উপহার - পর্ব ০৫ - সুলতানা পারভীন - ধারাবাহিক গল্প


০৯!! 

কফিশপের দরজায় দাঁড়িয়ে মাইশার চিন্তিত মুখটা দেখছে ধ্রুব। সাদা সুতোর ভারি কাজ করা রয়েল ব্লু কালারের  একটা থ্রি পিছ জামা পড়নে মাইশার। সাদা আর রয়েল ব্লু কমবাইন্ড কালারের ওড়নাটা সুন্দর করে গায়ের উপরে টানা। সরু করে কালো কাজলের টান দেয়া চোখ জোড়া ভাসাভাসা হয়ে আছে। মনে হচ্ছে সবেমাত্র আকাশের সাথে অভিমান করে মেঘেরা বৃষ্টি হয়ে ঝড়ে পড়েছে। ধ্রুবর মনে হচ্ছে এই মূহুর্তে সে মাইশাকে দেখছে না। কোন এক মেঘপরীকে দেখছে। ভুল করে এই মেঘপরীটা পৃথিবীতে নেমে এসেছে। 

কতোক্ষণ দাঁড়িয়ে মাইশাকে দেখছে ধ্রুবর সেই হুঁশ নেই। এই কফিশপটা ধ্রুবর ভিষণ পছন্দ। কাঁচে ঘেরা চারপাশ। বাইরের সবটা বেশ পরিষ্কার দেখা যায়। এখানে বসে কতোদিন মাইশাকে দেখেছে সেটা মাইশা জানেও না। ভাবতেই ধ্রুবর ঠোঁটের কোণে বাঁকা একটা হাসি ফুটলো। এতোদিন অপেক্ষা করে সে তার মেঘপরীটাকে পাচ্ছে সেটাই তার পরম পাওয়া। তিনটা বছর অপেক্ষা করেছে। আরো নাহয় ছ'টা মাস অপেক্ষা করবে। অপেক্ষা করার কথা ভাবতেই ধ্রুবর মনে পড়লো মাইশা ওর জন্য বসে আছে। মাইশার মুখের দিকে তাকিয়ে বুকটা কেঁপে উঠলো এবার ধ্রুবর। কি হয়েছে তার মেঘপরীটার!

ধ্রুব গিয়ে মাইশার সামনাসামনি চেয়ারে বসলো। মাইশা মৃদু হেসে চুপ করে বসে রইলো। কি বলবে! 

-কেমন আছো?

-ভালো। আপনি?

-আমি তো খুব ভালো আছি---।

-------------------------------

-তা কেমন বৃষ্টি ঝড়লো ম্যাডাম?

-কখন?

-সেটা তো আপনি জানেন--। কখন মেঘেরা অভিমানের জল ঝড়িয়ে চোখ ফুলিয়ে চলে গেল--। কিসের এতো অভিমান মেঘপরীটার---?

মাইশা মাথা নিচু করে চিন্তা করতে লাগলো। এই লোকটা এমন কেন! সোজাসুজি না বলে ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করছে কেঁদেছে কেন! এই রে! কেঁদেছে বুঝে গেছে লোকটা! এখন কি জবাব দিবে!

-ভাবনার জগৎ থেকে একটু বাস্তবে আসবেন ম্যাডাম? লাঞ্চ করি কোথাও বসে?

-হুম?

-২টা বাজে। চলো লাঞ্চ করে বাসায় দিয়ে আসবো তোমাকে--।

-আপনার অফিস?

-আজকে আর কাজ নেই--। তাছাড়া পাশেই তো অফিস--। দরকার পড়লে কল করবে--।

-ওহ-----।

-কি হলো চলো? 

-এখানে লাঞ্চ? 

-হা হা হা------------।

-কি আশ্চর্য! পাগলের মতো হাসছেন কেন! আমি কি হাসার মতো কিছু বলেছি! নাকি জোকস শুনাচ্ছি! 

-ম্যাডাম! এই কলেজেই তো চার বছর পার করে দিলেন। অথচ এটা জানেনই না যে এই কফিশপটার পুরোটা কফিশপও না। পাশের ব্লকে আইসক্রিম পার্লার আছে। দোতলায় রেস্টুরেন্ট আছে--। জুস কর্নার আছে। মিনি ফুড হেভেন এটা--।

-আমার এতো রেস্টুরেন্টে ঘুরার শখ নেই------।

-সে তো দেখতেই পাচ্ছি--। তবে আমার সাথে থাকলে তো বিপদে পড়ে যাবেন দেখছি-। আমি ঘুরতেও ভালোবাসি-। খেতেও ভালোবাসি।

এই কথার পর মাইশা কি বলবে বুঝতে পারছে না। তাই চুপ করে রইলো। খাওয়ার ব্যাপারে ততটা সচেতন না হলেও ঘুরতে তো মাইশাও ভিষণ ভালোবাসে! কথা ছিল কারো হাত ধরে সমস্ত পছন্দের জায়গাগুলোয় ঘুরতে যাবে--।

-এই যে মিস ভাবনাবিদ! চলুন! বাকিটা খেতে খেতে ভাববেন না হয়। খিদেয় মরে যাচ্ছি আমি---।

-হুম। চলুন।

মাইশার পছন্দের খাবার অর্ডার করেছে ধ্রুব। প্রত্যেকটা খাবার মাইশার পছন্দের। ইভেন খাওয়া শেষে স্ট্রবেরি আইসক্রিম টাও! মাইশা আনমনে ভাবছে-এই মানুষটা ওর সব পছন্দগুলো জানলো কি করে! নাকি কাকতালীয়ভাবে এসব ধ্রুবরও পছন্দের!

-পছন্দের খাবার সামনে নিয়ে ধ্যানে বসতে শুধু তোমাকেই দেখলাম!

-আপনি কি করে-------?

-সেসব পরে জানলেও চলবে--। আপাতত চলো খেয়ে একটু কোথাও ঘুরে আসি--। বহুদিন কোথাও যাওয়া হয় না---।

-কোথায় যাবো?

-গিয়েই না হয় দেখো-? তাড়াতাড়ি শেষ করো খাবারটা---।

বহু দ্বিধা দ্বন্দ্ব মাথায় নিয়েও খাওয়ার চেষ্টা করছে মাইশা। ধ্রুবর সাথে যাওয়াটা কতোটা যুক্তিযুক্ত?

১০!! 

এই মূহুর্তে ধ্রুবর সাথে নদীর পাড়ে বসে আছে মাইশা। কি করবে, আসবে কিনা সেটা ভাবতে ভাবতেই শেষে ধ্রুবর সাথে আসার সিদ্ধান্তটা নিয়েছে মাইশা। দুদিন বাদে না হোক ছ'মাস বাদে তো এই মানুষটার সাথেই সংসার করতে হবে ওকে। এখন যদি ভরসা করে কোথাও একটা যেতেই না পরে, তবে বিয়ের পরে থাকবেই বা কেমন করে মানুষটার সাথে! অস্বস্তি নিয়ে তো আর সংসার করা যায় না! আর ভরসা-বিশ্বাস-কমফোর্ট-এসব না গড়ে উঠলে সংসার নামের জার্নিটায় কতদিনই বা একসাথে চলতে পারবে দুটো মানুষ!

নদীর পাড়ে বড় গাছের ছায়ায়  পাপোশ টাইপের ঘাসের উপরে কাগজ বিছিয়ে দিয়েছে ধ্রুব। সেখানে বসে বসেই নদীর ছোট বড় ঢেউগুলো দেখছে মাইশা। বাতাসে চুলগুলো বারবার এলোমেলো করে দিচ্ছে ওর। ব্যাপারটা খানিকটা বিরক্তিকর। তাই চোখ মুখ ভ্রু একটু পর পর কুঁচকে বিরক্তিটা প্রকাশ হচ্ছে অনিচ্ছাতেও। তার উপরে থ্রি-পিস জামাটাও সমান তালে বিরক্ত করে যাচ্ছে ওকে। মাইশা ভাবছে কেন যে এই বাতাসটা বইছে আজকে! 

এদিকে পাশে বসে থেকে মাইশার বিরক্ত হওয়া মুখটা দেখছে ধ্রুব। মেয়েটা একটুতেই বিরক্ত হয়ে যায়। আর বিরক্ত হলে ভ্রু জোড়া যেন নিজের জোরেই কুঁচকে বিরক্তিটার মাত্রা বুঝিয়ে দেয় সামনে থাকা মানুষটাকে। ধ্রুবর সামনে জামা চুল এসবের উড়াউড়ির কারণেই বোধহয় মেয়েটা আরো বেশি অস্বস্তি বোধ করছে। তবে মাইশার খোলা চুলগুলো এসে যখন ধ্রুবর চোখ মুখের উপর এসে পড়ছে তখন অন্য রকমই একটা অনুভূতি কাজ করছে ধ্রুবর। মিষ্টি মিষ্টি একটা ঘ্রাণ এসে লাগছে ধ্রুবর নাকে। এই স্মেলটা ওর ভিষণ ভালো লাগছে। নেশা ধরানো ঘ্রাণ।চোখ বুজে সেই মিষ্টি ঘ্রাণটাই উপভোগ করছে সে চুপচাপ।

চুলগুলো কিছুতেই সামলাতে না পেরে আরো বেশি বিরক্ত হয়েই ধ্রুবর দিকে তাকালো মাইশা। এখানে আর বসে থাকতে ইচ্ছে করছে না। ক'টা বাজে! ৪ টা তো বোধহয়! ফিরতে দেরি হয়ে গেলে বাসায়ও চিন্তা করবে মা বাবা দুজনেই। যদিও বলে এসেছে ধ্রুবর সাথে দেখা করবে আজকে....। তবুও-----। এসব ভাবতে ভাবতেই ধ্রুবর মুখের দিকে চোখ পড়লো মাইশার। ধ্রুব চুপ করে চোখ বুজে বসে আছে। ওকে এভাবে দেখে ধাক্কা মতন খেল মাইশা। মাইশার খোলা কয়েকটা চুল বারবার উড়ে গিয়ে ধ্রুবর মুখের উপর পড়ছে। আর তাতেই ওর ঠোঁটের কোণে একটা বাঁকা হাসি ফুটে উঠছে। 

ধ্রুবর মুখটা দেখতে দেখতে মাইশার চোখটা ঝাপসা হয়ে আসছে। মানুষটা কোন কথা না বলেও কেমন করে যেন মাইশার জীবনে নিজের একটা জায়গা করে নিচ্ছে। কেন হচ্ছে এমনটা! এতোটা স্বার্থপরই বা মাইশা হচ্ছে কেমন করে! এমন হওয়ার তো কথা ছিল না! কথা ছিল মাইশার পাশে বসা থাকবে অন্য একটা মানুষ। তার হাতে হাত রেখে নদীর বুক চিরে নৌকায় করে ঘুরে বেড়াবে মাইশা। অথবা নদীর পাড়ে বসে দুজনে চুপচাপ একে অন্যকে অনুভব করবে। সে সমস্ত স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেছে মাইশার। মুখ ফুটে রাতুলকে যে কখনো বলাই হয়ে উঠে নি---। আজ এই মানুষটা কেন সবটা গোলমাল করে দিচ্ছে ওর!

একটু পরেই চোখ খুলে মাইশাকে দেখে লাজুক হাসল ধ্রুব। মাইশাও কি বলবে ভেবে না পেয়ে অন্য দিকে ফিরে গেল। কি হচ্ছে তার কিছুই মাথায় ঢুকছে না ওর আর।

-জায়গাটা আমার ভিষণ পছন্দ। আর তার উপরে তোমার এই নেশা ধরানো চুলের ঘ্রাণ-------।

কথাটা শুনেই চট করে ধ্রুবর মুখের দিকে তাকালো মাইশা। নদীর দিকে মুখ করে হাসছে ধ্রুব। 

-নৌকায় চড়বে মেঘপরী? মেঘপরীটাকে জলপরী রূপে কেমন লাগবে দেখতে ইচ্ছে করছে খুব---।

মাইশা একটু চুপ করে থেকে একটু পর আলতো করে সম্মতিসূচক মাথা দোলালো। লোকটাকে না বলতে ইচ্ছে করছে না। আর কিই বা হবে না করে!

-এই মামা! নৌকায় করে একটু ঘুরবো। কত নিবা?

-আপনারা একলা যাইবেন! নাকি মাঝি লাগবো?

-না মামা মাঝি নিবো সাথে। দাঁড় বাইতে পারবো না ---। 

-তাইলে ঘন্টায় দুইজনে ১০০ টাকা-।

-হায় হায় কি কও! একেবারে ১০০!

-মাঝিরেও তো  আলাদা কইরা টাকা দেওন লাগবো সার----।

-আচ্ছা-। চলো তাইলে? --- মাইশা এসো?

ধ্রুব আগে নৌকায় চড়ে মাইশার একটা হাত ধরে উঠতে সাহায্য করলো। দুজনে নৌকায় বসার পরেও ধ্রুব ওর হাতটা ছাড়ে নি। এমন একটা ভাব করছে যেন তার মনেই নেই যে হাতটা ধরে বসে আছে। মাইশাও আর কিছু না বলে ধ্রুবর কথা শুনছে। নদীর পাড়ে কোন কোন জায়গা আছে, তাতে কারা থাকে, কোথায় কি পাওয়া যায়, এসব নিয়ে কথা বলছে ধ্রুব। আর মাইশা শুনছে চুপ করে। লোকটার বকবকানি শুনতেও ভালো লাগছে। কেন হচ্ছে এমন? চিনে না জানে না এমন একটা মানুষ অধিকার নিয়ে ওর মধ্যে জেঁকে বসছে, আর সেটা ও নিজেও মেনে নিচ্ছে আনমনে! কেন?

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন