উমা - পর্ব ০৪ - মুশফিকা রহমান মৈথি - ধারাবাহিক গল্প


এর মাঝেই কাঠের জং ধরা দরজাটি ঠেলে ঘরে আসে রুদ্র। রুদ্রের আগমনের আভাষ পেতেই ঘরে যায় উমা। ঘরে প্রবেশ করতেই যা দেখলো তাতে গা শিউরে উঠলো উমার। রুদ্র যেনো রক্তস্নান করে এসেছে, সাদা শার্টটা রক্তের ভিজে লাল রঙ্গে রঙিন হয়ে আছে। রুদ্রের চোয়াল শক্ত, মুখেও রক্তছিটা স্পষ্ট, চোখজোড়া যেনো জ্বলছে ক্রোধের অগ্নিতে। রুদ্রের এমন রুপ দেখে শরীরে হিম ধরে আসে উমার। হাত পা জমে যায় অজান্তেই। মনের এক কোনে কালো শীতল ভয় জট পাকাতে শুরু করে। ইহজীবনে কোনো মানুষের এমন রুপ সে দেখে নি; ছা পোষা নিখিলের ঘরে অভাব ছিলো বটে, তবে ত্রাশের ছিটাফোটা ছিলো না। রতী দেবী লোভী, দজ্জাল, অত্যাচারী তবে সে উমাকে কথায় আঘাত করতেন; তবে কখনো শারীরিক নির্যাতন করেন নি। রুদ্রকে দেখে উমার প্রথম যে প্রশ্নটা মস্তিষ্কে খেললো তা হলো,
"রুদ্র কি চোট পেয়েছে?"

উমার ভীত নজরকে উপেক্ষা করে আলমারির কাছে চলে গেলো রুদ্র। রক্তে ভেজা শার্টটা খুলে ছুড়ে ফেললো ঝুড়িতে। উমা কাঁপা স্বরে প্রশ্ন করলো,
"এ..তো রক্ত? আপনি কি চো..ট পেয়েছেন?"

গামছাটা ঘাড়ে নিতে যেয়ে থেমে গেলো রুদ্র। সরু দৃষ্টিতে তাকালো উমার দিকে। উমার ভীত শুকনো মুখশ্রী দেখে কেনো যেনো তৃপ্তি লাগছে তার। এই ভীত মুখশ্রীর মোহে পড়েছিলো সে এক দিবস।  ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো উমার দিকে। উমা তখন ও ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো সেই জায়গায়। রুদ্র খানিকটা ঝুকলো, উমার চোখে চোখ রেখে ফিসফিসিয়ে বললো,
"আমার জন্য চিন্তা হচ্ছে তোমার?"
 
রুদ্রের রহস্যপ্রবণ চোখ জোড়ায় চোখ রাখতেও ভয় হলো উমার। কেমন যেনো চোখ জোড়া, এক পৈশাচিক প্রবৃত্তি! উমা নজর সরিয়ে নিলো। কথাগুলো এলোমেলো হয়ে গেলো। গলার কাছে এসে সব কিছু যেনো হাওয়া হয়ে গেলো! উমাকে চুপ করে থাকতে দেখে শব্দ করে হাসলো রুদ্র। এক ভয়ংকর হাসি। শ্রবণেন্দ্রিয়তে হাসি ঝংকার তুলতেই গায়ে কাঁটা দিলো উমার। রুদ্র হাসি থামিয়ে উমার কানে মুখ লাগিয়ে বললো,
"এই রক্ত আমার নয়, এক জানোয়ারের। ওই শুয়োরের বাচ্চা, আমার উমাকে নিয়ে বাজে কথা বলার স্পর্ধা দেখিয়েছিলো।"

কথাটা শুনতেই উমার মনে শিরদাঁড়া বেয়ে এক শীতল রক্তের স্রোত বয়ে গেলো। এক ভয়ংকর শীতল ভয়ে হাত পা অবশ হয়ে এলো। তবে কি রুদ্র কাউকে খুন করেছে! রুদ্র মাতাল, অসভ্য, নারীলোভী কথাগুলো জানাছিলো উমার। কিন্তু তার ভেতর এক হিংস্র পশু লুকিয়ে আছে সে রাতের আধারে মানু্ষকে শিকার করে; এই সত্যটা যেনো হজম হলো না উমার। রুদ্র আবারো ঝংকার তুলে পৈশাচিক হাসি হাসলো। উমার ভীত মুখশ্রীর উপরের অবাধ্য চুলগুলো রক্তাক্ত হাতে সরিয়ে দিয়ে ধীর শীতল কন্ঠে বললো,
"চিন্তা করো না, খুন করি নি। বেঁচে আছে শুয়োরটা। তবে এমন শাস্তি দিয়েছি আজীবন স্মরণে রাখবে।"

হ্যা রুদ্র কারোর খুন করে নি একথা সঠিক তবে মৃত্যু থেকেও খারাপ অবস্থায় এখন বাদল। বাদল, রুদ্রের বন্ধুমহলের একজন। সন্ধ্যের কথা, গুদামে চা খাচ্ছিলো রুদ্র। মদ খাবে না বিধায় এখন চা খাওয়ার বাতিক হয়েছে। নয়ত মাথা যন্ত্রণায় ছিড়ে যায় তার। সেই মূহুর্তে বাদল, শাবীব, রক্তিম, তূর্য, সৌমিকের আগমন ঘটে গুদামে। রুদ্রের অনুপস্থিতি তাদের বিরক্ত করছে। যে রুদ্র সন্ধ্যা হলেই বোতল খুলতো। সেই রুদ্র এখন এক দিন অন্তর অন্তর বোতল খুলে তাও খুব ই কম মদ্যপান করে। এক পেগ, আধ পেগ খেয়েই সে উঠে যায়। বন্ধুদের সাথে নিষিদ্ধ পল্লীতেও যায় না সে। গুদাম, বাড়ি, বাড়ি, গুদাম---- এই তার দৌড়। তাই বিরক্ত বন্ধুরা জড়ো হয়েছে গুদামে। যে করেই হোক আজ সারারাত তাদের সাথেই থাকবে রুদ্র। নিষিদ্ধ পল্লীতেও যাবে তারা। এটাই তাদের ইচ্ছে। গুদামে বন্ধুদের দেখেই রুদ্রের সন্দেহ হলো। অভিনব সিংহের কড়া নির্দেশ উলটা পালটা কোনো কাজ সে আসার আগ অবধি যেনো রুদ্র না করে। একটা ঝামেলা ইতিমধ্যে সে করে ফেলেছে। যার কারণে অভিনব সিংহের শহরে ছুটতে হয়েছে। শাবীব এসেই চেয়ার টেনে বসলো। হেসে আবদার করলো,
"দোস্ত, আজ বৃহস্পতিবার, আজকের রাত আমাদের। চল, ফিরু বু বলেছে কড়া মাল এসেছে। তাই চল যাই।"
"আমি যাবো না। তোরা যা"

রুদ্রের কঠোর অসম্মতিতে রক্তিম জোর করলো,
"বিয়ের পর থেকেই এই বাহানা শুনছি চল না ভাই"
"বললাম তো যাবো না, বাবা মানা করেছে। বাবা আসুক, এর পর যাবো"

বন্ধুদের হাজারো আবদার, আকুতি বাদেও যখন রুদ্রের সম্মতি হলো না তখন হিনহিনে স্বরে বাদল বললো,
"কেনো রে! বউ কি খুব ভালো সেবা করছে নাকি? একেবারে বউ লেউটা হয়ে উঠলি যে বড়। তা আমাদের একটু ভাগ তো দিতেই পারিস। গ্রামের সুন্দরী মেয়েটাকে একা একাই ভোগ করছিস।"

তূর্য, রক্তিম, শাবীব তাকে থামানোর চেষ্টা করে কিন্তু সে থামে না। বাদলের কথাগুলো কানে যেতেই চোয়াল শক্ত হয়ে আসে রুদ্রে। রাগে গা কাঁপতে থাকে। নিজের সম্পত্তির উপর অন্য কারোর কু নজর একেবারেই সহ্য হয় না তার। উপরন্তু বাদলে বাজে কথাগুলো তার মাথায় আগুন জ্বেলে দেয়। ব্যাস, ক্রোধ সংবরণ না করে ইচ্ছেমতো আপাদমস্তক মারে বাদলকে সে। এতোটাই বাজে ভাবে যখম করে যে ছেলেটা রক্তবমি অবধি করে। কেউ ঠেকাতে পারে না রুদ্রকে। পরিশেষে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
"বন্ধু বলেছিলাম তাই জানে মারলাম না। এর পরে আমার জিনিসে নজর দিলে মাটিতে পুতে ফেলবো। এই নিয়ে যা ওকে"

বাদলকে তাড়াতাড়ি নিয়ে যায় শহরে। তার বুকের পাজরে এতো লাথি দিয়ে রুদ্র যে তা ভেঙ্গে যাবার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। বাদলের রক্তেই তার সাদা শার্ট আজ রক্তে রঞ্জিত। রুদ্র শীতল স্বরে বলে,
"একটি কথা মনে রেখো, তুমি আমার ব্যাক্তিগত জমাপুঁজি। কেউ তোমার দিকে চোখ উঠিয়ে তাকালে সেই চোখ আমি গালিয়ে দিবো। তুমি আমার, শুধু আমার। তোমার দেহ, হৃদয়, মস্তিষ্কে শুধু আমার রাজত্ব চলবে। অন্য কোনো পুরুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ। স্বপ্নেও যদি তেমনটা হয়; তবে এই পৃথিবীতে সেদিন ই তোমার শেষ দিন। শুনেছি খুব ছাত্রী তুমি, রপ্ত করে নাও। শাশ্বতের সাথের সেই সকালের ঘটনাটাই যেনো শেষ ঘটনা হয়।"

রুদ্রের কন্ঠ শীতল, ঠান্ডা কন্ঠে আড়ষ্টতা নেই। ঠান্ডা স্বরে কোনো মানুষ কাউকে হত্যা করা কথা বলতে পারে এই প্রথম দেখলো উমা। সে চোখ তুলে তাকালো না। শব্দহীন মাটির দিকে তাকিয়ে রইলো। বুকের ভেতরটা ভয়ে আতঙ্কে চুপসে গিয়েছে উমার। তার মাথাটা চিন্তাশূন্য হয়ে যাচ্ছে, অতিরিক্ত ত্রাশে চিন্তাশক্তি যেনো লোপ পাচ্ছে উমার। রুদ্রের চোখের দিকে তাকানোর সাহসটা হলো না তার। রুদ্র উমার উত্তরের জন্য অপেক্ষা করলো না, স্নানঘরে চলে গেলো। উমা এখনো দাঁড়িয়ে রইলো সেই স্থান। কিছু সময় বাদে অনুভব করলো তার গাল ভিজে গেছে নোনাজলে। বুকের বা পাশে চিনচিনে সূক্ষ্ণ ব্যাথা অনুভূত হচ্ছে তার। ব্যাথাটা প্রবল হচ্ছে এটা ভেবে সেদিন বাঁচার সুযোগ ছিলো তার। শাশ্বত তাকে এই নরক যন্ত্রণা থেকে মুক্ত করতে দেবদূত হয়ে এসেছিলো, কিন্তু ভয়ে, জড়তা, কাপুরুষতার কারণে সে এই সুযোগটাও হাতছাড়া করেছে। এখন এই জমিদার বাড়ির চার দেওয়ালেই তার ইহজীবন কাটাতে হবে। একটু সাহস করলে কি হতো! কি বা হতো!

রাতে খাবারের পর শরীর এলিয়ে দিলো রুদ্র। বিদ্যুৎ নেই, মোমের হলুদ কিরণে ঘরটি কিঞ্চিত আলোকিত হলেও সম্পূর্ণ অন্ধকারকে গ্রাস করতে পারে নি। উমা ফুলির মার সাথে হেসেলের সকল কাজ শেষ করে ঘরে এসেছে। রুদ্র সরু দৃষ্টিতে চেয়ে আছে উমার দিকে। মেয়েটিকে দেখতে ভালো লাগে রুদ্রের। মেয়েটি যেনো তার চোখের খোড়াক। মোমের স্বল্প মৃদু আলোতে উমাকে কোনো অপ্সরা থেকে কম লাগছে না। লাল পাড়ের সুতি শাড়ি, আটপৌড়ে করে পড়া; সাপের ন্যায় চুল গুলো খোঁপা করে ঘাড়ের উপরে তুলে রাখা। ফর্সা ঘাড় বেধে ঘামের শতবিন্দু গড়িয়ে পড়ছে। সূচালো নাকের নিচেও বিন্দু বিন্দু ঘাম। ঈষৎ গোলাপী ঠোঁটজোড়ায় যখন হাসির এক চিলতে প্রলেপ আটে বুকের কোনায় উথাল-পাতাল ঢেউ উঠে রুদ্রের। টানা টানা সুগাঢ় নয়নে যেনো কত অভিমান, বিষাদ, সঙ্কা জড়ো হয়ে থাকে। মেয়েটি হাসলে এই চোখ জোড়াও যেনো হাসে। কিন্তু আফসোস বিয়ের পর থেকে একদফাও তাকে হাসতে দেখে নি রুদ্র। চিরটা সময় এক রাশ ভয় নিয়ে তাকায় সে রুদ্রের দিকে। রুদ্র ছুলেই গুটিয়ে যায়। চোখ থেকে নোনাজলের জোয়ার উঠে। রুদ্রকে ছেলেবেলা থেকে শেখানো হয়েছে দূর্বলের উপর জোর খাটাতে হয়, ভয় ই একমাত্র অস্ত্র মানুষকে নিজের আয়ত্ত করার। উমাও ব্যাতিক্রম নয়। সে ভয় পায় তাই তার আয়ত্তে আছে, এবং থাকবে। ভালোবাসার মতো অবাস্তক কাব্যিক অনুভূতিতে বিশ্বাস করে না রুদ্র। সে বিশ্বাস করে, ভয় ই জয়ের একমাত্র উপায়। আজ ও তাই করবে, উমাকে হুকুমের স্বরে বললো,
"মোমটা নিভিয়ে আমার কাছে এসো।"

রুদ্রের কন্ঠ শুনতে ঈষৎ কেঁপে উঠলো উমা। কিছুক্ষণ পূর্বের স্মৃতি মাথা থেকে মুছে নি। ভয়ের কালো ছাপ এখনো বুকের ভেতরে বিচরণ করছে। উমার কোনো হেলদোল না দেখে অস্থির রুদ্র নিজেই এগিয়ে এলো, উমাকে টেনে নিজের কাছে বসালো। উমা তখন নতমস্তকে বসে রয়েছে। চোখ তোলার সাহস হচ্ছে না। রুদ্রের হাতের বেষ্টনী আরোও শক্ত হলো। এতো শক্ত যে শ্বাস নেওয়াও কষ্টকর হয়ে গেলো উমার জন্য। উমার চাপা আর্তনাদ করে উঠলো,
"লাগছে"

রুদ্রের ভ্রু ক্ষেপ হলো না। সে উল্টো আরোও শক্ত করে উমাকে জড়িয়ে ধরলো। উমার নতমস্তক দেখে ধীর স্বরে বললো,
"ভয় পাচ্ছো কেনো? আমি কি এখন তোমাকে মেরে ফেলবো নাকি! তুমি ভালো হয়ে থাকলে আমিও ভালোই থাকবো। তুমি খারাপ হলে, আমিও খারাপ হবো।"
"লাগছে আমার"
"আমার কাছে থাকতে এতো আপত্তি কেনো তোমার বলতো?"
"......."
"তোমার কৌতুহল হয় না আমায় নিয়ে? জানতে ইচ্ছে হয় না আমাকে?"

উমা এবার চোখ তুলে তাকালো রুদ্রের দিকে। রুদ্রের দিলে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো সে। রুদ্রের চাহনীতে নেই কোনো ক্রোধ, নেই কোনো পৈশাচিকতা। খুব কোমল, শান্ত একটা চাহনী। এই রুদ্র যেনো অচেনা এক রুদ্র। উমার এক আগে এই রুদ্রকে দেখে নি। কাঁপা স্বরে প্রশ্ন করে উমা,
"অভয় দিলে একটা প্রশ্ন করবো?"
"করো"
"বিয়ের রাতে কোথায় ছিলেন আপনি?..........

—————

উমা এবার চোখ তুলে তাকালো রুদ্রের দিকে। রুদ্রের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো সে। রুদ্রের চাহনীতে নেই কোনো ক্রোধ, নেই কোনো পৈশাচিকতা। খুব কোমল, শান্ত একটা চাহনী। এই রুদ্র যেনো অচেনা এক রুদ্র। উমার এক আগে এই রুদ্রকে দেখে নি। কাঁপা স্বরে প্রশ্ন করে উমা,
"অভয় দিলে একটা প্রশ্ন করবো?"
"করো"
"বিয়ের রাতে কোথায় ছিলেন আপনি? লোকেরা কানাগোসা করছিলো যে আপনি নাকি নিখোঁজ। কোথায় ছিলেন সে রাতে?"

উমা ভীত স্বরে প্রশ্নটি ছুড়লো। স্বর এখনো কাঁপছে, কন্ঠে জড়তার তীব্র ছোয়া। কাঁচুমাচু হয়ে বসে রয়েছে সে। রুদ্রের ঠিক কেমন প্রতিক্রিয়া হবে জানা নেই উমার। রুদ্র মানুষটির আচারণ অনুমান করা বেশ দুষ্কর কার্য্য। মানুষটির চিত্তপটের তল পাওয়া ভার। অবশ্য উমা চেষ্টাও করে নি। মানুষ তার মনের গভীরত্ব মাপে যাদের প্রতি সুপ্ত নীল ভালোলাগা কাজ করে। যে মানুষটাকে সে ঘৃণা করে, ভয় পায় তার অন্তরে উঁকি দিয়ে কি বা হবে! ষোড়শী উমার মনের কৌতুহল গুলো রুদ্রের কাছে আসলেই বিলীন হয়ে যায়। হ্যা, তার বর চমৎকার পুরুষ। উঁচু, লম্বা, সুদর্শন, ধনবান; কিন্তু সৌন্দর্য কি সবকিছু? যার অন্তরে সামান্য দয়াটুকু নেই; অহমিকা, দাম্ভিকতায় পরিপূর্ণ মানুষটিকে ভাবনার গহীণে ঠায় দেওয়া যায়? প্রশ্নের উত্তর গুলো জানা নেই ষোড়শীর। জানার ইচ্ছেও নেই, সরীসৃপের মতো তো বেশ বাঁচছে সে। আজ হুট করেই মনের কৌতুহলের ডানা মেলে ধরলো সে রুদ্রের সামনে। রুদ্র উত্তর না দিয়ে উমার সাথে নিজের দূরত্ব কমিয়ে দিলো। এগিয়ে এসে স্পর্শের প্রগাঢ়তা বাড়ালো। কাঁধ বেয়ে নেমে আসা গহীন কালো ডেউ খেলানো চুল সরিয়ে নাক ঠেকে ষোড়শীর কাঁধে। এক অসম্ভব মিষ্টি ঘ্রাণ নাকে এলো রুদ্রের। ঘ্রাণটি রুদ্রের চেনা। উমার নিজস্ব মিষ্টি ঘ্রাণ। এই সুগন্ধে যেনো এক মাদকতা রয়েছে, প্রতিটা সময় যখন উমার সন্নিকটে আসে এই ঘ্রান তাকে তাকে মাতাল করে তোলে। কোনো মদে এই মাদকতা নেই। মেয়েটিকে তার ভালো লাগে, বড্ড ভালো লাগে। এই ভালোলাগার মাত্রাটা বাড়ছে। পাগলামীর নেশার মতো মত্ত করে তুলছে তাকে। রুদ্র কাঁধে নাক ঘষতে ঘষতে মাদকতাপ্রবণ কন্ঠে বললো,
"যদি বলি সে হাতে আমি খুব নিকৃষ্ট কাজ করেছি সইতে পারবে?"

কথাটা বলে মুখ তুললো রুদ্র। স্মিত হাসির প্রলেপ ঠোঁটে লেগে রয়েছে। রুদ্রের কথার উত্তর দিলো না উমা। শুধু রুদ্রের গাঢ় নয়নের পানে চেয়ে রইলো। মানুষের চোখ কখনো মিথ্যে কথা বলে না। যে মানুষ চোখের ভাষা গোপন করতে পারে সে মানুষ নয়, মানুষ রুপে শয়তান। উমার আজ বেশ অবাক হলো, কারণ সে রুদ্রের চোখ পড়তে পারছে। রুদ্র মিথ্যে বলছে না, ভয় ও দেখাচ্ছে না। তবে কি সত্যি প্রচন্ড নিকৃষ্ট কোনো কাজ করেছে সে! এবার নিজচিত্তকে প্রশ্ন করলো,
"সত্য শোনার সাহস কি আছে তোর?"

উত্তরে ক্ষীণ সঙ্কার পরিচয় মিললেও বেশ দৃঢ় প্রকল্প করলো রুদ্রের উত্তরে ভয় পাবে না সে। উমার ভীতু মুখশ্রীর সুদৃঢ় চাহনী দেখে হেসে উঠলো রুদ্র। হাসির ঝংকার চার দেয়াল গমগম করে তুললো। তারপর বললো,
"ছোট মানুষের এতো কৌতুহল ঠিক না।"

উমা চোখ নামিয়ে নিলো। অজানা কারণে বেশ আশাহত হলো সে। বুকের ভেতর কেনো যেনো এক চিলতে আশা জটলা বেঁধেছিলো, হয়তো রুদ্র হয়তো তার প্রশ্নের উত্তর দিবে। রুদ্র সুনিপুন ভাবে উমার চিন্তার মোড় বদলে দিলো। নির্লিপ্তকন্ঠে বললো,
"কাল ও বাড়ি যাবে?"

কথাটা শুনতে বিষন্ন চিত্ত উচ্ছ্বাসিত হয়ে উঠলো উমার। অবাক কন্ঠে বললো,
"আপনি আমায় ও বাড়ি নিয়ে যাবেন?"
"হ্যা, বিকেলে যাবো সন্ধ্যায় চলে আসবো। যাবে?"
"হ্যা"

ষোড়শীর চোখ চকচক করছে। পিপাসু ব্যাক্তি হাজারো মাইল চলার পর যখন কুয়োর সন্ধান পায় তখন যেমনটা উজ্জ্বল হয়ে উঠে তার চোখ, উমার চোখ ও তেমন ই উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। রুদ্র স্মিত হাসি দিয়ে বললো,
"বেশ, ঘুমিয়ে পড়ো। কাল সকালেই যাবো নাহয়।"

উমার ঠোঁট চিরে এক চিলতে হাসি উঁকি দিলো। রুদ্র খেয়াল করলো তার বুকের বা পাশটায় চিনচিনে ব্যাথা অনুভূত হচ্ছে। হৃদস্পন্দন বেড়ে গিয়েছে, মেয়েটির এক টুকরো হাসি বুকচিরে গিয়েছে যেনো।

 রুদ্র আর বসে থাকতে পারলো না সেখানে। উঠে দাঁড়ালো, নতুন সিগারেটের প্যাকেটটা নিয়ে ঘরসংলগ্ন বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো সে। মনের কোঠরে উৎপন্ন অচেনা, অজানা অনুভূতিগুলোকে ঠাহর করতে পারছে না রুদ্র। খুব বিচিত্র এই অনুভূতি, যার মাঝে এক রাশ সুখ, দুঃখ, ভয়ের অদ্ভুত সংমিশ্রণ লুকায়িত। এর পূর্বে এমন অনুভূতি পরিচয় পায় নি সে। সুখ উমার নিবিড় হাসির লুকোচুরিতে, বেদনা তার চোখে নিজের জন্য ঘৃণার ছাপে; ভয় তার ঘৃণার ছাপ প্রবল হবার। হুট করেই এক অদ্ভুত কালো সঙ্কা উঁকি দিলো মনের আঙ্গিনায়, নিজের চারপাশের দূর্ভেদ্য প্রাচীরে ফাটল ধরার সঙ্কা। এই সঙ্কা যে বড্ড ভয়ানক। এতোকালের রচিত খেলার মোড় পালটে দেবার জন্য যথেষ্ট। না না, ভুল করছে রুদ্র। নিজেকে সামান্য নারীর প্রতি দূর্বল করে তুলছে সে। ভুলে গেলে চলবে না, সে অভিনব সিংহ রায়ের পুত্র, এই গোপিনাথপুর গ্রামের ভবিষ্যৎ শাসক রুদ্র সিংহ রায়। সে সামান্য নারীর জন্য নিজেকে দূর্বল করতে পারে না। কদাপি না। রুদ্র গহীন আধারে চেয়ে রইলো। হাতে থাকা সিগারেট জ্বলছে। রাতের সাথে সাথে নিকোটিনের ধোয়া নিবিড় হচ্ছে, সে সাথে বুকের এক কোনায় জ্বলন্ত ছাই ছাপা লেলিহান শিখাটাও_____________

৬!!

নিখিল বাড়ি ধুম পড়েছে। রতীরানী আপ্যায়নের ঘটা লাগিয়েছেন। মায়ের উৎসাহের কারণ খুঁজে পাচ্ছে না রাজশ্বী। যে দিদি মায়ের চক্ষুশুল ছিলো; তার দ্বিরাগমনে আসার সংবাদে মাকে এতোটা উৎসাহিত দেখে অবাক হওয়াটা অহেতুক নয়। রাজশ্বী মুখড়া কিশোরী, মুখে লাগাম নেই। উমা যতটা শান্ত, রাজশ্বী ততটা চঞ্চল। তার পক্ষে কথা মাটিতে ফেলা অসম্ভব। তাই তো হেসেলে মায়ের উৎসাহ দেখে প্রশ্ন ই করে বসে সে,
"মা, এতো আড়ম্বরতার রহস্য কি? বিয়ের পর বুঝি দিদির প্রতি আদর বেড়ে গেলো!"

রাজশ্বীর ঠেস মারা কথায় তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে রতী। রাজশ্বীর এই স্বভাব অতি অপছন্দের তার। হিনহিনে স্বরে বলে,
"মুখপুড়ি, ভুলে যাস না আমি তোর মা। মুখে যা আসছে তা বলছিস। হতচ্ছাড়ি, যা এখান থেকে"
"বাহ রে, সত্য কথা বললাম বুঝি রাগ করলে?"

রতীরানীর রাগ বাড়লো। অকথ্য ভাষা মুখ থেকে বের হবার আগেই নিখিল বাবুর কন্ঠ কানে এলো তার,
"কই গো, রুদ্রবাবা জীবন এসেছে। কই গো উমার মা"

নিখিলের স্বর  শ্রবণ হতেই মুখের কথাটা গিলে ফেললো রতী। হাতটা ধুয়ে ছুটলো আঙ্গিনায় সে। মেকি হাসি মুখে একে স্নেহময়ী স্বরে বললো,
"উমা কেমন আছিস মা? এই কদিন কতো স্মরণ করেছি তোকে"

রতীর এমন ধারা কথা শুনে অবাক হয় উমা, মনে মনে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে উমা। যে উমাকে ঘাড় থেকে নামাতে পারলে তিনি বাঁচে সেই উমাকে দেখে তার আদিক্ষেতার অন্ত নেই। মানুষ কতোটা রঙ বদলায়। গিরগিটির চেয়েও নিপুন ভাবে রঙ্গ পালটায় তারা। উদ্দেশ্য তাদের নিজস্ব বিষাক্ত স্বার্থ। 

বাড়ির পেছনের পুরোনো বেল গাছের নিচে বসে রয়েছে উমা, রাজশ্বী এবং উমার ছেলেবেলার সখীরা। গল্পের আসর জমজমাট। কত প্রশ্ন তাদের, বিয়ের পর উমার জীবন কেমন? বর কেমন? জমিদার বাড়ির দিনগুলো কেমন? উমা শুধু হাসে, আর নিপুন হস্তে পায়ে আলতা দেয়। আলতা দিতে বড্ড ভালো লাগে তার। পাজোড়া লাল করে সারা বাড়িময় হাটতে এক অদ্ভুত আনন্দ রয়েছে। এর মাঝে সখী আখলিমা প্রশ্ন করে,
"হ্যা রে, দুলাভাই কি বদলেছে নাকি এখনো মাতাল হয়ে এদিক সেদিক পড়ে থাকে?"

আখলিমার প্রশ্নে কর্ণকুহরে যেতেই মাথা তুলে উমা। প্রশ্নটার সম্মুখীন যে হতে হতো জানা ছিলো, তবুও বেশ বিচিত্র লাগছে। রাজশ্বী কেনো দেয় আখলিমাকে, চোখ রাঙ্গায়। আখলিমা জিব কাটে। উমা নিজেকে সামলায়, স্মিত হাসি হেসে বলে,
"মানুষটা আজকাল নেশা করে না।"
"কি বলিস? জামাইবাবু মদ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে?"

অবাক কন্ঠে প্রশ্ন করে রাজশ্বী। উমা হাসির প্রস্থ বাড়ায়, মৃদু স্বরে বলে,
"জানি না, তবে মাতলামি করে না। বড্ড স্বাভাবিক থাকে। স্বাভাবিক ভাবেই কথা বলে।"
"তোর বর অথচ তুই জানিস না?"

প্রশ্নটার উত্তর দেয় না উমা। শুধু হাসে। সত্যি ই তো, তার বর অথচ সেই জানে না। জানতে চায় না। পিছে পুনরায় রুদ্রের রুদ্রমূর্তির সম্মুখীন হতে হয়। ওই বাড়িতে সব কিছুই কেমন রহস্য, আর রুদ্র সবচেয়ে বড় রহস্য। এরই মাঝে রুদ্রের তীব্র হুংকার শুনলো উমা। ঈষৎ কেঁপে উঠলো তার শরীর। আলতার রেখা বেকে গেলো। আলতার বাটি উলটে  পড়লো তার পায়ে। সেই আলতা রাঙা পায়েই ছুটলো অন্দরমহলে। অন্দর মহলে যেতেই নিখিলের ভীত মুখটা নজরে পড়লো। রুদ্রের দিকে চাইতেই হিম ধরে আসলো তার। চোখ জোড়া লাল হয়ে রয়েছে, চোয়াল শক্ত। অবাক উমা কারণ বুঝলো না। এতোক্ষণ তো ভালোই ছিলো। হুট করে কি এমন হলো!রুদ্রের নজর উমার দিকে পড়তেই বললো,
"বাড়ি চলো...."

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন