০৭!!
বোর্ড রুমে আসা প্রত্যেকটা মানুষ হা করে প্রজেক্টরের দিকে তাকিয়ে আছে। সাউন্ড নেই ফুটেজটাতে। তবুও সবটা সবার কাছে স্পষ্ট। কারো বুঝতে এক দন্ডও দেরি হচ্ছে না ঠিক কি হয়েছিল মায়ার কেবিনে। দ্বীপের নিজে থেকেই মায়ার কেবিনে যাওয়া, কথা কাটাকাটি, দ্বীপের বেরিয়ে যাওয়ার নাটক, ফিরে এসে রুমের দরজা লক করা, মায়ার সাথে জবরদস্তি করা, হাতাহাতি, আর শেষে দ্বীপের মাথায় মায়ার ফুলদানি ভেঙে দরজা খুলে দেয়া এতটুকু পর্যন্ত সবটা সবাই হা করে দেখলো। কেউ একটা কথাও বলতে পারলো না। এমন একটা অমানুষের সাথে একই অফিসে কাজ করছে ভাবতেও মেয়ে স্টাফদের গা শিউরে উঠছে।
এতোক্ষণ সবাইকে কি সুন্দর হাতে রেখেছিল দ্বীপ। জাস্ট একটা ভিডিও ওর সব পর্দা ফাঁশ করে দিলো। এভাবে ধরা খেয়ে যাবে সে একবারও ভাবে নি। আর ওই রুমের সিসিটিভি ফুটেজ রাহাতের কাছে কি করে এলো সেটাও দ্বীপ বুঝতে পারছে না। দুর্বল গলায় কিছু বলার জন্য মুখ খুললো দ্বীপ।
-সব এই মেয়ের কারসাজি--। এই ভিডিও নকল--। কাউকে টাকা দিয়ে করিয়েছে---।
-তাই নাকি মিস্টার দ্বীপ? তা কাকে টাকা দিয়ে এই ভিডিও বের করেছে উনি? আমাকে? কজ এই সিসিটিভি ফুটেজ তো আমার ল্যাপটপ থেকে নেয়া---। দেখছেন না?
-স্যার-------?
-সবার উপরে নজর রাখাটা অফিসের বসের দায়িত্ব--। সিসিটিভি দিয়ে প্রত্যেকটা রুমকে তো নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব--নয় কি? অফিসে কে কি করছে সেটা তো আমার জানার দরকার----।
-স্যার? আসলে----।
-আর কত মিথ্যে বলবেন? আপনি জানেন আপনি কি করেছেন--। বাকিদেরও তো জানা দরকার---। ওয়েট----। মায়া?
রাহাত মায়ার হাত ধরে টেনে সবার সামনে দাঁড় করালো।
-এই মেয়েটাকে দেখুন সবাই--। আজ ওর জায়গায় কিন্তু আপনাদের মধ্যে যে কেউই হতে পারতো--। তাই না? তখন কি করতেন? সিসিটিভি ফুটেজ টা না হয় নকল বলবেন- কিন্তু এই মেয়েটার গায়ের চোটগুলো? দাগ গুলো? এসব মিথ্যে? সব সময় আমরা বলি মেয়েরা হ্যারাসমেন্টের শিকার হয় কজ তারা কিছু বলে না বলে--। আসলে কথাটা মোটেও ঠিক না--। মেয়েরা এই রকম হ্যারাসমেন্টের শিকার হয় আশেপাশের আপনাদের মতো মানুষদের কারণে। যারা মেয়েদের অসম্মানটা দেখেও না দেখার ভান করে। আর উল্টো মেয়েটাকে টিজ করে যে সে পুরুষদেরকে শরীর বিলিয়ে বেড়াচ্ছে---। আপনাদেরকে আর কি বলবো? গার্ডস--উনাকে থানায় দেয়ার ব্যবস্থা করো----।
গার্ডদেরকে লাস্ট কথাটা বলেই মায়াকে নিয়ে বেরিয়ে এলো রাহাত। একেবারে গাড়িতে বসিয়ে হাত ছেড়েছে মায়ার। মায়াও হা করে এতোক্ষণ ধরে এই মানুষটাকে দেখছিল। মানুষটা অনেকটা রেগে গেছে। তাই সাহস করে কিছু বলতেও পারছে না মায়া। কি বলবে সেটাও ভেবে পাচ্ছে না বেচারি।
-মায়াবতী? বেশি কষ্ট হচ্ছে? ডক্টরের কাছে নিয়ে যাই?
-নাহ---। লাগবে না--। বাসায় যাবো স্যার--।
-হুম---। কিন্তু এভাবে?
-হুম----। এভাবে বাসায় গেলে মা হয়তো টেনশন করবেন--। কিন্তু কি আর করবো বলুন?
সবই আমার কপাল।
-চুপ---। তুমি চুপ করে বসে থাকো---। আমি ব্যবস্থা করছি---।
-কি ব্যবস্থা------?
রাহাতের লাল চোখের দিকে তাকিয়ে কথাটা আর শেষ করতে পারলো না মায়া। মাথা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজলো। রাহাত ড্রাইভের ফাঁকে ফাঁকে মায়ার মুখটা দেখছে। মায়াবতীটা ক্লান্ত হয়ে হয়তো ঘুমিয়ে গেছে। কি ভেবে রাহাত গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে ড্রাইভে মন দিলো। অনেকক্ষণ পর মায়ার ঘুম ছুটলো কারো ডাকে। চোখ খুলে দেখলো রাহাত ডাকছে।
-এই মায়াবতী? উঠো না? কতোক্ষণ ধরে ডাকছি---। কি ঘুম রে বাবা!
-স্যার? এটা কোথায় আনলেন?
-আরে বাবা--। আমাদের বাড়িতে--। এই অবস্থায় বাসায় ফিরলে কাল থেকে তোমাকে হয়তো আর অফিসেই আসতে দিবে না--। সেই রিস্ক বাবা আমি নিতে পারবো না---।
-মানে?
-মানে হলো---। আপনি এখন কিছুক্ষণ এখানে রেস্ট করুন। ড্রেস চেইঞ্জ করুন---। খাওয়া দাওয়া করে তারপর যাবেন-----।
-কিন্তু স্যার? আপনার বাড়ির সবাই----। কেউ কিছু মনে করবে না?
-কে আবার কি মনে করবে? বাবাই তো আছে-। যিনি তোমাকে জবটা দিলেন---।
-ওহ--। আর---?
-একটু চুপ থাকো না বাবা---। এসো?
মায়া গাড়ি থেকে নেমে আস্তে আস্তে বাড়ির ভিতরে পা রাখলো। রাহাত ওর পাশে পাশে হাঁটছে। মায়াবতীটা আজ প্রথম ওর বাড়িতে এলো। যদিও মেয়েটাকে এভাবে বাড়িতে আনতে হবে ভাবেই নি রাহাত। তবুও ভালো লাগছে রাহাতের। মায়াবতীটা যা দেখছে অবাক হয়ে তাকাচ্ছে। সেই অবাক মুগ্ধ দৃষ্টিতে নিজেকে হারিয়ে ফেলছে রাহাত। পৃথিবীর সমস্ত সুখের বিনিময়ে এই মায়াবতীটাকে তার চাই ই চাই।
রাহাত মায়াকে একটা রুমে বসিয়ে আলমারি আর ওয়াশরুম দেখিয়ে দিলো। নিজে বাবার সাথে কথা বলতে গেল। বাবাকে সবটা জানিয়ে না রাখলে কখন কি হবে তার ঠিক নেই। মায়া ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে আলমারিটা খুলে জাস্ট হা করে তাকিয়ে রইলো। পুরো আলমারি জুড়ে শাড়ি আর শাড়ি। এতো শাড়ি হয়তো কোন শাড়ির দোকানেও পাওয়া যাবে না। শাড়ি পড়ার যাবতীয় খুঁটিনাটি জিনিসগুলোও একসাথে ভাঁজ করা। মায়া একবার ঢোক গিললো। এই বাড়িতে রাহাত আর তার বাবা ছাড়া নাকি কেউ থাকে না। তবে এই এতো শাড়ি সাজ পোশাক এলো কোথা থেকে! কার এগুলো!
ভাবতে ভাবতেই সব কটা শাড়িতে হাত বুলাচ্ছিল মায়া৷ একটা শাড়িতে চোখ আটকে গেল। কলা পাতা রঙা একটা জামদানি শাড়ি। দেখেই মায়ার পড়তে ইচ্ছে করছে। কিন্তু দেখেই অনেক দামি মনে হচ্ছে শাড়িটা। সবগুলো শাড়িই দামি। পড়া ঠিক হবে কিনা কিছুই বুঝতে পারছে না বেচারি। এর মধ্যেই দরজায় নক পড়লো।
-মায়াবতী? কই হলো?
-স্যার?
-কি হলো? কোন প্রবলেম?
-স্যার--। শাড়ি পড়বো?
-হুম--। তোমাকে তো পুরো আলমারিটাই দিয়ে দিলাম---। নাকি চয়েজ হচ্ছে না----? আরো লাগবে নাকি শাড়ি?
-এতো দামি শাড়ি -------।
-শাড়িগুলো তো তোমাকেই পড়তে হবে-----।
-জি?
-তাড়াতাড়ি চেইঞ্জ করে বেরিয়ে এসো না? খেতে হবে----।
-আসছি -----।
শাড়িটা সুন্দর করে পড়ে বের হলো মায়া। দরজা খোলার শব্দে এগিয়ে এসেই মায়াকে দেখে থ হয়ে গেল রাহাত। এ কাকে দেখছে সে? একেবারে কোন রকমের সাজ নেই মুখে। শুধু কলাপাতা রঙা জামদানি আর খোলা চুল। তাতেই মায়াবতীকে আরো মায়াবী লাগছে রাহাতের। চোখ ফেরানো দায় হয়ে গেছে রাহাতের। এদিকে রাহাতের এমন চাহনিতে লজ্জায় মাথাই তুলতে পারছে না মায়া।
০৮!!
রাহাতের অপলক চাহনি দেখে মায়া লজ্জায় মুখটাও তুলতে পারছে না। এমন না যে এই মানুষটা শাড়িতে আজকে ওকে প্রথম দেখছে। প্রতিবারই শাড়িতে মায়াকে দেখে এভাবেই হা করে তাকিয়ে থাকে মানুষটা। আর এই অবাক চাহনিতেই মায়া লজ্জায় লাল নীল বেগুনি হয়ে যায়। মায়া বেশ অনেকক্ষণ পর মুখ তুলে রাহাতের দিকে তাকিয়ে দেখলো মানুষটা একইভাবে অপলকে ওকে দেখছে। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে মায়া রাহাতকে কয়েকবার ডাকলো। কিন্তু কে শোনে কার কথা! মায়ার ডাক মনে হয় রাহাতের কান পর্যন্তই পৌঁছচ্ছে না। মায়া এবার রাহাতের সামনে এসে রাহাতের একটা হাত ধরো ঝাঁকি দিতেই রাহাতের ঘোর কাটলো।
-স্যার?
-হুম? কি? কি?
-কতোক্ষণ থেকে ডাকছি আপনাকে--? শুনতে পান না?
-চোখের সামনে একটা পরী এসে দাঁড়ালে কে আর কি শুনতে পায় বলো?
-কি?
-কই কি!
-এতোক্ষণ এতো তাড়াহুড়ো করে ডেকে এখন চুপ করে গেলেন কেন?
-ওহ---। এসো এসো?
-কোথায়?
-এতো কথা বলো কেন?
রাহাত মায়াকে নিয়ে আরেকটা রুমে গেল। এই রুমটাও সুন্দর করে গোছানো। রুমের মাঝামাঝিতে খাট পাতা। একপাশে বারান্দা আর অন্য পাশে ওয়াশরুম। দেয়ালের গা ঘেষে ওয়ারড্রব আর আলমারি। খাটের পাশেই বেড সাইড টেবিল আর বিছানার সামনাসামনি তিনজনে বসার একটা সোফা। রুমের বেড কাভার, পর্দা হতে শুরু করে সব কিছুই ডার্ক ব্রাউন মেরুন কালারের। দেখতে বেশ ভালোই লাগছে। এসব দেখতে দেখতেই রাহাত মায়ার একটা হাত আলতো করে ধরে এনে খাটে বসিয়ে নিজে খাবারের প্লেট হাতে নিয়ে পাশে বসলো। প্লেটের ভাত মাখানো হলে এক লোকমা মায়ার মুখের দিকে তুলে ধরলো। মায়া অবাক চোখে রাহাতকে দেখছে।
-এই যে মায়াবতী? হা করো?
------------------------------
-কই? হা করো? খেয়ে একটা ব্যথার ওষুধ খেতে হবে তো?
-এটা কার রুম স্যার?
-এটা কার রুম আবার! আমা-- আমার----।
-আর আমি যে তখন গেলাম! ওটা?
-এতো প্রশ্ন কেন করো?
-বলুন না?
-বলছি না হা করো? কথা কম বলক হা করো?
- খাবো না--। বাড়ি যাব---।
-বেশি বাড় বেড়ো না মায়াবতী--। কথা না শুনলে হাত পা ভেঙে এখানেই বসিয়ে রেখে দিব বলে দিলাম--।
-কেন? আমি আপনার কে? পি.এ ও তো রাখছিলেন না---।
-তুমি বুঝবেও না তুমি আমার কে---।
-কে বলুন? ------উমম--।
মায়া আর কিছু বলার আগেই রাহাত ওর মুখে এক লোকমা ভাত পুরে দিলো।
-কথা কম বলো-----।
-হুহ-----। অসহ্য----।
-হা-------?
মায়াকে খাইয়ে দিতে দিতে নিজে নিজেই কথা শুরু করলো রাহাত।
-আসলে--। ওই রুমটা ছিল মায়ের। মা শাড়ি খুব পছন্দ করতেন। যেমন পছন্দ করে পড়তেন শাড়িগুলো তেমনি যত্ন করেও রেখে গেছেন--।
-কার জন্য স্যার?
-তোমার জন্য---।
-হ্যাঁ?
-কার জন্য আর রাখবে ছেলের বউয়ের জন্য রেখেছে--------।
রাহাত মায়ার দিকে তাকিয়ে বাঁকা একটা হাসি দিয়ে আবার খাইয়ে দিতে লাগলো। মায়াও মাথা নিচু করে আর প্রশ্ন না করে খাচ্ছে চুপচাপ।
-এই? মায়াবতী? আর একটু ভাত নিই?
-না না--। স্যার--। আর খেতে পারবো না--।
-জিজ্ঞেস করায় মানা করছো?
-নাহ স্যার---। আর পারবো না--।
-আচ্ছা ---।
রাহাত নিজে হাত ধুয়ে মায়ার মুখ মুছিয়ে দিয়ে প্লেটটা রাখলো। তারপর মায়ার হাতে একটা ওষুধ ধরিয়ে দিলো। মায়া একবার ওষুধ দেখছে আর একবার রাহাতকে।
-কি সমস্যা? খাও না কেন?
-এই ওষুধটা একদম পচা--। আগেও খেয়েছি। মুখের ভিতরে লাগলেই তিতা তিতা---। ইইইই।
-হা হা হা---। আচ্ছা আগে একটু পানি নাও। আর টুপ করে ওষুধটা মুখে দিয়ে গিলে ফেল। মুখেও লাগবে না তিতাও লাগবে না-। হা হা হা।
-খারাপ --। মানুষের সমস্যাটা না বুঝেই খালি হাসে---। হুহ---।
-খেতে বললাম না?
-হুম--। খাচ্ছি তো?
আরো মিনিট পাঁচেক বসে থেকে মায়া আসলেই টুপ করে ওষুধটা গিলে ফেললো। আর রাহাত ওর কান্ড দেখে হাসতে হাসতে শেষ। মায়া সেটা দেখে গাল ফুলিয়ে বসে রইলো। রাহাত লাঞ্চ করে মায়াকে বাসায় দিয়ে এলো। পুরোটা রাস্তা চুপ করে জুবুথুবু হয়ে বসেছিল মায়া। চোখে মুখে আগের সেই ছেলেমানুষি কৌতূহল খেলা করছে না। মায়ার দিকে তাকাতেই বারবার চোখাচোখি হচ্ছে দুজনের। দুজনেই তখন মুচকি হেসে অন্য দিকে ফিরছে। সারা রাস্তা এসব করেই কাটলো ওদের।
মায়াকে ওর ফ্ল্যাটে দিয়ে এসে রাহাত দেখলো মায়ার জন্য কেনা ওষুধগুলো বাসাতেই রয়ে গেছে। ভেবে রাখলো পরেরদিন মায়া অফিসে আসলে দিয়ে দিবে।
পরে দুটো দিন কাটলো। মায়া অফিসে আসে নি। রাহাত কি করবে কিছুই ভেবে পাচ্ছে না। মেয়েটাকে না দেখে দম বন্ধ হয়ে আসছে ওর। কল যে করবে সেই নাম্বারটা পর্যন্ত নেই। নিজে নিজেরই চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে রাহাতের। শেষ মেষ আর থাকতে না পেরে মায়ার ফ্ল্যাটে গিয়েই হাজির হলো রাহাত। দরজা খুলে সামনে একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটাকে আগে কখনো দেখে নি রাহাত। আসলে মায়ার পরিবারের কাউকেই আগে দেখে নি ও আগে। কে কে আছে সেটাও জানে না। তাই এখন ছেলেটাকে চিনতেও পারলো না। আর কি বলবে কিছুই বুঝতে না পেরে চুপ করেই দাঁড়িয়ে রইলো বেচারা।