মায়াবতী (পর্ব ০৫)


০৯!! 

অনেক ভেবে রাস্তাটা ধরেই সামনে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাহাত। আবার এতোটা রাস্তা ফিরে গিয়ে জ্যামের মুখোমুখি হওয়ার চেয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়াটাই বেশি যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছে রাহাতের কাছে। যদিও রাহাত নিজেও শিওর না এই রাস্তাটা আধো ওকে মায়ার বাসায় পৌঁছে দিবে কি না। তবু মায়াকে এভাবে ওর সাথে জড়ানো অবস্থায় কেউ দেখুক সেটাও রাহাত চায় না। অবশ্য এই না চাওয়ার পিছনে যতগুলো কারণই থাক কোনোটাই মন মতো হচ্ছে না রাহাতের। পার্টি শুরু হওয়ার পর থেকেই রাহাত নিজের মনকে কিছু একটা বোঝানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু সেটা যে কি সেটা ও নিজেই জানে না। আর এখন মায়ার এভাবে ওর সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা! রাহাত ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না মেয়েটাকে ও নিজের থেকে সরিয়ে না দিয়ে কেন আরো নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়েই ড্রাইভ করছে। নিজের এই পাগলামিগুলো রাহাতের কাছেও পরিষ্কার নয়। তাই মন আর মস্তিষ্কের এই দ্বন্দ্বের মধ্যে কিছুটা অশান্ত হয়েই ড্রাইভিং করছে রাহাত। 

যত সময় যাচ্ছে তত কিছু একটা হারানোর ভয় হচ্ছে রাহাতের। মনে হচ্ছে কিসের একটা শূন্যতা ধীরে ধীরে রাহাতকে গ্রাস করতে এগিয়ে আসছে। আবার মায়াকে এভাবে নিজের সাথে আটকে রেখে গাড়ি চালানোও প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়াচ্ছে রাহাতের পক্ষে। নিজের মনে কোনো ধরনের দোটানা নেই রাহাতের। তবু নিজেকে কেমন অবশ লাগছে। না চাইতেও একটু পর পর রাহাতের চোখ চলে যাচ্ছে মায়ার মুখের দিকে। মায়ার ঘুমন্ত মায়াবী মুখটা দেখে রাহাতের শান্তি লাগছে। অনুভূতিটাকে প্রশ্রয় দিতে চাইছে না রাহাত। তবু! ওই যে বেহায়া মন! একটু পর ঘুরেফিরে ঠিকই মায়ার চোখমুখের দিকেই তাকায়। এভাবে আর কিছুক্ষণ চললে কি ঘটবে সেটা রাহাত নিজেও হয়তো অনুমান করতে পারছে তাই নিজেকে শান্ত করার জন্যই চোখ বুজে নিজের সিটে হেলান দিয়ে বড় একটা নিঃশ্বাস নিলো। 

কিছুক্ষণ পর শান্ত হয়ে ভাবার চেষ্টা করলো রাহাত। এতো সময় হয়ে গেল রাস্তাটা তো শেষ হলো না! ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্তটা না নিয়ে আসলেই কি খুব ভুল করেছে রাহাত? কথাগুলো ভাবার ফাঁকেই রাহাতের মোবাইলটা শব্দ করে বেজে উঠলো। রাহাত কিছুটা বিরক্ত হয়ে চোখ মেললো কলটা রিসিভ করার জন্য। আর চোখ মেলেই রাহাত এতো বড় একটা শকড পাবে আশাও করে নি। মায়া রাহাতের বুকের উপর থেকে কখন সরে এসেছে রাহাত সেটা একদমই টের পায় নি। রাহাত অবাক হলো মায়ার রাগী মুখটা দেখে। মায়া আর এক সেকেন্ড অপেক্ষা না করে রাহাতের উপর থেকে সরে এসে রাহাতকে মোবাইলটা ধরিয়ে দিয়ে বাইরের দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকালো। রাহাতও বোকার মতো হা করে মায়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। একটু আগে ঠিক কি ঘটে গেল সেটা রাহাত কিছুই বুঝতে পারলো না। সদা শান্ত থাকা মায়াবতীটা আজ রাহাতকে এতো অবাক করে দিচ্ছে। মোবাইলের দিকে তাকিয়ে জুলির নামটা দেখে রাহাত কলটা রিসিভ করে মোবাইলটা কানে লাগালো।

-রাহাত? কোথায় তুমি? বাড়ি ফিরো নি এখনো? মায়াকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছ ঠিকঠাক মতো?

-বাড়ির কাছাকাছি আছি। ফোনটা রাখ এখন। ড্রাইভিং করছি---।

-কি বলছ কি এসব? এখনো পৌঁছাও নি মানে? দশটা বাজতে চললো! তুমি মায়াকে নিয়ে তো সেই কখন বের হলে অফিস থেকে? আর মায়ার বাসায় যেতেও তো এতো সময় লাগার কথা না? সব ঠিক আছে তো রাহাত? মায়ার কিছু হয়নি তো? ও ঠিক আছে তো? আম সো সরি রাহাত। বুঝতে পারি নি মজা করতে গিয়ে এতো বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে ব্যাপারটা---। সরি? মাফ করে দাও প্লিজ?

-জুলি--। রিল্যাক্স। কিছু হয়নি। রাস্তায় প্রচুর জ্যাম ছিল। তাই একটা শর্টকাট নিয়েছি। পৌঁছে যাবো কিছুক্ষণের মধ্যেই। আমি বাড়ি পৌঁছে তোকে কল করবো। এখন রাখ। 

রাহাতের কথাগুলো বলা শেষ হতে না হতেই মায়া রাহাতের হাত থেকে মোবাইলটা খামচে নিয়ে কলটা কেটে দিয়ে মোবাইলটাকে রাগ করে সিটের উপরে ছুঁড়ে ফেললো। রাহাত আরেকবার থতমত খেয়ে মায়ার দিকে তাকালো। মেয়েটা নিজে পাগল হয়ে গেছে নাকি রাহাতকে পাগল করতে চাইছে সেটাই রাহাতের মাথায় ঢুকছে না। রাহাতের এমন অবাক চাহনি দেখেও মায়া রাহাতের দিকে প্রায় তেড়ে এলো। 

-কি সমস্যা হ্যাঁ? কি সমস্যা? এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? আমি কি ভূত নাকি জ্বীন? হ্যাঁ?

-আপনি তো জ্বীন-ভূত না ম্যাডাম। আপনি তো একজন মায়াপরী। তা ম্যাডাম হঠাৎ এমন পাগলামি করছেন কেন? আমি কথা বলছিলাম তো ফোনে? এভাবে কলটা যে কেটে দিলে জুলি কি ভাবলো বলো তো?

-রাত কয়টা বাজে সে খেয়াল আছে? দশটা বাজে। এতো রাতে ওই বজ্জাত মেয়ে আপনাকে কল করবে কেন? আর আপনিও বা কোন সাহসে বলেন যে বাসায় গিয়ে কল করবেন? একদম না আপনাদের দুটোকেই খুন করে ফেলবো আর ও যদি আর আপনার পিছে পিছে ঘুরে, আর আপনি ওকে পাত্তা দেন। হুহ।

-আরে! কি বলো এসব মায়াবতী? পাগল হয়ে গেছ নাকি? আরে বাবা! ও আমার ফ্রেন্ড। কল করতেই পারে।

-না না না। করবে না, করবে না, করবে নাআআআ।

-মায়া? আরে? কি হলো? এতো রেগে যাচ্ছ কেন বাবা? উফ! এই বলো তো কি হয়েছে? এতো রাগ করছ কেন তুমি? 

-রাগ করবো। ১০০ বার করবো, হাজার বার রাগ করবো। আপনার কি?

-আরে বাবা! কি মুশকিল! আমার উপরেই রাগ করে বলে কিনা আমার কি! আল্লাহ!

-খালি খালি সে আমাকেই বকতে পারে। আমাকে কতোগুলো বকা দিয়েছে, বোকা বলেছে, গাধা বলেছে, পাগলিও বলেছে, আর এখন পাগলও বলছে--। আআআআ। আম্মু? উনি এতো খারাপ! আমাকে থাপ্পড় দিবেও বলেছে। আর যার জন্য এতোসব হলো তার সাথে কতো মিষ্টি মিষ্টি করে কথা বলছে। আবার নাকি বাড়ি ফিরেও কল করবে! আআআ। 

-হায়রে! এই পাগলিটাকে নিয়ে যে কি করবো আমি? মায়া? তাকাও তো আমার দিকে? এই যে মিস মায়াবতী? আরে বাবা তাকাও না একবার?

-উঁহু। না---।

মায়ার কাঁপা গলায় 'না' শব্দটা রাহাতের কানে গিয়ে লাগলো। মেয়েটা জানালা দিয়ে বাইরের দিকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছে। তবু রাহাত মায়ার নিরবে কান্নাটা অনুভব করতে পারছে। রাহাত আর কিছু না ভেবেই মায়াকে হালকা করে টেনে নিয়ে নিজের সাথে জড়িয়ে নিল। মায়াও চুপ করে রাহাতের বুকে মুখ লুকিয়ে বসে রইলো। রাহাত আলতো করে মায়ার চুলে হাত বুলিয়ে দিল।

-আরে বোকা মেয়ে এগুলো তো ভালোবেসে বলে না? আমি কি সত্যি সত্যি বকেছি তোমাকে? কেন এতো পাগলামি করছ আজ বলো তো?

-আপনি বকলে আমার কত কষ্ট হয় জানেন? ভালোবাসি তো আপনাকে। খুব খুব খুব ভালোবাসি। তাই ওই ফাজিল মেয়েটা আপনার কাছাকাছি এলেও কষ্ট হয় খুব। জানেন? ইচ্ছে করে ওর চুলগুলো টেনে ছিঁড়ে ফেলি। ও কোন সাহসে আপনার কাছে আসবে? কোন অধিকারে আপনার সাথে কথা বলবে? আপনাকে কেন নিজের হাতে খাইয়ে দিবে হ্যাঁ? আর কখনো ওকে আপনার আশেপাশেও ঘুর ঘুর করতে দেখলে ওকে আমি-- আমি ওকে---।

মায়ার এই সহজ স্বীকারোক্তি শুনে রাহাত কি বলবে বুঝতে না পেরে চুপ করে রইলো। মায়াবতীটা ওকে ভালোবাসে? কথাটা ভাবতেই রাহাত কেন জানি চমকে উঠলো। আগে কেন ব্যাপারটা বুঝতে পারে নি রাহাত? তাহলে হয়তো আজকে এমন ঘোলাটে পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হতো না রাহাতকে। রাহাত আবার ভাবার চেষ্টা করলো। মেয়েটা নেশার ঘোরে কিসব বলছে। কথাগুলোকে পাত্তা না দিলেও চলবে। সকালে হয়তো এসবের কিছুই ওর মনেও থাকবে না। রাহাত কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই মায়া মুখ তুলে রাহাতের চিন্তিত মুখের দিকে তাকালো। 

-এই? রাহাত? বলো না? তুমি ভালোবাসো না আমাকে? হুম? তুমি কিছু বলো না কেন? ওই শাঁকচুন্নিটাকে ভালোবাসো? খুন করে ফেলবো কিন্তু তাহলে----।

-মায়া? চুপ করে বসো তো? এমনিতেই অনেক রাত হয়ে গেছে। আমাকে ড্রাইভ করতে দাও প্লিজ? তোমার মা বাসায় কতো টেনশন করছে জানো?

-উঁহু। মা তো জানে আমি তোমার সাথে আছি। এট্টুও চিন্তা করবে না। আমি তো বলে এসেছিলাম মাকে। দেরি হয়ে গেলে তুমি পৌঁছে দিয়ে যাবে আমাকে---। হি হি। তুমি তো সত্যি সত্যি যাচ্ছো আমার সাথে। তাই না? তাহলে টেনশন করবে কেন? উঁহু একদম টেনশন করবে না---।

-মায়া? এতো কথা বলো না। ঘুমানোর চেষ্টা করো একটু।

-উহুঁ ঘুমাবো না। আমি আজকে কতো কষ্ট পেয়েছি জানো? পায়ে কতো ব্যথা পেয়েছি আমি। তবু তুমি আমাকে কোলে করো নি। কেন বলো তো? তুমি আমাকে এট্টুও ভালোবাসো না। আমি খুব রাগ করেছি আজকে তোমার উপরে। খুব খুব খুব।

-মায়া? নেশার ঘোরে কিসব বলছ আজ বলো তো? কালকে এই জুলিকে তো আমি----।

জুলির নামটা শুনেই মায়া আবার রেগে গিয়ে রাহাতের কোটটা খামচে ধরে নিজের নিজে টেনে ধরলো রাহাতকে। রাহাত থতমত খেয়ে মায়ার গভীর মায়াবী চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে রইলো। মেয়েটা কখন খেপে যাচ্ছে আর কখন লক্ষী মেয়ের মতো চুপ করে রাহাতের বুকে মুখ লুকিয়ে  নিচ্ছে সেটাও বুঝতে পারছে না রাহাত। মায়া ভ্রু কুঁচকে রাহাতের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। 

-আবার জুলি? এতো জুলি জুলি করো কেন হ্যাঁ? আমাকে চোখে পড়ে না তোমার? হ্যাঁ? আরেকবার ওই মেয়ের নাম মুখে আনলেও মেরে ফেলবো তোমাকে বলে দিলাম। হুহ। 

-মায়া? রিল্যাক্স। আচ্ছা বাবা ঠিক আছে। জুলির নাম নিবো না। তুমি শান্ত হও এখন।

-ভাবছ নেশার ঘোরে এসব উল্টো পাল্টা বকছি তাই না? কিন্তু তুমি কি জানো তুমি আমার সবচেয়ে বড় নেশা? তুমি সামনে থাকলে তো আমার এমনিই নিজেকে মাতাল মাতাল লাগে। এই সামান্য ড্রিংকসে কি আর তোমার চেয়ে বেশি নেশা হওয়া সম্ভব বলো?

রাহাতের চোখে চোখ রেখে মায়া কথাগুলো বলে রাহাতের কাঁধে মাথা রেখে চুপ করে রইলো মায়া। আর মায়ার কথা শুনে রাহাত পুরো শকড হয়ে বসে রইলো। মায়াকে বাসায় পৌঁছে দেয়ার জন্য এতোক্ষণ যে তাড়াহুড়ো করছিল সেটাও যেন বেমালুম ভুলে গেছে ছেলেটা। রাহাতের কানে শুধু মায়ার কথাগুলোই বাজছে। মেয়েটা নেশার ঘোরেই কথাগুলো বলুক বা সজ্ঞানে। এই আবেগের কি পরিণতি হতে চলেছে সেটা ভেবে রাহাত নিজেও কিছুটা শিউরে উঠলো। কি হতে চলেছে সামনে কে জানে!

১০!! 

-এই এই এই? রাহাত? শোনো না?আমি ডান্স করবো তো? 

মায়া বেশ অনেকক্ষণ রাহাতের কাঁধে মাথা রেখে চুপ করে থাকায় রাহাত ভেবেছিল এবারে অন্তত মেয়েটা ঘুমিয়ে গেছে। কিন্তু নাহ। রাহাত মায়াকে খুব সাবধানে পাশের সিটে বসিয়ে দিয়ে স্টিয়ারিংয়ে হাত দেয়ামাত্রই মায়া আবার প্রায় লাফিয়ে রাহাতের দিকে ফিরে নতুন বায়না শুরু করলো। একে তো মায়ার এই অদ্ভুত অত্যাচার, তার উপরে এই ভূতুড়ে রাস্তা শেষ হওয়ার নামই নেই। সব মিলিয়ে বেচারা রাহাতের মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়। তার মধ্যে এই আধো নেশাগ্রস্ত মেয়েটা এমন রাত বিরেতে গাড়িতে নাচানাচি করার জন্য বায়না ধরলে রাহাত আর কি করবে মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকা ছাড়া? রাহাতের এমন চুপসে যাওয়া মুখটা দেখে মায়া মনে হয় এবারে কিছুটা উৎসাহিত হলো। মায়া এবারে রাহাতের মোবাইলটা নিয়ে প্লে মিউজিক থেকে গান প্লে করতে করতে গাড়ি থেকে নামার জন্য দরজাটা খুলতেই রাহাত মায়ার একটা হাত চেপে ধরে ফেললো। মায়া একটু হাসিহাসি মুখে রাহাতের দিকে ফিরে মিষ্টি করে হাসলো। রাহাতও কিছুটা বিব্রত হয়ে মায়ার হাতটা ছেড়ে দিলো।

-কি হলো?  কোথায় যাচ্ছ তুমি মায়া?

-ওমা! ডান্স করবো না? এই একটুখানি গাড়িতে কি আর ডান্স করা যাবে?

-মায়া? বাসায় ফিরতে লেইট হয়ে যাচ্ছে আমাদের। 

-বাসায় গেলে তো আর আপনাকে পাবো না। তখন আমি একা একা ডান্স করবো কার সাথে?

-পরে একসময় করা যাবে। এখন এসো তো? আমারও তো বাসায় ব্যাক করতে হবে। সেই খেয়াল আছে আপনার ম্যাডাম?

-আছে তো। একটুখানি ডান্স করবো। একটুউউউ। প্লিজ?

-মায়া?

-প্লিজ প্লিজ প্লিজ?

-ঠিক আছে। তার আগে বলো তোমার এই শর্টকাট রাস্তা দিয়ে আর কতক্ষণ যাওয়া লাগবে? আধো ঠিক রাস্তায় যাচ্ছি তো নাকি?

মায়া গাড়ি থেকে নেমে পড়েছে ততক্ষণে। রাহাতের প্রশ্ন শুনে আশেপাশে ভালো করে দেখার চেষ্টা করলো ঠিক কতোটুকু পৌঁছেছে। রাহাতও ততক্ষণে গাড়ি থেকে নেমে মায়ার পাশে গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে মায়াকে দেখছে। মায়া চারদিকটা ভালো করে একবার দেখে নিয়ে রাহাতের দিকে তাকালো।

-আরো দশ-পনেরো মিনিটের মতো লাগবে। তারপর ডানদিকে টার্ন নিলেই আমাদের বাসার গলিটায় পৌঁছে যাবো আমরা---।

-গড! এই তোমার শর্টকাট রাস্তা! মেইন রোড ধরে আসলেও তো এর আগে বাসায় পৌঁছে যাওয়া যেত! তাই তো বলি তোমার এই শর্টকাট রোডে আর কোনো গাড়ি দেখলাম না কেন। কাউকে তো আমার মতো পাগলে কামড়ায় নি। 

-এমন করে বলার কি হলো? মেইন রোডে তো কত্তো জ্যাম ছিলো। হুহ। এখন সব আমার দোষ! অবশ্য এ রাস্তা দিয়ে আরেকটা কারণ আছে।

মায়ার লাজুক রাঙা মুখটা দেখে রাহাতের ভ্রু জোড়া আপনাআপনিই কিছুটা কুঁচকে গেল। কি এমন কারণ আছে যেটা বলার আগে মেয়েটার মুখটায় লজ্জার আভা ছড়িয়ে পড়েছে? এই মেয়ের মনে যে আজ কি চলছে সেটা আল্লাহ ছাড়া আর কেউই বলতে পারবে না। আজ তার কপালে আর কি শনি অপেক্ষা করছে সেটাই ভাবছে রাহাত। মায়ার লজ্জা পেয়ে মুখ নামিয়ে নখ খোঁটা দেখেও রাহাত বেশ খানিকটা অবাকই হলো। 

-আর কি কারণ?

-ওমা! আমি ডান্স করবো না? মেইন রোডে এতো লোকের সামনে কি ডান্স করা যাবে নাকি? আমার লজ্জা করবে না?

মায়ার এমন কথা শুনে রাহাত হাসবে না কাঁদবে সেটাই ভেবে পাচ্ছে না। কেন যে আজকে পার্টিটার আয়োজন করেছে সেটা নিয়েই এই মূহুর্তে সবচেয়ে বেশি আফসোস হচ্ছে রাহাতের। না জুলি আর সোহানের কথায় রাহাত আজকে এই পার্টি থ্রো করত, আর না এতো সব ঘটতো। এক পার্টি বেচারা রাহাতকে একেবারে রাস্তায় এনে দাঁড় করে দিয়েছে। মায়া অবশ্য রাহাতের মতো এতো ভাবনার মধ্যে নেই। সে একমনে গান সিলেক্ট করা শেষ হতে আবার কিছুটা মন খারাপ করে রাহাতের সামনে এসে দাঁড়ালো। রাহাত এবারেও কিছুটা অবাক হলো। 

-কি হলো মায়াবতী? মন খারাপ কেন? 

-আমি ডান্স করবো কি করে? আমি তো ডান্স পারিই না। কখনো তো শিখিও নি। এখন?

-তাহলে তো হয়েই গেল। আজকে ডান্স করতে হবে না। পরে একসময় শিখে তারপর না হয়----।

-না না না। আমি ডান্স করবো এখনই। আআআআ। আপনি আমার একটা কথাও শোনেন না কেন? আমি ডান্স করবো মানে করবো। করবো করবো করবো।

-ওরে বাবা! করো। কে মানা করেছে তোমাকে? 

-এই? তাহলে আপনি শিখিয়ে দিন না? প্লিইজ? প্লিজ প্লিজ প্লিজ?

-আমাকে কি তোমার ডান্স টিচার মনে হয়? নাকি আমি রাত দুপুরে সবাইকে নাচ শিখিয়ে বেড়াই হ্যাঁ?

-না তো। সবাইকে শেখাতে যাবেন কেন? আপনি শুধু আমাকে শেখাবেন। প্লিজ? শিখিয়ে দিন না? একটু ডান্স করবো তো? দেরি করলে কিন্তু বাসায় যেতে আরো দেরি হবে।

-ওহ গড! আচ্ছা। এসো শিখাই। 

-ওকে ওকে। 

-ডান্স করা খুব একটা কঠিন কোনো ব্যাপার না। শুধু লিরিক্সটা ফলো করো। আর গানের অর্থটা নিজের মতো করে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করো। ওকে? তাহলেই হবে।

-এতো সোজা? ইয়েএএ। আমিও তাহলে ডান্স করতে পারবো।

-হ্যাঁ মিস মায়াবতী। অনেক সোজা। এখন আপনি তাড়াতাড়ি ডান্স করুন। আমি দেখি কি শিখলেন। 

-আপনাকেও লাগবে তো। 

-আমাকে লাগবে মানে কি?

-ওমা! আমি কি একা একা ডান্স করবো নাকি? উঁহু। একা একা ডান্স একটুও মজা লাগবে না।

রাহাত আর কিছু বলার আগেই মায়া নিজের হাইহিল জোড়া খুলে নিয়ে রাহাতকে টেনে কিছুটা সামনে নিয়ে এসে রাহাতের একটা হাত নিজের কোমড়ে রেখে অন্য হাতটা নিজের হাতের বাঁধনে নিয়ে রাহাতের কানের কাছে ঠোঁট নিল মায়া।

-নাউ ফিল দা মিউজিক। 

রাহাত মায়ার কথাটার মানে বুঝলো গানটা শুরু হওয়ার পর। মায়া মোবাইলটা গাড়ির উপরে রেখে রাহাতের কাঁধে হাত ঝুলিয়ে গানের তালে গা ভাসিয়ে দিলো। আর রাহাত বেচারা মায়াকে পুতুলের মতো নিজের সাথে হালকা করে জড়িয়ে ধরে আছে। আর গাড়ির উপরে রাখা রাহাতের মোবাইলটা অনেক আবেগ ভরা কণ্ঠে চিৎকার করে গান বাজিয়ে চলেছে। নির্জন এই রাস্তার মাঝখানে গানটাকে রাহাতের কাছে ভুতুড়ে থেকে হয়তো কম কিছু মনে হচ্ছে না। অবশ্য মায়াবতীর সেসবে কোনো হুঁশ নেই। সে ও যান্ত্রিক গানের কণ্ঠের সাথে গলা মিলিয়ে গানটায় নতুন মাত্রা যোগ করছে। রাহাতকে কিছুটা স্তব্ধ করে দেয়ার জন্যই কিনা কে জানে মায়ার আর মোবাইলের মিউজিক স্টোরের গায়কের গলায় যেন রাজ্যের আবেগ জমা হয়েছে আজ। রাহাত এই মূহুর্তে প্রায় দম আটকে গানটা শেষ হওয়ার অপেক্ষা করছে মায়াকে নিজের সাথে আঁকড়ে ধরে। গান কিন্তু থেমে নেই। সে রাহাতের আত্মা কাঁপিয়ে দিয়ে একবারের পর আরেকবার চলছেই তো চলছে।

"Tere qareeb aa raha hoon
Khud se main door jaa raha hoon
Yeh bewajah toh nahi hai
Tu jo mila…

Dheere dheere se tera hua
Haule haule se tera hua
Rafta rafta tera hua
Tere bin main hoon be-nishaan
 
Dheere dheere se tera hua
Haule haule se tera hua
Rafta rafta tera hua
Tere bin main hoon be nishaan"

গানটা পরপর কয়বার বাজলো কে জানে। বেশ কিছুক্ষণ রাহাতের বুকে মুখ লুকিয়ে গানের সুরে হারিয়ে যাওয়ার পর একসময় মায়া মুখ তুলে রাহাতের চোখে চোখ রাখলো। এবারে মেয়েটার মনে কি চলছে সেটা ভাবতে ভাবতেই মায়া নিজের পায়ের পাতা উঁচু করে একদম সোজা রাহাতের মুখের বরাবর উঠে এসে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে আবার রাহাতকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাহাতের বুকে মুখ লুকিয়ে নিলো। মায়ার এই আচরণে রাহাত যতোটা না চমকেছে তার চেয়েও বেশি চমকালো মায়ের শেষের বলা কথাগুলো শুনে। রাহাতের বুকে মুখ লুকিয়ে নিয়েই মায়া ছোট্ট একটা শব্দই বলেছে। আর আকাশে বাতাসে যেন সেই একটা শব্দই প্রতিধ্বনিত হচ্ছে বারবার। আর শব্দটা ছিল 'ভালোবাসি।'

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন