অচেনা অতিথি - পর্ব ১৬ - সিজন ২ - নাফিসা মুনতাহা পরী - ধারাবাহিক গল্প


নিঃস্তব্ধতার গভীর রাত্রি। দুরে পেঁচার অদ্ভুদ ডাক অস্পষ্ট ভাবে শোনা যাচ্ছে। মাহাদ সেন্সলেস হয়ে পড়ে আছে বিছানায়। তিতির পাশে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। মাহাদের হাতেই ফোনটা ছিল। হাতটা বেড থেকে একটু সরে শক্তিহীন অবস্থায় পড়ে আছে। হাত থেকে মোবাইলটা আস্তে আস্তে সরে গিয়ে ফ্লোরে ধপ করে পড়ে যেতেই পাশে দোলনায় শুয়ে থাকা অতিথীর ঘুম ভেঙ্গে যায় আর সে চিৎকার দিয়ে কেঁদে ওঠে। মেয়েটা অত্যন্ত ঠান্ডা স্বভাবের। কিন্তু আজ সে বেশিই ছটপট করে কেঁদে চলছে। মেয়ের কান্নার শব্দে তিতিরের ঘুম ভেঙ্গে যায়। দ্রুত উঠেই অতিথীর কাছে গিয়ে ওকে কোলে তুলে নিয়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করতে লাগলো। হঠাৎ তিতিরের মনে হল কি ব্যাপার, মেয়ে এত জোড়ে কেঁদে উঠলো তবুও মাহাদের ঘুম ভাঙ্গলোনা!  এতক্ষনে ও আগে উঠে যেত। ও দ্রুত লাইট জ্বালিয়ে দেখলো মাহাদ হাত-পা ছেড়ে দিয়ে পড়ে আছে বেডে। মাহাদ বলেই তিতির দৌড়ে এল ওর কাছে। মেয়েকে বেডে সুয়ে দিয়েই মাহাদকে চেক করতেই বুঝলো ও সেন্সলেস হয়ে গেছে। 

ভিতরের জমে থাকা রাগ অভিমান নিমিষেই চোখের জল হয়ে ঝড়ে পড়তে লাগলো। দ্রুত মাথার নিচ থেকে বালিশ সরিয়ে মাহাদকে সটান করে সুয়ে দিয়েই  বার বার পানির ঝটকা দিতে লাগলো ওর চোখে মুখে। আরও কিছু প্রসেস করতেই মাহাদের রক্ত চলাচল স্বাভাবিক হতেই ও চোখ মেলে চাইলো। কিছু সেকেন্ড না যেতেই ওর চোখ দিয়ে গড়িয়ে পানি পড়তে লাগলো।

মাহাদ, মাহাদ বলে তিতির কয়েকবার গা ঝাকালো কিন্তু কথা বলতে পারলোনা। তিতির আর কোন হুশ না পেয়ে দৌড়ে রুম থেকে বের হয়েই ফুয়াদদের রুমের দরজা ধাক্কাতে লাগলো। এত জোরে জোরে দরজা ধাক্কাতে লাগলো যে অন্য রুম থেকে লাবিবা বের হয়ে এসে দেখলো তিতির কাঁদছে আর ভাইয়া ভাইয়া বলে দরজা ধাক্কাচ্ছে। মাহাদ বলেই লাবীবা আধা দৌড়ে মাহাদের রুমে গিয়ে দেখে মাহাদ নিথর হয়ে পরে আছে আর পাশে অতিথী গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিয়ে কান্না করছে।

এদিকে ফুয়াদ এসে দরজা খুলেই হতবম্ভ হয়ে বলল-

~" কি হয়েছে তিতির! এমন করছো কেন?"

তিতির কাঁদতে কাঁদতে ওর রুমের দিয়ে হাত তুলে ইশারা করে বলল-

~" ভাইয়া মাহাদ।"

ফুয়াদ ওদিকে যেতেই নিসা এসে ভয়ার্ত কন্ঠে বলে উঠলো-

~" তিতির মাহাদ ঠিক আছে!"

তিতির কথার জবাব না দিয়ে ফুয়াদের পিছনে হানতান করে ছুটে চলে গেল। পুরো বাসার মানুষ উঠে মাহাদের রুমে গেল। সব ঠিক আছে কিন্তু মাহাদ কথা বলতে পারছেনা। স্থির হয়ে চেয়ে শুধু চোখের জল ফেলছে। রেজওয়ান ডক্টরকে কল দিল দ্রুত বাসায় আসার জন্য। বাসায় সবাই উপস্থিত কিন্তু সাদা, বাতাসী আর সাবিনা অনুপস্থিত।

কিছু সময় পর ডাক্তার আসলো। তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে তিনি এখুনি ঘুম থেকে উঠে এসেছেন। তিনি যখন মাহাদের ট্রিটমেন্ট করতে ব্যস্ত তখন ফুয়াদের সন্দেহ হলো তার দাদী কই! এতক্ষনে সে তো এসে হাজির হয়ে যেত। নিসাকে এদিকটাই দেখতে বলে সোজা বাতাসির রুমে গিয়ে নক করতে গিয়ে দেখে বাহির থেকে দরজা বন্ধ। চাবি দেওয়া দেখেই ফুয়াদের বুকটা ছাৎ করে উঠলো। সাবিনা বলেই দৌড়ে চাবি আনতে গেল। তারপর চাবি এনে তালা খুলতেই দেখলো, বাতাসি চেয়ারে বাধা অবস্থায় রয়েছে। ফুয়াদ তাড়াহুড়া করে বাঁধন খুলে দিতেই  বাতাসি ফুয়াদকে জড়িয়ে ধরে বলল-

~" ফুয়াদ অ্যার মনে হয় সাবিনা ভয়ঙ্কর কোন কাম করতে গেছে। মাইয়া অ্যার কোন কতাই শুনলো না। ও ঠিক নাই ফুয়াদ।"

~" দাদী, মাহাদের অবস্থা খুব খারাপ। সাবিনার ব্যাপার আমি দেখছি।"

~" মাহাদ, অ্যার মাহাদের কি হইছে!"

তুমি ওর রুমে যাও বলেই ফুয়াদ সদর দরজা খুলতেই দেখলো বাহিরের ঘুটঘুটে অন্ধকার। এবার ফুয়াদের ধারনা সত্যতে পরিনিত হল। খুব ভয়ানক কিছু একটা ঘটেছে। ফুয়াদ দ্রুত বাসায় ঢুকে দরজা বন্ধ করেই ওর অফিসে ফোন দিল। তারপর ডক্তারের কাছে গিয়ে দেখলো তিনি মাহাদকে মেডিসিন দিয়ে আরও কিছু কাজে ব্যস্ত রয়েছেন। ফুয়াদ শুধু ডাক্তারকে জিঙ্গাসা করলো, আসার সময় বাহিরের সব লাইট বন্ধ ছিলো কিনা?"

ডাক্তার জবাব দিল, হ্যাঁ অন্ধকার ছিলো। আর মেইন গেটটা খোলাই ছিল। আমি তাড়াহুড়ার মাথায় এসব আপনাকে বলতে ভুলে গিয়েছি। ফুয়াদ আর কোন কথা না বলে অপেক্ষা করতে লাগলো পুলিশের ফোর্স 
আসার। 

ফযরের টাইমে চার গাড়ি পুলিশ আসলো বাসায়। তারপর পুরো বাসা সার্চ করে সব কাজের লোকদের বাঁধা অবস্থায় পাওয়া গেল। কয়েকজনদের বেদম মাইরও দেওয়া হয়েছে। এমন উচ্চ সাম্মানিত মানুষদের বাসাও যখন নিরাপত্তা থাকেনা তাহলে সাধারন মানুষদের বাসার নিরাপত্তার কথা ভাবা বোকামি ছাড়া কিছুই নয়। সব তন্ন তন্ন করে খুজে তেমন কিছু পাওয়া গেলোনা। শেষে ফুয়াদ একটা মোটা লাঠি নিয়ে দেয়াল চেক করতে লাগলো হালকা বারি দিয়ে দিয়ে। বাসার পিছন দিকের এক ওয়ালে বাড়ি দিয়ে ফাপা লাগলো। সেই জায়গা চেক করতেই আসল রহস্য বের হল। একটা মানুষ পার হওয়ার মত দেয়ালের ইট খসানো। এমন ভাবে সেটা করা হয়েছে যে সহজে কেউ বুঝতে পারবেনা। সেখান দিয়ে যাতায়াত পর আবার নিখুত ভাবে সাজানো হয়েছে।


মাহাদকে ঘুমানোর মেডিসিন দেওয়া হয়েছে তাই ও ঘুমাচ্ছে। রুমে তখন কেউ ছিলোনা। প্রায় সকাল হয়ে এসেছে। তিতির উঠতে যেতেই পায়ে কিছু বাঁধে। নিচু হতেই ফ্লোরে মাহাদের ফোন পড়ে থাকতে দেখলো। ফোন তুলেই টেবিলে রাখতে গিয়ে থমকে দাড়ালো। বাসায় আসার পর থেকে মাহাদ ওর ফোনটা কাছ ছাড়া করতো না। এমনকি কেউ যদি ভুলেও সেই ফোনে হাত দেয় তাহলে তাকে ধমক দেয়। সাদকেও ধমক দিয়েছিল। আর আমার আশপাশ তো ফোনটা রাখতোই না। তিতির ফোন অন করেই দেখে ফোনে পাসওর্য়াড দেওয়া। তিতির ভাবতে লাগলো কি এমন পাসওর্য়াড হতে পারে। 
মাহাদের এই ক'দিনের ব্যবহারে যে কোন মেয়ে হলেই রেগে গিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যেত না হয় সিনক্রিয়েট করতো। কিন্তু তিতির করেনি তার একটাই কারন, ঘুম থেকে উঠে তিতির সব সময় নিজেকে মাহাদের বুকে দেখেছে। গতকাল রাতেও মাহাদ ওর বুকের সাথে তিতিরকে এত শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ছিলো যেটা দেখে যে কারো মনে হবে ওর কাছ থেকে তিতিরকে কেউ কেড়ে নিতে চায়। তাই ওর বুক দিয়ে তিতিরকে আগলে রেখেছে। সাবিনার সাথে খারাপ ব্যবহার করার একটাই কারন, যাতে সাবিনা অনুতপ্ত হয়ে সঠিক ঘটনাটা তিতিরকে জানায়। কি এমন হয়েছে যার জন্য মাহাদ এত পেরেশানিতে আছে। ঘুমের মধ্যও মাঝে মাঝে ভয়ে থরথর করে কাঁপে সে। মনে হয় আমার সব প্রশ্নের উত্তর এর মধ্যই আছে। তিতির গভীর ভাবে চিন্তা করতে লাগলো। কি পাসওর্য়াড হতে পারে। 
মাহাদের সব থেকে দুর্বল জায়গা হল তিতির। আমার নাম দিবে! নাহ্ সেটা দিবেনা। তাহলে কি হতে পারে কি সেটা ভাবতে ভাবতে তিতির ৮টা কোড বসালো। ইয়েস খুলে গেছে। যেদিন মাহাদ তিতিরকে প্রথম দেখেছিল সেই তারিখ,মাস সহ সাল বসিয়ে দিতেই লক খুলে যায়।

ফোন খুলতেই একের পর এক মাসেজ আসে। তিতির সেগুলো চেক করতেই যা দেখলো তাতে সে এত জোড়ে চিৎকার দিলো যে মাহাদ পর্যন্ত উঠে বসে পড়লো। কিন্তু কয়েক সেকেন্ড পর আবার বালিশে ধপ করে পড়ে গেল। তিতিরের পুরো শরীর থরথর করে কেঁপে চলছে। মাহাদকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলো। 

তিতিরের চিৎকারে প্রথমে ডাক্তার ছুটে এল। মাহাদকে দ্রুত পরীক্ষা করতে লাগলো। তিতির কাঁদতে কাঁদতে ফুয়াদকে জোড়ে জোড়ে ডাকতে লাগলো। ডাক্তার নিষেধ করছে তবুও ও থামছেনা। শেষে ফুয়াদ ওর কাছে আসতেই তিতির তার হাতে ফোন দিয়ে ভিডিওটা দেখালো। একটা ছেলে সাবিনাকে ৭ টুকরো করে বস্তায় পুরে প্যাক করছে। এমন দৃশ্য দেখে ফুয়াদ সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে ফেলল। অজান্তেই ওর চোখ দিয়ে ঝর ঝর করে পানি পড়তে লাগলো। এতক্ষন পুলিশের সন্দেহ ছিল এসব প্লানে সাবিনা সামিল ছিল। কিন্তু বাতাসি শুধু বলছিল, কোন বড় এক ভুল হচ্ছে আমাগো। ঐ অবলা মাইয়াটারে দোষ দেওনা। কিন্তু কেউ তার কথা শোনেনি। বাসার প্রতিটা মানুষ মাহাদ আর সাবিনাকে বরাবর দোষারোপ করেই চলছে। তারা একবারও ভাবেনি কত বড় ফাঁদে পড়লে মানুষ কাউকে কিছু বলতে পারেনা। দুটা মানুষ এত বড় সমস্যা নিজেরা একাই হজম করে ফেলছে দিনের পর দিন।

সকাল ৮টার দিকে মাহাদদের বাসা থেকে একটু দুরে ডোবার উপর বড় একটা কার্টুন পাওয়া যায়। সেখানে সাবিনার ক্ষত-বিক্ষত লাশ ছিলো। শুধু মুখটা দেখে চেনা গেছে। বাসায় শোকের মাতাম চললো। অজ্ঞাত নামের কয়েকজনকে আসামী করে থানায় একটা ডায়রী করা হলো। যহরের পরপরই দ্রুত কবর দেওয়া হয় সাবিনাকে। মাহাদ তখনো গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। 

বাসার সবাই যখন শোকে কারত তখন বিপদের উপর বিপদ এসে ভিড় করলো। হঠাৎ করেই সাদের শরীর খারাপ হতে লাগলো। জোড়ে জোড়ে শ্বাস নেওয়া সহ কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এলো। এর মধ্য সাদ একবার সেন্সলেস হয়ে যায়। অনেক কষ্ট করে সেন্স ফিরানো হয়। ডাক্তার শরীরের কোন সমস্যায় ধরতে পারছেনা। কিন্তু ছেলেটা আস্তে আস্তে মৃত্যুর দিকে হাটা দিয়েছে। 

আসরের দিকে মাহাদ আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে গেল। ও ঠিক হতেই তিতিরকে ডাকলো। সাদকে কোলে নিয়েই তিতির মাহাদের কাছে আসলো। সাদকে ঐ অবস্থায় দেখে মাহাদের ধৈর্য্যর বাঁধ ভেঙ্গে গেল। মাহাদ চিৎকার দিয়ে উঠলো, আল্লাহ্ আর কত আমার ধৈর্য্যর পরীক্ষা নিবেন! আর কত কিছু আমাকে বির্সজন দিতে হবে। আমার অক্ষমতার সুযোগ নিয়েছে তারা। সাদকে কোলে নিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো মাহাদ। বাবা আমি থাকতে তোমার কিছু হবেনা। আল্লাহ্ আমার মাসুম ছেলেটার জিবন নিয়ে আর খেলোনা। আর সহ্য করার ক্ষমতা আমার নেই। মাহাদের এমন কান্না দেখে রেজওয়ান মাহাদকে জড়িয়ে ধরে বলল-

~" ভাই আমি তোকে পছন্দ করিনা। তাই বলে আমি কোন দিনও সাদের ক্ষতি চাইনি। আমার নিজের থেকেও আমি সাদকে ভালোবাসি। একটু ঠান্ডা মাথায় চিন্তা কর। এই কদিন ধরে কি কি ঘটছে তোর সাথে। একটু চিন্তা কর।  না হয় আমাকে বল, আমি আমার সমস্ত মেধা খাটিয়ে কিছু করতে পারি কিনা!"

ঘটনাটা ঘটে মাহাদ সিংগাপুরে যাওয়ার পর।
সাদের স্কুলে কারা যেন সাদকে সেন্সলেস করে ওর শরীরে ইনজেকশন পুশ করে। তারপর থেকে ওর শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। আর একটা অজানা ভাইরাস ওর শরীরে বাসা বাঁধতে শুরু করে।
সাবিনা যেদিন প্রকাশ করে ওর পেটে মাহাদের বাচ্চা সেদিন মাহাদের কাছে একটা ভিডিও রেকর্ড যায়। যেখানে ওরা সাদের শরীরে কিছু একটা প্রবেশ করাচ্ছে। তারপর মাস্ক পড়া একটা লোক ওর সামনে কিছু মেডিসিন দেখিয়ে বলল-

~" তোকে ধংস করার ক্লু পেয়ে গেছি। তোকে মানুষিক ভাবে প্রতিদিন তিলে তিলে মারবো। দেখি কত যন্ত্রনা সহ্য করে মরতে পারিস। তোর স্ত্রী, সন্তানকে তোর থেকে কেড়ে নিব। তুই কিছু করতে পারবিনা। শুধু চেয়ে চেয়ে দেখবি আর যন্ত্রনা উপভোগ করবি। এত যন্ত্রনা দিব এত যন্ত্রনা দিব যে প্রতিদিন মৃত্যুর স্বাধ উপভোগ করবি। অক্ষম মাহাদ এবার বসে বসে আয়েস করে তার ধংস দেখবে। একদম অ্যাকশন মুভি। হিট হিট হিট......।"

সেই ভিডিওটা মাহাদের মুখ বন্ধ করার জন্য যথেষ্ঠ ছিল। তার ভিতর সাবিনা অনেক বড় ফাঁদে পড়েছে। সাবিনা বাধ্য হয়ে বাসার সব খবর তাদের কানে দেয়। সাবিনা প্রতিদিন সাদকে মেডিসিন দেয়। কিন্তু আজ মারা যাওয়ার কারনে সাদ কোন মেডিসিন পায়নি। পরপর দুইটা ড্রোজ না পেলে সাদের বেঁচে থাকার কোন সম্ভবনা থাকবেনা। এই জন্য সাদের এত কষ্ট হচ্ছে। 

মাহাদ চুপ করে ভাবতে লাগলো। সাবিনার সাথে যা যা ঘটেছে সবটা মাহাদ দেখেছে। সাবিনা কেন ওদের কাছে নিজেকে বির্সজন দিবে! সাবিনা সাবিনা সাবিনা  বলতে বলতে মাহাদ চুপ করে রয়। 
নিসা আর তিতিরকে দ্রুত সাবিনার রুম চেক করতে বলল। প্রতিটা কোনা খুটে খুটে যেন দেখে।  মাহাদ আবার চুপ করে রইলো। সাবিনা কি বলতে চেয়েছিল এসব ভাবতে ভাবতে মাহাদ চট করে বলল-

~" ভাইয়া আমার এই রুমটা তন্ন তন্ন করে চেক করো তো! দ্রুত করো। সাদের মেডিসিনটা দরকার।  না হলে........। "

ফুয়াদ আর রেজওয়ান দু'জনেই খুজতে লাগলো পুরো রুমটা। সাবিনার রুমে একটা চিঠি পাওয়া গেল। কিন্তু আর কিছু পাওয়া গেলোনা। তবে মাহাদের রুমে একটা ছোট্ট বক্স পাওয়া গেল। সেটাও মাহাদের পাঞ্জাবীর পকেটে। ফুয়াদ সেটা আনতেই মাহদের এত খারাপ লাগলো যে সেটা বলার বাহিরে। যে পাঞ্জেবী তে মেডিসন টা পাওয়া গেছে সেটা সাবিনার দেওয়া পাঞ্জেবী ছিল। সাবিনার মাসিক যে পারিশ্রমিক দেওয়া হত, একবার সেই টাকা দিয়ে মাহাদকে একটা পাঞ্জেবী গিফট্ করেছিল ২ বছর আগে। কখন যে মেয়েটা ওখানে মেডিসিন রেখে দিয়েছিল সেটা সেই শুধু জানে। ফুয়াদ গ্লাসে পানি এনে ওটা সাদকে খাওয়াতে যাবে এমন সময় মাহাদ নিষেধ করলো। কারন ওটা খালি খাওয়ানো যাবেনা। হালকা কুসুম গরম দুধে মিশিয়ে খাওয়াতে হবে। রেজওয়ান গিয়ে দুধ নিয়ে এল।  তারপর মেডিসিন দুধে মিশিয়ে সাদকে খাওয়ানো হল। মোট তিনটা মেডিসিন ছিলো। হাতে আরো দুটো আছে। এই দু'দিনের ভিতর আরও ৮টা মেডিসিন জোগাড় করতে হবে। নিসা সাবিনার চিঠিটা মাহাদের হাতে দিয়ে বলল-

~" সাবিনা মনে হয় তোকে কিছু বলতে চেয়েছিলো।"

মাহাদ চিঠিটা নিলো কিন্তু পড়লোনা। সাদ মাহাদের গলা জড়িয়ে ধরে বাবার বুকে ঘুমানোর জায়গা করে নিয়েছে। ফুয়াদ সহ সবাই রুম থেকে বের হয়ে যেতেই নিচে দেখলো, বাতাসি বিবি প্রলাপ করে সাবিনার জন্য ডুকরে কেঁদেই চলছে। কাল যদি তিতির ওর সাথে ঝগড়া করে গায়ে না হাত তুলতো তাহলে সাবিনা রেগে গিয়ে এমন কঠিন সিদ্ধান্ত নিতোনা। অনাথ মাইয়াটা বাঁইচা যাইত। ও ঘর থেকে বাইর হওয়ার আগে অ্যার পা ধইরা কান্দছিলো। দাদী অ্যারে মাফ কইরা দিয়েন। অাই আপনাগো ম্যালা কষ্ট দিছি। ভাইজানের নাম খারাপ করেছি। আল্লাহ্ অ্যারে মাফ করবেনা।  অ্যার মত পাপী জগতে নাই। আন্নেরা সগ্গলে অ্যার বাপ-মা। আই বুজবার পারিনাই অ্যারে তারা ফান্দে ফেলাইছে। অ্যার মরা ছাড়া আর কোন উপায় নাই। 

মাইয়াটার এত কান্দন আই বাতাসি কোনদিনও দেহি নাই। ওর আপন বলে কেউ নাই। থাকলে আর ওর মরা লাগতো! বুঝলি তিতির! কামডা তুই ভালো করোস নাই। আল্লাহ্ এর শাস্তি তোরে দিবে দেখিস। আজকের পর থাইকা তোরে অ্যার মন থাইকা বাইর কইরা দিনু। সোয়ামীরে যদি বিশ্বাস নাই করবার পারোস তয় বিয়া সান্দাইছিলি ক্যান! অপেক্ষা কর.. প্রতিদান তুই পাবুই।

বাতাসির অর্তনাদের চিৎকার তিতিরের কানে এসে ধাক্কা খেল। ও ওখানেই বসে চোখের পানি ফেলতে লাগলো। মাহাদের দিকে তাকিয়ে দেখে ও চুপ করে আছে আর বাতাসির অভিশাপ কানে ভরছে। যদি তিতির একটু বিশ্বাস করে সাবিনার সাথে ভাল ব্যবহার করতো তাহলে সাবিনা নিজেকে সপিয়ে দিতোনা। মাহাদ কিছুনা কিছু একটা ব্যবস্থা করেই ফেলতো। তার আগেই সে সব শেষ করে দিয়েছে।

তিতির মাহাদের দিকে অসহায়ের মত চাইতেই মাহাদ ওকে ইশারা করে কাছে ডাকলো। তিতির উঠে মাহাদের কাছে যেতেই মাহাদ সাবিনার চিঠি দিয়ে বলল-

~" এটা পড়ে আমাকে শোনাও তো!"

তিতির চিঠিটা নিয়ে খুলে চোখের পানি মুছে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে পড়তে লাগলো।

প্রিয় আপা,
আই জানি চিটিডা ভাইজান পেলেও হেই পড়বো না। আন্নেরে দিয়েই পড়াবো। আন্নে কোনদিন অ্যার লগে রাগ কইরা কতা কননি। কিন্তু আন্নে এমন জায়গায় রাগ করছেন হেই জায়গায় মজবুত বিশ্বাসের দরকার ছিলো। যেটা আন্নের ভিতর খুইজা পাই নাই। ভাইজানের কোন দোষ নাই। অ্যার জন্য ভাইজান কত কষ্ট সইছে। হেই কইছে অ্যার ভিডিও নেটে ছাইড়া দিব। হেইডা যদি ছাইড়া দিত তয় ভাইজানের নাম আগে আইতো। তাই ভয়ে আই মুখ খুলি নাই। আর ভাইজানরে চুপ কইরা দিছে সাদের জন্য। আন্নে যহন এই চিটিডা পরবেন তহন আই মনে হয় দুনিয়াতে থাকুমনা। ভাবছি শয়তানডারে মাইরাই মইরা যামু। কি করুম, তারে ভালোবাইসা সব দিছি। কিন্তু হেই অ্যারে এভাবে ব্যবহার করবো হেইডা জানতাম না। হেই তো একটা বহুরুপী।  ভাইজানরে ভুল বুঝেননা। ভাইজান ছাড়া আর কেউ ভালা চাইতোনা। কোনদিনও কেউ চাইতো না। ভালা থাকবেন। সাদরে কখনো একা ছাড়বেন না। আন্নেরে ভয়ানক শক্ত হওন দরকার। ভাইজানের ম্যালা শত্রু। কখন কি হয় তহন কিন্তু কোনদিনও নিজেকে মাফ করতে পারবেন না....।

আর কিছু লেখা ছিলোনা। মাহাদের চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি এসে পড়লো সাদের গায়ে। মাহাদ চোখের পানি মুছে আসমার বাবার ড. আলীমকে ভিডিও কল দিলো। রিসিভ হতেই সালাম দিয়ে মেডিসিনটা তাকে দেখিয়ে বলল-

~" আঙ্কেল, মেডিসিনটার সম্পর্কে আমাকে একটু জানান তো! সাদের জন্য জরুরি ভাবে দরকার।"

ড. আলীম পিকটা ভালো করে দেখে ভ্রু কুচকে বলল-

~" মাহাদ, এটা সাদের দরকার হবে কেন? এটা খুব মারাত্বক মেডিসিন। সরকারের অনুমোদন ছাড়া এটা ব্যবহার করা দন্ডনীয় অপরাধ।"

মাহাদ ড.আলীমকে সব খুলে বলল। আর সাবিনা যে মারা গেছে সেটাও বলল তাকে। আলীম সাহেব সব শুনে তিনি বললেন-

~" মাহাদ চিন্তা করোনা। আমি যেহেতু এখানকার একজন প্রফেশনাল সরকারী ডাক্তার তাই মেডিসিনটা জোগার করতে তেমন কষ্ট হবেনা। আমি আজই ওটা পাঠানোর ব্যবস্থা করছি। আর শোন আমি একটু হাই পাওয়ারের দিব। সেটা একবারে খাওয়াবানা। দিনে দুইবার আলাদা আলাদা ভাবে খাওয়াবে।"

ঘুমন্ত সাদকে কয়েকটা কিস করে কলটা কেটে দিয়ে ড.আলীম বাসা থেকে ততক্ষনাৎ বের হয়ে গেল।
মাহাদের সাথে আর তিতিরের কোন কথা হলোনা। বাসার সবাই তিতিরের দিকেই আঙ্গুল তুলল। ও যদি কাল রাতে এমন কিছু না করতো তাহলে এতোটা বাজে ঘটনা ঘটতোনা। তিতির নিরবে সহ্য কথা শুনলো। ছেলেটা একটু সুস্থ। বাসার পরিস্থিতি খুব একটা ভালো নয়। এতবড় ঘটনা ঘটলো তার কোন সুরাহ পাওয়া গেলোনা। ভিডিওর ঐ ছেলের চেহারা সাথে বাংলাদেশের আইডি কার্ডের কারও সাথে ম্যাচ খায়নি। মনে হচ্ছে সে উড়ে এসে কাজটা করেছে আর দ্রুতই ফিরে গেছে। এমন বাসায় কারা ঢুকলো আর সেটা কোন সময়ে এতদ্রুত কাজ করলো তার কোন খবরও পাওয়া গেলোনা। সবার একই কথা, সাবিনা যেহেতু এই বাসা সম্পর্কে সব জানতো তাই তার দ্বারাই সব কাজ হয়েছে। 


রাত্রি ১০.৩০,
 মাহাদ দ্রুতই ঘুমিয়ে পড়েছে মেয়েকে নিয়ে। মেডিসিনের রেশ এখনো কাটেনি। মাহাদ ঘুমিয়ে পড়লেও অতিথী হাত-পা তুলে খেলা করছে। তিতির আস্তে করে দরজা খুলে দেখে ওর মেয়ে চুপ করে সুয়ে দরজার দিকেই চেয়ে আছে। কোন শব্দ না করে তিতির আস্তে আস্তে অতিথীর কাছে যেতেই ও দু'হাত তুলে মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য ছটপট করতে লাগলো। মেয়েকে কোলে নিয়ে ফিডিং করাতেই মেয়ে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে। এমন সময় রাতিশা এসে ডেকে গেল খাবার খাওয়ার জন্য। 
তিতির নিচে গিয়ে দেখলো যে যার মত খাবার খেয়ে উঠে গেছে। 

বাতাসি বিবি তখনো খাচ্ছিলো। তিতিরকে দেখা মাত্রই খেখিয়ে উঠে বলল-

~" ঐ তুই অ্যার চোখের সামনে আইবিনা। তোরে যেন না দেহি অ্যার চোখের সামনে।"

তিতির কোন কথা না বলে মাথা নাড়িয়ে মাহাদের জন্য খাবার তুলে উপরে চলে গেল। আর এদিকে বাতাসি চোখের পানি ফেলতে লাগলো সাবিনার জন্য।

তিতির রুমে এসে দেখলো মাহাদ বালিশে হেলান দিয়ে বসে আছে। মাহাদকে দেখে তিতির বেশ ভয়ই পেয়ে গেল। সাবিনার মৃত্যুর জন্য সবাই তাকেই দোষারোপ করছে। না জানি মাহাদও ওর উপর আরও রেগে যায়। আজ সবাই তিতিরের বিরুদ্ধে। 

তিতিরকে দেখে মাহাদ স্মিত হেসে বলল-

~" তিতির, টাইট পোষাকে আমার সমস্যা হচ্ছে। একটু বদলে দিবা!"

মাহাদের এতটুকু কথাতে তিতিরের পুরো শরীরে শান্তির বাতাস বয়ে গেল। ও দ্রুত খাবার রেখে একটা ফতুয়া আর লুজ থ্রী কোয়াটার প্যান্ট এনে মাহাদের কাছে আসতেই মাহাদ বলল-

~" আরে বাবা, আগে দরজাটা তো বন্ধ করে আসবা! সবাইকে কি আমার ইজ্জত দেখিয়ে ছাড়বা! যাও দরজা বন্ধ করে দাও।"

তিতির দ্রুত দরজা বন্ধ করে দিয়ে মাহাদের পোষাক চেঞ্জ করে দিতেই মাহাদ বলল-

~" খুব খুদা লাগছে। খাবার গুলো নিয়ে আসো।"

তিতির খাবার গুলো এনে মাহাদের সামনে রাখলো। তারপর মাহাদের পাশে দাড়িয়ে রইলো। চোখে পানি টলমল করছে কিন্তু নিজেকে খুব কষ্টে সংযত করে রেখেছে। মাহাদ তিতিরের দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে বলল-

~" বৌ আমাকে খাওয়াই দিবা! তোমার হাতে খেতে ইচ্ছা করছে।"

এবার তিতির কেঁদেই ফেলল। মাহাদ কিছু বললোনা। বরং খাবার টুকু দু'জনে ভাগ করে খেয়ে নিল। তারপর মেডিসিন খেল। তিতির প্লেটগুলো নিচে রেখে আসতেই মাহাদ বলল-

~" সাদ ঘুমিয়েছে!"

~" হুম....।"

তুমি দাড়িয়ে আছো কেন? আসো এখানে বলে হাত দিয়ে ইশারা করে তিতিরকে ডাকলো। তিতির প্রায় দৌড়েই চলে আসলো মাহাদের কাছে। এসে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। মাহাদ ওর ফোনটা অন্য হাতে নিয়ে লক খুলে কিছু পিক বের করে তিতিরের সামনে ধরলো। তিতির ঘুমাচ্ছে আর মাহাদ ওর গালে আর কপালে ঠোটের ছোয়া দিচ্ছে। তিতির অবাক হয়ে বলল-

~" এগুলো কখনো তুলছেন?"

~" যেদিন বাসায় এসেছি সেদিন রাতে তুলেছি। এতদিন বৌকে ছেড়ে থেকেছি। বাসায় এসে বৌকে ছাড়া আমিতো থাকতে পারবোনা। আরও কিছু আছে দেখবে?"

~" হুম...।"

মাহাদ কিছু ভিডিও দেখালো। তিতির মুগ্ধ হয়ে দেখছে। তার বর প্রতিটা সময় লুকিয়ে লুকিয়ে ভালোবেসে গেছে। কত সুন্দর সময়টা ছিলো। এত কিছু করেছে তবুও তিতির ঘুম থেকে জাগতেই পারেনি। অদ্ভুদ ব্যাপার! মাহাদ ওর হাতে ফোনটা দিয়ে সুয়ে পড়লো। তিতির আর দেখলোনা। সেও মাহাদের পাশে সুয়ে নিরবে চোখের জল ফেলতে লাগলো। 

মাহাদ ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল-

~" সাবিনার মৃত্যু আমাদের অনেক শিক্ষা দিয়ে গেল। ওর মৃত্যু ওভাবেই লেখা ছিল। আমরা যেখানেই থাকিনা কেন! মৃত্যু হতে আমরা বাঁচতে পারবোনা। বাসার সবাই তোমাকে দোষারোপ করছে তাই তো!"

তিতির কাঁদতে কাঁদতে বলল-

~" দাদীতো তার সামনে আমাকে যেতে নিষেধ করেছে। মা, ফুফু ভাবী এমন কি ভাইয়াও আমার উপর রেগে আছে। দাদীতো আমাকে অভিশাপ দিয়েই চলছে। আমিতো শুধু......"

তিতিরে কপালে একটা কিস করে মাহাদ বলল-

~" এর থেকেও অনেক বড় বিপদ আমাদের উপর দিয়ে গেছে। আচ্ছা বলতো, তোমার স্বামীর ভালোবাসা চাই, না বাসার সবার ভালোবাসা চাই! যে কোন একটা চুজ করতে হবে।"

~" আপনার....!"

~" গুড গার্ল। কাল প্রস্তুত থেক। নিজেকে ধৈর্য্যশীল অবস্থায় রাখবা। কাল অনেক কিছু ঘটতে চলেছে। বাবা আসবেন কাল। নিজেকে শক্ত রাখবা সবসময়। তুমিতো মাহাদের বৌ। এত অল্প কিছুতেই ভেঙ্গে গেলে চলবে! পৃথিবীর সবাই তোমার বিপরীতে থাকলেও সব সময় বিশ্বাস রাখবে, তোমার বর তোমার পাশে রয়েছে। কে কি বললো, ডোন্ট কেয়ার। আমি তোমাকে শাসন করবো, ভালোবাসবো, পথ দেখাবো মানে সব কিছু করবো। মনে রেখ তুমি আমার সম্মান আর অর্ধাঙ্গিনী.....। "

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন