বন্ধন - পর্ব ১৫ - সুলতানা পারভীন - ধারাবাহিক গল্প


২৯!! 

তিয়াশের ঘোর লাগা চোখের দিকে তাকিয়ে তিথির নিজেরও কেমন ঘোর ঘোর লাগছে৷ এদিকে একটু ভয় ভয়ও লাগছে এই বুঝি কেউ চলে এলো এটা ভেবে। না পারছে তিয়াশের সামনে থেকে সরে যেতে, আবার না পারছে ওর সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে। তিথির এতো ছটফটানি দেখে তিয়াশ ভ্রু কুঁচকে তাকালো। আরেকটু কাছে টেনে একেবারে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো। 

-এমন করছো কেন গো পিচ্চি বউ? দেখছি না তোমাকে?

-ছাড়ো না? ভাবিকে হলুদ লাগাবো। তারপর বাড়ি যাবো--।

-তা হঠাৎ আপনি কেন এলেন? 

-বারে! আসা ঠিক হয় নি বুঝি? আসব না আর।

-আমি কি তাই বললাম?

-নয়তো কি? কোথায় একটু খুশি হবে দেখে তা না--। কেন এলেন জিজ্ঞেস করতে আসছে সে।

-আহারে! পিচ্চিটা রাগ করেছে?

-এই পিচ্চি বলবা না তো। অসহ্য। সরো তো সরো? আসবই না আর আমি--। 

-হুট করে এসেছো যেহেতু নিশ্চয়ই কোন কাহিনী আছে--। কি হয়েছে বলো তো?

-বাসায় ভাইয়ার ফ্রেন্ডরা এসেছে, কাজিনরা এসেছে, আর আরিয়ান আর আমার আরো কয়েকটা বান্ধবীও এসেছে--। ছেলেগুলো সব কেমন কেমন করে হা করে তাকিয়ে থাকে-। হুহ। তাই চলে এসেছি-। বিরক্ত লাগছিল বাড়িতে--।

-আরিয়ান কেন এসেছে---?

-ওমা! আমার সব ফ্রেন্ডরাই এসেছে--। ভাইয়ার গায়ে হলুদ না?

-তাই বলে ওই ছেলেকেও আসতে হবে? আজব! তুমি এসেছ ভালো করেছ। কোথাও যেতে হবে না আজকে। 

-আরে! কোথায় থাকবো?

-আমার বুকের ভিতর----। 

-ইশ! যাও তো। খালি দুষ্টু দুষ্টু কথা বলো। আমার ভাইয়ার বিয়ে না কাল? আমি তো ভাবিকে সাজাতে আসবো কাল সবার আগে--। 

-যেতেই হবে?

-হি হি--। তুমি পাগল হয়ে গেছো--। 

-হ্যাঁ--পাগল হয়ে গেছি--। ওই ছেলে যদি আর একদিন তোমাকে বউ বলে ডাকে একেবারে খুন করে ফেলবো ওকে আমি---। 

-হি হি হি-। হি হি---। তুমি সত্যি পাগল হয়ে গেছো---। আচ্ছা কেউ এসে পড়বে--। আমি ভাবির কাছে যাই--। ওক্কে? টা টা----। 

-আরে? তিথি? দাঁড়াও?

তিথি তিয়াশের থেকে সরে এক ছুটে মায়রার রুমে চলে গেল। মায়রা মোবাইল হাতে আয়ানের মেসেজের অপেক্ষা করছিলো। তিথি এসেছে তাই টের পায় নি। তিথি মায়রাকে এসে জড়িয়ে ধরায় হুঁশ ফিরলো মায়রার। মন খারাপ নিয়েও মায়রা কোনমতে হাসার চেষ্টা করলো। তিথি অবাক হয়ে মায়রার দিকে তাকালো। 

-ইশ! ভাবি? তোমাকে এতো কিউট লাগছে! দাঁড়াও--। ভাইয়াকে ছবি পাঠাইসো?

-হুম---।

-বাহ! সো ফাস্ট--। হি হি---। চলো চলো? হলুদের অনুষ্ঠান শেষ হলে আবার গোসল দিতে হবে--। তারপর মেহেদীর অনুষ্ঠান--। বহু কাজ আজকে--। 

-হুম----। 

তিথি মায়রাকে নিয়ে ড্রইং রুমে এনে বসালো। মায়রা ড্রইং রুমের ডেকোরেশন দেখে একটু অবাকই হলো। এক পাশে ছোট্ট একটা স্টেজের মতো করা হয়েছে। আর স্টেজের মুখোমুখি করে বেশ অনেকগুলো চেয়ার সারি করে রাখা। সেই চেয়ারগুলোর প্রথম সারিতই মায়রার বাবা আর মা বসা। তাদের মুখ দেখে মায়রা বুঝতে পারছে না তারা খুশি নাকি বিরক্ত। ঘাড় থেকে এতোদিনের একটা বোঝা নামবে খুশি হওয়ার তো কথা ছিল!

তিথি, তিয়াশ আর মায়রার অন্য সব কাজিনরা হলুদের আয়োজন করছে। একবার একটা নিয়ে ছুটোছুটি করছে। কেউ হলুদ বাটিতে করে এনে রাখছে, কেউ উপটান, কেউ চন্দন গুলছে, কেউ হলুদের ডালা সাজাচ্ছে, আর কেউ মিষ্টি সাজাচ্ছে। সবাই ব্যস্ত যার যার কাজে। শুধু বাবা মা আর মায়রা কেমন ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে সব দেখছে। কার মনে কি চলছে কে জানে! মায়রা এসব খেয়াল করতে করতেই টুং করে একটা মেসেজ এলো। মোবাইলটা হাতে নিয়ে মেসেজ ওপেন করলো। জানে এটা আয়ানের মেসেজ। যেটার আসার জন্য এতোক্ষণ ধরে মেয়েটা অধীর হয়ে বসে ছিল। 

"আমার লাজুক পরীটাকে দেখে কি বলবো ভাষাই হারিয়ে ফেলেছিলাম। এখনো বুঝতে পারছি না কি বলবো। ভাবতেও পারছি না কিছু। কিন্তু শুধু একটা কথা জানি। রাতটা পেরুলেই এই লাজুক পরীটা আমার হবে। তাই নতুন সূর্যোদয়ের অপেক্ষায় বসে আছি। আর দোয়া করছি যাতে আজকের রাতটা একটু তাড়াতাড়ি কেটে যায়। জীবনের বাকি রাতগুলো যত ইচ্ছে লম্বা হোক। শুধু আজকের রাতটা সবচেয়ে ছোট রাত হোক-।"

মায়রা কি করবে বুঝতেই পারছে না। এই মেসেজের জবাবে কি বলবে ও! তবে আয়ানের মেসেজের রিপ্লাই দেয়ার সময় পেল না মায়রা। তার আগেই তিথি আর মায়রার আর সব কাজিনরা ওর থেকে মোবাইলটা নিয়ে রেখে দিয়েছে পাশে। মায়রার বাবা মাকে ধরে এনে হলুদের অনুষ্ঠান শুরু করেছে। ইচ্ছেয় কি অনিচ্ছেয় কে জানে, মায়রার বাবা মা একে একে মায়রাকে একটু হলুদ লাগিয়ে দিলেন। তারপর একটু মিষ্টি খাওয়ালেন। তারপর একে একে তিয়াশ, তিথি আর মায়রার কাজিনরাও মায়রাকে হলুদ লাগিয়ে প্রায় ভূত বানিয়ে দিচ্ছে। আর কেউ একজন গান ধরেছে।

"হলুদ বাঁটো, মেন্দি বাঁটো, বাঁটো ফুলের মৌ,
বিয়ার সাজে সাজবে কন্যা নরম নরম ব'রে

হলুদ বাঁটো, মেন্দি বাঁটো, বাঁটো ফুলের মৌ,
বিয়ার সাজে সাজবে কন্যা নরম নরম ব'রে

সুরমা-কাজল পরাও কন্নার ডাগর নয়নে,
আলতা বিছপ রাঙা দুটি, রাঙা চরণে
ভরা কলস ছলাৎ ছলাৎ ডাঙা এ নিতল ।
হলুদ বাঁটো, মেন্দি বাঁটো, বাঁটো ফুলের মৌ,
বিয়ার সাজে সাজবে কন্যা নরম নরম ব'রে
ঢেঁকি তোমার বিয়ার বাড়ির নতুন ঝামেলা,
সরু পিঠার মিঠার ক্ষীরে নতুন ঝামেলা,
তালে তালে সুর তুলে আজ মধুর কথা কও ।
হলুদ বাঁটো, মেন্দি বাঁটো, বাঁটো ফুলের মৌ,
বিয়ার সাজে সাজবে কন্যা নরম নরম ব'রে
রঙিন পারের শাড়িতে বউ সাজবে যতনে,
কন্যা সাজবে যতনে ,
মন ময়ূরী পেখম মেলে নাচবে তখনি,
কন্যা সাজবে তখনি,
পাল দুলিয়ে মাঝ গাঙ্গেতে চলছে যেন নাও ।
হলুদ বাঁটো, মেন্দি বাঁটো, বাঁটো ফুলের মৌ,
বিয়ার সাজে সাজবে কন্যা নরম নরম ব'রে------"

মায়রার গায়ে হলুদ, চন্দন, উপটান এসব মাখা শেষ হলে মেয়েরা মিলে মায়রাকে গোসল করিয়ে আনলো। সবাই মায়রাকে চেইঞ্জ করে আসার জন্য বলে চলে গেলে মায়রা আয়ানের দেয়া লেহেঙ্গাটা বের করলো। গোল্ডেন পাড়ে রঙ বেরঙের পাথর বসানো হলুদ একটা লেহেঙ্গা। লেহেঙ্গার টপসটাও গোল্ডেন কালারের। পাথর আর সুতার কাজ করা ভারি দোপাট্টা। সাথে আরেকটা বড় বক্স রাখা। সেটা খুলে মায়রা হা হয়ে গেল।

মায়রা লেহেঙ্গাটা একবার দেখছে আর একবার গয়নার বক্সটা। লেহেঙ্গাটা পড়ে আস্তে আস্তে গয়নাগুলো পড়ে নিজেকে আয়নায় দেখলো মায়রা। গোলাপ আর কাঠবেলি ফুল দিয়ে গড়া হলুদের গয়নার সাজে আয়নায় মায়রার প্রতিবিম্ব পড়েছে। গলায় ফুলের হার, মাথায় ফুলের টায়রা, হাতে হলুদ কাঁচের চুড়ির সাথে মোটা করে ফুলের বালা দিয়ে পাঁচ রিংয়ের পাঞ্জা, বাহুতে ফুলের বাজু, কোমড়ে ফুলের বিছা হার, পায়ে ফুলের জোড়া নূপুর আর নাকে ফুলের নথ। দেখতে ভালো লাগছে। চোখে মোটা করে কালো কাজল পড়লো মায়রা। আর ঠোঁটে হালকা রঙা লিপস্টিক। মনে করে আজ হলুদ রঙা টিপও পড়েছে ও। নিজেকে দেখে নিজেই যেন চিনতে পারছে না মায়রা। 

তিথি আর মায়রার কাজিনরা মায়রাকে মেহেদী পড়াতে স্টেজে নিতে এসে একেবারে হা হয়ে গেল। মেয়েটাকে এতোটা স্নিগ্ধ লাগছে দেখতে! তার উপরে ফুলের সাজে একেবারে হলদে পরী লাগছে মায়রাকে। সবাই দুষ্টুমি করতে করতে মায়রাকে নিয়ে স্টেজে গেল। তারপর মেহেদী লাগালো দু হাতে। সবাই একে অন্যের হাতে মেহেদী লাগিয়ে দিলো। সেই সুযোগে তিথিও মেহেদী পড়লো হাতে। মেহেদী শুকালে সেটার রঙ নিয়েও সবাই মায়রার সাথে অনেকক্ষণ দুষ্টুমি করলো। তারপর মেহেদী অনুষ্ঠান শেষ করে খাওয়া দাওয়া করে নিলো সবাই মিলে। খাওয়া শেষে সবাই যে যার মতো বিছানা পেতে ঘুমানোর জন্য চলে গেল। আর তিয়াশও তিথিকে বাসায় পৌঁছে দিতে বের হলো।

গায়েহলুদ আর মেহেদীর ঝামেলায় মোবাইলটা হাতে নেয়াও সময় পায় নি মায়রা। এখন একা রুমে মায়রা চেইঞ্জ না করেই আয়ানকে কল দিলো। কলটা রিসিভ না হয়ে কেটে গেল। মায়রার মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল। মোবাইলটা রাখবে এমন সময় টুং করে একটা মেসেজ আসতেই সেটা ওপেন করলো মায়রা। আয়ানের ছোট্ট একটা মেসেজ।
 

"এখনই চেইঞ্জ করো না প্লিজ। আর ১০ টা মিনিট একটু কষ্ট করে এভাবেই থাকো।"

মায়রা মেসেজটার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারলো না। চেইঞ্জ না করে এভাবে বসে থাকলেই বা কি হবে! তবু মায়রা বসে অপেক্ষা করছে। কি হবে সেটা জানার দরকার নেই ওর। এই মানুষটার জন্য অপেক্ষা করায় ও মেয়েটা আলাদা একটা শান্তি পায়। কেন হয় এমন কে জানে!

৩০!! 

তিয়াশের পাশে চুপটি মেরে বসে আছে তিথি। মুখটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে মানুষটা চাইছে না তিথি যাক। কিন্তু সেটা তো আর সম্ভব নয়। লোকটা কেন যে এতো ছেলেমানুষি করে কে জানে! এতোক্ষণ বহু বিষয় নিয়ে তিয়াশের সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছে তিথি। কিন্তু ছেলেটা চুপচাপ গাড়ি চালাচ্ছে। না কোন কথা বলছে না তিথির দিকে তাকাচ্ছে। তিথি রাগ করে গাল ফুলিয়ে বাইরের অন্ধকার দেখছে। আর কাঁচের ভেতর দিয়ে তিয়াশের প্রতিবিম্ব খেয়াল করছে। তিথি রাগ করে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে দেখেও যখন তিয়াশ কিছু বলছে না, রাগ ভাঙানোরও চেষ্টা করছে না দেখে তিথি কেঁদে ফেললো। 

তিয়াশ তিথির দিকে না তাকিয়েই হাত বাড়িয়ে তিথিকে কাছে টেনে বুকে জড়িয়ে ধরলো এক হাতে। তিথি চমকে গিয়ে তিয়াশের মুখের দিকে তাকালো। তিয়াশ এখনো নিজের মতো করে গাড়ি চালাচ্ছে সামনে রাস্তার দিকে তাকিয়ে। মুখটা গম্ভীর হয়ে আছে। তিথি সরে গিয়ে বসলো সিটে। 

-এই যে? গাড়ি থামান?

তিয়াশ কিছু না বলে চুপচাপ গাড়ি থামাতেই তিথি সিটবেল্ট খুলে নামার চেষ্টা করতেই তিয়াশ তিথির হাতটা শক্ত করে ধরে রাগী চোখে তাকালো তিথির দিকে।

-এখানে নামছো কেন?

-হাত ছাড়ুন?

-তিথি? 

-ছাড়ুন--। এতো কষ্ট করে আমার সাথে যেতে হবে না আপনাকে। আপনি চলে যান। আমি একাই চলে যাবো----।

-সেদিন রাতের কথা খেয়াল নেই তোমার? জায়গাটা কতো নিরব দেখেছো তুমি?

-সব মনে আছে-। কিছু হবে না। হলেও আপনিও বেঁচে যাবেন--। ছাড়ুন--। 

-তিথি? কি বলছো এসব? আরে!

-ছাড়ুন বললাম না? আপনি আপনার ওই সুন্দরী গার্লফ্রেন্ডের কাছেই যান-। আমার এতো প্যাঁচাল আপনাকে সহ্য করতে হবে না---। ছাড়ুন---।

-এবার একটু বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না তিথু? আর গার্লফ্রেন্ড কোত্থেকে এলো এর মধ্যে?

-সেদিন তো বলছিলেন আপনি গার্লফ্রেন্ডের কথাই শুনবেন--। আমার কথা শুনবেন কেন! আমি আপনার কে লাগি? যেতে দিন আমাকে। আমি তো কেউ না--।

-তিথি?

-ছাড়ুন?

-বেশি নাটক করতে মন চাচ্ছে না তোর? নাকি বাড়ির ছেলেগুলোর কাছে যাওয়ার জন্য তর সইছে না? কোনটা?

--------হ্যাঁ, সেটাই--। ছাড়ো বলছি----?

-হ্যাঁ যাও। তোমার ওই আরিয়ানের কাছেই যাও। 

তিয়াশ রাগ করে হাত ছেড়ে দিতেই তিথি রাগ করে গাড়ি থেকে নেমে গেল। কয়েক পা গিয়ে একবার পিছনে ফিরে দেখলো তিয়াশের গাড়িটা সামনেও আসছে না, আবার ফিরেও যাচ্ছে না। তিথি চোখ মুছতে আবার সামনের দিকে পা বাড়ালো। রাগ লাগছে প্রচন্ড রকমের। কান্না করার কারণে চোখ ঝাপসা হয়ে পথ দেখতে কষ্ট হচ্ছে তিথির। তবুও হাঁটা বন্ধ না দিয়ে হাঁটছে মেয়েটা। হঠাৎ কারো টানে একেবারে বুকের সাথে মিশে গেল তিথি। ছোটার জন্য ইচ্ছে করেই লাফালাফি করছে তিথি। কিন্তু মানুষটা না ছেড়ে আরো আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিচ্ছে তিথিকে।

-ছাড়ো? অসভ্য ছেলে ছাড়ো বলছি? এখন প্রেম দেখাইতে আসছে সে!

-তিথু? সরি?

-ওই? রাখো তোমার সরি--। ছাড়ো। আমার দেরি হচ্ছে। সবাই আমার জন্য ওয়েট করছে না বাসায়? সরো? নইলে ওদেরকেই কল করে বলবো নিয়ে যেতে এসে--। তবু তোমার সাথে-।

-সরি তো মনি? সরি সরি?

-তোমার থেকে আরিয়ানই ভালো---।

কথাটা শেষ করার আগেই তিয়াশ তিথির মুখটা তুলে ধরে ঠোঁট জোড়া কামড়ে ধরলো শক্ত করে। তিথি চমকে উঠে তিয়াশের পাঞ্জাবিটা খামচে ধরলো। বেশ অনেকটা সময় পর তিয়াশ তিথির মুখটা তুলে ধরে দেখলো কিছুক্ষণ। মেয়েটার লজ্জামাখা মুখটায় লাল আভা ছড়িয়ে পড়েছে। তিয়াশ তিথির মুখটা তুলে ধরে আস্তে করে ঘাড়ের কাছের চুলের গোছা সরিয়ে ঠোঁট ছোঁয়ালো। তিথিও শক্ত করে তিয়াশের হাত চেপে ধরেছে। 

-তোমার মুখে যদি আরেকবার ওই বদ ছেলেটার নামও শুনি--। তাহলে এমন হাল করবো যে---কল্পনাও করতে পারবা না--। বুঝতে পেরেছো? 

-হুম--। কিন্তু ও তো আমার----।

-আবার?

-ছাড়ো? বাসায় যাবো?

-হুম---।

তিয়াশ আলতো করে তিথিকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে কয়েক পা হেঁটে গিয়ে গাড়িতে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিলো। তারপর আলতো করে বুকে টেনে নিয়ে চুলে চুমো খেল। 

-সরি পিচ্চি বউটা?

-তাড়াতাড়ি চলো না? ঘুম পাচ্ছে খুব--।

-এই? বুকের মধ্যেই ঘুমিয়ে যেও না আবার আজকেও---।

-কেন? ঘুমালে বুঝি সমস্যা?

-তা তো একটু সমস্যাই---। আপনাকে তো আর আপনার বাসায় সবার সামনে দিয়ে কোলে করে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে আসতে পারবো না----।

-যাহ-। কি সব বলে সবসময়! গাড়ি চালাও তো তুমি---। আমি ঘুমাবো না---। 

এদিকে মায়রাও সারা রুমে চক্কর দিতে দিতে আয়ানের অপেক্ষা করছিলো। হঠাৎ মোবাইলে কল আসতেই তাড়াহুড়ো করে রিসিভ করলো কলটা। 

-হ্যালো?

-ও লাজুক পরী? একটু বারান্দায় আসবে?

-আপনি এতো রাতে এখানে?

মায়রা বারান্দায় এসেই দেখলো আয়ান গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মায়রার বারান্দার ঠিক সামনা সামনি। হলুদ রঙের পাঞ্জাবি, সাদা পাজামা আর লাল ওড়না। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় মানুষটাকে রাজকুমারের মতো দেখতে লাগছে। আয়ানও মোবাইলটা কানে লাগিয়ে তার লাজুক পরীটাকে দেখলো বেশ অনেকক্ষণ। 

-হ্যালো? চুপ করে গেলেন কেন ম্যাডাম?

-তিথি তো চলে গেছে ভাইয়ার সাথে--।

- জানি তো-। আমি তো অন্য কারণে এসেছি--।

-হুম?

-মেহেদী কেমন হয়েছে? 

----ভালোই---।

-অন্ধকারে তো দেখতে পাচ্ছি না-। কাল দেখবো কেমন?

-আচ্ছা----।

-এখন ঘুমিয়ে পড়ো কেমন?

-জি--।  

-আসছি মিসেস মায়রা আয়ান আহমেদ----।

---------সাবধানে যাবেন--।

-সাবধানে তো যেতেই হবে-। কাল একেবারে বউ করে নিয়ে যাবো কিন্তু--। কি বলেন? রাজি তো?

-হুম-----। 

-বায় মিষ্টি পরী---। টা টা। গুড নাইট।

সকালবেলা মায়রার ঘুম ভাঙতে একটু দেরি হয়েছে। কেউ এতো বেলা হওয়ার পরেও ডাকে নি সেটাই আশ্চর্য ঠেকছে মায়রার কাছে। হয়তো আজ বিয়ে বলেই কেউ কিছু বলছে না। মায়রা ফ্রেশ হয়ে এসে দেখলো তিয়াশ মায়রার রুমে বসা। মায়রা অবাক চোখে তিয়াশকে আর পাশে রাখা খাবারের প্লেট দেখছে। তিয়াশ হাত নাড়িয়ে মায়রাকে বিছানায় বসায় জন্য ডাকলো। মায়রার সেদিকে হুঁশ নেই দেখে তিয়াশ গলা খেঁকারি দিলো।

-মায়ু? আয়? এখানে বস?

-ভাইয়া? খাবার রুমে এনেছ! মা বকবে---।

-চুপ থাক তো---। হা কর---।

-ভাইয়া?

-চুপ--। হা করতে বললাম না?

-হুম----।

মায়রা বিছানায় তিয়াশের সামনে বসলে তিয়াশ নিজ হাতে মায়রাকে খাইয়ে দিতে লাগলো। পাউরুটি টোস্ট করা, ডিম পোঁচ, আর জুস। মায়রা অবাক চোখে তিয়াশকে দেখছে আর খাচ্ছে। 

-জানিস? তুই আমার চেয়ে ৪ বছরের ছোট। মা যেদিন প্রথমবার তোকে নিয়ে বাড়ি এলো আমাকে তখন আর পায় কে! পিচ্চি একটা লাল টুকটুকে পুতুলের মতো ছিলি তুই। আমার বোন পুতুল। তোর নামটাও আমার দেয়া জানিস? ছোট বয়সে মায়রা নামটা মাথায় এসেছে বলে এটাই রেখে দিয়েছিলাম। আজও তোর এই নামটা আমার ভিষণ পছন্দের জানিস? ধীরে ধীরে বড় হতে হতে যখন বুঝতে পারলাম এই বাড়িটায় আমার পুতুলটা ভালো নেই, তখন কিছুই করতে পারি নি রে আমি। কোনমতে এটা ওটা বলে তোর পড়াটা যাতে হয় সেটুকুই ব্যবস্থা করতে পেরেছি। কিন্তু তোর ভাইয়ের এতো ক্ষমতা ছিল না যে তোকে এতো অত্যাচার থেকে আগলে রাখবে--। 

-ভাইয়া? কাঁদছো কেন? তুমি না থাকলে কে আমাকে হুটহাট খাতা কলম বই রংপেন্সিল এসব কিনে দিতো বলো? কে নিজের টাকাটা লুকিয়ে আমাকে চকলেট কিনে দিতো? তুমি তো তোমার মতো করে আগলে রেখেছিলে আমাকে--। আর কতো আগলাতে বলো?

-কাঁদিস না রে বোন-। আয়ানরা যখন তোকে দেখতে এলে সেদিন আমি ভিষণ ভয় পেয়ে গেছিলাম জানিস? ওখানেও যদি ওরাও তোর সাথে এমন------। তবে সব খবরাখবর নিয়েছি রে আমি পরে। মানুষগুলো আসলেই ভিষণ ভালো। তাই বিয়ের খরচ হচ্ছে না বলে বাবা মাও বেশ শান্ত হয়েই আছে--। যাক সেসব। এই বাড়ির তিক্ত অতীতটা পারলে ভুলে যাস মায়ু--। কখনো কোনদিন বাড়ি আসার দরকার হলে নিশ্চিন্তে ভাইয়ের কাছে চলে আসবি---। বাবার বাড়িতে আসতে না পারিস- ভাইয়ের বাড়ি ভেবে অন্তত আসিস বোন? একেবারের জন্য পর করে দিস না এই ভাইটাকে?

-ভাইয়া?

মায়রা তিয়াশের বুকে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেললো। এই মানুষটার জন্যই তো ওর এতোদূর পর্যন্ত আসতে পারা। মানুষটাকে কি করে পর করে দিবে মায়রা! তিয়াশ একটু পর নিজেকে সামলে নিয়ে মায়রার চোখ মুছে দিলো ভালো করে।

-এ যে বিয়ের কনে? এতো কাঁদতে আছে? খেয়ে নে তাড়াতাড়ি। একটু পরেই তিথিরা চলে আসবে। বিয়েটা কিন্তু আজ দুপুরেই-। দেখা যাবে সাজতে সাজাতে তোদের বিকেল হয়ে যাবে---।

-ভাইয়া?

তিয়াশ আর মায়রা দুজনেই হেসে ফেললো। তিয়াশ মায়রাকে খাইয়ে দিচ্ছে আর রাজ্যের গল্প করছে। এদিকে মায়রাও ভাইয়ের হাতে খাচ্ছে আর বহুদিন পর হাসতে হাসতে ওর চোখে পানি এসে যাচ্ছে।  তবু মেয়েটার হাসি থামছেই না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন