সিঁদুর রাঙা মেঘ - পর্ব ০১ - সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি - ধারাবাহিক গল্প


চিত্রা তার বাবার সাথে কিছুদিন হলো ময়মনসিংহের  একটি পুরাতন দোতলা বাড়িতে শিফট হয়েছে।  সুন্দর পরিপাটি এই দোতলা বাড়িটির নাম  "বৃষ্টি বিলাস"। খুটিয়ে খুটিয়ে বাড়িটির প্রতিটি কোনা দেখতে ব্যস্ত সে। আপাদত ভার্সিটি বন্ধ তার। কি করবে ভেবে পাচ্ছিলো না সে। মা মারা যাওয়ার পর থেকে বাবাই তার সব। সরকারী চাকরী করাতে তাদের কয়েক মাস বা বছর গড়াতেই এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় শিফট হতেই হয়। এবং তাদের করে দেয়া নির্ধারিত জায়গায় থাকতে হয় চিত্রাদের।সেই সুবাদে এ বাড়িটিতে থাকতে আসা। চিত্রার এ বাড়িটি খুব মনে ধরছে। বিগত যত বাসা পাল্টেছে সব দম বন্ধের মতো লেগেছে তার। এই "বৃষ্টি বিলাস" বাড়িটিতে যেন সে মন খোলে শ্বাস নিতে পারছে। বাড়ির বাহিরে বাম সাইডে বৃহৎ ফুলের বাগান থেকে আসা চেনা-অচেনা কত শত ফুলের ঘ্রাণে মন মুগ্ধ করে তুলছে চিত্রাকে। চিত্রা প্রতিটি রুম হেটে হেটে দেখচ্ছে।কিছু রুম কালা বদ্ধ৷ যেগুলো তালা খোলা সেগুলো খুব সুন্দর করে গোছানো। বুঝতেই পাড়ছে। বাড়িটি যাদের ছিল তারা নিশ্চয় অতি রুচিশীল আর সৌখিন মানুষ ছিলেন। বাড়ির প্রতিটি কোনে তারই আভিজাত্যের ছোঁয়া লাগা যেন। 

চিত্রা হাঁটতে হাঁটতে এ বাড়ির লাইব্রেরী রুম  সামনে এসে দাঁড়ায়। রুমে ঢুকতেই  তার চোখ কঁপালে। এত এত বইয়ে ঠাসা। চিত্রার বরাবরই বই পড়তে পটু। অবসরেই বই নিয়ে বসে পড়ে সে। লাইব্রেরী ঘরে এত এত বইয়ের তাকে ঠাসা বই দেখে মন তার ফুরফুরে হয়ে গেল। 

চিত্রা বই গুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতে লাগলো। খুশিতে তার চোখ জোড়া চকচক করছে। কিছুটা হলেও তার একাকীত্ব  কাটবে তা ভেবেই ছোট শ্বাস ফেললো চিত্রা। চিত্রা হাত দিয়ে প্রতিটি বই ছুঁয়ে দেখছে তখনি টুং টাং তার ফোন বেজে উঠলো। সে বিরক্ত নিয়ে ফোনটা হাতে নিলো। ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠলো "নেওয়াজ কলিং "।
বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকালো চিত্রা।  ফোন কেঁটে সাইলেন্ট করে দিলো সে। এখন তার কল রীতিমত আসতেই থাকবে। লোকটি তার ফোন না তোলা পর্যন্ত কল করতেই থাকবে। সে দিকে আর পাত্তা দিল না চিত্রা ফোনটি  টেবিলের কোনে রেখে আবার বই দেখায় মন দিলো। 

চিত্রা একটি বই পছন্দ হলো তা টান দিতেই হুড়মুড় করে কিছু বই  পড়ে গেল চিত্রার উপর। খানিকটা ভয় পেয়ে গেল চিত্রা। বই ছিড়ে ছুঁড়ে গেলে না তাকে বকা দেয় বাবা। তাড়াতাড়ি করে তুলতে লাগলো সে। তখনি একটি ডাইরি হাতে লাগে তার। হালকা  লাল রঙ্গা ডায়রিটি। যার উপরে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা "সিঁদুর রাঙা মেঘ "

চিত্রা সব বই তুলে এই ডায়রিটা হাতে নিলো। বড় উৎসুক নিয়ে ডাইরিটি খুলতেই বুঝতে পারে এটি কারো পার্সোনাল ডায়রি। দ্বিধান্বিত তো পড়ে গেল চিত্রা।  পড়বে কি না। কিছুক্ষণ দোনামোনা করে খুলেই ফেলল চিত্রা। এবং পড়তে লাগলো সে। প্রথম পেইজে একটি ছন্দ লিখা। তা পড়লো প্রথমে,,

"মনে পড়ে কি সেই দিনটির কথা?
যেদিন হয়েছিলাম আমি তোমার ঠোঁটের কোনের হাসি?

মনে পড়ে কি সেই রাতের খোলা আকাশের তারার কথা?
যারা হয়েছিল আমার তোমার ভালবাসার সাক্ষী?

মনে পড়ে সে মধ্যরাতের মুঠো ফোনের কথা? যার এপার ওপার ছিল তোমার আমার নিশ্বাসের শব্দ?

মনে পড়ে কি সেই শেষ বিকেলের গোধূলি লগনের কথা?
যখন সিঁদুর রাঙা মেঘ উড়ে যেতো? তুমি বলতে ভালবাসি।"

ছন্দটা খুব মনে ধরলো চিত্রার। পরের পৃষ্ঠা উল্টে পড়তে লাগলো সে,, 

সময়টা ছিল শীতকাল।ডিসেম্বরের শুরুতেই হাড় কাঁপানো কনকনে শীত । সকাল তখন সাতটা বাজে কিন্তু  চারিদিকে কুয়াশা চাদরে ঢাকা দেখে মনে হয় যেন কাক ডাকা ভোর।কখন থেকে ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে। কোনো এক সমস্যা হয়েছে মাইকিং করে বলেছে। কুহু এবার ট্রেনের বাহিরে তাকালো। ঘন কুয়াশার মাঝে কিছু মানুষ আগুন ধরিয়েছে। যার লিক লিকে আলো দেখা যাচ্ছে। কুহু এবার তার পাশে তাকালো। তার মার কাঁধে মাথা পেতে তার থেকে দু বছরের ছোট বোন ঘুমিয়ে আছে নিশ্চিন্তে। কিন্তু কুহুর চোখ জোড়ায় ঘুম নেই। আছে শুধু এক রাশ অস্থির আর ভয়। তখনি পাশ থেকে তার মা সুমি তার ছোট বোন মিহুর গায়ে চাদর টেনে কঠিন সুরে বলে উঠলো,,

---" ইউসুফের থেকে দূরে থাকবি। আর ও বাড়ির সবার থেকেও। দরকার ছাড়া কোনো কথা বলবি না। তুই যা করেছিলি তাদের সাথে! ভেবেছিলাম বাপের বাড়িটা আমার হারিয়েছে কিনা! কিন্তু তাদের বড় মন দেখেছিস? ইউসুফের বিয়েতে আমাদের ঠিকি ইনভাইটেশন দিয়েছেন তারা। আমি চাই না তোর জন্য আরো ঝামেলা বাড়ুক। "

কুহু সুমির কথায় বিরক্ত হলো। এই জন্যই তার বিন্দুমাত্র যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না সেই  বাড়িটিতে। না  দ্বিতীয়বার পড়ার ইচ্ছা ছিল সেই মানুষ গুলোর সামনে। সে বলল,,

---" আনতে গেলে কেন আমায়? আসতে তো চাইনি আমি! তুমি জোড় করলে কেন তাহলে?"

