২৫!!
আশেপাশে ছোটোখাটো একটা শোরগোলের শব্দ শুনে মায়রা অনেক কষ্টে চোখ খোলার চেষ্টা করলো৷ চোখ খোলার পরও চোখের সামনের অন্ধকারটা কাটতে বেশ কিছুটা সময় লাগলো। যেন আধো জাগরণে কোন এক কাল্পিক দুনিয়ায় আছে ও৷ মনে হচ্ছে ওকে ঘিরে ছোট খাটো একটা জটলা তৈরি হয়েছে। আর ওর চারপাশে জটলা পাকিয়ে থাকা মানুষগুলোই কোন এক দুর্বোধ্য ভাষায় কিছু বলাবলি করছে। ঠিক বুঝতে পারছে না মায়রা। না তাদের ভাষা বোধগম্য হচ্ছে মায়রার, না কোথায় আছে সেটা বুঝে উঠতে পারছে। এর মধ্যেও নিজের হাত পা নাড়ানোর চেষ্টা করতেই যে অসহ্য তীক্ষ্ম একটা ব্যথা অনুভব করলো সেটাই মায়রাকে জানান দিচ্ছে যে ও বেঁচে আছে। আশেপাশের সব দুর্বোধ্যতার পাঁচিল ভেদ করেও এই কথাটাই শুধু মায়রা অনুভব করতে পারছে।
চোখের সামনে থেকে কুয়াশার মেঘটা ধীরে ধীরে কাটতে শুরু করায় মায়রার কানেও আশেপাশের গুঞ্জনটা স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। আর চোখের সামনে হালকা আলোক রশ্মিটা দেখতে পাওয়ার পরেই মুখগুলোও স্পষ্ট হলো মায়রার কাছে। মায়রা একটু হাসার চেষ্টা করে বিছানার চারপাশে উদভ্রান্তের মতো মুখগুলোকে একবার দেখার চেষ্টা করলো। মানুষগুলোর চোখে মুখে ভয়, রাগ, কষ্ট সবকিছুই যেন একসাথেই খেলা করছে। কি করে ফ্লোর থেকে বিছানা পর্যন্ত পৌঁছেছে সেটা নিয়ে মাথা ঘামানোর বিন্দুমাত্র চেষ্টা না করেই মায়রা নিজের ভাগ্যের পরিহাসেই একটু হাসার চেষ্টা করলো। একেবারে মরে যেতে পারলো না ও! খুব কি ক্ষতি হতো তাতে? নাহয় কিছু মানুষ মুক্তিই পেয়ে যেত। নাহয় এই জীবন নামের কারাগার থেকে ও নিজেই মুক্তি পেয়ে যেতো! একটু পরে গালে কারো হাতের ছোঁয়া পেতে আবার দেখার চেষ্টা করলো মায়রা। চোখ জোড়া বারবার বুজে আসতে চাইছে ওর। খুব কষ্ট করে তাই দেখতে চেষ্টা করলো মায়রা। ছোট্ট গুটি গুটি এক জোড়া হাত মায়রা গালে হাত দিয়ে ঝাঁকিয়ে ওকে কিছু একটা বলছে। মুখটা অস্পষ্ট হতে চাইছে বারবার। তবু সেই ছোট্ট মুখটা চিনতে পারলো মায়রা। বাঁধন।
-মায়রাপু? ও মায়রাপু? তোমার কি হয়েছে? তুমি কথা বলো না কেন? ও মা? দেখো না? মায়রাপু কথা বলছে না--। আমার দিকে এখনই তো তাকিয়েছিল--। ও বাবা! আপুকে বলো না আমি আর দুষ্টুমি করবো না। লক্ষী ছেলে হয়ে থাকবো তো। ও মায়রাপু? দেখো না?
-পেশেন্টের সামনে এমন কান্নাকাটি করাটা মোটেও ঠিক হচ্ছে না--। আপনারা দয়া করে বাচ্চাটিকে অন্য রুমে---।
-না না না--। আমি মায়ুপুর সাথেই থাকবো--। কোথাও যাবো না---। না না --।
-আচ্ছা আচ্ছা। ঠিক আছে--। থাকো৷ কিন্তু কান্নাকাটি বা চিৎকার চ্যাঁচামেঁচি করবে না বাবু--। মনে থাকবে?
-জি আঙ্কেল---।
-সামি? আমার মনে হয় ঘটনাটা পুলিশকে জানিয়ে রাখলে ভালো হবে--। এভাবে একটা মেয়েকে যে মেরেছে তার শাস্তি হওয়া উচিত--। আমার বিশ্বাস এটা প্রথমবার ঘটছে না ভাগনির সাথে--। অন্তত ওর গায়ের দাগগুলো তো সেটাই বলছে---।
-ওই অমানুষটাকে তো আমি ছাড়বোই না--। কিন্তু মেয়েটা একটা বার সুস্থ হোক--। তারপর না হয় কোন স্টেপ নেয়া যাবে---।
-হুম---। জ্বরটা অনেক বেশি--। আর মেয়েটাকে ফুল সেন্সে আসার জন্য ইনজেকশনও দিলাম-। কিন্তু কি হচ্ছে বুঝতে পারছি না-। ও কোনো রেসপন্সই তো করছে না--। আভাকে একবার ট্রাই করতে বল--। ওর ডাকে যদি সাড়া দেয় মেয়েটা---।
-হুম---। আভা----?
মায়রা বুঝতে পারছে আলোচনাটা যে ওকে নিয়েই হচ্ছে। সামির এই ডাক্তার বন্ধুটাকেও চিনতে পারছে মায়রা। কিন্তু তাদের কারো কথার রেসপন্স করতে পারছে না। কেন পারছে না সেটাও কিছুটা দ্বন্দ্বের মায়রার কাছে। ইচ্ছে করছে না কারো কথার রিপ্লাই করতে! নাকি বলতে পারছে না! মস্তিষ্কটা কি একেবারেই অকেজো হয়ে গেছ ওর! সেরকম কিছু ঘটেছে বলেও মায়রার মনে পড়ছে না। আপাতত সমস্ত শরীরে প্রচন্ড ব্যথাই একমাত্র অনুভব হচ্ছে। আর বাদবাকি পৃথিবীর সবই এই ব্যথার কাছে তুচ্ছ। এসব ভাবতে ভাবতেই টের পেল কয়েকজন মানুষ এসে ওকে ঘিরে ধরেছে। এর মধ্যে একজন মায়রার মাথার কাছে বসে কেঁদেই ফেলেছে। এই মানুষটাকেও মায়রা চিনতে পারলো। আভা, ওর মামনি।
-এই মায়ু? শোন না? কথা বল না মা প্লিজ? জানিস? আজ সকাল সকাল তোকে দেখতে কে এসেছে? উঁহু--। আমি বলবো না। তুই নিজেই গেস করতো--। দেখি বলতে পারিস কিনা। কিছু তো বল প্লিজ মায়রা?
-মেয়েটার কি অবস্থা হয়েছে দেখেছো? তোমার বাবা মা মানুষ? নাকি অন্য কিছু? নিজেদের শান্তশিষ্ট মেয়েটাকে একেবারে লাশ করে ফেলেছে অমানুষটা সেসব দেখেও---।
-তুমি থামো প্লিজ---।
-আজ ওর জায়গায় তুমি থাকতে তাথৈ--। কথাটা ভুলে যেও না--। তুমি আমার সাথে চলে এসেছিলে বলে তোমার পরিণতিটা হয়তো এটা হয়নি---। কিন্তু ওই অমানুষটা--মায়রার মতো ফুটফুটে হাসিখুশি মেয়েটাকে কেমন জীবন্ত লাশ বানিয়ে দিয়েছে দেখছ? তবু তোমার বাবা মা তার হয়েই কথা বলছে এখন! এরা সত্যই কি মানুষ!!
-রিহান---! চুপ করো তো একটু-। যারা কখনোই কিছু বুঝতে চায় নি তারা আজ হুট করে কিভাবে বুঝবে? সন্তানের সুখ চাই বলে বলে যে তাকে সোজা নরকে ঠেলে দিয়েছে সেটা বোঝার ক্ষমতা যদি থাকতো তাহলে আজ মায়রার পরিণতিটা এমন হতো না--। আর না আমাদের তাদের বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়েটা করতে হতো।
-কিন্তু----।
-জানি তোমার খারাপ লাগছে--। কিন্তু কি করবে? যে নিজে বদলাবে না তাদেরকে তো তুমি হাজার চেষ্টা করেও বদলাতে পারবে না-। আগে মায়ুকে সুস্থ হতে দাও--। এই মায়ু? বনু? শুনছিস? আপুই চলে এসেছি আর কোন ভয় নেই---। তোর কিচ্ছু হতে দিবো না--।
এতোক্ষণে মায়রার দু চোখ বেয়ে দু ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো। কোনমতে ঠোঁট জোড়া নাড়িয়ে অস্ফুট স্বরে কিছু বলার চেষ্টা করলো। কিন্তু একটা শব্দও বের হলো না গলা দিয়ে। মায়রা হাল ছাড়লো না। আরেকবার নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে চেষ্টা করলো হাতটা বাড়িয়ে দেয়ার। অনেক কষ্টেই অসাড় হাতটা সাড়া দিলো এবারে। মায়রা দুর্বল হাতে তাথৈকে একটু জড়িয়ে ধরলো।
-আপু--?
মায়রার এই অস্পষ্ট শব্দটা কারো কানই এড়ালো না। তাথৈ পাগলের মতো মায়রার গালে দু হাত রেখে ডাকলো।
-মায়রু? এইতো আপুই আছি--। একদম ভয় পাবি না--। এইতো আপুই তোর পাশেই আছি---।
-দেখি--। আমাকে চেক করতে দাও--। তাথৈ? তুমি ওর সাথে কথা বলতে থাকো-। ও যাতে আবার সেন্স না হারায়---। কিপ হার টকিং--।
-হুম--। এই মায়রা? শুনছিস? তাকা আমার দিকে? ঘুমাবি না একদম--। তাকা?
এক মূহুর্তের মধ্যেই সবাই সক্রিয় হয়ে উঠলো। ডাক্তার আঙ্কেল মায়রার নাড়ি চেক করছে, আভা আর সামি মায়রার হাত পা ঘষছে, তাথৈ মায়রার মাথার কাছে বসে ওকে জাগিয়ে রেখে কথা বলানোর চেষ্টা করছে, আর কান্নারত বাঁধবকে শান্তনা দিচ্ছে রিহান। মায়রা বুঝতে পারছে না সবাই এতো টেনশন করছে কেন। ও তো দিব্যি ঠিক আছে। শুধু ব্যথায় শরীরটা আড়ষ্ট হয়ে আছে, এতোটুকুই তো!
মায়রাকে সম্পূর্ণ সেন্সে আনতে আরো ঘন্টাখানেক সময় লাগলো। বেশ কয়েকটা ইনজেকশন দেয়ায় হাতের রগটা দগদগ করছে মায়রার। বালিশের সাথে হেলান দিয়ে খাটে বসতে মায়রার মনে হচ্ছে শরীরে কেউ কয়েক শো চাবুকের ঘা বসিয়েছে। আভা ফোঁপাতে ফোঁপাতে নিজের হাতে ভাত মাখিয়ে মায়রার মুখের সামনে ধরতেই মায়রা একটু দুর্বল চোখে তাকালো আভার দিকে।
-মামনি?
-হা কর মায়রা৷ কোন কথা না--। খেতে হবে এখন--। খেয়ে ওষুধ খাবি--। এভাবে বিছানায় পড়ে থাকলে তো চলবে না-। তোকে উঠে দাঁড়াতে হবে--। ওই বদমাইশ সীমান্তকে এর জবাব দিতেই হবে--। কাল ওভাবে শয়তানটা বেরিয়ে যাওয়ার পরই রুমে আমি আর তোর মামা না এলে কি হতো ভাবতে পারছিস?
-বাদ দাও না মামনি---।
-একটা থাপ্পড় লাগাবো বলে দিলাম মায়রা--। সীমান্তের ব্যাপারটা পরে দেখছি--। তুই হা কর এখন?
-তুমি এখনও আমাকে মারবে বলছো মামনি!
-না খাওয়ার জন্য আবার নাটক করলে কিন্তু সত্যিই মারবো মায়রা।
-মামনি?
-হা?
মায়রা মুখ কালো করে একটু একটু করে খাচ্ছে দেখে তাথৈ এসে মায়রার পাশে বসে চুলে হাত বুলিয়ে দিলো।
-কি রে ছোটি? মুখ কালো করে আছিস কেন? না খেলে ওষুধ খাবি কি করে বাবা? আর নিজে না সুস্থ হলে লড়াই করবি কি করে?
-আপুই? আমাকে এখান থেকে দূরে কোথাও নিয়ে যাবি প্লিজ? কয়েকটা দিনের জন্য? আপু প্লিজ?
-আচ্ছা ঠিক আছে---। আমি রিহানকে বলে দিবো--। তুই আগে সুস্থ হয়ে ওঠ--। কেমন?
-সত্যি নিয়ে যাবে?
-হুম--। এখন খা তো---। সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে-। খা এখন।
-হুম।
মায়রা কিছু না বলে এবারে একটু কষ্ট করে খাবারটা গিলতে লাগলো। আর ভাবতে লাগলো এই অসহ্য ব্যথাটা বেশি কষ্টের? নাকি এভাবে প্রতিনিয়ত অপমানিত হয়ে বেঁচে থাকাটা? এই অপমানের জীবনটা থেকে আসলেই কি কখনো বের হতে পারবে ও? কে জানে! জীবন কোথায় নিয়ে দাঁড় করাবে ওকে কে জানে! আপাতত জীবনের এই বহমান স্রোত যেদিকে নিয়ে যেতে চায় সেদিকেই নাহয় পাল বিড়িয়ে বসে থাকবে ও। জীবন যেদিকে চায় ভাসিয়ে নিয়ে যাক। আজ সব হারিয়ে মায়রার অবশ্য আর কিছু করারও নেই।
২৬!!
দেখতে দেখতে চারটা দিন কেটে গেছে। একটা ফুরফুরে বাতাস চোখে মুখে এসে পড়ায় মায়রা চোখ খুলে তাকালো। খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে দুদিকে হাত ছড়িয়ে দিয়ে চোখ বুজে শ্বাস নিচ্ছিলো মায়রা। কক্সবাজারের হালকা ঠান্ডা বাতাস মনের সমস্ত চাপা ব্যথা কেমন উড়ে উড়ে যাচ্ছে যেন। মায়রার ঠোঁটের কোণে হালকা হাসিটা দেখে ভালো লাগছে তাথৈ আর রিহানের। কিছুক্ষণ বাতাসের ছোঁয়া অনুভব করে মায়রা ওদের কুঁড়েঘরের মতো কটেজটা ঘুরে দেখায় মন দিলো। নামি দামি হোটেলে রুম ভাড়া না করে ইচ্ছে করে এমন কটেজ নিয়েছে রিহান। জায়গাটাও অনেক সুন্দর। পাশাপাশি বেশ অনেকগুলো কুঁড়েঘর টাইপের কটেজ রুম এখানে। সবগুলো কটেজই বিশাল একটা করিডর দিয়ে একসাথে জুড়ে দেয়া আছে৷ সাগর থেকে বেশ কিছুটা দূরে হলেও বেশ ফুরফুরে বাতাস এসে লাগে করিডোরে দাঁড়ালেই। জায়গাটা বেশ পছন্দ হয়েছে।
তাথৈ এসে মায়রার পাশে দাঁড়িয়ে চুলে হাত ছোঁয়ালো। মায়রা হেসে তাথৈকে জড়িয়ে ধরলো।
-আপুই--।
-মায়রু? পছন্দ হয়েছে কটেজ?
-হুম--। ভিষণ--। থ্যাংক ইউ ভাইয়া। থ্যাংকু আপু--। ইশ! মামা, মামনি আর বাঁধন এলে কতো মজা হতো!
-বাঁধনের স্কুল আছে তাই আসে নি--। পরে আবার সবাই মিলে আসবো আমরা--। কেমন?
-হুম---।
-মায়ু? এখন ফ্রেশ হয়ে কিছুক্ষণ রেস্ট কর--। যা--।
-আপুই? আর একটু থাকি না প্লিজ?
-মাইর লাগাবো মায়ু--। এখন বিকেলে রোদ অনেক বেশি প্রখর। এখন যেতে হবে না---। সূর্য ডোবা দেখতে যাবো---। উমমম--। কথা না কোনো--। শরীরের দিকেও তো খেয়াল রাখতে হবে নাকি?
-উহু---। এমন করো কেন? আমি একটু সাগর পাড়ে গিয়েই চলে আসবো--। প্রমিস---।
-বেশি বায়না করলে কিন্তু নিবোই না বলে দিলাম মায়রা--।
-উহুম--। আপুই?
-এখন যা--। ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নে-। আমাদের পাশের কটেজটা তোর--।
-হুম--। সন্ধ্যায় কিন্তু যতক্ষণ ইচ্ছে সাগরে থাকবো--। বলো দিবা?
-আচ্ছা বাবা। ঠিক আছে--।
-হুম--। রিহান ভাইয়া? আপনার হিটলার বউ পরে পল্টি খেলে কিন্তু মানবো না বলে দিলাম--। আপনি সাক্ষী কিন্তু---।
-মায়রা---? দাঁড়া তুই--।
মায়রার ছুটে পালানো দেখে রিহান আর তাথৈ দুজনেই হেসে ফেললো। মেয়েটার ঠোঁটের কোণে আগের মতো সেই ছেলেমানুষির হাসিটা ফুটিয়ে তুলতে পেরে ওদের দুজনেরই ভালো লাগছে। এই হাসিটা যেন মেয়েটার ঠোঁটের কোণে সবসময় বজায় থাকে তার জন্য ওরা সবরকম চেষ্টাই করবে।
এদিকে আরিশা গাল ফুলিয়ে বিছানায় হেলান দিয়ে এক বাটি নিউটেলা নিয়ে বসেছে। একটু পর পর বাটিতে চামচ ডুবিয়ে বাচ্চাদের মতো নিউটেলা খাচ্ছে আর রাগে ফুঁসছে। তাওহীদ কিছু বলার চেষ্টা করলেই একবার রাগী চোখে তাকিয়ে আবার নিজের মতো করে নিউটেলা খাওয়ায় মন দিচ্ছে। তাওহীদ আর কি করবে? বেচারা বুঝতে পারছে না হঠাৎ ম্যাডামের এমন রণচন্ডী রূপ ধারণের কারণটা ঠিক কি। অনেক ভেবেও কূল কিনারা করতে না পেরে শেষ মেশ তাওহীদ নিজেই আরিশার সামনে এসে বসলো। আরিশা একবার তাওহীদের মুখের দিকে বিরক্তভরা চোখে তাকিয়ে ভালো করে হেলান দিয়ে লিকুইড চকলেট মুখে পুরলো। তাওহীদ আরিশার হাতে ধরা বাটিটার দিকে হাত বাড়িয়ে দিতেই আরিশা আরো বেশি বিরক্ত হলো।
-কি সমস্যা তোমার? আমার চকলেটের দিকে নজর দিচ্ছো কেন?
-আরু? এখন আর খেয়ো না চকলেট প্লিজ। লাঞ্চ করতে পারবে না তো বাবা---।
-একে তো এখানে ঘুরতে নিয়ে এসেও বন্দী করে রেখে দিয়েছে, আবার বলে কিনা চকলেট খেও না! এই যাও তো তুমি সামনে থেকে-। অসহ্য!
-ও আচ্ছা! ম্যাডাম তাহলে এইজন্য খেপে আছে? আরে বাবা এই ভর দুপুরে বাইরে গেলে তোমার আর বাবুটার শরীর খারাপ করবে তো-। মাঝে মাঝে এমন বাচ্চাদের মতো জেদ করো না তুমি!
-এই যাও তো সামনে থেকে--। ভর দুপুর দেখাতে আসছে সে আমাকে। যাও তো যাও--। তুমি আর আয়ান দুজনকেই দেখে নিবো আমি দেখবা--।
-আরু? ---আরে বাবা এতো রাগ কেন করছো? লাঞ্চটা করে কিছুক্ষণ রেস্ট করো--। তারপর যাবো। এতোটা পথ জার্নি করে এসেছ--।
-হ্যাঁ! বাবা! পুরো দুই তিন লেগে গেছে আমাদের চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার আসতে! এতো লওম্বা জার্নি! ও মাই গড! যাও তো--।
-আরে! আরু? বাবা! উফফ। আচ্ছা লম্বা জার্নি ছিলো না মানছি--। কিন্তু জার্নি তো করেছ? একটু খেয়ে রেস্ট তো করতে হবে--। আর এখন তো রেস্টের সময় তোমার---।
-এই? তুমি যাবা আমার সামনে থেকে এখন?
-জি না ম্যাডাম--। খাবার অর্ডার করে এসেছি--। আগে খেয়ে নিবে তারপর যা বলবে শুনবো--। আর চকলেট আর খেতে হবে না--। দাও বাটিটা আমাকে--।
-না--। আর এটা নেয়ার চেষ্টা করলে ভালো হবে না তাওহীদ-। বাবু এখন চকলেট খাবে বলেছে-। সো ডিস্টার্ব করবা না একদম--।
-আরু? বেশি চালাকি করার চেষ্টা করবা না একদম----।
-তুমি খাবা?
-হ্যাঁ দাও----।
তাওহীদ আবার হাত বাড়িয়ে চকলেট সুদ্ধ বাটিটা নেয়ার চেষ্টা করতেই আরিশা চট করে বাটিটা সরিয় নিয়ে তাওহীদের গালে একটু চকলেট লাগিয়ে দিয়ে খিলখিল করে হাসতে লাগলো। তাওহীদও হেসে মুগ্ধ হয়ে ওর হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।
-হি হি--। ইশ! আমাকে বোকা বানানোর চেষ্টা না? হুহ--। পারবে ন পারবে না--।
-ও আচ্ছা? তাই নাকি?
-এই? একদম কাছে আসবা না--।
-চকলেট তো চাই আমার---।
-উহু--। দিবো না---। সরো?
-সেটা না হবে না ম্যাডাম--। আপনারা মা মেয়ে দুজনে আয়েশ করে চকলেট খাবেন। আর আমি কি হা করে সেটা শুধু দেখবো? হবে না। আমিও খাবো---।
-আরে? তাওহীদ?
আরিশা একেবারে খাটের সাথে সেধিয়ে গেছে তাওহীদের এগিয়ে আসা দেখে। তাওহীদ আরিশার একদম কাছে এসে দুহাত দিয়ে আরিশার পালানোর পথ আটকালো। আরিশা আর পালানোর রাস্তা না পেয়ে একেবারে থতমত খেয়ে গেছে। আর এই সুযোগে তাওহীদ আরিশার আরেকটু কাছে এসে নিজের গাল আরিশার গালে ঘষে দিয়ে লেগে থাকা চকলেট আরিশার মুখে লাগিয়ে দিলো। আরিশা কেঁপে উঠে চোখ বুজে ফেললো। তাওহীদ আরিশার মুখের দিকে তাকিয়ে আরিশার মুখে লাগানো চকলেটটুকু নিজেই আবার লিক করে নিলো। আরিশা লজ্জা পেয়ে একদম লাল হয়ে গেল। তাওহীদ হেসে আরিশার হাত থেকে বাটিটা নিয়ে আলতো করে কপালে চুমো খেল। আরিশা একটু পর চোখ খুলে তাকালো।
-আরু? এখন লাঞ্চ করবে কেমন?
-হুম---।
-আবার পরে খেও চকলেট, কেমন?
-হুম--। আইসক্রিম এনে দিবা বলো?
-আচ্ছা রে পাগলি দিবো তো। আর বাইরেও যাবো--। রোদের তেজটা একটু কমুক--। কেমন পাগলিটা?
-হুম---।
-এখন তাহলে উঠো? বাবুর খিদে লেগেছে না? আর বাবুর বাবারও খিদে লেগেছে খুব--।
-হুম---।
আরিশার সরার কোন লক্ষণ না দেখে তাওহীদ আরিশাকে আলতো করে বুকে জড়িয়ে নিলো। পাগলিটা লজ্জায় একেবারে লাল হয়ে গেছে। এই পাগলিটা হঠাৎই রেগে লাল হয়ে যায়, আবার হুট করেই লজ্জায় একেবারে তাওহীদের বুকের ভেতরে লুকিয়ে যেতে চায়। ব্যাপারটা চিন্তা করেই হাসলো তাওহীদ। এই পাগলিটার সবগুলো রূপই ওর বড্ড ভালো লাগে। রাগলে ওকে আরো রাগাতে ইচ্ছে করে, লজ্জা পেলে বুকে জড়িয়ে আদর করে দিতে ইচ্ছে হয়। এই পাগলিটার ছেলেমানুষি ভালোবাসা থেকে দূরে থাকা কি সম্ভব? উহু। একদমই না। অবশ্য কোন কিছুর বিনিময়েই এই পাগলিটার থেকে কোন কারণেই কখনোই দূরে থাকতে চায় না তাওহীদ। তার জন্য দুনিয়াটা ছাড়তে হলেও হয়তো পিছপা হবে না তাওহীদ কখনো।