বকুল ফুলের মালা - পর্ব ২৯ - সুলতানা পারভীন - ধারাবাহিক গল্প


৫৭!! 

-তোদের যা ইচ্ছে হয় কর। আমি আর একটা কথাও বলবো না---।

আয়ানের মা রাগে আর কিছু না বলতে পারলেন না৷ ধুমধাম পা ফেলে সিঁড়ি বেয়ে নিজের রুমের দিকে চলে গেলেন। আয়ান তখনও চুপ করে দাঁড়িয়ে ভাবছিল। সায়না এক নজর আয়ানের দিকে তাকিয়ে নিজের লাগেজটা নিয়ে বের হওয়ার জন্য পা বাড়ালো। আবার কি মনে হতে সায়না ঘুরে আয়ানের দিকে তাকালো। 

-আসছি রে আয়ান। ভালো থাকিস তোরা দুজনে। সুখে থাকিস।

আয়ান মুখ শক্ত করে এক পা এক পা করে সায়নার সামনে এসে দাঁড়ালো। সায়না এবারে একটু ইতস্তত করে অন্য দিকে তাকিয়ে আয়ানের থেকে চোখ সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করলো। এতে আয়ানের ভ্রু জোড়া আরেকটু কুঁচকে গেল।

-এবার কি নতুন নাটক শুরু করেছিস সায়না? এবারে আর একটাও নাটক করার চেষ্টা করলে সত্যি সত্যি তোকে খুন করে ফেলবো বলে দিলাম। আমার আর মায়রার মাঝে আমি কাউকে এলাউ করবো না। তোকে তো নয়ই---। তুই মায়ের চোখে ফাঁকি দিতে পারবি, আমার চোখে না---।

-তোর নজর আমার উপরে ছিল কবে বল যে এখন তোর নজর ফাঁকি দিবো? 

-একটাও আজাইরা নাটক করবি তো তোকে আমি সায়না----।

-কি করবি? মারবি? যে তোর বিরহে আগেই মরে আছে তাকে মেরে কি করবি? এর চেয়ে মেরেই ফেল না? ভালো হবে--। তুইও শান্তিতে থাকবি, আর আমিও----।

-আবার শুরু করেছিস? তোর লজ্জা করে না একটুও বল তো? তোকে কয় শ বার বলেছি আমাকে তোর এসব ফালতু কাহিনী শুনাতে আসবি না। অমুক দিন অমুকের সাথে রিলেশন হয়েছে, তমুক দিন তার সাথে ব্রেকাপ হয়েছে, সমুক দিন সে আবার ব্যাক করতে চাইছে--। এতো অপমান করার পরও কেন আমাকে এসব শোনাতে আসিস তুই? লজ্জা বলে কি তোর শরীরে কিছু নেই? ছি!

-হাহ---। তুই আমাকে কখনোই বুঝলি না আয়ান। তোকে ভালোবেসে নিজের সমস্ত লাজ লজ্জা বিসর্জন দিয়ে দিয়েছি, তোকে পাগলের মতো করে চেয়েছি। তবু কোনোদিন তুই আমাকে বুঝতেই পারলি না। ---। জানিস? ওই যে রিয়ান, সাদমান, রবিন এসব নামের কেউই আমার জীবনে কখনোই ছিল না। আমি শুধু তোকে ওদের কথা বলে জেলাস ফিল করানোর চেষ্টা করতাম। আমার জীবনে তুই ছাড়া আর কখনো কেউ ছিলই না রে। বিশ্বাস কর। 

-আমি তোর জীবনে কখনোই ছিলাম না সায়না। তুই আমার কাজিনের চেয়েও ভালো বন্ধু ছিলি। কিন্তু বন্ধুত্বের সম্মানটুকু তুই রাখতে পারিস নি---। 

-আমি জানি আয়ান---। আমি ভুল করেছিলাম। তার জন্য তো কত বার ক্ষমাও চেয়েছি তোর কাছে বল? একটা বারের জন্যও কি ক্ষমা করে কাছে টেনে নিতে পারতি না তুই?

-সব অন্যায়ের ক্ষমা হয় না সায়না। তুই যে শুধু আমার সাথে অন্যায় করেছিস তাও না---। তুই আরিশার কাছেও আমাকে ক্যারেক্টারলেস প্রমাণ করার চেষ্টা করেছিস---।

-আমি শুধু চেয়েছিলাম ও যেন তোর জীবন থেকে সরে যায়---। আমি শুধু তোকে চেয়েছিলাম আয়ান। শুধু তোকে, শুধু তোকে----।

কথাগুলো বলতে বলতে সায়নার গলা বুজে আসলো। কোনোমতে কান্না চেপে পিছন দিকে ঘুরে দাঁড়ালো সায়না। আয়ান ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। 

-আমার জীবনে তুই আর আরিশা দুজনেই সবচেয়ে ইম্পর্ট্যান্ট মানুষ ছিলি। কিন্তু তুই তোর দোষে সেই জায়গাটা হারাোি সায়না৷ আর এখন? এখন আমার কাছে মায়রার চেয়ে বেশি কিচ্ছু নেই। কেউ না৷ ওর কোনোভাবে কোন ক্ষতি হোক সেটা আমি কখনো মেনে নিবো না---।

-জানিস? এতোদিন একটা আশায় ছিলাম--। ভেবেছিলাম অন্তত এবারে তুই আমাকে--। তোর বিয়ের খবরটা শুনে কি কষ্ট পেয়েছিলাম জানিস? তারপর তোর ওভাবে অপমান! কিন্তু মায়রার ঘটনাটা জানার পর আমি ভেবেছিলাম ওরা হয়তো তোকে না জানিয়েই বিয়েটা দিয়েছে---। কিন্তু যখন জানলাম তুই নিজে সবটা জানতি তখন আমার শেষ সুযোগটাও হারিয়ে গেছে। 

---------------------------

-আর কাল রাতে তোকে আর মায়রাকে দেখে আমার এতোদিনের সমস্ত ভুল ভেঙ্গে গেছে একদম। তোদের দুজনকে কতোটা স্নিগ্ধ আর সুখি লাগছিল একসাথে! একদম পরিপূর্ণ দুজন মানুষ! যতক্ষণ এখানে চোখের সামনে তোদেরকে দেখবো কিছুতেই শান্তি পাবো না রে। বেহায়া মন তো বল? হয়তো ভুল করে আবার তোকে পেতে চাইবে, তাই চলে যাচ্ছি আমি---। আর তোদের মাঝে আসবো না প্রমিস। আর আমি চলে গেলে দেখবি খালামনি আর মায়রার সম্পর্কটাও ভালো হবে---। খালামনি কতক্ষণ আর রাগ করে থাকবে? 

-তুই সত্যি চলে যাচ্ছিস?

-হ্যাঁ রে---।।সত্যি চলে যাচ্ছি--। ঘন্টা খানেক পরে আমার বাস ছাড়বে---। 

-সায়না আপু? কোথায় যাচ্ছেন আপনি?

মায়রার গলার আওয়াজ শুনে আয়ান পিছনে ফিরতেই দেখলো মায়রা সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসছে। সায়নাও নিজের চোখজোড়া মুছে নিয়ে মায়রার দিকে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করলো। 

-ভাবি চলে এসেছ? তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম এতোক্ষণ। আমি ঢাকায় ব্যাক করছি---।

-আরো কয়েকটা দিন থাকতেন? কত মজার মজার গল্প করতাম আমরা সবাই মিলে?

-পরেরবার আসলে অনেক গল্প করবো গো ভাবি। এবারে আমাকে ছেড়ে দাও কেমন? অবশ্য তোমার সাথে আমার কয়টা কথা বলার আছে--। চলো যেতে যেতে বলি?

মায়রা সায়নার সাথে এক পা সামনে বাড়াতেই আয়ান মায়রার হাত টেনে ধরলো। সায়নার কথা কতোটুকু বিশ্বাস করবে সেটা আয়ান এখনো ঠিক করতে পারছে না। কিন্তু সায়না মায়রাকে কিছু বলবে বলায় আয়ানের কেমন একটা ইতস্তত লাগছে আবার। এই মেয়েটাকে আয়ান এতো সহজে কি করে বিশ্বাস করবে? এটা ওর নতুন কোনো নাটক নয় এটা কি করে মেনে নিবে?

-উফফ। আয়ান? তোর বউকে কিডন্যাপ করছি না আমি। কয়েকটা কথা বলবো ব্যাস---। 

-কথাগুলো আমার সামনেও বলা যায়।

-উঁহু--। না বলা যায় না। সব কথা সবার শুনতে হয়। তুই পরে ওর কাছেই শুনে নিস---। এসো তো ভাবি? 

মায়রা একবার আকুতি ভরা চোখে তাকাতেই আয়ান মায়রার হাত ছেড়ে দিয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। আর মায়রা আর সায়না দুজনেই এক মূহুর্তের জন্য আয়ানের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মেইনডোরের দিকে পা বাড়ালো। 

-জানো ভাবি? তুমি অনেক লাকি। আয়ানের মতো একজন মানুষের ভালোবাসা পাওয়া, তাকে স্বামী হিসেবে পাওয়া আসলেই সবার কপালে থাকে না। ও আর যাই হোক তোমাকে অনেক সুখে রাখবে এটাই আমার বিশ্বাস---।

-হ্যাঁ আপু।

-আর ভাবি? আমার উপরে রাগ করে থেকো না। আমি ছোটবেলা থেকে এই মানুষটাকে দেখে বড় হয়েছি। কারণে অকারণে তার উপরেই অধিকার খাটিয়েছি। কিশোরী মনের লুকানো আমার সমস্ত ভালোবাসা উজাড় করে পেতে চেয়েছিলাম তাকে। কিন্তু কি বলো তো? ওর মনে আমি কখনো ছিলামই না। ওর ইগনোরেন্সের কারণে আমারও ওকে পাওয়ার জেদ চেপে গেল। জোর করে ভালোবাসা হয় না কথাটা বোঝার চেষ্টা করি নি একবারও। ওর জীবনে আসা প্রত্যেকটা মানুষকে আমি ওর জীবন থেকে দূরে সরাতে চেয়েছিলাম। আরিশার সাথে ওকে দেখলে কি যে রাগ হতো আমি তোমাকে বলে বোঝাতে পারবো না---। ওকেও সরানোর চেষ্টা করলাম। হলো না। কিছুদিন পর জানলাম আয়ান নিজে দাঁড়িয়ে থেকে আরিশা আর তাওহীদের বিয়েটা করিয়েছে। তখন বুঝতে পারলাম কি ভুলটাই না আমি করেছি!

---------------------------

-ভালোবাসার একটা সহজ সূত্র আমি ভুলে গিয়েছিলাম। কাউকে ভালোবাসলে কোনো স্বার্থ ছাড়াই ভালোবাসতে হয়--। অন্য মানুষটাও আমাকে ভালোবাসবে এটা আশা করা নেহাৎ বোকামি ছাড়া আর কিচ্ছু না। তাই না বলো?

-সায়না?

-তোমার সাথে কি ঘটেছিল আমি সত্যিই কিছু জানতাম না। শুধু আয়ানকে পাবার জেদ থেকেই খালামনিকে সবটা বলে দিয়েছিলাম। হয়তো যা জেনেছি তার চেয়ে বাড়িয়েও বলেছি---। আম সরি ভাবি। পারলে ক্ষমা করে দিও।

----------------------------

-কাল আমি ইচ্ছে করেই তোমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে খালামনিকে কথাগুলো বলছিলাম। তুমি কিছু মনে করো না প্লিজ? আয়ান তোমাকে পেয়ে কতোটা খুশি সেটা আর কেউ জানুক না জানুক ওকে দেখলে সেটা আমি বুঝতে পারি। তুমিও বুঝতে পারো তাই না? সবসময় এভাবেই ওর পাশে থেকো। কেমন?

-হুম----।

-আর পারলে আমাকে মাফ করে দিও। আমার কারণেই তোমার---।

-তোমার উপরে আমার আর কোন রাগ নেই আপু। তুমি যে নিজের ভুলটা বুঝতে পেরেছ সেটাই বেশি ইম্পর্ট্যান্ট----।

-হুম ভাবি। নিজেকে শোধানোর চেষ্টা করবো। আয়ান হয়তো আমাকে ক্ষমা বা বিশ্বাস কোনটাই করতে পারবে না কখনো। কিন্তু বিশ্বাস করো আমি আর কখনো তোমাদের মাঝে আসবো না। ককনো না।

-সায়না? আপু? এভাবে কেঁদো না প্লিজ?

-আসছি ভাবি--। পারলে ছোট বোন মনে করে মাফ করে দিও। আর নিজের সংসারটা সামলে রেখো। সবাইকে নিয়ে ভালো থেকো--। আসি।

সায়না আর এক মূহুর্তও না দাঁড়িয়ে হনহন করে বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে। আর মায়রা থ হয়ে সায়নার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। নিজের ভালোবাসাকে ভুলে থাকার চেষ্টা করা কতোটা কঠিন আর কষ্টের সেটা মায়রাও বোঝে। আর বোঝে বলেই হয়তো সায়নাকে ও মন থেকেই মাফ করতে পেরেছে। আর চাইছে মেয়েটা যেন যেখানেই থাকে ভালো থাকে। যেন সব ভুলে নতুন করে নিজের জীবনটা শুরু করতে পারে এটাই মনে মনে দোয়া করলো মায়রা।

৫৮!! 

দেখতে দেখতে পুরো একটা সপ্তাহ কেটে গেছে। এই সাতটা দিনে খুব বেশি কিছু পরিবর্তন না হলেও রান্নাঘরে শাশুড়ির পাশে দাঁড়িয়ে কাজ করার অধিকারটা পেয়েছে মায়রা। টুকটাক  প্রয়োজনীয় কথার বাইরে মায়রার সাথে একটা কথাও বলেন না আয়ানের মা। অথচ মায়রার ছোটখাটো কোনো ভুল হলে সেটা নিজেই ঠিক করে দেন। এই যে সেদিন মাংস রান্নার সময় হাত ফসকে একটু বেশিই লবণ পড়ে গিয়েছিল। বেচারির তো ভয়ে রীতিমতো হাত পা কাঁপতে শুরু করেছে। ভয়ে ভয়ে শাশুড়িকে কথাটা জানাতেই তিনি তাড়াতাড়ি দুটো আলু কেটে মাংসে দিয়ে দিলেন। খাওয়ার সময় দেখা গেল কেউ লবণ বেশি হওয়ার ব্যাপারটা টেরই পেল না। মায়রা তো জাস্ট হা করে তাকিয়ে রইলো শাশুড়ির দিকে৷ 'বাপের বাড়ি থেকে কি শিখে এসেছ' এমন ধরনের কথার খোঁচার বদলে মানুষটার নিরব সহযোগিতায় মায়রা বেশি আশ্চর্য হয়েছে নাকি তৃপ্ত হয়েছে সেটা বোঝা গেল না ওর মুখ দেখে। অবশ্য এরকম বেশ কয়েকটা ঘটনাই ঘটে গেছে গত কয়দিনে। মায়রাও নিজের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে চেষ্টা করছে শাশুড়ির মন জুগিয়ে চলতে। কতোটুকু সফল হচ্ছে সেটা যদিও বোঝা যাচ্ছে খুব একটা৷ 

আজ মায়রা রাতের রান্না করার জন্য রান্নাঘরে এসে শাশুড়িকে না দেখতে পেয়ে কিছুটা অবাক হলো। কাজের ফাঁকে ফাঁকে একটু পর পরই রান্নাঘরের দরজার দিকে চোখ চলে যাচ্ছে মায়রার৷ দেখতে দেখতে রান্নাও শেষ হলো। কিন্তু শাশুড়ি এলো না দেখে এবারে মায়রার চিন্তা হতে লাগলো। এর আগে এমনটা কখনোই হয়নি। বিকেলেও নাস্তা করার সময় কেমন থমথমে মুখ করে বসেছিলেন মানুষটা৷ মায়রা আঁচলে হাত মুছতে মুছতে কিছু একটা ভাবলো। এভাবে অপেক্ষা করার চেয়ে শাশুড়ির রুমে গিয়ে দেখে আসাটাই বেশি যুক্তিযুক্ত মনে হলো মায়রার৷ খাবারগুলো টেবিলের উপরে ঢেকে রেখে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠবে এমন সময় কলিংবেলের আওয়াজ শুনে থেমে গেল মায়রা৷ তাড়াতাড়ি গিয়ে মেইনডোরের দরজা খুলে দিতেই আয়ানকে দেখতে পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো মায়রা৷ আয়ানও মায়রার চোখে মুখে ফুটে থাকা টেনশনটা টের পেল। তাই দরজা বন্ধ করে মায়রার সামনে দাঁড়িয়ে মায়রার গালে হাত ছুঁইয়ে দিলো। 

-কি হয়েছে মায়রা? এমন দেখাচ্ছে কেন তোমাকে?

-দেখো না? মা বিকেলে নাস্তা করে রুমে চলে গেছে। আমি রান্না করতে এসে দেখি মা রান্নাঘরে নেই৷ এতোক্ষণ হয়ে গেল মা একবারও আসে নি নিচে---।

-সে কি? চলো তো দেখি কি হয়েছে?

-আমার ভয় করছে আয়ান----।

-আরে ধুর পাগলি। মা হয়তো অজিফা পড়ছে। তাই নিচে আসে নি। চলো গিয়ে দেখি---। 

-হুম----।

আয়ান আর মায়রা দুজনেই এসে দেখলো রুমের দরজাটা হালকা ভেজিয়ে দেয়া। আয়ান একবার মায়রার দিকে তাকিয়ে দরজায় হালকা করে নক করলো। ভিতর থেকে কোন শব্দ হলো না। আয়ান আরেকবার নক করলো। এবারে একটু জোরে। 

-মা? আসবো?

এবারেও কোনো জবাব এলো না রুমের ভিতর থেকে। আয়ান আর অপেক্ষা করলো না। দরজা ঠেলে রুমে ঢুকে পড়লো। আর আয়ানের পিছু পিছু মায়রাও রুমে ঢুকলো। আর রুমে ঢুকেই দুজনেই রীতিমতো ঝটকা খেল। আয়ানের মা বিছানায় নেতিয়ে পড়ে আছেন। চোখ বন্ধ, কেমন একটা অবচেতন ভাব ফুটে আছে চেহারায়৷ সাথে রাজ্যের ক্লান্তিতে যেন মুখটা শুকিয়ে গেছে অনেকখানি। আয়ান মায়রা দুজনেই ছুটে এসে মায়ের কাছে এলো। মায়রা শাশুড়ির কপালে হাত দিয়ে দেখলো জ্বরে শরীর যেন পুড়ে যাচ্ছে। আয়ান ফ্লোরে বসে মায়ের হাত ঘষতে শুরু করেছে ততক্ষণে। 

-মায়ের তো অনেক জ্বর। আয়ান? এভাবে হবে না। তুমি একটা বাটিতে করে পানি এনে দাও না প্লিজ? মায়ের মাথায় জলপট্টি দিতে হবে-।

-আনছি---। ধুর এই সময়ই বাবাকে কাজের জন্য সিলেটে যেতে হলো! 

-তাড়াতাড়ি করো না?

-হ্যাঁ হ্যাঁ--। যাচ্ছি---। 

আয়ান একটা বাটিতে করে পানি আর একটা রুমাল ভিজিয়ে এনে মায়রাকে দিতেই মায়রা শাশুড়ীর মাথায় জলপট্টি দেয়া শুরু করলো। বেশ কিছুক্ষণ কেটে যাওয়ার পরও মায়ের চোখ খোলার কোন নাম নেই৷ মায়রা মাথায় পানি দিচ্ছে, হাত পা ভেজা রুমাল দিয়ে মুছে দিয়েছে, আর আয়ান একটু পর পর হাত পা ঘষছে মায়ের৷ তবু মা চোখ খুলছে না দেখে আয়ানও এবারে খানিকটা ভয় পেল। মায়রার তো কেঁদে ফেলার অবস্থা হয়েছে৷ আয়ান উঠে দাঁড়িয়ে মোবাইলে কিছু একটা ডায়েল করলো।

-মায়ের রেগুলার চেকআপ করে সাইফ আঙ্কেল। উনাকে খবর দেয়া দরকার। লোকটার নাম্বারটা পাচ্ছি না কেন? উফ!

-বাবাকে কল দাও না? বাবার কাছে থাকবে ডাক্তার আঙ্কেলের নাম্বার।

-হ্যাঁ ঠিক বলেছ---। বাবাকেও তো জানাতে হবে---।

আয়ান বাবাকে কল করে সবটা জানাতেই বাবাও ডাক্তার সাইফ মির্জাকে কল করবেন বললেন। আর ওদেরকে চিন্তা করতে মানা করলেন। আধা ঘন্টার মতো পরে ডাক্তার সাইফ মির্জা এসে আয়ানের মাকে চেকআপ করে জ্ঞান ফেরার জন্য ইনজেকশন দিলো। বেশ কিছুক্ষণ পর আয়ানের মা চোখ খোলার চেষ্টা করছেন দেখে ডাক্তার সাইফ মির্জা উনার চোখ, নাড়ি চেক করে প্রেসক্রিপশনে কয়েকটা ওষুধের নাম লিখে আয়ানের হাতে ধরিয়ে দিলো। 

-এই নাও আয়ান। এই ওষুধগুলো যত তাড়াতাড়ি পারো আনার চেষ্টা করো। আর ভাবির এই অবস্থা হলো কি করে?

-সেটাই বুঝতে পারছি না আমি আঙ্কেল। বিকেলে নাস্তা করে যে রুমে গেছে তারপর অনেকক্ষণ রুম থেকে বের হয়নি। তাই মায়রা আর আমি গিয়ে দেখি মা অচেতন হয়ে বিছানায় পড়ে আছে----।

-হুম। আই সি। ভাবির ব্লাড প্রেশারটা সাংঘাতিক পরিমাণে ফল করেছে৷ বেশ কয়েকদিন ঠিক মতো না খাওয়ার ফলে এমনটা হয়েছে। আর ভাবি সম্ভবত কিছু নিয়ে টেনশনও করছে কয়েকদিন থেকে৷ এটা কিন্তু শরীরের জন্য একদমই ঠিক না। আর এখন জ্বর---। ব্যাপারটা অনেক রিস্কি আয়ান---। 

-এখন কি করবো আঙ্কেল? মা তো ঠিক করে তাকাতেও পারছে না?

-স্যালাইন দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে শরীরের ক্লান্তিটা চলে যাবে আর ব্লাড প্রেশারটাও ঠিক হবে। কিন্তু আমার চিন্তা হচ্ছে জ্বরটা নিয়ে--। এখন সিজনটা যা খারাপ। আর ভাবির জ্বরের উপসর্গগুলো সুবিধার ঠেকছে না আমার কাছে।

-কেন আঙ্কেল? কোনো সমস্যা?

-ভাবির সিম্পটম দেখে আমার ভয় হচ্ছে এটা হয়তো নতুন কোনো ভাইরাসজনিত জ্বর--। এর বেশি কিছু বলতে পারছি না। আমি ভাবির ব্লাড স্যাম্পল নিয়ে যাচ্ছি। তোমরা আপাতত দু একটা দিন উনার থেকে দূরে থাকো---।

আয়ান থমকে দাঁড়িয়ে রইলো। গলা দিয়ে একটা শব্দও যেন বের হলো না। মায়রাও কি বলবে বুঝতে পারছে না। একটা মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে৷ এই সময় তার সেবা না করে তার কাছ থেকে দূরে থাকতে হবে? এটা কেমন কথা?

-তোমরা দুজনেই একটু সাবধানে থেকো। আপাতত আমি ভাবিকে স্যালাইন আর ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে যাচ্ছি। কয়েক ঘন্টার মাঝে ঘুম ভাঙ্গবে না আশা করি। ততক্ষণে একজন ওয়েল ট্রেইন্ড নার্সের ব্যবস্থা করে দিবো----। 

-কোনো নার্সের দরকার নেই আঙ্কেল। কী কী করতে হবে আপনি আমাকে বলে দিন। আমি নিজেই করে নিতে পারবো---।

-আরে বউমা! তুমি বুঝতে পারছ না। ব্যাপারটা রিস্কি হতে পারে। হয়তো তুমিও ইনফেক্টেড হয়ে যেতে পারো---।

-নিজে অসুস্থ হওয়ার ভয়ে মাকে এই অবস্থায় একা রেখে চলে যাবো আঙ্কেল?

-ব্যাপারটা সেরকম না--। তোমাদেরকে নিজের সেইফটির কথাও তো মাথায় রাখতে হবে।

-আমার কিছু হবে না আঙ্কেল। হতে পারে আপনি ট্রেইন্ড কাউকেই পাঠাবেন। কিন্তু আঙ্কেল নিজের কথা ভেবে জানা নেই চেনা নেই এমন একজনের হাতে মায়ের দেখাশোনার ভারটা আমি মরে গেলেও দিতে পারবো না। কিছুতেই না।

-দেখো আমি তোমাদের ভালোর জন্যই বললাম কথাটা। সবাই একসাথে অসুস্থ হয়ে পড়ার কোনো মানেই হয় না। তবু একান্তই যদি তুমি নার্স রাখতে না চাও--। তবে এই দেখো এই ট্যাবলেটটা ভরা পেটে খাওয়াতে হবে। দিনে একটা করে দুবার। আর এই-----।

ডাক্তার সাইফ মির্জা মায়রাকে ওষুধ কোনটা কখন কিভাবে খাওয়াতে হবে সেটা বলে দিলো। জ্বর কতোটুকু বাড়লে মাথায় পানি দিতে হবে এসবও বুঝিয়ে দিলো। যাওয়ার আগে আরেকবার আয়ানের মায়ের চেকআপ করে দেখলেন। ততক্ষণে তিনি আবার চোখ বুজেছেন। আয়ান ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন দেখে ওষুধ আর স্যালাইন নিয়ে এলে ডাক্তার স্যালাইন সেট করে দিলেন। কতোক্ষণ পর সেই স্যালাইন খুলতে হবে আর কিভাবে করতে হবে সেটাও আয়ান আর মায়রাকে বুঝিয়ে দিয়ে তিনি বিদায় নিলেন। আয়ান ডাক্তারকে এগিয়ে দিতে নিচে গেল। আর মায়রা শাশুড়ির মাথার পাশে বসে আলতো হাতে বিলি কেটে দিতে লাগলো। অনেকদিন পর শাশুড়ির এতোটা কাছে আসতে পেরে ভালো লাগার চেয়েও কষ্ট বেশি হচ্ছে মায়রার৷ এভাবে মানুষটার নিথর হয়ে পড়ে থাকা অনেক বেশি কষ্ট দিচ্ছে মায়রাকে। নল বেয়ে স্যলাইনের পানির টুপ টুপ করে ঝড়ে পড়ার দৃশ্যটাকেও কেমন ধীর গতির মনে হচ্ছে মায়রার কাছে৷ মনে হচ্ছে কখন এই স্থবির সময়টা পার করে মা উঠে ওকে একবার জড়িয়ে ধরবেন। সেই সময়টা আসার কতো দেরি কে জানে!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন