সিঁদুর রাঙা মেঘ - পর্ব ০৮ - সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি - ধারাবাহিক গল্প


কুহুকে দেখতে এসেছে এক ঘটক। তার সাথে মধ্য বয়সক এক লোক। মাইশা তাদের নানা খাবার এগিয়ে দিচ্ছেন। সুমিকে তখন ফিসফিস করে মাইশা বলল,,
---"যা কুহুকে নিয়ে আয়। কুহুকে না দেখে পাত্র মিলাবে কিভাবে?"
সুমি হেসে উঠে গেল উপরে।কুহু তখন রুমে শুয়ে ছিল।  সুমি এসে হুড়মুড়িয়ে উঠিয়ে দিল। কুহু শরীর কাঁপতে লাগলো। মাত্রই চোখ লেগেছিল তার।সে বলল,,
---"মা কি হইছে? এমন করলা কেন?"
সুমি তাড়া দিয়ে বলল,,
---"উঠ উঠ যলদি।  আর ভাল কিছু পড়ে নে। জলদি কর!"
কুহু অবাক হয়ে বলল,,
--"কেন মা? কোথায় যাবে?"
---"এত কথা সব সময় কেন বলিস তুই? যা রেডি হো। "
কুহু আর কথা বাড়ালো না রেডি হয়ে তার মার সাথে নিচে আসতেই একটি পুরুষ আর একটি মহিলাকে দেখতে পেলো।কুহুকে তাদের সাথে বসিয়ে দিয়ে বলল,,
---"আপা ওই আমার মেয়ে। ওর কথাই বলছিলাম!"
মহিলা কুহুর পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে বলল,,
--"আলহামদুলিল্লাহ। মেয়ে সুন্দরী খুব।  কিন্তু..!
চিন্তিত দেখালো মহিলাকে। তা দেখে মাইশা বলল,,
---" কি হলো আপা কি সমস্যা? "
মহিলা তার পানের বটা থেকে পান বের করে পান মুখে পুড়লো। ঠোঁটের কোন দিয়ে পানের রস গড়িয়ে পড়ছে তা আবার মুছে নিচ্ছে শাড়ির আঁচলে।কুহু ঘিন্না লাগল খুব। মহিলা বলল,,
--"আপনার মাইয়ার ওই বড় খুত না থাকলে বড় বড় ঘরে বিয়া দিয়া যাইতো!"
সুমির মুখটা ফেকাসে হয়ে গেল। মহিলা আবার বলল,,
--"তবে একটা পোলা আছে তবে বয়স একটু বেশি।  আপনি চাইলে ছবি দেখাইতে পারি!"
মাইশা হেসে বলল,,
---" দেখান দেখি!"
মহিলা ছবি বের করে দেখালো। মাইশা বলল,,
---" ছেলেতো তেমন বয়স বোঝায় যায় না। দেখ সুমি। "
সুমি একটু হেসে ছবি দেখেই মুখ কালো করে ফেললো। 
---"বড় ভাবি ছেলের বয়স তো অনেক বেশী দেখাচ্ছে চুল টুল পেকে গেছে,  চামড়াও ঝুলে গেছে।আর তাকে তুমি কম বয়সি বলছো?"
মাইসা মুখটা কাচুমাচু করে বলল,,
---" কই না তো!ঠিকি আছে! আর এখন কি এতো খুঁজা যাবে? তোর মেয়ে যে কাহিনী করছে এর পর এ বিয়ে করবে নাকি সেটা দেখ?"
সুমি আবাক হলো ভাবির কথায়। সাথে ভাবতেও লাগলো ঠিকিতো তার মেয়ের যে কাহিনী আর যদি বিয়ে না হয়?
মাইশা সুমিকে ভাতে দেখে বলল,,
---" কি ওত ভাবিস? আমরা তোর পর না। এত ভাবিস কেন?"
সুমি অনেক ভেবে হে বলতে নিবে তার আগেই কুহু বলল,,
---" মা আমি এ বিয়ে করবো না!"
সুমি চমকে বলল,,
---"তোর রায় কে চাইছে বসে থাক!"
কুহু রেগে বলল,,
---"বিয়ে আমি করবো মা। সারা জীবন সংসার আমি করমু।  আমার মতামত আছে একটা। "
মাইশা তখন তাচ্ছিল্য করে বলল,,
---"এ বয়সে এসব তো পাচ্ছিস সামনে আর পাবি নাকি সে চিন্তা কর! যে বদনাম তোর নামে লাগা।"
কুহুর মাইশার দিকে শীতল দৃষ্টিতে দাকিয়ে হেসে বলল,,
---"বড় মামনী! আমি যে বদনাম  তা আপন মানুষদের জন্যই। "
মাইশা থতমত খেয়ে গেল। কিছু কথা মনে পড়তেই তিনি চুপ করে গেলেন। কুহু উপরে চলে গেল। তখন দেখা হলো ইউসুফের সাথে।  ইউসুফকে দেখে বুকের মাঝে ছ্যাত করে উঠলো। ইউসুফের লাল হয়ে থাকা চোখ, মুখ আর এলো মেলো চুল। ইউসুফ ভাই কি কেঁদেছে? মনেরাঝে প্রশ্নটি উঁকি মারছে বার বার।

ইউসুফ কুহুর দিক তাকালো এক পলক। চোখ মুখ শক্ত করে নিচে নেমে গেল সে। রুমে যেতেই মিশু বলল,,
---"কুহু ব্যাগপ্যাক করে নে। আমরা রাতে রওনা করবো।"
---"কোথায় যাবো বড়পু?"
মিশু অবাক হয়ে বলল,,
---"ভুলে গেছিস? সাজেক যাবো সবাই?"
কুহু  "ওহো " বলে কথা টেনে শুয়ে পড়তে চাইলো। শরীরটা একদম চলছে না আর। তখনি মিশু টেনে টুনে নামালো কুহুকে বলল,,
---"তুইও যাবি।  চল ব্যাগপ্যাক করবি।"
---"বড়পু প্লীজ!"
---"কোনো প্লীজ টিজ না। যাবি তো যাবি! "
ঠিক তখনি মাইশা ঘরে ডুকলো। মিশু বলল,,
---"মা দেখনো না কুহু যেতে চাইছে না! তুমি একটু বুঝাও!"
মাইশা কেমন অস্বস্তি বোধ  করছে কুহুর সাথে কথা বলতে। মিশুকে সে বলল,,
---"তোর বাবা ডাকছে নিচে যা। আমি বুঝিয়ে বলছি ওকে!"
মিশু মাথা নেড়ে চলে গেল। মাইশা তখন কুহুকে বলল,,
---" আমায় ক্ষমা করে দিস কুহু! আমি তোকে কষ্ট দিয়ে ফেলেছি।"
কুহু চকিতে বলল,,
---"ছিঃ ছিঃ বড় মামনী এসব বলবেন না। আমি হয়তো বেশী বলেছি!"
মাইশা কুহুর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,,
---" নারে মা।  তুই আমাদের জন্য যে বলিদান দিয়েছিস তার বদলে তোকে শুধু দুঃখ দিয়ে গেলাম আমায় ক্ষমা করিস মা।"
---" বড় মামনী তুমি আমাকে এবার পর করে দিচ্ছো!"
---" নারে পর করছি না তুই তো আমাদের আপনের থেকে বেশী।  তুই যদি আমায় মাফ করিস তাহলে সাজেক যাবি।  ঘুড়ে আয় ওদের সাথে!"
--" বড় মামনী সত্যি আমার ইচ্ছে নেই যাওয়ার!"
---"আমি কিন্তু তাহলে ভাবব্য তুই মাফ করিস নি!"
কুহু হেসে দিল বলল,,
---"আচ্ছা যাবো!"

—————

কনকনে ঠান্ডা বাতাস বাসের জানালা ভেদ করে সাই সাই করে ঢুকছে ভিতরে। কুহু তা বন্ধ না করে শরীরে পড়া সুয়েটারটা আরো আকড়ে ধরলো। লাষ্ট পর্যন্ত কুহু সাজেক যাচ্ছে। মাইশার কথা ফেলতে পারেনি কুহু।
---" কুহু জানালাটা লাগিয়ে দে ঠান্ডা বাতাস আসচ্ছে অনেক।"
মিশুর কথায় কুহুর ধ্যান ভাঙ্গে এতখন রাতের আকাশ দেখে কিছু স্মৃতিতে বিভোর ছিল সে।কুহু জানালা লাগালো। আড় চোখে পাশের সিটে তাকালো। হুর ইউসুফের কাঁধে মাথা রেখে শুয়ে আছে। আর ইউসুফ চোখ বুজে কানে হেড ফোন লাগিয়ে গান শোনায় ব্যস্ত।কুহু ছোট শ্বাস ফেললো। আর তাকালো না কষ্ট লাগে তার হুরকে আসেপাশে দেখলে ইউসুফের।  কিন্তু এ কষ্টের দাম নেই কিছুদিন পর সহধর্মিণী হবে তার। কুহু চোখ বুঝে নিজেও ঘুমুতে চেষ্টা করলো।

রাত তখন ১২ টার উপর। ঠিক ৩ টায় কুমিল্লায় পৌঁছাবে তারা।এখনো অনেক সময় বাকি।ইউসুফের শান্তি লাগচ্ছেনা যেন। হুর কখন থেকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরছে।  বিরক্ত লাগচ্ছে তার। এই মেয়েকে আনতেই চায়নি সে। এমন করবে জানাই ছিল। কই ভেবেছিল সুখে শান্তিতে দুটো দিন পার করবে কিন্তু এই মেয়ে প্যারা দিতেই ব্যাগপ্যাক নিয়ে হাজির। অসহ্য 
ইউসুফ হুরকে আবার সোজা করলো। পাশে মিশুকে সজাগ দেখে ধাক্কিয়ে বলল,,
---" এর সাথে বস তো!"
মিশু হেসে দিল। টিপুনি কেঁটে বলল,,
---" এটুকু সময়ে এই হাল? বাকি জীবন কেমনে কাঁটাবা?"
ইউসুফ চোখ রাঙালো। বলল,,
---"বেশী কথা শিখে গেছিস তুই? বড় ভাই তোর ভুলে গেছিস?"
মিশু হাসি চেপে রেখে বলল,,
---" আচ্ছা আচ্ছা সরি। বস তুমি!"
মিশু হুরের পাশে বসে পড়তেই কুহুর পাশে ইউসুফ বসে পড়লো। কুহু তখন ঘুমিয়ে গেছে জানালায় মাথা রেখে।ইউসুফ সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে, কানে আবার হেড ফোন গুঁজে দিলো।

এভাবে কিছুক্ষণ কাঁটাবার পর ইউসুফের মনে হলো কেউ তার কাঁধে মাথা রেখেছে। ইউসুফ চোখ মেলে তাকালো। কুহু তার কাঁধে মাথা রেখেছে।  ইউসুফ প্রথমে রাগে ধাক্কা দিয়ে সরাতে চাইলো কিন্তু তা না করেই সে আলতো হাতে কুহুর কোমরে তার বলিষ্ঠ হাত ধারা চেপে কাছে টেনে নিলো। একদম তার বুকে লুকিয়ে ফেললো যেন। নিজের কাছে নিজেই বেকুব ইউসুফ। যাকে সে দিন রাত বলে ঘৃণা করে সে তার পাশে আর তাকেই আকঁড়ে ধরেছে আষ্টেপৃষ্ঠে। ইউসুফ হাসলো। বুকের মাঝে কুহুকে পেয়ে শান্তি শান্তি অনুভব হচ্ছে। অথচ হুর তাকে জড়িয়ে ধরাতে অস্বস্তি লাগচ্ছিল খুব। যেকিনা দুদিন পর অর্ধাঙ্গিনী হবে তার স্পর্শ অসহ্য লাগে তার কাছে? দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ে ইউসুফ। কুহুর মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে বিড়বিড় করে বলল,,
---"কেন এমন করলি? বাবুইপাখি? আজও তোর দেয়া ধোকা ভুলতে পারিনা। না বিশ্বাস করতে পারি তুই এই কাজ করেছিলি।"

সময়ের সাথে সাথে প্রতিটি জখম ভড়ে যায়। কিন্তু মনের জখম ভালবাসার মানুষকে আরো কাছে পেয়ে ভেঙ্গে ঘুড়িয়ে জখম তাজা করে দেয়। যেমনটি হচ্ছে এদের দুজনের সাথে। দিনরাত প্রতিটি মুহুর্ত কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে তাও উফ টুকু করছে না তারা।

কুমিল্লা বাস থামে একটি খাবার রেস্টুরেন্টে । যারা খাবার খাবে বা রেষ্টরুমে যাবে যেতে পারবে। ইউসুফ কুহু জাগার আগেই উঠে চলে গেল নিচে।  তার বন্ধু জায়েদ সবাইকে নিয়ে এলো রেস্টুরেন্টের ভিতরে। সকলেই চা,  কফি খেয়ে নিচ্ছে। জায়েদ তাদের কার কি লাগবে দেখচ্ছে। তখন দেখে ইউসুফ হাওয়া।  তাই সে মিশুকে বলল,,
---"তোমার ভাই কই?"
মিশু চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলল,,
---"ভাইয়া আগেই নেমেছে।"
 সাবিত পাশ থেকে বলল,,
--"আমি দেখে আসচ্ছি!"

ইউসুফ রেস্টুরেন্টের বাহিরে সিগারেট ফুকছিল। পিছন থেকে সাবিত চাপর মেরে বলল,,
---" কি করে সবাই ওখানে। আর তুই এখানে কি করিস?"
ইউসুফ নাক দিয়ে ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে উদাসীন ভাবে বলল,,
-- সবাই তো আছেই। আমার কি প্রয়োজন?"
সাবিত অবাক হয়ে বলল,, 
--"কি যাতা বলছিস?"
--" সত্যি বলছি দোস্ত। দুটো দিন শান্তিতে কাঁটাবো ভেবেই এসেছিলাম অথচ দেখ শান্তি নাই আমার কঁপালে।"
--"মরিচীকার পিছনে ছুটলে শান্তি পাবি না কখনো?
ইউসুফ ম্লান চোখে তাকালো।  সাবিত আবার বলল,,
--"তুই ভুলতে পারিসনি এখনো কুহুকে তাই না! গাড়িতে দেখলাম ভালবাসার চাদরে জড়াচ্ছিস!"
ইউসুফ কিছু বলল না।  দূর আকাশে তাকিয়ে রইলো। সাবিত আবার বলল,,
---" অতীত ভুলে যাওয়াই ভালো। "

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন