২১!!
তাওহীদ আর আয়ানের অবাক হওয়া দেখে আরিশা ভ্রু কুঁচকে দুজনের দিকে তাকালো। আর কিছু না বলে চুপচাপ খাওয়া শেষ করে উঠে তিনজনে সোফায় এসে বসলো। আরিশা একটা বড় বাটিতে আইসক্রিম নিয়ে খেতে খেতে আয়ান আর তাওহীদের শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসছে। তাওহীদ হাত বাড়িয়ে বাটিটা ধরার চেষ্টা করতেই আরিশা একবার রাগী চোখে তাওহীদের দিকে তাকিয়ে বাটিটা সরিয়ে নিলো।
-আরে আরু? ঠান্ডা লেগে যাবে তো বাবা।
-সেটা আয়ানকো বলো। আমি তো এখন আইসক্রিম খাবো। হুহ--।
-ওফ!! আল্লাহ! এই মেয়েটা কথা শুনে না কেন!
-কি বললা তুমি? ওই আমি কথা শুনি না? কথা শুনি না বলো আমাকে! এত বড় সাহস তোমার!
-উফফ! আরু? তুমি কি বলতে চাইছিলে আপাতত সেটায় ফোকাস করি আমরা কি বলো?
-উমম--। হুম। তোমাকে তো পরে দেখছি আমি--। আয়ান শোন। আমি একটা প্ল্যান করেছি। আর সেটা তুই আর আমার উনি মানবি। ওকে?
-জি ম্যাডাম--।
আরিশা তাওহীদের দিকে একবার বিরক্ত হয়ে আয়ানের দিকে তাকালো।
-বল মেরি মা। না মেনে কি আর রক্ষা আছে?
-হুহ। যাই বলো আর তাই বলো বাচ্চু। প্ল্যান বলি শোন। ইদানিং তোর মন টন ভালো না। আর আমি তো এই ভদ্রলোকের জ্বালায় আমি তো রীতিমতো গৃহবন্দী হয়ে আছি। তাই আমি একটা ব্রেক নিচ্ছি। সাথে তোমরাও আমার সাথে লম্বা একটা ব্রেক নিবে।
-মানে? ব্রেক নিচ্ছিস মানে? কোথায় যাবি?
-শুধু আমি যাবো না। আমরা যাবো দোস্ত। তুই, আমি আর আমার মিস্টার হিটলার--।
-আরু! ওকে--। কোথায় যাবি?
-উমমম। কক্সবাজার।
-আরু? তোর মাথা টাথা খারাপ হয়ে গেছে? এই তাওহীদ ভাই? আপনাকে ওকে কাল সকালেই সাইকিয়াট্রিস্ট দেখান। প্রেগন্যান্সির আট মাস চলছে। সে নাকি এখন কক্সবাজার যাবে--।
-ইচ্ছে করছে থাপড়ে তোকে লাল করে দেই বেদ্দপ ছেলে--। প্রমিস করে এখন পল্টি খাচ্ছিস--। এই তুমি বলো নিবে না তুমি?
তাওহীদ একবার আয়ানের দিকে একবার তাকাচ্ছে আর একবার আরিশার দিকে তাকাচ্ছে। বেচারা কি বলবে সেটাই বুঝতে পারছে না। আর তাওহীদের এমন ভ্যাবাচাকা খেয়ে চুপ করে থাকায় আরিশা এবার তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো।
-তার মানে তুমিও যাবা না তো? ওকে? এই আমি গেলাম--। তোমাদের দুজনের কারো সাথেই কথা নেই আমার--।
-আরে? কই যাও? আরু?
-তোমরা যতক্ষণ কক্সবাজার যেতে না হবে ততক্ষণ তোমাদের কারো সাথে কথা নেই। আর খাবোও না৷ ঘুমাবোও না--। আড়ি আড়ি আড়ি।
-আরে? আরিশা? শোনো?
আরিশা আইসক্রিমের বাটি আয়ানের সামনে ধপ করে রেখে দিয়ে বেডরুমে চলে গেল৷ তাওহীদ আর আয়ান দুজনেই মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। এবার কি করবে সেটাই গালে হাত দিয়ে ভাবতে বেসেছে দুজনে। এই মেয়ে যা জেদি এবার একে সামলাবে কি করে সেটাই আপাতত ভাবনার বিষয়।
এদিকে সকালে ঘুম ভাঙ্গার পর মায়রার হাতে ব্যথাটা আরো বেড়েছে। কোনমতে উঠে হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরে নাস্তা বানানোর কাজ শুরু করলো। রাতের কান্নার ছাপ যেন মামা মামি বুঝতে না পারে তাই হালকা একটু সাজগোজ করে তারপর কাজ করছে মায়রা৷ একটু পরেই মাথায় আলতো করে আদরের ছোঁয়া অনুভব করে মায়রা পিছনে ফিরতেই মামিকে দেখলো। মামা মামি দুজনেই কখন পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে সেটা একদমই টের পায়নি মায়রা৷ তাই দুজনকেই দেখে একটু হাসলো।
-কি রে মায়ু? এতো সকালে রান্নাঘরে কি করছিস?
-নাস্তা বানাচ্ছি মামনি--।
-সে তো দেখতেই পারছি-। তা ম্যাডামের ব্যাগ গোছানো কমপ্লিট?
-মামি--। আমি যাবো না---।
-একটা চড় লাগাবো বেয়াদব মেয়ে। যাবি না কেন হ্যাঁ?
-আমি আসলে--। উনার----।
-সীমান্ত কিছু বলেছে তোকে? বল?
-না মামনি---। উনি কিছু বলে নি। কিন্তু---।
-মায়ু---?
মায়রা আভার সামনে থেকে সরে যাওয়ার চেষ্টা করতেই আভা মায়রার হাত টেনে ধরতেই মায়রার গলা দিয়ে অস্ফুট চিৎকার বের হলো। মায়রা তাড়াতাড়ি নিজের মুখে হাত দিয়ে নিজেকে সামলে নিলো। আভা আঁতকে উঠে তাড়াতাড়ি মায়রার হাতটা আলতো করে ধরে মায়রার সামনে এসে দাঁড়ালো। আভা বেশ খানিকটা ভয় পেয়ে গেল মায়রার মুখের দিকে তাকিয়ে। মেয়েটার চোখে মুখে ব্যথা আর ভয় দুটোই দেখতে পেল আভা।।
-মায়রা? কি হয়েছে বল মামনিকে। কি হয়েছে?
-কিছু না মামনি। আমার যেমন কপাল--। কিছুই হওয়ার বাকি নেই।
-মায়রা----?
আভা কিছু একটা বলার চেষ্টা করতেই সীমান্ত আর সামিকে একসাথে আসতে দেখে চুপ হয়ে গেল। আভা সীমান্তের দিকে পা বাড়ানোর আগেই মায়রা আভার হাত ধরে আটকে ফেললো। আভা মায়রার মুখের দিকে তাকাতেই কাকুতিভরা চাহনি দেখে থমকে গেল। ততক্ষণে সীমান্ত আর সামি ডাইনিং টেবিলে এসে বসেছে দেখে আভাও চুপচাপ মায়রাকে নাস্তা বানানোয় হেল্প করা শুরু করলো। সামি সীমান্তের সাথে এটা ওটা নিয়ে কথা বলছে আর মাঝে মাঝে মায়রা আর আভার দিকে তাকাচ্ছে। কিছু একটা ভেবে সামি মায়রাকে ডাক দিলো।
-কি রে মায়রা? রেডি হস নি যে এখনো? ব্যাগ গুছিয়েছিস?
-মামা আসলে----। আমি যাবো না।
-আভা? তোমার মেয়ে আজকাল একটু বেশিই কথা বলছে না? ওর কাছে কি আমরা পারমিশন চেয়েছি?
-মামা? প্লিজ শোনো না?
-তোমার হাসবেন্ডকে কেউ চুরি করে নিয়ে যাবে না মা।
-মামা?
-শোন মায়রা। সকাল সকাল বের হবো। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে। নইলে ব্যাগ ট্যাগ গোছানোর সময় টময় দিতে পারবো না। সোজা তুলে নিয়ে যাবো চট্টগ্রাম। তারপর দেখবো কি করে এমন লাফাস তুই---। সীমান্ত তুমিই ওকে বোঝাও তো বাবা। তোমার যেখানে সমস্যা নেই সেখানে ওর কিসের সমস্যা?
সামির কথাটা শুনে সীমান্ত মুখ তুলে তাকাতেই মায়রার সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল। মায়রা কিছু না বলে চোখ সরিয়ে নিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। সীমান্ত একটু ইতস্তত করে সামির দিকে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করলো।
-আম--। মায়রা তুমি যাচ্ছো না কেন? মামা মামি এতো করে বলছে--।
মায়রা এক দৃষ্টিতে সীমান্তের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। কিচ্ছু বললো না। শুধু ওর চোখেমুখে একটা চাপা ক্ষোভ খেলা করে গেল। সেটা সীমান্তের চোখে যেমন পড়লো, তেমনি সামি বা আভা কারোরই চোখ এড়ালো না।
-দেখলি তো? সীমান্তেরও কোনো আপত্তি নেই। সো তোর এমন আজাইরা 'যাবো না' কথাটা চলবে না। আর তাছাড়াও আরেকটা জরুরি খবর আছে।
-কি?
-আগামী সপ্তাহে তোদের ব্যাচমেটদের একটা গেট টুগেদার আছে। সেখানে তো যাবি নাকি?
মায়রা কি বলবে ভেবে না পেয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। সীমান্ত এবারে এক গাল হাসি দিয়ে মায়রার দিকে তাকালো।
-মায়রা তুমি ব্যাগ গুছিয়ে রেডি হয়ে নাও। উনারা এতো করে বলছে যখন-। আমি গিয়ে নিয়ে আসবো তোমাকে--। টেনশন করতে হবে না--।
-এবার তো শান্তি মায়ু? তুই রেডি হ। যা। আমি এদিকটা সামলাচ্ছি। তাড়াতাড়ি কর। বাঁধনটা একা বাড়িতে---। কালই চলে যাওয়ার কথা ছিল আমাদের--।
মায়রা আরেকবার সীমান্তের দিকে তাকিয়ে রুমে চলে গেল। ব্যাগ গোছাতে গোছাতে চোখ দিয়ে টুপটুপ করে অশ্রু বৃষ্টি ঝরছে মেয়েটার। একটা মানুষ ঠিক কতো রকমের রঙ বদলাতে পারে সেটা মায়রার জানাই ছিল না। হয়তো সীমান্তকে না দেখলে জানতেই পারতো না মানুষ এতোটাও নিচ আর কুটিল হতে পারে। এসব ভাবতে ভাবতেই ব্যাগ গোছানোয় মন দিয়েছে মায়রা। আজও একবার এই বন্দিশালাটা থেকে মুক্তি পাবে ও। কিন্তু সেটা কয়দিনের জন্য কে জানে?
২২!!
দেখতে দেখতে বেলা বাড়ছে। আর রোদের সাথে পাল্লা দিয়ে বাসের গতিরও তারতম্য ঘটছে। কখনো জ্যামে আটকা পড়ে পা টিপে টিপে লাজুক কিশোরীর মতো এগুচ্ছে বাসটা। আবার কখনো ফাঁকা রাস্তায় দুরন্ত বালকের মতো ছুটছে। কিন্তু মায়রার এসব নিয়ে বিন্দুমাত্রও যেন মাথাব্যথা নেই। বন্দীশালা থেকে বেরিয়ে খোলা আকাশের নিচে এসে আজ নিজেকে একদম হালকা লাগছে মায়রার। দূরের বড় বড় গাছ, বিশাল নদী, খোলা আকাশ সব কিছুরই ঘ্রাণ নিচ্ছে অন্যমনস্ক হয়ে। সব কিছুই যেন ওর নাগালের মাঝেই, শুধু হাত বাড়িয়ে ছোঁয়া যায় না এই স্বাধীনতাটুকু। মুক্ত সবুজ ওকে হাত বাড়িয়ে আগলে রাখতে চাইছে ঠিকই, কিন্তু ও যে পায়ে বন্দিত্বের শৃঙ্খলে জড়িয়ে পেঁচিয়ে বিশ্রিভাবে ফেঁসে গেছে। এই শিকল ছিঁড়ে না মেয়েটা যেতে পারছে, না শিকল থেকে মুক্তি পাচ্ছে। ক্ষণিকের এই স্বাধীনতাটুকু যে ওর জন্য পরিহাস ছাড়া আর কিছু নয় সেটা মায়রার মনে বন্ধমূল হয়ে বসে গেছে। তাই প্রকৃতির এতোটা কাছে থেকেও তার থেকে হাজারো ক্রোশ দূরে ওর মন। প্রকৃতির এই অপার সৌন্দর্য ওর মনকে কিছুতেই সতেজ করে রাঙিয়ে তুলতে পারছে না। হয়তো কখনো আর রাঙাতে পারবেও না।
