বকুল ফুলের মালা - পর্ব ১৮ - সুলতানা পারভীন - ধারাবাহিক গল্প


৩৫!! 

দরজায় নকের শব্দে মায়রা দু হাতে নিজের কান চেপে ধরে রুমের এককোণে দেয়ালের পাশ ঘেঁষে বসে আছে। গত চারটা মাসে প্রতিদিন দুপুরবেলায় এই একটা ঘটনা কমন হয়ে গেছে মায়রার এই বন্দী কারাগারটায়। বাঁধন দুপুরবেলা স্কুল থেকে ফিরেই প্রত্যেকদিন মায়রার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বেশ অনেকক্ষণ ধরে কান্নাকাটি করে। মায়রা চাইলেও দরজাটা খুলতে পারে না। আজও দরজায় নকের শব্দে মায়রা নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে রুমের এক কোণে গুটিশুটি হয়ে বসে আছে। আবারও দরজায় নক পড়লো। মায়রা এবারে উঠে এসে দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে ফ্লোরে বসে পড়লো।

-বাঁধন? এমন করিস না ভাই। প্লিজ?

-মায়রাপু---। আমি কি করেছি? বলো না? তুমি আমার সাথে রাগ কেন করেছ? কেন দরজা খোলো না? ও মায়রাপু?

-প্লিজ-। বাঁধন কাঁদিস না পাখি। 

-তাহলে তুমি দরজা খোলো না? তুমি সবার সাথে কথা বলো--। বাবা সাথে, মায়ের সাথে, ওই পচা তাথৈ আপুর সাথেও বলো-৷ শুধু আমার সাথেই কেন বলো না?

-এইতো এখন বলছি---।

-তাহলে দরজা খোলো এখন--।

-------------------------------

-নইলে আমি কিন্তু কাঁদবো--। এই আম্মু? তুমি আপুকে বলো না? এই আব্বু? 

এবারে আভা মায়রার দরজায় নক করলো।

-মায়রা? বাঁধন তো তোর ছোট ভাই। ছেলেটা তোর জন্য কতোটা পাগল সেটা তো তুইও জানিস। তবু এখনও এমন বন্দী হয়েই থাকবি?

-------------------------------

-তোর ইদ্দতের নব্বই দিন তো সেই কবেই শেষ হয়ে গেছে৷ এখনও কেন ঘরে বন্দী হয়ে নিজেকে কষ্ট দিচ্ছিস আর এই ছোট্ট শিশুকেও কষ্ট দিচ্ছিস? এখনও এমন বন্দী হয়ে থাকার কি খুব দরকার আছে রে মা?

-মামনি?

-কিসের শাস্তি দিচ্ছিস তুই নিজেকে? ওই অমানুষটার সাথে সংসার করতে পারিস নি সেটার? শোন মায়রা? যেখানে তোর কোন ভুল ছিল না তার দায় কেন তুই নিজের ঘাড়ে নিবি? কেউ একজন তোর উপরে এতো অন্যায় করেছে, তবুও তুই তার সাথে মানিয়ে চলার চেষ্টা করেছিস। তবু সে তোকে ছেড়ে চলে যাওয়াই ঠিক মনে করলো--। তাহলে তুই কেন সেসব ভেবে নিজেকে শাস্তি দিবি বলতে পারিস?

-আমি আর পারছি না মামনি-। 

-দরজাটা খোল মায়রা--। তোর মামনি, মামা, ভাই আমরা সবাই তোর পাশে আছি। আমরা বেঁচে থাকতে তোর উপরে আর কোনো আঁচ লাগতে দিবো না মা--। দরজাটা খোল একবার প্লিজ?

-মামনি---।

মায়রা কোনমতে টলমলে পায়ে উঠে দাঁড়িয়ে দরজাটা খুলে দিতেই বাঁধন মায়রাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। বাঁধনের পিছন পিছন আভা আর সামিও মায়রার রুমে ঢুকলো। মায়রাও বাঁধনকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে দেখে আভা মায়রার চুলে হাত বুলালো। 

-বাঁধন কাঁদিস না প্লিজ? আপুই আর কক্খনো এমন করবো না। সরি রে ভাইটু--। সরি?

-আপুই? তুমি কেঁদো না তো--। এই দেখো আমি আছি না? তুমি একদম কাঁদবা না। তাহলে কিন্তু বকে দিবো আমি--। ইইইইই। বুঝসো? কাঁদবা না। পচা পচা পচা লোকটাকে আমি মারবো ধরে-। তুমি কাঁদবা না--।

-হ্যাঁ রে। কাঁদবো না আর--। তুইও আর কাঁদিস না-।

দুপুরবেলা খাওয়া দাওয়া শেষ করে মায়রা বাঁধনকে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে নিজেও ঘুমিয়ে গেছে। হঠাৎ মাথায় কারো হাতের আলতো স্পর্শে ঘুমটা চোখে আরো জাঁকিয়ে বসতে চাইছে মায়রার। এই স্পর্শটা মায়রার ভিষণ পরিচিত। এই স্নেহের ছোঁয়ায় কিছু একটা নেশার মতো আছে যা মায়রাকে সবসময় অন্য একটা ঘোরের মাঝে ডুবিয়ে দেয়। কেন হয় এমনটা? লোকটাকে নিজের অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে ভালোবাসে বলে? কথাটা মাথায় আসতেই ধড়মড় করে উঠে বসলো মায়রা। আর মাথার কাছে বসে চুলে হাত বুলানো আয়ানকে দেখে একেবারে ভূত দেখার মতো চমকে গেল। গত চারটা মাসে যে লোকটা একটা বারের জন্য কল পর্যন্ত দেয় নি, সেই আয়ান কিনা একেবারে ওর মাথার কাছে বসা! ব্যাপারটা রীতিমতো অবিশ্বাস্য লাগছে মায়রার কাছে। সব ভুলে মায়রা হা করে আয়ানের দিকে তাকিয়ে ভাবার চেষ্টা করলো মানুষটা সত্যি ওর সামনে বসা? নাকি প্রত্যেকদিন মানুষটাকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে মাথায় কোন গন্ডগোল শুরু হয়েছে ওর! তাই লোকটাকে এমন হুট করে সামনে বসা দেখছে?

আয়ানও কিছু না বলে মায়রার উষ্কখুষ্ক মুখটা দেখছে। মেয়েটার চোখে মুখে আগের সেই উজ্জ্বলতা খেলা করছে না। চুলগুলোও কেমন উষ্কখুষ্ক। পড়নে হালকা রঙা একটা থ্রি পিস। এই হালকা রঙটায় মায়রার মুখটাকে আরো যেন বিষন্ন করে ফুটিয়ে তুলছে। সাজহীন মুখ, বিষন্ন চেহারা আর উষ্কখুষ্ক চেহারার মায়রাকে দেখে আয়ানের বুকের ভিতরটা হু হু করে উঠছে। মেয়েটাকে না দেখে এ কয়টা মাস কি করে যে ছিল আয়ান নিজেই জানে। এবারে আর সামলাতে না পেরে মায়রাকে একহাতে টেনে একেবারে বুকের মধ্যে লুকিয়ে ফেললো আয়ান। আর মায়রা তখনো ঘোরের মধ্যেই আছে।

-এই মেয়ে? এই কয়দিনে নিজের কি হাল করেছ? এই নাকি তুমি অসহায় মেয়েদের পাশে দাঁড়াবে! নিজেকেই যদি সামলাতে না পারো আর দশজন অসহায়কে কি করে সামলাবে?

-তুমি? আয়ান? তুমি এখানে? কেন এসেছ এখানে? ছাড়ো---।

-শশশশ। বাঁধন ঘুমাচ্ছে দেখছ তো? বাচ্চা মানুষ কাঁচা ঘুমটা ভাঙ্গলে কাঁদবে না?

-তুমি! তুমি রুমে এলে কি করে?

-দরজা তো খোলাই আছে। দরজা দিয়েই আসলাম----।

-কেন এসেছ? প্লিজ----।

-আর একবার চলে যেতে বললে ঠাস করে একটা থাপ্পড় লাগিয়ে দিবো মায়রা-। নিজেকে কি ভাবো কি তুমি? আগেরবার নাহয় তোমার করার কিছু ছিল না। বাবা মায়ের জন্মের ঋণ শোধ করতে গিয়ে আমাকে দূরে ঠেলে দিয়েছিলে। কিন্তু এবার? এবার কিসে আটকাচ্ছে তোমার? একটা অকৃতজ্ঞ লোক, যে তোমাকে দু পয়সার দাম দেয়নি কখনো, সেই লোকটার জন্য তো আমাকে দূরে ঠেলে দিচ্ছো না তুমি। তাহলে কেন? কেন কেন কেন? কেন আমার কাছ থেকে পালানোর জন্য এতো ছটফট তোমার? কেন সেদিন আমাকে না জানিয়েই চোরের মতো পালিয়ে এলে? কেন নিজের জীবনের সাথে আমাকে জড়াতে চাইছ না তুমি? কি দোষ আমার সেটা কি বলবে প্লিজ? কোন বারবার আমাকেই তোমাকে হারাতে হয়? কেন অন্য কারো কাজের শাস্তি আমাকেই পেতে হয়? কেন তোমাকে খুব ভালোবেসেও তোমাকে আমি পাই না? কিসের বাধা বলতে পারো?

-সব প্রশ্নের উত্তর হয় না আয়ান।

-কিন্তু আমার এই প্রশ্নের উত্তর তো তোমাকে দিতেই হবে মায়রা। তুমি এতোদিন কিসব ইদ্দত পালন করছিলে-- সেসব তো শেষ। তবে কোন আমার ভাগ্যে এখন তুমি থাকবে না? কিসের বাধা এখন আমাদের মিলনে? কিসের ভয়ে আমার কাছে ধরা দিতে এতো আপত্তি তোমার? সত্যি যদি তুমি লজিকাল একটা কারণও দেখাতে পারো তবে সত্যি বলছি আর জীবনেও তোমার সামনে এসে দাঁড়াবো না--। বলো তুমি--। 

-আমি তো আগেই বলেছি----।

-আগে তুমি কি বলেছ আমার মনে নেই। এখন বলো--। আমার চোখে চোখ রেখে বলো---। কি সমস্যা? তোমাকে পেতে ঠিক কি করতে হবে? তোমার বাবা মায়ের হাতে পায়ে ধরতে হবে? তাও ধরবো নাহয়। তুমি মুখ ফুটে একবার বলো---।

-আমাদের সব চাওয়া যে পূরণ হবে তেমনটাও তো নয় আয়ান---।

-দয়া করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে না বলে সহজ সোজা কথাটা বলে দাও মায়রা। আমার সাথে জীবনের বাকি সময়টুকু কাটাতে চাও কি না? জাস্ট ইয়েস অর নো তে আনসার দিবা। 

-সেটা হয় না আয়ান---।

আয়ান এবারে মায়রাকে বুক থেকে সরিয়ে দু হাতে মায়রার কাঁধ চেপে ধরে ঝাঁকি দিলো।

-কেন হয় না? সেটাই তো জানতে চাইছি আমি। বলো? কেন হয় না? 

-আস্তে আয়ান---। বাঁধন জেগে যাবে---।

-তোমাকে যেটা জিজ্ঞেস করছি সেটা বলো--। কেন হয় না? কিসের অভাব আমার ভালোবাসায়? 

-ভালোবাসাই সব কিছু নয় আয়ান। সমাজ বলে একটা কথা আছে। আমাকে নিয়ে চলতে গেলে লোকের হাজারটা কথা তোমাকে শুনতে হবে৷ লোকে নিন্দে মন্দ করবে--। আমার জন্য তোমাকে বা তোমার পরিবারকে কোনভাবে সাফার করতে হওয়ার চেয়ে---।

-একদম চুপ--। কিসের সমাজ হ্যাঁ? সমাজ শিখাও তুমি আমাকে? তোমাকে আমি ভালোবাসি। পাগলের চেয়েও বেশি ভালোবাসি। আর তুমি আমাকে কতোটা ভালোবাসো সেটা কাউকে বলে দিতে হবে না--। কে কি মন্তব্য করলো সেটা ভেবে আমি আমার ভালোবাসাকে পেয়েও হারিয়ে ফেলবো? এতোটা গাধা মনে হয় আমাকে তোমার?

-আবেগ আর বাস্তবতার মাঝে আকাশ পাতাল ফারাক আছে আয়ান। 

-এই চুপ থাকো তো। আমাকে বাস্তবতা দেখাতে আসবা না একদম। আর এই তোমার বিয়ে না করার লজিক তো? নাকি আরো লজিক বাকি আছে?

-------------------------------

-বেশ! একটা কথা বলছি শোনো। তোমাকে ভালোবাসি। আর তোমাকে আজীবনের জন্য নিজের করে নিতে এই একটা কারণই আমার জন্য যথেষ্ট। তোমার এমন আজাইরা লজিক শুনে মত বদলানোর ছেলে আমি না। এখন একদম ফ্রেশ হয়ে যাও। সন্ধ্যায় মা বাবাকে নিয়ে আসছি। এখন আমার আগের মায়রা হয়ে যাও---। যদিও বাবা মা তোমাকে দেখে না করবে না। তবুও আমি চাই তোমাকে আগের সেই প্রাণবন্ত রূপে দেখতে--। আমার হাসিখুশি লাজুক মায়রাটাকে দেখতে চাই---।

-কেন বুঝতে পারছো না তুমি? এটা কিছুতেউ সম্ভব না। আমি পারবো না--।

-শোনো মায়রা? একটা শেষ কথা বলি তোমাকে। তুমি কোন ভ্যালিড কারণ দেখালে আমি অবশ্যই তোমার যতদিন সময় লাগে দিতাম--। কিন্তু তুমি যা বলছ তার পরে আমি ঠিক করেছি কোন সময় দেয়া হবে না তোমাকে। বড় জোর একটা সপ্তাহ পাবে। এর মধ্যেই সোজা বিয়ে করে নিয়ে যাবো--। সে তুমি যতই নাচানাচি করো না কেন---।

-কেন কথা শুনছ না তুমি? এভাবে হয় না আয়ান। আর তোমার বাবা মা তারাও কি মন থেকে মেনে নিতে পারবেন? তারাও তো আশা করছে যে তোমার জন্য তাদের পছন্দ মতো কাউকে----।

-শোনো মায়রা? একটা সহজ কথা বলি। গত একটা বছর আমার কি করে কেটেছে সেটা শুধু আমিই জানি। তোমাকে হারানোর পর মরে যাওয়াটাই বেশি সহজ বলে মনে হচ্ছিলো--। তবু বেঁচে থাকতে বাধ্য হয়েছিলাম। মা বাবার কথা ভেবে মরার মতোই বেঁচে ছিলাম। প্রতিনিয়ত তোমাকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করেছি, ঘৃণা করারও চেষ্টা করেছি। কিন্তু আমার সবটা জুড়ে তুমি তখনও ছিলে, এখনও আছো। গত চারটা মাস তোমাকে পাওয়ার সবকটা সম্ভাব্য দিক নিয়ে যতটা সম্ভব ভেবেছি, প্ল্যানিং করেছি কিভাবে কি করবো--। আগের বার ফিরিয়ে দিয়েছিলে, তবু একটা ছোট্ট আশায় বুক বেঁধে বেঁচেছিলাম। কিন্তু এবারে যদি আজও আমাকে ফিরিয়ে দাও--তাহলে জানবে এই আয়ানের মরা ছাড়া কোন পথই খোলা থাকবে না---। তোমাকে না পেলে কাল সকালের সূর্যটাও আমার জীবনে আসবে না মায়রা। কথাটা মাথায় রেখো----।

-ব্ল্যাক-ব্ল্যাকমেইল করছো? তুমিও আমাকে এভাবে ব্ল্যাকমেইল করতে পারলে?

-তোমাকে পাওয়ার জন্য আমি সব করতে পারি মায়রা। আগেরবার এতোটা কঠোর হলে হয়তো তোমাকে হারাতে হতো না---। তবে এবারে আর কোন চান্সই আমি নিবো না। আজ হয় তুমি আমার হবে-নয়তো জানবে তোমাকে না পেয়ে তোমার ভালোবাসার মানুষটা এই পৃথিবীটাই ছেড়ে দিয়েছে---। যদি বিশ্বাস না হয় তাহলে এখনই প্রমাণ দিতে পারি--। দাঁড়াও--। একটা ছুড়ি বা ব্লেড হবে তোমার কাছে?

-আয়ান?

-ভয় নেই। এখনো হাতে কয়েক ঘন্টা সময় আছে। ভাবো। ভেবে সিদ্ধান্ত নাও। আমি বাঁচলাম কি মরলাম সেটা না ভাবলেও চলবে। তুমি আমার সাথে থাকতে চাও কি চাও না সেটাই নাহয় ভাবো----। যদি শুধু আমার পরিবার রাজি হবে কি না সেটা নিয়ে সমস্যা মনে করো, তাহলে একটা কথা বলি। বাবা মা কে আমি নিজের মতো করে সামলে নিবো। ওকে? আসছি এখন। বায় মায়রা। 

আয়ান মায়রার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে উঠে সোজা বেরিয়ে গেল রুম থেকে। আর মায়রা বিছানায় বসে আয়ানের চলে যাওয়ার দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো। জীবন আবার কোন অদ্ভুত মোড়ে এনে ওকে দাঁড় করাচ্ছে? কি করবে ও এখন? ছোট্ট একটা ডিসিশন নিতে হবে মায়রাকে। কিন্তু এই একটা সিদ্ধান্ত কি নতুন ঝড় তুলবে ওর জীবনে? আর ভালোবাসা আর বাস্তবতার লড়াইয়ে কোন দলের হয়ে মাঠে নামবে মায়রা? সব কিছুই গোলমেলে লাগছে মায়রার৷ কয়েকটা ঘন্টা পর কি ঘটতে চলেছে কে জানে।

৩৬!! 

মাগরিবের নামাজ শেষ করে তাথৈয়ের দেয়া সোনালি হলুদ রঙা শাড়িটা হাতে নিয়ে বসে ভাবছে মায়রা৷ কিভাবে কি হবে কিছুই ভাবতে পারছে না৷ ধর্মীয় কোন বাধা যদিও নেই ওদের বিয়েতে। তবুও নিজেকে আয়ানের জীবনে কেমন একটা অযাচিত লাগছে মায়রার নিজের কাছেই। ছেলেটা ভালোবাসে বলে আবেগের বশে আগেপিছে না ভেবেই না হয় এমন একটা সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। কিন্তু পরে যদি সিদ্ধান্তের জন্যেই কখনো তাকে পস্তাতে হয়? যদি কখনো মনে হয় মায়রাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্তটা ওর জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল একটা সিদ্ধান্ত ছিল? তখন? তখন নিজেকে তো চাইলেও ক্ষমা করতে পারবে না মায়রা? আবেগের বশে ভালোবাসার মানুষের হাত ধরে ঘর ছাড়ার পর যদি বুঝতে পারে কাজটা ঠিক ছিল না? তখন ছেলেটা নিজের ভুলটা তো জীবন দিয়েও শোধরাতে পারবে না। বাধা পড়ে যাওয়ার আগে সেটা কি তার ভেবে দেখা উচিত নয়? কিন্তু এই পাগলটা তো গোঁ ধরে বসে আছে৷ বিয়েতে রাজি না হলে হয়তো সত্যিই নিজের কোন ক্ষতি করে ফেলবে। সেটাও বা মায়রা কি করে মানবে? এই নিয়ে ভয়ংকর দ্বিধায় পড়ে গেছে মায়রা।

অনেকক্ষণ ভাবার পরও কোন সিদ্ধান্ত নিতে না পেরে শাড়িটা পড়ায় মন দিলো মায়রা। যা হবে পরে দেখা যাবে। যা কপালে থাকবে তা বদলানোর ক্ষমতা তো কারো নেই। শাড়িটা পড়া শেষ হতেই দরজার নকের শব্দে চমকে উঠলো মায়রা৷ উঠে গিয়ে দরজাটা খুলে দিলে তাথৈ রুমে আসলো। মায়রাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসিয়ে দিয়ে সাজানোয় মন দিলো। মায়রা বাধা দেয়ার চেষ্টা করতেই তাথৈ বিরক্ত হয়ে একবার মায়রার দিকে তাকিয়ে আবার সাজানো শুরু করলো। 

-জানিস মায়রা? রিহানের সাথে আমার সম্পর্কটা বেশ অনেকদিনের৷ প্রায় ছ-সাত বছরের প্রেম আমাদের। এতোদিন ধরে একটা সম্পর্ক চালিয়ে যাওয়া কতোটা মুশকিল সেটা তো জানিস। সময়ের সাথে সাথে দূরত্ব আসে দুজনের মাঝে৷ হয়তো একজনের জন্য অন্যজনের রেসপেক্ট কমে যায়। নয়তো অন্য কাউকে তার চেয়ে বেশি ভালো লাগে, আকর্ষণীয় মনে হয়। বা প্রিয় মানুষের করা ইগনোরেন্স সম্পর্কটার সমাপ্তি ঘটায়। আমাদের ক্ষেত্রে তেমনটা কখনোই হয়নি জানিস? আমি ওকে যতোটা না ভালোবাসি, ও আমাকে তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি ভালোবাসে। আর দশটা বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ডের মতো সন্দেহ জিনিসটা ছিল না আমাদের মধ্যে। ভালোবাসার নামে মাথায় ছড়ি ঘোরানোর বালাইও ছিল না। কোন কারণে সময়ে অসময়ে কল ওয়েটিং পেলে গোয়েন্দার মতো প্রশ্নবানও ছিল না। আমরা নিজেদের মতো করে নিজেদের বুঝে নিতাম। কখনো কখনো হয়তো দিনশেষে একবারও 'আই লাভ ইউ' বলা হয়নি আমাদের। কিন্তু এটাই আমার কাছে ভালোবাসা। এই ভালোবাসার জোরেই আমি মা বাবার অন্যায় আবদারের আগল ছেড়ে ওর হাত ধরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছি। মনে যে একেবারেই কোনো ভয় ছিল না তাও কিন্তু না। কিন্তু ম্যারেজ রেজিস্টারের অফিসের বাইরে ওর বাবা মাকে দেখে সেই ভয়টা কেটে গেছে নিমিষেই। আমাদের এই গল্পটা থেকে কি বুঝলি মায়রা?

-ভাইয়া তোমাকে খুব ভালোবাসে। আর তুমিও--। তাই হাজার বাধার পরও আজ তোমরা একসাথে। আর খুশি---।

-হ্যাঁ। ঠিক বলেছিস একদম। আমি নিজের সমস্ত পিছুটান ছেড়ে এসেও তার সাথে খুশি। কারণ সেই মানুষটা আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসে। তার চোখের দিকে তাকিয়ে আমি ফিল করতে পারি আমৃত্যু আমি তার সাথে থাকতে চাই। আর তার সাথেই আমার সমস্ত সুখ জড়িয়ে আছে।

-হুম--। তুমি অনেক লাকি আপু৷ সবার এমন ভালোবাসা পাওয়ার ভাগ্য হয় না----।

-আয়ান তোকে এর চাইতেও বেশি ভালোবাসে মায়রা। সেদিন সীমান্তের সাথে আমার বিয়েটা হয়ে গেলে--। আর এতোগুলো দিন পর আমি আবার রিহানের সামনে ফিরে এলে সে কি সিদ্ধান্ত নিতো সেটা আমি ভয়েও ওকে জিজ্ঞেস করতে পারি নি মায়রা৷ কিন্তু এই ছেলেটা দেখ? তোকে সেদিন কক্সবাজারে ওইভাবে দেখে তখনই---। তোর হয়তো মনে হতে পারে এতোদিন তাহলে কেন কোন যোগাযোগ করে নি--। তাই না? ও কিন্তু এই চারটা মাস তোর সমস্ত খবরাখবর নিয়েছে। কি খাচ্ছিস, কি করছিস সমস্ত খবর--। 

-আপু?

-ভালোবাসা বারবার ফিরে আসে না রে মায়রা। নিয়তি যখন চাইছে তুই সুখী হ, তাহলে কেন নিজের সুখটা নিজে মানছিস না তুই? 

-আপু? সবাই যখন জানতে পারবে আমি ডিভোর্সি তখন তো----।

-আয়ান নিজের দিক থেকে সবটা সামলে নিয়েছে মায়রা। সেসব নিয়ে চিন্তা করিস না। আর যদি তেমন কোনো পরিস্থিতি আসেও দুজনে মিলে সেটা মোকাবেলা করবি। একটা কথা মনে রাখিস। ভালোবাসার মানুষটার মুখের দিকে তাকিয়ে মানুষ অনেক বড় যুদ্ধেও জয়লাভ করতে পারে। শুধু প্রিয় মানুষটার মুখের হাসি আর সাহসটা সবচেয়ে বড় টনিকের কাজ করে তখন। 

-আপু---। 

-শোন মায়রা? ছেলেটা গত দশটা মাস অপেক্ষা করেছে তোর জন্য। অন্য কেউ হলে এতোদিনে জেদ দেখিয়ে বিয়ে করে ফেলতো। আয়ান সেটা করে নি। কেন জানিস? কারণ সত্যিকারের ভালোবাসা ভুলে যাওয়া এতোটাও সহজ নয়। তুই প্লিজ ওর সাথে নতুন করে নিজের জীবনটা শুরু কর। একজন সীমান্ত তো আর মায়রার জীবন থেকে সমস্ত সুখটা কেড়ে নিয়ে যেতো পারে না। তোকে সুখে থাকতে হবে মায়রা, ভালো থাকতে হবে।

---------------------------

-অনেক কান্নাকাটি হয়েছে। এবার চোখ মোছ। আর একদম কাঁদবি না৷ দেখা যাবে তোর এমন পেত্নীর মতো চেহারা দেখে ওদের বাড়ির কেউ বিয়েতে রাজিই হবে না---।

-আপুই??

তাথৈ মায়রার সাজের ফিনিশিং টাচ দিচ্ছে এমন সময় কোথা থেকে বাঁধন ছুটে এলো। সোজা এসে মায়রার দিকে তাকিয়ে অবাক অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর তাথৈয়ের হাতে টুপ করে একটা চিমটি কাটলো। তাথৈ 'আউচ' করে উঠতেই বাঁধন আর মায়রা দুজনেই হেসে উঠলো।

-উফ! বাঁধন? এতো জোরে চিমটি কাটলি কেন বজ্জাত? কান মলা খাওয়াবো মামিকো বলে দাঁড়া তুই।

-ইশ! আমি তো চেক করলাম এটা স্বপ্ন নাকি সত্যি। আমরা বউটাকে কি সুন্দর সাজিয়েছ--। পুরাই বারবি ডল। উম্মাহ!

-আল্লাহ! মায়রা! এই ছেলে কি বলে এসব? আয়ানের কপালে দেখি একটা বাচ্চা সতীন জুটে গেছে এর মধ্যেই---।

-এই এই? পচা মেয়ে কিসব বলো? একটা কথা বলতে এসেছি তোমরা সেটাও শুনছ না? পরে মা আবার আমাকে বকবে--। মা বলেছে বারবিডলকে নিয়ে যেতে--। আয়ান ভাইয়ারা চলে এসেছে---।

-এই যে হিরো? আয়ান যে তোমার ডলকে নিয়ে পালাবে সেটা কি জানো? তখন কি করবে?

-ইশ! ভাইয়া আমাকে বলেছে যখনই চাইবো তখনই মায়রাপুকে নিয়ে আসবে--। আর অনননেএএক চকলেটও দিয়েছে আমাকে--। 

-এই রে? চকলেট পেয়ে নিজের বউকে দিয়ে দিলি?  হায় রে! বাচ্চাটা?

-এই এই? মায়রাপু? এই পচা মেয়েটাকে বলো তো চুপ করতে। নইলে আরেকটা চিমটি দিবো। চিমটি না চিমটি না। খামচি দিবো বলে দিলাম--। আয়ান ভাইয়া বলেছে বউ হবে বয়সে ছোট৷ নইলে কথা শুনবে না। কান মলা দিবে মায়রা আপুর মতো। উহু উহু। তাই মায়রাপুকে বিয়ে করবো না। সবার সামনে কান মলা দিলে আমার লজ্জা করবে না? 

-ওরে বাবা? এতো চুক্তি হয়ে গেছে আয়ানের সাথে?

-হুম তো। ভাইয়া বলেছে একটা পুতুল দেখে বউ এনে দিবে আমাকে। এই এই? মায়রাপু জানো? একটা ছোট্ট কিউট পুতুলও এনেছে। একটা আপু পুতুলটাকে কোলে করে বসে আছে। জানো? পুতুলটা হাত পা নাড়ে। কাঁদে আবার হাসে। কি কিউট। 

মায়রা আর তাথৈ দুজনেই মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। বাঁধন আবার মায়রার হাত ধরে টানতে শুরু করলো।

-ও মায়রাপু? মা বকবে তো? চলো না? চলো না?

তাথৈ আর মায়রা দুজনেই হেসে ফেললো। তাথৈ বাঁধনের মাথায় একটা গাট্টা মেরে মায়রাকে নিয়ে ড্রইংরুমে এলো। মায়রার কেন যেন ইতস্তত লাগছে। আর সাথে বেশ অনেক ভয়। আয়ানের মা বাবার ওকে পছন্দ হবে তো? যদি হয়ও তারপর কি হবে? মায়রার বাবা মা কি বিয়েটা আধো হতে দিবে? মনে এমন হাজারটা প্রশ্ন নিয়ে দুরুদুরু বুকে মায়রা ড্রইংরুমে এসে দাঁড়ালো। কোনমতে কাঁপা গলায় সবাইকে সালাম দিলো। মুখ তুলে কারো দিকে তাকানোর সাহস হলো না মায়রার। একটু পরে কেউ একজন উঠে এসে মায়রাকে হাত ধরে নিয়ে সোফায় বসিয়ে দিলো। মায়রা এবারে একবার মুখ তুলে সামনে বসা মানুষগুলোকে দেখে নেয়ার চেষ্টা করলো। আয়ানের বাবা মায়ের সাথে আরিশা আর তাওহীদকেও দেখলো মায়রা। আর আয়ানের কোলে ছোট্ট একটা ফুটফুটে পুতুলের মতো পরী। মায়রা থতমত খেয়ে আয়ানের দিকে কয়েক মিনিট তাকিয়ে থেকে আয়ানের চোখে চোখ পড়তেই লজ্জা পেয়ে চোখ নামিয়ে নিলো। নিজের এমন গাধামির জন্য নিজেই মনে মনে গালি দিল মায়রা৷ 

আর এদিকে মায়রার এমন লজ্জা পাওয়া মুখটা দেখে আয়ান, আরিশা আর তাওহীদ তিনজনেই মিটিমিটি হাসছে। আয়ানের বাবা মা মায়রাকে দু একটা প্রশ্ন করে মায়রার মামা মামির সাথে কথা বলছে। আর মায়রা নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে পায়ের ঠকঠক করে কাঁপানো বন্ধ করার৷ বাইরে থেকে বোঝা না গেলেও মায়রার মধ্যে যে তুফান চলছে সেটা আরিশা বুঝতে পেরে হেসে আয়ানকে পাশ থেকে কনুই দিয়ে একটা গুঁতো দিলো। 

-আয়ান? তোরা দুজন এভাবে স্ট্যাচু হয়ে বসে না থেকে বাড়িটা ঘুরে দেখ। আর নিজেরাও একটু কথা বলে নে। আর আরশিকে আমার কোলে দিয়ে যা। কি বলেন আঙ্কেল আন্টি? ওরা একটু নিজেরা কথা বলুক?

-আরে হ্যাঁ হ্যাঁ যাও--। 

আয়ান পিচ্চিটাকে কোলে নিয়েই উঠে দাঁড়ালে তাথৈ মায়রাকে নিয়ে রুমের দিকে পা বাড়ালো। আয়ানও চললো পিছুপিছু। মায়রা হাবিজাবি চিন্তা করতে করতেই কখন রুমে এসেছে টেরই পায়নি৷ দরজা বন্ধের শব্দ শুনে চমকে পিছনের দিকে তাকাতেই রুমে শুধু আয়ানকে দেখে একটু ভড়কে গেল মায়রা৷ আয়ান হেসে মায়রার কোলে আরশিকে ধরিয়ে দিয়ে নিজে বিছানায় গিয়ে বসে পড়লো। আর মায়রা? বেচারি এই দুই আড়াই মাস বয়সী বাচ্চা পুতুলটাকে কোলে নিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে রইলো। আর ছোট্ট আরিশটা অবাক অবাক চোখে মায়রার দিকে পিটপিট করে তাকাচ্ছে আর মিটিমিটি হাসছে। সেই হাসিতে সত্যি যেন মুক্তা ঝরছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন