে দেয়ায় রাহাত কিছুটা অবাকই হলো। বি.এস. এম. কোম্পানির সেক্রেটারি মিস্টার শওকত বাঁচাল রকমের একজন মানুষ। একবার কথা বলা শুরু করলে লোকটা থামতেই চায় না। কিন্তু এভাবে অকারণে তাকে থামিয়ে দেয়ায় অন্যদের সাথে সাথে রাহাতও কিছুটা অবাক হলো। লোকটাকে আরো একবার ভালো করে দেখে মনে করার চেষ্টা করলো কোথায় তাকে দেখেছে। কিন্তু এবারে ব্যর্থ হলো বেচারা। কিন্তু ভদ্রলোকটির চোখেমুখে ফুটে থাকা চাপা আতঙ্কটা কিছুতেই চোখ এড়ালো না রাহাতের। লোকটার চোখ মুখ কপাল ঘামে ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে দেখে রাহাতের ভ্রু কুঁচকে গেল।

-আর ইউ ওকে? আপনাকে অসুস্থ দেখাচ্ছে? আই থিংক ইউ নিড সাম ওয়াটার।

-ইয়া! শরীরটা খারাপ লাগছে কিছুটা। ক্যান আই হ্যাভ এ গ্লাস ওফ ওয়াটার প্লিজ?

ভদ্রলোকটি পানির কথাটা বলার সাথেসাথেই মায়া পাশ থেকে একটা হাফ লিটারের পানির বোতল তার দিকে এগিয়ে দিলো। এক নজর মায়ার দিকে তাকিয়ে সে ও বোতল খুলে ঢকঢক করে পানি গলায় ঢাললো। কিছুক্ষণ পরেই কেমন একটা অস্বস্তি লাগতে শুরু করেছে লোকটার। চোখের সামনে সবকিছু কেমন ঘোলাটে হয়ে আসতে চাইছে। কি ঘটছে কিছুই বুঝতে পারছে না সে। এদিকে মায়া আর সেদিকে না তাকিয়ে আহমাদ খানের পাশে এসে দাঁড়ালো। বয়স্ক ভদ্রলোক মায়ার মাথায় হাত রেখে ধীরে ধীরে বিড়বিড় করলেন যেন।

-তোমাকে যে কি বলে ধন্যবাদ দিবো মা মায়া আমি নিজেও জানি না। আজ এতোগুলা বছর পর যে সুস্থ শরীরে এতোদূর আসতে পেরেছি সেটা হয়তো তুমি না থাকলে কখনোই হতো না। 

কি নাটকীয় ঘটনা ঘটছে তার কিছুই বুঝতে পারছে না রাহাত। তাই একবার মায়ার মুখের দিকে তাকাচ্ছে, আর একবার মিস্টার খানের মুখের দিকে। মায়া এবারে রাহাতের দিকে তাকালো।

-স্যার? সেদিন আপনি আমাকে আপনার জীবনের যে অর্ধেক গল্প শোনালেন তার বাকি অংশটুকু আজ আমি আপনাকে শোনাই। পাঁচ বছর আগে আমাদের এই সুন্দর দেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরের ডাবলিন শহরে আপনি যে মিষ্টি বাকপটু রহস্যময়ীর প্রেমে পড়েছিলেন-তার পুরো নামটা আপনার মনে আছে? তার নাম ছিল মিস মৌনতা খান স্মৃতি, ডটার অফ মিস্টার আহমাদ খান, ওনার অফ চেইন অফ খান এন্ড খানস ইন্ডাস্ট্রিজ।

-হোয়াট!

মায়ার কথাগুলো শুনে রাহাত আর আহমাদ খান দুজনের মাথায়ই যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। মায়া মিষ্টি করে হেসে এবারে আহমাদ খানের দিকে তাকালো। বিস্ময়ের চোটে ভদ্রলোকের গলা দিয়ে একটা শব্দও বের হচ্ছে না। অনেকদিনের অসুস্থ শরীরটা যেন এতোটা চাপ সহ্য করতে পারছে না। পাশ থেকে উনার সেক্রেটারি উনাকে ধরে না রাখলে হয়তো এতোক্ষণে মাটিতেই লুটিয়ে পড়তো লোকটা। মায়াও এগিয়ে এসে আহমাদ খানের দিকে তাকালো। মানুষটার চোখেমুখে হতাশার ছাপ স্পষ্ট। যেন নিজের ভুলে সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটা হারিয়ে উনি আজ ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত। 

-আঙ্কেল আপনিই একমাত্র মানুষ যার সাথে মৌনি আপু সবকিছু শেয়ার করতো। আর একমাত্র আপনিই পারবেন রাহাত স্যারের প্রশ্নের উত্তর দিতে। যে প্রশ্নগুলো উনি পাঁচ বছর ধরে নিজের মনে নিয়ে ঘুরছেন। 

-রাহাত?

-মিস্টার আর. মাহবুব চৌধুরী নামটা তো আপনার কাছে পরিচিতই, তাই না আঙ্কেল?

-হ্যাঁ! হ্যাঁ। মাহবুব চৌধুরী। এই একটা নাম আমি গোটা ডাবলিন শহরে খুঁজে বেড়িয়েছি। সেদিন ঠিক কি ঘটেছিল আমার মৌনির সাথে সেটা জানার জন্য।

-কি ঘটেছিল সেটা নাহয় আমি আপনাদেরকে বলছি। আপনি মৌনি আপুর ডাবলিনে যাওয়া আর এর পরে যা জানেন সেটাই নাহয় বলুন।

-হ্যাঁ হ্যাঁ----।

আহমাদ খান টলমল পায়ে এগিয়ে এসে একটা চেয়ারে থপ করে বসে পড়লো। পাশে তার সেক্রেটারি, রাহাত আর মায়া অধীর আগ্রহে তার দিকে তাকিয়ে আছে লোকটার নিজেকে সামলে নিয়ে ডাবলিন শহর থেকে স্মৃতির হারিয়ে যাওয়ার রহস্যময় গল্পটা শুনতে। 

-মৌনি, আমার মেয়ে হলেও ওর কাছে আমি ওর সবচেয়ে ভালো বন্ধু ছিলাম। বেস্ট ফ্রেন্ড। আজ থেকে পাঁচ ছ' বছর আগের ঘটনাটা। ডাবলিনে আমাদের ব্যবসাটা এতো খারাপ যাচ্ছিল যে বন্ধ করে দেয়া ছাড়া কোনো উপায় দেখছিলাম না। নিরবও ডাবলিনে একা সবটা সামলে উঠতে পারছিল না। মৌনির অনার্সটাও শেষ হয়নি। কিন্তু মেয়ে জেদ ধরলো ও নিজেই এবার ব্যবসার হাল ধরবে। কিছুতেই কারো আপত্তি শুনে না মেয়েটা। পড়া মাঝপথে ছেড়ে এমন পাগলামি জেদ করলে কি আর মানা যায়? ওকে আটকানোর জন্যই বললাম, ডাবলিনে নিজেদের বিজনেস সামলানোর সুযোগ ওকে দেয়া হবে। তবে শর্ত হলো নিরবকে বিয়ে করতে হবে। নিরব-আমার বোনের ছেলে। মৌনি খুব একটা আগ্রহ দেখায় নি কখনো ওকে নিয়ে। ওর জীবনের চাওয়াগুলো অন্যরকম ছিল। কিন্তু সেদিন আমাদের সবাইকে অবাক করে দিয়ে মৌনি আমার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেল। তবে ওরও শর্ত বিয়ে হবে ওরা দুজনে ডাবলিন থেকে ফেরার পর। ছোটোখাটো আয়োজনে মৌনি আর নিরবের এ্যাঙ্গেজমেন্টটা করে ফেললাম আমরা। আর এর পরদিনই মৌনি নিরবের সাথে ডাবলিনে চলে যায়। 

আহমাদ খানের কথা শুনে রাহাত নিজেও থ হয়ে গেল। স্মৃতির এঙ্গেজমেন্ট হয়েছিল নিরবের সাথে! তাহলে কথাটা ও রাহাতের কাছে গোপন করলো কেন? এমন কি নিজের পরিচয়টাও মেয়েটা রাহাতের কাছ থেকে লুকিয়েছে। কিন্তু কেন? আর কি এমন ঘটেছিল সেদিন যে মেয়েটা হুট করে ডাবলিন শহর থেকে একেবারে নিশ্চিহ্ণ হয়ে গেল? আর এখনই বা কোথায় আছে? রাহাতের এতোগুলো প্রশ্নের উত্তর পাওয়া এখনও বাকি। এদিকে কেউ একজন টলমলে পায়ে যে পিছু হটছে সেটা এতো চিন্তা, প্রশ্ন, আর দ্বিধার মাঝে ওরা কেউ খেয়ালই করলো না। 

২৪!! 

-আর কেউ জানুক না জানুক আমি জানতাম মৌনি খুব কৌশলে আমাদেরকে বোকা বানিয়ে নিজের জেদটা পূরণ করেছে। মেয়েটার কোনো ইচ্ছে আমি কখনো অপূর্ণ রাখি নি, তাই সেদিন সব বুঝতে পেরেও চুপ রইলাম। ও যে নিরবের সাথে আমাদের কোম্পানির ফার্মহাউজে থাকবে না এটাও বেশ জানতাম আমি। তাই মৌনি আয়ারল্যান্ডে পৌঁছানোর আগেই হোটেল গ্রান্ডভ্যালিতে ওর জন্য একটা রুম বুক করে রাখি। ডাবলিন শহরে পৌঁছেই আমাকে কল করে মৌনি হোটেলের ব্যবস্থা করতে বললে আমিও হেসে ফেলি। আর আমার কাছে আগেই ধরা পড়ে যাওয়ায় আমার মেয়েটাও যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। কারণ আমার সাথে এই লুকোচুরি খেলাটা মেয়েটা কিছুতেই করতেও পারত না। 

আহমাদ খান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ বুজে নিজের মেয়ের মুখটা মনে করার চেষ্টা করেন। তার দুই মেয়ের মধ্যে মৌনি ঠিক যতটা দুষ্ট ততটাই বাবার আদরের। দিয়া মৌনির মতো ততটা বাবার আশেপাশে ঘুরে না বলেই আহমাদ খান মৌনিকে হয়তো দিয়ার চেয়েও বেশি ভালোবাসেন। কথাগুলো ভাবতেই আরেকটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো আহমাদ খানের বুক চিরে। রাহাত স্তব্ধ হয়ে আহমাদ খানের মুখের দিকে তাকিয়ে পরের অংশটা শোনার অপেক্ষায় অধীর হয়ে বসে আছে। মনের মধ্যে কেমন একটা কু ডাকছে রাহাতের। স্মৃতির কি হয়েছে সেটা না জানা পর্যন্ত কিছুতেই শান্তি পাচ্ছে না বেচারা। আহমাদ খান মুখ তুলে রাহাতের দিকে তাকিয়ে আবার বলা শুরু করলেন। 

-আয়ারল্যান্ডে যাওয়ার কয়দিন পরেই মেয়েটার বিহেভিয়ার পুরোই বদলে গেল। হুটহাট প্রচন্ড রেগে যেত। বারবার জিজ্ঞেস করলেও কিছুই শেয়ার করতো না কারো সাথে। এদিকে নিরবের কাছে শুনলাম অফিসে কাজের প্রেশার হ্যান্ডেল করতে পারছে না আমার ছোট্ট মৌনিটা। একদিন তাই ধমক লাগিয়ে বললাম বিজনেস চুলোয় যাক, তুই কয়টা দিন ব্রেক নে। তারপর আবার শুরু করিস। ভালো না লাগলো দেশে ফিরে আসিস। আপাতত এতো দূর একটা দেশে গেছে, একটু ঘুরাঘুরি করবে, লাইফটা এনজয় করবে তা না, মেয়ে স্ট্রেস নিয়ে বসে আছে! আমার কথামতো কয়েকদিনের ব্রেক নিয়ে একটা দলের সাথে আয়ারল্যান্ড ট্যুরে বের হলো মৌনি। ট্যুরটা শেষ হওয়ার আগেই একদিন সব ছেড়েছুড়ে হোটেলে ফিরেই আমাকে কল করলো। আমি তো অবাক। সেদিন মৌনির কাছে নামটা প্রথম শুনেছি আমি। মাহবুব চৌধুরী। তোমার ফার্স্ট নেমটা হয়তো মৌনি জানতে পারে নি তখনো। 

-হোয়াট! আয়ারল্যান্ডে গ্রাজুয়েশন করার সময় মাহবুব চৌধুরী নামটাই ব্যবহার করেছিলাম। খুব ক্লোজ কেউ ছাড়া রাহাত নামটা কেউ জানত না। কিন্তু স্মৃতি আমাকে চিনলো কি করে?

-তোমাকে মৌনি কোথায়, কখন দেখেছিল সেসব আমাকে কিছুই বলে নি। শুধু বলেছিল বিয়ে করলে ও তোমাকেই করবে। এদিকে আমিও পড়লাম মহা মুশকিলে। হুট করে তো ওর আর নিরবের এঙ্গেজমেন্টটাও ক্যান্সেল করে দিতে পারতাম না। আর তোমার সম্পর্কেও প্রায় কিছুই জানতাম না আমি। যতটুকু জানার তাও জেনেছি মৌনির কাছ থেকে। এদিকে ওকে আটকাবে সে সাধ্য কার! মাস খানেক যেতে না যেতেই একদিন মৌনি হোটেল থেকে কল করে জানালো ও তোমার বাড়িতে শিফ্ট করবে। শুনেই আমার রীতিমতো হার্টএ্যাটাক হওয়ার অবস্থা। জানা নেই শোনা নেই এমন একজনের বাড়িতে গিয়ে থাকবে আমার মেয়ে! মানা যায়? কিন্তু মৌনিরও এক কথা। কাছাকাছি থাকলে তবে না বুঝতে পারবে তার সাথে সারাটা জীবন কাটাতে পারবে কি না। এবারেও নিজের মতামতটাই বেছে নিল মেয়েটা। তোমার অফিসে জয়েন করেছে, মাঝেমাঝে হুটহাট সময়ে আমাদের অফিসে গিয়ে হানা দিচ্ছে। কিন্তু সমস্যা বাঁধলো যখন নিরব দেশে ফিরে এলো। 

-কেন?

-আরো মাস তিনেক পর নিরব বাড়িতে ফিরেছে। একা। নিরবের একা বাড়ি ফেরায় সবার হাজারটা প্রশ্ন বানের মুখে পড়তে হলো আমাকে। মৌনির কাজকর্মের খবরাখবর আমি জানবো না এটা তো হতেই পারে না। আমাকেও বাধ্য হয়ে সবটা স্বীকার করে নিতে হলো মৌনতার মায়ের কাছে। মেয়ে যতটা না জেদী তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি জেদি ছিল তার মা। আর তাদের মা মেয়ের মাঝখানে আমি ফেঁসে গেলাম। মৌনিকে তখনই কল করে দেশে ব্যাক করতে বলে ওর মা। মৌনিও সাফ জানিয়ে দেয় নিরবকে ও বিয়ে করবে না। কয়েকদিন এসব নিয়ে মা মেয়ের মধ্যে বাকযুদ্ধ চললো। শেষে মৌনির মা হতাশ হয়ে মৌনিকে ফেরানোর আশাই ছেড়ে দেন। আমাদের আয়ারল্যান্ডের বিজনেসটা লস হওয়ার কারণ ও নাকি জানতে পেরেছে নাকি মেয়েটা তখন। এদিকে কিছুদিন দেশে থেকে নিরব আয়ারল্যান্ডে ফিরে গেছে। সপ্তাহ খানেক পর হঠাৎ একদিন নিরব কল করে জানালো মৌনি দেশে ফিরছে। প্লেনেও নাকি কেঁদেকেটে একাকার করেছে মেয়েটা। কারণটা আর জানা হলো না।

-কেন? ও দেশে ফিরে আসে নি? স্মৃতিকে তো আমি পুরো ডাবলিন শহরে তন্নতন্ন করে খুঁজেছি। পাই নি।

-হাহ্। ফিরেছিল আমার মেয়েটা। তবে আমার কলিজার টুকরো চোখের মণিকে আর দেখার ভাগ্য আমার হয়নি। নিরবের কলটা পেয়ে ওদের অপেক্ষায় ছিলাম আমি। তোমাদের বিয়ে হওয়ার পর দেশে ফিরবে বলেছিল মৌনি। হঠাৎ কি এমন হলো যে মেয়েটা একা ফিরছে তাও কাঁদতে কাঁদতে! কিছুই বুঝতে না পেরে অপেক্ষা করতে লাগলাম ওর ফেরার। আমার মৌনি ফিরেছে ঠিকই। সাদা কাপড়ে মোড়া তখন ওর শরীরটা। 

-হোয়াট!

নিজের কানকেই যেন বিশ্বাস করতে পারলো না রাহাত। ওর স্মৃতি পাঁচ বছর আগেই ওকে ছেড়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছে কথাটা ভাবতেও পারছে না রাহাত। রাহাত ধপ করে আহমাদ খানের সামনে গলির ঢালাই দেয়া রাস্তায় বসে পড়লো। কোনমতেই নিজের চোখের পানি আটকাতে পারছে না রাহাত। যে তিনটে মাস স্মৃতি ওর সাথে ছিল সেই স্মৃতিগুলো বুকে আগলে এতোগুলো বছর স্মৃতির মুখোমুখি হওয়ার অপেক্ষায় ছিল রাহাত। সামনে এলে ওকে ক্ষমা করতে পারত কিনা রাহাত নিজেও জানে না। কিন্তু দূরেও যে ঠেলে দিতে পারতো না সেটাও রাহাত জানে। তাই এতোগুলো দিন মেয়েটার ফেরার অপেক্ষায় বসে ছিল রাহাত। কিন্তু আজ! রাহাত কোনমতে কাঁপা হাতে আহমাদ খানের হাত চেপে ধরে বসে রইলো রাস্তায় মাঝেই। নিজেকে বড্ড বেশিই অসহায় লাগছে ওর। স্মৃতি এভাবে ওকে ফাঁকি দিবে সেটা কল্পনারও অতীত রাহাতের জন্য। 

-কি করে হলো আঙ্কেল? ও একদম সুস্থ ছিল। কিছু নিয়ে টেনশন করছিল ঠিকই--। কিন্তু সি ওয়াজ এ্যাবসুলুটলি অল রাইট। কি করে---?

-নিরবেরও মাথায় অনেকটা আঘাত লেগেছিল। ওর কাছেই জানতে পারলাম ওরা এয়ারপোর্ট থেকে ফেরার পথে ওদের গাড়ির উপরে এ্যাটাক করে কেউ। এক্সিডেন্টে ড্রাইভার স্টপ ডেড। মৌনিকে হসপিটালে নেওয়ার পথেই---। নিরবেরও জ্ঞান ফিরে প্রায় ১০-১২ ঘন্টা পর। ওই মৌনির---বডিটা নিয়ে আসে। তখনও আমরা জানতাম না আমাদের মেয়েটা আর-আর নেই----।

-কে করিয়েছিল ওর উপরে এ্যাটাক আঙ্কেল? জানতে পারেন নি কিছু? 

রাহাতের প্রশ্নটা যেন শুনতে পেলেও যেন বুঝতে পারেন নি এমন শূন্য দৃষ্টিতে কয়েক সেকেন্ড রাহাতের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে মাথা নিচু করে আবার বলা শুরু করলেন।

-মৌনির মা মৌনির ক্ষত বিক্ষত দেহটা দেখে সহ্য করতে পারে নি। মেয়েটার কাফনে ঢাকা শরীরটার সামনেই ফ্লোরে মুখ থুবড়ে পড়ে মৌনির মা। মুখে না বললেও সেও তো মৌনিকে আমার মতোই ভালোবাসত। আর এই একটা দিনে আমি আমার জীবনের সবচেয়ে ইম্পর্ট্যান্ট দুজন মানুষকে একদম এক নিমিষেই  হারিয়ে ফেললাম। পর পর এতোগুলো আঘাত আমিও নিতে পারি নি। শুধু ছোট মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে আর ওর ভবিষ্যতের কথা ভেবে নিজেকে শক্ত করে শুধু বেঁচে আছি----।

-কিন্তু যে বা যারা এ্যাটাক করেছিল তারা? তাদের কি হলো? ওদের শাস্তি হয়নি? 

রাহাতের প্রশ্নটার জবাব না দিয়ে আহমাদ খান দুহাতে মুখ ঢেকে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। রাহাতের প্রশ্নের উত্তর যে তার কাছেও নেই। মায়া এবারে এগিয়ে এসে পরম মমতায় আহমাদ খানের কাঁধে হাত রাখলো।

-আঙ্কেল আপনি নিজেকে একটু শক্ত করুন। মৌনি আপুর সাথে, আন্টির সাথে যে অন্যায়টা হয়েছে সেটার সাথে জড়িত কালপ্রিটটাকে তো ধরতে হবে। আর তার মুখোশটা যখন আপনার সামনে আসবে তখন নিজেকে শক্ত রাখতে হবে আপনাকে। দুর্বল হলে চলবে না। 

মায়ার কথাটা শুনে আহমাদ খান আর রাহাত দুজনেই অবাক দৃষ্টিতে তাকালো। রাহাত কোনমতে রাস্তা থেকে উঠে মায়ার কাঁধে হাত দিয়ে জোরে কয়েকবার ঝাঁকি দিলো। মায়া এতোটা যখন জানে তারমানে বাকিটাও মায়া জানে বা জানার পথ খুঁজে পেয়েছে। এই কথাটাই রাহাতের মাথায় খেলা করছে। রাহাত আর আহমাদ খান দুজনের ব্যথিত মুখটা দেখে মায়ার নিজের কাছেও খারাপ লাগছে। দুজন মানুষই তাদের প্রিয়জনকে হারিয়েছে। তাদের দুঃখটাও এক, আর সেই দুঃখ দূর করার ওষুধটাও এক। একটা সত্য- যা সবটা সবার চোখের সামনে আলোর মতো ফুটিয়ে তুলবে। মায়া কথাগুলো ভাবতে ভাবতে রাহাত আবার মায়ার কাঁধে একবার ঝাঁকি দিয়ে দু হাত জড়ো করে মায়ার সামনে দাঁড়িয়ে রইলো।

-প্লিজ মায়া। এতোটা যখন তুমি নিজের চেষ্টায় বের করেছ তাহলে আমাকে বাকিটাও বলো। কি ঘটেছিল ওইদিনটায়? স্মৃতির ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের অফিসে আসার কথা ছিল। তাহলে কি এমন হলো যে---। আমাকে কিছু না বলে, না জানিয়ে সোজা দেশে চলে এলো? ডাবলিন থেকে কি করেই বা বের হলো স্মৃতি? আমি পুরো শহর, এয়ারপোর্ট, হসপিটাল সব জায়গায় খোঁজ করেছি। তবু কি করে ও আমার নজরেই পড়লো না সেদিন?

-আমার যতটুকু মনে হয় মৌনি আপু মানে আপনার স্মৃতি সেদিন ডাবলিন এয়ারপোর্টে নয় অন্য কোনোভাবে দেশে এসেছে। 

-হোয়াট! কিন্তু কেন!

-কারণ কেউ একজন চায় নি আপনি স্মৃতিকে খুঁজে পান। ছোট্ট একটা গল্প বলি শুনুন। মৌনি আপু জেদ ধরে আয়ারল্যান্ডে নিজেদের মৃতপ্রায় ব্যবসার হাল ধরতে এসেছিলেন। হয়তো কিছু নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছিল উনার মনে। তাই আগেপিছে একদম না ভেবেই সব শর্তে রাজি হয়ে ডাবলিনে আসে। আঙ্কেল ভেবেছে আপু জেদ করে এমনটা করছে। কিন্তু না। আপু কিছু খুঁজছিল। নিশ্চিত প্রমাণ ছাড়া যার বিরুদ্ধে কিছু বললেও কেউ বিশ্বাস করবে না এমন একজনের বিরুদ্ধে প্রমাণ খুঁজছিল আপু। ডাবলিনে এসে হয়তো সন্দেহ আরো দৃঢ় হয় কিন্তু প্রমাণ না পেয়ে আপুর মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার অবস্থা। এই সময়টায় কেউ ভিষণ কৌশলে আপুকে অফিস থেকে দূরে সরানোর প্ল্যান করে আর সফলও হয় কিছুটা। 

-কে! কিসের প্রমাণ! কিসব বলছ? 

-শুনুন আগে। আপনিও বুঝতে পারবেন তাহলে। তারপর বলি শুনুন। আপু আঙ্কেলের কথায় কিছুদিন ব্রেক নিবে বলে হয়তো ছেলেদের বেশ ধরে ডাবলিনেই অফিসের আশেপাশে কোথাও নজর রাখছিলেন। সেখানেই হয়তো কোনোভাবে আপনাকে দেখে ভালো-ভালো লেগে যায় উনার। কি ঘটেছিল সেটা আপুই ভালো জানে। তারপর আপু ধীরে ধীরে আপনার সম্পর্কে সব খোঁজ খবর নেয়। একদিন হুট করেই আপনার সামনে পড়ে যায় হয়তো। অথবা ইচ্ছে করেই। যাই হোক। সেখান থেকে উনি আপনার বাসায় থাকতে শুরু করে। আপনি যখন ক্লাসে ব্যস্ত থাকতেন ওই সময়টাই আপু নিজেদের অফিসের উপরে নজর রাখতেন হয়তো। 

-এতো লুকোচুরি কেন? ও আমাকে বললেই তো---কিছু অন্তত করতাম ওর টেনশন দূর করার জন্য!

-আপু হয়তো এসব নোংরা খেলায় আপনাকে জড়াতে চায়নি। তবু হয়তো বলেই দিতো। এদিকে আন্টিও জেনে যায় আপু নিরবকে বিয়ে করবে না। শুরু হয় নতুন অশান্তি। এদিকে যার উপরে নজর রাখতে এতো সাবধানে কাজ করছিল তার কাছেও ধরা পড়ে যায় আপু। আর সেদিন সেই লোকটাকেই আপনি দেখেছিলেন। কথাগুলো শুনতে পেলে হয়তো আপনার কনফিউশান তখনই দূর হয়ে যেত---। আপনি কি লোকটাকে চিনতে পেরেছেন? বলুন তো কে ছিল!

-চেহারাটা ভালো করে দেখি নি আমি। দূর থেকে যাওয়ার সময় এক নজর দেখেছিলাম শুধু। ওই একবারই। ঠিক মনে করতে পারছি না চেহারাটা----।

-মনে করুন স্যার। সেদিন ডাবলিন শহরের ভিড়ে আপনি আপুকে ছদ্মবেশেও চিনে ফেলতে পেরেছিলেন। আজ এই কয়জনের মধ্যে চিনবেন না তাকে?

-মানে! সে লোকটা এখানে আছে? কে বলো আমাকে মায়া---।

-সেটা তো আপনিই বলতে পারবেন আছে কি না। চোখ বুজে তার চেহারাটা মনে করার চেষ্টা করুন স্যার। কোন কি মিল খুঁজে পাচ্ছেন?

-হ্যাঁ---। হ্যাঁ--। চেহারাটা মনে পড়েছে আমার। একটু আগেও তো লোকটা ছিল এখানে। শওকত! আপনাদের এম.ডি---। কি নাম উনার? আনসার মি ড্যাম ইট। হয়ার ইজ হি?

-উনিই হলেন নিরব। স্মৃতির ফিওয়ন্সে, কাজিন ব্রাদার আর আমাদের বাকি গল্পটা উনিই শোনাতে পারবেন। 

-গেল কোথায় লোকটা? এখানেই তো ছিল?

-রিল্যাক্স স্যার। দুটো সপ্তাহ এতো দৌঁড়ঝাপ করে যাকে খুঁজে বের করলাম তাকে কি এমনি এমনিই যেতে দিবো নাকি? ঘুরেঘুরে আজ তাকে এখানেই ফিরতে হবে। এই গোলকধাঁধা থেকে কোথাও পালানোর সুযোগ নেই আজ উনার।

রাহাত মায়ার এমন হেয়ালি কথার কিছুই বুঝতে পারছে না। আবার মায়াকে কেমন রহস্যময়ী লাগছে রাহাতের কাছে। কিন্তু স্মৃতির বাকি কাহিনীটা তো জানতে হবে রাহাতকে। তার জন্য তো নিরবকে চাই এখন। কোথায় গেল লোকটা? নাকি ওদের সবার অসাবধানতার সুযোগে পালিয়ে গেছে? লোকটাকে পাতাল থেকে হলেও খুঁজে বের করবে রাহাত আজকে। এতোগুলো বছর ধরে কত শত প্রশ্ন জমে আছে রাহাতের মনে। সবগুলো প্রশ্নের উত্তর যে রাহাতকে জানতেই হবে। যে করেই হোক আজ ওই লোকটার কাছ থেকে রাহাতের উত্তরগুলো চাই ই চাই।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন