ইনারা বারবার পিছন দিকে তাকাচ্ছিলো। দেখছিলো রুমের ভেতর কেউ আসছে কি-না। সে সামনে সভ্যের দিকে তাকাতেই খেয়াল করে সে সভ্যের কাছে এসে পরেছে। একটু বেশিই কাছে। তার চোখ চোখ পড়ে তার। হয় প্রথম নয়নবন্ধন।
সাথে সাথে ইনারা পিছিয়ে যায়। নিজেই গলার স্বর উঁচু করে বলে, "আপনার লজ্জা লাগেনা? রুমে একটা মেয়ে থাকা সত্ত্বেও খালি গায়ে দাঁড়িয়ে আছেন।" পরক্ষণেই সে আবার বিড়বিড় করে বলল, "ভবিষ্যতে যদি জোহানের সাথে আমার কিছু হয় তখন একথা জানলে কি ভাববে সে?"
"নিজে এসে আমার উপর চড়ে বসছিলে, আর এখন আমার উপর কথা বলছ। আর তোমাকে থাকতে কে বলেছে রুমে। তুমি ব্যাকস্টেজে কীভাবে আসলে? ভিআইপি পাস থাকলেও তো ভেতরে ঢোকার আগে জিজ্ঞেস করার আদব থাকে মানুষের। ভালো কথা, তোমার কাছে ভি-আই-পি পাস আছে তো?"
বিষয়টা এখন ইনারার বিপক্ষে যাচ্ছে। ইনারা মনে মনে বলে, "একদিকে সাইদ ভাইয়া, আর অন্যদিকে এই অসভ্য কাউয়া। তোর কোনো না কোনো তিকরাম লাগাতে হবে ইনু। কারও হাতে পরা যাবে না।"
ইনারা হঠাৎ কাঁদোকাঁদো গলায় বলে, "আপনি আমার সাথে এভাবে কথা বলছেন কেন? কেউ একটা মেয়ের সাথে এমন রুক্ষ ভাবে কথা বলে। আমার কোমল হৃদয়টা..."
"তোমার কোমল হৃদয় মাই ফুট। তোমার মতো মেয়েদের অনেক দেখেছি। একবার দেখা করার জন্য সব জ্ঞান-বুদ্ধি ডাস্টবিনে ফেলে আসো। প্রাইভেসি শব্দটা হয়তো জীবনে শুনোও নি। ঠিকাছে তুমি আমার ফ্যান কিন্তু প্রাইভেসির খেয়াল তো রাখবে। তা নয়, বেহায়ার মতো রুমে ঢুকে আমাকে বলছ আমার লজ্জা নেই না'কি?" অনেকটা ধমক দিয়ে বলল সভ্য। কিন্তু ইনারা কম কিসের? সেও একই সুরে বলল, "ওহ প্লিজ নিজের ব্যাঙের মতো চেহেরা দেখছেন? আপনার পিছনে আমি পাগল হবো? অসভ্য একটা।"
"ইট'স সভ্য ওকে?" রুক্ষ গলায় বলে সভ্য, "আর তোমার ভি-আই-পি পাস দেখালে না? না'কি নেই?"
"থা-থাকবে না কেন? আমাকে দে-দেখতে কি মনে হয় আমি চোর? আমি চুরি করে এখানে আসবো?"
সভ্য ইনারার দিকে এগোল, "একদম মনে হয়।"
সভ্য যত এগোচ্ছিল ইনারা ততই পিছিয়ে যায়। একসময় ইনারার পিঠ ঠেকে যেন দরজায়। সে কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু সভ্যের শীতল দৃষ্টি দেখে তার গলায় যেন শব্দেরা জমাট বেঁধেছে।
সভ্য তার পকেটে হাত রেখে খানিকটা ঝুঁকে ইনারার মুখোমুখি হয়। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে। তীক্ষ্ণ হেসে বলে, "তুমি আমার সাথে দেখা করতে না আসলে এখানে কী করছ? হঠাৎ আমার রুমে? বাহিরে যার জন্য সিকিউরিটি ঘুরছে সে মানুষটা কী তুমি?"
"আপনি কী করে জানেন সিকিউরিটি পড়েছে কি-না?" "হাওয়ায় তীর মারলাম আরকি। লেগেও গেল। জানো কি তোমার ভাগ্য আজ কতটা খারাপ? অন্যকারো রুমে ঢুকলে বেঁচেও যেতে, কিন্তু আমার রুমে ঢুকে এতটা বেয়াদবি করার পর অসম্ভব। তুমি জানো সভ্যের সাথে এত বেয়াদবি করে কেউ কথা বলে রেহাই পায় না। এখন তুমিও পাবে না। জলদি আমাকে পাস দেখাও। এসে যদি তোমার শাস্তি খানিকটা কমে।"
ইনারা চিন্তা শেষ। এ কোথায় ফেঁসে গেল সে? সে মাথা নামিয়ে মিনমিনে গলায় বলে, "একটু দূরে যান। আমি দিচ্ছি।"
সভ্য দূরে যেতেই ইনারা ব্যাগ থেকে একটা খাম বের করে সভ্যকে দেয়। সভ্য কাগজটি হাতে নিয়ে বলে, "ভাবিনি আসলেই তোমার কাছে পাস থাকবে।" সে খাম খুলে কপাল কুঁচকে নেয়, "এখানে তো কিছু নেই।"
"জিনিবাবা পাস নিয়ে নিজের ল্যাম্পে ঘুমায়।" বলেই ইনারা দ্রুত দরজা পালাতে নেয় তখনই সভ্য তার হাত ধরে নেয়। কিন্তু ইনারা দাঁড়ায় না। হাত ছাড়িয়ে চলে যায়। আর সভ্যের হাতে থেকে যায় কেবল ইনারার হাত থেকে বেরিয়ে আসা একটি রূপালী চুড়ি। সে চুড়িটি দেখে সভ্য বিরক্ত হয়ে বলে, "দোয়া করো কেবল যেন আর কখনো আমাদের দেখা না হয়, নয়তো-বা আজকের দিনটার জন্য সারাজীবন আফসোস করতে হবে তোমার।"
সভ্য চুড়িটি নিজের সোফার দিকে ছুঁড়ে ফেলে। শার্ট পরতে নিলেই আয়নায় তার চোখ পড়ে। নিজের মুখে হাত রেখে আয়নায় ভালো করে দেখে বলে, "কোন দিক থেকে আমার মুখ ব্যাঙের সাথে মিলে? নিশ্চিত মেয়েটার মাথায় সমস্যা আছে।"
ইনারা পালিয়ে কোনো একভাবে ব্যাকস্টেজের গেইটের কাছে এসে পড়েছে। সেখানেই দাঁড়িয়ে ছিলো প্রিয় এবং সুরভী। সেখানেই দাঁড়িয়ে তার অপেক্ষা করছিলো তারা। তাকে দেখে সুরভী ছুটে আসে। পিছনে আসে প্রিয়ও। সুরভী জিজ্ঞেস করে, "তুই এখানে কি করছিস? জোহান তো বাহিরে সবাইকে অটোগ্রাফ দিচ্ছে। আর তুই হাপাচ্ছিস কেন?"
"ওই সাইদ ভাইয়া...সিকিউরিটি...মিস্টার অসভ্য... "
"ভাই কি বলতে চাস সরাসরি বল। যা কইতাসোস আন্ডাও বুঝি না।" প্রিয় বলে।
"দাঁড়া নিশ্বাস নিয়ে নেই।" ইনারা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, "ওই আমি জোহানের রুমে ছিলাম না তখন সাঈদ ভাইয়া আমাকে দেখে নিয়েছিলো। এরপর ভি-আই-পি পাস চায়। না থাকায় সিকিউরিটি ডাকে। তাদের থেকে লুকানোর জন্য আমি ঢুকে পড়ি সভ্যের রুমে। সেখানেও তার সাথে একটু তর্কাতর্কি হয়ে যায়।"
"কী তুই সভ্য ভাইয়ের সাথে তর্কাতর্কি করছিস?" প্রিয় হতদম্ব হয়ে বলে। সুরভী বিরক্ত হয়ে তার মাথায় থাপড় মারে, "এখন এটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ, না সাইদ ভাইয়া ওকে দেখে নিয়েছে তা বেশি গুরুত্বপূর্ণ? কোন গর্দভের জাতির সাথে ঘুরাঘুরি করি আমি?"
"ভাইয়া মেবি আমার চেহারা দেখে নি। ভালো করে দেখার পূর্বেই আমি মিলকা সিং এর মতো দৌড় মারছি।"
"আবারও সেভাবে দৌড় মারতে হবে।"
"পারতাম না। আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি। আরাম করি একটু।"
"তোর আরাম হারাম করতে সিকিউরিটি কাকারা আসে। দৌড় মার।" বলেই প্রিয় দিলো এক দৌড়। ইনারা পিছনে ঘুরে সিকিউরিটিকে দেখে নিজেও দৌড় মারে। আবার সুরভির হাত ধরে বলে, "ব্রো তুই পালানোর জন্য ঈদের অপেক্ষা করতাসোস? তারা ধরতে পারলে টাকার না লাঠির বকশিস দিব।"
সুরভিকে নিয়ে আবার দৌড় দেয় সে। ইনারা যত দ্রুত সম্ভব দৌড়ে যাচ্ছিলো। আর বারবার পিছনে তাকাচ্ছিল সিকিউরিটির দিকে। এভাবে পিছনে তাকিয়ে দৌঁড়ানোর কারণে দরজার কাছে আসতেই হঠাৎ কেউ একজন তার হাত ধরে তাকে হ্যাঁচকা টান দিয়ে কাছে টেনে নেওয়ায়।জোহান তাকে ধরে আছে। জোহানকে একটা কাছাকাছি দেখার পর কিছু সময়ের জন্য যেন হৃদয়ের স্পন্দন থেমে গেল। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো। সে জগৎ ভুলে সেখানেই হারিয়ে গেল। আশেপাশে এত ঝামেলা চলছে, একবার ধরা খেলে সে যে কত বড় সমস্যায় পড়তে পারে তা সব ভুলে গেল। তার মস্তিষ্কে কেবল একটি নামই ঘুরছে, জোহান, জোহান এবং জোহান।
জোহান অটোগ্রাফ দিয়ে ভিতরে ঢুকে ছিলো এবং ব্রেকের পরের এন্ট্রি নিয়ে কথা বলছিল তার স্টাফের সাথে। হঠ্যাৎ সে দেখে একটি মেয়ে দ্রুত দৌড়ে আসছে। পিছনে তাকাচ্ছে বারবার। সে দেখলো মেয়েটা সামনে অনেকগুলো বড় স্টিলের বাক্স রাখা। মেয়েটা যেভাবে না দেখে দৌড়ে যাচ্ছে নিশ্চিত এগুলো যেয়ে ধাক্কা লাগতে পারে তার। আর তা হলে বড়সড় দুর্ঘটনা ঘটে যাবে। জোহান দ্রুত যেয়ে মেয়েটার হাত ধরে তাকে নিজের দিকে টেনে নেয়। মেয়েটার চোখ তুলে তাকায় তার দিকে। সে কাজল মাখা দৃষ্টি দেখে এক মুহূর্তের জন্যও চমকে যায় জোহান। মৃদু আলোর মাঝে মেয়েটার যতটুকু দেখা পেয়েছে সে, ততটুকুকেই মোহিত হয় সে। সাদা পোশাকে শুভ্র পুষ্পের ন্যায় দেখাচ্ছিলো মেয়েটাকে। এত সুন্দর এবং মার্জিত মেয়ে খুব কম দেখেছে সে। বাহিরের এত শব্দের মাঝেও যেন মেয়েটার সৌন্দর্যে কিছু মুহূর্তের জন্য হারিয়ে গেল সে।
সুরভি এগিয়ে যেয়ে দেখে ইনারা আশেপাশে নেই। সে প্রিয়কে ধরে বলে, "ওই ঝামেলার ম্যাগনেট আবার কই গেল?"
"কীসের কী?"
"ইনু। ওই মেয়ে যেখানে থাকে সেখানে ঝামেলা থাকবেই।"
"আবার কই গেল মেয়েটা? শুন তুই নড়বি না। আমি ওকে নিয়ে আসি।"
প্রিয় আবার ভেতরে ঢুকেই দেখে ইনারাকে। সে জোহানের সাথে। তার পিছনেই সিকিউরিটির লোকেরা আসছে। সে বিড়বিড় করে বলে, "এই মেয়ে জোহানের সাথে দেখা করার জন্য এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে পড়লো।"
সে দৌড়ে যেয়ে ইনারার হাত ধরে বলল, "গাঁধি একদিন নিজেও মরবি, আমাদেরও মারবি।" বলেই সে তাকে টেনে নিয়ে যেতে লাগে।
ইনারা হতদ্ম্ব। কি হচ্ছে সে বুঝে উঠতে পারছে না। তার এই মুহূর্তটা একটা স্বপ্নের মতো লাগছে। সুন্দর স্বপ্ন। সে আসলেই জোহানের দেখা পেয়েছে? নিশ্চিত হবার জন্য সে আবারও পিছনে তাকায়। জোহানকে দেখে তার ঠোঁটের কোণে হাসি এঁকে উঠে। তখনই সিকিউরিটিকে বলতে শুনে, "এদের ধরো, এরা অবৈধভাবে ঢুকেছে।"
ইনারা দাঁড়াতে চেয়েও আর দাঁড়ায় না। আরেকটিবার জোহানের দিকে তাকিয়ে প্রিয়'র সাথে কনসার্টের ভেতর চলে যায়। হারিয়ে যায় ভিড়ের মাঝে
জোহান সিকিউরিটিকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করে, "কি হয়েছে মেয়েটার পিছনে যাচ্ছ কেন?"
"স্যার সাইদ স্যার বলেছে। আপনার রুমে ছিলো, তাও ভি-আই-পি পাস ছাড়া। স্যার পাস চাওয়ার পর এমন দৌড় দিলো। তাকে খুঁজতে খুঁজতে আমরাই হয়রান হয়ে গেলাম।"
জোহান হাসে খানিকটা। দরজার দিকে তাকিয়ে বলে, "ভালোমতো খোঁজো। পেলে সোজা আমার কাছে নিয়ে আসবে। আর এই ব্যাপারে অন্যকাওকে জানানোর প্রয়োজন নেই। ওকে?"
"আপনি যা বলেন স্যার।"
সিকিউরিটি যাবার পর তার স্টাফের ছেলেটা জোহানকে জিজ্ঞেস করে, "স্যার আপনি অন্যকাওকে জানানোর জন্য না করলেন কেন? পাস ছাড়া কেউ ঢুকলে তাকে শাস্তি বা জরিমানা দেওয়া তো বাধ্যতামূলক। যেন ভবিষ্যতে এমন না হয়।"
জোহান সাথে সাথে উওর দিলো না। সে নিজের রুমে যেয়ে আরামে বসে তাকে জিজ্ঞেস করে, "মেয়েটা দেখতে কেমন?"
"হুঁ? আমি ভালো করে দেখতে পারি নি। একতো তার মুখ অন্যদিকে ছিলো, এর উপর আলোও তেমন ছিলো না। এত হাল্কা আলোতে কীভাবে দেখবো?''
" আমি দেখেছি। অসম্ভব সুন্দর সে। এমন রূপসীকে শাস্তি দেবার ভাবনাটাও অনুচিত। জানো, এমন নয় যে এমন রূপসী আমি আর জীবনে দেখি নি। অনেক দেখেছি। কিন্তু ওর মধ্যে অন্যরকম আকর্ষণ ছিলো। এমন আকর্ষণ আমি সহজে অনুভব করি না। তুমি কনসার্টে যাও। প্রয়োজনে সে সিকিউরিটি গার্ডের সাথে কথা বলো। মেয়েটাকে আমি আবারও দেখতে চাই।"
"কিন্তু স্যার, হাজার হাজার মানুষ এসেছে। এদের মধ্যে কীভাবে খুঁজে পেয়ে পারি।"
জোহানের হাসিমুখটা গম্ভীর হয়ে গেল। সে কঠিন দৃষ্টিতে জয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, "সেটা তোমার কাজ। জোহান হকের না শোনার অভ্যাস নেই। আমার যা চাই, তা চাই। তা তুমি কীভাবে আনবে তা তোমার ব্যাপার। না পারলে তোমার জায়গায় নতুন কেউ চাকরি পেতে পারে, ব্যাপার না।"
.
.
.
চলবে................................