৪৫!!
গত কয়েকটা মাস ধরে আয়ান আবার প্রজেক্ট নিয়ে ব্যস্ত। প্রজেক্ট সাবমিটের দিন যত এগিয়ে আসছে ততই কাজের চাপ যেন বাড়ছে আয়ানের। সাথে টেনশনটাও। কিছু না কিছু ঝামেলা লেগেই আছে প্রজেক্টটায়। সেসব সামলাতে গিয়ে বাসায় ফিরতে ফিরতে বেশ অনেক রাতই হয়ে যায় আয়ানের। মায়রার সাথে মুখোমুখি বসে কথা বলার সময়টুকুও বের করতে পারছে না বেচারা। এদিকে মায়রাকেও ইদানিং বেশ টায়ার্ড দেখাচ্ছে। আয়ান ফিরতে ফিরতেই মেয়েটা ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে যায় প্রায়ই। সারাদিন পর বাসায় ফিরলে আরো বেশি ক্লান্ত চেহারা দেখে মায়রার। কিছু বললেও শোনে না মেয়েটা।
আয়ান আজও বাসায় ফিরতে বেশ অনেক রাতই হয়ে গেল। মায়রা ডাইনিং টেবিলে আয়ানের জন্য খাবার নিয়ে বসে আছে। আয়ান ফিরতেই খাবার গরম করে প্লেটে বাড়তে শুরু করেছে মায়রা। আয়ান ফ্রেশ হয়ে এসে মায়রাকে টেনে পাশে বসিয়ে নিলো নিজের পাশে। মেয়েটার চোখ মুখ আরো শুকনো লাগছে। মায়রা আয়ানের দিকে তাকিয়ে একটু লাজুক হাসলো। আয়ান মায়রার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে খাবার তুলে দিলো মায়রার মুখের দিকে। মায়রা কিছু না বলে চুপচাপ খাচ্ছে।
-আপনাকে কি বলা হয়েছিল ম্যাডাম? বলেছি না আমার ফিরতে দেরি হলে খেয়ে নিবা? আর কখনো রাতে না খেয়ে ঘুমাবা না---।
-খাই তো-----।
-তাই নাকি? কাল রাতে খেয়েছিলে?
-উমমমম-। মনে নেই। খেয়েছি মনে হয়---।
-পরশু?
-মনে পড়ছে না--।
-তার আগের দিন?
-আমমম--। ওই দিন তুমিই খাইয়ে দিলে---।
-বাহ! সেটা তো ঠিকই মনে আছে। এর মানে গত দু রাত তুমি না খেয়েই ঘুমিয়ে গেছ?
-আরে? না মানে--।
-আজকে তোমার হচ্ছে দাঁড়াও--।
-শোনো না?
আয়ান চোখ গরম করে তাকাতেই মায়রা আর কিছু বললো না। চুপচাপ খেয়ে নিল। আয়ানও মায়রাকে খাইয়ে দিয়ে নিজেও খেয়ে নিল। দুজনে মিলে প্লেট বাটিগুলো রান্নাঘরের বেসিনে রেখে আয়ান মায়রাকে জোর করে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে রুমের দিকে হাঁটা ধরলো। মায়রা একটু হাত পা নাচিয়ে নামার চেষ্টা করলো।
-এই? বাসনগুলো একটু ধুয়ে রাখতে হবে।
-আর একটাও কথা বলবা টুপ করে ফেলে দিবো একেবারে---।
-এই না না না--।
মায়রা আর কিছু না বলে শক্ত করে আয়ানের গলা জড়িয়ে ধরলো। আয়ান রুমে এসে মায়রাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে নিজেও পাশে শুয়ে পড়লো। মায়রা একটু সাহস করে এসে আয়ানের বুকের কাছে ঘেঁষে আসলো। সামনের দিকে তাকাতেই দেখলো আয়ান এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
-এভাবে কি দেখছ?
-আমি সময় পাচ্ছি না বলে কি নিজের খেয়াল রাখা যায় না মায়রা? নিজের কি হাল করেছো নিজে জানো তুমি?
-আমি ঠিক আছি---।
-চোখগুলো কেমন বসে গেছে। কালি ভরছে চোখের নিচে। আর তোমাকে দেখে যে কেউই বলে দিতে পারবে তুমি কতোটা ক্লান্ত। আমার আসার অপেক্ষায় রাত জাগার কি দরকার আমি বুঝি না।
-তুমিও তো জাগো---?
-বেশি কথা বললে ধরে মাইর লাগাবো বলে দিলাম--। একে তো ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করবে না, আবার আমাকে বলতে আসবে সে--।
-রাগ করছ কেন? আমি কি করেছি?
-রাগ করবো না? তো কি আদর করব তোমাকে? এসে যদি দেখি না খেয়ে বসে আছো বা না খেয়েই ঘুমিয়ে গেছ-কেমন লাগো বলো তো? রাগ হবে না?
-আমি তো খাই--। সত্যি---।
-ও আচ্ছা? তাই নাকি? আপনাকে সময় দিতে পারছি না তার মানে এই না যে আমি আপনার কোন খবরই রাখি না---।
-সরি-। আসলে-। খেতে ভালো লাগছিলো না। আর কেমন শরীরটাও কেমন লাগছিল---।
-কেন পরী? কি হয়েছে? তুমি বলো নি কেন কিছু? কি হয়েছে আমাকে বলো? বেশি খারাপ লাগছে?
-আরে! না-। এমনি একটু টায়ার্ড লাগছিল--।
-কালকে সকালেই তুমি ডাক্তার দেখাবা---।
-কালই দেখাতে হবে?
-জি ম্যাডাম। কালই দেখাতে হবে। আমি এ্যাপয়েনমেন্ট নিয়ে রাখবো। সকালে না পারলে অবশ্যই বিকেলে দেখাবা--।
-আমি তো ঠিক চিনি না---।
-তোমাকে একা যেতে কে বলছে? মায়ের সাথে যাবা---।
-এই না না না--।
-নয়তো তিথির সাথে যেও--।
-উমমম--। তোমার তো কাল পরশু প্রজেক্টের কাজটা শেষ হয়ে যাবে। তখন না হয়----।
-বেশি কথা বলবা না একদম। এখন শরীর খারাপ। তিনদিন পর ডাক্তার দেখালে কি লাভ হবে?
মায়রা কিছু না বলে আয়ানের বুকে মুখ লুকালো। আয়ান এক হাতে আলতো করে মায়রার কোমড় জড়িয়ে ধরে অন্য হাতে চুলে হাত বুলাতে লাগলো।
-মায়রু? শুনেছ কি বলেছি? কালই যেন ডাক্তার দেখানো হয় ম্যাডাম। নইলে কিন্তু আমি সব কাজ ফেলে আসতে হলে খবর আছে---।
-আমার ভয় করছে---।
-ভয়ের কিছু নেই তো পাগলিটা। চেকআপ করাবা আর বড় জোর মেডিসিন দিবে কিছু। ব্যাস।
-ইনজেকশন দিলে?
-হা হা---। আচ্ছা। তো এই ব্যাপার! বউটা ইনজেকশনের ভয়ে ডাক্তার দেখাতে চাইছে না?
-হাসবা না একদম---।
-আচ্ছা বাবা ঠিক আছে। ডাক্তার ইনজেকশন দিতে চাইলেই আমাকে কল দিবা। আমি না করে দিবো কেমন? আর তোমাকে নিয়ে আসবো--। ওকে?
-তোমার তো কাজ আছে---?
-সেটা কাল দেখা যাবে। ডাক্তার দেখাবা কিন্তু। ওকে?
-হুম-----।
আয়ান মায়রাকে বুকে শক্ত করে জড়িয়ে নিতেই দুজনেই ঘুমিয়ে গেল। সকালে মায়রার ঘুম ভাঙতেই দেখলো আয়ান পাশে নেই। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠলো মায়রা। দশটা বাজে। তাড়াহুড়ো করে হাতমুখ ধুয়ে এসে রুম থেকে বের হবে এমন সময় তিথি ট্রে হাতে রুমে ঢুকলো।
-এই ভাবি উঠে গেছ? যাক। নাস্তা করো এখন।
-তিথি? এখানে আনলে কেন? আর আমার এতো দেরি হয়ে গেছে ডাকো নি---।
-আরে বাবা! ভাইয়া তোমাকে ডাকতে বারণ করে গেছে সকালে।
-সে কি! কেন?
-কেন না? নিজের অবস্থা দেখেছ? এখন রান্নাঘরের আশেপাশে গেলেও মা মাইর লাগাবে।
-রান্না---।
-আজকে মা আর আমি করে নিচ্ছি। তুমি খেয়ে রেস্ট করো---। আর ভাবি তুমি আমার সাথে বিকেলে ডক্টরের কাছে যাবা---।
-আম-- তিথি? বাবু? ভাবি এখন একদম ঠিক আছি।
-আমি বাপু মা আর ভাইয়া কারো হাতে শহীদ হতে চাই না। সো তুমিও খেয়ে নাও। আমি প্লেট পরে নিয়ে যাব। আসো আসো?
মায়রা বিছানায় বসে বসে খাচ্ছে আর একটু পর পর তিথির দিকে তাকাচ্ছে করুণ মুখ করে। তিথি সেসব পাত্তা না দিয়ে মায়রার পাশে বসে মোবাইলে কিছু একটা করছে।
-তিথু? আর না তো প্লিজ?
-আমি ভাইয়াকে কল করে বলবো তুমি খাচ্ছো না যে? ভাইয়া কিন্তু বলে গেছে না খেলে কল করতে। ও এসে তোমাকে নিজের মতো করে খাওয়াবে---। তখন কিন্তু আমার দোষ দিও না।
-উহহহমমম। এমন করো কেন তোমরা সবাই?
-খাও খাও ভাবি। লক্ষী ভাবি না? খাও।
-হুম---। তোমার ভাইয়া কখন গেছে সকালে?
-ওই তো আরিশা আপু আর তাওহীদ ভাইয়া এসেছিল সকালে।
-কয়টার দিকে?
-উম। মনে হয় ৮ টা কি সাড়ে ৮টা।
-আরিশা? উনি কেন এসেছিল?
-কি জানি। আমি ঠিক শুনি নি গো ভাবি। হয়তো ভাইয়ার সাথে কোন কাজ ছিল---।
-আচ্ছা তিথু? আরিশা কি প্রায়ই বাড়িতে আসতো? না মানে আমি তো বিয়ের দিন ছাড়া তেমন দেখি নি উনাকে---।
-আরে? ভাইয়ার এই একটাই ফ্রেন্ড কলেজ টাইম থেকেই আমাদের বাসায় আসতো প্রায়ই। এখন হয়তো কাজের প্রেশার বেশি তাই আর আসে টাসে না।
-ওহ! কিন্তু উনারা এক সাথে কাজ করে?
-আরে? তুমি জানো না? ভাইয়া আর আরুআপ্পি পার্টনারশিপে দিবাশা কোম্পানিটা খুলেছে তো। আপুর মায়ের জুয়েলারি বিজনেস ছিল। আর ভাইয়া বাবার থেকে টাকা লোন নিয়ে ওরা নিজেরা নিজেরা দিবাশা খুলেছে। তাও সেই অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে। কতোগুলো বছর হয়ে গেছে। আমার তো এখনো মনে আছে। ভাইয়াদের ফার্স্ট প্রজেক্টটা পাওয়ার পর বাসায় বড় করে একটা পার্টি হয়েছিল---।
-উনার মাকে তো দেখলাম না বিয়ের দিন?
-আরে! আপু তো বিয়ে করতে চায় না। এখন ভাইয়ারও বিয়ে হয়ে যাচ্ছে জানলে আবার আন্টি আবার আপুর বিয়ের জন্য বলবে, তাই আরুআপু মানা করেছে আন্টিকে বলতে--।
-ওহ!
-কিন্তু জানো? আন্টি চেয়েছিল আরুপুর সাথে আয়ান ভাইয়ার বিয়েটা দিতে--। বাসায়ও বলেছিল।
------তাহলে? হলো না কেন?
-আরে! আপু তো জেদ ধরে বসেছিল। ও বিয়েই নাকি করবে না। এটা কোন কথা বলো?
-হুম-----।
-হি হি--। তবে রাজি না হয়ে ভালো হয়েছে। আমি এতো লক্ষী একটা ভাবি পেয়েছি। হি হি।
মায়রা একটু হেসে খাবার নাড়া চাড়া করতে লাগলো। গলা দিয়ে আর কিছু নামছে না। মাথায় একটা কথাই ঘুরছে। আরিশা বিয়ের জন্য রাজি ছিল না। কিন্তু আয়ান? ও কি আরিশাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল? না চাইলেও বিয়েটা না হওয়ার পরেও একই সাথে একই অফিসে কেন কাজ করছে এতোগুলো বছর? আর এই যে আরিশার কোন সমস্যা হলেই আয়ান পাগলের মতো ছুটে যায়!
-ও ভাবি? খাও না?
-আর পারবো না গো তিথু? প্লিজ?
-আচ্ছা। জুসটা খাও তাহলে আর কিছু বলব না।
-হুম----।
মায়রা জুসের গ্লাসটা খালি করলে তিথি ট্রে নিয়ে আবার বেরিয়ে গেল। মায়রাও বিছানায় হেলান দিয়ে বসতেই মোবাইলে টুং করে একটা মেসেজ এলো। মায়রা মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখলো আয়ানের মেসেজ।
"গুড গার্ল। এখন রেস্ট করো। বিকেলে ডক্টরের কেবিনে যাওয়ার সময় কল দিবা। একসাথে বাসায় ফিরব। ওকে ম্যাডাম?"
মায়রা রিপ্লাই দিতে গিয়েও রিপ্লাই দিতে পারলো না। হাত চলছে না একদম। আবার শরীরটা নিস্তেজ হয়ে আসছে। যা কিছু খেয়েছে সব গলা দিয়ে উঠে আসতে চাইছে। মায়রা কোনমতে মুখ চেপে ধরে বিছানায় সোজা হয়ে শুয়ে গেল। শরীরের চেয়ে মনটাই যেন বেশি অসাড় হয়ে যাচ্ছে মায়রার। খুব করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। এমনটা হওয়ার কারণটা মায়রার জানা নেই। তবু কান্না আসছে প্রচন্ড। আর আয়ানের বলা একটা কথা মাথায় ঘুরছে।
"আরিশাকে নিয়ে উল্টাপাল্টা কিছু মাথায় না আনতে। ও আয়ানের বেস্ট ফ্রেন্ড। শুধুই বেস্টফ্রেন্ড।"
৪৬!!
বিকেলে তিথি আর তিয়াশের সাথে বেরিয়েছে মায়রা। তিয়াশ ড্রাইভ করছে। ওর পাশে তিথি বসা। আর মায়রা পিছনের সিটে বসেছে। আয়ানের নাম্বারে কল দিয়েছিল বাসা থেকে বের হওয়ার সময়। অনেকক্ষণ কল হয়ে কেটে গেছে। সিটে হেলান দিয়ে বসে মায়রা বাইরের ব্যস্ত শহরটা দেখছে। পাশ দিয়ে সাঁ করে গাড়িগুলো পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। কিসের এতো ব্যস্ততা সবার? এসব ভাবতে ভাবতে কখন যেন হসপিটালেও পৌঁছে গেছে। কিছুক্ষণ বসে থাকার পর মায়রার নাম ডাকা হলো। তিথি আর মায়রা দুজনে ডাক্তারের চেম্বারে গেল। বেশ কিছুক্ষণ মায়রার সাথে কথা বললেন ডাক্তার। কয়েকটা টেস্ট করানো হলো।
-দেখো মা। এসব টেস্ট হলো ফর্মালিটি। আয়ান তো আসে নি। আসলে কিন্তু এখনই মিষ্টি আনতে পাঠাতাম।
-জি?
-আরে বাবা! সে তো বাবা হবে।
কথাটা শুনেই মায়রা চমকে উঠলো। সত্যি কি ও কথাটা শুনেছে? আয়ান বাবা হবে! তার মানে মায়রা প্রেগন্যান্ট! তিথি পাশ থেকে মায়রাকে জড়িয়ে ধরলো।
-ইয়েএএএ৷ কি মজা! আমি ফুপি হবো। লাভ ইউ ভাবি--।
-আরে? তিথি মা! ভাবিকে একটু খাওয়া দাওয়া করিও। ওর প্রেশার অনেক ফল করেছে। ওয়েটও কম। আর সময়মতো চেকআপ করাতে আসবা। এই সময়টায় একটু সাবধানে থাকতে হবে---।
-জি----।
মায়রাকে টিটি টিকার একটা ইনজেকশন দেয়ার পর তিথি, মায়রা আর তিয়াশ গাড়িতে এসে বসলো। তিথি খুশির চোটে বলতেই পারছে না কি হয়েছে। আর তিয়াশ বেচারা বারেবারে প্রশ্ন করেই চলেছে। মায়রা সেসব নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে আবার আয়ানকে কল করলো। এবারও কল রিসিভ করছে না দেখে মায়রা আয়ানের অফিসের ল্যান্ডলাইনে কল করলো। অনেকক্ষণ কল বাজার পর কলটা রিসিভ হলো।
-হ্যালো? কোথায় আপনি?
-হ্যালো ম্যাডাম? আয়ান স্যার আর আরিশা ম্যাডাম একটা মিটিংয়ে আছেন।
-ওহ!
-স্যারকে কি কিছু বলবো?
-নাহ! কিছু বলতে হবে না। রাখছি।
মায়রা কলটা কেটে দিয়ে কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে তিয়াশের দিকে তাকালো। তিথি এতোক্ষণে বলে দিয়েছে কথাটা। তিয়াশ হেসে মায়রার মাথায় হাত রাখলো। খুশিতে বেচারা কি করবে, কি বলবে সেটাই বুঝতে পারছে না। লাইফে প্রথম বার মামা হবে সে। অনুভূতিটা এতো সুন্দর হবে তিয়াশ ভাবেও নি।
-ভাইয়া? বাসায় চলো না?
-আয়ান ভাইয়া আসবে না?
-নাহ। ও মিটিংয়ে আছে। কাল তো ওদের প্রজেক্টটার সাবমিট করতে হবে। তাই হয়তো ব্যস্ত। চলো না বাসায় যাই?
-হ্যাঁ হ্যাঁ----।
বাসায় ফিরার পর তিথিকে সবাইকে খবরটা দিয়ে দিল। মায়রার শ্বশুর শাশুড়ি দুজনেই খুশি হয়ে মায়রাকে অনেক দোয়া করলেন। মায়রা সালাম করতে যাচ্ছিলো শাশুড়ীকে। উনি তাড়াতাড়ি মায়রাকে ধরে আটকালেন।
-এই সময় এসব ফর্মালিটির কাজকর্ম করবি না একদম। এভাবে ঝুঁকে সালাম করতে হবে না। ভারি কাজ করা যাবে না। টেনশন করা যাবে না। বুঝলি?
-জি মা।
তিথি ফ্রিজ থেকে মিষ্টি এনে সবাইকে মিষ্টি খাওয়ালো। তারপর মোবাইলটা বের করে আয়ানকে কল করলো। এবারেও কলটা রিসিভ করলো না আয়ান। তিথি বিরক্ত হয়ে আয়ানের অফিসের নাম্বার ডায়েল করছে।
-উফফ। এই ছেলেটাকে এতো বড় নিউজটা দিবো আর সে কলই রিসিভ করছে না। অসহ্য--।
-তিথি? উনাকে এখন বলো না প্লিজ।
-ওমা! কেন?
-না মানে! কাল উনারা প্রজেক্টটা পেলে পরে বলবো।
-ওহো! সারপ্রাইজ দিবা ভাবি? উমমমম। ওকে ডান। এই আম্মু আব্বু---। কেউ ভাইয়াকে বলবা না কিন্তু----।
আটটা কি সাড়ে আটটার দিকে সবাই ডাইনিং রুমে বসে গল্প করছে। আর মায়রা শাশুড়ির বকা খেতে খেতে জুস খাচ্ছে। এমন সময় তিথির মোবাইলে রিং আসতেই তিথি কলটা রিসিভ করলো।
-হ্যাঁ ভাইয়া। বল?
-কি রে? মায়রা কোথায়? ওর ফোনে কল করছি রিসিভ করছে না কেন?
-ওহ। আমরা সবাই তো ডাইনিংরুমে বসে আছি। ভাবিও এখানে। ফোন মনে হয় রুমে ভুলে রেখে এসেছে।
-ওহ! সবাই এখানে মানে? কি করছে? ডক্টর কি বললো?
-তেমন কিছু না। ভাবির প্রেশার লো হয়ে গেছে৷ এই আর কি।
-ওহ! ওকে ফোনটা একটু দে তো?
-হুম----। এই ভাবি কথা বলো?
মায়রা মোবাইলটা কানে লাগালো।
-হ্যালো?
-মায়রু? সরি সরি সরি। কল করেছিলে রিসিভ করতে পারিনি--।
-আরে? কাজ করছিলেন তো। ইটস ওকে। আমি কিছু মনে করিনি।
-সিউর?
-হুম----।
-থ্যাংক ইউ পরীটা। কি করছ এখন?
-মা জুস খেতে দিয়েছে---।
-গুড গুড। খাও--। এই শোনো? আমার আসতে একটু দেরি হবে। তুমি খেয়ে নিও। ওকে?
-হুম----।
-রাগ করো না প্লিজ--?
-হুম। আচ্ছা।
-বায় বউটা৷ টা টা।
আয়ান বাসায় ফিরলো সাড়ে দশটার দিকে। মায়রা চুপ করে শুয়ে আছে চোখ বুজে। আয়ান ফ্রেশ হয়ে এসে মায়রার পাশে শুয়ে পড়লো। মেয়েটা উল্টো দিকে মুখ করে ঘুমাচ্ছে। আয়ান আস্তে করে মায়রাকে টেনে নিয়ে নিজের বুকে সাথে আঁকড়ে জড়িয়ে ধরলো মায়রাকে৷ আয়ানের দিকে পিঠ ফিরিয়ে শুয়ে আছে মায়রা। মায়রাকে জড়িয়ে ধরার কিছুক্ষণের মাঝেই আয়ান ঘুমিয়েও গেল। আয়ানের উষ্ণ নিঃশ্বাস এসে পড়ছে মায়রার কাঁধে। মায়রা আয়ানের হাতের বাঁধন ছাড়িয়ে নিয়ে আয়ানের মুখের দিকে তাকালো। বড্ড বেশি অভিমান হচ্ছে মায়রার। তাই জেগে থাকলেও একটাও কথা বলেনি আয়ানের সাথে। বলবে কেন? আয়ানও তো ওকে একবারও ডাকলো না। বুকে জড়িয়ে ধরলো না। আগের মতো বুকে চেপে ধরে কপালে চুমো খেল না একবারও। একবারও তো মায়রার মুখটা তুলে ধরে জিজ্ঞেস করলো না ডাক্তার কি বলেছে। মায়রা বেশ অনেকটা সরে এসে আবার অপরপাশে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে রইলো। ঘুমে চোখ বুজে আসছে। ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে আসছে। ঘুমের কোলে ঢলে পড়ার আগেও মায়রা টের পেল আয়ানের হাত জোড়া মায়রাকে টেনে নিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে ঘুমের ঘোরেই।
সকালে মায়রার ঘুম ছুটে গেল মোবাইলের রিংটোনের শব্দে। আয়ানের মোবাইলে কল এসেছে। আয়ানের নড়াচড়া টের পেয়ে মায়রা আর চোখ খুললো না। চুপ করে শুয়ে রইলো। আয়ান হাতড়ে মোবাইলটা নিয়ে রিসিভ করে মোবাইলটা কানে লাগালো। আর মায়রাকেও বুকে জড়িয়ে নিলো।
-হ্যালো? আয়ান?
-হুম--। বল আরু।
-একটা সমস্যা হয়েছে রে। লোকেশন সেন্ডিংস ঠিকমতো অপারেট হচ্ছে না। তিনটা নাম্বারে মেসেজ আসার কথা ছিল না? আসছে না একসাথে তিনটাতে। একবার একটা ডিসকানেকটেড হয়ে যাচ্ছে। আমি কিছু বুঝতে পারছি না।
-আরু---। ওয়েট! আমরা কাল রাতেও তো চেক করলাম।
-সেটাই তো। সবগুলো একসাথে রিটেস্ট করছিলাম। তখন দেখি---।
-ওফফফ। ধুর বাবা! ভাবলাম সব টেস্টিং শেষ। বিকেলে একেবারে অফিসে যাবো। আর সন্ধ্যায় সেইফটি ফর উইমেনের পোগ্রামে। ধ্যাত--।
-কি করবি? সমস্যা কি বলে আসে?
-তুই থাক। আমি আসছি---।
-হুম---।
আয়ান কলটা রেখে কিছুক্ষণ চুপ করে শুয়ে রইলো। মায়রাকে আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রইলো কিছুক্ষণ। একটু পরে মায়রার মাথাটা বালিশে রেখে আয়ান উঠে গেল। ফ্রেশ হয়ে এসে ফর্মাল গেটআপ নিলো আয়ান। সাদা ফর্মাল শার্টটার হাতা ফোল্ড করে হাতে ঘড়ি পড়লো। মায়রা ততক্ষণে উঠে বসেছে বিছানায়।
-কোথায় যাচ্ছো?
-উঠে গেছেন ম্যাডাম?
-হুম।
আয়ান চুলটা পিছনের দিকে সেট করে নিয়ে মায়রার পাশে বসে কপালে ছোট্ট করে একটা চুমো খেল।
-অফিসে একটু সমস্যা হয়েছে। অফিসে যাচ্ছি। তুমি আর একটু ঘুমিয়ে নাও না?
-উহু---।
-ওকে। তাহলে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে নাও। পোগ্রাম শুরু হবে সন্ধ্যায় ৭ টার দিকে। মা, বাবার সাথে চলে এসো কেমন?
-হুম-----।
-এখন লক্ষী বউটা৷ আসি? বায়।
-বায়। সাবধানে যেও।
-হুম।
আয়ানের যাওয়ার দিকে মায়রা চুপ করে তাকিয়ে রইলো। খুব কান্না পাচ্ছে। কিন্তু চোখ থেকে এক ফোঁটা পানিও বের হচ্ছে না। মায়রা খাটের সাথে হেলান দিয়েই চুপ করে বসে রইলো। কিছুই ভালো লাগছে না। দূরে কোথাও হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। যেখানে এতো কিছুর ভাবনা থাকবে না। আয়ানকে হারানোর ভয়টা থাকবে না। আরিশাকে নিয়ে কোন দ্বন্দ্ব থাকবে না মনের কোণে। বা নিজের পরিবার নিয়ে কোন ক্ষোভ থাকবে না। কথাগুলো ভাবছে এমন সময় মায়রার মোবাইলটাও শব্দ করে বেজে উঠলো। মোবাইলটা হাতে নিয়েই ভ্রু কুঁচকে গেল মায়রার। সেই বিয়ের দিনে চোরের মতো এসে বেশ দামি কিছু গয়না দিয়ে গিয়েছিলেন উনি। আজ আবার হঠাৎ কলও করছে? কি চলছে উনার মনে? মায়রার কাছে কি চায় উনি?