ব্যাগটা নিয়ে নিচে নামতেই রুদ্রের চক্ষুচড়ক গাছ। সে কল্পনাতেও ভাবে নি এই সময়ে তার সামনে শাশ্বতের আগমন ঘটবে। বলা নেই কয়া নেই শহর থেকে শাশ্বত এসেছে। সে তো শুধু বছরে এক বার ই গ্রামে আসে। কিন্তু এখন তার আসার কি কারণ। শাশ্বতের আকস্মিক আগমনে অভিনব সিংহের থমথমে মুখে বাক্য নেই। শাশ্বত কাঁধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে অবাক কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো,
"রুদ্র কি কোথাও যাচ্ছিস?"
আমতা আমতা করে রুদ্র বললো,
"কাজে যাই"
"কি কাজ? আমি যতদূর জানি গ্রামের বাহিরে তেমন কোনো কাজ নেই মামা মশাই এর। কি কাজে যাচ্ছিস?"
শাশ্বতের হঠাৎ প্রশ্নে কিংকর্তব্যবিমূঢ় রুদ্র। সে কিছু বলার আগেই অভিনব সিংহ গম্ভীর কন্ঠে বলেন,
"ও বেনাপোল যাচ্ছে শাশ্বত। বর্ডার থেকে আঙ্গুর আসছে। জানোই তো শীত এসেছে। এখন ফলফলাদি আসবে, বেশ কিছু মালামাল ও আসছে। আমাদের আমদানি রপ্তানির ব্যাবসা৷ প্রতি মাসেই বেশ কিছু মালামাল আসে, আবার যায়। এ নিয়ে এতো প্রশ্নের কি আছে? প্রতিবার আমি যাই, এবার রুদ্র যাবে।"
শাশ্বত, মামা মশাই এর উত্তরে সন্তুষ্ট হতে পারলো না। কারণ একজন গ্রামের চেয়ারম্যানের এতো বড় ব্যাবসা হওয়াটা পূর্বে সন্দেহ না জাগালেও এখন কেনো যেনো খটকা লাগছে। মালামাল আমদানি রপ্তানি ব্যাবসা অভিনব সিংহের। ব্যাবসাটা প্রথমে এতো বড় ছিলো না, অভিনব সিংহের পিতার মৃত্যুর পর সে এই গ্রামের চেয়ারম্যান হন। তাদের কারবার বলতে গ্রামের বাজারের বড়ো চালডালের আরদটাই ছিলো। এই আরদের ব্যাবসা হুট করেই আমদানী রপ্তানিতে পরিবর্তিত হলো। গ্রামের চেয়ারম্যান রাজনীতিতে যোগ দিলেন। বিভিন্ন পার্টির উচ্চপদস্থ নেতাদের সাথে বেশ ভালোই পরিচিতি হলো অভিনব সিংহের। তিনি চাইলে শহরে পাড়ি জমাতেই পারতেন কিন্তু গ্রামের সত্ত্বা ছাড়তে চাইলেন না। এটা অবশ্য একটা দিকে বের উপকার ও হয়েছে। দলের লোকে তার একটা বেশ ভারী প্রভাব রয়েছে। উপজেলার চেয়ারম্যান পদেও তিনি বিগত পনেরো বছর যাবৎ এক তরফা জিতে আসছেন। কিন্তু একটা আরদ ব্যাবসায়ীর এতো দাপট কিভাবে? শুধু রাজনীতিতে নেতাদের সাথে ভালো সম্পর্ক তাই? শাশ্বত অংক মেলাতে পারছে না। গণিতে যেমন ডানপক্ষ এবং বামপক্ষের মিল হলেই সমাধান বেড়িয়ে যায় ঠিক তেমন ই জীবনের গণিতেও ডানপক্ষ বামপক্ষ মিলাতে হয়। নয়তো অজানা সংখ্যাটির মান বের করা যায় না। শাশ্বত সেই অজানা সংখ্যাটি ই খুঁজতে এসেছে। ইচ্ছে করেই সে ঢাকা থেকে বদলি টা বিভাগীয় শহরে না করে সাতক্ষীরার মতো ছোট জেলায় করেছে। শাশ্বতের এই হুট করে বদলিটা মামা মশাই এর অজানা থাকাটাই শ্রেয়। সময় আসলে সব কিছুই সবাই জানবে। মামামশাই মাত্রাতিরিক্ত বুদ্ধিমান ব্যাক্তি। তিনি খুব সহজেই শাশ্বতের আকস্মিক আবির্ভাবের কারণ বের করে ফেলবেন। তাই তার সন্দিহান নজর এড়াতে শাশ্বতও রুদ্রকে ছেড়ে দিলো। ঠোঁটে হাসির প্রলেপ একে বললো,
"মামামশাই, রাগ করবেন না। আমি তো এমনেই প্রশ্নটি করেছি। কৌতুহল বলতে পারেন।"
"বেশি কৌতুহল কিন্তু ভালো নয় শাশ্বত"
"কৌতুহল না থাকলে রহস্যের উম্মোচন কি করে করবো বলুন তো মামামশাই? তাহলে তো আমার সাংবাদিকতাই বৃথা।"
অভিনব সিংহ দমলেন। শাশ্বতকে ঘাটানোটা ঠিক উচিত হবে না। ঘুমন্ত সিংহ জাগলেই বিপদ। মহা বিপদ। নিজের ক্ষীন ভয়কে নিপুন ভাবে আড়াল করে তিনি রুদ্রের উদ্দেশ্যে বললেন,
"মা এর নাম নিয়ে বের হও। তিনি চাইলে এবারের কাজে কোনো বিপদ হবে না আশা করি।"
"জ্বী বাবা, ভরসা রাখুন। কোনো অসুবিধা হবে না"
রুদ্রের সাথে কিছুক্ষণ নিঃশব্দে দৃষ্টি বিনিময় ঘটলো শাশ্বতের। এই দৃষ্টি বিনিময় প্রতিদ্বন্দীকে ভয় দেখানোর প্রচেষ্টা। তাকে সতর্ক করা, সাবধান করা যেনো তার সীমানা লঙ্ঘন না করে শত্রু৷ শাশ্বতের ঠোঁটে হাসির প্রলেপ, চোখে এক অদ্ভুত রহস্য। রুদ্র বেরিয়ে গেলো। লক্ষী দেবী প্রনাম করে বললেন,
"দূগগা, দূগগা"
রুদ্রের চলে যাবার পর নিজ ঘরে আসে উমা। ঘরটা নিস্তব্ধ, কোনো চিৎকার নেই, কোনো কোলাহল নেই। কারোর নিষ্ঠুরতার ছাপ নেই, নেই কোনো ক্রুদ্ধতা। টেবিলের উপর অবহেলিত আলতার বাটিটি পরে রয়েছে। বিকেলের সেই মূহুর্তগুলো চোখের সম্মুখে ভেসে উঠলো। মূহুর্ত যেনো জীবন্ত। রুদ্রের যাবার পর থেকেই এক অদ্ভুত বিষন্নতা ভর করলো উমার হৃদয়ের প্রাচীরে। কেনো যেনো এক সূক্ষ্ণ শূণ্যতা অনুভব হচ্ছে উমার। শুন্যতার কারণ কি! রুদ্রর অনুপস্থিতি! উমার জানা নেই এই শুন্যতার কারন। বিছানায় গা এলিয়ে উমা। ক্লান্ত বিষন্ন চোখজোড়া নিমিষেই বুজে আসে। তলিয়ে পড়ে ঘুমের সমুদ্রে।
৯!!
রকিবুল মাষ্টারের ঘরে বসে রয়েছে শাশ্বত। তার সামনে তেলের পিঠা এবং পেয়ারা কেটে দেওয়া হয়েছে। রকিবুল মাস্টারের বউ হাসনা তাকে আপ্পায়ন করতে ব্যাস্ত। চেয়ারম্যানের ভাগ্নে বলে কথা। তার সম্মান তো রাখতেই হয়। শুধু রকিবুল মাষ্টার নির্বিকার। সে সরু দৃষ্টিতে শাশ্বতের দিকে চেয়ে রয়েছে। তার মনে বহু প্রশ্ন। ছেলেটা পুজোর সময় বেশ তার আশেপাশে ঘুরঘুর করেছে। তথ্য যোগাড় করতে নানা ভাবে নিজের উপর বিশ্বাস তৈরি করতে চেয়েছে, কিন্তু রকিবুল মাষ্টারকে ভোলানো এতো সোজা নয়। সে কিছুতেই ভুলবার ব্যাক্তি নয়। তাই নিপুন ভাবে কাটিয়ে দিয়েছে সকল কিছু। তবে এখন মনে হচ্ছে আটঘাট বেঁধে এসেছে শাশ্বত, তাই তো কথায় কথায় বারংবার তার মেয়ের কথা তুলছে। শিমুল সাতক্ষীরার সরকারি কলেজে ইন্টার পড়ছে। মেয়েটি গ্রামের প্রথম মেয়ে যে কি না মেট্রিক পাশ দিয়ে সাতক্ষীরা জেলায় প্রথম হয়েছে। তাই জেলা কমিশনার নিজ থেকে মেয়েটিকে খরচা দিয়ে ভালো সরকারী কলেজে ভর্তি করিয়েছেন। শাশ্বত বারবার শিমুলের কথাই তুলছে। হাসনা ঘরের ভেতর চলে গেলে রকিবুল মাষ্টার ভনিতা ছেড়ে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়,
“এতো সক্কালে আমার কাছে কি চাই তোমার? শুধু শিমুলের খোঁজ দিতে তো আসো নি তুমি। তাহলে?”
“উত্তর চাই? প্র্শ্নের উত্তর। প্রশ্নগুলো কি তা আপনার জানা”
“যদি না দেই?”
“সমস্যা নেই, আমি আবার আসবো। বারবার আসবো। প্রশ্নের উত্তর যে আমার চাই রকিব সাহেব”
শাশ্বতের উত্তরে হাসলো রকিবুল মাষ্টার। তার হাসিতে তাচ্ছিল্য, তারপর হাসি থামিয়ে বললো,
“বেশ তবে এবার আসো।“
“উত্তর দিবেন না তবে?”
“নাহ, আজ দিবো না। আগে তুমি নিজে উত্তর খোঁজার চেষ্টা করো, গ্রামের দক্ষিণের নদীতে একটা ব্রীজ করা হয়,। উপজেলার চেয়ারম্যান হিসেবে ব্রীজটা তোমার মামাই করেছিলেন কিন্তু ব্রীজটা এক মাসের ভেতর ভেঙ্গে যায়। যে ইঞ্জিনিয়ার পদে ছিলেন তিনি গায়েব। কোথায় তিনি? খুজে আনো, নয়তো উত্তর আনো”
রকিবুল মাষ্টার কথায় মাথায় বাজ পড়ে শাশ্বতের। একটা ব্রিজ ধসেছে অথচ এই খবর উপজেলা থেকে বের হয় নি। এও কি সম্ভব? তোর শব্দ নেই, কোনো তথ্য নেই একজন ইঞ্জিনিয়ার উধাও তো হয়ে যাবে না। তার কিছু তো তথ্য হবে। শাশ্বতের চিন্তিত মুখখানা দেখে হাসে রকিবুল মাষ্টার। তারপর বলে,
“উত্তর নিয়েই আসবে, কেমন? এবার আসো”
শাশ্বত কথা বলে না। একরাশ প্রশ্ন এবং চিন্তার স্রট ণীয়ে বেরিয়ে যায় রকিবুল; মাষ্টারের বাড়ি থেকে। মাথাটা শুন্য হয়ে রয়েছে। রহস্যের জাল তাকে মাকড়সার জালের ন্যায় জড়িয়ে ফেলছে। এই মনে হচ্ছে জালের প্রকটতায় দম আটকে যাবে শাশ্বতের। গ্রামের পথ দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে শাশ্বত। সূর্যের প্রখরতা তাকে ছুয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেদিকে তার দৃষ্টি নেই। তার মস্তিষ্ক একটাই প্রশ্ন করছে। ব্রীজটা ভাঙ্গলো কিভাবে? আর ইঞ্জিনিয়ার কোথায়?
গভীর রাত,
বর্ডারের সীমান্তে এসে দাঁড়িয়ে আছে রুদ্র। সাথে পাঁচজন লোক। মালের গাড়ি প্রবেশ করছে চোরাই পথে। একে একে মাল বুঝে নিচ্ছে রুদ্র। মুখে প্রশান্তির হাসি। এবার বাবা সন্তোষের কারণ হবে সে। হঠাৎ কালো অন্ধকার চিরে একটা সোনালি আলো চোখে এসে বিধলো রুদ্রের। চোখ কুচকে এলো তার। তখনই……
—————
গভীর রাত,
বর্ডারের সীমান্তে এসে দাঁড়িয়ে আছে রুদ্র। সাথে পাঁচজন লোক। মালের গাড়ি প্রবেশ করছে চোরাই পথে। একে একে মাল বুঝে নিচ্ছে রুদ্র। মুখে প্রশান্তির হাসি। এবার বাবা সন্তোষের কারণ হবে সে। হঠাৎ কালো অন্ধকার চিরে একটা সোনালি আলো চোখে এসে বিধলো রুদ্রের। চোখ কুচকে এলো তার। তখনই এক হিনহিনে কন্ঠ কানে আসে রুদ্রের।
“আমাদের নাকের ডগা দিয়ে বেআইনি কাজ করে পার পাওয়া কি এতো সোজা রুদ্র বাবু? কি ভেবেছেন রাতে নাকে সরষের তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছি? জ্বী না, এই আহমদ উল্লাহর চোখ ফাঁকি দেওয়া এতোও সোজা নয়”
রুদ্র লোকটার পানে সরু দৃষ্টিতে চাইলো। রোগা শুটকো একজন লোক, উচ্চতা রুদ্রের বুক অবধি, মুখের কাঁচা ফাকা দাঁড়ি, সরু নাকের নিচে পান খাওয়া লাল ঠোঁট। চক্ষুজোড়া কুঠরে ঢুকে আছে। লোকটার চোখের ভাষা বোঝার চেষ্টা করলো রুদ্র। বাবার বদৌলতে কম মানেষের সাথে তার পরিচয় হয় নি! মানুষের সাথে সাথে তাকে স্বভাব, চরিত্র অনুমান করার গুনটাও বাবা থেকে রপ্ত করেছে রুদ্র। তাই এই লোকটির ও স্বভাব বোঝার চেষ্টা করলো রুদ্র। আহমদ উল্লাহ বেনাপোলের কাস্টমস অফিসার। বেশ উচ্চ পদধারী। তাই তো এসেই হুমড়ি তুমড়ি করছে না। বরং সাথের বন্দুক ধারী অফিসারটি বেশ চোটপাট করছে। একে একে রুদ্রের সব বাক্স খোলা হলো। এগারোটা বাক্সে কেবল পেন্সিডিল, হেরোইন এবং গঞ্জিকা। হেরোইন, গাঁজার প্যাকেট গুলো হাতে নিয়ে শুকে দেখলো আহমদ উল্লাহ। মুখে বাঁকা হাসির প্রলেপ দিয়ে বললো,
“বাহ, মাল তো বেশ কড়া। তা কত টাকার মাল?”
“দশ লক্ষ”
জড়তাহীন কন্ঠে কথাটা বললো রুদ্র। তার মুখে মৃদু হাসি। সে আহমদ উল্লাহ চোখের ভাষা পড়ে ফেলেছে। লোভী চোখ টাকার গন্ধে মূহুর্তেই চকচক করে উঠেছে। আহমদ উল্লাহ খানিকটা অবাক হলো, হাতে নাতে ধরা পড়েও রুদ্র যেন নির্বিকার। তার চোখে ভয় নেই, নেই কোনো ত্রাশ। আহমদ উল্লাহ চাইলেই এই চোরাইকৃত, অবৈধ মাল বায়েজাপ্ত করে তাদের ধরিয়ে দিতে পারে। এই ভয়টা সকল পাচারকারীদের মধ্যে খুব পরিচিত। এই ভয় দেখিয়ে বেশ টাকা হাতিয়ে নেয় আহমদ উল্লাহ। সে চাইলো রুদ্রকে চমকে দিতে। চালান কেটে ভড়তে দিতে। যেনো রুদ্র নিজ থেকে তাকে টাকা সাদে। তাই সে কড়া কিন্তু শীতল স্বরে বললো,
“দশ লাখ টাকার অবৈধ কারবারি ধরা পড়লে কত টাকা জরিমানা জানা আছে?আর কত বছরে সশ্রম কারাদন্ড”
“জানা আছে সব ই কিন্তু প্রমাণ কি আমার দোষের?”
“আমি”
“দাম কতো এই সাক্ষ্ণীর?”
তীক্ষ্ণ হাসি দিয়ে প্রশ্ন টি ছুড়ে দেয় রুদ্র। রুদ্রের নির্বিকার চিত্তের প্রশ্নে চমকে যায় আহমদ উল্লাহ। এই প্রথম কেউ তার নিপুন চতুর বুদ্ধি ধরে ফেলেছে, আজ অবধি কত মানুষকে এভাবে ঠগেছে তার ঠিক নেই। আহমদ উল্লাহ এর হাসি মিয়ে গেলো। তার চোখে মুখে বিস্ময়ের ছাপ। আহমদ উল্লাহ লম্বাটে মুখখানা দেখে রুদ্রের হাসি প্রশস্ত হলো। সন্তোষের ছাপ তার চোখে। বিদ্রুপের স্বরে বললো,
“পঁচিশ হাজার টাকা চলবে?”
পঁচিশ হাজার টাকা শুনতেই চোখ চকচক করে উঠলো আহমদ উল্লাহ এর। কিন্তু সে পঁচিশ হাজার নিবে না, এবার বড় দাও খেলবে সে। কম করে হলেও এক লক্ষ টাকা তো নিবেই। নিজের সততা বেচবে এতো কমে? অসম্ভব। আহমদ উল্লাহ নিজেকে সংবরণ করে সুর টানলেন,
“সততার দাম মাত্র পঁচিশ হাজার? এ কেমন কথা। অন্তত মালের দশ ভাগের এক ভাগ তো পাওয়া উচিত”
রুদ্রের চ্রুযুগল কুঞ্চিত হলো। তীর্যক দৃষ্টি প্রয়োগ করলো সে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মৃদু হাসি দিয়ে বললো,
“বুকের পাটা তো বেশ চওড়া, তা একা আপনি গিলবেন নাকি ওই ছোকরাও আছে?”
“ওকে হাজার খানেক গুজে দিলে৪ই হবে।“
“বেশ, এই দীপংকর ওকে চা খাওয়ার টাকাটা দে। আর আপনি আমার সাথে চলুন। বাচ্চারা কাজ মিটিয়ে আগাক। আমরা নিরিবিলিতে কথা বলি।“
আহমদ উল্লাহ এর মুখে প্রশান্তির হাসি। এবার বড় মাছ জালে এসেছে। এই টাকা দিয়ে ঢাকার উত্তরাতে জমি কিনবে সে, এখন সেখানে শুধু পানি। নতুন শহর গড়বে সিটি কর্পোরেশন। আহা! সারাদিন রাত এই কেরানির চাকরি করে কি হবে। টাকাই তো আসল সুখ। টাকা থাকলে সমাদরের বর্ষণ হবে। মানীগুনী নেতারাও হুজুর হুজুর করবে। সেটা এই ঘুনে ধরা সমাজের নিয়ম। দীপংকর নামক ছেলেটি জোয়ানটিকে এগিয়ে নিয়ে গেলো। এদিকে এক নিরিবিলি অন্ধকার জায়গায় গল্প করতে করতে চলে গেলো রুদ্র এবং আহমদ উল্লাহ।
সব মাল নিপুনভাবে বর্ডারের এপাড়ে আনা হলো। একটা টেম্পো খুব সুন্দর ভাবে পাড় হয়ে গেলো কাস্টমস। রুদ্র এখনো আহমদউল্লাহ এর সাথে, কাজ শেষে দীপঙ্কর এলো রুদ্রকে সুখবর দিতে। কিন্তু জায়গায় পৌছাতেই শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল রক্তের স্রোত বয়ে গেলো তার। শীতল বাতাসের মাঝেই কপালে ঘাম জমছে দীপঙ্করের। স্বর যথাসম্ভব ধীর করে কাঁপা কন্ঠে বললো,
“এ কি করলে রুদ্রদা?”
রুদ্র তখন রুমাল দিয়ে তার মুখ মুছতে ব্যাস্ত। নীল পাঞ্জাবী লাল লহমায় রঞ্জিত হয়ে আছে। সামনে আহমদ উল্লাহ নিথর শরীর। উষ্ণ রক্তের বেগ এখন বইছে। পেটে ছোড়া মেরেছে। তাও অগণিতবার, যতক্ষণ না রুদ্রের রাগ দমেছে। দীপঙ্করের ভীত মুখখানা দেখে অদ্ভুত হাসি হাসে রুদ্র। এ হাসি এই ভুবনের নয়, এক ভয়ানক পৈশাচিক প্রবৃত্তি লুকিয়ে আছে এই হাসির আড়ালে। পরমুহুর্তে হাসি থামিয়ে বলে,
“শালাকে পুতে দে, আমায় ভয় দেখাচ্ছিলো। এবার বোঝ, কত ধানে কত চাল”
“জ্যাঠা রাগ করবেন, কেনো করলে এমনটা?”
“জানোয়ারকে জানোয়ার মারবে, এটাই নিয়ম। সৎ হলে ভয় পেতাম, অসৎ লোককে মেরেছি এখন কিসের ভয়? এতো ভাবিস না। পুতে দে। বাবাকে আমি বলবো ক্ষণে।“
ভেজা মাটিতে রাতারাতি পোতা হলো আহমদ উল্লাহ কে। প্রযুক্তির উপযুক্ত ব্যাবহার শুরু হয় নি বিধায় রাতের আধারেই ঘটনাটা চাপা পড়ে থাকলো সীমান্তের ভেজা মাটিতে। আকাশে মেঘের গর্জন শোনা যাচ্ছে, আকাশের বুক চিরে শত জলরাশি পৃথিবীর পানে নামতে লাগলো। শার্টের তাজা রক্ত মিলিয়ে যাচ্ছে, রুদ্রের দৃষ্টি আকাশের পানে। মুখে উজ্জ্বল হাসি। এবার তার ফেরার পালা।
গ্রামের মেঠোপথ দিয়ে হেটে যাচ্ছে শাশ্বত। বাজারে যেতে হবে তাকে। প্রতন্ত্য গোপিনাথপুরের এই একটাই অসুবিধা। যোগাযোগ করতে বাজারে ছুটতে হয়। সারা গ্রামে একটা ফোন ও নেই। অথচ ঢাকাতে মানুষ হাজার হাজার টাকা খরচ করে মোবাইল কিনছে। প্রযুক্তির নতুন সংযোজন, মোবাইল ফোন। কোনো তার ব্যতীত একটা ছোট ডিব্বা যা দ্বারা কথা বলা যায়। কামাল সাহেব একখান কিনেছে, বেশ দামী। হাজার পনেরো লেগেছে, সেটায় এখন তিনি কথা বলেন। ঢাকার পিচের রাস্তা দিয়ে হাটার সময় ও কথা বলা যায়৷ নম্বরটা মুখস্ত শাশ্বতের। দু তিনবার ফোন করেছিলো। শাশ্বতের খুব ইচ্ছে একটা মোবাইল ফোন কেনার। কিন্তু যার নুন আনতে পান্তা ফুরায় তার আবার মোবাইল ফোন। শাশ্বত দ্রুত পা চালালো, রোদের তাপ বাড়ছে। এই এক ঝামেলা কার্তিক পাশের কখন বর্ষা, কখন রোদ তার কোনো ঠিক নেই। এই যে সকালে কি বৃষ্টি ছিলো, বারির সামনে পানি জমে গিয়েছে অথচ এখন কি কড়া গা পোড়ানো রোদ। গরম লাগছে বলে আরোও জোড়ে হাটছে শাশ্বত। এতে শরীর ঘামলেও উষ্ণতা অনুভব হচ্ছে না। আর মিনিট দশেক লাগবে, শামসুদের বাগান পার করেই বাজার। বিশাল পেয়ারা বাগান শামসুদের। পেয়ারার টোকরি উপজেলায় এখান থেকেই যায়। সোজা না গিয়ে পথ বাঁচাতে শাশ্বত পেয়ারা বাগানের মাঝ দিয়ে যেতে লাগে। হঠাৎ গায়ের উপর একের পর এক পেয়ারা পড়তে থাকে। শাশ্বত প্রথমে ভেবেছিলো পাখি হয়তো পেয়ারা খাচ্ছে তাই গায়ে পড়তে। কিন্তু না, কেউ গাছ থেকে ঢিল ছুড়ছে। একেই ঘামে নেয়ে ক্লান্ত, উপরন্তু এই অশৈল্যপনা যেনো সহ্য হলো না শাশ্বতের। তীব্র স্বরে বলে উঠলো,
“ভরপদুপুরে মশকরা করার জায়গা পাও না তাই না? নেমে আসো বলছি, নেমে আসো”
“হি হি, হাউমাউ খাও। মানুষের গন্ধ পাও”
অত্যন্ত নেকা কন্ঠে এক রমনীর কন্ঠ কানে এলো শাশ্বতের। প্রচন্ড তীক্ষ্ণ কন্ঠটির। শাশ্বতের গ্রামের মানুষের কাছে শূনেছিলো এই বাগানে দুপুরে একটা ভুত ঘুরে বেড়ায়। তাই ভয়ে এমুখো দুপুর বেলাতে কেউ হয় না। মূল রাস্তা দিয়েই তারা যাতায়াত করে। শাশ্বতের ও এই পেয়ারা গাছের পেত্নীকে দেখার ইচ্ছে জাগলো। তাই সে ঘুরে গাছের অপর পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। তারপর যা দেখলো তাতে তার আক্কেল গুড়ুম। পেয়ারা গাছের গাছের মাঝের আমগাছের ডালে এক জোড়া পা ঝুলছে। নুপুর পরিহিত সফেদ পা। পেত্নী ই বটে তবে জীবন্ত। পেয়ারা খাচ্ছে আর পা দুলাচ্ছে। আর মাঝেমাঝে নেকী সুর তুলছে। শাশ্বত মেয়েটিকে ভালো করে পর্যবেক্ষ্ণ করতে লাগলো। ছোটখাটো, রুগ্ন দেহ, গোলগাল শ্যাম মুখখানায় এক চিলতে হাসি খিলখিল কল্লোল তুলছে। লাল শাড়ির আঁচল মাজায় পেঁচিয়ে রেখছে। ঘনকালো চুল সাপের ন্যায় নেমে গেছে কাঁধ থেকে, মৃদু হাওয়ার সাথে তার কতো কথা। মেয়েটিকে এর আগে দেখেছে বলে মনে পড়ছে না। তবে চেনা মুখ। শাশ্বত শব্দ না করে গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়ালো। মেয়েটি তখন পেয়ারা খেতে ব্যাস্ত। সুযোগ বুঝে গম্ভীর কন্ঠে শাশ্বত বলে উঠে,
“পেত্নীরা বুঝি ভরদুপুরে পেয়ারা খায়?”
শাশ্বতের ভারী কন্ঠ কানে যেতেই চমকে উঠলো কিশোরী। তার ভীত মুখখানা নিতে থাকাতেই শাশ্বত ধমকের স্বরে বলে,
“এক থেকে পাঁচ গুনবো, এর মধ্যে নিচে না এলে বুঝবে কত ধানে কত চাল”
শাশ্বতকে অবাক করে কিশোরী ভয় না পেয়ে উলটো তেজ দেখিয়ে বললো,
“নামবো না, দেখি কি করো?”
“না নামলে মানুষ জড়ো করব, মানুষ দেখুক কে আসল পেত্নী”
“যাও যাও ডাকো”
বলেই খিলখিল করে হাসলো মেয়েটি। পরমূহুর্তে দম নিয়ে বললো,
“তুমি ডাকতে যাবে আর আমি ফুরুত”
মেয়েটি প্রত্যুতপন্নমতী, এতো বুদ্ধি কোনো কিশোরীর হয়? বয়স কতো? চৌদ্দ কি পনেরো। অথচ শাশ্বতকে নাকানি চুবানি দিচ্ছে। শাশ্বত হাসলো নির্লিপ্ত চিত্তে। তারপর প্রশ্ন করলো,
“মানুষকে ভয় কেন দেখাও?”
“কারণ এই গ্রামের লোকেরা ভীত। তারা শক্তিকে ভয় পায়। নয়ত এতোকাল কেউ ধরতেই পারলো না এটা আমি। শুধু তুমি বাদে। এই কাউকে বলবে না কেমন। বললে তোমার বাড়ি এসে ভয় দেখাবো।“
“আমি মেকি পেত্নীকে ভয় পাই না।“
হেসে কথাটা বলেই হাটতে লাগলো শাশ্বত। অমনি আবারো পেয়ারা লাগলো গায়ে। শাশ্বত পিছনে ফিরতেই মেয়েটি বললো,
“কি ভয় নাকি পাও না?”
বলেই খলখিল করে হেসে উঠলো।কি প্রানবন্ত হাসি। মেয়েটির চেহারায় হুট করেই উমার আদল ভেসে উঠলো। শাশ্বতের মনটা বিষন্নতায় ঢেকে গেলো। আচ্ছে উমারা কি এভাবে হাসে? উত্তরটা জানা নেই শাশ্বতের। সে উপেক্ষা করে এগিয়ে যেতে লাগলো বাজারের দিকে। তার যে অনেক কাজ__________________________________
১০!!
বাঘের ডেরায় ঢুকতে নেই, প্রান বিপন্ন হবার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু শাশ্বত আজ বাঘের ডেরাই ডুকেছে। সে এখন অভিনব সিংহের ঘরে। তল্লাশি করছে। তল্লাশি করছে কিছু কাগজের। দু বছর আগে ব্রীজ রহস্যের তল্লাশি। ডাহাকায় কথা বলেছিলো শাশ্বত। তারা জানিয়েছে এমন কোন ব্রীজ ভেঙে মানুষের মৃত্যু হয়েছিলো বলে তারা জানেই না। উপজেলা থেকে খবর বের ই হয় নি। ইঞ্জিয়ার যুবকের খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। সময় লাগবে। এর মাঝে তো শাশ্বত বসে থাকতে পারে না। তাই সে নিজে তদন্ত করছে। ব্রীজের টেন্ডরের কাগজ বা কোনো প্রমান অন্তত সে পাবে এই ঘরে। গত রাতে গুদামে খুজেছে। কিন্তু কালো সিন্দুকের চাবি পায় নি। চাবি মামার কাছে। তাই সেদিকে দেখে ঘরটা খুঁজছে। যদি কিছু পায়। মামী হেসেলে, মামা গুদামে; এর থেকে ভালো সুযোগ আর আসবে না তাই এখন ই তল্লাশি চালাতে হবে। খুজতে খুজতে পুরানো কাঠের আলমারির ভাঙ্গা ড্র্যারে এক গুচ্ছ কাগজ পেলো শাশ্বত। উপরে লেখা, “কমলাপট ব্রীজ”। গ্রামের দক্ষিনের নদীর নাম কমলাপট। শাশ্বতের বুকে সূক্ষ্ণ আশার ডহেঊ উঠলো। যেই কাগজ টা নিতে যাবে অমনি দরজা খোলার ধ্বনি কানে এলো। আকস্মিক ঘটনায় বুকটা ধক করে উঠলো শাশ্বতের। শিরদাঁড়ায় কাঁটা দিলো, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমলো। শুকনো ঢোক গিলে পিছনে তাকাত দেখে…………