বাসের জানলার কাঁচে মাথা হেলিয়ে দিয়ে দূরে তাকিয়ে থাকলেও চোখের সামনে সকালবেলার সীমান্তের ভাবলেশহীন মুখটা ভেসে আছে। লোকটার রাতের নিষ্ঠুর মুখটা যতটা সত্য ছিল, সকালেই সবার সামনের ভালোমানুষির এই মুখোশটা ঠিক ততটাই মিথ্যে। সামি আর আভার জোরাজুরিতে মায়রার আর কিছুর সুযোগ নেই দেখে সীমান্ত নিজেই মায়রাকে যাওয়ার কথা বলেছে। তাই মায়রা ড্রেস চেঞ্জ করে ব্যাগ গোছানোর সময় সীমান্ত দাঁড়িয়ে ছিল পাশে। 'সাবধানে থেকো, নিজের খেয়াল রেখো, তাড়াতাড়ি নিয়ে আসবো' এসব বলছে সীমান্ত। মায়রা পুতুলের মতো 'হু, হ্যাঁ' করছে আর নিচের দিকে তাকিয়ে নিজের কাজ করছে। সীমান্তের এই অল্পক্ষণের ভালোমানুষীর নাটকটা অসহ্য লাগছে ওর। এর চেয়ে হয়তো লোকটার রাতের হিংস্র চেহারাটাই ভালো। অন্তত সেটা লোক দেখানো নয়৷ আসার সময় মায়রাকে বেশ কিছু টাকাও দিয়ে দিয়েছে সীমান্ত। মায়রা সেটাতেও প্রতিবাদ করে নি। যদিও স্বামী নামে এই মানুষটার একটা পয়সার প্রতিও ওর আকর্ষণ নেই বিন্দুমাত্রও৷ তবু কিছু বললো না। শুধু লোকটার ভালো সাজার নাটকটা চুপ করে দেখলো। কে বলবে এই লোকটাই সবার আড়ালে মায়রার সাথে জানোয়ারের মতো ব্যবহার করে!
হঠাৎ কাঁধে কারো হাতের স্পর্শে মায়রা জানলা থেকে মুখ তুলে পাশ ফিরলো।
-হুম মামনি। কিছু বলবে?
-মন খারাপ করে আছিস কেন মায়ু? তুই আমাদের সাথে যাচ্ছিস সেটার জন্য কি মন খারাপ?
-মামনি! এটা বলতে পারলে তুমি?
-তাহলে মুখ এমন কালো করে বসে আছিস কেন? কি এতো ভাবছিস?
-ভাবছি তোমাদের সাথে তো যাচ্ছি-। কিন্তু সেই তো আমাকে ফিরতেই হবে। আজ হোক, কাল হোক, বা এক সপ্তা পরেই হোক। ঘুরে ফিরে তো ওই লোকটার কাছেই আসতে হবে---।
-মায়রা? তোর হাতে কি হয়েছিল? তখন তো সীমান্তকে দেখে আর জিজ্ঞেস করতে পারলাম না--। কিভাবে ব্যথা পেলি? এমনিতেই কতোটা পুড়েছিস হাত। আবার হাতে ব্যথা পেলি কি করে?
-----আসলে মামনি---।
-বল কি হয়েছিল?
-কি আর হবে? আমি তোমাদের সাথে যাবো সেটাইবা কম দোষের নাকি বলো?
-সীমান্ত তোর গায়ে হাত তুলেছে?
মায়রা অনেক কষ্টে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে আবার জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালো। চোখ জোড়া ছলছল করায় বাইরের প্রকৃতিও যেন কেঁপে কেঁপে উঠে ফোঁপাচ্ছে। আভা এক মূহুর্তের জন্য থমকে গিয়েছিল। কি বলবে এতোক্ষণ খুঁজে না পেয়ে অবাক হয়ে মায়রার দিকে তাকিয়েছিল। এবারে একটু ধাতস্থ হয়ে মায়রার চুলে হাত রাখলো আভা।
-মায়ু? কবে থেকে চলছে এসব? আর তুই কাউকে কিছু বলিস নি কেন?
-মাকে তো বলেছিলাম। কি বলেছে জানো? বলেছে এমন ছোটখাটো রাগারাগি, কথা কাটাকাটি, মন কালাকালি সব সংসারেই হয়। আর আমি নাকি নিজেই ওই লোকটার সাথে মানিয়ে নেয়ার সামান্য চেষ্টাটুকুই করছি না। আর ও আর ওর পরিবার এতো মহান তাই আমাকে দয়া করে তাদের পরিবারে ঠাঁই দিয়েছে---। এসব শোনার পরও আবার----।
-সাহেলা আপা এসব বলেছে তোকে! তুই আমাকে বলিস নি কেন!
-বাদ দাও না মামনি--। আমার কপালটাই খারাপ--। তাই আজীবন ভোগ তো করতেই হবে---।
-চুপ থাক তো। কি আছে কপালে, কি ভোগ করতে হবে না হবে সেটা পরে দেখা যাবে--। আপাতত এসব ভাবিস না--। নিজেকে নিয়ে ভাব। তোর লাইফটাকে নতুন করে শুরু কর।
-আর নতুন করে শুরু!!
-এখন এসব ভাবিস না। আগামী সপ্তাহে তো প্রোগ্রাম। সেটায় কি পড়বি, কার কার সাথে দেখা হবে, কতো মজা হবে সেসব ভাব--।
-হুম---।
-একটু রেস্ট কর। ভালো লাগবে।
-জি মামনি---।
মায়রা এবার বাসের জানলার সাথে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বুজলো। বড্ড ঘুম এসে বাসা বেঁধেছে ওর ক্লান্ত চোখ জোড়ায়। ক্লান্তিটা জীবনের প্রতি নাকি নিজের নিয়তির প্রতি সেটা মায়রা জানে না। তবু মনে হচ্ছে অন্তত কয়েক দন্ডের জন্য যদি এই বিস্বাদের জীবনটা থেকে মুক্তি পাওয়া যেত!
এদিকে সকাল থেকে আরিশার রুমের দরজায় নক করতে করতে এবারে কিছুটা ভয়ই পেয়ে গেছে আয়ান আর তাওহীদ। রাতে আরিশা রাগ করে চলে আসার পর তাওহীদ আরো কিছুক্ষণ আয়ানের সাথে কথা বলে আসার পর দেখলো বেডরুমের দরজাটা ভেতর থেকে লক করে রেখেছে আরিশা। তাওহীদ একবার নক করলো। কিন্তু আরিশা দরজা খুলছে না দেখে আর ডাকে নি। ভেবেছে হয়তো ঘুমিয়ে গেছে মেয়েটা। তাওহীদও আর টেনশন না করে ড্রইংরুমের সোফায় শুয়েই রাতটা কাটিয়ে দিয়েছে। কিন্তু সকালে এতোক্ষণ ধরে দরজা নক করার পরও যখন আরিশার দরজা খোলার নাম নেই তখন সত্যিই ভিষণ চিন্তা হচ্ছে তাওহীদের। তাওহীদের দরজার নকের শব্দে আয়ানও এসে আরিশাকে ডাকছে। কিন্তু রুমের ভিতর থেকে একটা টু শব্দও পাওয়া গেল না। এবারে আয়ান নিজেও একটু ভয় পেল। আরিশার কিছু হয়েছে কিনা সেটা নিয়েই ওদের টেনশন হচ্ছে বেশি। একবার তাওহীদের দিকে তাকিয়ে আয়ান আবার দরজায় নক করলো।
-আরু? আরিশা? দরজাটা খোল প্লিজ? তুই শুনতে পাচ্ছিস? আরু?
-ভাই ওর কিছু হলো না তো?
-টেনশন করবেন না তাওহীদ ভাই। আমি দেখছি--। এই আরিশা? চড় খাবি কিন্তু এভাবে চুপ করে থাকলে। দরজা খোল?
-----------------------
আয়ান কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে কিছু একটা ভাবলো। তারপর আবার দরজায় ধাক্কা দিলো।
-আরু? দরজাটা খোল। আমি তোর সব শর্তে রাজি। যেখানে যেতে চাস নিয়ে যাবো-। যত দিনের জন্য চাস যাবো--। হ্যাপি? এবার দরজাটা খোল প্লিজ? তোর পায়ে পড়ি বোন। আর টেনশন দিস না---।
আয়ানের কথাটা শেষ করার ঠিক এক মিনিটের মাথায় দরজাটা সটান করে খুলে গেল। আর আরিশাও গিয়ে টুপ করে বিছানায় বসে পড়লো। তাওহীদ আর আয়ান দুজনেই এতোটা হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল যে কয়েক মিনিট কথাই বলতে পারলো না। হুঁশ হতেই দুজনেই রুমে ঢুকলো। এতোক্ষণে তাওহীদের টেনশনটা কমতেই বেশ রাগ হলো আরিশার উপরে। সোজা এসে আরিশার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। আরিশা তাওহীদের রাগে লাল হয়ে যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে একগাল হাসি দিলো। ফলে তাওহীদের রাগটা দ্বিগুণ হয়ে গেল।
-পাগল হয়ে গেছ তুমি? এভাবে টেনশন দিয়ে মজা পাচ্ছো তাই না খুব? এদিকে আমার কি হাল হয়েছিল একবারও ভেবেছ? এভাবে জেদ করে ব্ল্যাকমেইল করার কি কোন দরকার ছিল আরু? বলো?
আরিশা মুখ বাঁকিয়ে বিছানায় ভালো করে হেলান দিয়ে পেটে হাত ছুঁইয়ে দিয়ে মুখ কালো করে বসে রইলো। তাওহীদের রাগটা কমতেই নিজেকে সামলে নিলো। আরিশার পাশে ফ্লোরে হাঁটু মুড়ে বসে আরিশার হাতে হাত রাখলো। আরিশা তাওহীদের দিকে না তাকিয়েই হাতটা ঝটকা দিয়ে সরিয়ে দিলো। আয়ান দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এদের দুজনের মান অভিমান দেখে হাসলো। তাওহীদ এবার আলতো করে আরিশার আঙুলে নিজের আঙুলগুলো চেপে ধরলো।
-এই আরু? শোনো না? সরি তো-।
আরিশা আবার মুখ বাঁকিয়ে নিজের হাতটা ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু সফল হলো না। তাই নিজের মনেই কথা বলা শুরু করলো।
-একজন বলছে আমি পাগল। আরেকজন বলেছে চড় লাগাবে-। একে তো ঘরে বন্দি করে রেখেছে তার উপরে বলছি ঘুরতে যাবো তাও দিচ্ছে না--। মনে হচ্ছে আমি মানুষ না--। কারো সাথেই কথা নেই আমার---।
আয়ান এবারে হেসে আরিশার মাথায় একটা গাট্টা মারলো ছোট্ট করে।
-তোকে সত্যি সত্যিই দুটো লাগালো দরকার--। কি ড্রামা কুইনরে বাবা!তিনি নিজের কথা মানানোর জন্য নাটক করে দরজা আটকে চুপটি করে বসে আছে--। আর এদিকে আমরা দুই নিরীহ প্রাণী টেনশনে মরছি।
-বেশ হয়েছে--। হুহ---।
-ওকে মেরি মা--। আপনি যা চাইবেন তাই হবে--। তবে এখন নয়।
-হুহ--। তো কি আমি মরলে নিয়ে যাবি?
-আরু? কিসব বলছিস? এবার সত্যি সত্যি থাপ্পড় খাবি বলে দিলাম।
-হুহ--।
-কিছুদিন তো সময় লাগবে--। অফিসে কাউকে কাজগুলো বুঝিয়ে দিতে হবে-। ট্যুরের প্ল্যানিং করতে হবে। সময় লাগবে না বল?
-সত্যি যাবি?
-হুম--। নইলে তো তোর অত্যাচার বেচারা তাওহীদ ভাইয়ের অবস্থা কাহিল হয়ে যাবে---।
-অসভ্য ছেলে--। যা। তোর যেতে হবে না। কারোই যেতে না। আমিও যাবো না--।
-ওরে ড্রামাবাজ! এবার তুই যেতে না চাইলে তোকে বেঁধে নিয়ে যাবো। এই সপ্তাহে না পারলেও পরের সপ্তাহে শিউর যাচ্ছি আমরা--। হ্যাপি এবার?
-সত্যি!!
আরিশা এতোক্ষণে খেয়াল করলো আয়ান আর তাওহীদ দুজনেই ওর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। বেচারি এবারে ভিষণ লজ্জা পেল। আর ওর লাজুক রাঙা মুখটা দেখে আয়ান আর তাওহীদ ওকে আরো খেপাচ্ছে আর হাসছে। এতো কিছুর মাঝে আরিশার মনে হচ্ছে। আয়ানের মুখে অন্তত আগের সেই হাসিটা তো ফিরিয়ে আনতে পেরেছে। এবার নিশ্চয়ই স্বাভাবিক একটা জীবন ফিরে পাবে ছেলেটা। এটা ভেবেই একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে পারছে আরিশা।