!!৪৩!!
"তুমি তাহলে ব্যান্ডেজ করা শেষ হলে বাসায় চলে যেও এশা। আমার একটু জরুরি কাজ আছে।"
ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে এশার হাতের কাটা অংশ ব্যান্ডেজ করা হচ্ছে। চোখ মুখ কুঁচকে রেখেছে মেয়েটা। পাশে রেজওয়ান। এশা আদোও রেজওয়ানের কথা শুনেছে কিনা সন্দেহ। কাটা স্থানটায় স্যাবলন লাগাতেই এক চিৎকার দিলো সে। সহ্য করতে না পেরে কেঁদেই দিলো এবার। নার্স রুনা বিরক্ত হলেন। এমন চিৎকার, চেঁচামেচি করা রোগী তার বড্ড অপছন্দ। পাশে ইউনিফর্ম পরনে পুলিশ দেখে চেয়েও ধমক দিতে পারছেন না তিনি। তাই নরম গলায় বললেন,
"এতো চিৎকার করবেন না।"
এশা তার টানা টানা ছলছল চোখে একবার তাকালো রেজওয়ানের দিকে। তার চোখগুলো যেন চিৎকার করে বলছে,
"এই পুলিশ একটু আমার হাত ধরলে কি হয়! একটু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে কি হয়!"
মুখে নিস্তব্ধতা। রেজওয়ান তখন ফোনে ব্যস্ত। চোখ তুলে তাকানোর আগেই এশা নিজের চোখ ফিরিয়ে নেয়। এক তরফা ভালোবাসায় সত্যিই অনেক কষ্ট। নিরবে চোখের পাশ ঘেঁষে বেয়ে পড়ে অশ্রু। এই অশ্রুর মূলে কে? হাতে জ্বালা নাকি রেজওয়ান? নার্স ব্যান্ডেজ করে চলে গিয়েছেন। ছোট বেডটায় বসে এশা। হাঁটু বিস্তৃত চুলগুলো এলোমেলো।
"চলো তোমাকে রিকশা করে দিই।"
এশা কোনো প্রতুত্তর করলোনা। মনে কথা কি মুখে বলা যায়? হাসপাতালের গেটের সামনে থেকে এশাকে রিকশা করে দিলো রেজওয়ান। রিকশায় উঠে মাথা নিচু করে বসে রইলো এশা। রেজওয়ান ভাড়াটা মিটিয়ে দিয়ে বললো,
"এখন জরুরি কাজ আছে আমার। নয়তো আমিই দিয়ে আসতাম তোমাকে। আর ছিনতাইকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবো আমি। তুমি চিন্তা করোনা।"
"আচ্ছা।"
অভিমান ভাঙলো তবে। এই কয়েকটা লাইনই মন ভরিয়ে দিলো যেন। মুচকি হাসিটা বিস্তৃত হলো ঠোঁটে। শ্যামল মায়াবতীর রূপ দেখার জন্য রেজওয়ানের সময় কই? সে তো তার প্রাণপাখিতে মত্ত!
"কই আমার মাইয়া কই? আল্লাহ গো।"
চৈতির ফুফুর আহাজারিতে হাসপাতাল কেঁপে উঠছে। চৈতির বাবা জামান সাহেব অসুস্থ মানুষ। চেয়ারে চুপ করে মাথা নিচু করে বসে আছেন তিনি। রেজওয়ান প্রথমে একটু থতমত খায়। চৈতির ফুফুর এহেন আচরণ ও আশা করেনি। যতদূর জানতো চৈতির ফুফু তো চৈতিকে সহ্যই করতে পারেনা। আর এখন এমন দেখাচ্ছে যেন চৈতি উনার নিজেরই মেয়ে। রেজওয়ান বসলো জামান সাহেবের পাশে। আস্তে করে বললো,
"চাচা।"
মাথা তুললেন জামান সাহেব। চোখ দুটো গর্তে ডেবে আছে। রোগা, ফর্সা শরীর। বড় দাঁড়ি। এককালে এই লোক অনেক সমৃদ্ধশালী ছিলেন দেখেই বুঝা যায়। রেজওয়ানের হাতে দুটো ফাইল। ফাইল খুলে একটা সদ্য তোলা ছবি দেখালো সে। একটা নুপুরের ছবি। সাদা গোল্ডের নুপুর। শুধু একটা চিকন চেন। একপাশে একটা লাভ আকৃতির ডিজাইন। ছবিটার দিকে শব্দহীন কয়েক পলক চেয়ে রইলেন জামান সাহেব। অতঃপর দু'হাতে মুখ ঢেকে নিরবে অশ্রু ঝড়ালেন তিনি। রেজওয়ান জিজ্ঞেস করলো,
"চাচা, নুপুরটা কি চৈতির?"
জবাব না দিয়ে মাথা নাড়লেন জামান। নিজেকে সামলিয়ে সিক্ত গলায় বললেন,
"নুপুর টা আমার চৈতির। আমিই উপহার দিয়েছিলাম।"
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো রেজওয়ান। সে বুঝতে পারছে জামান সাহেবের মন অবস্থা ভালোনা। কিন্তু কিছু কথা না জিজ্ঞেস করলেই নয়।
"আপনার শেষ কবে কথা হয় চৈতির সাথে?"
"বিশ কি বাইশ দিন আগে।"
"ঠিক আছে। আপনি বসুন। কিছুক্ষণের মাঝেই ডিএনএ টেস্ট করার জন্য ডাকা হবে আপনাকে।"
"আমার চৈতি? আমার চৈতির কি হয়েছে ইন্সপেক্টর সাহেব?"
!!৪৪!!
অসহায় বাবার আকুতিতে কিছুই বলতে পারলোনা রেজওয়ান। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
"আপনি বসুন। আমি আসছি।"
চৈতির ফুফু রেহানা। নিজের মতো বিলাপ করেই যাচ্ছেন। দোষগুলো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তিনি মাহার কাঁধেই ফেলতে চাচ্ছেন। রেজওয়ান মহিলার বিলাপে কর্ণপাত না করে বেরিয়ে এলো।
দুতালায় যাওয়া প্রয়োজন। এশাকে রিকশায় তুলে দিয়ে আসার সময়ই চৈতির ফুফু আর বাবার সাথে দেখায় হয়ে গিয়েছিলো রেজওয়ানের। এতোটা সময় হয়ে গেছে! এত চেষ্টা করেও দুতালায় যাওয়ার সুযোগ পেলোনা সে।
ঘুমিয়ে আছে মাহা। রেজওয়ান ঘুমন্ত মাহার নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে। মেয়েটা এত মোহনীয় কেন? সার্থক ইনজেকশন নিয়ে ভিতরে ঢুকে বিরক্ত চোখে রেজওয়ানের দিকে তাকালো। মিঃ রেজওয়ান কেন এভাবে তার অলকানন্দার দিকে তাকিয়ে থাকবেন? কেন? বুকে জ্বালাময়ী অনুভূতি অনুভব করছে সার্থক। সেও কি তবে হিংসুটে হয়ে গেলো?
"মিঃ রেজওয়ান?"
একধ্যানে মাহার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলো রেজওয়ান। সার্থকের ডাকে ধ্যান ভাঙে তার। কিছুটা বিব্রতবোধ করছে সে। বিব্রতবোধ কাটাতে হালকা হেসে বলে,
"ডক্টর ফায়রাজ, মাহার কি অবস্থা এখন?"
মাহার কাছে এগিয়ে আসে সার্থক। একটা অধিকারবোধ থেকে হাত ধরে তাতে ইনজেকশন পুশ করে। তুলা দিয়ে স্থানটায় হালকা ঘষে বলে,
"পেশেন্ট মানসিক ট্রমার ভিতর আছেন। চৈতি মেয়েটার মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না সহজে। নিজেকে অপরাধী ভাবছেন। যার ফলস্বরূপ প্রেশার হাই হয়ে উন্মাদের মতন আচরণ করছেন তিনি।"
"আমারই ভুল ডক্টর ফায়রাজ। আমার ওকে মর্গে নিয়ে যাওয়া ঠিক হয়নি।"
"আমরা যারা প্রতিনিয়ত এসব দেখে আসছি তারা যত সহজে জিনিসটাকে গ্রহণ করতে পারবো একজন সাধারণ মানুষ তা পারবেনা মিঃ রেজওয়ান। আমার মনে হচ্ছে পেশেন্টের এসবের উপর ভয়ানক রকমের ফোবিয়া আছে।"
রেজওয়ান আর কিছু বললোনা। একবার তাকালো মাহার ঘুমন্ত মুখপানে। সার্থক নিজের রাগ চেপে গেলো। মেয়েটাকে একবার নিজের করে পেলে হৃদয়ের ভিতরে রেখে দিবে। যেন অন্য কেউ তাকে ছুঁতে না পারে, দেখতে না পারে।
"ভিক্টিমের পরিবারবর্গ এসেছে কি ইন্সপেক্টর রেজওয়ান?"
আবার ধ্যানে ব্যাঘাত ঘটে রেজওয়ানের। এবার কিছুটা বিরক্ত হয় সে। সার্থক আর রেজওয়ানের মাঝে একটা সূক্ষ্ম দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে গেছে। দুজন দুজনের উপরে বিরক্ত। শুধু প্রকাশে নমনীয়তা।
"জ্বি। ভিক্টিম চৈতির বাবার ডিএনএ টেস্ট করা হবে।"
নিরবতা। দুজনই অপরজনের উপস্থিতি পছন্দ করছেনা। ঘুমন্ত মাহার মুখপানে একমনে তাকিয়ে থাকতে চাচ্ছে। নিজের প্রেয়সীর সাথে একান্তে সময় বিনিময় করতে চাচ্ছে। অঘোষিত লড়াইয়ে কে হবে বিজয়ী?
কেটে গেলো সহস্র সময়। ফোন বেজে উঠলো রেজওয়ানের। মোবারক ফোন করেছেন। ফোন হাতে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাইরে বেরিয়ে গেলো সে।
ঈষৎ হাসলো সার্থক। এগিয়ে গেলো মাহার পাশে। ধপ করে বসে পড়লো পাশের চেয়ারটায়। হাত বুলিয়ে দিলো মাহার মাথায়।
"তুমি তো একান্তই আমার।"
!!৪৫!!
"বলুন, মিঃ মোবারক।"
"মিঃ রেজওয়ান, আমি টিম নিয়ে সিলেটের পথে বেরিয়ে পড়েছি। শাওনের কথা ছিলো সিরিয়াল কিলার মাতব্বর শরীফ এর সাথে জেলে গিয়ে কথা বলার।"
"পারমিশন নিয়েছেন?"
"প্রলয় স্যারের পারমিশন নেওয়া হয়েছে। তবে বিপত্তি অন্য জায়গায়?"
"একটু খুলে বলুন মিঃ মোবারক।"
"শাওন এই কেসটায় আমাদের সাথে থাকতে পারবেন না মনে হচ্ছে। উনার ওয়াইফ সন্তান সম্ভবা। কিছুদিনের ছুটি নিতে চাচ্ছেন।"
"উনি কথাটা প্রলয় স্যারের সামনে বলেন নি কেন?"
"স্যারকে সবাই ভয় পায়। বুঝতেই তো পারছেন।"
"এখন করনীয়?"
"মিস তাজ আমাদের সাথে যোগ দিবেন।"
"কথাটা কি স্যারকে জানানো হয়েছে?"
"না, এজন্যই আপনাকে কল করা। আপনি কি কাইন্ডলি স্যারকে একটু রাজি করাতে পারবেন?"
বিরক্ত হলো রেজওয়ান। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে বাইরে। ডুবন্ত সূর্যের দিকে তাকিয়ে রেজওয়ান বললো,
"আমি বললে জিনিসটা খারাপ দেখায় ইন্সপেক্টর মোবারক। এসপি স্যার খুবই ভরসা করে আমাদের তিনজনকে নিযুক্ত করেছেন। তাছাড়া বিপদটা কত গভীর সেটা হয়তো আপনিও উপলব্ধি করতে পারছেন। আমরা এখন রুখে না দাঁড়ালে পুনরায় ২০১২ দেখতে হবে আমাদের। হাহাকার, আহাজারি থাকবে চারপাশে।"
"বুঝতে পারছি মিঃরেজওয়ান। তবে কাইন্ডলি আপনি যদি স্যারকে বলে দেন। তাহলে স্যার শাওন কে ছুটি দিবেন। উনার ওয়াইফের কন্ডিশন ভালোনা। বিদেশ নেওয়া প্রয়োজন। মিস তাজ তো দক্ষ পুলিশ অফিসার। আপনি একটু বিষয়টা দেখেন মিঃ রেজওয়ান।"
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো রেজওয়ান। অতঃপর বললো,
"ঠিক আছে। আমি দেখছি।"
জুনিয়র অফিসার প্রদীপকে কল করলো রেজওয়ান,
"হ্যালো, প্রদীপ?"
"ইয়েস স্যার।"
" ডিএনএ টেস্ট করা শেষ হয়েছে?"
"না, স্যার। সময় লাগবে। ভিক্টিমের পরিবার আপনার সাথে দেখা করতে চাচ্ছে।"
"ঠিক আছে। আমি আসছি।"
রেহানার আহাজারি কমেছে কিছুটা। রেজওয়ান কে দেখে দাঁড়িয়ে গেলেন তিনি।
"ঐ মাইয়া কই, স্যার?"
"কোন মেয়ে?"
"যার জন্য আমার চৈতি মরলো। মাহা?"
রেহানাকে ধমক দিলেন জামান।
"কি শুরু করলি রেহানা? চুপ কর।"
"ভাইজান, আপনে আমারে চুপ করতে বলেন? আপনে তো নিজেও জানেন চৈতি ঐ মাইয়ার লগেই সিলেট গেছিলো। সব দোষ ঐ মাইয়ার ভাইজান। আমি ছাড়তাম না। কেস করমু। ক্ষতি পূরণ চাই আমার। কত বড় ক্ষতি হইয়া গেলো ভাইজান?"
বলে আবারও কান্নায় ভেঙে পড়লেন তিনি। এতক্ষণে রেজওয়ানের কাছে বিষয়টা স্পষ্ট হলো। চৌকস মস্তিষ্ক বুঝে গেলো ক্ষতিপূরণ পাওয়ার লোভেই এই নাটক তবে। গম্ভীর সুরে সে জিজ্ঞেস করলো,
"আপনি এতটা সিউর কি করে যে মাহা এর সাথে যুক্ত?"
ভড়কালেন রেহানা। ভীতু চেহারায় বললেন,
"মানে?"
"মানে আপনি হয়তো যুক্ত আছেন কাজটার সাথে। মাহা যদি কিছু করে থাকে তাহলে মাহার সাথে আপনিও যুক্ত আছেন।"
"কিসব আবোল তাবোল বলছেন স্যার! আমি কেমনে যুক্ত থাকবো?"
"এখন আবোল তাবোল লাগছে কেন? আপনি তো পুলিশ না তাহলে আপনি বুঝলেন কি করে অপরাধী কে? ধরাই যায় আপনিও অপরাধী?এইজন্যই সবটা জানেন। অপরপক্ষের সাথে মনোমালিন্যের কারণে দায় চাপাতে চাচ্ছেন।"
স্তব্ধ হয়ে গেলো রেহানা। বুঝতে পারলো চৌকস লোকের সামনে সে নিতান্তই শিশু। সব আহাজারি বন্ধ হয়ে গিয়েছে তার। রেজওয়ান আর কথা বাড়ালোনা। এগিয়ে গিয়ে জামান সাহেবের পাশে বসলো আবারো।
________________
ঘুমের মাঝে মনে হচ্ছে একটা শক্ত হাত। একটা শক্ত হাত গলা চিপে ধরেছে মাহার। সে চিৎকার......
.
.
.
চলবে...........................