বকুল ফুলের মালা - পর্ব ২৭ - সুলতানা পারভীন - ধারাবাহিক গল্প


৫৩!! 

বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে বাইরের নিকষ কালো অন্ধকার দেখছে মায়রা। ড্রইংরুমের ঘড়িতে ডং ডং শব্দে রাত নয়টা বাজার ঘোষণা হলো। আয়ানের আসতে আর কতো দেরি হবে সেটা জানা নেই মায়রার। রুম থেকে বেরিয়ে নিচে ড্রইংরুমে যাওয়ার সাহসটুকুও এখন আর অবশিষ্ট নেই মায়রার মনে। নিজেকে যতটা না তুচ্ছ মনে হচ্ছে, তার চেয়েও কয়েক গুণ বেশি অপরাধী মনে হচ্ছে মায়রার। কিন্তু এই হীনমন্যতাটা কেন? ও তো কোন অন্যায় করে নি? একজন মানুষকে ভালোবেসেছে। ভালোবেসে তার সাথে নিজের বাকি জীবনটা কাটাতে চেয়েছে। তার খুশিতে হাসতে চেয়েছে, তার মন খারাপের সময়টায় পাশে বসে বকবক করে মন ভালো করতে চেয়েছে। অথবা তার পরিবারের মানুষগুলোকে নিজের জীবনের চেয়েও বেশি গুরুত্ব দিতে চেয়েছে। তাহলে দোষটা কোথায়? দোষটা কি এই মানুষটাকে ভালোবাসায়? নাকি অন্য একজনের সাথে মানিয়ে নিতে না পেরে তার কাছে ফিরে আসায়? সব নিয়ম কানুন মেনেই তো ফিরেছে মায়রা! তবু কিসের এতো বাধা এখনো?

মায়রা একমনে বাইরের অন্ধকার দেখতে দেখতে হঠাৎ টের পেল দুটো হাত শক্ত করে ওকে পিছন থেকে জাপটে ধরেছে। তারপর মানুষটা মায়রার ঘাড়ে নিজের নাক মুখ ডুবিয়ে লম্বা করে শ্বাস নিয়ে আলতো করে  ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো। মায়রা একটু চমকে উঠলো। মানুষটার দিকে না ফিরেই আলতো করে হাতে হাত রাখলো মায়রা।

-চলে এসেছেন জনাব? তা এতো তাড়াতাড়ি!

-রাগ করেছে বউটা? আসলেই অনেক দেরি হয়ে গেছে। সরি বউটা?

-উঁহু। রাগ করি নি।

-সত্যি?

-হুম---। 

-তাহলে এদিকে তাকাও তো আমার দিকে?

-হুম?

মায়রা আয়ানের দিকে ফিরতেই আয়ান মায়রার কোমড় পেঁচিয়ে টেনে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো। মায়রা আয়ানের দিকে তাকাতে চোখাচোখি হয়ে গেল দুজনেরই।

-কি এতো ভাবছে আমার পরীটা? হুম? হুম? এতো মনোযোগ দিয়ে চিন্তা করছে যে আমি এসেছি সেটা ম্যাডাম টেরই পায়নি--৷ কি ভাবছো বলো তো?

-উঁহু---। তেমন কিছু না। এমনি একটা কথা---।

-যেমনই হোক৷ আমি শুনবো৷ তুমি বলো তো বাবা। 

-পরে বলবো। এখন এসেছ ফ্রেশ না হয়ে কি করছো?

-বাসায় আসার পর স্বামীর প্রথম কাজ হলো বউকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরা। সেটাই করছি।

-তাই নাকি?

-জি ম্যাডাম। কিন্তু আপনি তো আপনার কাজটা করছেন না?

-আমার আবার কি কাজ?

-এই যে আপনার স্বামী এতো পরিশ্রম করে বাসায় ফিরলো। আপনার উচিত ছিল না তাকে জড়িয়ে ধরে আদর করে দিয়ে একটু তার মনটা চাঙ্গা করে দেয়া?

-অসভ্য লোক একটা৷ সারাদিন অফিসে কাজ করে টায়ার্ড৷ তবু তার দুষ্টুমি কমে না।

-আরে? এটা কেমন কথা? আর ম্যাডাম। আমি যতই টায়ার্ড হই না কেন আপনাকে আদরে মাতাল করে দেয়ার জন্য আমার মনের ইচ্ছেটাই যথেষ্ট। সে আমি টানা ১৮ ঘন্টা কাজ করলেও---।

-হয়েছে জনাব। এখন যান তো? ফ্রেশ হয়ে আসেন যান।

-ভিষণ টায়ার্ড--। একটু হেল্প করতে আসবেন?

-ইশ! একটু আগেই কি যেন বলছিলেন? টানা ১৮ ঘন্টা কাজ করলেও কি যেন? এই বুঝি তার নমুনা?

আয়ান মায়রার কোমড় জড়িয়ে আরো গভীরভাবে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো।

-তোমাকে আদর করে পাগল করার সুযোগটা দিয়ে দেখ আগে? তারপর নাহয় বলো----।

-হয়েছে--। এখন যাও--। চেইঞ্জ করে নাও। 

-কি আর করা! বউ যখন আদর দিবেই না অগত্যা----।

-হুম?

আয়ান মায়রার ঠোঁটে নিজের ঠোঁটটা একটু করে ছুঁইয়ে দিয়ে সরে এলো। মায়রার লজ্জারাঙা মুখটা দেখে নিজের টাওয়ালটা নিয়ে হাসতে হাসতেই ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালো। মায়রাও লজ্জা পেয়ে আবার বারান্দা দিয়ে বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকালো। বেশ অনেকক্ষণ পর আয়ান আবার এসে মায়রাকে আগের মতো জড়িয়ে ধরতেই একটা স্নিগ্ধ শীতল ছোঁয়ায় যেন একটা হিমেল বাতাস বয়ে গেল মায়রার শরীর বেয়ে। আয়ান ভিজে টাওয়াল ঘাড়ে ঝুলিয়ে রেখেই মায়রার ঘাড়ে নাক মুখ ডুবিয়ে দুষ্টুমিতে মেতেছে৷ মায়রা ঘাড় ঘুরিয়ে আয়ানের দিকে তাকাতেই আয়ান মায়রাকে বারান্দার গ্রিলের সাথে হালকা করে চেপে ধরে মায়রার ঠোঁটে ছোট্ট করে চুমো খেল কয়েকটা। মায়রা কেঁপে উঠতেই আয়ান হেসে মায়রার মুখের উপরে আসা চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে কানের পিছনে গুঁজে দিলো। 

-এই মায়রা? খিদে লেগেছে তো? চলো না? খেয়ে আসি। তারপর দেখা যাক দুষ্টুমি কতোটুকু কন্টিনিউ করা যায়।

-তুমি যাও খেয়ে এসো। আমি গেলে মা রাগ করলে?

-আরে বাবা! তাই বলে খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিবা নাকি? সকালে ওই বাড়িতেও কিছুই তো তেমন খাও নি৷ আর সারাদিন ও খাও নি কিছু। এভাবে চললে অসুস্থ হয়ে যাবেন তো ম্যাডাম।

-মা ও সকাল থেকে কিছু খায় নি।

-আচ্ছা। বুঝেছি। এখন চলো? খেয়ে নিবে। আমি খাবার এনেছি৷ মাকে দিয়ে এসেছি অনেকক্ষণ হলো।

-ভালো করেছ৷ এই শোনো না? 

-আচ্ছা। আমি গিয়ে দেখছি কি অবস্থা। কেমন?

-হুম---।

-আরে পাগলি? এতো টেনশন করার কি হলো? মা দেখবে বেশিদিন রাগ করে থাকতেই পারবে না---।

আয়ানের কথাটা শেষ হওয়ার আগেই দরজায় নকের শব্দ হলো। আয়ান ভ্রু কুঁচকে একবার দরজার দিকে তাকিয়ে আবার মায়রার দিকে তাকালো। আবার দরজায় নকের শব্দ শুনে আয়ান এসে রুমের দরজাটা খুলে দিলো। দরজার সামনে সায়নাকে ট্রে ভর্তি খাবার নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আয়ান মায়রা দুজনেই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। সায়নাও আয়ানের দিকে দু মিনিট চুপ করে তাকিয়ে থেকে কিছু না বলেই খাবারের ট্রে আয়ানের দিকে এগিয়ে দিলো। আয়ান ট্রে না নিয়েই সায়নার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে তখনো। 

-খাবারগুলো নে আয়ান? খালামনি পাঠিয়েছে তোদের দুজনের জন্য।

-আমরা তো নিচে আসছিলাম ডিনার করতে। রুমে পাঠানোর কি দরকার ছিল? 

-সেটা গিয়ে খালামনিকে জিজ্ঞেস কর। আমি কি করে জানবো? আমাকে বলেছে খাবার দিয়ে যেতে, আমি দিয়ে গেলাম। 

-দে তাহলে। আর মা খেয়েছে?

-খায় নি এখনো। খেতে বসছে সবাই এখন।

-ওহ। 

-আমি গেলাম। 

আয়ানের হাতে খাবারের ট্রেটা ধরিয়ে দিয়ে সায়না ছুটে চলে গেল। আয়ান কিছু একটা ভাবতে ভাবতে খাবারগুলো নিয়ে বেড সাইড টেবিলের দিকে আসছে দেখে মায়রা নিজে এসে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে আয়ানের পাশে এসে দাঁড়ালো। আয়ান মায়রাকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে ওয়াশরুম থেকে হাত ধুয়ে এলো। মায়রা ততক্ষণে প্লেট আর বাটিগুলো থেকে ঢাকনা সরিয়ে হা হয়ে গেল। অনেক ধরনের খাবার পাঠিয়েছে মা। ভাত, মাছ, সবজি আর সাথে চাটনি, মিষ্টি আর পেস্ট্রি। আয়ান এসে একটা প্লেটে ভাত মাখিয়ে মায়রার মুখের সামনে ধরলো। মায়রা আয়ানের দিকে তাকিয়ে আছে দেখে আয়ান ভ্রু নাচালো।

-কি হলো? হা করো?

-এতো খাবার দিয়ে কি হবে?

-কি আর হবে? খাবে। এখন কথা না বলে হা করো তো? সারাদিন না খেয়ে থেকে কি মজা পাও কে জানে?

-মা খেয়েছে কিনা সেটা না জেনে---।

মায়রাকে কথাটা শেষ করতে দিলো না আয়ান। মুখে খাবার পুরে দিয়ে চোখ ছোট করে মায়রার দিকে তাকালো।

-আমি যে না খেয়ে আছি সেটার দিকে কারো হুঁশ ই নেই। হুহ। খাও তো। আর মাকে নিয়ে এতো চিন্তা করো না। বাবা মাকে না খেয়ে থাকতে দিবে না। দুপুরে বাবা অফিসে ছিল তাই মা না খেয়ে থাকতে পেরেছে। এখন সেটা হবে না। সো ডোন্ট ওরি ম্যাম৷ 

-হুম। সরি---।

-হা করো। সরি টরি পরে বলো---।

-তুমিও খাও না?

-হুম---। খাচ্ছি তো ম্যাডাম। 

আয়ান মায়রাকে খাইয়ে দিচ্ছে আর নিজেও খাচ্ছে। আর মায়রা খেতে খেতে একটু পর পর আয়ানকে দেখছে অবাক চোখে। মানুষটাকে এতো স্নিগ্ধ লাগছে দেখতে৷ ধবধবে সাদা রঙা একটা ফতুয়া পড়নে মানুষটার৷ এই রঙটা লোকটাকে এতো কেন মানায় সেটাই মায়রা বুঝে পায় না৷ আয়ান মায়রার দিকে তাকাতেই দুজনের চোখাচোখি হয়ে গেল। আয়ান মায়রার দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচালো। 

-এতো মনোযোগ দিয়ে কি দেখছ বলো তো? 

-কই না তো---।

-ব্যাপারটা কি! আমাকে কি আজকে বেশিই হ্যান্ডসাম লাগছে নাকি? তখন সায়না কেমন হা করে তাকিয়ে ছিল। আর এখন তুমি! কাহিনী কি বলো তো?

-হুহ। কিছু না। ওকে গিয়েই জিজ্ঞেস করো যাও---।

-ওরে বাবা! বউটা রাগ করেছে দেখছি। সরি সরি বউসোনা। দুষ্টুমি করছিলাম পাগলিটা। খাও?

-আর খাবো না---।

-সরি তো বাবু? রাগ করো না। দুষ্টুমি করেছি তো?

-রাগ করি নি। খাওয়া হয়ে গেছে আমার। তুমি খাও না? 

-আচ্ছা। আসার সময় মায়ের জন্য মিষ্টি এনেছিলাম। মা তোমার জন্যও পাঠিয়েছে--৷ খাও?

-হুম---। 

-আর এই পেস্ট্রিটা আপনার জন্য। এটাও খান। 

-ওমা! এতো কিছু খাবো কি করে?

-এটা সারাদিন না খেয়ে থাকার শাস্তি। এখন চুপচাপ খাও। আর এই মিষ্টি আমার একদমই পছন্দ না। তুমিই খাও।--উম-। কথা না কোনো।

-হুম----।

আয়ান খাওয়া শেষ করে উঠে হাত মুখ ধুয়ে এসে দেখলো মায়রা একটু একটু করে মিষ্টি খাচ্ছে। আয়ান মায়রার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে একটা হাসি দিলো। মায়রা সেটা দেখেও কিছু না বললো না। এই মানুষটার মনে কখন কি চলে বোঝা মুশকিল। জিজ্ঞেস করলেই হয়তো এমন কিছু বলবে যে বেচারি লজ্জায় মরেই যাবে৷ তাই মায়রা আর কোন কথা না বলে চুপচাপ মিষ্টি খাচ্ছে। আর একটু পর পরই দুজনের চোখাচোখি হয়ে গেলেই দেখতে পাচ্ছে আয়ান তখনও মিটিমিটি হাসছে। এতো হাসার কি আছে সেটাই বেচারি বুঝতে পারছে না।

৫৪!! 

বারবার চোখাচোখি হয়ে যাচ্ছে বলে মায়রার কেমন একটু লজ্জা করছে। ও নিজে বসে খাচ্ছে আর মানুষটা একটু পর পর তাকাচ্ছে৷ ব্যাপারটা কেমন জানি অস্বস্তিকর৷ মায়রা একটা মিষ্টি শেষ করে অন্য একটা মিষ্টি আয়ানের দিকে এগিয়ে দিলো। আয়ান হেসে মাথা নাড়লো।

-তুমি খাও। 

-একটু খাও না? অনেক মজা--। সত্যি--।

-তাই নাকি? 

-হুম--। সত্যি। খুব মজা খেতে--।

-মজা হলে তুমিই খাও। এসব মিষ্টি আমার পছন্দ না। আর পেস্ট্রিও রয়ে গেছে। সেটাও শেষ করো--।

-হুম---।

মায়রা মিষ্টিটা খেয়ে বাটিটা রাখতেই আয়ান মায়রাকে টেনে নিজের কাছে আনলো। মায়রা একটু সরে যাওয়ার চেষ্টা করতেই আয়ান মায়রার কোমড় পেঁচিয়ে নিজের কোলে বসিয়ে মুখটা দুহাতে তুলে ধরলো। মায়রা থতমত খেয়ে আয়ানের চোখে চোখ রাখলো।

-কি করছ?

-বলছিলে না মিষ্টিটা খুব মজা খেতে? তাই আমারও খুব মিষ্টি খেতে ইচ্ছে করছে---। দাও না?

-ওমা! মিষ্টি! মিষ্টি তো আমি খেয়ে ফেললাম--। তখন না বলে খাওয়ার পরে বললে আমি কেমন করে দিবো?

-আমি এতো কিছু জানি না। আমি মিষ্টি চাই। দাও এখন? আমাকে ওমন লোভ লাগালে কেন না দিলে?

-আরে! কি মুশকিল! আমি তো তোমাকে দিতেই চেয়েছিলাম--। তুমিই তো খেলে না তখন--। 

-আমি এতো কথা শুনবো না। আমার মিষ্টি চাই মানে চাই। 

-আমি দেখি মাকে জিজ্ঞেস করে--।

-উঁহু--। এখন রুম থেকে বের হতে পারবে না--। আর মায়ের কাছে গিয়ে কি বলবে? আর মা কি ভাববে! ছি ছি! একদম না।

-আরে! তাহলে পেস্ট্রিটা খাও। ওটাও অনেক মজা।

-না। আমি মিষ্টিই খাবো--। আমি আর কিছু জানি না---।

-আরে!

-এক কাজ করো। তুমি তো মিষ্টি খেয়েছ। তোমার ঠোঁটে এখনও নিশ্চয়ই মিষ্টির স্বাদটা লেগে আছে। সেটাই নাহয় টেস্ট করাও। দেখি কেমন মজা?

-কিসব বলছ?

-আমি তো ভুলেই গেছিলাম। তোমার থেকে চেয়ে তো লাভ নেই। আমি নিজেই টেস্ট করে দেখছি। ওয়েট--।

-আরে?

আয়ান মায়রাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নিজের ঠোঁটের বাঁধনে মায়রার ঠোঁট জোড়া আটকে নিলো। মায়রার কোমড় চেপে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঠোঁট জোড়া নিজের মুখে পুরে নিয়ে স্বাদ নিতে ব্যস্ত আয়ান। মায়রাও আয়ানের স্পর্শে যেন হারিয়ে গেল। আয়ানের গলা জড়িয়ে নিজেও আয়ানের ভালোবাসায় ডুব দিলো মায়রা। বেশ অনেকক্ষণ পরে আয়ান সরে এসে মায়রার কপালে কপাল ঠেকিয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিলো কিছুক্ষণ। একটু পরে আয়ান নিজেকে একটু সামলে নিয়ে মায়রার গালে হাত ছুঁইয়ে দিয়ে চোখে চোখ রাখলো। 

-এই মিষ্টির চেয়েও তোমার ঠোঁটজোড়া বেশি টেস্টি জানো তুমি মায়ু? একেবারে নেশা ধরানো। এতোই নেশাতুর করে তোলে আমাকে যে মনে হয় তোমার এই নরম ঠোঁটের মায়ায় ডুবে যাই। আর এমন বাচ্চাদের মতো মিষ্টির রস লাগিয়ে রেখেছ মুখে--। আমি তো তোমার ঠোঁটের মধু ঠিক করে খেতেও পারলাম না। এটা কিন্তু ঠিক না একদম বুঝসো? আর মিষ্টিটাও অবশ্য খেতে খারাপ না। 

-অসভ্য একটা৷ সবসময়ই কিসব বলে---।

-হা হা। ঠিকই তো বলি----। 

-সরো তো? আমি প্লেটগুলো রান্নাঘরে রেখে আসি---।

-এমন টুকটুকে রাঙা ঠোঁট জোড়া নিয়ে নিচে যাবে? কারো সামনে পড়ে গেলে তো লজ্জায় তোমাকে আর খুঁজেই পাওয়া যাবে না---।

-চুউপপপ। 

-এর চেয়ে ভালো আমিই রেখে আসি। তুমি ততক্ষণ পেস্ট্রিটা খাও। এটার টেস্ট কেমন সেটাও বলো--। কেমন?

-তুমি? যাও তো যাও---।

-যাচ্ছি তো বাবা। এসে যেন দেখি খাওয়া হয়ে গেছে--। ওকে? নইলে কিন্তু----।

-যাও তো তুমি----।

-জি যাচ্ছি মহারাণী--।

আয়ান খাবারের ট্রে, প্লেট, বাটিগুলো রান্নাঘরে রেখে রুমে এসে দেখলো মায়রা রুমে নেই। পেস্ট্রির বক্সটা খালি দেখে আয়ান নিজের মনেই হাসলো। আয়ান রুমের দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে এসে বারান্দায় গিয়ে মায়রার পাশে গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। মায়রা আবার অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে কিছু একটা ভাবছে। আয়ান ব্যাপারটা খেয়াল করে মায়রার শাড়ির ভিতর দিয়ে কোমড় পেঁচিয়ে ধরে নিজের দিকে ফেরালো মায়রাকে৷ মায়রা একটু চমকে উঠে আয়ানের দিকে তাকালো। আয়ান আবার মায়রাকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিলো।

-মায়ু? কি ভাবছ এতো? তখন তো বললে না কিছু। এবার বলো কি হয়েছে?

-তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি? রাগ করবে না বলো?

-আচ্ছা। রাগ করবো না। বলো তুমি।

মায়রা আয়ানের চোখে চোখ রাখলো। মেয়েটার মনে কি একটা ঝড় বয়ে যাচ্ছে সেটা আয়ান টের পেল। আলতো করে মায়রার গালে হাত ছুঁইয়ে দিয়ে একটা চুমো খেল আয়ান।

-বলো না পরীটা? কি বলছিলে--।

-আমাকে বিয়ে করে তুমি সত্যি খুশি তো আয়ান? তোমার মনে আমাকে নিয়ে কোন দ্বিধা আছে আয়ান? তোমার মনে হয় না আমাকে বিয়ে করে ভুল করেছ তুমি? এর চেয়ে হয়তো অন্য কাউকে-----।

আয়ান মায়রাকে কথাটা শেষ করতে দিলো না। মায়রার ঠোঁট জোড়া ততক্ষণে আয়ানের ঠোঁটের বাঁধনে আটকা পড়ে গেছে।

-আমি ঠিক কতোটা খুশি কতোটা সুখী সেটা কি বুঝতে পারো না তুমি মায়রা? ঠিক প্রথম যেদিন তোমাকে দেখেছিলাম সেদিন থেকেই শুধু একটা প্রার্থনাই করেছি--। তোমাকে নিজের করে পাওয়ার প্রার্থনা। সেদিনের সেই ছোট্ট মায়রাটা আজ আমার লক্ষী বউ হয়ে সবসময় আমার পাশে আছে, আমি তাকে হুট করে এসে ছুঁয়ে দিতে পারি৷ কাছে টেনে নিয়ে আদর করে দিতে পারি। এই অনুভূতিটাকে তুমি কি বলবে? এটা যদি সুখ না হয় তবে আমি সুখী হতেও চাই না। 

-আয়ান?

-জানো মায়রা? যেদিন তুমি প্রথমবার ভালোবাসি কথাটা বলেছিলে সেদিন মনে হয়েছিল আমার চেয়ে ভাগ্যবান বুঝি পৃথিবীতে আর কেউ নেই। দেখতে দেখতে কতোগুলো দিন যে কেটে গেছে তার পর--৷ তোমাকে প্রতিনিয়ত নতুন করে আবিষ্কার করেছি। তোমাকে হারিয়ে পাগলের মতো দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলাম। আর সেই সময়টায় আমি তোমাকে আরো বেশি করে ফিল করতে পেরেছি। তখন বুঝতে পেরেছি আমার জীবন থেকে কি অমূল্য সম্পদটা আমি হারিয়ে ফেলেছি। তুমি যদি ওইদিন আমার এক কথায় আমার সাথে চলে আসতে তাহলে এই অনুভূতিটা আমার কখনই হতো না মায়রা। তাহলে কখনোই বুঝতে পারতাম না তোমাকে আমার কতোটা প্রয়োজন। 

-আয়ান?

-ছয়টা মাস পরে তোমাকে পাওয়ার আশাটা যখন ফিরে পেলাম সেদিন কি ইচ্ছে করছিল জানো? ইচ্ছে করছিল চিৎকার করে পুরো পৃথিবীকে জানিয়ে দিই যে আমি আমার পরীটা এবার আমার হবে। শুধুই আমার। আর কোন বাধা থাকবে না। এই একটা কথা পরের চারটা মাস তোমাকে এক মূহুর্তের জন্য না দেখেও কাটিয়ে দিতে সাহস যুগিয়েছে জানো? আর এখন যখন তোমাকে সত্যি সত্যি পেয়ে গেছি তখন আমি অবাক হয়ে সারা রাত জেগে তোমাকে দেখি জানো? মনে হয় স্বপ্ন দেখছি। সুন্দর একটা স্বপ্ন। ভয় হয় স্বপ্নটা ভাঙলেই তোমাকে আর পাশে পাবো না। তাই আর ঘুমই আসতে চায় না একদম। 

-এতো কেন ভালোবাসো তুমি আমাকে আয়ান?

-কারণ তুমি শুধু আমার মায়রা। আমার ভালো থাকার মেডিসিন। আমার ছোট্ট ছোট্ট খুশির কারণ তুমি৷ আর বেঁচে থাকার অবলম্বন। তোমার সাথে কাটানো প্রতিটা মূহুর্তগুলো আমার জীবনের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ সময়। তাই কারণে অকারণে তোমাকেই ভালোবাসি।

কথাটা বলা শেষ করেই আয়ান আবার মায়রার ঠোঁট জোড়া দখল করে নিল। একটু পরে আয়ান সরে এসে মায়রার টুকটুকে লাল মুখের দিকে তাকালো। মায়রা এতোক্ষণ চোখ বুজে আয়ানের উষ্ণ স্পর্শে যেন সুখের অন্য জগতে ভাসছিল। আয়ান সরে আসতেই মায়রাও চোখ মেলে আয়ানের দিকে তাকালো। আয়ানের ঘোর লাগা দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে মায়রার নিজেকে কেমন অবশ মনে হচ্ছে। মায়রা কোন এক ঘোরের মাঝেই এক পা এগিয়ে এসে দু হাতে আয়ানের গলা জড়িয়ে ধরে সোজা আয়ানের চোখে চোখ রাখলো। আয়ানও ঠোঁটের কোণে মিষ্টি একটা হাসি ঝুলিয়ে মায়রার কোমড় জড়িয়ে ধরে নাকে নাক ঘষলো।

-বউটা কি চাইছে বলো তো? আমার তো সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে মাথার মধ্যে--। বউসোনা কি সেটাই ইশারা করছে যেটা আমি ভাবছি?

মায়রা মুচকি হেসে আয়ানের চোখে চোখ রাখলো। 

-কেউ নাকি আমার লাজুক চোখের চাহনি দেখে বুঝে যাবে আমি কি চাই। তাইলে এখন কি হলো?

-কারো এতো সহজ আত্মসমর্পণে আমার ভিতরটা এতোটাই নাড়া দিয়ে গেছে যে সব সহজ ইশারাগুলো কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। তা ম্যাডাম এই পাগল মানুষটার পাগলামি ভালোবাসায় ধরা দিতে প্রস্তুত তো আপনি? 

-আমি তো ধরা দিতেই চাই। কিন্তু একটা যে সমস্যা রয়ে যাচ্ছে---।

-কি সমস্যা?

-আমার ফুল কই? কথা ছিল আজ কেউ আমাকে বকুলের সুবাসে ভরিয়ে দিবে৷ সেটার কি হলো?

-ফুল তো আছে ম্যাডাম। ফুল ছাড়া কি করে আমার এই বকুল ফুলের বাসর সাজাই বলো? সো ম্যাডাম? ক্যান উই স্টার্ট নাউ?

আয়ানের কথা শুনে মায়রা মুখ নামিয়ে একটু লাজুক হাসলো। আয়ানও নিজের প্রশ্নের উত্তরটা পেয়ে গেল নিমিষেই। আর সাথে সাথেই মায়রাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিলো আয়ান। মায়রাও ঠোঁটের কোণে একটা তৃপ্তির হাসি ফুটিয়ে আয়ানকে দেখছে অপলকে। দুজনের চোখের চাহনিই যেন হাজারো না বলা কথাগুলো বলে যাচ্ছে। আজ এতোদিনের অপেক্ষা শেষে মিলন হবে দুটো ভালোবাসার মানুষের। আর সেই বাসরের সাক্ষী হয়ে সুবাস ছড়াবে শত শত বকুলেরা। আজ এই সুন্দর রাতটার সাক্ষী হয়ে মিলে মিশে এক হয়ে যাবে বকুল ফুলের মালাগুলোও।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন