আমাদের ওয়েবসাইট ভিজিট করার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। অনুগ্রহ করে গল্প সম্বন্ধে আপনার মতামত অবশ্যই প্রকাশ করবেন। আপনাদের মতামত আমাদের এই ছোট প্রয়াসকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রেরণা যোগায়। শীঘ্রই আরও নিত্য নতুন গল্প আপডেট আসছে, সঙ্গে থাকুন। গল্পের ডায়েরি'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখক/লেখিকা'র নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত গল্পের ডায়েরি’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখক/লেখিকা'র কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় গল্পের ডায়েরি কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। গল্পের ডায়েরি'তে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ করলে তা কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।

বকুল ফুলের মালা - পর্ব ৩৬ - সুলতানা পারভীন - ধারাবাহিক গল্প


৭১!! 

-মায়রা? মায়রা চোখ খোলো প্লিজ? প্লিজ চোখ খোলো? এই মায়রু?

আয়ানের শাড়ির দোকানের সেলসবয় কয়জনকে সাথে নিয়ে শাড়ি আর অন্যান্য শপিংয়ের প্যাকেটগুলো গাড়িতে রেখে আসতে দশ মিনিটের মতো সময় লেগেছে। শপিংমলের কোনো ফুডকোর্টে নাস্তা করে কিছুক্ষণ আশেপাশে ঘুরবে কথাটা ভাবতে ভাবতে আবার জুয়েলারি শপটার এসেছে আয়ান। মায়রাকে একটু চমকে দেয়ার জন্য আয়ান ইচ্ছে করেই ঘুর পথ দিয়ে মায়রার পিছন দিকের এলিভেটর দিয়ে এসেছে। হুট করে পিছন থেকে এসে ধরে এই পাগলিটাকে চমকে দিতে আয়ানের দারুণ লাগে সবসময়ই। তাই সুযোগটা মিস করতে চায় নি। মায়রার কাঁধে হাত দিবে এমন সময় আয়ান টের পেলো মায়রা ওর বুকেই সেন্সলেন্স হয়ে ঢলে পড়েছে। আয়ান মায়রাকে এক হাতে বুকের সাথে বেঁধে নিয়ে গালে হাত ছুঁইয়ে কয়েকবার ডাকলো। আস্তে আস্তে ওদের দুজনকে ঘিরে ভিড় বাড়তে শুরু করেছে। সেদিকে আয়ানের হুঁশই নেই। জুয়েলারি শপের একটা ছেলে এসে আয়ানকে এক বোতল পানি এগিয়ে দিলো। 

-স্যার ম্যাডামের চোখে মুখে পানির ঝাপটা দিন। তাহলে চোখ খুলবে হয়তো। আর স্যার এখানে ভিড়ও হয়ে গেছে। আপনি চাইলে ম্যাডামকে আমাদের দোকানের ভিতরে নিয়ে আসতে পারেন। শুইয়ে দিতে পারলে---।

-না না। থ্যাংকস। আমি ওকে নিয়ে গাড়িতেই শুইয়ে দিবো। থ্যাংকস ফর ইওর হেল্প ম্যান। 

-ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম স্যার। 

আয়ান মায়রাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে লিফ্টে করে কয়েক মিনিটের মধ্যেই পার্কিং এরিয়ায় পৌঁছে গেল। আয়ান সাবধানে মায়রাকে সিটে বসিয়ে দিয়ে সিটটা হেলিয়ে দিয়ে আরো কয়েক বার মায়রার গালে হাত ছুঁইয়ে দিয়ে ডাকলো। পানির বোতলটা ভুলে জুয়েলারি শপের ওখানেই ফেলে এসেছে আয়ান। এদিকে গাড়িতেও পানির বোতল নেই দেখে নিজের উপরেই রীতিমতো রাগ হচ্ছে আয়ানের। এভাবে মায়রাকে গাড়িতে একা রেখে যেতেও মন টানছে না ওর। আবার মেয়েটাকে এমন অচেতন হয়ে পড়ে থাকতে দেখেও ভালো লাগছে না। আয়ান কি করবে ভাবছে এমন সময় পাশ থেকে কেউ একটা পানির বোতল এগিয়ে দিল আয়ানের দিকে। আয়ান মুখ তুলে মানুষটার দিকে তাকালো ঠিকই কিন্তু ঠিক চিনতে পারলো না।

-পানির বোতলটা দিতে এলাম আপনাকে। ওপরেই ফেলে এসেছিলেন। তাই নিয়ে এলাম--।

-ওহ! থ্যাংকস। আপনাকে ঠিক চিনতে পারলাম না। 

-আপনি না চিনলেও আপনাকে আমি চিনি--। আপনি আয়ান রাইট?

-জি। আমম আপনি?

-নাম বললে হয়তো চিনতে পারবেন। আমি সীমান্ত। মায়রার-----।

সীমান্ত কথাটা পুরো শেষও করতে পারলো না। তার আগেই আয়ান উঠে সীমান্তের কলার চেপে ধরে কয়েকটা ঘুষি বসিয়ে দিলো নাক মুখ বরাবর। পার্কিং এরিয়ায় কেউ নেই যে এই মূহুর্তে সীমান্তকে আয়ানের হাত থেকে বাঁচিয়ে নিবে। অবশ্য সীমান্ত নিজে আয়ানের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে চাইছে সেটাও মনে হচ্ছে না। না সে আয়ানের কিল ঘুষি থেকে বাঁচার জন্য আত্মরক্ষা করার চেষ্টা করছে, না পাল্টা আয়ানকে আঘাত করছে। অবশ্য 'সীমান্ত' নামটা কানে যাওয়ার সাথে সাথেই আর কিছু শোনা বা বোঝা কোনটারই সময় বা ক্ষমতা কোনটাই যেন নেই আয়ানের মধ্যে। পারলে এই লোকটাকে এখানেই মেরে পুঁতে দিবে এমন ভঙ্গিতে সীমান্তকে ঘুষি, চড়, থাপ্পড় একসাথে মেরে চলেছে আয়ান। রাগের চোটে আয়ানের একবারও মনে হলো না ছেলেটার ঠোঁটের কোণ ফেটে তাজা রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। অথবা আয়ানের বলিষ্ঠ মুঠোর আঘাতে সীমান্তের নাক দিয়ে গল গল করে রক্ত গড়াচ্ছে। আয়ান এবারে সীমান্তকে পার্কিংয়ের পিলারের দিকে প্রায় ছুঁড়ে ফেলবে সেই মূহুর্তে কেউ এসে আয়ানকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে সীমান্তকে ছাড়িয়ে নিলো আয়ানের হাত থেকে।

-লোকটাকে কি একেবারে খুন করে ফেলবি নাকি আয়ান? তুই কি মানুষ? একটা মানুষকে কেউ এভাবে মারে?

-না মানুষ না। ওই অমানুষটাকে খুন করতে প্রয়োজনে আমি অমানুষই হয়ে যাবো সায়না। সর তুই সামনে থেকে----।

-আয়ান? তুই পাগল হয়ে গেছিস? দেখছিস কি অবস্থা করেছিস মানুষটার? ইশ! এভাবে কেউ মারে?

-হা হা হা! ও তাই না? এটাকে মারা বলে নাকি? যাকে সেইভ করার চেষ্টা করছিস তাকেই জিজ্ঞেস কর না মারা কাকে বলে? কতটা মারলে একটা মেয়ের সমস্ত শরীর জুড়ে তার ছাপগুলো ছয় মাস পরেও ফুটে থাকে? জিজ্ঞেস কর না কত আঘাত করলে একটা মেয়ে মৃত্যুর মুখে চলে যায়? শরীরের আঘাতের কথা না হয় বাদই দিলাম। মায়রার উপরে কি পরিমাণ মানসিক অত্যাচার করেছে ও জানিস? কতোটা অত্যাচার করলে যে মানুষটাকে ও ভালোবাসে তার স্পর্শেও ভয় পেয়ে যায় ভাবতে পারিস? আর তুই এই লোকটাকে বাঁচাতে চাইছিস? ছি সায়না! ছি!

-আয়ান? সব গল্পেরই দুটো দিক থাকে। একটা ভালো, একটা মন্দ। একটা শুরু, একটা শেষ। এই মানুষটার কাজগুলোরও হয়তো কোনো কারণ ছিল। তাকে একটা বার নিজের কথাগুলো বলার সুযোগটুকু অন্তত দে? প্লিজ?

-ওই মেয়ে? তুই নিজেও আমার সামনে থেকে দূর হ। আর এটাকেও নিয়ে যা। নইলে সত্যি ওর সাথে সাথে তোকেও খুন করে ফেলবো বলে দিচ্ছি আমি---। তুই জানিস আমি অহেতুক গলাবাজি করি না। যা বলি সেটা করেও দেখিয়ে দিই। যা এখান থেকে সায়না---।

সায়না আবার মরিয়া হয়ে আয়ানকে কিছু বোঝানোর জন্য এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেই সীমান্ত সায়নার হাত টেনে ধরে থামালো। এতোক্ষণ নাকে রুমাল চেপে ধরে থাকায় নাক দিয়ে রক্ত ঝড়া বন্ধ হয়েছে ছেলেটার। সায়নার হাতে টান খাওয়ায় পিছনে ঘুরে সীমান্তের রক্ত জমে থাকা মুখটা দেখে রীতিমতো আঁতকে উঠলো সায়না। সীমান্ত কোনমতো একটু হাসি ফোটানোর চেষ্টা করলো ঠোঁটের কোণে। 

-সায়না? আপনি টেনশন নিবেন না। আমিই কথা বলছি আয়ানের সাথে। ইউ প্লিজ রিল্যাক্স।

-কিন্তু---?

সীমান্ত কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে আয়ানের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। আয়ান অবশ্য আবার মায়রার দিকে মনোযোগ দিয়েছিল। সীমান্ত পাশে এসে দাঁড়িয়েছে টের পেতেই আয়ান ঘুরে দু হাতে সীমান্তকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। সীমান্ত আয়ানের এমন কাজের জন্য প্রস্তুত ছিল না বলেই প্রায় ছিটকে গিয়ে পড়লো সায়নার উপের। সায়নাও তাড়াতাড়ি সীমান্তকে আঁকড়ে ধরে ফেললো। 

-আপনি ঠিক আছেন?

-হ্যাঁ---। আম সরি সায়না। আপনার কোথাও লাগে নি তো?

-না----।

সীমান্ত একবার সায়নার দিকে তাকিয়ে আয়ানের দিকে এক পা বাড়ালো। এবারে আয়ানের চোখ জোড়া রাগে টকটকে লাল রঙ ধারণ করলো যেন। যেন রক্ত ঝড়ে পড়ার অপেক্ষা শুধু।

-I said stay away from her. এর পর কিন্তু নিজেকে বাঁচানোর আর কোনো চান্সই তুমি পাবে না মিস্টার সীমান্ত। সো জাস্ট গেট লস্ট। 

-আমি জাস্ট কয়েকটা কথা বলতে এসেছিলাম----।

-তোমার এই ভালোমানুষির চেহারাটা না ওই যে পাশে আছে? তাকে দেখাও বুঝেছ? আমার সামনে আসার চেষ্টা ভুলেও করবে না তুমি। শুধু নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে সুখে রাখতে তার পাশে থাকতে চাই বলে তুমি এখনো নিজের পায়ের উপরে দাঁড়িয়ে আছো। নইলে আমার মায়রাকে আঘাত করার অপরাধে এতোক্ষণে মেরে পুঁতে রাখতাম তোমাকে এখানেই। তার জন্য জেল, ফাঁসি সব মেনেও নিতাম হাসিমুখেই। শুধু এই মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে আমি চুপ করে আছি। এটাকে নিজের সৌভাগ্য মনে করে নিজের পথে যাও মিস্টার। নইলে আমি মুড চেইঞ্জ করলে কেউ তোমাকে আমার হাত থেকে আজ বাঁচাতে পারবে না---।

-তুমি আমাকে মেরে ফেলতে চাইলে মেরে ফেলতে পারো। আমি কোন প্রতিবাদ করবো না। শুধু আমার কয়েকটা কথা শোনো আয়ান? প্লিজ?

-তোমাকে তো আমি------।

আয়ান এগিয়ে আসছে দেখে সায়না এক ঝটকায় সীমান্তের আর আয়ানের মাঝে এসে দাঁড়িয়ে গেল। 

-সায়না? সামনে থেকে সর তুই---। আর এই শয়তানটাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছিস কেন তুই? জানিস তুই এই লোকটা কি কি করেছে?

-জানি আয়ান। জানি বলেই চাই তুইও সবটা জান। উনার কথাগুলো একবার শোন। অনেক কিছুই ক্লিয়ার হবে তোর কাছে---।

-এই লোকটার থেকে ক্লিয়ার করে জানতে হবে আমাকে? মায়রার শরীরের প্রত্যেকটা দাগ আমাকে প্রতিনিয়ত চিৎকার করে এই লোকটার কাহিনীগুলো আমাকে শোনায়। তবু এর মুখ থেকেই শুনতে হবে আমাকে?

-হ্যাঁ হবে--। সবারই একটা পয়েন্ট অফ ভিউ থাকে আয়ান। সেটা জানাটা দরকার। তাই মায়রাকে আঘাত করার নেপথ্য কারণটাও তো জানা দরকার। একবার অন্তত শোন? তারপরও যদি তোর মনে হয় এই লোকটার শাস্তি হওয়া দরকার তাহলে তাই দিস নাহয়--। আমি আটকাবো না তোকে প্রমিস---।

আয়ান সায়নার দিকে এক পা এগিয়ে এসে সোজাসুজি সীমান্তের চোখে চোখ রাখলো। ঘৃণায় আর বিরক্তিতে আয়ানের মুখ খানিকটা বিকৃত হয়ে মুখের ভঙ্গিটা খানিকটা কঠিন করে তুলেছে। সায়না একটু ভয় পেয়ে সীমান্তের সামনে দাঁড়িয়ে সীমান্তকে আড়াল করার চেষ্টা করলো। কিন্তু দুজন লম্বাচওড়া সুপুরুষের চোখাচোখি হওয়া আটকাতে পারলো না মেয়েটা। একজনের চোখেমুখে ঘৃণার ছাপ আর অন্যজনের চোখে অনুশোচনার অশ্রু। আর তাদের মধ্যখানে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা জানে মধ্যবিন্দুর ভিন্ন পাশে থাকলেও এদের দুজনেরই লক্ষ্য একটাই, প্রিয় মানুষটার মুখে হাসি ফোটানো।

৭২!! 

-মায়রাকে আমি প্রথম দেখেছি তাথৈকে দেখতে ওদের বাসায় যাওয়ার পথে। তখন আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারি নি যে পাত্রী দেখতে যাচ্ছি তারই ছোটো বোনকে মাঝরাস্তায় প্রথম দোখাতেই আমার এতো ভালো লেগে যাবে। হ্যাঁ লাভ এট ফার্স্ট সাইট বলতে যদি কিছু হয়ে থাকে তবে সেটাই হয়েছিল আমার মায়রাকে দেখে। মেয়েটা ছোট্ট একটা বাচ্চাকে রাস্তা পার করিয়ে দিচ্ছিলো--। চোখেমুখে রাজ্যের চাঞ্চল্য আর ছেলেমানুষি। আর ঠোঁটের কোণে লজ্জা মাখা কিন্তু তৃপ্তির হাসি। মেয়েটাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল ও বাইরে থেকে বাড়ি ফিরছিল। হাতে ভারি ব্যাগ নিয়েও সে অন্য একজনকে হাসিমুখে সাহায্য করছে। দৃশ্যটা সত্যি মুগ্ধ হওয়ার মতোই---।

-ইয়া। দ্যাটস মাই মায়রা।

আয়ান ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ঝুলিয়ে কেবিনের ছোট্ট উইন্ডো টা দিয়ে মায়রার মুখের দিকে তাকালো। মেয়েটার এখনো জ্ঞান ফিরে নি। যদিও ডাক্তার একটা ঘুমের ইনজেকশন দিয়েছেন। আর আয়ানকে এটা আশ্বস্ত করেছেন যে মায়রার তেমন কিছু হয়নি। কোনো কারণে প্যানিক হয়ে সেন্সলেস হয়ে গেছে। আরো কিছু ফরমাল চেকআপ কমপ্লিট হলে মায়রাকে ডিসচার্জ করা হবে। ততক্ষণ সীমান্তের কথাগুলো শোনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আয়ান। যদিও আয়ানের এই লোকটার কথা শোনার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। শুধু সায়নার কান্নাকাটি আর বারবার অনুরোধের কারণেই রাজি হয়েছে। সীমান্তের কাহিনী বিশ্বাসযোগ্য মনে না হলে লোকটা যে আরেকবার আয়ানের হাতে সিরিয়াস একটা ধোলাই খাবে সেটা বলাই বাহুল্য। একজন নার্স এসে সীমান্তের মুখে, নাকের রক্ত মুছে ওষুধ লাগিয়ে দিয়েছে। মাথায়ও ব্যান্ডেজ করা হয়েছে। এই অবস্থাতেও সীমান্ত বেশ আগ্রহের সাথেই আয়ানকে মায়রার আর নিজের কাহিনী শুনিয়ে যাচ্ছে অবলীলায়। আর তার পাশে বসে সায়না ওদের দুজনকেই নজরে রাখার চেষ্টা করছে। শান্ত সমুদ্রে আবার কখন ঝড় ওঠে কে জানে!

-গাড়ি থেকে নেমে যে মেয়েটার সাথে পরিচিত হবো তার কোনো সুযোগই ছিল না তখন। তাছাড়া অনেকগুলো প্রপোজাল রিজেক্ট করার পর তাথৈয়ের ছবি দেখে হ্যাঁ বলেছিলাম বিয়ের জন্য। এখন ওকে সরাসরি দেখতে যাওয়ার পথে মানা করার সাহস আমার হলো না। অবশ্য যার জন্য জোর গলায় বিয়ে করবো না বলবো না জানি তার নাম, না কিছু। অবশ্য তাথৈকে দেখতে গিয়ে আবার যখন ওকে দেখলাম তখন কি ফিল করেছি সেটা আপনাকে বলে বোঝাতে পারবো না আয়ান।

-তারপর?

-তাথৈয়ের ফ্যামেলি সহজভাবেই বিয়েতে রাজি হয়ে যায়। তাথৈকে দেখে যদিও বেশ বুঝতে পারছিলাম ও বিয়েটা করতে চাইছে না। এদিকে বাবা মায়েরও তাথৈকে বেশ পছন্দ হয়েছে। সুতরাং আমার না কথাটা বলার আর কোনো সুযোগই নেই। পরেরদিন অবশ্য তাথৈ আমাকে কল করে একটা ক্যাফেতে দেখা করতে বলে। আমি জানতাম এমনটাই ঘটবে। তাথৈয়ের কলেরই অপেক্ষায় ছিলাম। ক্যাফেতে দেখা হয় তাথৈ আর রিহানের সাথে। তাথৈয়ের কাছেই জানতে পারি ও বাসায় রিহানের কথা জানানোর পরও রাজি হয়নি। ছেলেটা ভালো জব করে। কিন্তু বাবা মা নেই। এটাই ওর দোষ। আমার পক্ষে না বলার উপায় নেই জানানোর পর রিহান রেগে গিয়ে সেখান থেকে চলে যায়। আর সাথে তাথৈও। 

-হোয়াট!

-সেদিন রাতে তাথৈ আমাকে আবার কল দিয়ে জানায় ও রিহানের সাথে পালিয়ে যাবে। তাথৈ আমাকে সরি বলতে কলটা করেছিল। তাথৈ চলে যাওয়ার পর মায়রার ব্যাপারে বাবা মাকে কনভেন্স করতে কয়েকদিন সময় লেগেছে। মা কিছুতেই রাজি ছিল না প্রথমে। পরে বাবার আর আমার কথায় রাজি হয়। মায়রার বাবাও আমাদের প্রস্তাবটা খুশি হয়েই মেনে নেয়। বিয়ের আগে--- মায়রার সাথে আলাদা করে কথা বলার সুযোগ আমার হয়নি। জানি না কেন ওর ফ্যামেলি থেকে বিয়েটা নিয়ে একটা তাড়াহুড়ো ছিল শুরু থেকেই। আমিও আর না করি নি। প্রথম ভালোলাগার মানুষটাকে বিয়ে করছি, এক্সসাইটমেন্ট ছিল প্রচন্ড। তাই মায়রাকে আলাদা করে কিছু জিজ্ঞেস করার ইচ্ছে হয়নি। অথবা সাহসও হয়নি---।

-তা-তার-তারপর? তারপর কি হলো? যদি এতোই ভালোবাসতে তাহলে এমন কষ্ট দিলে কি করে? একবারও বুকটা কেঁপে উঠে নি তোমার? এই ফুলের মতো মেয়েটাকে এভাবে----এভাবে জানোয়ারের মতো আঘাত করতে বিবেকে বাঁধে নি তোমার একবার?

আয়ান চোখজোড়ায় আবার রক্তলাল বর্ণ ধারণ করতে শুরু করেছে। সীমান্ত একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে হেসে আবার বলা শুরু করলো। 

-প্রথমদিন মায়রা আমার কোনো কথাতেই তেমন রেসপন্স করছিলো না দেখে বিরক্ত হচ্ছিলাম। জানতে চাইলাম কেউ ছিল কিনা। ও তখনও চুপ ছিল। ভাবলাম এভাবে হুট করে বিয়ে হওয়ায় মেয়েটা হেজিটেট ফিল করছে। আমিও ওর হেজিটেশন কাটানোর চেষ্টা করলাম---। বুঝতে পারছিলাম বাড়িতে থাকলে একজন একেকটা কথা শোনাবে যাতে ওর আরো খারাপ লাগবে। বিশেষ করে মা। উনি একে তো তাথৈয়ের ব্যাপারটা নিয়ে রেগে ছিলেন, তার উপরে মায়রার সাথে বিয়েতে মায়ের মতও ছিল না। আমি শিওর জানতাম মায়রাকে কথা শোনাতে সুযোগ পেলে মা ছাড়বেন না। তাই বিয়ের পরদিন সকালেই মা বাবাকে বলে দিই আমি মায়রাকে নিয়ে ঢাকা ব্যাক করবো। বাবা ব্যাপারটায় তেমন রিএ্যাক্ট করলেন না। কারণ আমি অলরেডি ১৫ দিনের ছুটি কাটিয়ে ফেলেছি। কিন্তু মা এসব কিছুই বুঝলেন না। উনি এক প্রকার ধরেই নিয়েছেন মায়রা নিজে থেকেই উনাদের সাথে থাকতে চাইছেন না। অবশ্য তখনও কথাগুলো আমি জানতাম না।

-হুম। 

-ঢাকায় আমাদের দিনগুলো একটু অদ্ভুত কাটছিলো। একদিকে এক্সট্রা ছুটি নেয়ায় কাজের প্রেশার আর অন্যদিকে মায়রার নিস্তব্ধতা। ও কখনো আমাকে কিছু বলতো না। ধরুন রান্না করতে গিয়ে হাত কেটেছে বা হাত পুড়েছে, ব্যথায় সারাদিন ছটফট করছে কিন্তু সেটা আমাকে কখনো বলতো না। ওকে কাছে টানলে কখনো বাধা দিতো না, আবার নিজে থেকে এসে ধরা দেয়ার ব্যাপারটা আমাদের ছয়মাসের দাম্পত্য জীবনে কখনো হয়েছে কিনা সন্দেহ।

----------------------------

-ইউ নো? প্রথম মিলনের পর একটা মেয়ের চোখে পানি দেখলে সেটাকে স্যাটিসফেকশন বা তৃপ্তির বলে ধরে নেয়া যায়। কিন্তু প্রত্যেকবার মিলনের পরে একটা মেয়ে রীতিমতো কাঁদতে কাঁদতে রাতটা পার করে দেয় তাহলে সেটাকে কি বলবেন? আমারও তাই মনে হচ্ছিল মায়রা কিছু একটা লুকাচ্ছে আমার কাছ থেকে। খারাপ লাগছিলো নাকি রাগ হচ্ছিল জানি না। মায়রার সাথে মিসবিহেভ করে ফেলছিলাম। ও তবু কিছুই বলতো না। ব্যাপারটা আমার রাগটাকে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছিলো। এসব করতে করতে তিনমাস কাটে আমাদের বিয়ের। আমার ফ্রেন্ড মাহিব আর ওর ওয়াইফ তিয়া একদিন বাসায় আসে। শপিংয়ে নিয়ে যায় মায়রাকে। আমার সেদিন অফিসে বেশি কাজ ছিল না। তাই মায়রার ব্যাপারে একটু খোঁজ খবর নেয়া শুরু করি। ওর কলেজ থেকেই আপনার আর মায়রার প্রায় চার বছরের রিলেশনের কথাটা জানতে পারি। জানি না কেন মানতে কষ্ট হচ্ছিল। এতোদিনের রিলেশন ছেড়ে এসেছে, আমাকেও কিছু জানানোর প্রয়োজনও মনে করে নি। সব মিলিয়ে মাথা পুরো ব্ল্যাঙ্ক হয়ে গেছিলো আমার। বাসায় কি করে ফিরেছি আমি জানি না। আর সেদিন প্রথমবার ওর গায়ে হাত তুলি আমি।

---------------------------

-পরদিন সকালে মায়রাকে সরিও বলেছিলাম আমার রাফ বিহেভের জন্য। সন্ধ্যার জন্য স্পেশাল প্ল্যান করেছিলাম। পুরো ব্যাপারটা ওর সাথে ক্লিয়ার করা উচিত মনে হয়েছিল। কিন্তু সেটা আর হয় নি। বাসায় ফিরে এসে দেখি ও নেই। একাই চলে গেছে। রাগের মাথায় রাতে বলেছিলাম চলে যেতে। এবারে রাগটা আরো বেশি হলো। মনে হলো ও আসলেই আমার সাথে থাকতে চায় না বলেই চলে গেছে। হয়তো বাড়ি না গিয়ে আপনার কাছে---। আমি আর ভাবতে পারছিলাম না। তখনই রওনা দিই গাড়ি নিয়ে। এতো স্পিডে গাড়ি ছুটিয়েছি যে কয়েকবার এক্সিডেন্ট হতে হতে বেঁচে যাওয়া যাকে বলে---। জার্নি সিকনেসের কারণে আর কান্নাকাটি করে ঘুমিয়েছিল মেয়েটা। আমাকে একদমই আশা করে নি। আসতেও চায় নি। কিন্তু কোনোভাবে ওর মা ওকে কনভেন্স করেছেন। ও ওই অবস্থাতেই আমার সাথে আবার ঢাকায় ব্যাক করে। 

-হুম। তারপর?

-তারপর? মায়রার চোখমুখের ক্লান্তি আমাকে স্পর্শ করতে পারে নি। মনে হচ্ছিল ও ছলনা করেছে আমার সাথে। ওর কাছে আমার ইমেজটা কতোটা খারাপ সেটাও বুঝতে পারলাম। রাগ আরো বেড়ে গেল। রীতিমতো হিংস্র হয়ে গেলাম। যাকে চাই তাকে জোর করে, শাসন করে আটকে রাখতে চাইলাম। কিন্তু একটা কথা তখন বুঝতে পারি নি। জোর করে ভালোবাসা হয়না---।

-সবটা জানতেই যদি তাহলে ওকে এতো কষ্ট দিতে গেলে কেন? ওর সাথে সবটা শেয়ার করতে পারতে। তারপর দুজনে একসাথে সিদ্ধান্ত নিতে---। এভাবে---।

-ওকে আপনার কথা জিজ্ঞেস করলে হয়তো বলতো সবটা। কিন্তু তারপর? কয়েকটা মাস চেষ্টা করেছি ওকে ভালো রাখতে। কিন্তু ছয়টা মাসে একটা রাতও ঠিক করে ঘুমাতে দেখি নি ওকে। ক্লান্ত শরীর হার মেনে নেতিয়ে পড়েছে, কিন্তু সেটাকে আর যাই বলুক ঘুম বলে না মিস্টার আয়ান। ব্যাপারটা শুধু আমি টের পাচ্ছিলাম তেমনও না। মাহিব ওর ওয়াইফকে নিয়ে প্রায় অফডেতে বাসায় আসতো। ওরাও টের পেতো। ওই ঘন্টা দুয়েক সময়ই আমি মায়রার ঠোঁটের কোণে হাসি দেখতে পেতাম। মাহিবের সাথে এ ব্যাপারে অনেক পরামর্শও করেছি। মায়রাকে ভালো রাখার, ভালোবাসার চেষ্টা করেছি। কিন্তু ওকে ছাড়ার সাহস ছিল না।

---------------------------

-ভেবেছিলাম ফ্যামেলি প্ল্যানিং করি। ধীরে ধীরে ও সবটা ভুলে যাবে। তখন পর্যন্ত আমার জানা ছিল না আপনার সাথে ওর বিয়েটা শেষ পর্যন্ত হয়নি কেন। ভেবেছিলাম কোনো কারণে ব্রেকআপ হয়ে গেছে বা আপনিই চলে গেছেন। তাই মায়রাকে নিয়ে নতুন করে একটা সংসার সাজানোর চিন্তা করলাম। ওর বার্থডের দিনটা অসম্ভব ভালো কেটেছিল আমার। রান্না করতে গিয়ে হাত পুড়িয়ে ফেলেছিল। ভেবেছিলাম দিনটা আমার যেমন ভালো লেগেছে ওরও ভালো লেগেছে। কিন্তু না। ওর নির্ঘুম রাতের লিস্টে আরেকটা রাত যোগ হলো। 

---------------------------

-তবু মায়রার থেকে আলাদা হওয়ার কথাটা আমি ভাবতে পারছিলাম না। পরের দিন মায়রাকে কল করে শুনলাম মামা মামি এসেছে। কলটা কাটার প্রায় সাথেসাথে একটা নাম্বারে কল এলো। মায়রার একটা ফ্রেন্ড কল করেছিল। ওদের রিইউনিয়নের কথা বলার জন্য। ওকে অনেক রিকুয়েষ্ট করার পর জানতে পারলাম মায়রা ওর বাবা মায়ের চাপে বিয়েতে রাজি হয়েছে। জানি না কেন নিজেকে বড্ড বেশিই অপরাধী লাগছিলো। মেয়েটা তাথৈয়ের মতো নিজের পছন্দের কথাটা আমাকে জানাতেও পারে নি, এমনকি এতোগুলো দিন ইচ্ছের বিরুদ্ধে চাপানো একটা সংসারে নিজেকে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছিলো। আমি মায়রাকে আর আটকে রাখতে চাই নি এই চাপিয়ে দেয়া সম্পর্কটায়। কিন্তু এটাও জানতাম তোমার কাছে ফিরতে পারবে জানলেও বিয়ের মতো পবিত্র একটা সম্পর্ক ভাঙ্গতে মায়রা কিছুতেই রাজি হবে না। তাই একটা প্ল্যান করলাম---।

-প্ল্যান? কিসের প্ল্যান?

-আমি জানতাম আমি যাই করি মায়রা আমাকে ডিভোর্স কিছুতেই দিবে না। তাই----। মায়রা মামা মামির সাথে এখানে আসবে বলায় আমি মানা করে দিই। সেদিন ইচ্ছে করেই ওকে মেরেছিলাম। পরের দিন ওকে যাওয়ার সময়ও কিছু বলিনি। এক সপ্তাহ পরও কোনো খবর না পেয়ে নিজেই চট্টগ্রামে চলে এলাম। মায়রা বাসায় ছিলো না। মামা মামীর রিএ্যাকশন দেখে বুঝতে পারলাম মায়রা বাসায় কিছু বলে নি। তাই মায়রার সুখের জন্য----। সেদিন মায়রাকে করা প্রত্যেকটা আঘাত আমার নিজের বুকে এসে লাগছিলো। আমি চাইছিলাম মায়রা সুখে নেই, ভালো নেই সেটা ওর ফ্যামেলি জানুক। তারা নিজেরা কোনো সিদ্ধান্তে আসুক। 

-হোয়াট! আর ইউ ক্রেজি?

-এতো কিছুর পরও, মেয়েটাকে সবাই মিলে এতো করে বোঝানোর পরও ডিভোর্স দিতে চায় নি। তাই আমি নিজেই সব ব্যবস্থা করলাম। মায়রা তাথৈ আর রিহানের সাথে কক্সবাজার গেছে জানতে পেরে সেখানেই চলে গেলাম। সবার সামনে একটা সিনক্রিয়েট করলাম যাতে ও রেগে গিয়ে ডিভোর্স পেপারে সাইনটা করে দেয়। -----পরে অবশ্য জানতে পারলাম আপনি আর আপনার ফ্রেন্ডরাও সেখানে ছিলেন। তাই নিশ্চিতেই ফিরে এলাম। জানতাম এবার অন্তত মেয়েটা নিজের ভাগ্যের হাসি, আনন্দটুকু ফিরে পাবে। 

কথাগুলো বলা শেষ হতেই সীমান্ত মাথা নিচু করে বসে রইলো। পাশে সায়নার চোখের পানি ঝড়ছে ঝর্ণার মতো। আর আয়ান? সে অবাক হয়ে সীমান্তের দিকে তাকিয়ে রইলো। আয়ান বুঝতে পারছে না ওর সামনে বসে থাকা এই লোকটার কথা বিশ্বাস করা উচিত না কি শাস্তি দেয়া উচিত। যতোটা কষ্ট এই লোকটা মায়রাকে দিয়েছে তার কয়েক গুণ বেশি শাস্তি দিবে না কি মায়রাকে ওর জীবনে ফিরিয়ে দিয়েছে বলে ধন্যবাদ জানাবে।
Author, Publisher & Developer

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

উফ!
মনে হচ্ছে আপনার ইন্টারনেট সংযোগে কিছু সমস্যা আছে। অনুগ্রহ করে আগে আপনার ইন্টারনেটের সংযোগ ঠিক করুন এবং তারপর আবার ব্রাউজিং শুরু করুন৷
AdBlock সনাক্ত করা হয়েছে!
আমরা শনাক্ত করেছি যে আপনি আপনার ব্রাউজারে অ্যাডব্লকিং প্লাগইন ব্যবহার করছেন৷ আমরা আপনাকে আপনার অ্যাডব্লকিং প্লাগইন বন্ধ করার জন্য অনুরোধ করছি, কারন বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে আমরা যে রাজস্ব আয় করি তা এই ওয়েবসাইট পরিচালনার জন্য ব্যবহৃত হয়।