সবুজ কাজলের কৌটো - পর্ব ০৫ - সুলতানা পারভীন - ধারাবাহিক গল্প


০৯!! 

দিনের আলো চোখে এসে পড়ায় ঘুম ছুটে গেলো মায়রার। চোখ কচলাতে কচলাতে বিছানায় উঠে বসে মনে করার চেষ্টা করলো কোথায় আছে। রুমটা পরিচিত লাগছে না। মাথা চুলকে চুল এলোমেলো করে ভাবতে বসলো কোথায় আছে। নিজের দিকে তাকাতেই পড়নের কালো পাড়ের রয়েল ব্লু শাড়িটা চোখে পড়লো।। সাথে সাথেই রাতের ঘটনাগুলো মাথায় আসলো। লজ্জাও পেল কিছুটা। আয়ানের জন্য খারাপও লাগলো। একটু রাগও হলো কেউ এতোদিন কিছু জানায় নি ওকে-এজন্য।। ভালোবাসা বড়ই অদ্ভুত। প্রিয় মানুষকে কষ্ট পেতে দেখলে সব অনুভূতিই যেন গুলিয়ে যায়।। মায়রারও এখন সব অনুভূতি তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।। 

ফ্রেশ হয়ে এসে মোবাইলটা হাতে নিয়েই দেখলো ঘড়িতে ১০ টা বাজে।। মায়রা নিজেই নিজের মাথা চাপড়ালো। নিজের বোনের শ্বশুরবাড়িতে এসে সে নাকি ১০ বাজে উঠছে।৷ কে কি ভাবছে কে জানে! আর রিহান ভাইয়ার কাজিনরা!!! সবাই মিলে নিশ্চয়ই খুব জ্বালাবে মায়রাকে।। আয়ানটা যে কি করে মাঝে মাঝে!!??
এসব ভাবতে ভাবতেই মায়রা তাথৈকে খুঁজতে রুম থেকে বের হলো। একটা কি দুটে রুম ক্রস করতেই কেউ হাতটা টেনে একটা রুমে ঢুকিয়ে ফেলল।। মায়রার তো ভয়ে কাঁপুনি উঠে গেছে। পরে অবশ্য তাথৈকে দেখে যেন বুকের উপর থেকে ১০০ টনের পাথর নেমে গেল।।৷ 

-আপুই??? কি হলো!! এভাবে আনলে কেন!!?? ভয় পেলাম আমি---।।

-মায়রু---।। কি কি হলো রে কালকে!?

-কি হবে!!??

-তোকে নাকি আয়ান প্রপোজ করেছে। তুই নাকি হ্যাঁও বলে দিলি??? কাহিনী কি?

-কাহিনী আবার কি!!??

-ওমা!!! কাহিনী বলবি না?? কি কি হলো? কতটুকু এগোলি----।।

তাথৈ দুষ্টুমি করে চোখ টিপল মায়রার দিকে তাকিয়ে।  মায়রা বুঝতে পারলো না তাথৈ ঠিক কি বুঝাতে চাইছে।। তাই চুপ করে তাকিয়ে রইলো।। তাথৈ তবু হাল ছাড়ল না।। ইনিয়ে বিনিয়ে মায়রাকে এটা ওটা বলে গুতাগুতি করতেই লাগলো।। শেষে মায়রাও বিরক্ত হয়ে গেলো।।

-কি বলো আপ্পি-।। ঠিক করে বলো না?!

-এই মেয়ে তুই তো দেখি-- একদম বাচ্চাই রয়ে গেলি---।। সব কথা কি ডিরেক্ট জিজ্ঞেস করতে হয়???

-হ্যাঁ করতে হয়।। নইলে বুঝিয়ে বলো কি বলতে চাইছো---।।

-শুনলাম কাল সেই রাতের এগারোটায়ও ছুটতে ছুটতে আয়ানের গাড়িতে উঠে দুজনে বেরিয়ে গেলি--।। তো কি কি হলো??

-কি আর হবে!!! উনার সাথে উনাদের বাড়িতে গেলাম----।।

কথাটা শুনেই তাথৈয়ের মুখটা শুকিয়ে গেল। মায়রকে নিজের কাছে টেনে নিল।

-কি বললি!!?? ওই বাড়িতে!!?? আয়ান ঠিক আছে?? কোন সমস্যা হয়নি তো?? তু-তু-তই ঠিক আছিস???

মায়রা ভ্যাবাচ্যাঁকা খেয়ে তাকিয়ে রইলো তাথৈয়ের দিকে। 

-কি হলো বলিস না কেন কিছু??

-তুমি এমন করছো কেন আপ্পি??

-আয়ান ঠিক আছে??? ওকে তো দেখলাম ঘুমোচ্ছে---।। কিন্তু-কিন্তু--।

-কি হলো আপ্পি??

-আয়ান উল্টা পাল্টা কিছু করে নি তো ও বাড়ি গিয়ে--??

-আপু-কি বলছো এসব??

-মায়রা ভুল বুঝিস না প্লিজ।। ওই বাড়িতে যাওয়ার পর প্রত্যেকবারই ছেলেটা পুরো পাথর হয়ে থাকে।। একটা কথা পর্যন্ত বলে না।। আর বললেও সব আবোল তাবোল কথা।---। রিহান তোদের ব্যাপারটা জানতো। কালই আমাকে বললো- তোকে পেয়ে সবটা ভুলে নতুন করে বাঁচতে শিখেছে ছেলেটা।। এতোগুলো বছর পর দেশে ফিরেও প্রায় প্রতিদিনই নাকি ওই বাড়িতে গিয়ে পড়ে থাকতো---।

-কি বলছো এসব আপি??

-রিহানের কাছে শুনেছি-ইভেন আমি নিজেও দেখেছি ছেলেটা কেমন পাথর হয়ে বসে থাকত ফ্লোরের দিকে মুখ করে। রিহানের সাথে বাসায় এসেই তোকে প্রথম দেখে ছেলেটা---।। তারপর থেকে আর ও কখনো অস্বাভাবিক আচরণ করে নি।৷ একটা কোম্পানিতে জয়েন করেছে। বাবা অনেকবার বলেছে-কোম্পানিটা রিহানের যেমন তেমনি আয়ানেরও।। আয়ান মোটেও রাজি হয় নি---।। তবে কাল কি এমন হলো ছেলেটার!!? আর এখন তো বেশ ভালোই ঘুমাচ্ছে------।।

মায়রা কি বলবে বুঝতে পারলো না। লজ্জা পাবে নাকি আয়ানের জন্য কষ্ট পাবে সেটাও মাথায় আসছে না।। মানুষটার এতো কষ্ট!! কখনো তো কিছুই বলে না সে!!??

মায়রাকে ভাবতে দেখে তাথৈ কিছু একটা ভেবে একটু মুচকি হাসল। তারপর মুখটা একটু তুলে দিল।। মায়রা অবাক হয়ে তাকাল তাথৈয়ের দিকে।।

-তা কি কি হলো বললি না তো???

-আপু----??!!

তাথৈ মায়রার সাথে দুষ্টুমিতে মেতেছে আর মায়রা এদিক ওদিক ছুটছে। ছুটতে ছুটতে কখন যে রুম থেকে অন্য একটা রুমের সামনে চলে এসেছে খেয়ালই নেই।। তাথৈ হালকা করে ধাক্কা দিয়ে রুমে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে দরজাটা লক করে দিল।। মায়রা রেগে গিয়ে একটু জোরেই দরজা ঠ্যালা দিলো।। বাইরে থেকে তাথৈয়ের হাসির শব্দ শোনা গেল। আর কি যে বলে চলেও গেল।। আরো কিছুক্ষণ দরজা খোলার জন্য ধাক্কাধাক্কি করলো মায়রা। মৃদু একটা মিষ্টি ঘ্রাণ নাকে এসে লাগছে। ঘ্রাণটা মায়রার পরিচিত।। আঁতকে উঠেই পিছনে ঘুরে দেখল আয়ান ঘুমাচ্ছে।। সাদা রং করা ঘর। সাদা বেড কাভার-সাদা বালিশ-সাদা চাদর গায়ে--। তার মাঝে আয়ান বেঘোরে ঘুমাচ্ছে।৷ আর ওকে দেখে মনে হচ্ছে 'শ্বেত রাজ্যের ঘুমন্ত রাজকুমার'। 

মায়রা কোনোমতে একটু একটু করে বিছানার সামনে গিয়ে আয়ানের মাথার কাছটাতেই ফ্লোরে বসে পড়লো। ঢোক গিললো।। লোকটাকে মারাত্মক রকমের সুন্দর দেখাচ্ছে।। ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি লেগে আছে। কি যে লাগছে আয়ানকে!!

ঘুমন্ত মানুষটার ঠোঁটের কোণে প্রশান্তির হাসি। মায়রা হয়তো সারাদিন বসে থেকে এই হাসিমুখটা দেখতে পারবে।। আয়ানের চুলগুলো এখন প্রচন্ড রকমের এলোমেলো হয়ে চোখ মুখের উপরে এসে পড়েছে। ফ্যানের হালকা বাতাসে একটু একটু উড়ছে আর আরো এলোমেলো করে দিচ্ছে।। ব্যাপারটা দেখতে ভালো লাগছে মায়রার। ঘন ভারি শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে আয়ানের। সেটাও ভালো লাগছে। আয়ানের মাথার একদম কাছে বসেই ভালোভাবে আয়ানের ঘুমন্ত মুখটা দেখছে। এর আগে এতো কাছ থেকে আয়ানকে কখনো দেখেনি মায়রা। মানুষটাকে দেখতে দেখতে ঘোর লেগে যাচ্ছে মায়রার।।

একটু পরেই হকচকিয়ে উঠলো মায়রা। এভাবে বসে থাকলে চলবে!! একটু পরেই আয়ানের ঘুম ভাঙবে নিশ্চয়ই। তখন মায়রাকে এভাবে রুমে দেখলে কি ভাববে!

মায়রা কিছুক্ষণ পায়চারি করতে লাগলো। তাথৈটার মাথা ফাটিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে এখন। জোরে ডাকতেও পারছে না কাউকে। মানুষটা কতো রাত করে ঘুমিয়েছে। এখন হুট করে এভাবে ঘুম ভেঙে গেলে??!! দরজার দিকে মুখ করে এসব ভাবতে ভাবতেই হাতে টান পড়লো। আর মায়রা সোজা আয়ানের উপর।। ভয় পেয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল মায়রা।।আর আয়ান মায়রার ভীত মুখটা দেখছে।। আলতো করে মুখটা তুলে ধরতেই চোখ মেলে তাকাল মায়রা।। মানুষটার ঘুম ভেঙে গেছে!!! 

-আমার পরীটার বুঝি আমাকে দেখার জন্য তর সইছিল না???

-হুম!!??

-পরী বউ?? ঘুম হয়েছে রাতে??

-হুম---।।

মায়রা একটু সরে বসতেই আয়ান উঠে বসে খাটে হেলান দিয়ে মায়রাকে আবার বুকে টেনে নিলো।। মায়রা চুপ করে আয়ানের বুকের ঢিপঢিপ হৃৎস্পন্দন শুনছে।। আর ভাবছে। গতকাল ওভাবে মরে যাওয়ার কথা বলা মোটেও ঠিক হয় নি। কিন্তু সে কিভাবে জানবে আয়ানের পরিবারের সাথে এমন কিছু একটা----।।

-মায়রা??? 

-হুম??

-কি ভাবছো??

-কিছু না---।। 

-তুমি আমার রুমে এলে কি করে!!

-না মানে--।। তাথৈ আপু---।।

-ও আচ্ছা--।। আটকে গেছে বাইরে থেকে??

-হুম----।।

-আহারে পরীটা!!! নাস্তা করেছ??

-উহু---। 

-তাথৈয়ের বাচ্চার আজকে খবর আছে-।। আমার পিচ্চি বউটাকে এতো বেলা পর্যন্ত না খাইয়ে রেখেছে---।।

-তুমিও তো খাও নি---।।

-আমি খাব আর কি---।। কিন্তু তোমার তো না খেলে চলবে না পরী--।।

ঠুং করে একটা শব্দ হতেই মায়রা হকচকিয়ে আয়ানের থেকে সরার চেষ্টা করতেই আয়ান আরো আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নেয় মায়রাকে।

-এই মেয়ে এমন করো কেন??

-দ-দর-দরজার লক খুলেছে তো---।।

-হুম??? তো???

-তো মানে!! আমি বাড়ি ফিরবো না??

-বাড়ি ফিরে যাবে মানে কি!!! আজকে বৌ-ভাতের অনুষ্ঠান না এই বাড়িতে??

-না মানে---!! এতো মানুষ আসবে--।

-মানুষ তো আসবেই--।৷ কি সমস্যা?? কিছু হয়েছে? কেউ কিছু বলেছে??

-না----।।

-তাহলে কি প্রবলেম??

-আমি না আসলে--আসার সময় এক্সট্রা ড্রেস কিছু আনি নি---।। কাল তো আপনার দেয়া -- শাড়ি - শাড়িটা পড়েই কাটালাম--।। আজ তো যেতে হবে বাড়িতে---।। রেডি হয়েই চলে আসবো।

-ওরে পাগলিটা!!! 

আয়ান শক্ত করে মায়রাকে বুকে জড়িয়ে নিলো। একটু পরে ছেড়ে দিয়ে আলতো করে কপালে ঠোঁট ছোয়াল।

-তুমি দু মিনিট বসো--।।কেমন??

আয়ান উঠে কাবার্ড থেকে একটা শপিং ব্যাগ নিয়ে মায়রার হাতে ধরিয়ে দিলো।

-এখন যাও।। ড্রেসটা পড়ে রেডি হও।। আগে খেয়ে নাও---।।

-ড্রেস মানে!!??

-এতো কথা বলো কেন বাবা?? তোমার জন্যই নিয়েছি ড্রেসটা।। এমন কিছু হবে আমি আগেই জানতাম--।। এখন নাস্তা করে রেডি হও---।। শ্বশুর বাড়িতে এতো বেলা পর্যন্ত না খেয়ে বসে আছো?? যাও যাও।!

মায়রা শপিংব্যাগটা দুহাতে জাপটে ধরেই দরজার কাছে চলে এলো।। এমন সময় আয়ানের ডাক শুনে আবার দাঁড়ালো। 

-মায়রা?? তোমার ইয়ার ফাইনাল কবে?

-আগামী মাস থেকে--।।

-পরী---।। একটা জব করছি-জানো তো?? ওদের হেড অফিসে ট্রান্সফার করেছে আমাকে।৷ আগামী মাসে আমিও ওখানে শিফ্ট করবো--।। বাসা নেয়া হয়ে গেছে--।। সেলেন্ড হওয়ার জন্য এখন তোমাকে দরকার---।। কি বলো?? 

মায়রা কি বলবে বুঝতে না পেরে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো।।

-আমরা এখানে থাকবো না??

-না রে পাগলি--।। সেই ছোটবেলা থেকে অযাচিতভাবেই রিহানের সব কিছুতে ভাগ বসিয়েছি--। আর না--।। আমি সবটা ছেড়ে শুধু তোমাকে নিয়েই শুরু করতে চাই জীবনটা।
সুযোগটা দিবে প্লিজ??

-হুম---।। 

-যাও নাস্তা করে রেডি হও। তাথৈয়ের বৌভাত কিন্তু  আজকেই।।

আয়ানের কথায় মায়রা হেসে ফেলল।৷ রুম থেকে বেরিয়ে নিজের রুমটাতে এসেই দরজা বন্ধ করল।। শপিং ব্যাগটা এখনো বুকে জাপটে ধরিয়ে রেখেছে মেয়েটা।।

১০!! 

কিছুক্ষণ শপিং ব্যাগটাকে জাপটে ধরে বসে থেকে একসময় ব্যাগটা খুলে দেখলো মায়রা। ক্রিম কালারের একটা ফ্লোরটাচ গাউন।। গাউনটার উপরের দিকের অংশে গোল্ডেন আর কালো কালারের রেশমি সুতার ঘন ডিজাইন। আর নিচের অংশে আর গাউনের লং হাতায়-গলায় ভারি গোল্ডেন লেইস বসানো। সাথে গোল্ডেন চুড়িদার পাজামা আর গোল্ডেন ঢেউ খেলানো লেইস দেয়া গোল্ডেন কালারের সেমি পিউর ওড়না।। শপিং ব্যাগটায় আরো আছে ছোট পাথর বসানো দুটো গোল্ড প্লেটেড ব্যাঙ্গেল, বড় একটা পাথর বসানো রিং। আলাদা একটা বক্সে গোল্ডেন কালারের পাম-সু।

মায়রা কিছুক্ষণ হাতে ধরে ধরে গাউন আর অর্নামেন্টগুলো দেখলো।। তারপর শাড়িটা বদলে গাউনটা পড়লো। হাতে ব্যাঙ্গেল আর মধ্যমায় রিংটা। আয়ানের দেয়া গতরাতের লাভ শেইপের লকেট দেয়া সরু চেইনটা পড়লো গলায়। চোখে মোটা করে কালো কাজল পড়ে সাথে হালকা করে সবুজ কাজলের টান। ঠোঁটে হালকা ক্রিম কালারের লিপস্টিক। ওড়নাটা এক পাশ করে দিয়ে নিজেকে আয়নায় দেখছে মায়রা। বেশ ভালোই লাগছে।। চুলটা বাঁধা বাকি।। কি চিন্তা করে মায়রা চুলের সামনের দিকে পাফ করে বেঁধে নিয়ে পিছনের চুলগুলো ছেড়ে দিল। বক্সের গোল্ডেন সু টাও পড়লো। 

নিজেকে আয়নায় দেখছে এমন সময় দরজায় নক হলো।। দরজা খুলতেই আয়ানকে দেখে লাজুক হাসল মায়রা। আয়ান রুমে ঢুকে দরজা ভেজিয়ে দিয়েই মায়রাকে টেনে কাছে আনলো।

 -বাহ--।। বেশ মানিয়েছে পরীটাকে--। তবে আজও একটা জিনিস বাকি রয়ে গেছে---।।

-কি!!!??

-টিপ-টিপ--।। টিপ কই??

-ওহ সরি--।। ভুলে গেছি।। 

আয়ান হেসে টিপের পাতা থেকে গোল্ডেন কালারের একটা পাথরের টিপ মায়রার কপালে পড়িয়ে দিলো।।

-পিচ্চি?? ড্রেস কি বেশি পছন্দ হয়েছে?

-হুম---।।

-তাই?? 

-হুম--।।

-কয়টা বাজে ম্যাডাম??

-হুম??

-এই মেয়ে--কয়টা বাজে হ্যাঁ?? ধরে মাইর লাগানো দরকার তোমাকে--।।

-ওমা!! বকছেন কেন!!??আমি কি করলাম!!!??

-কিছুই করেন নি আপনি--।। ১২ টা বাজতে চললো--।। নাস্তা না করে রেডি হতে বলেছিলাম আপনাকে!!??

-না মানে---ইয়ে--!! আসলে---।।

মায়রা ভয় পেয়ে কাঁদো কাঁদো মুখ করে ঢোক গিললো। এই লোকটার ভরসা নেই। রেগে গেলে কি যে করে কে জানে!! খেতে একদমই ইচ্ছে করছে না ওর। এটা বললে না জানি কি করে!!! দরজায় খুঁট করে একটা আওয়াজ হয়ে দরজাটা খুলে গেলো। আয়ান পিছনে না ফিরেই আলতো করে একটু সরে এলো।। মায়রা মাথা নিচু করেই দাঁড়িয়ে রইলো।।

-ভাইয়া?? আপুর খাবারটা??

-রেখে যা--।।

রিহানের একটা কাজিন খাবার আর পানি রেখে যাওয়ার সময় দরজাটা টেনে দিয়ে গেল। আয়ান ওয়াশরুম থেকে হাত ধুয়ে এসে মায়রাকে টেনে বসালো খাটের উপর। খাবারের প্লেটটা হাতে নিয়ে মায়রার মুখের সামনে খাবার নিয়ে দেখলো মায়রা এখনো মুখ নিচু করে বসে আছে।।

-পিচ্চি- হা করো তো একটু--।।

-উহু---।।

-আচ্ছা সরি--।। আর বকবো না। তাকাও না বাবা??

মায়রা মুখ তুলতেই আয়ান হাসলো।। খাবার মুখের সামনে ধরলো।। এবার লক্ষী মেয়ের মতো খেয়ে নিলো মায়রা। খাওয়া দাওয়া শেষ করে হাত ধুয়ে মায়রার কপালে আলতো ঠোঁট ছুঁইয়ে বেরিয়ে গেল আয়ান। 

তাথৈয়ের বৌভাতের অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে। অনেক মানুষ।। এতো মানুষের ভিড়ে আয়ানকে খুঁজছে মায়রা। নিজের মনেই গজগজ করছে মায়রা। লোকটা কি!! ধুমধাম গায়েব হয়ে যায় কেন!!! বিরক্ত হয়েই শেষে চেয়ারে বসে রইলো মায়রা। নাকে মিষ্টি একটা ঘ্রাণ এসে লাগতেই পাশে ফিরলো মায়রা। মানুষটা কখন এলো টের পায়নি একদম। মায়রা অবাক চোখে আয়ানকে দেখছে। সাদা পাজামা-পাঞ্জাবির উপরে গোল্ডেন কালারের কাজ করা হাতকাটা চারকোল গ্রে স্যুট। পায়ে ব্রাউন সু।। আয়ান আর মায়রা-একে অন্যের দিকে অবাক চোখেই তাকিয়ে আছে।।

পাঞ্জাবীতে আজকে আয়ানকে তৃতীয় বারের মতো দেখছে। তিন দিন তিন রঙের পাঞ্জাবি-তিন ধরনের স্টাইল। সব কটাতেই আয়ানকে এতো সুন্দর লাগছে যে মায়রা চোখ ফেরাতে পারছে না।

তাথৈয়ের বৌভাতের অনুষ্ঠান শেষ করে বাসায় যাওয়ার জন্য বের হতে হতে রাত হলো।। প্রায় ১০ টা মতোন বাজে। তাথৈ, রিহান আর মায়রা তাথৈদের বাড়ি যাচ্ছে আজকে। আর তাদের ড্রাইভ করে নিয়ে যাচ্ছে আয়ান। সারদিনই মায়রার আশেপাশে ঘুরেছে ছেলেটা। দু দন্ড চোখের আড়াল হতে দেয় নি। ঘুম ভাঙার পর থেকে এই নিয়ে তিন বার বকা দিয়েছে আয়ান মায়রাকে। প্রতিবারই খেতে চায়নি বলে।৷ পরে অবশ্য নিজ হাতে খাইয়েও দিয়েছে।। 

তাথৈ আর রিহান আগেই উঠে বসেছে গাড়িতে। মায়রা এসে ওদের সাথে বসতে যাবে তখনই বাধা দিল আয়ান।

-পিচ্চি--সামনে এসো---।।

মায়রা গাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলো।। সামনে আয়ানের পাশে বসবে!! ব্যাপারটা কেমন দেখাবে?? তাথৈ আর রিহানের সাথে বসলে---!!??

-এই মেয়ে?? কি সমস্যা?? উঠে এসো??

-সা-সা-সামনে!! সামনে বসবো!!??

-ওদের কালই তো বিয়েটা হলো!! একটু ওদেরকে ওদের মতো করে শান্তিতে থাকতে দাও না বাবা---।।

আয়ানের কথা শুনে তাথৈ আর রিহান দুজনেই গাড়িতে বসে হেসে ফেললো। ওদেরকে বিদায় জানাতে আসা রিহানের কাজিনগুলো হাসাহাসি করলো কিছুক্ষণ। মায়রা লজ্জা পেয়ে আয়ানের পাশের সিটে বসলো। সিট বেল্ট পড়ে আয়ানের দিকে তাকাতেই চোখে চোখ পড়লো। আয়ান এতোক্ষণ ধরে মায়রাকেই দেখছে। কি এতো দেখে লোকটা!!! সবাইকে বিদায় জানিয়ে গাড়ি স্টার্ট করলো আয়ান। বেশি দূরের রাস্তা না।। ২০-২৫ মিনিট লাগবে বড়ো জোর।। তাথৈয়ের হাতটা ধরে বসে আছে রিহান। আর আয়ান মায়রাকে দেখছে আর ড্রাইভিং করছে। খোলা জানালা দিয়ে মুখ বের করে মেয়েটা তাকিয়ে আছে বাইরে। কিছু বলতেও পারছে না ওকে।। অসম্ভব রকমের সুন্দর লাগছে মায়রাকে। গাউনটা পড়া এখনো।। চুলগুলো দুরন্ত বাতাসে উড়ছে আর আয়ানের চোখে মুখে চুলের ঝাপটা লাগছে। ব্যাপারটা ভালো লাগছে আয়ানের। 

মায়রাকে এভাবে দেখে মাথায় অন্য প্ল্যানিং চলছে আয়ানের। তাথৈদের বাড়িতে পৌঁছতে সাড়ে দশটা বাজে। সবাইকে বলেই গাড়ি নিয়ে আবার বের হয় আয়ান।। মায়রাও ফ্যালফ্যাল করে আয়ানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। মানুষটা এমন কেন!! তার তো আজকে থাকার কথা!! সকাল থেকে খালি বকছে আর ধুম করে গায়েব হয়ে যাচ্ছে!! আবার হুট করে এসে মায়রাকে বারে বারে তাক লাগিয়ে দেয়া সারপ্রাইজ দিচ্ছে।।কি চায় লোকটা!! মায়রাকে পাগল করে দিতে!! 

আয়ানের কথা ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে গেছে খেয়াল নেই।। মোবাইলের কলের আওয়াজে ঘুমটা ছুটে গেল। ঘুমঘুম চোখে ফোনটা রিসিভ করে কানে লাগালো মায়রা।।কে কল করেছে সেটাও দেখেনি।। চোখ বুজে মোবাইল কানে লাগালো।।

-হ্যালো??

-পরীটা ঘুমিয়ে গেছে??

-হুম!!???

-পিচ্চি বউটা কি আজকে বেশি টায়ার্ড??

-আপনি??? কোথায় আপনি?? 

-কি জিজ্ঞেস করেছি??

-না-না--।। টায়ার্ড না তো। একটুও না-।

আয়ান হেসে ফেললো মায়রার কথা শুনে। ঘুমকাতুরে কন্ঠ মায়রার-দারুণ লাগছে শুনতে।। অথচ সে নাকি টায়ার্ড না!!

-পরী?? একটু বাইরে আসবে??

-হুম---।। আসছি---।।

ঘুম চোখেই বেরিয়ে এলো মায়রা। দরজাটা খুলতেই সামনে দাঁড়ানো দেখলো আয়ানকে। মায়রাকে দেখে ধাক্কা মতোন খেল আয়ান।। চোখ দুটোতে রাজ্যের ঘুম যেন ভর করেছে মায়রার। তার উপরে চুলগুলো অসম্ভব এলোমেলো।।নীল-সাদা কম্বিনেশনের একটা থ্রি পিস পড়নে। তাতেই যেন পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে মায়রার মধ্যে।।

-আপনি গিয়েছিলেন কোথায়??

মায়রার কথায় হুঁশ ফিরতে মায়রাকে একটা শপিং ব্যাগ ধরিয়ে দিলো আয়ান।।

-এটা পড়ে একটু ছাদে আসবে প্লিজ?? 

-এখন!!!

-প্লিজ??? জাস্ট ৫ মিনিটের জন্য--??

-আচ্ছা----।।

মায়রা রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে শপিং ব্যাগটা খুললো।। ব্লু আর পারপেল কালার মিক্সড ফ্লোরটাচ একটা গাউন। গাউনের থ্রি কোয়ার্টার হাতা আর গাউনের ঘেরটা পারপেল। গাউনের উপরের দিকটায় রাজকীয় স্টাইলে গয়না সেটের মতো ডিজাইন করা। সুতা দিয়ে ফুল আঁকা আর তাতে গোল্ডেন স্টোন বসানো। ৫ মিনিটে গাউনটা পড়ে আর সাজ কমপ্লিট করে ছাদে চলে এলো মায়রা।। 

দরজায় ঠুং করে আওয়াজ হতেই পেছন ফিরলো আয়ান।অবাক হয়ে মায়রাকে দেখছে ও।। হাতে ময়ূর ডিজাইন করা মোটা ব্রেসলেট আর কানে ময়ূর খচিত ঝুল কানের দুল।। চুল গুলো ছাড়া আর স্মোকি সাজের চোখে সবুজ কাজলের টান।।মাথায় ময়ূরের পালক বসানো টায়রা। মায়রাকে দেখতে একদম পুরোপুরি মানুষ রুপি ময়ূরীর মতো লাগছে। মায়রা লজ্জায় লাল হয়ে আছে আয়ানের এমন চাহনিতে।। আয়ান একটু এগিয়ে এসে মায়রার কানে ঠোঁট ছোঁয়াল। আলতো করে একটা কথা বললো কেবল।।

"মন-ময়ূরী।"

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন