১৭!!
-বাহ! বিয়ে হচ্ছে একজনের সাথে, আর একজন এতো রাতে তোমাকে বাসায় ড্রপ করে দিয়ে যাচ্ছে! অসাধারণ দৃশ্য বলতেই হয়।
রাহাত একেবারে বাসার সামনেই মায়াকে নামিয়ে দিয়ে গেছে। যদিও মায়া বারবার বারণ করছিল। কিন্তু রাহাত মায়ার কোনো কথাই শোনো নি। গলির সামনে থেকে মায়াদের বাসা পর্যন্ত ওই অন্ধকার রাস্তাটুকু মায়া একা একা পার করবে সেটা কিছুতেই মানে নি রাহাত। রাহাতকে বিদায় জানিয়ে ঘড়িতে সময় দেখতে দেখতে বাসায় ঢুকেছে মায়া। একে তো রাত নয়টার মতো বাজছে, তার উপরে বাসার দরজাটা খোলা দেখে মায়া কিছুটা অবাকই হলো। মাকে খুঁজতে তাদের ছোট্ট ড্রইংরুমটায় পা রেখেই কারো কথাগুলো শুনে রীতিমতো চমকে গেল মায়া। সোফায় বসা দ্বীপের ঠোঁটের কোণের বাঁকা হাসিটা দেখে মায়া ভ্রু কুঁচকে তাকালো। এই লোকটা এতো রাতে ওদের বাসায় কি করছে সেটাই মায়া বুঝতে পারছে না। মায়া এমন অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে দেখে দ্বীপ নিজেই উঠে মায়ার একদম সামনে এসে দাঁড়ালো।
-মিস মায়াবতী? স্যারের সাথে তো বেশ অনেকটা সময় কাটালেন। তা উনি কি আশ্বাস দিলেন জানতে পারি? না মানে? উনি কি এবারে রাজি হয়েছেন আপনাকে বিয়ে করতে? অবশ্য একবার ফুলের মধু খাওয়া হয়ে গেলে ভ্রমর কি আর সেই ফুলে বসে বলুন?
-মুখ সামলে কথা বলুন মিস্টার দ্বীপ। কি যা তা বলছেন আপনি?
-হা হা হা। আমি যা তা বলছি? সিরিয়াসলি? তা তুমি রাহাতের কাছে যাও নি আজ বিকেলে? তার হাতে পায়ে ধরে বিয়েটা করার অনুরোধ করো নি তাকে? তাকেও তো দেখলাম একেবারে তোমার হাত ধরে সবার সামনে দিয়ে তোমাকে নিয়ে বেরিয়ে যেতে। তা কোথায় গিয়েছিলে বলো তো? সময়টা নিশ্চয়ই দারুণ কেটেছে তোমাদের----।
-ছি! আপনার মতো লোকের পক্ষেই এমন নোংরা গল্প বানানো সম্ভব। একটা মেয়ে কি শুধু বসের কাছে তার শরীর বিলাতেই যায়? নাকি আপনিও এমন করেন নিজের জুনিয়র লেডি স্টাফদের সাথে?
-ওহ শাট আপ! আলোচনা তো তোমার ক্যারেক্টার নিয়ে হচ্ছে। আমার ক্যারেক্টার নিয়ে না। তাছাড়া ওয়ার্ক প্লেসে আমার ক্যারেক্টার অন্তত তোমারটার চেয়ে ক্লিন আছে। তা কি করতে গেছ রাহাতের কাছে বললে না তো?
-রেজিগনেশন দিতে গিয়েছিলাম। শুনেছেন আপনি? এখন বেরিয়ে যান আমাদের বাসা থেকে---। আর কক্খনো আপনার মুখটা যেন না দেখি আমি--। গেট আউট গেট আউট গেট আউট।
-আরে? এতো চিৎকার করছ কেন? আর বাহ! তোমার টাইমিং সেন্স তো ভিষণ ভালো! একটা রেজিগনেশন দিতে গিয়ে ৪-সাড়ে ৪ ঘন্টা সময় লাগে?! তার উপরে কোথায় গিয়ে রেজিগনেশনটা জমা দিয়েছ কে জানে!
-গেট আউট মিস্টার দ্বীপ। আমি কি করব, কি করেছি সেটার ব্যাখ্যা আমার আপনাকে দেয়ার প্রয়োজন নেই।
-প্রয়োজন আছে কি নেই সেটা তোমার মাকেই নাহয় জিজ্ঞেস করে নিও। উনিই সবটা বলবে তোমাকে। অবশ্য রেজিগনেশন দিয়ে ভালোই করেছ। তোমার জানের জান রাহাত স্যার আবার আজকাল নতুন পি. এ মিস লিজার সাথে যা শুরু করেছে সেটা তোমার সহ্যও হতো না অফিসে থাকলে। গাছেরও খাবে, আবার তলার কুড়োবে-এসব দেখলে সহ্য হবে কি করে বলো?
-উনি কি করছে আমি জানতে চাইও না। তবে যা ই করুক সেটা আপনার মতো নোংরা মানসিকতার লোকের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়।
-আহা! এখনো কি প্রেম! করে নাও, করে নাও। আগামী দুই সপ্তাহ পর সেই আমার ঘরেই তো আসবে। তখন এই তেজের হিসেব সুদে আসলেই নাহয় উসুল করবো। নো প্রবলেম। আগামী দুই সপ্তাহ নিজের ইচ্ছে মতো উড়ে নাও। আই উইল ওয়েট ফর ইউ মাই বিউটিফুল লেডি।
-গেট লস্ট।
-ওকে ম্যাম। আপনার মা একটু বাইরে গেছে। ফিরলে উনাকেই নাহয় জিজ্ঞেস করবেন। বায় ম্যাডাম। সি ইউ সুন।
দ্বীপ বাসা থেকে বের হচ্ছে এমন সময় মায়ার মা বাসায় ঢুকলেন। দ্বীপ একটু হেসে উনার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে সোজা হয়ে দাঁড়ালো।
-মা, মায়া চলে এসেছে। আপনি আর টেনশন করবেন না। আমিও এখন তাহলে আসি? আপনারা একটু সাবধানে থাকবেন।
-রাতের খাবারটা আমাদের সাথে খেয়ে যাও বাবা। আমার রান্না প্রায় হয়ে গেছে। তুমি আর কিছুক্ষণ---।
-না মা। আজ না। একেবারে জামাই হয়ে এসেই নাহয় অধিকার নিয়ে আপনার হাতের রান্না মুখে তুলবো। আজ আসি মা? অনেক দেরি হয়ে যাবো বাড়ি ফিরতে।
-আচ্ছা বাবা। সাবধানে যেও।
-জি মা।
দ্বীপ বেরিয়ে যেতেই মায়ার মা বাসায় ঢুকে মেয়েকে দেখে এগিয়ে এসে মায়ার মাথায় হাত ছুঁইয়ে দিলেন।
-কি রে মা? এতো দেরি হলো যে ফিরতে? রাহাত কিছু বললো?
-না মা। কিন্তু উনি এখানে কি করছে?
-দ্বীপের বাবা মা এসেছিল বিকেলে। তোকে তো কত কল দিলাম। তুই তো ফোনটা রিসিভও করলি না। তোর মামা ছেলেটার সম্পর্কে সব খোঁজ খবর নিয়ে দেখেছে। ছেলেটা ভালোই। আর ওর ফ্যামেলির সবাইও অনেক ভালো। উনাদের বাসার আশেপাশের কেউই উনাদের নামে খারাপ কিছুই বলে নি---। তাই সবাই বলছে তোর বিয়েটা---।
-মা?
-দেখ মায়া? রাহাত ছেলেটাও ভালো। কিন্তু ও যদি তোকে বিয়ে করতে রাজি হত তাহলে আমি এখনও তোর মুখের দিকে তাকিয়ে নাহয় রাজি হয়ে যাবো। কিন্তু ও কি তোকে বিয়ে করতে রাজি আছে?
-না মা। কিন্তু তাই বলে এতো তাড়াহুড়ো করার কি----?
-মায়া দেখ। ওইদিনের পর এলাকায় অনেকে এসব নিয়ে অনেক আজেবাজে কথা বলছে মা। সব জানার পরেও দ্বীপ যে তোকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে সেটাই আশ্চর্যের কথা। মা আমার। তুই রাজি হয়ে যা। আমার এই কথাটা রাখ? তোর বিয়েটা দিয়ে আমি গ্রামের বাড়িতেই চলে যাবো। সেখানেই নাহয় বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিবো। তুই রাজি হয়ে যা মা? লক্ষী মা আমার।
-ঠিক আছে মা। তোমার যা ভালো মনে হয় করো।
মায়া মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আর না করতে পারলো না। কোনমতে মায়ের সামনে থেকে নিজের রুমে চলে গেল। রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে ফ্লোরে বসে বিছানায় মুখ চেপে কাঁদতে শুরু করলো। জীবনটা কেন ওর সাথে খেলায় মেতেছে কে জানে! দ্বীপ এমন একজন মানুষ যাকে মায়া কখনো মন থেকে হয়তো সম্মান করতে পারবে না। অন্তত আজকে লোকটার কথাগুলো শোনার পর তো লোকটার জন্য ঘৃণা ছাড়া আর কোনো ফিলিংসই নেই মায়ার মনে। আর অন্যদিকে রাহাত। আজ রাহাতের মুখ থেকে তার জীবনের সব ঘটনা শোনার আগ পর্যন্ত মানুষটাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখার অধিকারটুকু ওর ছিল। কিন্তু এখন? তার জীবনে মায়া নামের কারো অস্তিত্বই কখনো ছিল না সেটা জানার পর কোন অধিকারে তার কথা ভাববে মায়া? আর সেই মানুষটাও যে গত পাঁচটা বছর ধরে যে যন্ত্রণা সহ্য করে একজনকে মনে প্রাণে ঘৃণা করে আসছে সেই ঘটনাটার পিছনের আসল সত্যটাই বা তার সামনে কি করে তুলে ধরবে?
মায়া আরো কিছুক্ষণ এভাবে বিছানায় মুখ গুঁজে কান্নাকাটি করার পর মুখ মুছে নিয়ে নিজের মোবাইলটা নিয়ে কারো একটা নাম্বার ডায়াল করলো। ওর নিজের জীবনে কি হবে সেটা মায়া আর ভাবছে না। অন্তত মানুষটাকে এভাবে তিলে তিলে শেষ হওয়ার যন্ত্রণা দেয়া থেকে অন্তত মুক্তি দেয়ার চেষ্টা করতে পারে মায়া। সেই মানুষটার জীবন থেকে এই অতীতের ধাঁধাটার জবাব খুঁজে বের করতে পারলে মানুষটার কষ্টগুলো যদি কিছুটা লাঘন হয় তাতেই নাহয় মায়া নিজের সুখ খুঁজে নিবে। মায়া কথাগুলো ভাবতে ভাবতে কল করছিল কাউকে। কলটা রিসিভ হতেই মায়া মোবাইলটা কানে লাগালো।
-হ্যালো ভাইয়া? দিয়া আপুর নাম্বারটা আমাকে একটু টেক্সট কর না প্লিজ? হ্যাঁ হ্যাঁ। আপুর সাথে আমার কিছু কথা আছে। আরে বাবা! সব কথা তোকে বলতে হবে নাকি? তাড়াতাড়ি নাম্বারটা দে। রাখছি। ওকে বায়।
মায়া কলটা কেটে দেয়ার সাথে সাথে একটা মেসেজ এলো মোবাইলে। এতো তাড়াতাড়ি কি করে টেক্সট করেছে কথাটা ভেবে মোবাইলটা হাতে নিয়েই মায়ার আবার কাঁদতে ইচ্ছে হলো। অল্প কয়েকটা শব্দের একটা মেসেজ।
"বাসায় সব ঠিক আছে মায়াবতী? আন্টিকে আমার হয়ে সরি বলে দিও। এতোটা দেরি হবে ফিরতে আমি বুঝতেই পারি নি।"
মেসেজটা দেখে যতটা না কান্না পাচ্ছে ততটাই মাথায় জেদ চেপে গেছে মায়ার। একদিকে লোকটা ওর জন্য নিজের সব আবেগ তালাবদ্ধ করে রেখেছে। অন্যদিকে কিছু হলে ব্যাকুল হয়ে উঠছে, খোঁজ নিচ্ছে। কি চায় কি এই লোকটা? মায়া রাগে একবার ভাবলো মেসেজের রিপ্লাই করবে না। পরে আবার কি মনে হতে একটা রিপ্লাই দিয়ে মোবাইলটা বিছানার উপরে ফেলে আবার হাঁটুতে মুখ গুঁজে চুপচাপ বসে রইলো। রাহাতকে করা মায়ার রিপ্লাইটা ছিল-
"মা আপনাকে একটা খুশির খবর দিতে বললো স্যার। দু সপ্তাহ পরেই দ্বীপ স্যারের সাথে উনি আমার বিয়েটা ফিক্সড করেছেন। আপনি কিন্তু অবশ্যই বড় স্যারকে নিয়ে আসবেন। কার্ড রেডি হয়ে গেলেই অফিসে পাঠিয়ে দিবো।"
এদিকে বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে মোবাইল হাতে নিয়ে রাহাত চিন্তা করছিল মায়ার কথা। অনেকটাই দেরি হয়ে গেছে আজ মায়ার বাসায় ফিরতে। ওর মা ও নিশ্চয়ই ব্যাপারটা নিয়ে বকাবকি করবে অনেক। কয়েকবার কল করতে গিয়েও কেটে দিলো রাহাত। পরে কি চিন্তা করে একটা মেসেজ করলো মায়ার নাম্বারে। মায়া মেসেজটার রিপ্লাই দিবে কিনা সেটাও জানে না রাহাত। তবু মোবাইলটা হাতে নিয়েই বসে ছিল। মেসেজের টুং শব্দটা শুনে অজান্তেই এক চিলতে হাসি ফুটে উঠেছিল রাহাতের ঠোঁটের কোণে। কিন্তু মেসেজটা পড়েই সেই হাসিটা নিমিষেই মিলিয়ে গেল। মোবাইলটা হাতে নিয়ে থ হয়ে বসে রইলো রাহাত। এতো নিষ্ঠুরভাবে রিপ্লাই পাবে মায়ার কাছ থেকে কথাটা স্বপ্নেও ভাবতে পারে নি রাহাত। দু সপ্তাহ পর মায়ার বিয়ে কথাটা একদম বুকে গিয়ে লাগছে রাহাতের। কিন্তু কারণটা বুঝতে পারলো না রাহাত। শুধু ফ্যালফ্যাল হয়ে মোবাইলের স্ক্রিনে ভেসে থাকা শব্দগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলো এক দৃষ্টিতে। প্রতেকটা শব্দ যেন ছাড়পোকার মতো সূক্ষ্ম কামড় বসাচ্ছে রাহাতের বুকের ভিতরে। এই অসহনীয় ব্যথাটার রহস্যও রাহাত বুঝতে পারলো না।
১৮!!
দেখতে দেখতে একটা সপ্তাহ কেটে গেছে। এই সাতটা দিন রাহাত প্রায় ঘরবন্দী হয়েই কেটেছে। নয়না ভয়ে ভয়ে রাহাতের ঘরে খাবার রেখে যাচ্ছে প্রতিবেলাতেই। কখনো রাহাত সেই খাবার একটুখানি খাচ্ছে, আবার কখনো প্লেটের ঢাকনা খুলেও দেখছে না। গত পাঁচ বছরে যে অনুভূতিটা রাহাতের হয়নি সেটা এই সাত দিনে হয়েছে। সেদিন মায়াকে বাসায় ড্রপ করে ফিরে আসার পর থেকে একটা রাতও রাহাত দু চোখের পাতা এক করতে পারে নি। চোখ বুজলেই একটা মিষ্টি হাসির শব্দ কানে এসে বাজে রাহাতের। মনে হয় ওর আশেপাশেই কেউ হাঁটছে, ওকে ছুঁয়ে দিচ্ছে। কিন্তু চোখ খুলে কাউকে আর দেখতে পায় না রাহাত। স্পর্শগুলো ভিষণ পরিচিত মনে হয় রাহাতের কাছে, মানুষটার শরীরের মিষ্টি মাতাল করা গন্ধটাও যেন রাহাতের জীবনে তার অস্তিত্বের কথাটা জানান দেয় প্রতিরাতে। কিন্তু রাহাত ধরতে পারে না এটা স্মৃতি, নাকি তার মায়াবতী। কিসের এক দ্বিধাদ্বন্দের মাঝে দুজনকেই গুলিয়ে ফেলছে রাহাত। শুধু মানুষটা একবার সামনে এসে ওর দ্বিধাটা দূর করে না।
আজ রাতেও এর ব্যতিক্রম হলো না। সারাদিনের ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসতে চায় রাহাতের। কিন্তু মস্তিষ্কের যেন ছুটি নেই। সে নিজের সাথে যুদ্ধ করে চলেছে। যুদ্ধটা স্মৃতিকে মনে প্রাণে নিজের মাঝে আগলে রাখার নাকি মায়ার দূর চলে যাওয়ার আগেই আটকানোর সেটাই বুঝতে পারে না রাহাত। এই সাতটা দিনে হাজারবার মায়াকে কল করার ভেবেছে রাহাত। কিন্তু পরক্ষণেই আবার নিজের ভাবনার গহীনে ডুবে গেছে। মনটা বেহায়ার মতো মায়াবতীর মায়াতে ধরা দিতে গিয়েও কোন এক অদৃশ্য টানে ফিরে আসে বারবার। এই টানটাকে যেমন অগ্রাহ্য করতে পারে না রাহাত, তেমনি মায়ার দিকে মনের ছোটাও আটকাতে পারে না। মন আর দ্বিধার এই যুদ্ধে ক্লান্ত রাহাত আবার চোখ বুজে কারো উপস্থিতি অনুভব করার অপেক্ষায় থাকে। একটু পরেই কারো পা টিপে ধীর পায়ে হাঁটার শব্দ আসে রাহাতের কানে। আজ আর রাহাত চোখ মেলে তার পালানোর সুযোগ করে দেয় না। আজ তার কাছেই নিজের এই দ্বন্দ্বের মুক্তি চাইবে রাহাত। এভাবে দোটানা নিয়ে থাকা কয়দিন চলবে?
-আজ কেউ বুঝি খুব অভিমান করে আছে? চোখ মেলে আমাকে একটা বার দেখতেও চায় না?
অভিমানী কণ্ঠটা শুনে রাহাত নিজের মনেই হাসলো। এই উপস্থিতিটা রাহাত অনুভব করতে পারে ঠিকই, তবু এই অভিমানী অদৃশ্যের মান ভাঙানোর কথা ভাবতেই নিজেরই হাসি পেল রাহাতের। যাকে ছোঁয়া যায় না, দেখা যায় না, যার মিষ্টি গন্ধটাই শুধু নাকে এসে লাগে, তার অভিমান কি করেই বা ভাঙাবে?
-বুঝেছি বুঝেছি। এখন তো আর আমার জায়গা হবে না কারো মনের কোণে। সেখানে তো অন্য কেউ এসে বাসা বেঁধেছে। আসবই না আর আমি।
-তুমি তো আসতে চাওই না। চাইলে এভাবে হুটহাট পালিয়ে বেড়াতে না আমার থেকে।
-আহা! আসবো কেন? আমি তোমার উপরে কতো রাগ সেটা কি তুমি জানো? আসবো কেন তাহলে?
-রাগ! কি করেছি আমি?
-তুমি জানো তোমার জন্য ও কত কাঁদছে? মেয়েটাকে এতো কাঁদাচ্ছ কেন তুমি? আগে তো এতো খারাপ ছিলে না তুমি রাহাত।
-কে কাঁদছে? কাকে কাঁদিয়েছি আমি?
-তুমিই বলো। আমি একটু মন খারাপ করলেও তো তুমি কত ব্যস্ত হয়ে পড়তে আমার মনটা ভালো করার জন্য। এখন এমন চুপ করে কি করে বসে আছো? মেয়েটাকে এতো কাঁদতে দেখেও কি করে চুপ করে থাকতে পারছ তুমি বলো তো রাহাত?
-কে কাঁদছে মায়া?
রাহাতের কথাটা শেষ হতেই একটা খিলখিল হাসি ঝুম বৃষ্টির মতো ঝমঝম করে কানের কাছে বেজে উঠলো রাহাতের। রাহাত চোখ বুজে থেকেও যেন পরিচিত মুখটা দেখতে পেল। ধবধবে সাদা শাড়ি পড়নে মেয়েটার, দীঘল কালো চুলগুলো রাতের অন্ধকারেও যেন ঝলমল করছে। মেয়েটা খিলখিলিয়ে হাসতে হাসতে রাহাতের পাশে এসে রাহাতের বুকে হেলান দিয়ে বসে পড়লো। শীতল একটা ছোঁয়া রাহাতের গায়ে এসে লাগায় পাশের অদৃশ্য মানুষটাকে আলতো হাতে নিজের সাথে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করলো রাহাত। সে আরো নিবিড় হয়ে রাহাতের বুকে মুখ গুঁজে হেসেই চলেছে। এ হাসি যেন এই জগতের নয়। রাহাতের মনে হচ্ছে অন্য কোনো এক জগৎ থেকে কেউ যেন হাসছে ওর বুকে মুখ লুকিয়ে।
-কেন এভাবে হারিয়ে গেলে স্মৃতি? আমি তো তোমাকে নিয়েই ভালো থাকতে চেয়েছিলাম। ফিরে এসো না প্লিজ? আই ওয়ান্ট ইউ। প্লিজ কাম ব্যাক টু মি।
-তোমাকে ফেলে এভাবে চলে যেতে হবে ভাবতে পারি নি আমিও। কিন্তু কি করবো বলো? ডাক পড়েছিল যে। যেতে তো হতোই। তাই বলে এভাবে পাগলামি করলে চলে? দেখছ না তোমার মায়ায় আমি আটকা পড়ে গেছি? আমাকে এভাবে আটকে রেখে কষ্ট দিচ্ছ কেন এতো?
-আমি কষ্ট দিচ্ছি তোমাকে স্মৃতি? কথাটা বলতে পারলে তুমি?
-দিচ্ছই তো। আমাকে কষ্ট দিচ্ছ, নিজেকে কষ্ট দিচ্ছ। আর সাথে তোমার মায়াবতীটাকেও কষ্ট দিচ্ছ। ও তো তোমাকে ভালো রাখতেই চায় রাহাত। ওকে কেন একটা সুযোগ দিচ্ছ না তুমি?
-আমিও তো তোমাকে ভালো রাখতে, ভালো বাসতে চাই স্মৃতি? তুমিও তো আমাকে সেই সুযোগটা দাও না। কেন বলতে পারো?
-তুমি সুখে থাকলেই আমার সুখ। তাতেই আমি ভালো থাকবো।
-উঁহু। আমার তোমাকে চাই স্মৃতি। ফিরে এসো না প্লিজ?
-যে গেছে সে ফিরবে না রাহাত। কিন্তু যে আছে তাকেও যদি না আটকাও তাহলে সেও হয়তো এতো দূরে চলে যাবে যে----। আর হয়তো সেও ফিরবে না রাহাত। আমার এই কথাটা রাখো প্লিজ? তাকে আটকাও রাহাত। আমার জন্য হলেও নাহয় তাকে নিজের করে নাও? প্লিজ?
-স্মৃতি?
-আমার যাওয়ার সময় হয়ে গেছে রাহাত। যাই?
-প্লিজ স্মৃতি? যেও না আমাকে এভাবে একলা ফেলে।
-আমি আসলে তোমার খুব কষ্ট হয় রাহাত। না আসলেও কষ্ট হয় জানি। কিন্তু আজকের পর আমি আর আসবো না তোমার কাছে। ওকে কিন্তু তুমি কাঁদাবে না একদমই। আমি চেয়েও তোমার কাছে থাকতে পারিনা রাহাত, কিন্তু যে এখনও তোমার পথ চেয়ে বসে থাকে তাকে নিজের করে নাও না রাহাত? প্লিজ? অন্য কোনো দুনিয়ায় হয়তো কোনোদিন তোমার আমার দেখা হবে। ততদিন নাহয় তোমার অপেক্ষাতেই থাকবো আমি। যাই রাহাত? কেমন? ভালো থেকো।
-স্মৃতি? স্মৃতি? স্মৃতিই?
স্মৃতি ধীরে ধীরে সরে আসছে টের পেতেই চোখ মেলে তাকিয়ে আর কাউকে পাশে পেল না রাহাত। আজও মেয়েটা ওকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে গেছে।
এদিকে মায়া গত কয়েকটা দিন ধরে কোথাও একটা যাচ্ছে সেটা দ্বীপ বুঝতে পারছে। রাহাত অফিসে যাচ্ছে না সেই খবরটাও দ্বীপের অজানা নয়। কিন্তু মায়া কার সাথে দেখা করার জন্য প্রতিদিন বেরিয়ে যাচ্ছে, কয়েক ঘন্টা জায়গায় জায়গায় ঘুরে হন্যে হয়ে কি এমন খুঁজছে সেটাই দ্বীপের মাথায় ঢুকছে না। সপ্তাহ খানেক পর ওদের দুজনের বিয়ে। অথচ মায়ার সেদিকে বিন্দুমাত্র আগ্রহই নেই দেখে রীতিমতো রাগে ফুঁসছে দ্বীপ। কাজের চাপে মেয়েটাকে বেশিক্ষণ ফলোও করতে পারে না। নইলে নিজেই ওর কাহিনীর উপর থেকে পর্দা সরিয়ে দিতে পারতো। দুপুরে লাঞ্চ ব্রেকের সময় মায়ার বাসার নাম্বারে কল দিয়েই যখন শুনলো মেয়েটা বাসায় নেই তখনই মাথায় রক্ত উঠে গেল দ্বীপের। নিজের কেবিনে এসে রাগে টেবিলের উপরে থাকা ফাইলগুলোকে ছুঁড়ে ফেলে দিলো নিচে। দ্বীপের রুমের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় লিজা কিছু পড়ার শব্দ শুনতে পেয়ে রুমের দরজায় নক করলো।
-স্যার? এনি প্রবলেম?
দরজার নকের শব্দে মুখ তুলে লিজাকে দেখে মাথায় আগুন ধরে গেল দ্বীপের। নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে লিজাকে রুমে আসতে বলে নিজেও চেয়ারে গা এলিয়ে দিলো দ্বীপ। এই মূহুর্তে কাউকে খুন করে ফেলতে পারলে হয়তো দ্বীপের মাথাটা ঠান্ডা হতো। আর সেই কেউ একজন রাহাত হলে হয়তো আরো তাড়াতাড়ি শান্তি পেত। কিন্তু সেটা হচ্ছে না বলেই দ্বীপের নিজেকে আরো পাগল পাগল লাগছে। দ্বীপের এমন গুম হয়ে চেয়ারে বসে থাকা দেখে লিজার কেমন ভয় ভয় করতে লাগলো। এই অফিসে চাকরি হয়েছে মাত্র কয়েক মাস হয়েছে। তেমন একটা কারো সাথে পরিচয় হয়নি ওর। ঠিক পরিচয় হয়নি বললে ভুল হবে। নিজে কারো সাথে আগ বাড়িয়ে যেমন কথা বলে না কারো সাথে, তেমনি কাজের বাইরে এক মূহুর্তও দেরি করে না লিজা। এখন তাই দ্বীপের সামনে বসে থাকতে কেমন একটা ইতস্তত লাগছে লিজার কাছে।
-মিস লিজা? রাহাতের স্যারের সাথে আপনার বন্ডিংটা কেমন বলুন তো?
-জি স্যার?
-বলছি আপনাদের বন্ডিংটা কেমন? কি কি সার্ভিস দিতে হয় উনাকে? অফিসে বাইরে থেকে তো তেমন কিছু নজরে পড়ে না। না উনার সাথে আপনাকে মায়ার মতো চিপকে থাকতে দেখা যায়, আর না উনি আপনার জন্য ততটা ব্যাকুল হয়ে পড়েন যতটা মায়ার জন্য হতেন। কিন্তু এই অফিসের বাইরের খবরটা কি? সেখানে কতোটুকু ক্লোজ আপনারা?
-কিসব আজেবাজে কথা বলছেন স্যার আপনি?
দ্বীপের কথাগুলো শুনে লিজা রেগে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়তেই দ্বীপ হাতের ইশারায় বসতে বলে সিগারেট ধরালো। লিজা চোখ মুখ লাল করে এখনো জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে দেখে দ্বীপ সিগারেটে লম্বা একটা টান দিয়ে ধীরে ধীরে ধোঁয়া ছেড়ে বাইরের দিকে তাকালো।
-দেখুন মিস লিজা? প্রশ্নগুলোর উত্তর জানা আমার জন্য ভিষণ জরুরি। আশা করি সবগুলো প্রশ্নের সত্যি জবাবটা দিবেন। আপনি হয়তো জানেন না যে আমার আর মায়ার বিয়েটা আগামী সপ্তাহে হচ্ছে। তাই বিয়ের আগে ব্যাপারটা আমার বিস্তারিত জানা দরকার। ব্যাপারটা আমার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। সেসব নিয়ে আপনি টেনশন করবেন না। এখন বলুন তো? এখন পর্যন্ত কয়বার----?
-জাস্ট শাট আপ। এই নোংরা চিন্তাগুলো আপনার মতো নোংরা লোকেদের মাথাতেই আসে। রাহাত স্যার আর মায়া ম্যামের সম্পর্কটা বোঝার মতো ক্ষমতা আপনার মরার পরে আরো দশবার জন্ম হলেও হবে না।
-এমন ভাব করছ যেন কর্পোরেট অফিসে আগে বাড়তে গেলে বা টিকে থাকতে গেলে কী কী করতে হয় সেটা তুমি জানোই না? এর আগেও তো দুটো অফিসে জব করেছ। দু মাসের বেশি তো টিকতেও পারো নি। আর এটায়? তিনমাস পার হয়ে গেছে--। তাও আবার তেমন কোনো কাজও করতে হয় না। লোকে কিছু বোঝে না ভাবছ?
-মাইন্ড ইওর ল্যাঙ্গুয়েজ স্যার। নইলে নইলে আমি----।
-এই যাও তো সামনে থেকে। তুমি না বললে আমি আসল ঘটনাটা কি বের করতে পারবো না ভেবেছ? কিন্তু একবার সবটা জানতে পারলে মায়ার সাথে সাথে তোমাকেও এক্সপোজ করবো। জাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ।
-ম্যাডামকে যখন আপনি বিশ্বাসই করেন না তাহলে বিয়ে করছেন কেন? লজ্জা করে না আপনার?
-গেট আউট। কেন করছি সেটার কৈফিয়ত আমি তোমাকে দিতে বাধ্য নই। আর তোমার পেয়ারের রাহাত স্যারকে চাইলে বলতে পারো কথাগুলো। আমিও দেখতে চাই উনি তার এই অকর্মা পি. এ র কথা শোনে নাকি সিনিয়র এক্সিকিউটিভের। জাস্ট গেট আউট ফ্রম মাই রুম। নাউ।
লিজা চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে যেতেই দ্বীপ সিগারেটে আবার লম্বা টান দিয়ে নিজের ভাবনার রাজ্যে হারিয়ে গেল। মায়াকে তো তার চাই ই চাই। কিন্তু কিছুতেই মেয়েটার ধারে কাছেও সে পৌঁছাতে পারছে না। কি করা যায় আনমনে সেটাই ভাবার চেষ্টা করলো দ্বীপ। আর এদিকে লিজা এক ছুটে নিজের রুমে চলে এসেছে কাঁদতে কাঁদতে। লাঞ্চ ব্রেক চলছে। অফিসের বেশিরভাগ স্টাফই ক্যান্টিনে। তাই ঘটনাটা কেউ জানতেও পারে নি। অবশ্য জানলেও কেউ বিশ্বাস করবে কি না সেটা নিয়েও কোনো ধারণা নেই লিজার। রুমে ঢুকে দিহানকে দেখে নিজেকে আর সামলাতে পারলো না মেয়েটা। দিহানের সামনেই ফ্লোরে বসে পড়ে একেবারে বাচ্চাদের মতো কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। আর দিহান? সে বেচারা লিজাকে খুঁজতে রুমে এসে রুমটা খালি দেখে বেরিয়ে যাচ্ছিল। লিজাকে এভাবে ছুটে রুমে আসতে দেখে আর এমন ফ্লোরে বসে কাঁদতে দেখে থতমত খেয়ে নিজেই লিজার পাশে বসে আলতো করে বুকে জড়িয়ে নিলো। এই মেয়েটার প্রত্যেকটা অশ্রু বিন্দু দিহানের বুকে ভিতরটা ক্ষত বিক্ষত করতে দিচ্ছে। তবু মেয়েটাকো সামলানোর চেষ্টা করছে দিহান। মেয়েটার কান্না না থামা পর্যন্ত কিছুতেই শান্তি পাচ্ছে না দিহান। কি হয়েছে সেটাও দিহান বুঝতে পারছে না। শুধু নিরবে মেয়েটার কান্না থামানোর বৃথা চেষ্টা করা ছাড়া আর কিছুই করার নেই এখন দিহানের।