বন্ধন - পর্ব ০৯ - সুলতানা পারভীন - ধারাবাহিক গল্প


১৭!! 

তিনটা দিন মায়রার কাছে স্বপ্নের মতো কেটেছে। বিশেষ করে আয়ানদের বাগান বাড়িতে কাটানো শেষ রাতটা। সবাই ঘুমিয়ে গেলে আয়ান মায়রার রুম থেকে মায়রাকে ডেকে তুলেছে। মায়রা বের হতেই একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিয়েছে আয়ান। 'বাইরে অপেক্ষা করছি' বলে এক মিনিটও দাঁড়ায় নি আয়ান। মেয়েটার ঘুমকাতুরে মুখটা দেখলে ওর নেশা ধরে যায়। কখন নিজের মনের বাঁধটা ভেঙে যায় কে জানে! 

মায়রা আয়ানের দেয়া প্যাকেটটা নিয়ে রুমে এলো আবার। তিথি ঘুমিয়ে গেছে দেখে হালকা হাতে প্যাকেটটা খুলে দেখলো। অফ হোয়াইট কালারের একটা ফ্লোর টাচ গাউন, গোল্ডেন লেইস বসানো। আর সাথে সাদা স্টোনের ব্যাঙ্গেল, গোল্ডেন কালারের ভারি ঝুমকো, একটা কালো কাজল, স্টোনের গোল গোল রঙিন টিপের পাতা। সাথে একটা ছোট চিরকুট।

"ম্যাডাম একটু তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে উঠোনে আসুন। অপেক্ষায় আছি।"

মায়রা থতমত খেয়ে একবার গাউনটা দেখছে আর একবার অন্য জিনিসগুলো। গোল্ডেন কালারের রেশমি সুতোয় কাজ করায় গাউনটাকে রাজকীয় কোন পোশাক মনে হচ্ছে মায়রার কাছে। প্রতিবছর রমজানের ঈদে শুধু একটা করে সুতোর জামা ছাড়া আর কিছু কিনে দেয় নি মায়রাকে কেউ। তবুও ঈদের জামার টাকাটাও ওর টিউশনের বেতন থেকেই আসতো। কেউ অহেতুক ওর জন্য এতো দামি, এতো সুন্দর একটা ড্রেস আনবে বা পড়তে দিবে এটাই মায়রার বিশ্বাস হচ্ছে না। গতকালের পিংক কালারের থ্রি পিস জামাটার পর আজকের এই অফ হোয়াইট গাউনটা। সব কিছুই স্বপ্নের মতো লাগছে মায়রার কাছে। মনে হচ্ছে রূপকথার রাজ্য থেকে কোন এক রাজকুমার এসে ওর এতোদিনের বাজে স্বপ্নয় ভরা ঘুমটা ভাঙিয়েছে। ঘুম ভাঙিয়েই ভালোবাসা দিয়ে ওকে তার হৃদয়ের রাণী করে বরণ করে নিয়েছে। এটাও কি সত্যি!

মায়রা আরেকবার তিথির ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। গাউনটা পড়ে এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকেই যেন চিনতে পারছে না মায়রা৷ নিজেকে অন্য দিনের চেয়ে সত্যি অন্য রকম লাগছে। কি এক অদ্ভুত আভা খেলা করছে ওর মুখটায়। কিসের এই আভাটা! সুখে থাকলে আসলেই কি তা চোখে মুখে ফুটে উঠে? এসব ভাবতে ভাবতেই চোখে কালো করে কাজল দিয়ে আর কপালে ছোট্ট করে টিপ দিয়ে হাতে ব্যাঙ্গেল পড়লো মায়রা। তারপর চুলটা একটু পাফ করে ফুলিয়ে ফ্রেঞ্চ স্টাইলে চুল খোপায় জড়িয়ে নিলো। নিজেকে আরেক বার আয়নায় দেখে রুম থেকে বের হলো মায়রা৷ 

উঠোনে এসে কাউকে দেখতে পেল না মায়রা। কি মনে হতেই সামনের দিকে হাঁটতে শুরু করলো মায়রা। আর তখনই হাতে টান পড়লো। মায়রা পিছনে ঘুরে তাকাতেই আয়ান ওকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে বাগানের দিকে পা বাড়ালো। মায়রা অবাক হয়ে আয়ানের দিকে তাকিয়ে আয়ানের গলা পেঁচিয়ে ধরলো দুহাতে। আয়ান মায়রার দিকে এক নজর তাকিয়ে হাসলো। আয়ানকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে গোল্ডেন কাজ করা অফ হোয়াইট কালারের পাঞ্জাবিতে। ঠোঁটের কোণের হাসিটা লোকটাকে যেন আরো বেশি কিউট করে তুলেছে। আয়ান বাগানের একটু ভিতর দিকে এসে মায়রাকে নামিয়ে দিয়ে হাত ধরলো। মায়রা জাস্ট অবাক হয়ে আয়ানকে দেখছিল। আশেপাশে কি হচ্ছে তার হুঁশও নেই ওর। তাই আয়ান একটু টেনে ধরে মায়রার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো। 

-ম্যাডাম? আমাকে তো পরেও দেখতে পারবেন। এখন একটু ডেকোরেশনটাও দেখুন প্লিজ? কেমন লাগলো? পছন্দ হল ম্যাডামের? 

মায়রা লজ্জা পেয়ে হাসলো একটু। কিন্তু পাশে তাকাতেই চমকে গেল। বাগানের এই অংশটায় গাছের সাথে একটা দোলনা বাঁধা হয়েছে। সেই দোলনাটাকেও ফুলে ফুলে সাজানো হয়েছে। তারচেয়ে বড় কথা হলো দোলনার জায়গাটাকে ঘিরে ছোট্ট ছোট্ট মোমের প্রদীপ জ্বেলে লাভ শেইপটা বানানো হয়েছে। ডেকোরেশনটা দেখেই মায়রার চোখে পানি এসে গেল। খুব সুখের মূহুর্তগুলোয় ওর কেন যে এতো কান্না পায় কে জানে!

আয়ানও এতোক্ষণ একটা গাছে হেলান দিয়ে মায়রাকে দেখছিল। মেয়েটাকে একেবারে পরীর মতো লাগছে দেখতে। চাঁদের ফকাফকা আলোয় মায়রার চোখের কোণে পানি দেখেই আয়ানের বুকের ভিতরটা ধ্বক করে উঠলো। একটু এগিয়ে এসে মায়রাকে আলতো করে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রাখলো।

-মায়রু? কি হয়েছে? কাঁদছো কেন?

-না--হ। কা-কা-কাঁদছি না তো।

-নাক টানতে টানতে কথা বলছো। তাও বলবা কাঁদছি না?

-না মানে--। সত্যি--সত্যিই---। 

-জি জি। দেখছি আমি ম্যাডাম। কাঁদছেন কিনা। 

আয়ান মায়রাকে ছেড়ে নিজের দিকে ফিরিয়ে দিয়ে চোখ মুছে দিলো। তারপর আরেকবার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে হাত ধরে দোলনাটার কাছে আনলো। তারপর মায়রার কোমড় ধরে একটু উঁচু করে দোলনাটায় বসিয়ে দিলো। মায়রা লজ্জায় লাল হয়ে গেল। আয়ান সেটা দেখে হেসে দোলনাটা ধরে একটু টেনে পিছনে এনে সামনের দিকে ধাক্কা দিলো। দোলনাটা সামনের দিকে এগিয়ে যেতেই মায়রা হেসে উঠলো। উজ্জ্বল চাঁদের আলোয়, ঝিরিঝিরি বাতাসে বাগানের মাঝে দোলনায় দোল খেতে মায়রার ভিষণ মজা লাগছে। তার উপরে প্রদীপের লাভ শেইপটার উপর দিয়ে দোল খেতেও মজা লাগছে মায়রার। আয়ান হেসে মায়রার হাসির শব্দ শুনে নিজেও হেসে ফেলছে। 

বেশ অনেকক্ষণ দোল খাওয়া শেষ হলে আয়ান মায়রার দোলনার সামনে এসে দাঁড়ালো। মায়রা মুখ তুলে আয়ানের দিকে তাকালো। আয়ান হেসে মায়রার মুখটা দুহাতে তুলে ধরলো। 

-তোমার আদুরে চেহারাটা সেদিন দেখে আমি পুরো নিস্তব্ধ হয়ে তাকিয়েছিলাম জানো? এতো মায়া কেন তোমার এই মুখে বলতে পারো? 

-জি?

-তোমাকে আজ ঠিক কতোটা মায়াময়ী লাগছে সেটা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না লাজুক পরী। এই লজ্জা রাঙা মুখটা দেখলে কি আর নিজেকে সামলানো যায় বলো? তবু নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছি। কেন জানো? আর কিছুদিন পর তোমাকে নিজের করে পাবো বলে। তখন কিন্তু একটুও ছাড় দিবো না। একেবারে বুকের ভিতরে লুকিয়ে রাখবো। আর খুব করে আদরে ভরিয়ে রাখবো। রাগ করলেও শুনবো না কিন্তু----।

মায়রা লজ্জা পেয়ে নিচের দিকে তাকাতে গেলে আয়ান মায়রার মুখটা আবারো শক্ত করে ধরে নিজের চোখে চোখ রাখলো।

-মায়রা? তুমি কি আমার সমস্ত পাগলামির সঙ্গী হবে? যতটুকু ভালোবাসা যায় তারচেয়েও বেশি ভালোবাসতে চাই তোমাকে। সেই সুযোগটা দিবে প্লিজ? তোমার এই মায়াবী চোখ দুটোয় খুশির ঝিলিক দেখতে তোমার পাশে থাকতে চাই। তোমার আর আমার-দুজনের মনের সবগুলো ইচ্ছে পূরণের সময়গুলোতে পাশাপাশি হয়ে হাতে হাত ধরে চলতে চাই। একটা সূক্ষ্ম ভালোবাসার বন্ধনে তোমার সাথে বাঁধা থাকতে চাই। ভুল বুঝে, বা রাগ করেও যেন এই বন্ধনটা না ছিঁড়ে সেজন্য পাকাপাকি করে তোমাকে নিজের মধ্যে ডুবিয়ে নিতে চাই। তুমি কি আমার সাথে সেই পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হতে চাও মায়রা?

মায়রা কিছু বলার আগেই চোখের দু ফোঁটা পানি টুপ করে গড়িয়ে পড়লো। আয়ান একটু নিচু হয়ে ঝুঁকে মায়রার মুখে কান্নার বিন্দুগুলোতে চুমো খেল। তারপর মায়রার মুখটা বুকে চেপে ধরলো।

-খুব বেশি বিরক্ত করবো তোমাকে। কখনো ভালোবাসায়, কখনো আদরে, কখনো রাগিয়ে--তবুও সজ্ঞানে কক্খনো তোমাকে কাঁদাবো না পরী---। থাকতে পারবে বাকি জীবনটা এই পাগলটার সাথে? 

মায়রা আয়ানের বুকের ভিতরে থেকেই কোনমতে 'হ্যাঁ' শব্দটা বললো। হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে মায়রার। তাই অনেক কথা বলার থাকলেও কিছু বলতে পারলো না। এতো দিনের এতো অপমান, এতো অবহেলার পর এতো বেশি ভালোবাসা আসলেই ওর কপালে আছে-এই কথাটা কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না মায়রার। মায়ের সেদিনের বলা কথাগুলো ভিষণ কানে বাজছে মায়রার। 

'আজ ছেলেটা কিছু একটা করে দিয়ে আর বিয়ে না করলে! তখন এই পোড়ামুখী কাউকে মুখ দেখাবে কি করে! সেটা মাথায় থাকে না।'

মায়রা আয়ানের বুকে মুখ ডুবিয়ে ভাবছে। জীবনটা কি অদ্ভুত। সারাজীবন মা বাবার কাছে শুধু তুচ্ছতাচ্ছিল্যটাই ওর ভাগ্যে জুটেছে। সেটাও মায়রা শুধু মেয়ে বলেই। বাবার ভিষণ শখ ছিল তিয়াশের পর আরেকটা ছেলে হবে। তার নাম রাখা হবে তিশান। দুই ছেলের বাপ-কথাটা লোকের মুখে শুনে একটু গর্বে তার বুকের ছাতি আরেকটু চওড়া হবে। কিন্তু মায়রার জন্মের সময় ওর মায়ের প্রেগন্যান্সিতে কিছু একটা কমপ্লিকেশন হয়। আর তাতে করে মায়রার জন্মের পর আর কখন সন্তান নিতে পারেন নি মায়রার বাবা মা। তাই হয়তো আরেকটা ছেলের ক্ষোভ সবসময় মায়রার উপরেই পড়ে। তিয়াশ নাছোড়বান্দা টাইপের বাড়াবাড়ি না করলে হয়তো জীবনে স্কুল বা কলেজের মুখটাও কখনো দেখা হতো না মায়রার৷ 

কথাগুলো ভেবে মায়রা আয়ানের বুকে লুকিয়েও ফুঁপিয়ে উঠতে লাগলো বারবার। আসলেই জীবনটা অদ্ভুত। নয়তো এভাবে ধুম করে তিথি নামের মেয়েটা কি করে ওর জীবনে সুখপরী হয়ে এসে সমস্ত কষ্টটা দূর করে দেয়! এতো সুখ কি আসলেই ওর কপালে ছিল! অথবা আসলেই কি এটা শুধু সুখের স্বপ্ন না? বাস্তব! আসলেই কি এতোটা সুখ ওর ভবিষ্যতে লেখা আছে?

আয়ান একটু অপেক্ষা করে মায়রার মুখটা তুলে ধরলো। মায়রার ভেজা চোখ দেখে দু হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে চোখের পানিগুলো মুছে দিলো। একবার মুখের দিকে তাকিয়ে আলতো করে মায়রার ঠোঁটে ঠোঁট রাখলো। 

-তোমার কিসের এতো কষ্ট আমি জানি না মায়রা--। তবে তোমার সমস্ত কষ্ট, সমস্ত যন্ত্রণার বিষ আমি শুষে নিতে চাই তোমার শরীর থেকে-। তোমার শরীর জুড়ে থাকবে শুধু আমার ঠোঁটের আদর, আর তোমার ঠোঁটের কোণে থাকবে শুধু আমার নামের হাসি। আর কিচ্ছু যাতে তোমাকে কাঁদাতে না পারে সেই দায়িত্বটা আজ থেকে আজীবনের জন্য আমি নিলাম--। সেটা তুমি মানো বা না মানো----।

আয়ান মুখটা তুলে তাকাতেই মায়রা চমকে আয়ানের দিকে তাকালো। এই মানুষটার চোখে মুখে একটা ব্যথা স্পষ্ট ফুটে আছে। আর সেটাও মায়রার কান্না ভেজা মুখটা দেখেই। ব্যাপারটা ভিষণ ভালো লাগছে মায়রার। চোখের পানিরা বাঁধ ভাঙ্গলেও মায়রার ঠোঁটের কোণে মিষ্টি একটা হাসি ফিরে এলো। আর আয়ানের দিকে তাকিয়ে একটা কথাই মায়রার মনে উঁকি দিচ্ছে। 

"এতো সুখ ওর কপালে সইবে তো?"

১৮!! 

সকালে ঘুম ভাঙতেই চোখে সূর্যের তীব্র আলো এসে পড়লো মায়রার। কোনমতে চোখ খুলে বিছানায় উঠে বসলো। নিজের দিকে তাকিয়ে নিজেই হেসে ফেললো। অনেক রাতে আয়ানের সাথে কথা বলে রুমে এসেছে মায়রা। এসে ফ্লোরটাচ গাউনটা বদলে নিয়ে শুয়েই ঘুম। এখন উঠতেও বেশ বেলা হয়ে গেছে। হয়তো বকা খাবে ভিষণ। তবুও কথাটা চিন্তা করেও মায়রার একটুও ভয় লাগছে না আজকে। এই মানুষটার জন্য একটু বকা খাওয়াই যায়। সেটা ব্যাপার না। পাশে তিথিকে দেখতে পেল না মায়রা। তাই তাড়াতাড়ি উঠে ফ্রেশ হতে চলে গেল। রুমের ওয়াশরুমটায় হাত মুখ ধুয়ে এলো মায়রা। রুমে এসেই দেখলো আয়ান দাঁড়িয়ে আছে দরজার বাইরে। মায়রা একটু তাড়াহুড়ো করে দরজার সামনে এলো।

-ঘুম কেমন হলো মহারাণী?

-জি? ভালো---।

-এটা ধরো--। আমরা আজকে সন্ধ্যায় দিকে খাওয়া দাওয়া করে রওনা হবো। এটা পড়ো যাওয়ার সময়--। কেমন?

-কি আছে প্যাকেটে?

-একটা থোর পিস জামার সেট-। লাজুক পরীটাকে শাড়িতে দেখেছি, থ্রি পিসে দেখেছি, গাউন পড়া দেখলাম কাল--। আজ এই থোর পিস জামাটায় দেখবো। বাদ বাকি গুলোয় আস্তে আস্তে দেখা যাবে---।

---কখন নিলেন এসব? আপনিও তো জানতেন না আমি আসবো যে?

-নিয়েছি যে দুদিন তোমাকে দেখতে পাই নি তখন। ড্রেসগুলো দেখেই ভিষণ পছন্দ হয়ে গেল। আর তোমাকে কি করে দিব বুঝতে পারছিলাম না। বাগান বাড়িতে আসবে শুনে সব প্যাকিং করে নিয়েছি---।

-আপনি এতো পাগল কেন?

-নিজের মানুষের জন্য এইটুকু পাগল হওয়াই যায়----।

------------------------------

-মিস মায়রা? এখন চলুন? আজকে অনেক আড্ডা দিবো সবাই মিলে-------।

-হুম----।

রাতে খাওয়া দাওয়া শেষ হলে সবাই যে যার মতো রেডি হয়ে নিলো। আয়ান আর মায়রার বাবা মা আগের গাড়িতে চলে গেছে। এবারও ওরা চারজন একসাথে যাবে। মায়রা আয়ানের দেয়া থোর পিস জামাটা পড়েছে। কালো জর্জেটের কাপড়ে পিংক কালারের লেইসের কাজ করা, পাজামা আর ওড়নাটা কালো আর কটিটা পিংক কালারের। জামাটা বেশ পছন্দ হয়েছে মায়রার। জামার সাথে আয়ান একটা ফুলের ডিজাইন করা চেইন ব্রেসলেট, কালো স্টোনের লকেট আর কানের দুলও দিয়েছে। সেগুলোও পড়ে নিলো মায়রা। চোখে হালকা করে কাজল টেনে, কপালে গোলাপি রঙের একটা টিপ পড়ে নিলো মায়রা। তারপর চুলটা বেঁধে নিলো। মায়রার সাজ কমপ্লিট। 

মায়রা রেডি হয়ে বাইরে এসে দেখলো সবাই ওয়েট করছে। মায়রা আয়ানের পাশে গিয়ে বসতেই আয়ান এক পলক মায়রার দিকে তাকিয়ে হাসলো। গাঢ় গোলাপি রঙটা মায়রাকে ভিষণ মানিয়েছে। পিছনের সিট থেকে তিথি এটা ওটা নিয়ে মায়রার সাথে কথা বলছে। আর তিয়াশ চুপ করে তিথিকে দেখছে। আর তিথিও বকবকের ফাঁকে তিয়াশকে দেখছে আর মুচকি হাসছে। এ কয়টা দিন পাগলামি করেছে দুজনে। আর চলে যাওয়ার সময়টায় কথাও বলতে পারছে না। ব্যাপারটায় তিয়াশের ভিষণ খারাপ লাগছে। কিন্তু পিচ্চিটার কোন হুঁশই নেই সেদিকে। সে নিজের মতো মায়রার সাথে বকবক করেই চলেছে। তিয়াশ শেষ পর্যন্ত আর থাকতে না পেরে তিথির ডান হাতটা শক্ত করে ওর বাম হাত দিয়ে চেপে ধরলো। বেচারি তিথি মায়রার সাথে কথা বলছিলো তখন। তিয়াশের হাতের স্পর্শে খেই হারিয়ে তিয়াশের দিকে তাকালো। লোকটার চোখে মুখে কিসের একটা চাপা অভিমান খেলা করছে। তিথি সেই অভিমানের কারণটা ধরতে পারছে না। 

আয়ানও মায়রার দিকে একটু পর পর তাকাচ্ছে ড্রাইভিংয়ের ফাঁকে ফাঁকে। মেয়েটা এখন উদাস চোখে অন্ধকার দেখছে। মেয়েটার আবার কি মন খারাপ? কেন?

মায়রার অন্ধকার জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেও আয়ানের মুখটা জানালার কাঁচে যে প্রতিবিম্বটা ফেলছে সেটাই দেখছে। মানুষটাকে এভাবে কাল সকাল থেকে আর দেখতে পাবে কিনা কে জানে। গত তিনটা দিন ওর কাছে রূপকথার কোন গল্পের স্বপ্ন থেকে কম নয়। আজ বাড়ি ফিরলেই হয়তো স্বপ্নগুলো ভেঙে। এভাবে সামনে থেকে হয়তো মানুষটাকে দেখা হবে না। আয়ান আলতো করে মায়রার চুলে হাত দিয়ে মায়রার দিকে তাকালো।

-মায়রা?

-হুম?

মায়রা আয়ানের দিকে ফিরলো।

-মন খারাপ কেন পরী?

-নাহ--।

-পাগলিটা---। এখানে আমরা আবার আসবো। মন খারাপ করো না। কেমন?

-হুম----।

মায়রার সাথে কথা বলতে বলতেই পিছনের সিটের দিকে চোখ পড়লে আয়ান হেসে ফেললো। ইশারায় মায়রাকে পিছনে তাকাতে বললো। মায়রা পিছনের সিটে তাকিয়েই চমকে উঠলো। তিথি একেবারে গুটিশুটি হয়ে তিয়াশের বুকের কাছে সেধিয়ে ঘুমাচ্ছে। তিয়াশ একটু পর পর তিথির মাথাটাকে নিজের কাঁধে রাখছে। আর একটু পরেই তিথির মাথাটা একেবারে তিয়াশের বুকে এসে পড়ছে। মায়রা থতমত খেয়ে একবার ভাইয়াকে আর একবার আয়ানকে দেখছে। আয়ান হাসছে তখনো। 

-তিয়াশ ভাইয়া? পিচ্চিটা ঘুমিয়ে গেছে? এই কয়টা দিন আপনাকে ভিষণ জ্বালিয়েছে তাই না? সরি ভাই--।

-আরে না না---। কি বলেন ভাইয়া?

-সামনে আরো জ্বালাবে। রেডি থাকবেন কিন্তু-। হা হা-। তবে সম্ভবত ও একমাত্র আপনার কাছেই নাস্তানাবুদ হয়েছে----।

তিয়াশ কিছু না বলে হাসলো। মায়রা অবাক হয়ে আয়ানকে দেখছে। এই লোকটার বোন তিয়াশের বুকে ঘুমাচ্ছে, সেদিকে কি তার একটুও খেয়াল নেই। তিয়াশ একবার মায়রার দিকে তাকিয়ে বাইরের দিকে তাকালো। তিথির মাথাটা আবার ওর বুকে এলিয়ে পড়েছে। এবার আর সেটা ঠিক না করে তিয়াশ তিথির কোমড় পেঁচিয়ে ধরে রইলো। পিচ্চিটাকে সেদিনের মতো বুকে চেপে ধরতে ইচ্ছে করছে তিয়াশের। কিন্তু সেটা করতে পারছে না বলে প্রচন্ড খারাপ লাগছে। মেয়েটা ওর এতো কাছে আছে অথচ ওর কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে আদর করতে পারছে না তিয়াশ। অথচ খুব করে ইচ্ছে করছে পাগলিটাকে একটু ছুঁয়ে দিতে। 

বেশ অনেকটা সময় পর তিথির ঘুম ভাঙলো আয়ানের ডাকে।

-তিথি? উঠ না? রুমে গিয়ে ঘুমা না বাবা যা--। এই তিথি?

-হুম?

তিথি চমকে উঠে আশেপাশে তাকালো। মায়রাও নেই, তিয়াশও নেই। 

-ভাইয়া? আমরা চলে এসেছি?

-তো? সারা রাস্তা পড়ে পড়ে ঘুমিয়ে এখন জিজ্ঞেস করছিস-----।

-ভাবিরা চলে গেছে?

-হুম---। মায়রা আর তিয়াশকে ড্রপ করে দিয়ে তারপর না বাসায় এলাম--। এখন নাম না? গাড়ি গ্যারেজে-----।

-তুই একটা অসভ্য, বেয়াদপ--। ভিষণ খারাপ তুই---। তোর সাথে আড়ি আড়ি আড়ি----।

-কি রে বাবা! আমি কি করলাম!

তিথি রাগে আয়ানকে আরো বকতে বকতে বাসায় গিয়ে ঢুকলো। আয়ানের উপরে প্রচন্ড রাগ হচ্ছে তিথির। সাথে তিয়াশের উপরেও। লোকটার সাথে যোগাযোগটা করবে কি করে এখন! ইচ্ছে করছে দুজনকেই মাইর দিতে। রাগের চোটে তিথি ঠিল করতে পারছে না এখন কি করবে। তিয়াশের সাথে যোগাযোগ করবে কি করে!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন