!!৪৯!!
দুপুর গড়িয়ে বিকেল। মাহা রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে একমনে। কোনো অনুভূতি নেই, কোনো অভিব্যক্তি নেই। নির্বিকার মানবী। বসন্ত এসেছে নির্মল ধরায়। হালকা হাওয়া বইছে। সাঁই সাঁই করে পাশ দিয়ে ছুটে চলেছে চলন্ত গাড়ি। সবাই সবার মতো ব্যস্ত। গমগমে আওয়াজ, চেঁচামেচি, গাড়ির হর্নের শব্দ, হকারের
হাঁক দেওয়ার শব্দ, শিশুর কান্নার শব্দ,কাকের কা কা, মানুষের কথাবার্তা। সব মিলিয়ে একত্রিত হয়ে তৈরি করেছে এক ঝিমঝিম শব্দ। শব্দের রয়েছে নিজস্ব বলয়। অদৃশ্য এক বলয়। সেই বলয়ের কারণেই হয়তো মাহার কানে অদ্ভুত এক আওয়াজ ভেসে আসছে। পিছন পিছন একটা কালো হাইস অনেকক্ষণ যাবত আসছে। অর্ধজাগ্রত, জীবন উদাসী মাহা হয়তো তা খেয়ালও করেনি। নিরব হলো রাস্তা। জনমানবশূন্য রাস্তায় প্রবেশ করতেই পিছন থেকে দ্রুত বেগে ধেয়ে আসলো গাড়িটা। কিছু বুঝে উঠার আগেই টেনে নিয়ে গেলো ভিতরে। মাহার ক্লান্ত, বিধ্বস্ত শরীর প্রতিবাদ করতে চাইলো খানিকটা। জুতসই হলোনা। জ্ঞান হারালো মাহা।
_________________
হসপিটালের বড় ঘড়িটা টং টং করে শব্দ করে উঠলো। জানান দিচ্ছে রাত বারোটা ছুঁয়েছে সময়। আজ দিনটা অনেক ব্যস্ততায় কেটেছে রেজওয়ানের। ইন্সপেক্টর তাজের সাথে ইনভেস্টিগেশন নিয়ে আলোচনা সহ নানা কাজ। ডক্টর ওয়াসিফের সাথে একটু আলোচনা প্রয়োজন। হাসপাতালের নিচতলায় ফরেনসিক ল্যাব। প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকে পশ্চিম পার্শ্বে কিছুদূর হাঁটতে হয়। এদিকটায় নিরব। জুতোর সাথে টাইলস লেগে হাঁটার দারুণ শব্দ হচ্ছে। ঠক ঠক ঠক। ফরেনসিক ল্যাবের দরজাটা সাদা রঙের। কাঁচের তৈরি। দরজা খোলাই। দরজার বাইরে রেজওয়ানকে দেখে হাঁক ছাড়লেন ওয়াসিফ।
"আসুন, মিঃ রেজওয়ান।"
বহু জিনিসপত্রে সাজানো গোছানো, ছিমছাম ঘর। কেমিক্যাল, পরীক্ষা করার যন্ত্র। ছুরি, হাতুড়ি সহ নানা জিনিস। একটা টেবিলে চৈতির ছিন্ন পা এবং অপরপাশে উদ্ধারকৃত আলামতসমূহ। রেজওয়ান পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।
"ডিএনএ রিপোর্ট আসতে কতদিন সময় লাগতে পারে? ডক্টর?"
"আরো পাঁচদিনের মতো লাগবে ।"
ল্যাবে তাদের ছাড়াও আরো দুইজন উপস্থিত। মোহাম্মদ জুলফিকার। সে ইন্টার্নি করছে আর ডক্টর মিনহাজ। দীর্ঘক্ষণ চৈতির পা পর্যবেক্ষণ করলেন ডক্টর ওয়াসিফ। অতঃপর বললেন,
"আপনাকে জরুরি একটা কথা বলার ছিলো মিঃ রেজওয়ান।"
"জ্বি, বলুন।"
"আপনি আমার সাথে আসুন।"
ডক্টর ওয়াসিফের পিছু পিছু ফরেনসিক ল্যাবের ভিতর আরেকটা দরজা দিয়ে ছোট একটা ঘরে ঢুকলো দুজনে। ঘরের একপাশে তিন থাকের ওয়ারড্রবের মতো ফ্রিজ। ঘরের তিনভাগের দুইভাগ ফ্রিজ। অপরদিকে কাঠের তৈরি থাক। তাতে কেমিক্যাল ভরপুর শতখানেক কাঁচের কৌটা। সেখানে ডুবিয়ে রাখা লাশের চোখ, হৃদপিণ্ড, কিডনি সহ অন্যান্য অঙ্গাণু। ঘরের মাঝে একটা কাঠের পুরানো টেবিল। ওয়াসিফ ঘরের লাইট জ্বালিয়ে দিলেন।
"আপনাকে কিছু দেখাতে চাচ্ছি মিঃ রেজওয়ান। আশা রাখছি আপনার ইনভেস্টিগেশনে তা সাহায্য করবে।"
রেজওয়ান কিছুই বললোনা। বর্তমানে হাতের কাছে যা পাবে তাই অনেক। একটা ক্লু। কেবলমাত্র একটা ক্লুর সন্ধান চাচ্ছে রেজওয়ান। বর্তমানে সে এবং তার টিম এমন পর্যায়ে আছে তাতে কি রেখে কি করবে বুঝা দায়। কি থেকে কি শুরু করবে! সন্ধ্যার দিকে ইন্সপেক্টর মোবারকের সাথে কথা হয়েছিলো তার। ঘটনা স্থান বারবার খুঁজেও কোনো তথ্য মোবারক পাননি।
!!৫০!!
অন্ধকার ঘর। কেমন স্যাঁতস্যাঁতে গন্ধ। মাহার জ্ঞান ফিরলো। কিন্তু আকস্মিক অন্ধকারে মস্তিষ্ক ধাক্কা অনুভব করলো। আলোর সন্ধান চায় সে। দুর্বল, ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঢুকরে উঠলো মাহা। চিৎকার করলো পাগলের মতন। কেউ আসেনা, কেউ না। পিছনে কিসের পাটাতন মাহার জানা নেই। তাতে হেলান দিলো মাহা। কানে ভেসে এলো ব্রিটিশ এক্সেন্টে আওড়ানো কিছু বুলি। কি বলছে বুঝতে পারছেনা মাহা। অন্ধকার সয়ে এসেছে চোখে। মাহার মনে হলো এমন ঘটনা তার সাথে আগেও ঘটেছে। এবং সেটা দেজা ভ্যু নয়। এরকম বন্দী অবস্থায় ছিলো সে। আধা জাগ্রত, আধা অবচেতন মাহা মস্তিষ্কে চাপ প্রয়োগ করলো তীব্রভাবে। তাতে জোড়ালো চিনচিন ব্যথার সৃষ্টি হয়েছে। মাহার সেদিকে খেয়াল নেই। আবছা স্মৃতিগুলোকে পুনর্জীবিত করার চেষ্টা চলছে যে! স্মৃতিকে বারবার মনে করতে থাকলে স্মৃতিটি যে নিউরোনে সংরক্ষিত আছে, সেটার সিন্যাপ্স বারবার আন্দোলিত হয়। যত বেশী সিন্যাপ্স আন্দোলিত হবে, সেই স্মৃতি তত শক্তিশালী হবে। মাহার ক্ষেত্রে তা হচ্ছেনা। সিন্যাপ্স আন্দোলিত হচ্ছে তবে কিছু মনে পড়ছেনা। মাথায় দু হাত চেপে ধরে আবার চিৎকার করে উঠলো মাহা। এবার মস্তিষ্কে জোর চালালো না। পিছনে শক্ত পাটাতন হয়তো এটা দেয়াল তাতে মাথা হেলিয়ে দিলো। চোখ বুজে গেলো তার। নিউরোন আন্দোলিত হচ্ছে ধীরে ধীরে। মাহার মস্তিষ্কের কিছু নিউরোন চাইলেও সম্পূর্ণরূপে আন্দোলিত হতে পারছেনা। কিছু একটা যেন ধরে রেখেছে তাদের। চোখ বুজলো মাহা। ফিরে গেলো কিছুদিন পূর্বে।
_______________
বিকেলে বাইরে বের হয়েছিলো মাহা, চৈতি। পরের ঘটনা অন্ধকারে ছেয়ে আছে । চোখের সামনে আবছা অন্ধকার। মাহার নাম ধরে চিৎকার করে ডাকছে কেউ। আশেপাশে জঙ্গল। দূরে বিশাল বিশাল পাহাড়। বড় একটা মেহগনি গাছের পিছনে লুকিয়ে মাহা। বারেবারে তার নাম ধরে চিৎকার করছে কেউ। কান খাড়া করলো মাহা। এই আওয়াজ তো চৈতির! গাছের পিছন থেকে বেরিয়ে এলো সে। দূরে শিয়াল ডাকছে। হুক্কা হুয়া। গাঁয়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো মাহার। সে এগিয়ে গেলো সামনে। অন্ধকার নেমে এসেছে চারপাশে। মাহা হাঁটছে। কাঙ্ক্ষিত ডাক থেমে গেলো। মাহার মুখ পিছন থেকে শক্ত করে কেউ ধরেছে। ছটফট করছে মাহা। ছাড়াতে পারছেনা। টানতে টানতে কেউ তাকে নিয়ে যাচ্ছে জঙ্গলের ভিতরে। কাঠের ঘর। একটা হারিকেন জ্বালানো কেবল। তাকে ঘরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বাইরে দিয়ে দরজা আটকে দিলো পুরুষালি রুক্ষ হাত। মাহা অনবরত চিৎকার করছে আর দরজা ধাক্কাচ্ছে। না কেউ খুলছেনা। বদ্ধ জায়গায় অসম্ভব খারাপ লাগে মাহার। ক্লস্ট্রোফোবিয়ায় আক্রান্ত মাহা কোনোদিন মানতে চায়নি তার কোনো বিষয়ে ফোবিয়া থাকতে পারে। একসময় শ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম। অতঃপর সব অন্ধকার।
যখন জ্ঞান ফিরালো তখন বোধহয় বাইরে গভীর রাত। নিশুতি রাতের কান্না ভেসে আসছে। হরেকরকম প্রাণীর ডাক ভেসে আসছে বাহির থেকে।
মাহা ঘরে দুজন মানুষের অস্তিত্ব অনুভব করলো। বাইরে একটা হারিকেন জ্বলছে। সেই আবছায়া আলোর ছিটেফোঁটা ভিতরে প্রবেশ করছে কেবল। ব্রিটিশ এক্সেন্টে একজন লোক কি যেন বলছে। তার পাশে বিশালদেহী আরেকজন। বিদেশি লোকটার নীল চোখ অন্ধকারে জ্বলজ্বল করছে। মাহা চিৎকার করার আগেই তার ঘাড়ে একটা ইনজেকশন পুশ করে দিলো লোকটা। মাহা একটা সূক্ষ্ম জ্বালা অনুভব করছে ঘাড়ে। মনে হচ্ছে ঘাড়ের ভিতর, শিরা দিয়ে রক্ত চলাচলের পাশাপাশি সুঁইও চলাচল করছে।
!!৫১!!
সুঁইগুলো চলাচলের সময় যেন একটা করে তীক্ষ্ণ আঘাত করে যাচ্ছে ঘাড়ে। নির্দিষ্ট জায়গায়। মাহা অর্ধচেতন হয়ে পড়লো। বিদেশি লোকটাকে দেখা যাচ্ছেনা। মাহা বুঝে গেলো। কারণ অন্ধকারে নীল জ্বলজ্বলে চোখ দেখা যাচ্ছেনা। মাহা কাঠের ঘরের দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে। চোখ বুজা তার। হঠাৎ খেয়াল করলো বিশালদেহী লোকটা নিজের একটা হাত এগিয়ে তার শরীরে স্পর্শ করতে চাচ্ছে। ধারালো দাঁতে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে লোকটার হাতে কামড় বসিয়ে দিলো মাহা। লোকটা চিৎকার করে উঠেছে। কাঠের ঘরের দরজা খোলা। মাহা সবকিছু ভুলে দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে এলো৷ দিকবিদিকশুন্য হয়ে দৌড় দিলো প্রাণপণে। নিজের অস্তিত্বের লড়াই, নিজের সম্ভ্রম বাঁচানোর লড়াইয়ে জয়ী হলো মাহা। পিছনে লোকটা দৌড়ালেও এখন নেই। জঙ্গল পেরিয়ে পাকা রাস্তায় উঠে গেছে সে। তারপর আবার দৌড়। পরে কি হলো মাহা জানেনা। যখন চোখ খুললো মাহা তখন পাশে পেয়েছে রুমানাসহ তার বাড়ির মানুষদের।
___________________
বর্তমান, অতীত মিলে একাকার। মাহা এখন কোথায় আছে জানেনা। মনে হলো প্রিয় একটা পুরুষালি হাত তার গালে নরম করে চাপড় মারছে। নরম কন্ঠে তাকে ডাকছে। মাহার চোখ খুলতে ইচ্ছে করছেনা। উষ্ণ বুকে মাথা দিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে সহস্র দিন, সহস্র মাস, সহস্র বছর। সার্থক একহাতে মাহাকে বুকে নিয়ে অপর হাতে ড্রাইভ করছে। মাহার মুখে অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দিলো সে। একটা ফোন পেয়েই এই রাস্তায় ছুটে এসেছিলো। ঘুমের মাঝেই কি যেন বিড়বিড় করছে মাহা। সার্থক আবার চুমু খেলো। এই মেয়েটাকে পারলে বুকের ভিতরেই রেখে দিতো সে। বিশাল আকাশে চাঁদ উঠেছে। হাওয়া বইছে মৃদু। মাহার দুচোখের পাশ ঘেঁষে জল গড়িয়ে পড়ছে। সার্থক শুষে নিলো তা। মাহার কানে কানে বললো,
"তোমার সকল কষ্টগুলো আমার।
আমার সকল সুখগুলো তোমার।"
মাহা অবচেতন অবস্থায় আরো গাঢ় করে জড়িয়ে ধরলো সার্থক কে। মাথা ঠেকিয়ে দিলো সার্থকের চওড়া বুকে। সার্থকের ঠোঁটে ঈষৎ হাসির রেখা দেখা দিলো কি?
চাঁদের সাথে মেঘেদের অবাধ খেলা হচ্ছে আকাশে। কখনো কখনো দুষ্টু মেঘের দল ঢেকে দিচ্ছে চাঁদকে। কখনো বা সরে যাচ্ছে। যেমনটা মাহার চুলগুলো তার সাথে করছে। খোলা কোঁকড়া চুলগুলো কখনো তার মুখ ঢেকে দিচ্ছে কখনোবা সরে যাচ্ছে। সার্থক চাঁদের পানে তাকালো একবার। আবার তাকালো তার অলকানন্দার দিকে। মুচকি হাসি উপচে করলো গম্ভীর মুখটায়। আবার চাঁদের পানে তাকিয়ে সে বললো,
"এই যে মেঘেরা আমার চাঁদ বেশি সুন্দর।"
মেঘের দল রাগ করলোনা। আকাশের চাঁদটাকে ঢেকে দিলো তারা। যেন বুঝিয়ে দিলো,
"হুম। তোমার চাঁদ বেশি সুন্দর ছেলে।"
.
.
.
চলবে.............................