তিতিরকে থাপ্পড় মেরে সবার সামনে টানা-হেচড়া করে রুমে নিয়ে গিয়ে আবার স্ব-জোরে দরজা বন্ধ করার মত ঘটনা সবাইকে একদম চুপ করে দিয়েছে। কামরান সাহেব এবং বাতাসি বিবি তীক্ষ্ণ নজরে লাবীবা বেগমের দিকে চেয়ে আছেন। তারা দু'জনেই লাবীবাকে আবার নতুন করে চেনার চেষ্টা করছেন। শাশুড়ী আর স্বামীর ওমন চাহোনি দেখে পুরো শরীরে তার কম্পন ধরে গেল। বাতাসি বিবি তো সবার সামনে বলেই ফেলল-
~" তুমি এত ডাহা মিত্যা কতা কদ্দিন থাইকা শিকছো লাবীবা।"
মা মিথ্যা কথা বলেনি দাদী! আমি নিজে দেখেছি, তিতির মায়ের গায়ে হাত তুলেছে। বিশ্বাস না হলে ফুফুরে জিঙ্গাস করুন। কথাগুলো বলে নিজের শাশুড়ির পাশে দাড়াল নিসা। নিসাকে পাশে পেয়ে মনে হয় লাবীবা দম ফেলার সুযোগ পেল। এরা মা ছেলে যেভাবে ওর পিছে পড়েছে নাজানি সত্যি কথাটা কখন যেন মুখ দিয়ে বেরই হয়ে যায়।
নিসার কথা শুনে বাতাসি বিবি হুংকার ছেড়ে বলে উঠলেন-
~" এই বেদ্দপ মাইয়া চুপ! তুইতো সব লষ্টের গোড়া। তোর এত্ত পাপের বিচার না জানি তোর মাইয়াগোর উপর দিয়া না যায়। বাড়ীত ক্যাচাল লাগার ধান্দা খুজোস সব সময়! তুই এত্ত কিলকবাজী লাগাইলি, তাও তোর ভাতার চুপ কইরা খাড়াই রইছে। এমনি এমনি কই হেই মাগীর ভ্যাড়া! দেখ, দেখ, কামু তোর পোলা এমন কইরা অ্যার দিকে চাইয়া আছে দেখে মনে হয় মুড়া ঝাডা দিয়া মুখেই শুধু বারি দিই।"
মুখ সামলে কথা বলেন দাদী। আমি বিয়াদপ না আপনি বিয়াদপ। বিয়াদপ না হলে সবার সামনে এমন করে মুখ চালান! আপনি তো দেখছি দু-মুখো সাপ। এদিকেও থাকেন ওদিকেও থাকেন। আগে নিজের চরিত্র ঠিক করেন তারপর আমার সাথে লাগতে আসবেন। আমরা যে এতগুলো মানুষ তার বিরুদ্ধ অভিযোগ করছি তার মানে আমরা সবাই মিথ্যাবাদী আর ঐ পাগলটা সত্যবাদী তাইনা! মাহাদ ওর গায়ে হাত তুলেছে বেশ করেছে। আরও দুটা দিতে পারলোনা! কথাগুলো বলে নিসা মুখ বাঁকালো।
নিসার কথা শেষ না হতেই ওর গালে অচমকায় ঠাশ্ করে একটা থাপ্পড় পড়লো সবার সামনে। নিসা গালে হাত দিয়েই দেখলো ফুয়াদ ওর সামনে দাড়িয়ে আছে। নিসা কাঁপা কন্ঠে বলে উঠলো-
~" তুমি সবার সামনে আমার গায়ে হাত তুললে?"
ফুয়াদ নিসার কথার জবাব না দিয়ে পকেট থেকে ফোনটা বের করে কাকে জানি কল দিতে দিতে বাহিরে চলে গেল।
এমন কান্ডে বাতাসি, রুপালি আর নিসার দিকে আঙ্গুল তুলে ঝাঁঝালো গলায় বলল-
~" তোগো মুখ দেখতে অ্যার মন চায় না। সর অ্যার চোখের সামনে থাইকা। একজন ইবলিসের মাও আর একজন বেটি। দুনিয়া উলটাইয়া যাইবো তবুও এরা কোনদিনও শোধরাবো না। সয়ং আল্লাহ্ ছাড়া তগো কেউ বিচার করবার পারবো না।"
বাসার এমন পরিস্থিতে সম্রাট বেশ বিব্রত বোধ করলো। তাই সে ওখান থেকে দ্রুত চলে গেল। পিছে রুমকিও চলে গেল। ওরা যেতেই কামরান সাহেব লাবীবার কাছে এসে নিচু গলায় বলল-
~" এত অন্যায় করার পরও তোমার ছেলে তোমাকে কিছু বলতে না পেরে নিজের স্ত্রীর গায়ে হাত উঠালো। আমার তো মনে হচ্ছে ঐ শাস্তিটা তোমার প্রাপ্য ছিলো। তোমার মিথ্যা কথা কি ভাবছো মাহাদ ধরতে পারেনি! তোমার কথা বিশ্বাস করে তিতিরের গায়ে হাত তুলেছে! কখনো না, সে অবশ্যই বুঝতে পেরেছে তোমার এগুলো চ্যাল ছিল। কোথায় গেল তোমার সেই ওয়াদা! যে ওয়াদা করে ছেলেকে বাসায় নিয়ে এসেছিলে!"
কামরান সাহেব আর কথাগুলো শেষ করতে পারলেন না। মাহাদের রুমের দরজা খুলে গেল এর মধ্য। দরজা খুলতেই ভিতর থেকে তিতিরের গলা শোনা গেল। সে চিৎকার করে বার বার বলছে, আপনি আমার গায়ে হাত তুললেন কেন! তাছাড়া তো ভাঙ্গচুর রয়েছেই। মাহাদ বাহির থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে দ্রুত পায়ে সিড়ি দিয়ে নেমে একদম মায়ের কাছে এসে দাড়ালো। হ্যাঁ মাহাদ তার মায়ের কথাতে তিতিরের গায়ে হাত তোলেনি। তার বাবার কথায় ঠিক। মায়ের কাছে এসে ধীর গলায় বলে উঠলো-
~" তরবারির চেয়ে ভালোবাসা অনেক উত্তম,
অন্যায়ের আধারে ডুবে থাকার চেয়ে।
তেতো ঘাস খেয়ে বেড়ে ওঠা ঘোড়া শাবকের চেয়ে, না বেড়ে ওঠাই উত্তম।
যে সুমুদ্রের নোনাজল তৃষ্ণা মেটায় না, সেটার অস্তিত্ব অনর্থক।
যে সন্তান তার পিতার যোগ্য উত্তরসরী হতে পারেনা, তার না থাকায় উত্তম।
টাকার বিনিময়ে কোন সুখ ও শান্তির চেয়ে, বসতিহীন জিবনও উত্তম।
আর তোমার মত মা থাকার চেয়ে, মা না থাকাটাই আমার জন্য শ্রেয়।"
~" মাহাদ শোন বাবা, আসলেই আমি......।"
মায়ের কথাকে আর বাড়তে না দিয়ে ও দু'হাত জোড় করে বলল-
~" এতদিন তোমার কথা আমি অনেক শুনেছি। আমার স্ত্রী কি কি করতে পারে সেটা শুধুমাত্র আমিই জানি। তাই তুমি হাজার বার গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিয়ে বললেও আমি মানবোনা আমার স্ত্রী এমন ধরনের কাজ করবে বা করেছে। শুধু তুমি কেন! যে কেউ বললেও আমাকে কেউ তা বিশ্বাস করাতে পারবেনা।
আর আমার স্ত্রীর গায়ে আমি এমনি এমনি হাত তুলিনি! আমি হাত এজন্যই তুলেছি যে, সে তোমার মত এত নিচু মনের মানুষের কাছে বিশ্বাস নিয়ে কেন যায়! তার বোঝা উচিত, তার জন্য এই বাসার কেউ সঠিক নয়। একটা কথা সবাই কান খুলে শুনে নাও,
এবার আমার বউয়ের অসুস্থতার সুযোগ নিয়ে যদি কোন মানুষ নোংরা খেলায় মেতে ওঠে তাহলে তার অস্থি মাংস আমি কাবাব করে ফেলবো। আমার বউকে যদি আমি ছাড় না দেই তাহলে অন্যদের ছাড় দেওয়ার কথা ভাবা মানে বোকামি ছাড়া কিছুই নয়। শুনেছি মা নাকি সন্তানের ভালোর জন্য সব করতে পারে। আর তুমিতো আমার সুখ-শান্তি বারবার গলা টিপে মেরে ফেলার চেষ্টা করছো! এখন বলো, তোমাকে মা হিসাবে কোন কাতারে দাড় করাব! ভালো না জঘন্যতম খারাপের কাতারে!"
কামরান সাহেব খপ করে মাহাদের হাত চেপে ধরে অশ্রু সিক্ত নয়নে বলে উঠলো-
~" বাবা, আমাকে ছেড়ে কোথাও আর যাসনা। আমার বেঁচে থাকার জন্য বিশুদ্ধ অক্সিজেন দরকার। আর আমার জিবনে বিশুদ্ধ অক্সিজেন তিতির আর সাদ। মেয়েটা কোনদিনও আমার মুখের উপর কথা বলেনি। যা বলেছি তা মাথা নিচু করে অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। আজ তার মাথার সমস্যা হয়েছে বলে ফেলে দিব, কখনো না! আমার মেয়ে নেই, তাকে মেয়ের স্থান দিয়েছি। তাকে অন্য কোথাও নিয়ে যাস না। তুইতো জানিস, গাছের সুমিষ্ট ফলের উপরই সবাই ঢিল ছোড়ে। তিতির সেই রকম সুমিষ্ট ফল তাই সবাই বার বার তাকে আঘাত করে।"
মাহাদ বাবার কথা শুনে ধপ করে সোফায় বসে পড়লো। মাহাদের মুখ থেকে শুধু একটাই কথা বের হলো। আপনজন হারানোর কষ্ট আমার থেকে আর কেউ ভালো জানেনা বাবা। অামি চাইনা আমার সাজানো পরিবারটা ধংস হয়ে যাক। মাকে একটু বুঝান। আমাকে কম কষ্ট দিতে বলুন তাকে। আমিও তো তার সন্তান। তাহলে আমার সুখের পিছনে তিনি মা হয়ে কিভাবে লাগেন!
কামরান সাহেব মাহাদ কে তুলে তিতিরের কাছে পাঠিয়ে দিয়ে নিজেও তার রুমে গেলেন। কামরান সাহেব চলে যেতেই এদের মিটিং ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল।
♥
তিতির আবার ব্যালকুনিতে এসে কান্না করতে লাগলো। তার একই কথা, মাহাদ তাকে মারবে কেন? আমি মাকে মারিনি তবুও মা মিথ্যা কথা বললো কেন? শুধু কাল দিনটা একবার আসুক তারপর মায়ের এমন হাল করবো তখন এমনি মিথ্যা কথা বের হয়ে যাবে। তিতির যখন নানা কথায় নিজের মনকে শান্ত করছে ঠিক তখনই মাহাদ রুমে ঢুকলো। তিতির দু'হাতের পিঠ দিয়ে চোখ মুছে চুপ করে রইলো।
কিন্তু অনেক সময় হয়ে গেল, মাহাদ ওর কাছে আর আসলো না। মাহাদ না আসার কারনে তিতির ভিতরে ভিতরে আরও রেগে গেল।
বেশ কিছুক্ষন সময় নিয়ে মাহাদ তিতিরের কাছে এসে দাড়িয়ে বউ বলতেই,
আমাকে ছেড়ে দিন, আমি আপনাকে ঘৃনা করি বলেই তিতির গায়ের শক্তি দিয়ে মাহাদকে জোড়ে একটা ধাক্কা দিয়ে রুমের ভিতর আসলো।
স্ত্রীর কাছ থেকে এমন কষ্টময় ব্যবহার দেখেও মাহাদ নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে আবার রুমের ভিতর এসে তিতিরের পিছনে দাড়িয়ে ওর মাথার সাথে নিজের মাথা লাগিয়ে ওর সামনে দু'হাত মেলে ধরলো।
পুরো হাত ওর বাথ্যায় চিন চিন করছে। দু হাতের তালুতে রক্ত দিয়ে লেখা ছিলো, I am sorry এবং I Love you Titir.
এমন দৃশ্য দেখে তিতির ছলছল চোখে পিছন ফিরে মাহাদের দিকে চেয়ে তাকাতেই মাহাদ ঐ অবস্থায় তিতিরের কমোর জড়িয়ে নিচে বসে পড়লো। আমার জিবনটা একবার চাও, সেটাও আমি তোমার জন্য দিয়ে দিব।
সাথে সাথে তিতিরের ওর মেয়ে মারা যাওয়ার দিনের কথা স্মরন হলো। এভাবেই রক্ত গড়িয়ে পড়ছিল অতিথীর মাথা দিয়ে। কয়েকবার কই মাছের মত ছটপট করেই নিঃস্তব্ধ হয়ে যায় মেয়েটি।
মাহাদকে নিজের কাছ থেকে সরিয়ে দিয়েই বেডে গিয়ে বসে কাঁপতে লাগলো তিতির। তারপর চিৎকার দিয়ে বলে উঠলো, সরান ওগুলো আমার চোখের সামনে থেকে। আমি সহ্য করতে পারছিনা।
কথাগুলো বলেই ছোট বাচ্চাদের মত কেঁদে উঠলো তিতির।
মাহাদ ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই দ্রুত মেডিসিন বক্স নিয়ে ওয়াসরুমে চলে গেল।
মাহাদ ওয়াসরুমে যেতেই ওদের দরজায় নক করলো কেউ। আরও কয়েকবার নক করতেই তিতির উঠে গিয়ে দরজা খুলেই দেখলো তার শাশুড়ী দাড়িয়ে আছে। লাবীবা বেগমকে দেখেই তিতির রাগী কন্ঠে বলে উঠলো-
~" ছেলের হাতে মাইর খাওয়ায় নিয়ে এখন দেখতে এসেছেন, আমি মরে গেছি না বেচে আছি! আমি যদি এর শোধ না তুলি তো আমার নামও তিতির নয়। আপনার ছেলেকে নিয়ে আপনি চলে যান এ রুম থেকে।"
ছেলের বউয়ের মাথা খারাপ তাই তিতিরের কথায় কিছু মনে না করে বেশ জোড় করেই রুমের ভিতর ঢুকে দেখলেন, অনেক জিনিস পত্র ভাঙ্গচুর করে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখছে তিতির। তুমি এসব আবার ভাঙ্গছো!
~" ভেঙ্গেছি বেশ করেছি। বেশি কথা বলবেন তো আপনারও মাথা ভেঙ্গে ফেলবো এরকম করে। আমি বলছিনা, আপনার ছেলেকে নিয়ে রুম থেকে চলে যেতে! কথা শোনেন না কেন!"
~" মাহাদ কই!"
~" জাহান্নামে গেছে।"
~" এই তুমি এসব কি বলো! স্বামীকে এমন কথা বলে নাকি? ও তোমাকে কত ভালোবাসে আর তুমি এসব কথা বলছো!"
বাল বাসে! ভালোবাসলে আমাকে ওভাবে মারতো নাকি! আপনার ছেলেকে নিয়ে যান বলে ফুফিয়ে উঠে কাঁদতে লাগলো তিতির।
~" আচ্ছা আমি নিয়েই যাব। এখন বলো, মাহাদ কই! ওকে দেখছি না যে!"
~" ওয়াসরুমে গেছে।"
মাহাদ নেই দেখে লাবীবার একটু সাহস হইলো। নিচে বসে ফ্লোরের জিনিস পত্র কুড়িয়ে রুমের কোনায় রাখা ঝুড়িতে ওসব ফেলতে লাগলো। কিন্তু এক জায়গায় গিয়ে ওর চোখ স্থির হয়ে গেল। ফ্লোরে অনেকগুলো রক্ত পড়ে আছে। তিতির তোমার কি আবার কোন জায়গায় কেটে গেছে! আমাকে দেখাও দেখি!
আপনার বজ্জাত ছেলের হাত কেটে গেছে বলে তিতির আবার ব্যালকুনিতে গিয়ে দোলনায় বসে রইলো মন ভার করে।
লাবীবা বেগম সব কিছু রেখে ওয়াসরুসের দরজা ধাক্কাতে লাগলো। মাহাদ, মাহাদ দরজা খোল। তোর কতখানি হাত কেটেছে আমাকে দেখা বাবা। দরজা খোল না বাবা।
মাহাদ দরজা খুলে ওর মাকে দেখে অবাক হলোনা। বরং ব্যান্ডেজ করা হাত নিয়েই ওয়াসরুমের দরজা বন্ধ করে দিয়ে রুমে এসে মায়ের দিকে চেয়ে রইলো। লাবীবা চোখের পানি মুছে বাঁকি কাচের টুকরোগুলো তুলতে লাগলো।
মাহাদ ক্লান্ত স্বরে বলে উঠলো-
~" মা, এসব কেন করছো?"
মাহাদের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে উল্টো তিনি নিজেই বলে উঠলেন-
~" তোর বউতো বলছে তোকে আমার সাথে নিয়ে যেতে। তুই না গেলে নাকি রুমেই আসবে না।"
~" তিতির কোথায়!"
~" ব্যালকুনিতে গিয়ে বসে আছে রাগ করে।"
মাহাদ আর কিছু না বলে চুপ হয়ে রইলো। প্রচুর ঘুম পাচ্ছে তার। পুরো দিনে তেমন ভালো খাওয়া হয়নি। টেন্ডার নিয়ে একজনের সাথে ঝামেলা চলছে। তাই টেন্ডার পেতে হলে ভালো পার্টিসিপেট করতে হবে। দিন-রাত এক করে কাজ করছে সে। তার ভিতর এত্ত ঝামেলা। কোন দিকে একা সে সামলাইবে। বালিশে মাথা রেখে টান হয়ে সুয়ে পড়লো বেডে।
লাবীবা বেগম পুরো রুম ভালো করে সাফ করে নিচে চলে গেলেন। তারপর খুব জলদিই প্লেটে খাবার নিয়ে এসে মাহাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, ঘুমিয়ে পড়েছিস বাবা!
মাহাদ আধো চোখ মেলে মাকে দেখে আবার চোখ বন্ধ করলো। লাবীবা এক প্রকার জোড় করেই ছেলেকে তুলে মুখে এক লোকমা ভাত এগিয়ে দিতেই মাহাদ বললো-
~" আমি বললাম না খাবোনা! বার বার জোড় করছো কেন?"
লাবীবা বেগমের চোখে পানি আর আটকালো না। তিনি নাক টেনে বললেন-
~" আমি যেমন বদলে গেছি ঠিক তুইও বদলে গেছিস? আমার জন্য তো তোর সময়ও হয়না। আমার খোঁজ খবর নেওয়ার সময়টুকুও নেই তোর কাছে।"
মাহাদ আর কথা না বাড়িয়ে খাবার খেয়ে নেয়। আমাকে কি মাফ করেছিস মাহাদ?
মায়ের এমন কথা শুনে মাহাদ নরম স্বরে বলে উঠলো-
~" আমি তোমার উপর বেশিক্ষণ রাগ করে থাকতে পারিনা মা। যাও খেয়ে নাও। বাবা কি খেয়েছে?"
~" তোর দাদী, জোড় করে এনে সবাইকে নিয়ে খাবার খাচ্ছে। তিতিরকে এখানে ডাক না! আমি ডেকেছি কিন্তু কোন কথা না বলে আরো নড়ে চড়ে বসলো দোলনাতে।
~" তাহলে ও এখন আর রুমে আসবেনা। ওর খাবার দিয়ে যাও। খুদা লাগলে এমনি খেয়ে নিবে।"
লাবীবা বেগম সব নিয়ে চলে যেতেই মাহাদ ব্যালকুনির থাই দিয়ে তিতিরের দিকে চেয়ে বললো-
~" ওখানে মশার ভিতর কি করছো? আর এভাবে থাই খুলে রাখলে তো রুমে মশা আসবে।"
একা একা খেয়ে আবার দরদ দেখানো হচ্ছে। আমার মা নেই বলে কেউ আমাকে এতো আদর করে খাওয়াতে আসলো না। আমি না খেলে কার কি! আমার ছেলেও খোঁজ নিলো না। সবাই আমার পর। কথাগুলো বিড়বিড় করে বললো তিতির।
মাহাদ আরও কয়েকবার ডাকলো কিন্তু তিতির কথা শুনলোনা। ওভাবে দোনলায় ঠায় বসে রইলো। কিছুক্ষন পর লাবীবা তিতিরের জন্য খাবার রেখে তিতিরকে ডেকে চলে গেলেন। মাহাদ অনেক্ষন বসে থেকে কেবল শুইতে গেছে অমনি তিতির লাফ দিয়ে দোলনা থেকে উঠেই দৌড়ে এসে বলল-
~" আপনি আমার বেডে একদম শুইবেন না। "
~" তাহলে আমি কোথায় শুইবো?"
~" আমি জানিনা। কিন্তু আমার কাছে একদম শুইতে পারবেন না।"
~" আচ্ছা যা বলবা তাই হবে। আপাতত খাবার খাও।"
~" আপনাকে বলেছি আমি খাবার খাবো! আমার বেড থেকে নামেন বলছি?"
মাহাদ কোন কথা না বলে বালিশটা নিয়ে ফ্লোরে সুয়ে পড়লো অন্যদিক হয়ে। শুধু বললো লাইট নিভিয়ে দিতে। কিন্তু তিতির লাইট নিভিয়ে না দিয়ে ওভাবেই বসে রইলো। অনেকক্ষন পর মাহাদের যখন কোন রেসপন্স পেলোনা তখন ও খাবার খেয়ে লাইট বন্ধ করে বেডে শুয়ে পড়লো। কিন্তু ঘুম আসেনা তার। তাই বালিশ নিয়ে মাহাদের একদম বুকের ভিতর ঢুকে চোখ বন্ধ করলো। কিছুক্ষন পর সে যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে গেল তখন মাহাদ চোখ খুললো। দু'চোখ বেয়ে কয়েক ফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো। তারপর তিতিরের কপালে কিস করে নিজেই ওকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়লো।
♥
পরদিন সকালে,
আজ রুমকির ছেলে শিহাবের মুসলমানি। রুমকি তো কি বজ্জাত তার ৩গুন দুষ্ট তার ছেলে। এক জায়গায় স্থির হয়ে দাড়িয়ে থাকেনা। বাসায় মেহমানদের খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মোটামুটি সব আয়োজন শেষ। এদিকে সাদেরও মুসলমানি করা হবে আজ। শিহাব সাদের হাত ধরে এক জায়গায় বসে আছে। তারা তাদের নিজেদের মধ্য আলাপ আলোচনা করছে। আজ নাকি তাদের কাছে ওস্তাদ আসবে। ওস্তাদ ভাষাটি বাতাসি বড়মার কাছ থেকে শিখেছে তারা।
ওদিকে বাতাসি বিবি সবার সামনে কর্কশ ভাষায় বলে উঠলো-
~" ব্যাটাগো ভোন কাটবি তার জন্য এত্ত মানুষদের জানানোর কি দরকার? তার থাইকা এক কাম করলে হয়না! বিয়ার আগের দিন যেমন কন্যার গায়ে হলুদ হয় মানুষ দেখানোর লাইগা! হেই রকম কর তোরা। স্টেজ বানাইয়া সগ্গলের সামনে তোগো পুতদের ভোন মানুষদের দেখাইয়া দেখাইয়া কাট। নতুন নিয়ম চালু কর তোরা।"
~" মা দেখছো তোমার মায়ে কান্ড! কি বিশ্রী ভাষায় কথা বলে আত্বীয় স্বজনদের সামনে। আমার সম্মান আর রাখলোনা সে।"
আরে মার কথা বাদ দে তো? চল ওদিকটাই বলে রুপালি রুমকিকে নিয়ে অন্যদিকে গেল। সবই ঠিক ছিলো কিন্তু সমস্যা বাধলো রুমকির ছেলেকে নিয়ে। সে কিছুতেই মুসলমানি করবে না। হাউমাউ করে কেঁদে ফেললো ডাক্তারের সামনে। সম্রাট এসে ছেলেকে বুঝিয়ে বলল-
~" সবাইকে এটা করতে হয় বাবা।"
~" সবাইকে করতে হয়! আম্মু করেছে, তুমি করেছ? ঔ ডাক্তার আঙ্কেলও করেছে?"
ছেলের এমন কথা শুনে সম্রাট আর রুমকি সবার সামনে লজ্জা পেয়ে গেল। সম্রাট তো কোন কথায় বললোনা। একদম থ মেরে গেল।
শিহাবের কথা শুনে বাতাসি বিবি হাতে তালি দিয়ে বললো-
~" ভালা এক্কান প্রশ্ন করছু শিহাব। আমাগো কারো মুসলমানি করান লাগেনি। তয় অ্যার মনে হয় তোর মা করচে।"
এর মধ্য সাদ কে মুসলমানি করার জন্য অন্য রুমে পাঠানো হলো কিন্তু শিহাব তা দেখে ডুকরে কেঁদে উঠলো। সে কিছুতেই তার ইজ্জত খোয়া দিবেনা। ওর দাদা বার বার বলছে এটা সবাইকেই করতে হয় কিন্তু শিহাব কোন কথা শুনতেই নারাজ। শেষে ডাক্তারকে বলল-
~" আপনিও করেছেন?"
~" আরে বাবা হ্যাঁ, আমিও করেছি।"
~" আমি বিশ্বাস করিনা। তাহলে আঙ্কেল আপনারটাও আমাকে দেখান। দেখি আপনি সত্যি করেছেন কিনা!"
~" তোর ছেলের কথা শুনছিস সম্রাট! জন্মানোর পর থেকে আমাকে জ্বালাচ্ছে। আর এখন এসব কথা বলছে। এই ছেলের কাজ আমি করতে পারবোনা! এটা করতে নাকি আমারটাও তাকে দেখানো লাগবে। এটা কোন কথা হলো!"
সম্রাটের পরিচিত ডাক্তার এসেছে। ডাক্তারের কথা শুনে সম্রাট বিনয়ের সাথে বলল-
~" দেখ, ও ছোট মানুষ। ওর কথায় কিছু মনে করিস না।"
~" মনে আর কি করবো! মান ইজ্জতের কি কিছু বাঁকি রাখলো সে! তোর যদি কিছু না মনে হয় তাহলে রুমে গিয়ে তুই তোর নিজেরটা ছেলেকে দেখিয়ে বিশ্বাস করা। ওর মুসলমানি করতে হবে কি হবেনা!"
এদের তর্ক বিতর্কের মাঝে মাহাদের ফোন বেজে উঠলো। মাহাদ নাম্বার দেখে বেশ বিরক্ত হয়ে কল রিসিভ করতেই অপর দিক থেকে কন্ঠ ভেঁসে এলো-
~" শুনেছি তোর বউয়ের নাকি মাথায় প্রবলেম। তো সে যদি বেইজ্জতি হয়ে রাস্তায় মৃত অবস্থায় পড়ে থাকে তাহলে কি তোর ভালো লাগবে! আমার কিন্তু অতীত রের্কড আছে, মানুষের কলিজায় গিয়ে আঘাত করা।"