রেগে গেলেন সুমি। কুহুর এমন কথার তেজ কখনোই পছন্দ ছিল না তার।বাড়িতে একা মেয়েকে রেখে আসার সাহসটুকু হচ্ছিল না । যে দিন পড়েছে একা মেয়ে বাসায় থাকা অনেক রিস্কি।নয়তো কখনো আনতেন না তাকে।   তিনি চোখ রাঙ্গিয়ে বললেন,,

---" একদম তেজ দেখাবি না। নয়তো মানুষের সামনেই পিঠে দু ঘা বসিয়ে দিবো!"

কুহু প্রতিউত্তর  কিছু বলল না। নিরবে ছোট শ্বাস ফেলল। তার জানা আছে সুমির খবর এখন সকলের সামনে তিনি মারতেও পারেন। কুহু এবার বাহিরে তাকালো। ট্রেন তখন চলতে শুরু করেছে সবে। ইটের দালান আর বড় বড় গাছ-পালা ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে তারা নিজ গন্তব্যে। কুহু এবার চোখ জোড়া বন্ধ করে নিলো। সীটের সাথে মাথা এলিয়ে দিতেই চোখ দুটি সিক্ত হয়ে গেল। তার ভালবাসার মানুষটির  বিয়ে হতে চলেছে। আর সেই বিয়ের দাওয়াত খেতে যাচ্ছে কুহু। কি ভাগ্য তার! এমন ভাগ্য কজনেরই বা হবে? নিজের ভালবাসার মানুষটি অন্যকারো হয়ে যাবে আর তা দাঁড়িয়ে দেখবে কুহু পাড়বে কি তা সহ্য করতে??ও যে মরণ যন্ত্রণার চেয়েও কম নয়!

কুহু এসব ভাবনা থেকে বের হতে চাইলো। চোখ দুটি মুছে কল্পনায় হারিয়ে যেতে চাইলে সে মানুষটির ।

আকাশে আজ এক বড় রূপালী চাঁদ যেন পূর্ণিমা। তার দিক এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে কুহু বলল,,

---" ইউসুফ ভাইয়া দেখেছেন চাঁদটা আজ কত সুন্দর।"

কুহুর মুখে মায়া মায়া হাসি। সেই চাঁদটার দিক ইউসুফের কোনো খেয়াল নেই যে। ইউসুফ কুহুর দিক মাদক দৃষ্টি মেলে তাকালো। ঠোঁটে তার সেই ভুবন ভোলানো হাসি। বলল,,

--" হে দেখছিতো!  কি সুন্দর সেই চাঁদের হাসি।এ জন্য তাকে এত ভালবাসি !"

কুহু ভ্রুকুটি কুচকে ফেললো। ইউসুফের কথা তার বোধগম্য হলো না। ইউসুফের দিক তাকিয়ে কথাটা ধরতে চাইলো।তার সেই বাঁকা হাসি দেখে যখন বুঝলো সে কোন চাঁদের কথা বলছে।সাথে সাথে লজ্জা পেল।মুখে তার লালীমা ফুটে উঠলো। মৃদু বাতাসের ঝাপটে সামনে এসে পড়া চুল গুলো গুঁজে দিল কানের পিছনে। নজর নিচু করে আবার আড় চোখে চাইলো। বলল,,

--" চাঁদের গায়ে কিন্তু বহুত দাগ থাকে ইউসুফ ভাই! সে ওই দূর আকাশের চাঁদ হোক বা রক্ত মাংসে গড়া  চাঁদ হোক।" 

ইউসুফ হেসে আকাশের চাঁদের দিক তাকালো। সত্যি চাঁদটা আজ বেশি  জ্বলজ্বল করছে। দৃষ্টি সেখানে রেখেই জবাব দিলো,,

--" ওই দূর আকাশের চাঁদটার গায়ে দাগ বলেই সবার কাছে প্রিয়! যার মাঝে দাগ বা কমতি নেই? সে তো পরিপূর্ণ হয়। কিন্তু পরিপূর্ণ কিছুর মাঝে যে শান্তি নেই। ঠিক তেমনি ওই চাঁদের যদি দাগ না থাকতো? তাহলে কেউ তার প্রতি আকৃষ্ট হতো না। "

কথাটুকু বলে থামলো ইউসুফ।এক গাল হাসলো। কুহু তাকিয়ে রইলো তার টোল পড়া গালে। কি সুন্দর হাসি। ইউসুফ বলল,,

--" তাইতো আমিও ভালবাসি। সেই দাগে ভরা  রক্ত মাংসে গড়া মানুষটিকে!"

কুহুর চোখ মুহূর্তে ছল ছল করে উঠলো। এ লোকটা তাকে এতো ভালবাসে কেন?
ইউসুফ এগিয়ে এলো। চোখের কোনের পানি মুছে বললো,,

--"চাঁদের গায়ে সেই জ্বলজ্বল করা আলো হতে চাই।  দিবি বাবুইপাখি?  আমাকে সেই আলো হতে?"

কুহু এবার জড়িয়ে ধরলো ইউসুফকে। তার বুকে মুখ গুঁজে হু হু করে উঠলো। ইউসুফও যেন তার উত্তর পেয়ে গেল। কুহুকে বাহুডোরে শক্ত করে আবদ্ধ করে রাখলো। মৃদু আওয়াজে বলল,,

---" ভালবাসি বাবুইপাখি! খুব খুব বেশি!"

ইউসুফের মুখে ভালবাসি কথাটুকু শুনে সেদিন কতই না কেঁদে ছিল কুহু।  সেদিনের মতো আজও কাঁদচ্ছে কুহু। কিন্তু তাদের মাঝে কান্নার কারণটা ভিন্ন। তখন কেঁদেছিল ভালবাসার মানুষটির মুখে ভালবাসি কথাটি শুনে। আর আজ কাঁদছে সে মানুুষটি তার থেকে কত দূর সে চলে গেছে সে কথা ভেবে।

—————

---" আপা রান্না কি বসাবেন না?"

চিত্রাদের বাসার কাজের মেয়ে টুম্পার কথায় ধ্যান  ভাঙ্গে।  এতক্ষণ সে যে হারিয়ে গেছিলো ডাইরির পাতায় । চোখের সামনে যেন এ মানুষ দুটোকে দেখতে ও অনুভব করতে পাচ্ছিল সে। সন্ধ্যা প্রায় হয়েই এলো। চিত্রার সেদিকে কোনো খেয়ালী ছিল না । 
বাড়ির সব কাজ টুম্পা করলেও চিত্রা রান্নার কাজ করত। কিন্তু এখন এ মুহূর্তে চিত্রা ডায়রিটা ছেড়ে উঠতে চাইলো না। ইউসুফ-কুহু একে অপরকে ভালবেসে থাকলে আলাদা কেন? আর কুহু নিজের ভালবাসার মানুষটির বিয়ে এটেন্ড কিভাবে করবে? ভেবে পাচ্ছে না। এখন তার এক কাজ আগে এটি শেষ করবে তারপর অন্য কিছু। চিত্রা ডায়রিটা হালকা বন্ধ করে বলল,,

---" টুম্পা? আজ তুই রেঁধে ফেল বনু। আমার ভাল লাগছে না।"

টুম্পা অবাক হলো।সে ছোট বেলা থেকেই তাদের সাথে।কখনই রান্না করতে দেয়নি চিত্রা তাকে।  সে যতই তার শরীর খারাপ থাকতো না কেন। আজ যে তাকে রান্না করতে বলছে? অবিশ্বাস্য।টুম্পা  হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে ছোট করে  বলল,,

---" আইচ্ছা আপা!"

চিত্রা আবার ডায়রিটা খুলে পড়তে শুরু করলো।সে এ মুহূর্তে অন্যদিকে ধ্যান দিতেই চায় না।

ঘন্টা দুয়েকের মাঝে সুমি তার দুই মেয়েকে নিয়ে পৌছে যায় তার ভাইয়ের বাড়ি। আদরের ভাতিজা ইউসুফের বিদেশ  থেকেই ফিরেছে কিছুদিন হলো। আসতেই বিয়েও ঠিক হয়ে গেল হুট করে। বিয়ে উপলক্ষেই আসা তাদের। তারা দাঁড়িয়ে আছে একটি বাড়ির সামনে। কুহু বাড়ির নেমপ্লেট টার দিকে তাকালো। সাদা পাথরে কালো কালিতে লিখা "বৃষ্টি বিলাস"।

চিত্রা চমকে উঠলো " বৃষ্টি বিলাস " নামটি শুনে। তার মানে এই বাড়ির অতীতে লুকিয়ে আছে এ দু মানব-মানবীর ভালবাসার তাজমহল?চিত্রার মনে আরো কৌতূহল সৃষ্টি হলো ডায়রিটা পড়ার। চিত্রা আবার পড়তে শুরু করলো....

কুহু তার মার সাথে বাড়ির মুল ফটকে পা রাখতেই মিহু বলল,,

---" মা দেখো মামা বাড়ি কত সুন্দর হইছে আগে থেকে!"

সুমি হাসলো ছোট মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,,

---" হে বাড়িটি অনেক পরিবর্তন হয়েছে। "

তারপর তার বাড়ির সদর দরজা পেরিয়ে  বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলো। বড় হল রুমটিতে অনেক সুন্দর সাজানো গোছানো। ঠিক মাঝা-মাঝিতে আছে সুন্দর কারুকাজ করা সিড়ি যা উপরের উঠে গেছে। কুহু খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে লাগলো চারিদিক।  সত্যি সব কিছু পরিবর্তন করেছেন তার মামারা। 

---"ও মা তোরা এসে গেছিস? মা মা দেখে যান আপনার কলিজার ধন এসে গেছে।"

মাঝ বয়সী এক মহিলা সিঁড়ি বেয়ে নিচে  নামতে নামতে চেঁচিয়ে ডাকলেন সবাইকে। সুমি এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরেলেন তাকে,,

---" কেমন আছো ছোট ভাবি? "

আয়শা হাসি মুখে জবাব দিলেন,,

---"আলহামদুলিল্লাহ ভাল। তা তোমরা কেমন আছো? আরে মিহু না?  কত বড় হয়ে গেছে দেখ! আরে কুহু 
ওখানে দাঁড়িয়ে কেন এখানে আয়।"

কুহু হেসে সামনে গেলো,,

---" কেমন আছো ছোট  মামনী?

---"ভাল আছি আমি।  দাঁড়িয়ে আছিস কেন বস এখানে।

কুহু বসলো। তখনি মিহু এদিক ওদিক উঁকি দিয়ে বলল,,

---" ছোট মামনী নুশরা-বুশরা কই? "

আয়শা হেসে বলল,,

---" এরা দুটা হয়েছে বাদরের মতো সারাদিন ছোটা ছুটি করে ঘুড়ে বেড়ায়। দেখ উপরে আছে হয়তো। যা!"

মিহু ছুটে উপরে চলে গেল। সুমি বলল,,

---" বাসায় কেউ নাই নাকি ছোট ভাবি? বড় ভাবি, মিশু তারা কই?"

আয়শা কাজের মেয়েকে চা দিতে বলে সুমিকে বলল,,

---" শপিং করতে বেড়িয়েছে এঙ্গেজমেন্টের বেশীদিন বাকি নেই কিনা?তার পরপরই বিয়ে। আর মা মনে হয় ঘরে আছেন।"

---" নানু ভাই যে আমার? কখন এলি তুই। নানুমাকে বুঝি মনে পড়ে নাই তোর?

তাদের কথার মাঝেই উপস্থিত হয় নাহার।অভিমানের সুরে কথাটুকু বলে উঠেন তিনি কুহুকে উদ্দেশ্য করে।  নাতনিটি একে বারে তার রূপ রপ্ত করেছে যেন। লম্বা ঘন চুল। সাদা টকটকে ফর্সা গায়ের রং।ডান গালের থুতনির তিলটাও পেয়েছে তার মতোই। ছোট থেকেই এই একটি কারণে কুহুকে তিনি সব থেকে বেশি আদর করতেন। কুুহু তার নানুমাকে ঝাঁপটে ধরে বলল,,

---" কেমন আছো নানুমা! এতই যদি মনে পড়তো গেলে না কেন আমাদের এখানে? আমার এখানে না হয় আসতে মানা, কিন্তু তুমিতো যেতেই পারতে?"

অভিমান স্পট কুহুর কন্ঠেও। নাহার কুহুর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,,

---" কে বলছে তোর এখানে আসতে মানা? এটা কি তোর বাড়ি না? "

কুহু প্রতিউত্তর কিছু বলল না। যতই বলুক আসতে মানা নেই? কিন্তু তার এ বাড়িটিতে যে আসতেই ইচ্ছে করে না। শুধু একটি মানুষের জন্যই। সে মানুষটি যে তাকে ঘৃণার চোখে দেখে। তার সাথে এ বাসার কিছু মানুষ যে তাকে বাঁঁকা চোখে দেখে। তা ছোট থাকতেই বুঝে ফেলে কুহু। কুহুর চোখ আবার ভিজে উঠলো। সবার অগোচরে চোখের জল টুকু মুছে নিলো। তখনি শুনা গেলো বাহিরে কিছু মানুষের কন্ঠ। যারা এদিকেই আসচ্ছে। তাদের মাঝে ভেসে আসচ্ছে একটি পরিচিত কন্ঠ।  কুহুর বুঝতে বাকি নেই তার পরীক্ষা  এখন থেকেই শুরু। হে পরীক্ষা!  এই কঠিন মানুষটির সামনে নিজেকে শক্ত রাখার পরীক্ষা। কিন্তু কুহু কোনো মতেই এ মুহূর্তে ইউসুফের মুখামুখি হতেই চায় না। সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,,

---" ছোট মামনী আমার রুমটি?"

আয়শা হেসে বলল,

---" আগেরটাই!"

কুহু আর এক সেকেন্ড দাঁড়ালো। কুহু আগে তিনটি বছর কাঁটিয়েছে এই বৃষ্টি বিলাসে। তখন তার নির্দিষ্ট একটা রুম দিয়েছিল  মহসিন। বড়ই আদরের ভাগ্নি ছিল তার।  বলেছিল সে যতদিন এ বাড়িতে থাকবে বা পরে আসবে এ রুমটি তারই থাকবে।দ্রুত স্থান ত্যাগ করে ফেললো কুহু। এদিকে ইউসুফ তার মা মাইশার সাথে কোনো কিছু নিয়ে চেঁচিয়ে কথা বলতে বলতে বাসায় ঢুকলো। সোফায় সুমিকে বসে থাকতে দেখে চুপ করে গেল। তারপর ভাল-মন্দ জিগ্যেস করে উপরে চলে গেল সে। তখন আয়শা জিগ্যেস করলো,,

---"বড়পু কি হলো ইউসুফ চেঁচাচ্ছিল কেন?"

মাইশা শাড়ির আঁচলে কঁপালের ঘাম মুছতে মুছতে বললেন,,

---" আর বলিস না! মেয়ের বাবা এত শখ করে একটা সেরবানি কিনে দিতে চাইলো তাকে। কিন্তু তিনি মুখের উপর না করে বসলেন। তাও আবার বলেও দিল আমি এসব রং চং মাখা জামা কাপড় পড়বই না। জানিস বেয়াই সাহেবের মুখটা ছোট হয়ে গেছিল মুহূর্তেই।"

সুমি  বলল,,

---" ইউসুফতো এমনি বড় ভাবি যা পছন্দ না তার, তা সে মুখের উপর বলতে দু মিনিট সময় নেয় না।"

মাইশা সুমির পাশে বসে বলল,,

---" হে ঠিক বলেছো!  তা তুমি কেমন আছো? ভাবিদের ভুলেই গেছো একদম!"

সুমি হেসে বলল,,

---"তেমন কিছু না ভাবি। সময় পাচ্ছিলাম না একদম!"

নাহার বলল,,

---" ঠিক আছে এবার এসেছিস সহজে ছাড়ছি না তোকে।"

সুমি হেসে সম্মিত জানালো।

কুহু ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হতেই মিশুকে দেখতে পায় খাটে বসে পা নাড়াচ্ছে। কুহুকে দেখেই জড়িয়ে ধরে সে বলে,,

---" বড্ড বেইমান হয়ে গেছিসরে তুই। ভুলেই গেছিস একদম আমাকে?"

কুহু মলিন হাসলো। বলল,,

--" না মিশুপি ভুলি নাই তোমাকে। লজ্জায় যোগাযোগ করতে পারিনি।"

--" পুড়ানো কথা ভুলে যা কুহু। দেখ ভাইয়াও মুভ  ওন করছে। তুইও করে ফেল। এসব মনে রেখে দুঃখ ছাড়া আর কিছুই পাবিনা জীবনে।"

--"দুঃখ, কষ্ট কেউ তো আমায় যেচে পড়ে দেয়নি মিশুপি। আমি নিজ থেকেই অর্জন করে নিয়েছিলাম যে! "

ধরে আসলো কুহু কন্ঠ। মিশু বিছানায় কুহুকে বসাল। বলল,,

--"সময় খারাপ ছিল তোর।  এসব বাদ দে এগিয়ে চল। দেখ ভাইয়া আজ কত সাবলীল ভাবে চলা-ফেরা করছে।"

কুহু মনে মনে বলল,," মানুষটি কি তাকে সত্যি ভুলে গেছে?পরমুহূর্তে এটি ভাবলো,, এটা কি স্বাভাবিক নয়? যাকে সে অফুরন্ত ভালবাসতো সে মেয়েটিই তাকে ধোকা দিয়ে ছিল!  তাহলে কেন পারবে না তাকে ভুলতে?"

কুহু  এই  বিষয়ে আর কথা বলতে চায় না। পুড়ো বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে বলল,,

---"তোমার কথা বল? জিজু কেমন আছে? বিয়ে কবে করছো?"

মিশু খানিকটা লজ্জা পেল কুহুর কথায়। লজ্জায় গাল দুটি লাল টমেটো হয়ে গেল। বলল,,

---" ভাল আছে! ভাইয়ার বিয়ের পর আসবে তারা!"

কুহু হেসে বলল,,

---" ভালই হলো দুটি বিয়ে খেয়ে যাচ্ছি এবার!"

কুহুর কথায় মিশু অতি অবাঞ্ছনীয় এক প্রশ্ন করে বসলো,,

--"তোর খারাপ লাগচ্ছে না কুহু?  ভাইয়ার বিয়ে!সে অন্য কারো হয় যাবে?"

এমন প্রশ্নে কুহু অপ্রস্তুত হয়ে  পড়লো। কি বলবে সে ভেবেই পেলো না। উঠে গেল। পিছন থেকে মিশু বলে উঠলো,,

---" কুহু সত্যি বলতো? তুই তোর সেই বিলাই চোখ ওয়ালা ইউসুফ ভাইকে কখনো ভালবাসিস নি?"

কুহুর চোখ থেকে এবার জল গড়িয়ে পড়লো। কোনো এক সময় ইউসুফ তার ক্রাশ থাকলেও ভালো যে তাকেই বেসেছিল মনের অন্তস্থল থেকে। সেটাই বুঝতে আজ পাঁচ বছর কেঁটে গেল তার। কুহু জলটুকু মুছে ফেলে। ঘাড়  কাত করে মিশুর দিক তাকিয়ে  শক্ত গলায় বলল,,

---" নাহ্। "

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন