১৯!!
-আহহহহহহহহহ। আবার ওই লোক, আবার ওই লোকটার কাছেই ফিরে যেতে হবে তোমার? আমি রাগ করেছি, অভিমান করেছি, বকেছি, কষ্ট দিয়েছি, মানছি। নিজেও যে এতোগুলো বছর তোমার জন্য তিলে তিলে পুড়ে মরেছি, তোমার অপেক্ষায় দিনের পর দিন, রাতের পর রাত নির্ঘুম কেটেছে আমার সেসব কি কিছুই না প্রজ্ঞা? রাগ করে দূরে ঠেলে দিয়েছি বলে এতো সহজে চলে গেলে? একটাবার সামনে দাঁড়িয়ে কেন বললে না 'আমি যা বলবো সব শুনতেই হবে'? পাঁচ পাঁচটা বছর ধরে বুকের ভিতরে যে যন্ত্রণা নিয়ে ঘুরছি সেই কষ্টটা কি শুধু একা আমার? যদি ভুল করে ভুল বুঝে থাকি তবে সেই ভুলটা চোখে চোখ রেখে ধরিয়ে না দিয়ে কেন ওই লোকটার সাথে যেতে হবে তোমাকে? কেন কেন কেন? এতোদিন পর আমিই তোমাকে পাগলের মতো খুঁজে বের করেছি, তুমি নিজে তো ফিরে আসোই নি। তবু নিজেই জেদ দেখাবে আমাকে? কেন? কেন? কেন?
প্রজ্ঞাকে ফলো করতে করতে কালো রঙের গাড়িটার পিছু নিয়ে মার্কেট পর্যন্ত এসেছিল ধূসর। গাড়িটার ড্রাইভারটাকে একদমই সুবিধের মনে হয়নি ধূসরের। সেজন্য লোকটাকে ফলো করেছে, নাকি প্রজ্ঞার সেইফটির কথা চিন্তা করে, নাকি প্রজ্ঞার সাথে ঠান্ডা মাথায় কথা বলে ভুল বোঝাবুঝিটা মিটিয়ে নিতে চাইছিল, সেটাও ধূসর জানে না। তবে কালো গাড়িটা প্রজ্ঞাকে মার্কেটের সামনে নামিয়ে দিতেই প্রজ্ঞা ভিড় ঠেলে হামিদের দিকে এগিয়ে যেতেই ধূসর নিজের গাড়িটা ঘুরিয়ে নিয়েছে। বিকেল থেকে সারাটা সন্ধ্যে পুরো শহরে পাগলের মতো গাড়ি ছুটিয়েও নিজের রাগটাকে কন্ট্রোলে আনতে পারে নি ছেলেটা। শেষে হাল ছেড়ে দিয়ে যখন অফিসে নিজের কেবিনে এসেছে ততক্ষণে ঘড়িতে আটটা বাজে। নিজের কেবিনটায় কিছুক্ষণ পায়চারি করে হাতের মোবাইলটা ফ্লোরেই সশব্দে ছুঁড়ে ফেললো। মোবাইলের ভাঙ্গা টুকরোগুলো এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়েছে সেদিকেও হুঁশ নেই ধূসরের। কেবিনময় পায়চারি করতে করতে পাগলের মতো চিৎকার করেই কথাগুলো বলছে সে। ধূসরের চিৎকারের শব্দে প্রায় ঝড়ের বেগেই আদিব ছুটে এসেছে। কেবিনের দরজার বাইরে বাকি স্টাফরাও দল বেঁধে কি ঘটছে সেটা নিয়ে কানাঘুষা করছে তার শব্দও ভেসে আসলো দরজা খোলার সময়। খোলা দরজার ফাঁক দিয়ে দু একজন উৎসুক স্টাফ যে উঁকি দেয়ার চেষ্টা করছে সেটা দেখেও কোনো অনুভূতিই যেন হচ্ছে না ধূসরের। ক্লান্ত, শ্রান্ত, পরাজিত সৈনিকের মতো সোফায় থপ করে বসে নিজের মাথা চেপে ধরে বসে আছে ছেলেটা। আর আদিব? সে বেচারা কাঁপা কাঁপা হাতে একটা ফাইল শক্ত করে নিজের চেপে ধরে রেখেছিল এতোক্ষণ। সেটাই কোনোমতে ধূসরের সামনে এনে রাখলো।
-স্যার? এক-এক-একটা ইম্পর্ট্যান্ট ফাইলে-ফাইলে আপনার-আপনার সাই-সাইন লাগবে। আর্জেন্ট। একটা প্রজেক্টের কাজ শুরু হবে কাল থেকে। প্লিজ স্যার?
-মিস্টার আদিব? ফাইলটা রাখুন। আর আপনি এখন যান এখান থেকে। কতবার বলেছি আমি না ডাকলে আমার কেবিনে আসবেন না? আপনারা কি সামান্য এই বাংলা কথাটুকু বুঝতে পারেন না?
-আমমম। স-স্যা-স্যার। আমমমম। আর্জেন্ট সাইনটা লাগবে স্যার। আমি ফাইলটা নিয়ে আপনার বাড়িতেই-বাড়িতেই যাবার জন্য বের হচ্ছিলাম। আসলে কালই ফাইলটা সাবমিট করতে হবে------।
-আর ইউ ডাম্ব মিস্টার আদিব? আমার কথা কি শুনতে বা বুঝতে পারেন না আপনি? জাস্ট গেট আউট। গো।
-স্যার জাস্ট ২ মিনিট সময় লাগবে। আপনি সাইনটা করে দিলেই আর প্রবলেম থাকবে না। আমিও চলে যাবে। জানি আপনি বিরক্ত হচ্ছেন। বাট বিলিভ মি স্যার অনেক কাজ পেন্ডিং এখনও। বড় স্যারও টাউনে নেই। কবে ব্যাক করবেন সেটাও জানি না আমরা। স্যারের অবর্তমানে কাজগুলো চালিয়ে নিতে হবে না স্যার? বিশ্বাস করুন জাস্ট ২ মিনিট সময় লাগবে, কয়েকটা সাইন জাস্ট---। প্লিজ স্যার।
আদিব কথাগুলো বলতে বলতে ধূসরের সামনে ফাইলটা মেলে ধরেছে ততক্ষণে। এই ছেলেটাকে এর আগে এতোটা মরিয়া হয়ে উঠতে কখনো দেখেনি ধূসর। রাগের মাথায় আদিবের এমন কাজে রীতিমতো বিরক্তই হচ্ছে ধূসর। কিন্তু সবসময় শান্ত এই ছেলেটা, যে কিনা ধূসরের একটা ধমক শুনলে কেঁপে উঠে সারাদিনে ধূসরের কেবিনের ধারেকাছেও আসে না, আজ হঠাৎ সেই ছেলেই এতো সাহস করে ধূসরের অর্ডার ডিনাই করছে কেন? ধূসর তীক্ষ্ম চোখে ভ্রু কুঁচকে আদিবের মুখের ভঙ্গিটা বোঝার চেষ্টা করছিল, এমন সময় আদিবের ডাকেই বাধ্য হয়ে ফাইলের দিকে তাকালো ধূসর। ধূসর যে সোফাটায় হেলান দিয়ে বসেছিল সেখানেই ফাইলটা বেশ খানিকটা বাঁকা করেই প্রায় ধূসরের মুখে কাছে ধরে রেখেছে ছেলেটা। আর নিজেও কেমন একটা অদ্ভুত ভঙ্গিতে ধূসরের দিকে ঝুঁকে এসেছে। ধূসর খানিকটা বিরক্ত হয়ে উঠে বসার চেষ্টা করতেই আদিব ব্যস্ত হাতে ফাইলের পাতা উল্টে কিছু একটার দিকে ইশারা করলো।
-এই যে স্যার, এখানটায় সাইন করতে হবে। এই যে এই লাইনটার ঠিক উপরে-------।
আদিবের এমন বাচ্চাদের মতো পয়েন্ট করে কোথায় সাইন করতে হবে সেটা দেখিয়ে দেয়ার ভঙ্গি দেখে ধূসর বিরক্ত হয়ে ফাইলটা আদিবের হাত থেকে টেনে নিয়ে সোজা হয়ে বসে ফাইলটা টি-টেবিলের উপরে রেখে টেবিলের উপর থেকে সাইন করার জন্য কলম নেয়ার জন্য হাত বাড়াতেই আদিব আবার আঙ্গুল দিয়ে লাইনটার দিকে পয়েন্ট করলো। ধূসর এবারে চোখ মুখ লাল করে আদিবের ফ্যাকাশে মুখটার দিকে তাকালো।
-এই যে স্যার? এই যে এই লাইনটার নিচে, এই যে এখানে সাইন করতে হবে।
-হোয়াটস দা প্রবলেম আদিব? আমাকে কি গণ্ডমূর্খ মনে হয় তোমার? আমি জানি না কোথায় সাইন করতে হয়? গাধা ভাবো আমাকে? এক কাজ করো, টিপসই দিই? চলবে? আমি তো পড়তে পারি না স্যার। সিগনেচার না দিয়ে টিপছাপ দিলে চলবে না?
-আমমমমম। স্যার আসলে-----। আসলে স্যার হয়েছে কি এই প্রজেক্টটা আগের প্রজেক্টগুলো থেকে একটু আলাদা। বেশ কিছু ক্লজ----ইয়াপ কন্ডিশন- কন্ডিশন দেয়া আছে বেশ কিছু। তাই বলছি যে একটু যদি চেক করে সাইন করতেন তাহলে পরে কোনো প্রবলেম হতো না। এই আর কি----।
-নো থ্যাংকস। যদি কন্ডিশন ফুলফিল করতে পারবে না মনে হয় তাহলে প্রজেক্ট নিচ্ছ কেন? ডিজগাস্টিং!
-স্যার। বেশি না স্যার। কয়েকটা কন্ডিশন জাস্ট। চেক করে নিন প্লিজ?
-ওকে ফাইন। শো মি। কি এমন কন্ডিশন যে তুমি আমাকে না দেখিয়ে থাকতে পারছ না?
ধূসরের কথায় এতোক্ষণে যেন মুখের ফ্যাকাশে ভাবটা কিছুটা দূর হয়েছে আদিবের। লোকটা বেশ উৎসাহ নিয়ে লাইনটার দিকে আবার পয়েন্ট করলো। এতোক্ষণে লেখাটা স্পষ্ট খেয়াল করে পড়ে আদিবের দিকে তাকালো ধূসর। ইংরেজি লাইনটাকে বাংলা অনুবাদ করলে যা দাঁড়ায় সেটা পড়ে আপনাআপনিই ধূসরের ভ্রু জোড়া কুঁচকে গেছে।
"কিছু না বলে আমার দেখানো লাইনগুলো পড়ে যান স্যার। লাস্ট লাইনটা পড়া হয়ে গেলে আপনি কিছু না বলে শুধু সাইনটা করে দিবেন।"
ধূসরের লাইনটা পড়া শেষ হয়েছে বুঝতে পেরে এবারে আদিব এক এক করে আরো বেশ কয়েকটা লাইনের দিকেই পয়েন্ট করে দেখাচ্ছে। ধূসরও একটু অবাক হলেও চুপচাপ আদিবের কথাটাই মেনে নিয়ে শুধু লেখাগুলো পড়ে চলেছে। পুরো ইংরেজিতে তৈরি একটা প্রজেক্টের ফাইলে এসব ঢোকানোর মানে কি সেটাই বুঝতে পারছে না লোকটা। শুধু লাইনগুলোর কথাগুলোই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে ধূসরের।
"আমাদের এই চেষ্টাটা কাজে লাগবে কিনা জানি না স্যার। আপনি এখান থেকে বেরিয়ে সোজা স্বপ্নকুটিরে চলে যান। আপনার গাড়িতে নয়, পার্কিংয়ে আপনার জন্য সাদা একটা গাড়ি অপেক্ষা করে আছে। যে কাজটা করার সাহস এতোদিন কারো হয়নি, আজ সবাই মিলে সেটাই করতে চলেছি স্যার। জানি না সফল হবো কিনা। কিন্তু জানবো অন্তত আপনাকে সত্যিটা জানানোর চেষ্টা তো করেছি।"
'স্বপ্নকুটির' নামটা পড়তেই ধূসর কিছুটা অবাক হয়েই আদিবের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। এই ছেলেটা ছাড়া স্বপ্নকুটিরের কথা আর কেউ জানে না। এমন কি বাবা মা শুভ্রা কেউ না। গত পাঁচ বছরে একবারের জন্যও বাড়িটায় পা ফেলে নি ধূসর। কিন্তু আদিব স্বপ্নকুটিরে কেন যেতে বলছে? বলছে না ঠিক। এমনভাবে লিখে লিখে কিছু বুঝাতে চাইছে যেন এই রুমে ধূসর আর আদিব ছাড়াও অন্য কেউ আছে, কেউ যেন ওদের কথাগুলো লুকিয়ে শুনছে এমন কেন মনে হচ্ছে ছেলেটার হাবভাব দেখে?
-স্যার কন্ডিশনগুলো মে বি ঠিকই আছে। তবু আপনি একবার ভালো করে চেক করে নিয়েছেন তো? স্যার সাইনটা?
ধূসর এবারে চুপচাপ কিছু না বলেই সাইনটা করে দিল। আদিব ততক্ষণে ফাইলটা বন্ধ করে একটা কার কিজ টি-টেবিলের উপরে রেখে ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা টানলো।
-হ্যাভ এ সেইফ জার্নি স্যার।
আদিব বেরিয়ে যাওয়ার পরও বেশ কিছুক্ষণ পুরো ব্যাপারটা ভাবার চেষ্টা করলো ধূসর। আসলে ঘটছে টা কি? এর আগে আদিব কি কখনো এমন অদ্ভুত বিহেভ করেছে? মনে পড়ছে না ধূসরের। করলেও হয়তো ততটা গুরুত্ব দিয়ে খেয়াল করে নি ধূসর। তবে আজ ছেলেটা কি বলতে চাইছে সেটা জানার বেশ কৌতূহলই হচ্ছে ধূসরের। তাই আদিবের রাখা গাড়ির চাবিটা তুলে নিয়েই প্রায় ছুটে বেরিয়ে গেল। গন্তব্য স্বপ্নকুটির।
অন্যদিকে, সকাল হতে না হতেই আলিশান একটা অফিসের ওয়েটিং রুমে বসে কারো অপেক্ষা করছে প্রজ্ঞা। পাশে হাসিহাসি মুখে হামিদ সাহেব ম্যাগাজিনের পাতা উল্টে পাল্টে যাচ্ছে। ভদ্রলোকের হাসিটায় আজ কেমন একটা নার্ভাসনেসের ছোঁয়া টের পাচ্ছে প্রজ্ঞা। ওর নিজের কাছে যে একটু ভয় ভয় লাগছে না তাও নয়। তবু অপেক্ষা করছে কারো সাথে দেখা করার। বেশ কিছুক্ষণ পরেই একটা মেয়ে এসে প্রজ্ঞাকে একটা কেবিন দেখিয়ে সেটায় গিয়ে বসতে বললো। হামিদ সাহেব সাথে যেতে চাইলে মেয়েটা সোজা বারণ করে দিলো। প্রজ্ঞা একটু হেসে হামিদ সাহেবকে অপেক্ষা করতে বলে কেবিনটার দিকেই এগিয়ে গেল। এক পা দু পা করে কেবিনটায় গিয়ে দাঁড়ালো প্রজ্ঞা। দরজার মুখোমুখি ডেস্কে উল্টোদিকে চেয়ার ঘুরিয়ে কেউ একজন বসে আছে। প্রজ্ঞা কেবিনের দরজায় হালকা আঙুলের টোকা নিয়ে নক করলো একবার।
-মে আই কাম ইন প্লিজ?
প্রজ্ঞার প্রশ্নটা শেষ হওয়া মাত্রই পরিচিত একটা মেয়েলি কণ্ঠের হাসি আর কথা শুনে চমকে সামনের দিকেই এগিয়ে এলো প্রজ্ঞা।
-ওয়েলকাম মিসেস ধূসর আহমাদ। উপস সরি। ওয়েলকাম, ওয়েলকাম, ওয়েলকাম মিস প্রজ্ঞা, এক্স ওয়াইফ অফ মিস্টার ধূসর আহমাদ।
-শুভ্রা! তুমি?
প্রজ্ঞা থতমত খেয়ে সামনে ডেস্কের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে চেয়ার ঘুরিয়ে ফিরে তাকিয়ে আবার শব্দ করেই হাসছে শুভ্রা।
-এতো ভালো টাইমিং তোমার আমার একদমই বিশ্বাস হচ্ছে না জানো প্রজ্ঞা? উফ! বাট ইউ বিট্রেইড মি। তুমি বলে গিয়েছিলে আর ধূসরের লাইফে আসবে না। অথচ দেখো? এতো বেহায়া মেয়ে তুমি মাত্র পাঁচ বছরেই নিজের দেয়া কথাটা বেমালুম ভুলে গেলে? তা ধূসরকে বিদায় দিয়ে ওই বুড়ো ডাক্তারের কাছে চলে গেলে কি করে? কি সিন বলো তো ওই বুড়োর সাথে? আমার জানা মতে লোকটা তো বিয়েও করে নি। অথচ তার সম্পত্তি পুনরোদ্ধারে তুমি হঠাৎ মাসিহা হয়ে এলে কি করে?
-একদম বাজে কথা বলবে না শুভ্রা। এতোটা নিচ মেন্টালিটি কেন তোমার হ্যাঁ? ডাক্তার সাহেব আমাকে নিজের মেয়ের মতো স্নেহ করেন? উনার কারণেই সেদিন সব হারিয়ে মরতে মরতেও বেঁচে গিয়েছিলাম আমি। হয়তো আজ তোমার মুখোমুখি হবো বলেই আল্লাহ সেদিন আমাকে বাঁচিয়েছিলেন। যাতে তোমার মতো একটা অসভ্য নরকের কিটের আসল রূপটা সবার সামনে আনতে পারি আমি।
-ও রিয়েলি? আমি যতদূর জানি তুমি ধূসরের এক্সিডেন্টের পর ওকে ডিভোর্স দিয়ে নিজের পুরোনো কোনো প্রেমিকের সাথে শহর ছেড়ে পালিয়ে গেছিলে।
-জাস্ট শাট আপ। মাকে বোকা বানিয়ে সেদিন আমাকে ধূসরের থেকে দূর করেছিলে তুমি। তুমি তুমি শুভ্রা। আর আমি ধূসরকে ছেড়েও যাই নি।
-তাই নাকি? বাট পুলিশ তোমার সাইন করা ডিভোর্স লেটারটা পাঁচ বছর আগেই পেয়েছে প্রজ্ঞা। আর ধূসরকে দেখছ না? সে তো জানে তুমি বাড়ির সব ক্যাশ, গয়না, এসব নিয়ে জাস্ট পালিয়ে গেছ। কাল বিকেলে বলে নি বুঝি? তা খবর পেলাম নতুন সংসারে একটা মেয়েও আছে তোমার? ভারি মিষ্টি নাকি দেখতে মেয়েটা? কার মতো হয়েছে গো? তোমার? নাকি ওই যে তোমার ডাক্তার ----------।
-জাস্ট শাট আপ।
-কি মুশকিল! আমাকে ধমকাচ্ছ কেন? গত পাঁচ বছর ওই লোকটার সাথে, এক বাড়িতে রয়েছ কথাটা আমি কিন্তু ধূসরকে বলি নি এখনও বিশ্বাস করো? বাইরে বসা তোমার দারোয়ানকে দেখে তোমার এক্স হাজবেন্ড এতোটা জেলাস হয়েছে যে আমার আগুনে ঘি ঢালার দরকারই হয়নি। বিলিভ মি।
-তোমার কষ্ট করে কিছু বলতে হবে না শুভ্রা, যা বলার ধূসরকে আমি নিজেই বলবো। কি করে সেদিন তুমি আমাকে বাধ্য করিয়েছিলে চলে যেতে, কি করে আমার হসপিটালের পেপারে করা সাইনটাকে ডিভোর্সপেপারে দেখিয়েছ, আর কিভাবে এখনও একজন বৃদ্ধ মানুষের শেষ সম্বলটুকু কেড়ে নিতে চাইছ।
-উপস। সেই বৃদ্ধ মানুষের দারোয়ানের সাথে তোমাকে দেখে আমাদের ধূসর সাহেব এতোটা রেগে গেছে যে তোমার কোনো কথা শুনবে বলে আমার তো মনে হয় না। ওকে, তুমি যদি ধূসরকে কনভেন্স করতে পারো সব দোষ আমার, তাহলে আমি সব ফিরত দিয়ে দিবো তোমাকে। তোমার সংসার, তোমার শ্বশুর, শাশুড়ি, তোমার বৃদ্ধ মানুষটার জমি, সব।
-মানে?
-যাও যাও। বাড়িটা এখনও সেইম জায়গাতেই আছে। আমিও অপেক্ষা করছি ধূসর কেমন করে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে তোমাকে বাড়ির চৌকাঠ থেকেই ছুঁড়ে বাইরে ফেলে সেটা দেখার।
-কখনোই না। ঘাড় ধাক্কা যদি পাওয়ার হয় তবে সেটা পাবে তুমি শুভ্রা। আমি নই।
-ওকে, লেটস সি। বাট ধূসর যদি তোমার কথা বিশ্বাা না করে তাহলে তোমাকে কিন্তু তোমার ওই বুড়ো ডাক্তারের কাছেই ফিরে যেতে হবে। কথাটা মাথায় রেখো। নইলে এই শহরে কত কিছু যে হয় রাস্তাঘাটে, বলা মুশকিল। তাছাড়া এতো ছোট বাচ্চাকে অন্য কারো ভরসায় রেখে এভাবে বাইরে বাইরে ছুটোছুটি করতে হয় না প্রজ্ঞা। কখন কি হয়ে যায় বলো তো?
-শুভ্রা? প্রত্যুষার কিছু করার কথা ভাবলেও তোকে খুন করে ফেলবো আমি।
-আমি কি করলাম? এজন্যই বলে কারো ভালো চাইতে নেই। ধ্যাত।
-এই ন্যাকামিগুলো না ভবিষ্যতের জন্য তুলে রাখ। তোর এতোদিনের কৃতকর্মের শাস্তি তোকে আমি নই, ধূসর নিজে দিবে।
-আআআআআআ। সো সুইট। আই উইল ওয়েট ফর হিম। বাট তুমি ফিরে এসো কিন্তু প্রজ্ঞা। ধূসর আসুক না আসুক, তুমি কিন্তু এসে পেপারে সাইন করে দিয়ে যেও। আমার সুপারশপের কাজটা শুরু করতে হবে তো? তাই না?
প্রজ্ঞা রাগের চোটে আর কিছু না বলেই কেবিন থেকে বেরিয়ে বাইরের দিকেই দ্রুত পায়ে ছুটলো। হামিদ সাহেব প্রজ্ঞাকে এভাবে ছুটে বের হতে দেখে নিজেও জোর পায়ে প্রজ্ঞার সাথে সাথেই চললো হাতের ম্যাগাজিনটা ফেলে রেখে। প্রজ্ঞাকে ভদ্রলোক হাজারটা প্রশ্ন করে চলেছে ঠিকই, কিন্তু প্রজ্ঞার সেসব যেন কানেই ঢুকছে না। ছুটতে ছুটতে বিশাল অফিসটা থেকে বেরিয়ে রোডের দিকেই পা বাড়িয়েছে প্রজ্ঞা। প্রজ্ঞার এতো তাড়াহুড়োর কারণ না বুঝলেও ভদ্রলোক নিজেও ছুটছেন প্রজ্ঞার সাথে। হঠাৎই আশেপাশের মানুষেরা উচ্চস্বরে কিছু একটা বলছে শুনে হামিদ সাহেবও মুখ তুলে সামনের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল জিনিসটা। আর গলা দিয়ে একটা চিৎকারই বের হলো ভদ্রলোকটির।
-ম্যাডাম, গাড়ি------।
২০!!
-তোমার সাহস হলো কি করে আবার এই বাড়িতে আসার? কি দেখতে এসেছ প্রজ্ঞা? কি দেখতে এসেছ? তোমার ছেড়ে যাওয়া বাড়িটা আগের মতো আছে কিনা সেটা দেখতে এসেছ? নাকি নতুন কেউ এসে সেই জায়গাটা দখল করেছে কিনা সেটা চেক করতে এসেছ? ডোন্ট ইউ ওয়ারি প্রজ্ঞা। তুমি নতুন করে, নতুন কারো সাথে সবটা নতুন করে শুরু করেছ যখন এবার আমিও করবো। এতো বছর তো জানা ছিল তুমিও নিজের জীবনে এতোটা এগিয়ে গেছ, এবার আমার নতুন করে জীবনে শুরু করতে তো কোনো বাধা রইলো না আর তাই না? সো তোমার নতুন জীবনে শান্তিতে থাকো, আমাকেও আমার মতো শান্তিতে থাকতে দাও।
শুভ্রার আলিশান অফিস থেকে ছুটে রাস্তায় বেরিয়ে আসার সময়েই আরেকটু হলেই কালো রঙের গাড়িটা প্রায় ধাক্কাই দিয়েছিল প্রজ্ঞাকে। হামিদ সাহেব ছুটে এসে প্রজ্ঞার হাত টেনে পিছনের দিকে টেনে নিতেই গাড়িটা শাঁ করে প্রজ্ঞার সামনে দিয়ে চলে গেল। আশপাশে একটা জটলা মতো পাকিয়ে গেছে ততক্ষণে। সবাই কিছুক্ষণ এতো কেয়ারলেসভাবে চলার জন্য প্রজ্ঞাকে লেকচার দিলেও প্রজ্ঞা সেসব নিয়ে মোটেও মাথা ঘামাচ্ছে না। ওর মাথায় তখনও চলছে ধূসরের কাছে কিভাবে নিজের নির্দোষিতার প্রমাণ দিবে। ভিড় করে ঘিরে থাকা মানুষগুলোর কথার খোঁচা গায়ে না মেখে আবার রাস্তার দিকে পা বাড়ানোর চেষ্টা করতে গিয়ে থামতে হলো প্রজ্ঞাকে। হামিদ নামের সদাহাস্য লোকটা প্রজ্ঞার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পথ আটকে দাঁড়াতেই প্রজ্ঞা হামিদ সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে বেশ অবাকই হলো। লোকটার হাসিটা ঠোঁটের কোণ থেকে হারিয়ে গিয়ে সেখানে বিন্দু বিন্দু করে জমা হয়েছে রাজ্যের ভয়, আতঙ্ক। কিন্তু লোকটা কাকে ভয় পাচ্ছে সেটাই বুঝতে পারছে না প্রজ্ঞা। হামিদ সাহেব রাস্তার ডানে বামে ভালো করে দেখে প্রজ্ঞার হাতটা ধরে টেনে জায়গাটা থেকে বেরিয়ে এসে সামনে থেকে আসা একটা সিএনজিতে উঠিয়ে দিয়ে নিজে সিএনজির বাইরে দাঁড়িয়ে থেকেই আশেপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিল। হামিদ সাহেবের এমন কাজে বিস্ময়ের চোটে কোনো রিএক্ট করতেই ভুলে গেছে বেচারি। ব্যস্ত শহরের হাজার শোড়গোলের মধ্যেও হামিদ সাহেবের কথাগুলো কানে এসে ধাক্কা খেল প্রজ্ঞার।
-ওদের লোকজন আমাদের অনেক আগে থেকেই ফলো করছে ম্যাডাম। কাল আপনাকে ওই কালো গাড়িটা থেকে নামতে দেখেই আমার কেমন সন্দেহ লেগেছিল। এখন দেখলেন তো ওই গাড়িটা অফিস কম্পাউন্ডেই আরেকটু হলেই কিভাবে আপনাকে এক্সিডেন্ট করে চলে যেত? কেউ বুঝতেও পারতো না এটা যে একটা প্রি-প্ল্যানড এক্সিডেন্ট ছিল।
হামিদ সাহেবের কথাগুলো শুনে রীতিমতো শকড হয়ে হা করেই লোকটার দিকে তাকিয়ে রইলো প্রজ্ঞা। ভদ্রলোক কি বলছে সেটাও যেন মেয়েটা বুঝতে পারছে না। ব্যস্ত রাস্তার হাজার গাড়ির শব্দও কানে না পৌঁছে কেমন একটা ঝাঁ ঝাঁ শব্দ হচ্ছে মাথার ভিতরে। শুভ্রা ওকে ধূসরের কাছে ফিরে যাওয়ার সুযোগ দিবে এটা ভাবাটাই আসলে ভুল ছিল প্রজ্ঞার। প্রজ্ঞার ভাবনার তারটা কেটে গেল হামিদ সাহেবের হাতের ঝাঁকানোয়।
-ওই লোকগুলো আপনার কোনো ক্ষতি করে দেয়ার আগে আপনি প্রত্যুষা মামনিকে নিয়ে ডাক্তার সাহেবের কাছে ফিরে যান ম্যাডাম। আমি দেখি এ দিকটা কিভাবে ম্যানেজ করা যায়। মালিক পক্ষের কেউ না থাকলে ওরা জায়গাটা দখল করতে পারলেও বেশিদিন ধরে রাখতে পারবে না।
-হামিদ সাহেব?! আপনি বাড়ি ফিরে যান। আমি জরুরি একটা কাজে যাচ্ছি। আপনার এখন প্রত্যুষা, অদিতি আর লতা ভাবির পাশে থাকা প্রয়োজন। আমি এদিকটা সামলে নিতে পারবো। চলুন ভাই। একটু দেখবেন যেন কেউ আমাদের ফলো করতে না পারে-----।
-কিন্তু ম্যাডাম? ওরা আপনার কোনো ক্ষতি করে ফেললে আমি ডাক্তার সাহেবকে কি জবাব দিব? প্রজ্ঞা ম্যাম?
হামিদ সাহেবের কথাগুলো শেষ হওয়ার আগেই প্রজ্ঞার কথায় সিএনজি অটোরিকশা চালক গাড়ি ছুটিয়েছে। হামিদ সাহেবের চিন্তিত মুখটা পিছন থেকে রাজ্যের আতঙ্ক নিয়ে সেখানে রাস্তাতেই দাঁড়িয়ে আছে। সেখান থেকে প্রজ্ঞা সোজা চলে এসেছিল ধূসরের বাড়িতে। পাঁচটা বছর পর বাড়িটায় পা দিতেই যেন একটা দমকা হাওয়া সমস্ত স্বত্তাটা কাঁপিয়ে দিয়ে গেল প্রজ্ঞার। বাড়িটাকে দেখে মনে হচ্ছে পাঁচ বছর আগে ঠিক যেভাবে বাড়িটা ছেড়ে গেছিল প্রজ্ঞা, বাড়িটা ঠিক যেন সেভাবেই রয়ে গেছে। একটুও যেন বদলায় নি বাড়ির একটুকু একটা অংশও। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে প্রজ্ঞা একটা একটা জিনিস হাতে ছুঁয়ে দেখছিল এমন সময়ই মেয়েটার বাম হাতটা কেউ পিছন থেকে টেনে ধরে কথাগুলো বলে। হাতের স্পর্শ আর কথা দুটোই যে ধূসরের সেটা বুঝতে দেরি হয়নি প্রজ্ঞার। তাই ধূসরের অপমানগুলো গায়ে না মেখেই ধূসরের দিকে ফিরে এক পা এগিয়ে আসার চেষ্টা করতেই ধূসর নিজের বাম হাতটা উঁচু করে প্রজ্ঞাকে সামনে আসতে বাঁধা দিল।
-নতুন করে তোমার আর কোনো নাটক দেখার মতো সাহস বা মনের জোর কোনোটাই অবশিষ্ট নেই আমার। তুমি নিজের জীবনে ভালো থেকো, এটাই প্রার্থনা করি। নাউ ক্যান ইউ প্লিজ গেট আউট? আমার জীবন থেকে, এই বাড়িটা থেকে এতোটা দূরে যাও যেন তোমার আর তোমার মেয়ের মুখটা আমাকে কখনো দেখতে না হয়। এই দয়া টুকু করতে পারবে প্লিজ প্রজ্ঞা? প্লিজ?
-ধূসর? প্লিজ আমার কথাটা বিশ্বাস করো? আমি তোমাকে এক সেকেন্ডের জন্যও ধোঁকা দিই নি। তোমাকে ফেলে আমি সত্যিই যাই নি ওইদিন। বিশ্বাস করো সেদিন এক্সিডেন্টটা আসলে এক্সিডেন্টও ছিল না। শুভ্রা প্ল্যান করে তোমাকে------। ডাক্তাররা আমাকে মিথ্যে বলেছে যে তোমার অপারেশনের জন্য বিশ পঁচিশ লাখ টাকা লাগবে। ওই পুরো ঘটনাটা শুভ্রার সাজানো নাটক ছিল ধূসর। আমি বুঝতে পারি নি কিভাবে ওদের পাতা ফাঁদে পড়ে আমি বোকার মতো------।
-বোকার মতো কি প্রজ্ঞা? বোকার মতো ডিভোর্স লেটারে সাইন করে দিয়ে পালিয়ে গেছিলে? কি ভেবেছিলে? ডিভোর্স দিয়ে দিলে আইনতভাবেই আমার ভাগের সম্পত্তির ৫০% তো পেয়েই যাবে। এমনিতে তো আমি মরে গেলেও একটা কানা কড়িও আমার বাবার থেকে পেতে না, এটাই ভেবেছিলে তো তুমি?
-ধূসর? কি বলছ এসব? তুমিও শুভ্রার কথাটাই বিশ্বাস করেছ শেষ পর্যন্ত? জানো ওইদিন মাও ওর কথা বিশ্বাস করে আমাকে হসপিটাল থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল। তুমি মাকে একবার জিজ্ঞেস করো, আমি সত্যি বলছি কি না-----।
-আমার কাউকেই জিজ্ঞেস করার কিছু নেই। ইউ জাস্ট গেট আউট----। যার নামে ফেইক এতোগুলো এলিগেশন দিলে সেই শুভ্রাই সেদিন মায়ের একটা কলে আমার অপারেশনের জন্য পঁচিশ লাখ টাকা নিয়ে অতো রাতে হসপিটালে এসে হাজির হয়েছিল। আর ওর জন্যই আজ আমার সামনে দাঁড়িয়ে তুমি কথাগুলো বলতে পারছ প্রজ্ঞা। গলা উঁচিয়ে তার দিকেই আঙুল তুলতে পারছ, যার জন্য আজ পাঁচটা বছর আমি সুস্থ হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারছি।
-সব সব সব মিথ্যে। সব ওই শুভ্রার সাজানো নাটক। তুমিও ওর সাজানো নাটকগুলো সত্যি মনে করে বিশ্বাস করে নিয়েছ ধূসর? আমি কি করে তোমাকে বুঝাই? আহহহহহ। বিশ্বাস করো ওই শুভ্রাই সব করেছে। তোমার এক্সিডেন্ট করিয়েছে, তোমার কাছ থেকে আমাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে, আজও তোমার কাছে ভালো হওয়ার নাটক করে চলেছে------।
-এনাফ ইজ এনাফ প্রজ্ঞা। যথেষ্ট বলে ফেলেছ তুমি। তোমার মুখ থেকে শুভ্রার নামে আর একটা বাজে কথাও আমি শুনতে চাই না। ওর নামে যদি আর একটাও বাজে কথা বলো তুমি তাহলে আমার চেয়ে খারাপ আর কেউ হবে না বলে দিলাম।
ধূসরের এমন অদ্ভুত ব্যবহার আর শুভ্রার জন্য এমন অন্ধ ভরসা দেখে প্রজ্ঞা ব্যাপারটা হজম করতে পারলো না। এক পা এগিয়ে এসে ধূসরের হাতটা ধরার চেষ্টা করতেই ধূসর ঝাড়া দিয়ে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিল।
-কেন এমন করছ ধূসর? আমার মুখেও যে মেয়েটার নাম তুমি সহ্য করতে পারতে না, সেই তুমিই কিনা ওই মেয়েটার হয়েই আজ সাফাই গাইছ? কেন ধূসর? কেন?
-কজ শুভ্রা তোমার মতো ধোঁকাবাজ নয় প্রজ্ঞা। ও আমাকে ভালোবেসেছে, শুধু আমাকেই ভালোবেসেছে। আমার হাজার অপমান, অসম্মান করা স্বত্ত্বেও শুধু আমাকেই পেতে চেয়েছে। এর বেশি তো কিছুই ওই মেয়েটা কখনো চায় নি। কিছু পাবে না জেনেও এই পাঁচটা বছর আমার পাশে ছায়ার মতো হয়ে ছিল। আমার বিপদে, কষ্টে, হতাশায় আমার ঢাল হয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল, যতবার ভেঙ্গে পড়েছি ততবার বন্ধু হয়ে শান্তনার জন্য কাঁধ বাড়িয়ে দিয়েছে আমার কষ্টের ভাগিদার হতে। সেই মেয়েটাকেই অবিশ্বাস করি কি করে বলো তো? আর কার কথায় অবিশ্বাস করবো বলো তো? তোমার? যে আমাকে বিপদের দিনে একা ফেলে জাস্ট পালিয়ে গেছে। তার কথায়?
-আমি তোমাকে ফেলে পালিয়ে যাই নি ধূসর। সেদিন হসপিটাল থেকে বের হওয়ার পরই একটা এক্সিডেন্ট ঘটে। যে বয়স্ক ডাক্তারের গাড়ির সামনে আমি সেন্সলেস হয়ে যাই, উনিই আমাকে নিজের সাথে নিয়ে যায়। বিশ্বাস করো প্লিজ? আমি তোমার কাছে কিভাবে পৌঁছাবো সেটাই ভাবছিলাম তখনও। কতোগুলো ঘন্টা পর যখন সেন্স আসে তখন অন্য কোনো শহরে আমি। সেখানেই জানতে পারি তোমার ভালোবাসার অংশের অস্তিত্বের কথা।
-এনাফ ইজ এনাফ প্রজ্ঞা। অনেক গল্প শুনিয়েছ এতোক্ষণ ধরে। আর নয়। এতো নাটক না করে সোজাসুজি বলে দাও কি জন্য এসেছ আবার? কি চাইতে এসেছ? টাকা? কত টাকা লাগবে বলো? নো নো ওয়েট--আমি একটা ব্ল্যাঙ্ক চেক এ সাইন করে দিচ্ছি। তুমি তোমার পছন্দ মতো এমাউন্ট ফিলআপ করে নিও। ডোন্ট ওয়ারি। ব্যাংক থেকে কোনো ঝামেলা ছাড়াই টাকাটা উইথড্র করে নিতে পারবে তুমি। যে কাজটা গতবার করতে পারো নি, এবার সেটা হবে না। এই নাও চেকটা ধরো? এন্ড লিভ প্লিজ?
-ধূসর?
-প্লিজ টেইক ইট, এন্ড লিভ প্রজ্ঞা।
ধূসর রীতিমতো জোর করে প্রজ্ঞার হাতে নিজের সাইন করা ব্ল্যাঙ্ক চেকটা ধরিয়ে দিলেও প্রজ্ঞা শুধু ফ্যালফ্যাল করে ধূসরের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। রাগ করে ধূসরের দেয়া চেকটা শত শত খন্ড করে টুকরো টুকরো করে ফেলে দিতে পারছে না ধূসরের চোখের দিকে তাকিয়ে। কেন জানি প্রজ্ঞার বারবার মনে হচ্ছে ধূসর ইচ্ছে করেই কথাগুলো বলছে যাতে প্রজ্ঞা কষ্ট পায়। ধূসরের চোখ আর মুখের ভঙ্গির সাথে ওর বলা একটা কথারও কোথাও যেন মিলই খুঁজে পাচ্ছে না মেয়েটা। প্রজ্ঞার কথাগুলো ভাবার ফাঁকেই প্রজ্ঞার মোবাইলটা শব্দ করে বেজে উঠতেই প্রজ্ঞা চমকে উঠে কলটা রিসিভ করতেই ধূসর প্রায় ছোঁ মেরে মোবাইলটা নিয়ে ফ্লোরে আছাড় মেরে টুকরো টুকরো করে ফেললো। ঘটনাটা এতো তাড়াতাড়ি ঘটেছে যে প্রজ্ঞা এক কথায় স্তব্ধ হয়ে ধূসরের দিকে তাকিয়ে রইলো কয়েক মূহুর্ত। ধূসর এবারে প্রজ্ঞার একটা হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে এসে প্রজ্ঞাকে বাড়ির বাইরে বের করে দিল। সরাসরি প্রজ্ঞার চোখে চোখ রেখে কয়েকটা কথা বলেই প্রজ্ঞার মুখের উপরেই দরজাটা শব্দ করে বন্ধ করে দিল ধূসর। আর কথাগুলো মাথার মধ্যে টেপরেকর্ডারের মতো বাজতে বাজতেই প্রজ্ঞা কেমন একটা ঘোরের মধ্যেই রাস্তার দিকে পা বাড়িয়েছে। মেয়েটার কানে তখনও বেজে চলেছে ধূসরের কথাগুলো। আর তখনও প্রজ্ঞার হাতে শক্ত করে আঁকড়ে ধরা আছে ধূসরের জোর করে ধরিয়ে দেয়া ব্লাঙ্ক চেক টা।
-নিজের মেয়েকে নিয়ে এতোটা দূরে চলে যাও যেখানে কেউ তোমাদের খুঁজে পাবে না প্রজ্ঞা। এতোটা দূরে চলে যাও যেখানে তোমার স্বপ্নের স্বপ্ন ঘেরা কুটির থাকবে আর তোমার মেয়ে থাকবে, আর কেউ না। আমার লাইফে, আমার বাড়িতে ফিরে আসার ভুলটা ভুলেও আর করবে না কখনো। বাকিরা ছেড়ে দিলেও আমি কিন্তু তোমাকে মরে গেলেও ক্ষমা করবো না কোনোদিন। কোনোদিন না।
২১!!
-ম্যাম প্লিজ এভাবে কাঁদবেন না। কি হয়েছে আমাকে বলবেন প্লিজ? আপনি হঠাৎ কোথায় চলে গিয়েছিলেন? আর এখন হুট করে ফিরে এসে ব্যাগ প্যাক করছেনই বা কেন? ম্যাম? কিছু তো বলুন?
প্রজ্ঞা কি করে ধূসরের বাড়িটা থেকে ফিরে এসেছে নিজেও জানে না। পুরোটা রাস্তা গাড়িতে তো কেঁদেছেই মেয়েটা, এখনও যেন কান্না বন্ধ হতে চাইছে না ওর। বারবার মনে হচ্ছে শুভ্রার ছলনার কাছে ওদের ভালোবাসা এভাবে হেরে গেল! এতোগুলো বছর যে মানুষটা ওর ফিরে আসার জন্য অধীর হয়ে অপেক্ষা করছিল, সেই মানুষটাই কিনা ওকে এক প্রকার ঘাড় ধাক্কা দিয়েই বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। সেই বাড়িটা থেকে, যেখানে ওরা নতুন করে সংসার শুরু করেছিল, যেই বাড়িটার এক টুকরো ছাদের নিচে সমাজের সবার সমস্ত অপমান, অসম্মানগুলোকে ভুলে ধূসরের বুকে নিজেকে লুকিয়ে রাখতো, সেই বাড়িটার দরজা নিমিষেই চোখের সামনে বন্ধ করে দিল প্রজ্ঞারই সবচেয়ে প্রিয় মানুষটা। এই কথাগুলো হামিদ সাহেবকে বললে কি লোকটা বুঝবে? প্রজ্ঞা কি করে বলবে এই চিন্তিত মানুষটাকে যে ধূসর যে কিনা হাজার জনের হাজার বাজে কথা, নাক সিঁটকানোতেও ওকে কখনো ছোটো করে দেখে নি কখনো, সেই ধূসর! সেই ধূসর হামিদ সাহেবকে নিয়ে প্রজ্ঞাকে এভাবে সন্দেহ করতে পারলো? তাও আবার নিজের মেয়েকে পর্যন্ত ------। কথাগুলো ভাবতেই কান্নাগুলো কেমন দলা পাকিয়ে যেতে শুরু করেছে প্রজ্ঞার বুকের ভিতরেই। কোনোমতে ধূসরের দেয়া ব্ল্যাঙ্ক চেকটা হামিদ সাহেবের দিকে এগিয়ে দিতেই হামিদ সাহেবও হাত বাড়িয়ে সেটা নিয়ে এক নজর ভালো করে দেখে ভ্রু কুঁচকে আবার প্রজ্ঞার দিকে তাকালো। ভদ্রলোক যে কিছুই বুঝতে পারছেন সেটা তার বিব্রত মুখভঙ্গিটা দেখেই বুঝতে পারছে প্রজ্ঞা।
-ম্যাম? এই চেকটা কে দিয়েছে? ওই শুভ্রা? আপনি ওই মেয়ের সাথে আবার দেখা করতে গেছেন? আমি তো আপনাকে বলেছিলাম ম্যাডাম ওই লোকগুলো একদমই সুবিধের না। এবার কি করবে আপনি ভাবতেও পারছেন না ম্যাডাম।
-এটা শুভ্রার দেয়া চেক নেয় হামিদ সাহেব। এটা আমার হাজবেন্ডের দেয়া চেক, ব্ল্যাঙ্ক চেক। যেন ওর আর শুভ্রার জীবন থেকে আগের মতোই দূরে কোথাও হারিয়ে যাই। এই শহরটায় আসাটাই বোধ হয় আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল হামিদ সাহেব। তাই আবার পালিয়ে যাচ্ছি এই অসম্মানের শহরটা থেকে। যে অপমানগুলো এতোদিন নিজে সহ্য করেছি, সেটা আমি আমার মেয়েকে ভোগ করতে দিব না, কখনোই না।
-আপনার হাজবেন্ড? ম্যাম কি বলছেন আপনি কিছুই বুঝতে পারছি না আমি। এখানে চেক এ কারো সাইনই ও তো নেই। এটা কেমন নাম? স্বপ্নকুটির! আর ব্ল্যাঙ্ক চেক কোথায়? এমাউন্ট তো লেখা আছে। ওয়েট এ মিনিট। এমাউন্ট না, কয়েকটা নাম্বার। কিসের নাম্বার এগুলো?
-কি নাম লেখা বললেন? স্বপ্নকুটির! ধূসর---! ধূসর তাহলে---ধূসর তাহলে আমাকে আমাদের বাড়িটার কথাই বলেছিল বারবার। আর আমি এতো বোকা! ওকেই ভুল বুঝে চলে যাচ্ছিলাম! আবার চলে যাচ্ছিলাম আমার ধূসরকে ফেলে! কত বোকা আমি!
হামিদ সাহেবের হাত থেকে চেকটা ক্ষীপ্রহাতে ছিনিয়ে নিয়ে চেকের প্রত্যেকটা নাম্বার ছুঁয়ে দেখতে দেখতে আবার কান্নার রেখাগুলো নতুন করে ফুটে উঠলো। সাইনের জায়গায় ধূসরের নামের জায়গায় 'স্বপ্নকুটির' লেখাটা দেখেই যা বোঝার তা বুঝে গেছে প্রজ্ঞা। প্রত্যুষা এতোক্ষণ অদিতির সাথে পাশের রুমে খেলছিল। মায়ের কান্নার শব্দে রুমে এসে এতোক্ষণ থতমত খেয়ে রুমের একটা কোণায় চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল মেয়েটা। এবারে প্রজ্ঞা রীতিমতো কাঁদতে কাঁদতে কাগজটা হাতে নিয়ে ফ্লোরে বসে পড়তেই প্রত্যুষা ছুটে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে নিজেও কেঁদে ফেললো। ছোট্ট দুটো হাত দিয়ে প্রজ্ঞার চোখের পানিগুলোকে মুছে দেয়ার চেষ্টা করতে করতেই নিজেই কেঁদে গাল ভিজিয়ে ফেলেছে মেয়েটা।
-মাম্মা? ও মাম্মা? তুমি কাঁদছ কেন এভাবে? আমি দুষ্টুমি করেছি বলে রাগ করেছি? এই দেখো কান ধরছি? প্রমিস আর দুষ্টুমি করবো না। পাপার কাছে যাওয়ার বায়নাও করবো না। প্রমিস তো? ও মাম্মা? লক্ষী মাম্মা, আর কেঁদো না।
-না মামনি। আর কাঁদবো না মাম্মা। তুইও কাঁদিস না সোনা মা আমার। আমরা তোর পাপার কাছে যাবো সোনা। আজই যাবো। কিন্তু ওই বাড়িটা---আমি জানিও না কিভাবে যাবো স্বপ্নকুটিরে, আমাদের স্বপ্নকুটিরে।
প্রজ্ঞা নিজের ছোট্টো মেয়েটাকে বুকে জাপটে আরেকবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়ার আগেই বাইরে থেকে গাড়ির হর্নের শব্দে হামিদ সাহেব, লতা আর প্রজ্ঞা তিনজনেই চমকে উঠলো। পর পর দুবার হর্ন দেয়ায় হামিদ সাহেব জানলার পর্দা সরিয়ে দেখার চেষ্টা করলো এই অসময়ে ওদের বাড়িতে কে এসেছে! শুভ্রার গুন্ডাবাহিনী কিনা কথাটা ভাবার ফাঁকেই বাসার দরজায় কলিংবেল বেজে উঠলো। হামিদ সাহেব খানিকটা ইতস্তত করে লুকিং গ্লাসটা একবার চেক করে হালকা করে দরজা খুলতেই একজন বয়স্ক মানুষকে দেখতে পেল। লোকটা একটা কাগজ হামিদ সাহেবের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে দরজার বাইরেই দাঁড়িয়ে রইলো। হামিদ সাহেব হাতে ধরা কাগজটার দিকে তাকাতেই কয়েকটা নাম্বার দেখতে পেল। নাম্বারটা দেখেই চিনতে পারলো হামিদ সাহেব। প্রজ্ঞার ব্ল্যাঙ্ক চেকে এই নাম্বারগুলোই লেখা ছিল। তাহলে কি এই লোকটাকে ম্যাডামের হাজবেন্ড পাঠিয়েছে? কথাটা ভাবতেই আরেকবার লোকটার দিকে সর্তক দৃষ্টি ফেললো হামিদ সাহেব।
-আপনাকে কে পাঠিয়েছে? এই বাড়িতেই বা এলেন কিভাবে? কাকে চাই?
-আমার কিছু বলার পারমিশন নেই। প্রজ্ঞা আর প্রত্যুষা ম্যাডামকে বলুন ড্রাইভার এসেছে। স্যার ম্যাডামদের জন্য অপেক্ষা করছে।
-ম্যাডাম---। আপনাদের জন্য গাড়ি এসেছে-----।
পুরোটা রাস্তা প্রত্যুষা মাকে দুনিয়ার প্রশ্ন করতে করতে প্রায় পাগল করে দিচ্ছে। ওরা কোথায় যাচ্ছে, প্রজ্ঞা কাঁদছে কেন, অদিতিরা সাথে আসে নি কেন, প্রজ্ঞা কাঁদছে কেন, ইত্যাদি ইত্যাদি। মেয়ের এতো হাজার প্রশ্নের জবাবে মেয়েকে বুকে আরো খানিকটা শক্ত করে জড়িয়ে নিয়ে দুরুদুরু বুকে একটা অজানা আতঙ্কে অপেক্ষা করছে স্বপ্নকুটিরে পৌঁছানোর। স্বপ্নকুটিরের গেইটের সামনে সাদা রঙের গাড়িটা যখন এসে থেমেছে ততক্ষণে চারদিকে অন্ধকার নেমেছে। গেইটে থাকা দারোয়ান গেইট খুলে দিতেই প্রজ্ঞা আর প্রত্যুষাকে নিয়ে গাড়িটা স্বপ্নকুটিরের গাড়ি বারান্দায় এসে থামলো। ড্রাইভার নেমে এসে গাড়ির দরজা খুলে ধরতেই প্রজ্ঞা প্রত্যুষার হাত ধরে নেমে এলো গাড়ি থেকে। বছর পাঁচেক আগের মতোই আজকেও বাড়িটার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো প্রজ্ঞা। স্বপ্নকুটির! হঠাৎ একদিন এই বাড়িটাতেই স্বপ্নের চেয়েও সুন্দর কতগুলো মূহুর্ত কাটিয়েছিল ওরা। আর আজও ভাগ্য ওকে সেই বাড়িটার চৌকাঠে এনে দাঁড় করিয়েছে প্রজ্ঞাকে। আজ কি লেখা আছে কপালে কে জানে! কথাগুলো ভাবার ফাঁকেই হাতে প্রত্যুষার ছোট্টো গুটিগুটি হাতের টান পড়ায় এক পা দু পা করে স্বপ্নকুটিরের দিকেই পা বাড়ালো প্রজ্ঞা। স্বপ্নকুটিরের মেইন ডোর পার করতেই ধূসরকে ব্যস্ত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে দেখে প্রজ্ঞা দরজার সামনেই থমকে দাঁড়িয়ে গেল। প্রত্যুষা ততক্ষণে ধূসরকে দেখতে পেয়ে মায়ের হাত ছেড়ে দিয়ে ছুটে এসে ধূসরকে এসে জড়িয়ে ধরেছে। ধূসরও প্রথমবারের মতো নিজের মেয়ে সামনে থেকে দেখে আদরে আদরে ছোট্ট প্রত্যুষার মুখটা ভরিয়ে দিয়ে বুকে শক্ত করে জাপটে ধরলো। প্রত্যুষাও নিজের ছোট্ট হাতের বাঁধনে যতটা সম্ভব ধূসরের জামাটা শক্ত করে জাপটে ধরলো।
-মাম্মা, মাম্মা, দেখো পাপা। পাপা, ইয়েএএএএ পাপার কাছে এসেছি আমরা। মাম্মা?
প্রত্যুষার কথায় এতোক্ষণে যেন হুঁশ ফিরলো ধূসরের। ছোট্ট প্রত্যুষাকে এতোক্ষণ বুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছিল খেয়াল হতেই ধূসর আস্তে করে ছেড়ে প্রত্যুষাকে কোলে তুলে নিয়ে প্রজ্ঞার দিকে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করলো। প্রজ্ঞা স্তব্ধ হয়ে দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে আছে দেখে ধূসরও প্রজ্ঞার দিকেই এক পা দু পা করে এগিয়ে এলো। আর এদিকে প্রত্যুষা ধূসরের কোলে থেকেই ধূসরের কান্নাভেজা চোখ জোড়া দু হাতে মুখে দিয়ে নিজেই দুনিয়ার বকবক করে চলেছে। আর প্রত্যুষার বকবক শুনতে শুনতেই প্রজ্ঞা আর ধূসর একে অন্যের দিকে এগিয়ে এলো।
-মাম্মা পাপা কাঁদছে কেন? সেই কখন থেকে মাম্মাও কাঁদছে। ও মাম্মা? তোমরা কাঁদছো কেন? ও পাপা?
প্রত্যুষার কাঁদোকাঁদো গলায় প্রশ্নটা শুনে ধূসর এবারে হেসে ফেললো। প্রত্যুষার গালে অনেকগুলো আদরের পরশ বুলিয়ে দিয়ে হাত বাড়িয়ে প্রজ্ঞাকে হালকা করে নিজের সাথেই জড়িয়ে নিল ধূসর।
-এবার থেকে কেউ কাঁদবে না মামনি। আমার প্রত্যুষা বুড়িটা চলে এসেছে না? আর কেউ কাঁদবে না। তুমিও কাঁদবে না মামনি। আর তোমার মাম্মা পাপা কেউ কাঁদবে না। একদম কাঁদবে না।
প্রায় মাঝরাত পর্যন্ত প্রত্যুষা পুরো স্বপ্নকুটিরে ধূসরের সাথে ছুটোছুটি করে কাটিয়েছে। ধূসরও যেন মেয়েকে পেয়ে নিজেও ছেলেমানুষ হয়ে গেছে। প্রত্যুষা ছুটোছুটি করে ক্লান্ত হয়ে যখন ধূসরের কোলেই ঘুমিয়ে গেছে তখন ধূসর মেয়েকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে এসে বারান্দায় প্রজ্ঞার পাশে এসে বসেছে। এই পুরোটা সময় তিনজন মিলে এতো পাগলামি করেছে ঠিকই, কিন্তু আলাদা করে একটা কথাও হয়নি দুজনের। তাই এবারে প্রজ্ঞাকে বারান্দায় চুপচাপ বসে থাকতে দেখে ধূসরও হুট করে প্রজ্ঞাকে টেনে নিয়ে নিজের কোলে বসিয়ে দিয়েই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিল।
-এখনও রাগ করেই থাকবে প্রজ্ঞা? কথা বলবে না তোমার ধূসরের সাথে? জানো এতোগুলো বছর তোমার প্রতীক্ষায় যতগুলো নির্ঘুম রাত কাটিয়েছি, প্রতিদিন নতুন নতুন প্ল্যান করতাম, তোমাকে ফিরে পেলে কি বলবো, কতগুলো বকা দিবো, তোমার আদুরে শরীরটায় আঁচড়ে, কামড়ে এতোগুলো বছর আমাকে কষ্ট দেয়ার প্রতিটা শোধ তুলবো। অথচ আজ দেখো? তুমি আমার সামনে, আমার বুকে গুটিশুটি হয়ে মুখ লুকিয়ে নিয়েছ, এতোগুলো ঘন্টা আমরা দুজনের এতোটা কাছে আছি, নিজেদের স্বপ্নের দুনিয়ায়, অথচ বলার মতো কিছুু খুঁজেই পাচ্ছি না আমি। আর না তুমি নিজেও কিছু বলছ। এরকম কেন বলো তো ম্যাডাম?
-হয়তো আকর্ষণটা কমে গেছে আগের চেয়ে। হয়তো পাঁচটা বছরে আগের চেয়ে আরো বেশি কুৎসিত দেখতে হয়ে গেছি। অথবা ভাবছ এতোগুলো দিন কার না কার সাথে-------।
-শশশশশশশ। চুপ-----। আমার বউকে নিয়ে একটাও বাজে কথা বললে না মেয়ে, সোজা খুন করে তোমার স্বপ্নকুটিরের আঙিনাতেই মাটি চাপা দিয়ে রেখে দিব বলে দিলাম। তার সাহস কতো বড় আমার বউকে নিয়ে বাজে কথা বলে! এই শোনো মেয়ে? আমার বউটা পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরতম মানুষ বুঝলে? রাগের মাথায় কিসব বলেছি নিজেও জানি না। কিন্তু তুমি কি জানো না তোমায় কতোটা ভালোবাসি? জানো না শুধু পাঁচটা বছর কেন প্রয়োজনে মৃত্যু পর্যন্ত তোমার প্রতীক্ষায় থাকতাম আমি। মৃত্যুর পরের জীবনে কি হবে আমি জানি না, তবু মনে প্রাণে প্রার্থনা করি যেন সেই জীবনেও শুধু তোমার অস্তিত্বটাই থাকুক আমার জীবনে। আর আমাদের ছোট্ট পরীটার।
-কোথা থেকে কি হয়ে গেল তাই না ধূসর? জীবনটা হুট করে কিভাবে যেন বদলে গেল। বিশ্বাস করো তোমার থেকে, আমাদের সংসার থেকে দূরে যাওয়ার কথা কল্পনাতেও ভাবতে পারি নি কখনো। অথচ জীবনের যে সময়টায় সবচেয়ে বেশি তোমাকে পাশে প্রয়োজন ছিল, সেই সময়টাতেই তোমাকে পাশে পাই নি।
-এই বাড়িটাতে বসেই একদিন কত প্ল্যানিং করেছিলাম আমরা মনে আছে প্রজ্ঞা? আমাদের ছোট্টো পরীটার আসার, ওর ধীরে ধীরে বড় হওয়ার মূহুর্তগুলো প্রাণ ভরে অনুভব করার প্ল্যান করেছিলাম। অথচ এটা জানতেও পারলাম না যে উপরওয়ালা অন্য কিছুই লিখে রেখেছেন আমাদের ভাগ্যে। নসীবের উপরে তো কোনো প্ল্যানিং চলে না প্রজ্ঞা। ভাগ্যে যা ছিল, তাই ঘটেছে। সেটা নিয়ে আফসোস করে তো সামনে যে জীবনটা অপেক্ষা করছে তাকে দূরে ঠেলে দিতে পারি না বলো? নতুন করে আবার সবটা শুরু করতে হবে তো নাকি?
-কিন্তু আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। তুমি তখন বাড়িতে ওভাবে আমার সাথে-----। আমার কি কষ্ট হয়েছিল জানো তুমি? মনে হচ্ছিল সত্যিই তুমি আমাকে অবিশ্বাস করেছ। মনে হচ্ছিল তখনই মরে যেতাম আমি------।
প্রজ্ঞার কান্নাভেজা মুখটা দু হাতে তুলে ধরে আলতো করে ঠোঁটে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে সরে এলো ধূসর। প্রজ্ঞার মুখের কান্নার বৃষ্টিটা মুছে দিয়ে প্রজ্ঞাকে বুকে জড়িয়ে নিল ধূসর।
-এই পাঁচ বছরে কত ঝড় বয়ে গেছে তোমার ফেলে যাওয়া সংসারটায় তুমি কল্পনাও করতে পারবে না প্রজ্ঞা। তোমার অবর্তমানে তোমার শ্বশুরও বুঝতে পেরেছিল আসলে তুমি আমার জীবনে ঠিক কতোটা জায়গা জুড়ে ছিলে। মায়ের কাছে আমার হসপিটালের দিনগুলোর কথা শুনে বাবা মাকে অনেক বার বুঝিয়েছেও। মা তখনও যদিও নিজের ভাতিজির স্নেহেই অন্ধ ছিল। কিন্তু এক সময় মা ও সেই অন্ধ ভালোবাসাটা থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছে, কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেছে ততদিনে।
-মানে? দেরি হয়ে গেছে মানে কি? বাবা মা কোথায় ধূসর?
-আরে ভয় পাওয়ার মতো কিছু হয়নি। শুধু তোমার শ্বশুর শাশুড়ির একটু শিক্ষা হয়েছে আর কি। তাদের আদরের কালনাগিনী তাদেরকেই ছোবল দেয়ার চেষ্টা করেছিল। ওই যে বললাম, বাবা তোমার কমতিটা বুঝতে পেরেছিল। তাই সমস্ত চেষ্টা করেছে তোমাকে খুঁজে বের করার। আর তখনই শুভ্রার আসল রূপটাও বাবার চোখের সামনে আসে। ওই মেয়েটা আর ওর বাবা কত বড় ফ্রড সেটাও জানতে পারে বাবা নিজের লোক লাগিয়ে। কিন্তু ওই যে প্রমাণের অভাবে ওকে কিছু করাও যাচ্ছে না। বাবা নিজেই তাই প্ল্যান করে ওকে হাতে নাতে ধরার চেষ্টা করে। বাট ওই মেয়ে এতোটা শয়তান যে বাবার প্ল্যানটা জেনে ফেলার পর বাবাকেই গুম করে দেয়।
-হোয়াট!
-শকড? আরো কাহিনী বাকি বুঝলে? শুভ্রার ভাড়াটে গুন্ডাগুলো চব্বিশ ঘন্টা আমাদের সবাইর উপরে নজরদারি করছিল। ইভেন ওই মেয়ে নিজের স্পাই লাগিয়ে অফিসে, বাসায়, ইভেন আমাদের বাড়িতেও সিসি ক্যামেরা লাগিয়েছে অলটাইম মনিটর করার জন্য। কেউ যেন আমাকে তোমার ব্যাপারে কোনো রকম ইনফর্মেশন না দিতে পারে সেজন্য আর কী কী যে করেছে এই মেয়েটা কে জানে!
-এতোকিছু তুমি জানলে কি করে? আর বাবা মা কোথায় সেটাই বা বলছ না কেন? উনারা ঠিক আছেন তো?
-আমি কিছুই জানতাম না। অফিসের পুরোনো স্টাফরা বোধহয় বাবার কাছ থেকে ব্যাপারটা জেনেছিল। অনেক কষ্টে ওরা প্ল্যান করে আমাকে জামায় ব্যাপারটা। শুধু আদিবই জানতো আমাদের স্বপ্নকুটিরের কথাটা। তুমি যাওয়ার পর একবারের জন্য এই বাড়িতে আসাই হয়নি। আর আদিব শুভ্রার ব্যাপারে যা যা জানতো, অফিসে, বাসায় যা হচ্ছে সব একটা চিঠিতে লিখে স্বপ্বকুটিরে রেখে গিয়েছিল।সেদিনই জানতে পারি আমার প্রজ্ঞা পাগলিটা সেদিন আমাকে ছেড়ে কোথাও যায় নি। তাকে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল।
-জেনেই এতোগুলো কথা শুনিয়েছিলে তাই না? শুভ্রা আমার মতো ধোঁকাবাজ নয়, তোমার বিপদে, আপদে ঢাল হয়ে তোমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আরো কি যেন বলছিলে? আমি টাকার জন্য তোমার কাছে এসেছি-------।
-আরে বোকা মেয়ে? বললাম তো ওই বাড়িতেও শুভ্রা সব মনিটরিং করছিল। ও যদি দেখে আমি তোমাকে বুকে জড়িয়ে আদর করছি তাহলে বাবা মায়ের কি হাল করতো একবার ভাবো তো?
-বাবা মায়ের কি হাল করতো মানে? তুমি বসে বসে আমাকে গল্প না শুনিয়ে বাবা মাকে কিভাবে উদ্ধার করতে হয় সেটা ভাবো আগে।
-রিল্যাক্স ম্যাডাম। সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে। সকাল বেলা আমাদের শুভ্রা ম্যাডামের চোখ খুলবে সোজা গারদের ভিতরে। আর বাবা মা ও এখন সেইফ আছে। বাবাকে আর মাকে একটা গোডাউনে আটকে রেখেছিল শুভ্রার সেই গুন্ডাবাহিনী। লোকটাকে তোমার মনে আছে? সেদিন রাগ করে তোমাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দেয়ার পর যার গাড়িতে করে তুমি মিস্টার হামিদ সাহেবের সাথে দেখার করতে গেলে? সেই লোকটাই শুভ্রার ব্রেকিং পয়েন্ট। ওই লোকটাকে দিয়েই দুনিয়ার সব অকাজ করায় মেয়েটা। আমার এক্সিডেন্টটাও ওই বদমাইশ লোকটাই করেছিল। তোমারও এক্সিডেন্ট করিয়ে দিত হয়তো সেদিন আমাকে দেখে ভয় পেয়ে না পালালে---।
-ওই লোকটা আজ সকালেও শুভ্রার অফিসের সামনেই আমাকে মারার চেষ্টা করেছিল। হামিদ সাহেব না থাকলে এতোক্ষণে কি হতো কে জানে।
-এই হামিদ সাহেবকে দেখছি একটা ধন্যবাদ দিতে হবে। মনে মনে কত গালিই না দিয়েছি লোকটাকে তোমার আশেপাশে ঘুরঘুর করতে দেখে। আর সেই ভদ্রলোকই কিনা আমার এই ছটফটে বউটাকে বাঁচিয়েছে। ধন্যবাদ তো পাওনা ভদ্রলোকের----।
-একটা খারাপ লোক। কতোগুলো বকেছ আমাকে উনার সাথে দেখে। একবার ভাবলেও না কেন আমি তোমার কাছে আসতে পারছি না। একে তো নিজে খুঁজেও পাও নি। আমি কত আশায় ছিলাম হঠাৎ তুমি এসে আমাকে বলবে আমি তোমাকে খুজে পেয়েছি প্রজ্ঞা। ভেবেছিলাম পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তেই আমি থাকি না কেন তুমি ঠিকই খুঁজে বের করে ফেলবে আমাকে আর প্রত্যুষাকে। কিন্তু তুমি উল্টো আমি আসার পরও ভুলই বুঝলে----। এই তোমার ভালোবাসা! ছি ধূসর! ছি ছি!
-এই যে ড্রামা কুইন? নিজে লুকিয়ে ছিলে। নইলে তুমি চাইলেই এই পাঁচটা বছর এভাবে নষ্ট হতো না। চাইলেই তুমি সুস্থ হয়ে পৃথিবীর যে কোনো প্রান্ত থেকেই আমার কাছে ফিরে আসতে পারতে, কিন্তু তুমি তো সেটা চাও ই নি। তখন আমাকে ব্লেইম করা হচ্ছে না? এর যোগ্য শাস্তিও পাবে তুমি ম্যাডাম। শুধু সময়টা আসতে দাও। ওকে?
এক সপ্তাহ পর।
ধূসরদের বাড়িটা আজ নতুন সাজে সেজেছে। শত শত ঝিলিক বাতির আভায় বাড়িটা মনে হচ্ছে চাঁদের জ্যোৎস্নাকেও আজ হার মানিয়ে দিবে। সেই উজ্জ্বলতাকে হার মানাচ্ছে আজ তিনটে মানুষ। তাদেরকে ঘিরে আজ হাজারো মানুষের ভিড়। সবার মুখে আজও প্রজ্ঞার নামের গুঞ্জন উঠেছে। তবে পাঁচ বছর আগের মতো অবজ্ঞার সুরে নয়। আজ ভিড়ের সেই পুরোনো মুখগুলো প্রজ্ঞার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এতোক্ষণে প্রজ্ঞার শাশুড়ির মুখে তারাও জেনে গেছে কিভাবে সেদিন মেয়েটা নিজের সর্বস্ব দিয়ে দিয়েছিল ধূসরের চিকিৎসার করার নামের সাজানো নাটকটায়। কিভাবে হাজার অপমানের পরেও বারবার আকুতি করেছিল এক নজর ধূসরকে চোখ মেলে দেখার। আজ কেমন করে যেন সবার চোখেই প্রজ্ঞা হয়ে উঠেছে পৃথিবীর সুন্দরতম মানুষের একজন, আর পাঁচ বছর আগের তাদের মুখেই আগুনসুন্দরী সার্টিফিকেট পাওয়া শুভ্রা হয়েছে নর্দমার কিট।
যাই হোক, প্রজ্ঞা আর প্রত্যুষার ফিরে আসার ঘরোয়া অনুষ্ঠানটা শেষ হতে বেশ রাতই হলো। বিছানার উপরে নতুন বউয়ের বেশে বসে থাকা প্রজ্ঞা ভাবছিল ওর এই চড়াই উতড়াইয়ে ভরা জীবনটার কথা। এই মানুষগুলো যারা সবসময় ওকে ওর বাহ্যিক সৌন্দর্য দিয়ে বিচার করেছে, আজ তারাও প্রজ্ঞার নিষ্ঠাভরা ভালোবাসার তারিফ করছে। ধূসরের বাবা মাও নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে নিজের মেয়ের মতোই কাছে টেনে নিয়েছে প্রজ্ঞাকে। তার চেয়ে বড় কথা সেই মানুষটাকে ফিরে পেয়েছে প্রজ্ঞা, যে মানুষটা ওর সমস্ত লড়াইয়ে ওর শক্তি হয়ে ছিল, পাঁচটা বছরের দীর্ঘ দূরত্বেও যে মানুষটা প্রজ্ঞার অপেক্ষায় ছিল, ফিরে আসার পর যে মানুষটা আর একটা মূহুর্তের জন্যও চোখের আড়াল হতে দেয় নি প্রজ্ঞাকে। একটা জীবনে সুখী হতে এর চেয়ে বেশি আর কি লাগে একটা মেয়ের?
প্রজ্ঞা কথাগুলো ভাবার মধ্যেই হঠাৎ আলতো শব্দ করে দরজাটা খুলে যেতেই প্রজ্ঞা চমকে মুখ তুলে তাকাতেই ধূসরকে দেখতে পেল। অনুষ্ঠানের জন্য দুজনকেই একেবারে নতুন বর বউ সাজানো হয়েছিল। এতোগুলো বছর পরেও ধূসরের ধীর পায়ে এগিয়ে আসা দেখে প্রথমদিনের মতোই কেঁপে উঠলো। আর সেটা দেখে ধূসরের ঠোঁটের কোণে আগের সেই দুষ্টুমিমাখা হাসি ফুটে উঠলো। ধূসর এগিয়ে এসে প্রজ্ঞার পাশে বসে আলতো করে প্রজ্ঞার গালে আলতো করে হাত ছুঁইয়ে দিয়ে বাঁকা একটা হাসি দিল।
-এভাবে লজ্জায় লাল হচ্ছো কেন বলো তো প্রজ্ঞা? মনে হচ্ছে এই বুঝি নতুন বউটাকে কেউ বাসরে বসিয়ে দিয়ে গেছে। আর সেই বেচারি স্বামীর প্রতিটা পদক্ষেপের শব্দেই কেঁপে উঠছে। এভাবে চলতে থাকলে আরো অনেক কিছুই কিন্তু রিপিট হতে পারে ম্যাডাম--- তখনও কি সেদিনের মতো লাল টুকটুকে মুখটা দেখার সৌভাগ্য হবে?
-চুপ করো তো। বেশি কথা বলবে না একদম। প্রত্যুষা কোথায়? কত রাত হয়েছে খেয়াল আছে? বাচ্চাদের এতো রাত জাগলে শরীর খারাপ হয় জানো না?
-প্রত্যুষা? সে তো তার খেলার সাথী পেয়ে গেছে। হামিদ সাহেবরা এসেছে না? উনারা তো থাকছেন রাতে। তো আমাদের প্রত্যুষা বুড়ি অদিতির সাথে স্টেজের দিকটায় নাচানাচি করছে। বাবা মায়ের বিয়ে বলে কথা।
-আরে? মেয়েকে বাইরে রেখে উনি এসেছেন ঢং করতে। তোমার যেতে হবে না। আমিই যাচ্ছি। হুটহাট কোন দুনিয়ার কথাবার্তা এই লোকটা কে জানে---।
প্রজ্ঞা গজগজ করতে করতে বিছানা থেকে এক পা বাড়াতেই ধূসর প্রজ্ঞাকে টেনে আবার বসিয়ে দিয়ে একটু একটু এগিয়ে যাচ্ছে প্রজ্ঞার দিকে।
-প্রত্যুষাকে নিয়ে আপাতত টেনশন করা লাগবে না ম্যাডাম। আমাদের বুড়িটা আজ দাদা দিম্মার সাথে ঘুমাবে। আমরা আপাতত আপনার প্রত্যাশাকে আনার ব্যাপারে প্ল্যানিং করি আসুন। প্রত্যাশা নামটা আপনার পছন্দ করা। বাট আমি ওকে প্রীতি বলেই ডাকবো। প্রত্যুষা আর প্রীতি। কিউট কিউট দুটো পুতুল আমার। প্রত্যুষার সব কিছু মিস করেছি, এবার আমার পিচ্চিটা আসার প্রত্যেকটা স্টেজ আমি অনুভব করতে চাই প্রজ্ঞাা।
-ধ্যাত। পাগল একটা। তোমার জন্য একটা গিফ্ট ছিল। দেখো নি কিন্তু।
-হুম? কি? এতো তাড়াতাড়ি গুড নিউজও চলে এসেছে নাকি? বাট কিছুই তো করলামই না আমি--।
-অসভ্য একটা লোক। এই সরো তো তুমি। একদম কাছে আসবা না।
-আরে রাগ করো কেন এতো? আচ্ছা বাবা কি গিফ্ট বলো শুনি?
-বক্সটা দেখো।
-বক্স? কি আছে?
ধূসর নিজেই হাত বাড়িয়ে প্রজ্ঞার হাত থেকে একটা সুন্দর ডিজাইন করা কাগজের বক্সটা নিল। কিছুটা ইতস্তত করেই বক্সটা খুলতেই রীতিমতো হাত কাঁপতে শুরু করেছে ধূসরের। তার আবদারগুলো কত যত্নে সাজিয়ে রেখেছে প্রজ্ঞা। প্রজ্ঞার কনসিভ হওয়ার রিপোর্ট, ছোট্টো প্রত্যুষার জন্মের পরের ছবি, ওর পায়ের ছাপ, প্রথম হামাগুড়ি দেয়ার ছবি, প্রথম ভাত মুখে দেয়া, প্রথম হাঁটতে শেখা, এমন কত কত ছবিতে ভরা বক্সটা। ছবিগুলো ছুঁয়ে দেখতে দেখতে প্রজ্ঞাকে বুকে জড়িয়ে ধরলো ধূসর। সেই কবে থেকে ধূসরের এই ছোট্টো ছোট্টো আবদারগুলো পূরণ করার জন্য পাগলামি করছিল মেয়েটা।
-স্বপ্নকুটিরের খালি ফ্রেমগুলোর কথা মনে পড়লেই বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠতো আমার। ফ্রেমগুলো খালি থেকে যাবে ভাবতেই বুকটা কেঁপে উঠতো। তাই যখন যা পেরেছি, স্বপ্নকুটির আর তোমার জন্য সাজিয়ে রেখেছি।
-বাট ম্যাডাম ফ্রেমের জন্য ছবি জোগাড় হলেও আমার তো লাভ হলো না কোনো। তাই তো বললাম প্রীতির আসার প্ল্যানিং করি চলো। হঠাৎ তুমি এসে আমার জীবনটা সবগুলো রঙে রাঙিয়ে দিয়েছিলে। আবার হঠাৎই এক নিমিষে হারিয়ে গিয়ে জীবনের সবক'টা রঙ কেড়ে নিলে। প্রত্যুষা, আমাদের ভালোবাসার অংশ, সেও হঠাৎই এলো আমার জীবনে। অথচ বাবা হওয়ার যে নয়মাসের দীর্ঘ সময়ের অনুভব সেটা ফিলই করতে পারলাম না। হয়তো ভাগ্যে ছিল না বলে। কিন্তু সেই কমতিটা আমি পূরণ করতে চাই প্রজ্ঞা। চাই এবার হঠাৎ করে নয়, আগাম বার্তা দিয়ে জানান দিয়ে কেউ আসুক আমাদের জীবনে। আর প্যারেন্টস হওয়ার যে নয়মাসের দীর্ঘ যাত্রাটা সেটা আমিও তোমার সাথে শেয়ার করি। আমাদের সন্তানের বেড়ে ওঠা থেকে শুরু করে পৃথিবীতে আসা সেই জার্নিটায় তোমার কষ্টগুলোর ভাগিদার হয়তো হতে পারবো না, কিন্তু সেটা একটু হলেও ফিল করতে চাই। সেই সুযোগটা আমাকে দিবেন ম্যাডাম?
ধূসরের গাঢ় কণ্ঠের কথাগুলো শুনতে শুনতে প্রজ্ঞারও চোখ জোড়া ভিজে এসেছিল। কোনোমতে চোখের পানিটা সামলে মাথা নেড়ে সায় জানাতেই ধূসরও আদুরে হাতে প্রজ্ঞাকে উষ্ণ ভালোবাসায় ছুঁয়ে রঙিন ভালোবাসার জগতে হারিয়ে যেতে শুরু করলো। আর বাইর থেকে ভেসে আসছে তাহসানের গানের মোহমাখা সুর।
"তোমাকে ভেবে পৃথিবী আমার
অদেখা তবু এঁকে যাই
আমার ভেতর শুধু তুমি
আরতো কিছু পায়নি ঠাঁই
তোমাকে ভেবে পৃথিবী আমার
অদেখা তবু এঁকে যাই
আমার ভেতর শুধু তুমি
আরতো কিছু পায়নি ঠাঁই
কেনো হঠাৎ তুমি এলে?
কেনো নয় তবে পুরোটা জুড়ে?"
***(সমাপ্ত)***