উমা - পর্ব ০৩ - মুশফিকা রহমান মৈথি - ধারাবাহিক গল্প


রাত বাড়ছে, সারাদিনের ধকলে ক্লান্ত শরীর ঘুমে জড়িয়ে গেছে উমার। হঠাৎ কারোর স্পর্শ পেতেই আৎকে উঠলো সে। সে ঘরে একা, তাই চিৎকার করতে যায় সে। তখনই মুখ আটকে ধরে কেউ। ধীর স্বরে বলে,
"চেঁচিয়ো না, আমি রুদ্র"

পুরুষালি হাত জোড়া উমার শরীরে বিচরণ করছে। উষ্ণ নিঃশ্বাস ছুয়ে যাচ্ছে কান। গভীর নিরব রাতের অন্ধকারে রুদ্রের মুখশ্রী দেখা না গেলেও অবয়বটুকু দেখা যাচ্ছে। আকর্ষিক ভয়ে উমার শরীর অবশ হয়ে আসছে। রুদ্র তো নিখোঁজ ছিলো! এই ব্যাক্তি কোথা থেকে আসলো? রুদ্রের শান্ত লাল চোখ জোড়া তখন তাকিয়ে আছে উমার দিকে। আলতো হাতে অবাধ্য চুলগুলো গুজে দিলো কানের পেছনে। কেঁপে উঠলো ষোড়শীর সমস্ত শরীর। এই প্রথম কোনো পুরুষের শীতল স্পর্শ পেয়েছে সে। আমাবস্যার আঁধারে উমার অস্থিরতা চোখে পড়লো না রুদ্রের। তার চোখে মাদকতা। আজ প্রথম নেশা না করেও নেশাগ্রস্থ সে। উষ্ণ ঠোঁট ঠেকালো উমার গলার কাছে। জড় কালো কুৎসিত ভয় উঁকি দিলো মনের ভেতর উমার। সারা শরীর শিরশির করে উঠলো তার। অস্থিরতা বাড়লো। দম আটকে আসতে থাকলো উমার। তীব্র আতঙ্ক ত্রাসে হাত পা ছুড়তে লাগলো সে। উমার অস্থির আচারণে খানিকটা বিরক্ত হলো রুদ্র। মূহুর্তেই ঝাঁঝিয়ে উঠলো সে,
"নড়ছো কেনো?"
"ছাড়...ছাড়ুন আমায়"

কাঁপা ভীত স্বরে কথাটা বলে উমা। চোখ জোড়ায় নোনা জলের ঢেউ উঠেছে। গলাটা আটকে আসছে, রুদ্রকে ধাক্কা দেবার চেষ্টা করতে লাগলো উমা। নিজেকে তার কাছ থেকে ছাড়ানোর প্রবল চেষ্টা করতে লাগলো সে। উমার নড়াচড়া, ছটপটানিতে বিরক্ত হয়ে ছেড়ে দিলো রুদ্র তাকে। রুদ্রের হাত থেকে মুক্তি পেতেই বিছানা থেকে দাঁড়িয়ে পড়লো উমা। হাপাতে হাপাতে দ্রুত হস্তে মোমবাতিটা জ্বালালো উমা। মোমের হলুদ আলোতে উজ্জ্বল হলো অন্ধকার কালো ঘর। সেই ঔজ্জ্বল্যে ভীত চোখে তাকালো রুদ্রের দিকে। খাটে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রুদ্র তাকিয়ে আছে তার দিকে। আজ প্রথম নজর রুদ্রকে খুতিয়ে দেখলো উমা। এর আগেও রুদ্রকে দেখেছে সে, কিন্তু ভয়ের চোটে কখনো মাথা তোলার সাহস পায় নি। লোকটা সুদর্শন, গ্রামের আর পাঁচটা সুদর্শন, সবল লোকের গণনায় নির্দ্বিধায় পড়ে সে। লম্বাটে ফর্সা মুখ, কালো চুল পড়ে রয়েছে কপালে, চাপদাঁড়িতে ঘিরে আসে গাল; ঘোলাটে চোখের হিংস্র চাহনী এড়ালো না উমার নজরে। রুদ্র মুখ খিঁচিয়ে বললো,
"আমি তো বললাম, আমি রুদ্র। তাহলে এতো ছটপটানি কেনো?"
"আপনি..এখানে?"
"আমি বাদে কি অন্য পুরুষকে আশা করছিলে তুমি?"

রুদ্রের এমন প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেলো উমা। এটা কেমন ধারা প্রশ্ন? উমাকে চুপ করে থাকতে দেখে তার দিকে এগিয়ে এলো রুদ্র। উমা দুকদম পিছিয়ে যেতে নিলেই রুদ্র তাকে খপ করে ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে ফেললো। কানে ঠোঁট লাগিয়ে বললো,
"পালাচ্ছো কেনো? পালিয়ে লাভ নেই। এতদিন পর ঘুঘুকে খাঁচায় আটকাতে পারলাম।"
"ছাড়ুন আমায়?"
"ভুলে যেও না আমি তোমার স্বামী। অধিকার আছে তোমার উপর।"

রুদ্রের কথায় জমে গেলো উমা। বিয়ে মানেই কি তবে শারিরীক সম্পর্ক? বুয়ে মানেই তার উপর পূর্ণ অধিকার পেয়ে যাবে রুদ্র? এমনটা কেনো? যে উমার উপর তার নিজের অধিকার নেই সেই উমার উপর আজ অন্য কেউ অধিকার জমাচ্ছে। অজান্তেই নোনাজল গড়য়ে পড়ে চোখ থেকে। যাকে চিনলো না জানলো না তাকে নিজেকে কিভাবে সপে দিবে উমা? ত্রাসে বুকটা ভীত হয়ে এলো উমার। রুদ্রের হাতের বেষ্টনী থেকে নিজেকে ছাড়াতে চাইলো সে। কিন্তু পুরুষের শক্তির সাথে পেরে উঠলো না। রুদ্র নিজের শক্তির অপব্যাবহার করলো। টেনে ছুড়ে ফেললো বিছানায়। নিজেকে চাপিয়ে দিলো কিশোরীর উপর। উমার আর্তনাদ লাল দেয়ালেই আটকে থাকলো। এক হিংস্র পাশবিক রাতের মুখোমুখি হলো উমা। নিজের সকল বাসনার পূর্তি করলো রুদ্র। আমাবস্যার অন্ধকারে এক কিশোরীর মেয়ের ইচ্ছাকে গলা টিপে হত্যা করা হলো। একটা সময় সকল চেষ্টা ছেড়ে দিলো উমা, ছটফটানি থেমে গেলো। জড় বস্তুর মতো পড়ে রইলো সে। 

নিঝুম রাত। রুদ্র ঘুমে মগ্ন। উমার চোখে ঘুম নেই। এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো সিলিং এর দিকে। জীবনসঙ্গী নিয়ে ভাবনাটা সকল কিশোরীর ই থাকে। উমার ও ছিলো। বড় দিদিদের কাছে শুনেছিলো, বরেরা নাকি ভালোবাসে, স্নেহ করে। ভালোবাসার অর্থটি না জানলেও উমার মনে এক সুপ্ত বাসনা ছিলো তার সঙ্গীটি তাকে প্রচন্ড আগলে রাখবে, তার ইচ্ছের সম্মান করবে; তার মনটাকে বুঝবে। কিন্তু রুদ্রের এই পাশবিক আচারণ তার সকল স্বপ্নকে মূহুর্তেই পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে। মানুষটাকে অপছন্দ ছিলো ঠিক ই কিন্তু এখন ঘৃণা জন্মাতে লাগলো তার প্রতি। এটাই যদি ভালোবাসা হয় তবে চাই না তার ভালোবাসা, চাই না তার স্নেহ। বুকটা হু হু করে উঠলো উমা। বালিশে মুখ গুজে নোনাজল ছেড়ে দিলো সে। রুদ্রের ছোঁয়া বিষ লাগলো তার। কোনো মতে উঠে দাঁড়ালো সে। শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে স্নানঘরের দিকে এগুলো সে। দরজা লাগিয়ে বালতিতে পানি ভরলো। পুরোটা শরীর সাবান দিয়ে ধুয়ে রুদ্রের বিষাক্ত ছোঁয়াগুলো মিটিয়ে দিতে চাইলো। ঠোঁট কামড়ে কাদতে লাগলো। মনে মনে বললো,
"হে ভগবান, আমায় মুক্তি দাও। মুক্তি দাও।"

উমার এই কান্নাটুকু শোনার ও কেউ নেই এই জমিদার বাড়িতে। ঘৃণায় গা গুলোচ্ছে তার। রুদ্রের প্রতি এক তরী ঘৃণা নিয়ে কি করে দিনের পর দিন থাকবে তার সাথে? স্নান শেষে বেড়িয়ে এলো উমা। চোখ গুলো ফুলে উঠেছে, ফর্সা মুখটা লাল হয়ে গেছে। রুদ্র তখন ও ঘুম। একরাশ ঘৃণা নিয়ে তাকালো তার দিকে। একই বিছানাতে শুতেও ইচ্ছে হলো না উমার। বেশ কিছুসময় দাঁড়িয়ে থেকে ধীর পায়ে বেড়িয়ে এলো কক্ষ থেকে। অন্ধকার বাড়িতে একা একা উমা হাটছে। উমার বরাবর ই ভুত প্রেতে ভয় ছিলো। কিন্তু আজ সেই ভয়টা বিলীন হয়ে গেছে। আজ যদি তেনারা তাকে উঠিয়ে নিয়ে যায় আফসোস নেই। অন্তত এই পাষন্ড দুনিয়া থেকে তো মুক্তি পাবে!

সকালের কিরণ পূবের জানালা দিয়ে উঁকি দিচ্ছে রুদ্রের রুমে। সকালে ওঠার স্বভাব নেই তার। তবে আজ তার ঘুমটি ভাঙ্গলো ভোরেই। মুখে তৃপ্তির হাসি নিয়ে চোখ খুললো রুদ্র। এর একটাই কারণ, গতকাল মদের এক বিন্দুও খায় নি সে। সে ঠিক করেছে উমার কাছে আসার সময় মদ্যপান করবে না। মেয়েটির ভীতচোখের মোহে পড়েছে বহুকাল আগে, যেদিন একটা আটপৌড়ে শাড়ি পড়া কিশোরী কাঁচা আম পাড়তে ঢুকেছিলো এই বাড়িতে। রুদ্র ভেবেছিলো মেয়েটি তার নিছক ভালোলাগা। কত সুন্দর নারী দেখেছে সে, এটা এমন কিছুই না। কিন্তু কেনো যেনো মেয়েটির দেবীমূর্তীর আদলে মুখশ্রীকে ভুলতে পারলো না সে। তারপর সেই ভালোলাগা মোহে পরিণত হলো। প্রথমে ভেবেছিলো ভোগ করবে, কিন্তু মেয়েটিকে ভোগ করতে ইচ্ছে হলো না রুদ্রের। তাকে সারাটাজীবন নিজের খাঁচায় আটকে রাখার এক অদম্য ইচ্ছে হলো রুদ্রের। আজ সেই ইচ্ছে পূরণ হলো, আজ থেকে সেই মেয়েটি সর্বক্ষণ তার আঙ্গিনাতে বিচরণ করবে, কথাটা ভাবতেই রুদ্রের মনমন্দির উচ্ছ্বাসে ভরে যাচ্ছে। মেয়েটির সাথে প্রতিটি মূহুর্তকে অন্তিমক্ষণ অবধি মনে রাখতে চায় সে। তাই মেয়েটির জন্য মদ্যপান করবে না সে। রুদ্রের কথা, একবার শরীর হাসিল করলে মন হাসিল করতে কতক্ষন। রুদ্র হাতড়ালো বিছানায়। ঠান্ডা বিছানাটি দেখেই চমকে উঠলো। পাখি কি পালালো? তড়িঘড়ি করে উঠে বসলো সে। না উমা কোথাও নেই, ঘরের স্নানঘরেও না। রুদ্রের মাথায় যেনো বাজ পড়লো। বুকের বা কোনায় চিনচিনে অনুভূতি হলো। বড় অদ্ভুত এই অনুভূতি! ত্রিশ বছরের যুবককে অবাক করলো এই অনুভূতি। শার্টটা গায়ে দিয়েই ছুটলো সে। এক এক করে প্রতিটা ঘর দেখলো রুদ্র, ফুলির মাকেও জিজ্ঞেস করলো সে। ফুলির মা এক রাশ বিরক্তি নিয়ে বললো,
"আমি কি দারোয়ান নি? যে তোমার বউ পাহারা দিম?"

রুদ্র অস্থির হয়ে উঠলো, সারা বাড়িতে উমা নেই। রুদ্রের অস্থিরতায় বিরক্ত হয়ে লক্ষী দেবী বললেন, 
"বউ কি তোমার একা হয়ে রুদ্র? দেখো কোথাও আছে হয়তো"
"আমি সব জায়গা দেখেছি মা, পেলাম না কোথাও"

লক্ষী দেবীর চোখে মুখে বিরক্তি। ছেলের আদিক্ষেতা পছন্দ হচ্ছে না। মালিনী দেবী বললেন,
"আমি তো সকালে উঠি, ফুল তুলি। আমিও দেখি নি বউ কে।"

রুদ্রের অস্থিরতা ক্রমশ বাড়ছে। এক অজানা ভয়ে হিম ধরছে তার। কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়ছে সে। তখনই.....

—————

রুদ্রের অস্থিরতা ক্রমশ বাড়ছে। এক অজানা ভয়ে হিম ধরছে তার। কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়ছে সে। তখনই ছাঁদের সিড়ি বেয়ে নেমে এলো শাশ্বত। সে উমাকে পাজাকোলে নামাচ্ছে। উমা তখন অচেতন। উমার নিথর শরীরটাকে সাবধানে নামালো শাশ্বত। নিচে উপস্থিত সকলের চক্ষু ছানাবড়া। মালিনী দেবী পুত্রের এমন ধারা কাজে খানিকটা অখুশী হলেন। রুদ্র স্থির, তার রক্তচক্ষু চেয়ে রয়েছে শুধু শাশ্বতের দিকে। চোয়াল জোড়া শক্ত। বুকের যেনো আগুন জ্বলছে। রুদ্রের নামের মতো তার স্বভাব ও প্রচন্ড ক্রুদ্ধ। নিজস্ব সত্তার অমতে কিছু ঘটলেই তার মাথায় আগুন জ্বলে উঠে। কেউ যদি তার পছন্দের জিনিসে হাত দেয় সেই মানুষটি তার চক্ষুশুল হয়ে উঠে। যেমনটি এখন হচ্ছে, রুদ্রের ইচ্ছে হচ্ছে শাশ্বতকে খুন করতে। এতো বড় স্পর্ধা হয় কি করে, তার বউ এর দিকে নজর দেবার। রুদ্রের রোষাগ্নিকে পরোয়া না করে শাশ্বত উমাকে তার ঘরে শুইয়ে দেয়। এরপর রুদ্রের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি প্রয়োগ করে। শীতল কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়,
"বিয়ে করলেই স্বামী হওয়া যায় না রুদ্র। এবার তো একটু শুধরা। গায়ে হাত দিয়ে দেখ, জ্বরে রীতিমতো পুড়ছে। না জানি কখন থেকে অচেতন হয়ে পড়ে ছিলো ছাঁদে। নিজের প্রয়োজন মিটিয়েই ছুড়ে ফেলাটা বন্ধ কর। আমি না দেখলে, না জানি কতো সময় এভাবেই পড়ে থাকতো।"

সত্যি, শাশ্বত না দেখলে হয়তো ওভাবেই পড়ে থাকতো উমা। শেষ রাতের দিকে ছাঁদে আশ্র‍য় নেয় উমা। হাটু গেড়ে এক কোনায় বসে থাকে। নির্ঘুম ক্লান্ত অশ্রুসিক্ত চোখ জোড়া চেয়ে থাকে কালো আকাশের দিকে। আমাবস্যার কালো আকাশে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে পারে উমা। নিগাঢ় কালো আধার একটু একটু করে তাকে গ্রাস করছে। আজ কেনো যেনো মরে যেতে ইচ্ছে করছে তার। একটা মানুষের নিজস্ব ইচ্ছাকে যেখানে গলা টিপে হত্যা করা হয় সেখানে বাঁচার বিন্দুমাত্র সাহস থাকে না মানুষের। কিন্তু ওই যে আত্নহত্যা মহাপাপ। আচ্ছা এবাড়ি থেকে পালিয়ে যাবার কি কোনো উপায় নেই? পরমূহুর্তে রাজশ্বী আর গোপালের মুখখানা ভেসে উঠে উমার চোখে। উমার পালিয়ে মুক্তি পেলেও রুদ্র তার পরিবারকে ছাড়বে না। সর্বনিকৃষ্ট শাস্তি পেতে হবে তাদের। এই বিষাক্ত যন্ত্রণা ভোগ করার বদৌলতে যদি চারটি জীবন সুখে থাকে ক্ষতি কি! মাথাটা ভারী ভারী লাগছে উমার। অতিরিক্ত সময় পানির ভেতর থাকার কারণে চোখজোড়াও লাল হয়ে এসেছে। উপরন্তু অক্টোবর মাস, সাতক্ষীরার দিকে এই সময় ঠান্ডা বাতাস বয়। উমা কোনো ভারী কাপড় ও আনে নি সাথে। সেই তো সুতির শাড়ি। তা কি আর এই শীতল হাড়কাপানো হাওয়াকে সামলাতে পারে! রাত ঘন হবার সাথে সাথে ঠান্ডার প্রকোপ বাড়ছে। সাথে মাথাব্যথাটাও। তীক্ষ্ণ সূচলো ব্যাথার সাথে শরীরের উত্তাপটাও বাড়ে। এক পর্যায়ে অচেতন হয়ে পড়ে উমা। প্রাতঃকালে হাটাহাটির স্বভাবটা শাশ্বতের বেশ পুরোনো স্বভাব। অভিনব সিংহের এই ছাঁদটা তার অতি পছন্দের। সকাল সকাল খালিপায়ে ভেজা ছাঁদে হাটতে বেশ ভালো লাগে তার। মস্তিষ্ক গভীরভাবে চিন্তা করতে সাহায্য করে। যেমন এখন তার চিন্তা রুদ্রকে কেন্দ্র করে, যে মামা সকাল অবধি ছেলের চিন্তা করছিলো সেই মামা দুপুরে কেনো এতো চিন্তামুক্ত হয়ে পড়লেন। আর শহরেই বা ছুটলেন কেনো? চিন্তার মাঝেই একজোড়া পা নজরে পড়লো শাশ্বতের। পা জোড়া দেখতেই সে ছুটে গেলো সেখানে; সেখানে গিয়ে চোখজোড়া বিস্ফোরিত হবার যোগাড়। উমা অচেতন অবস্থায় লুটিয়ে আছে মাটিতে। তাকে ডাকতে গিয়ে খেয়াল করলো মেয়েটির প্রচন্ড জ্বর। মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে আছে, ঠোঁটজোড়া শুকনো। উমার প্রতি যতটা না দয়া হলো শাশ্বতের দ্বিগুন রাগ হলো রুদ্রের উপর। বেশ কিছুবার ডাকার পরও যখন সাড়া মিললো না তখন উপায়ন্তর না পেয়ে উমাকে কোলে করে নিচে নেমে গেলো শাশ্বত। শাশ্বতের কিছুক্ষণ পূর্বের সূঁচালো কথাগুলো যেনো আরোও রাগ বাড়িয়ে দিলো রুদ্রের। ক্রোধে অন্ধ রুদ্র শাশ্বতের কলার চেপে ধরলো, তীব্র স্বরে বললো,
"আমার কি তোর জ্ঞান শুনতে হবে? কে তুই? ছোটলোক একটা! খাস তো আমার বাপের টাই। আবার জ্ঞান দিচ্ছোস? আমার বউ, আমার সম্পত্তি। আমি যা ইচ্ছা করবো, তুই বলার কে?"

রুদ্রের রাগ সম্পর্কে বেশ ভালো করেই অবগত মালিনী। ছুটে এসে তাকে বারংবার থামার জন্য বলতে লাগলেন,
"বাবা, ছেড়ে দাও শাশ্বতকে। ও সেভাবে বলে নি।"

কিন্তু শাশ্বত দমে যাবার পাত্র নয়। তীর্যক দৃষ্টিতে চোখে চোখ রেখে কড়া কন্ঠে বললো,
"অর্ধাঙ্গিনী কখনো সম্পত্তি হয় না, হয় সম্পদ৷ রবীঠাকুরের গল্পের এই বাক্যটির মর্মার্থ বোঝার ক্ষমতা তোর নেই। বলেও লাভ নেই। বিদ্যে গিললেই বিজ্ঞ হওয়া যায় না। সেটাকে অনুধাবন করতে হয়। যাক গে, রহিম ডাক্তারকে ডাক। অন্তত ঔষধ দেক মেয়েটাকে।"

 অন্যায় শাশ্বতের একেবারেই সহ্য হয় না। তাই রুদ্রের মতো মানুষকে একেবারেই ভয় পায় না সে। শক্ত হস্তে রুদ্রের হাতজোড়া কলার থেকে ছাড়িয়ে নেয় সে। ঘর ছাড়ার আগে একটা কথাই বলে শাশ্বত,
"মানুষ হ রুদ্র। মানুষ হতে পয়সা লাগে না।"

মালিনী দেবী ছোটেন পুত্রের পিছুপিছু। লক্ষী দেবী মুখ বাকিয়ে তীক্ষ্ণ স্বরে বলেন,
"বেলা গড়ালেই জ্বর সেরে যাবে। এই ঘরে এই প্রথম তো কারোর জ্বর বাধলো না। এতো আদিক্ষেতার কোনো প্রয়োজন আমি বোধ করছি না রুদ্র"

মায়ের কথার মর্মার্থ বুঝতে কষ্ট হলো না রুদ্রের। সত্যিই তো, মায়ের ও জ্বর হয়। কই বাবা তো একটি বার ও ডাক্তার বদ্যি আনেন না। তিনি মাকে সেভাবেই ছেড়ে দেন। তাহলে উমার এতোকিছু লাগবে কেনো? একেই শাশ্বতের উপর ক্রোধ এখনো শান্ত হয় নি তার। সেকারণে উমার নিথর শরীরটার দিকে একটি বার চাইতেও মন চাইলো না তার। রুদ্র এক মূহুর্ত অপেক্ষা না করে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। লক্ষী দেবী একটিবার উমার দিকে তাকিয়ে ফুলির মাকে বললেন,
"দেখো, মহারানী কি সত্যই মূর্ছা গেছে! নাকি ঢং করছে!"

বলেই ঘর থেকে প্রস্থান করলেন তিনি। ফুলির মায়ের মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি। ঘরের কুকুরের সাথেও এর চেয়ে ভালো আচারণ করা হয়। অথচ উমা একজন জ্বলজ্যান্ত মানুষ। ফুলির মা উমার কাছে গিয়ে বসে, কপালে হাত ছোঁয়ায়। জ্বরের তাপে কপাল পুড়ছে। উজ্জ্বল মুখখানা তার ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে। চুলগুলো এখনো ভেজা। চোখজোড়া গর্তে চলে গেছে এক দিবসেই। ফুলির মা ব্যাঙ্গাত্বক স্বরে বলেন,
"এ তো কেবল শুরু রে মাইয়্যা। এই বাড়িতে কতো কিছু দেখতে হবে রে! এখনই মূর্ছা গেলে চলবে?"

৫!! 

শাশ্বত শহরের জন্য প্রস্থান করেছে। মালিনী দেবী যেনো হাফ ছেড়ে বেঁচেছেন। এখানে থাকলে একটা না একটা ঝামেলা বাধতোই রুদ্রের সাথে। আর নিজের ছেলের উমার প্রতি এতো সংবেদনা একেবারের পছন্দ হচ্ছিলো না তার। উমার শরীরটা আগের চেয়ে কিঞ্চিত ভালো, জ্বর সারলেও কাশিটা যায় নি। তবে সেদিনের ঝাল তাকে বয়ে চলতে হচ্ছে। উঠতে বসতে খোটা শুনতে হচ্ছে তার। যতই হোক পরপুরুষের কোলে চড়ে ঘরে আসার জন্য কথা শুনতেই হবে। রুদ্রের ক্রোধও কমে নি, শাশ্বতের ক্রোধ সে উমার উপর মিটায়। গত দশ বারো দিনে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে সে। এখন আর নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করে না। জড়ো বস্তুর ন্যায় বিচরণ করে সে এই চেয়ারম্যান বাড়িতে। এটাই তার নিয়তি, যতদ্রুত মেনে নিবে ততই মঙ্গল। 

রাত ৯টা,
নিজের ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে উমা। আজকাল ভাইবোনের কথা খুব মনে পড়ে তার। কত দিন কেটে গেছে কারোর সাথে মন খুলে কথা বলে হয় না। সখীরাও কেউ তার সাথে দেখা করতে আসে না। রুদ্রের কড়া নির্দেশ সেদিনের শাস্তি স্বরুপ উমা এই বাড়ির বাহিরে যাবে না। তাই তো দ্বিরাগমনেও যাওয়া হয় নি তার। উমা কোনো কালে প্রতিবাদী ছিলো না, ছিলো একজন ভীতু নারী। তাই তো এবারেও সে প্রতিবাদ করলো না। মাথা নিচু করে মেনে নিলো তার শাস্তি। কিন্তু মানুষ তো, অনুভুতি গুলো এখনো সচল। আজ মনটা বারেবারে হু হু করে উঠছে, ছটফট করছে এক চিলতে মুক্তির জন্য। বুকজুড়ে হাহাকার শুরু হয়েছে। চোখের কোনায় নোনাজলের ভিড় জমেছে শুধু একটু মুক্তির জন্য। কষ্ট চেপে রাখা কি এতোটা সহজ! এর মাঝেই কাঠের জং ধরা দরজাটি ঠেলে ঘরে আসে রুদ্র। রুদ্রের আগমনের আভাষ পেতেই ঘরে যায় উমা। ঘরে প্রবেশ করতেই যা দেখলো তাতে গা শিউরে উঠলো উমার। রুদ্র যেনো রক্তস্নান করে এসেছে.........

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন