১১!!
দরজার সামনে থেকেই মায়রাকে পাঁজাকোলা করে তুলে ছাদের মাঝামাঝিতে নিয়ে এলো। মায়রা লজ্জায় লাল নীল বেগুনি হয়ে মুখটা তুলতে পারছিল না এতোক্ষণ। লজ্জা কিছুটা কাটতে আশেপাশে তাকিয়ে খেয়াল করলো ছাদে অনেক রঙ বেরঙের হার্ট শেইপ বেলুন ঝোলানো। বেলুনগুলোর ভেতর কেমন কেমন করে যেন জোনাকির মতো মিটমিট করে আলো জ্বলছে। মায়রা মুগ্ধ হয়ে দেখলো।। পাশেই একটা টেবিল পাতা।। তাতে খুব সুন্দর লাভ শেইপের কয়েকটা ক্যান্ডেল জ্বলছে।। একটা প্লেট আর ঢাকনায় ঢাকা একটা বাটিও আছে টেবিলের উপর। টেবিলের পাশে একটা চেয়ার। টেবিল চেয়ার এলো কোত্থেকে ছাদে!!!
আয়ান মায়রাকে নামাতেই মায়রা সব কটা বেলুন আর ছাদের অন্য ডেকোরেশন গুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতে লাগলো।। আয়ান পাশে দাঁড়িয়ে মায়রার ছেলেমানুষি দেখছে। আয়ান এগিয়ে এসে মায়রার মুখটা এক হাতে স্পর্শ করলো।।
-পরী-সারাজীবন এভাবে পাগলীটা হয়ে থেকো পাশে--।। আর কিচ্ছু চাই না--।
মায়রা আয়ানের দিকে তাকাল। এতোক্ষণ আয়ানকে ভালো করে দেখেনি ও।। এখন দেখে পুরো ভড়কে গেল।। একটা মানুষ এতোটা কিউট কেমনে হয়!! ব্লু কালারের টি শার্ট আর জিন্স।। ক্যান্ডেলের আলো আর মিটিমিটি বাতির আবছা আলো আঁধারিতে আয়ানকে পুরো ইংলিশ মুভির হিরোর মতো লাগছে। মায়া ভরা দুটো চোখ আয়ানের। গালে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি।। কুচকুচে কালো চুলগুলো পিছনের দিকে ব্রাশ করা। সব মিলিয়ে জাস্ট অসম্ভব রকমের হ্যান্ডসাম-কাতিলানা লুক---।।
আয়ান মায়রার হাতদুটো ধরে দাঁড়িয়ে আছে।। আর মায়রাকে দেখছে। আর মায়রা দেখছে আয়ানকে।। ভালোবাসাটা বোধ হয় এমনি হয়।। সব সময় প্রিয় মানুষটার জন্য একটা মুগ্ধতা কাজ করে। তার সামনে এলেই অন্য রকম ভালো লাগা কাজ করে মনের মধ্যে।। ব্যাপারগুলো বেশ উপভোগ্য হয়ে উঠে এমন রোমান্টিক আবহাওয়া আর সেটআপে।। প্রকৃতিও যেন আলাদা সৌন্দর্যের ঝাঁপি নিয়ে বসেছে আজ। গোল থালার মতো চাঁদ জোছনা ছড়িয়ে রাতটাকে আরো মধুর করে তুলছে এই দুটো মানুষের জন্য।।
আয়ান কি ভেবে মায়রাকে একটু নিজের দিকে টেনে নিলো।।
-মায়রা-তুমি যদি রাজি থাকো তাহলে আঙ্কেলকে বলতে পারি তোমার বাবার সাথে আমাদের বিয়ের ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলতে----।।
-রাজি থাকো মানে কি!!??
-মানে তুমি মত দিলে আর কি--।। জোর করবো না।৷ যখন বিয়ে করতে চাও আর কি---।। আমার জন্য অযথা প্রেশার নিতে হবে না--।।
মায়রা মুখটা কালো করে মুখ নিচু করে নিলো। এই লোকটার মাথাটা ফাটিয়ে দিতে মন চাইছে এখন।। যখন বিয়ে করতে চাও আরকি--।। এখনই বিয়ে করতে চাই--। সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে--।৷ করবে?? নিজের মনেই ইচ্ছে মতো আয়ানকে বকছে মায়রা।।। আয়ান হেসে মায়রার মুখটা তুলে ধরলো।।
-দেখেছো--তুমি রাজি না এখনো--।।
-ভালো হয়েছে---।।।
-মনে মনে আর কতো বকা দিবে?? সামনেই তো আছি--।। যা বলার বলে ফেলো---।।
-বলবো না---।।
-ওমা!! সেকি!!! বলো না প্লিজ???
-সরুন---।। আমি গেলাম--।।
মায়রা রাগ করে চলে যাচ্ছে দেখে আয়ান আবার মায়রাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিল। মায়রাকে কোলে রেখেই চেয়ারে বসে পড়লো।। আলতো করে মায়রার গাল টেনে দিলো।।
-পিচ্চির রাগ দেখো না--!! বলা যায় না কিছু আমাকে!!?? রাগ হলে বকা দাও না একটু?? চুপ করে চলে যেতে হবে কেন??
-জানি না---।।
-আচ্ছা বাবা--।। জানতে হবে না--।। হা করো--।।
-কি!!!
-বলছি যে হা করো?? তোমার জন্য নুডলস করেছি একটু--।। খেয়ে দেখে বলো তো কেমন হয়েছে--।।
-খাবো না---।।
-সত্যি তো???
আয়ানের দিকে ফিরে মায়রা একটু হা করলো।। আয়ানও বাটি থেকে মায়রাকে খাইয়ে দিতে লাগলো। অসম্ভব রকমের ভালো হয়েছে খেতে। ঠিক মায়ের করা নুডলসের রেসেপি যেন। মায়রার চোখ থেকে অজান্তেই এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো।। মানুষটা কতোটা আগলে রাখে ওকে!!! এই মানুষটাকে ছাড়া বাঁচা আদৌ কি সম্ভব!??
-কি ভাবতে বসলেন ম্যাডাম??
-উহু--।। তুমি খাও না--।।
-হুম--।।
দুজনে পুরো বাটির নুডুলসটা শেষ করে উঠল।। আয়ান হালকা করে মায়রাকে কোলে তুলে নিয়ে রুমে নিয়ে গেল।। খাটে শুইয়ে দিয়ে নিজে ফ্লোরে বসে মায়রার চুলে হাত বুলালো।।
-পাগলী?? আঙ্কেল আন্টি কিন্তু আসবে কথা বলতে---।।
-সত্যি!!!
-কেন?? মানা করবো আসতে??
মায়রা রাগ করে গাল ফুলালো।। আর আয়ান সেটা দেখে হাসছে।।
-আচ্ছা বাবা-। রাগ করে না।। তুমি ঘুমাও কেমন?? আর চেইঞ্জ করে নিও আগে-। এভাবেই ঘুমিয়ে যেও না।।
-হুম---।।
-আচ্ছা পাগলি পরীটা--।। লাভ ইউ--।।
মায়রা লাজুক হেসে মাথা নাড়ল।।আয়ান আলতো করে মায়রার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে বেরিয়ে গেল রুম থেকে।। মায়রা উঠে দরজাটা আটকে ড্রেস চেইঞ্জ করেই ঘুমিয়ে গেল।।কালকে দিনটায় ওর জন্য কি অপেক্ষা করছে কে জানে!!!
সকালবেলা মায়রার ঘুম ছুটলো দরজায় নকের শব্দ। তাথৈটা পারছে না দরজাটা ভেঙে রুমে ঢুকে যেতে।। বিরক্তি নিয়ে উঠে দরজাটা খুলতেই তাথৈ তড়িঘড়ি করেই রুমে ঢুকে দরজাটা আটকে দিলো। মায়রা অবাক অবাক চোখে তাথৈকে দেখছে। বিয়ের দিন ছাড়া তাথৈকে কখনো শাড়ি পড়তে দেখেনি।। গতকাল বৌভাতেও লেহেঙ্গা পড়েছিল। আজকে লাল একটা শাড়ি পড়ছে। ভিষণ রকমের সুন্দর লাগছে তাথৈকে। মুখে নতুন বৌয়ের লাজুক হাসি- সেটাতেও বেশ মানিয়েছে তাথৈকে।।কিন্তু চোখে মুখে চিন্তার ছাপ।মায়রা এসে তাথৈকে জড়িয়ে ধরলো।
-কি হয়েছে আপি?? এমন দেখাচ্ছে কেন তোমাকে!??
-মায়রু- একটা সমস্যা হয়ে গেছে রে--।
-কি!??
-বাবা তার কোন এক বন্ধুর ছেলের সাথে তোর বিয়ে ঠিক করছে---।।
কথাটা শুনে মায়রা দু পা পিছিয়ে গেল। তাথৈ এসব কি বলছে!! আজকে তো আয়ানের---।
-মায়রু--।। কিছু তো বল??
-আপু অন্য কারো সাথে বিয়ে হওয়ার আগেই আমি মরে যাবো--।। তবু বিয়ে করতে পারবো না---।
-মায়রা???
মায়রা কাঁদছে। আর তাথৈ থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে সেটা দেখছে। এমন কিছু হবে ও ভুলেও আশা করেনি। দুষ্টুমি করে কথাটা বলতে এসেছিল। আয়ানকেও বলেছে।। ও তো পাত্তাই দিলো না। তাথৈ মায়রাকে বলবে বলায় আয়ানও ফোন ধরে বসে আছে কি বলে সেটা শোনার জন্য। মায়রার কান্না দেখে তাথৈ সেটাও বেমালুম ভুলে গেছে। ফোনের অপর পাশ থেকে 'হ্যালো হ্যালো' শুনে ফোনটা কানে লাগালো তাথৈ।
-হুম??? হ্যাঁ বল আয়ান--।।
-দরজাটা খোল তাথৈ--।।
তাথৈ দরজাটা খুলে দিয়ে এক নজর আয়ানের দিকে তাকিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। যাওয়ার সময় দরজাটা একটু ভেজিয়ে দিয়ে গেল। আয়ানের চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে। এই মূহুর্তে ওকে ঘাটানোর সাহস তাথৈয়ের নেই।।
-মায়রা???
আয়ানের কণ্ঠ শুনে মুখ তুলেই আয়ানকে দেখতে পেল মায়রা। এক ছুটে এসে আয়ানকে জড়িয়ে ধরল। আয়ানও একটু শক্ত করো মায়রাকে বুকে জড়িয়ে ধরলো।
-এই পাগলী?? কাঁদছো কেন এমন?? কি হয়েছে??!!
-বাবা নাকি---।।
কান্নার চোটে মায়রা পুরো কথাটা বলতেই পারলো না। আয়ান আলতো করে মায়রার মুখটা তুলে ধরে চোখদুটো মুছে দিল।
-কি হয়েছে রে পাগলী?? তাথৈ বললো আর তুমিও বিশ্বাস করে নিলা?? আমাকে বিশ্বাস হয় না???হুম??
মায়রা তখনো কেঁদেই যাচ্ছে। আয়ান ওর মুখটা ধরে আছে।
-অন্য কারো সাথে বিয়ে দেয়ার আগে আমি মরেই যাবো--।। বলে দিলাম--।
আয়ান অবাক হয়ে মায়রার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। এই মেয়েটা এতোটা কি করে ভালোবাসতে পারে তাকে!!? মায়রা কাঁদছে তো কাঁদছেই।। থামার নাম গন্ধ নেই।। আয়ান আলতো করে মায়রার ঠোঁটে ঠোঁট ডুবাল। আয়ানের এমন কাজে থতমত খেয়েই মায়রার কান্নাটা বন্ধ হয়ে গেল।। বেশ কিছুক্ষণ পর আয়ান মুখ তুলে মায়রার মুখটা দুহাতে ধরে তাকিয়ে রইলো। লজ্জায় লাল হয়ে গেছে মেয়েটা। আয়ান হেসে আলতো করে মায়রার কপালে চু্মো খেল।।
-ভিষণ ভালোবাসি রে পাগলীটা--।। আর এমন কাঁদলে খুব খারাপ হবে বলে রাখলাম---।।
মায়রা লাজুক হেসে মাথা নাড়ল। আয়ানের সামনে থেকে সরার জন্য ছটফট করছে। কথা তো বলছিল তাথৈয়ের সাথে। এই লোকটা কখন এলো!!! আয়ান মায়রার ভাবভঙ্গি বুঝতে পেরে মুখটা ছেড়ে দিতেই মায়রা সরে আসার চেষ্টা করলো। আয়ান মায়রার কোমড় জড়িয়ে একদম নিজের কাছে টেনে নিল।। এক হাতে মায়রাকে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরে অন্য হাতে মায়রার মুখের উপরে আসা চুলগুলো ঠিক করছে আয়ান। মায়রা একটু পর পর আয়ানকে দেখছে। চোখাচোখি হতেই আবার চোখ নামিয়ে নিচ্ছে।। আয়ান আলতো করে মায়রার চোখদুটো মুছে দিল।
-আর কখনো এসব 'মরে যাবো-ফরে যাবো' টাইপের আজাইরা কথা বলে কান্নাকাটি করলে আমিই তোমাকে খুন করে ফেলবো বলে দিলাম---।।
আয়ানের কথা শুনেই মায়রা হি হি করে হেসে দিলো।। আয়ান মায়রার হাসিমুখটা দেখছে। চোখাচোখি হতে নিজেও হাসল।
-পরী--। তোমাকে অসম্ভব ভালোবাসি-। যাই হয়ে যাক না কেন উল্টা পাল্টা কিছু করবা না--।। চুপ---।। আর প্লিজ একটু ভরসা করো তোমার পাগলটাকে।। তোমাকে অন্য কেউ আমার কাছ থেকে কেড়ে নিবে--সেটা আমি হতেই দিবো না।।
মায়রা মাথা নাড়িয়ে হেসে আয়ানের বুকে মুখ ডুবালো। মানুষটার বুকে মাথা রেখে শান্তি শান্তি লাগছে মায়রার। আয়ান আলতো করে মায়রার চুলে হাত বুলিয়ে দিল।
-এই যে ম্যাডাম??ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নিন কেমন?? বিকেলে মিষ্টি দেখে একটা শাড়ি পড়বেন।। বুঝলেন??
মায়রা আয়ানের বুকের মধ্যে থেকেই মাথা নাড়লো। ছাড়লো না।। শক্ত করে জড়িয়ে রাখলো।।
-পিচ্চি বউটা--। না ছাড়লে কিন্তু যাবো না বলে দিলাম---।।
মায়রা লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি আয়ানকে ছেড়ে দিলেও আয়ান মায়রার কোমড় জড়িয়ে ধরে আছে। ছাড়ছে না দেখে আয়ানের মুখের দিকে তাকাল মায়রা।। আয়ান হেসে আলতো করে মায়রার কপালে চুমো খেল।।
-আমার ঘুমপরীটা রে---!! ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করো--।। আমি বিকেলে আঙ্কেল আন্টিকে নিয়ে আসবো।। কেমন??
-হুম।।
-আর বাবা--একদম কেঁদো না কেমন?? বায়---।। এসে যদি দেখি আবার কেঁদেছো--তবে আমিই বিয়ে করবো না কিন্তু---।।
আয়ানের কথায় মায়রা হেসে মাথা নাড়ল।
-গুড গার্ল---।। বায় বউটা--।।
আয়ানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মায়রা হেসে ফেললো।৷ একটা মানুষ এতোটা কিভাবে ভালোবাসতে পারে ওকে!! এতোটা ভালোবাসা কপালে সইবে তো ওর!
১২!!
বিকেলে তাথৈ মায়রাকে নীল রঙের একটা জামদানি শাড়ি পড়িয়ে দিলো। শাড়িটা অসম্ভব মানিয়েছে মায়রাকে। কোন সাজ নেই মুখে তবু মায়রাকে পরী পরী লাগছে। তাথৈ মায়রাকে সাজিয়ে দিতে চাইলেও ভারি মেকাপ করতে মায়রা কিছুতেই রাজি হলো না। শেষে সবুজ-কালো কাজল, নীল টিপ আর হালকা একটা লিপস্টিক দিয়েই সাজটা কমপ্লিট করল মায়রার।। তাতেও বেশ লাগছে মায়রাকে। গলায় আয়ানের দেয়া সরু লকেট চেইন, কানে নীল রঙা কানের দুল, হাত ভর্তি নীল কাঁচের চুড়ি-সব মিলিয়ে বর্ণনাতীত সুন্দর লাগছে মায়রাকে। তাথৈ হেসে নিজের চোখ থেকে একটু কাজল নিয়ে মায়রার কানের পিছে লাগিয়ে দিলো।
-নজর না লাগুক কারো---।।
মায়রা লাজুক হাসলো। আয়ান আঙ্কেল আন্টিকে নিয়ে এসেছে। সবাই বসে কথা বলছে ড্রইংরুমে। কি কথা হচ্ছে কে জানে!
-চল মায়রা--।। আমরা যাই--।।
মায়রাকে ড্রইংরুমে নিয়ে এসে তাথৈ আয়ানের পাশে চুপ করে বসে রইলো।। মায়রা টুকটাক প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে। কবে পরীক্ষা শুরু-কবে শেষ-কবে নতুন ইয়ারের ক্লাস শুরু এসব।। আর আয়ান অবাক চোখে মায়রাকে দেখছে। পুরো নীলপরী লাগছে মায়রাকে। আয়ান প্রায় হা করেই মায়রার দিকে তাকিয়ে রইলো। ফ্লোরের দিকে তাকিয়েই সবার এটা ওটার উত্তর দিচ্ছে মায়রা। আর মায়রার আনত লাজুক মুখটা দেখছে আয়ান। ঠোঁটের কোণে লাজুক হাসি- নীল আঁচলের কোণাটা আঁকড়ে ধরে বসে আছে। কখনো নখ খোঁটাখুঁটি করছে।। সবটাই ভালো লাগছে আায়ানের। মায়রার মাঝে যে কি প্রচন্ড রকমের তোলপাড় হচ্ছে সেটাও আয়ান মায়রার মুখ দেখেই বুঝতে পারছে।
-আয়ান??
-হুম??
তাথৈ কখন আয়ানের পাশে এসে বসেছে খেয়ালই করে নি আয়ান।। এখন ফিসফিস করে কথা শুনে আয়ান তাথৈয়ের দিকে তাকাল।
-এভাবে হা করে তাকিয়ে থাকলে সবাই বুঝে যাবে ডুবে ডুবে কতোটা জল খাচ্ছিস--।। কতো কষ্ট করে আমরা ব্যাপারটা এ্যারেন্জ ম্যারেজ দেখাচ্ছি। আর তুই কিনা সব ঘেটে ঘ করে দিতে চাচ্ছিস??
আসলেই তাথৈ আর রিহান দুই বাসায় সবটা ম্যানেজ করেছে। এমন একটা ভাব করছে যেন তারাই বিয়েটা দিচ্ছে।৷ আয়ান আর মায়রা একজন অন্যজনকে চিনেই না।।
-আয়ান?? বিয়ের পরেই ট্রিট চাই কিন্তু-।
-দিবো নি--।। থ্যাংকু রে---।।
-থ্যাংকু নিবো না।। আমার বোনটাকে সুখে রাখিস--।। তাতেই হবে--।।
আয়ান মৃদু হাসল। একটু পরেই আয়ান আর মায়রাকে আলাদা করে কথা বলার জন্য অন্য একটা রুমে নিয়ে গেল।। তাথৈ মিটিমিটি হাসতে হাসতে বেরিয়ে যেতেই আয়ান মায়রাকে একটু নিজের কাছে টেনে নিল।।মায়রা মুখ তুলে আয়ানের দিকে তাকাল।।
-এভাবে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে ছিলে কেন?? বরটাকে দেখতে ইচ্ছে হয় না বুঝি?
মায়রা লাজুক হেসে মাথা নিচু করে নিতেই আয়ান হেসে মায়রাকে খাটে বসিয়ে দিয়ে নিজে মায়রার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। মায়রা আয়ানের চুলে হাত বুলালো।।
-এখন থেকে তো অফিশিয়াল হাসবেন্ড ওয়াইফ আমরা।৷ তো একটু বরের সেবাযত্ন করো---। আধা ঘন্টার মধ্যে কেউ ডাকতে আসবে না।।সো চুলে হাত বুলিয়ে দাও-আমি একটু ঘুমাই--।।
মায়রা হেসে আয়ানের চুলে হাত বুলাচ্ছে। বেশ অনেকক্ষণ পরে তাথৈ আর রিহান ডাকতে এসে আয়ানকে শুয়ে থাকতে দেখে হাসলো।
-বাহ বাহ!! কি রোমান্টিক দৃশ্য!!
-তাথৈ--।। জ্বালাস না ঘুমুতে দে--।
-দেখেছো রিহান!!! তোমার ভাই!!??
-আয়ান?? উঠ--।। বিয়ের পরে বউকে দেখে দেখে যতো ইচ্ছে ঘুমাস--।। এখন কথা ফাইনাল করে নেই--??প্লিজ??
আয়ান উঠে চুল ঠিক করে মায়রার দিকে তাকিয়ে হাসল। আবার সবাই মিলে ড্রইংরুমে ফিরে এসে বসলো।। মায়রার ইয়ার ফাইনাল শেষ হতে হতে ডিসেম্বর মাস হবে। ডিসেম্বরের ২৫ তারিখ হলুদ আর ২৬ তারিখ বিয়ে।।
যাওয়ার সময় সবার আড়ালে আয়ান মায়রাকে টেনে নিয়ে কপালে আলতো করে চুমো খেল।।
-মিসেস মায়রা আয়ান চৌধুরী আপনাকে কনগ্রাচুলেশনস--।।
মায়রা হেসে আয়ানের হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।।
অপেক্ষার সময়গুলো আসলেই সহজে কাটতে চায় না। আয়ান আর মায়রার জন্যও এই তিনটা মাসকে তাই তিন যুগ মনে হলো। অবশেষে সেই শুভ দিনটি এলো। ২৪ শে ডিসেম্বর। সকাল থেকেই মায়রা ব্যস্ত।।অনেকটাই ব্যস্ত।। আজ বাদে কাল তাদের দুজনের স্বপ্নগুলো বাস্তবে রূপ নিবে। ব্যস্ততা আছে- উত্তেজনা আছে। আর আছে এক বুক ভালোবাসা।।
সকাল থেকেই মায়রা ছটফট করছে। কিছুতেই ঠিক করতে পারছে না কি পড়বে। আয়ানকে জিজ্ঞেস করা যেত। কিন্তু তার খবরই নেই।। সকাল গড়িয়ে দুপুর-আর দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে চললো। না আয়ানের খবর আছে- না মায়রা কি করবে সেটা ভেবে পাচ্ছে।। মানুষটা একটু ব্যস্ত।। নতুন অফিসে স্যাটেল হতে সময় লাগছে। তার মধ্যে কিছু একটার প্রজেক্ট নিয়েও কাজ করতে হচ্ছে আয়ানকে। তাছাড়া নতুন বাসাটা একাই ডিজাইন করাতে হচ্ছে।। কিছুটা কাজ কমপ্লিট-কিছুটা বাকি--। সব মিলিয়ে আয়ানের সময়টা ব্যস্ততায় ভরা। মায়রা সেটা বুঝে।। বুঝে বলতে ভালোভাবেই বুঝে।।কিন্তু মানতে কষ্ট হয়। প্রিয় মানুষগুলো একটু দূরে সরলেই কষ্ট হয়।। কষ্ট হওয়াটাই স্বাভাবিক।।তবে সেটা আয়ানের কাছ থেকে যতোটা সম্ভব আড়াল করে রাখে মেয়েটা।।
এই যে আজকে ওদের হলুদের অনুষ্ঠান। কথা ছিল আজ মায়রা আয়ানের পছন্দে সাজবে।। আর আয়ান লুকিয়ে হলেও একবার মায়রাকে দেখতে আসবে। কিন্তু সেটা আর হল না আজ।। কিন্তু গায়ে হলুদের জন্য রেডি তো হতে হবে।। সবাই যার যার মতো করে ব্যস্ত।। তাথৈ ব্যস্ত- রিহান ব্যস্ত।। বাবা ব্যস্ত। সবাই ব্যস্ত। সবার এতো ব্যস্ততা দেখে মায়রার মনটাই খারাপ হয়ে গেল। আর তো কটা দিন আছে এখানে।। এখনও কি একটু ব্যস্ত না হলেই নয়!! রুমে এসে বসে সেটাই ভাবছে মায়রা। একটু পরেই শুরু হবে হলুদ আর মেহেদির অনুষ্ঠান। রেডি হওয়া দরকার। বসে বসে ভেবে কি হবে!! তাই ওয়ারড্রবটা খুলে লেহেঙ্গা নিতে গেল। ওয়ারড্রবের দরজাটা খুলেই অবাক হলো।। একটা শপিং ব্যাগ রাখা।। এটা ওর নয়। শপিং ব্যাগটা খুলতেই চোখ কপালে উঠলো মায়রার।
গোল্ডেন পাড়ে রঙ বেরঙের পাথর বসানো হলুদ একটা লেহেঙ্গা। লেহেঙ্গার টপসটা গোল্ডেন কালারের। পাথর আর সুতার কাজ করা ভারি দোপাট্টা। সাথে একটা চিরকুট।।
"পরী, রেডি হয়ে তাড়াতাড়ি নিচে এসো। সারপ্রাইজ আছে।"
মায়রা লেহেঙ্গাটা একবার দেখছে আর একবার চিরকুটটা।। এগুলো কোথা থেকে এলো!! আর সারপ্রাইজটা কি!! এই লোক কি সোজা কিছু করতে পারে না!! সবসময় সারপ্রাইজ দেয়া লাগে কেন তার! সারাদিন মায়রার কতোটা মন খারাপ ছিল মানুষটা কি বুঝে না!! লেহেঙ্গাটা পড়ে আবার ভাবতে বসলো মায়রা।। এবার কিভাবে সাজবে!! গোল্ডেন??!! নাকি হলুদ অর্নামেন্ট?? কি পড়বে!! গোল্ড?? সিলভার?? নাকি অন্য কিছু??
ভাবতে ভাবতেই মোবাইলে টুং করে একটা মেসেজ এলো।।
" আপনার ওয়ারড্রবে একটা বক্স রাখা আছে।। দেখে নিন ম্যাডাম।"
মায়রা ভ্রু কুঁচকে আবার উঠে ওয়ারড্রবটা খুলে সত্যি সত্যিই একটা মাঝারি সাইজের বক্স পেল। টেনশনের কারণে দেখেও দেখেনি বক্সটা।। বক্সটা খুলেই মায়রা জাস্ট হা হয়ে গেল। গোলাপ আর কাঠবেলি ফুল দিয়ে গড়া হলুদের গয়নার সাজ।। ধীরে ধীরে মায়রা গয়নাগুলো পড়ে আয়নায় নিজেকে দেখল। গলায় ফুলের হার, মাথায় ফুলের টায়রা,হাতে হলুদ কাঁচের চুড়ির সাথে মোটা করে ফুলের বালা দিয়ে পাঁচ রিংয়ের পাঞ্জা, বাহুতে ফুলের বাজু, কোমড়ে ফুলের বিছা হার, পায়ে ফুলের জোড়া নূপুর আর নাকে ফুলের নথ।। দেখতে ভালো লাগছে।। চোখে মোটা করে কালো কাজল পড়লো মায়রা। সাথে সবুজ কাজলটার আলতো ছোঁয়া।। আর ঠোঁটে হালকা রঙা লিপস্টিক। মনে করে আজ হলুদ রঙা টিপ পড়লো। আজকে টিপটা ঠিক করে দেওয়ার জন্য আয়ানটা থাকবে না-ভাবতেই মনটা একটু খারাপ হলো মায়রার।
এমন সময় দরজায় আওয়াজ হলে দরজাটা খুলে দিল মায়রা। তাথৈ মায়রাকে দেখে রীতিমতো হা করে তাকিয়ে রইলো।। চোখ থেকে হালকা করে কাজল মায়রার কানের পিছনে লাগিয়ে দিলো আজো।।তারপর মায়রার মাথায় দোপাট্টা টেনে দিলো। মায়রা হেসে তাথৈয়ের সাথে নিচে নেমে এলো।। বড় হলরুমটাতে স্টেজ সাজানো হয়েছে বড় করে।। ফুলে ফুলে চারপাশ মো মো করছে।। এতো বড় করে স্টেজ করার কি ছিল সেটাই ভাবছে মায়রা।। আর এতো ফুলই বা কেন!!
স্টেজে বসার জায়গাটার মাঝে সুন্দর করে ফুলের নকশা করা। তাতে কিছু একটা লেখা আছে।।সেটা মায়রা উল্টো দিক থেকে বুঝতে পারছে না। একটা ডালায় মেহেদির কোন, একটা বড় বাটিতে হলুদ, একটা প্রদীপ, এক বাটি উপটান, আরো অনেক জিনিস যার নামও মায়রা জানে না।। পরিচিত অপরিচিত অনেক মানুষে ভরে গেছে হলরুমটা। আর এতো এতো ফুলের গন্ধকে ছাপিয়ে একটা আলাদা ঘ্রাণ নাকে এসে লাগছে মায়রার।। চারপাশে তাকিয়ে ঘ্রাণের উৎস খোঁজার চেষ্টা করছে বেচারি।