অচেনা অতিথি - পর্ব ৪৬ - নাফিসা মুনতাহা পরী - ধারাবাহিক গল্প


মাহাদের বলা প্রতিটা কথাগুলো তিতিরের অন্তরে গেঁথে গেল। মাহাদের সমস্ত কথা তিতিরে কানে সোঁ সোঁ আওয়াজ করে বাজছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে। এখন সে কি করবে? কই থেকে বাচ্চা এনে দিবে। 

মাহাদ জানেনা তিতির সবকিছু জেনে গেছে অনেক আগেই। তাই বাচ্চা সম্পর্কে ওর অনূভুতি প্রকাশ করতে কোন কমতি রাখলোনা সে।

আরো ঘন্টাখানেক পার্টি চললো। পার্টি শেষ করে মাহাদ আর তিতির রুমে ফিরে এল। তিতির ওর ড্রেস চেঞ্জ করার জন্য ড্রেস খুলতেই মাহাদ পিছন দিক হতে ওকে জড়িয়ে ধরে কয়েকটা কিস করতেই তিতির মাহাদকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিল। 

মাহাদ ভাবলো তিতির হয়ত মজা করছে। তাই এবার শক্ত করেই জড়িয়ে ধরল। আর তিতিরকে নিজের মত করে আলিঙ্গন করতে লাগল।

"মাহাদ আমাকে ছেড়ে দিন। আমার এসব ভালো লাগছেনা। প্লিজ.... বলেই মাহাদকে নিজের কাছ থেকে সরানোর চেষ্টা করে তিতির। আজ আর মাহাদের ভালোবাসার জন্য তিতির পাগল না,  মাহাদের ভালোবাসা তিতিরকে বারবার জানিয়ে দিচ্ছে তার অক্ষমতা।"

"কি হয়েছে আমার সুখপাখি! এমন করছো কেন? আমি কি তোমাকে কষ্ট দিয়েছি বলে তিতিরের ঘাড়ে মুখ ডুবাল মাহাদ।"

"আমি বলছিনা, আমার এসব ভালো লাগছেনা? তাহলে কেন আমার বিরুদ্ধে আপনি এসব করতে বার বার ফোর্স করছেন? আমাকে ছেড়ে দিন। আমি বাসায় যাব।"

মাহাদ সাথে সাথে তিতিরকে ছেড়ে দেয়। এতটা অপমান মাহাদ কোনদিনও কারো কাছে হয়নি। নিজেকে এখন নিকৃষ্ট মনে হচ্ছে মাহাদের। নিজের ভুল কোথায় সেটাই খুঁজে বের করতে পারছেনা।

তিতির ড্রেস চেঞ্জ করে বলল," আমি বাসায় যাব।"

মাহাদ আর কোন কথা না বলে তিতিরকে নিয়ে বের হয়ে আসল। হিনু তখনো বাসায় যায়নি। তাই হিনুর কাছে এসে বলল," হিনু ওকে বাসায় নিয়ে যা। আমার একটু কাজ আছে।"

মাহাদের এমন কথায় হিনুর মনে সন্দেহ জাগলো কিন্তু কিছু না বলে তিতিরকে নিয়ে বাসায় চলে আসল। রাস্তায় একবার এই বিষয়ে কথা বললেও তিতির এড়িয়ে গেল  বিষয়টা।

♦♦♦♦

পরেরদিন সকালবেলা,
আসমা নাস্তা বানাচ্ছিল। তিতির এসে আসমার পাশে দাড়িয়ে বলল," আসমা, তোমাকে যদি বলি তোমার ভাইজানকে সব দিক থেকে ১০০ মধ্য কত মার্ক দিবে?"

" বুঝলামনা আপা, আমাকে একটু ক্লিয়ার করে বলুন।"

"মনে করো, তোমার ভাইজানের আচার-ব্যবহার, উনি মানুষ হিসেবে কেমন, কতটা কেয়ারফুল। এই রকম আর কি?"

"অহ্.... আপা এই বিষয়ে ভাইজানকে ১০০ ভিতর ৯৭% দিব।"

" আসমা, ১০০ নয় কেন?"

" কারন ভাইজান অত্যান্ত রাগী একজন মানুষ। তার রাগের জন্য ৩% কাটা।"

" কই উনিতো তেমন রাগ দেখান না!"

" ভাইজান সাইলেন্ট কিলার। কেউ যদি আপনার সাথে দুর্ব্যবহার করে তখন নিজেই দেখবেন ভাইজানের টেম্পারি কতটা দুর্ধর্ষ। "

তিতির আসমার কথা শুনে মুচকি হেঁসে আসমার সামনে ওর ডান হাত বাড়িয়ে দিয়ে মুঠ খুলে বলল," দেখতো তোমার পছন্দ হয়েছে কিনা? এটা তোমার ভাইজান তোমার জন্য পছন্দ করেছে।"

আসমা তিতিরের হাতের দিকে চেয়ে দেখল, একটা সোনার চেন। চেনটা অনেক মোটা সাইজের। আসমা অবিশ্বাস্য ভাবে তিতিরের দিকে তাকিয়ে বলল," আপা এটা কি সত্যিই আমাকে দেওয়া হয়েছে?"

" হুম এটা শুধু তোমার জন্য। আমার বালা কিনার দিন উনি এটা কিনেছিলেন। আমার মনে ছিলনা। গতকাল উনি আমাকে স্মরন করে দিয়েছিলেন। তোমার পছন্দ হয়েছে তো?"

তিতির নিজে আসমার গলায় চেনটা পড়িয়ে দিয়ে বলল," তোমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে আসমা। এটা এখন থেকে পড়ে থেক।"

আসমা কিছু বলল না। কিন্তু তিতির কিচেন থেকে বের হয়ে যেতেই আসমার চোখদিয়ে টপটপ করে কয়েক ফোটা পানি পরোটার খামিরের উপর পড়ল।

এবার তিতির দরজার আড়াল থেকে বের হয়ে এসে আসমাকে বলল," চোখের পানি আটকে রাখা খুব কষ্টকর আসমা। যাও তুমি রেষ্ট করো আমি বাঁকিটা কাজ করে নিচ্ছি।"

আসমা চোখের পানি মুছে বলল," আপা, আমি আবার আটা গুলছি। ওটা তো নষ্ট হয়ে গেছে।"

"কে বলেছে নষ্ট হয়ে গেছে। বরং বলো এর মর্যাদা বহুগুনে বেড়ে গেছে। চোখের পানি সবসময় অমূল্য হয় আসমা। বেশি কষ্ট বা সুখ না পেলে সে কখনো সহজে বের হতে চায়না।
তিতির পরোটা বেলছে আর আসমা দাড়িয়ে কান্না করছে। আপা, আমাকে এমন উপহার কেউ দেয়নি। আমি যেখানে মানুষ হয়েছি সেখানে আমার মত আরো কিছু মেয়েরা মানুষ হয়েছিল। আমাদের অল্পস্বল্প পড়ালেখা করিয়ে কাজে পাঠানো হয় আর পুরো টাকা তাদের দিতে হত। আমি ভেবেছিলাম ওরা আমার বাবা-মা। কিন্তু পরে জানি এরা বিভিন্ন জায়গা থেকে শিশু চুরি করে এনে বড় করে। তারপর তাদের কাজে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এর মধ্য যদি কেউ মোটা অংকের টাকা দেয় তাহলে তাকে একেবারে দেওয়া হয়।

আমি এসএসসি পাশ করি। তখন বুঝে ফেলি আমাকে এখানে আর রাখা হবেনা। একবার পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি কিন্তু ভাগ্য মন্দ। ধরা পড়ে যাই। সেদিন প্রচুর ম্যার খেয়েছি। তারপর আমার এক স্কুল পড়ুয়া বন্ধুর সাথে যোগাযোগ করি। এখান থেকে যে ভাবেই হোক বের হতে হবে। না হয় আমার স্থান পতিতা পল্লীতে হবে।

আমার বন্ধুটি পার্কের আসেপাশে হকারির কাজ করতো। ওর ভাইজানের সাথে কেমন জানি করে পরিচয় ছিল। ওনার মাধ্যমে আমার মুক্তি ঘটে। ভাইজান অবশ্যই জানেনা আমাকে কোথা থেকে আনা হয়েছে। আমার বন্ধু হাসান ওর বাবাকে নিয়ে ভাইজানের সাথে দেখা করে। ওনার একটা খ্যাতি আছে, মানুষকে সাহার্য্য করা। সেটার কারনে ৪ লক্ষ টাকার চুক্তিতে আমার মুক্তি ঘটে। আমি তারপর হাসানের নানীর সাথে থাকতাম।

ভাইজানের কোন কারনে হাসানের সাথে একদিন দেখা হয়। উনি হাসানকে বলেছিলেন তার একটা ভালো কাজের মেয়ে দরকার। কারন তার স্ত্রী অনেক অসুস্থ ছিল। মানে আপনি অসুস্থ ছিলেন।

সেদিন ভাইজানের কাছে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়। সবসময় মুখে তার হাঁসি লেগেই ছিল। চোখের সামনে অনেক কিছু দেখেছি আপা, তাই সেদিনও মনে হয়েছিল হাসানরাও বুঝি আমায় বিক্রি করে দিল এই লোকটার কাছে। কিন্তু হাসানের আমাকে বলা শেষ কথা ছিল, " এবার নিজের স্বাধীনতা উপভোগ করিস।"

আমি অনেক সুখী আপা, মাহাদ ভাইজানের দায়িত্ব থেকে। আমি ওনার ঋন কোনদিনও শোধ করতে পারবোনা আপা। আমাকে ঐ নরক নামক যন্ত্রনা থেকে মুক্তি দিয়েছে ভাইজান।"

তিতির সব কিছু শুনে মনে মনে বলল," মানুষটা সবাইকে শুধু মুক্তিই দিয়ে থাকে। যেমনটা আমাকে সে দিয়েছে।" 
আসমা, যদি তুমি পড়ালেখা করতে চাও তাহলে আমি   মাহাদের সাথে এবিষয়ে কথা বলব। ও তোমার ভর্তির ব্যবস্থা করে দিবে।

"না আপা, আর ঋন বাড়াতে চাইনা। আমি এমনই ভালো আছি।"

তিতির আর কিছু না বলে নাস্তা বানানো কমপ্লিট করল। তারপর খেয়ে ভার্সিটিতে চলে গেল।  ভার্সিটির গেটে ঢোকার আগে কিছু ছেলে দাড়িয়ে থাকে আর তিতিরকে তারা প্রায় রোজই টিজ করে। অশ্লীল কথাবার্তাও বলে। শুধু তিতির না অন্য মেয়েদেরও টিজ করে।
গেটের সামনে এসে তিতির দাড়িয়ে গেল। আজও ছেলেগুলো দাড়িয়ে আছে। উফ্ আবার সেই অশ্লীল কথাবার্তা শুনতে হবে। 

তিতির মাথা নিচু করে ওদের সামনে দিয়ে চলে এল। কিন্তু আজব! আজ কেউ টু শব্দটিও করলনা? ছেলেগুলো তাহলে ভদ্র হয়ে গেছে। তিতির পিছনে আর না তাকিয়ে ভিতরে চলে গেল।

ছেলেরা আজ ভদ্র হয়ে গেছে কারন তাদের সামনে মাহাদ নামক চিতাবাঘ দাড়িয়ে ছিল। 
কিরে, মেয়ে দেখলেই তোদের পুরুষ্যত্ব জেগে ওঠে বলেই একটা ছেলেকে ঠাস্ করে থাপ্পড় মারল মাহাদ। এই আর কয়টা মেয়েকে এমন টিজ করিস বলতো?  আর একজনকে ধরতেই ওরা সবাই বলল," ভাইয়া ভুল হয়ে গেছে মাফ করে দেন। আর জিবনেও এই গেটে দাড়াবোনা।"

"মেয়েরা আল্লাহর হুকুম মেনে ওদের চেহারা দেখাতে চায়না বলে পর্দা করে আর তোরা ঐসব মেয়েদেরও ছেড়ে দিসনা? নাহ্ তোদের এভাবে হবেনা। চল তোদের আজ থানায় তুলবো।"

মাহাদের কথায় ওরা প্রচন্ড ভয় পেল। সোজা মাহাদের পা ধরে বলল," ভাই মাফ করে দেন, আর কোনদিনও আমাদের মুখ পর্যন্ত আপনাকে দেখাবোনা।"

মাহাদ চোখমুখ কঠিন করে বলল," আর কোনদিনও যেন তোদের এইখানে দাড়িয়ে থাকতে না দেখি। এলাকার বাপ হয়ে গেছিস তাইনা? এবার যদি দেখি তাহলে তোদের বাপগিরীই আগে ছুটাবো।

ওদের শায়েস্তা করে মাহাদ চলে আসে। কারন আজ আরও একটা এমন কাজ আছে।

♦♦♦♦

মাহাদ আর হিনু বসে আছে ব্যালকুনিতে। একটা   বিবাহিত ছেলে হিনুকে খুব ডিসর্টাব করে। ইদানিং সেটা বেশিই হয়ে গেছে।  বাসা অবদি চলে এসেছে।

সকালে হিনু মাহাদকে কল করেছিল। কিন্তু মাহাদ আসতে রাজি ছিলনা। শেষে হিনু যখন বলল, " আমাকে শুধু ডিসর্টাব করেনা সাথে তোর বউকেও করে। ব্যাস হয়ে গেল। মাহাদকে আর আটকায় কে। ঐ কথা শুনে আজ তিতিরকে পুরো রাস্তা ফলো করে ছেলেগুলোকে শায়েস্তা করেছে। এখন হিনুর সমস্যা সমাধান করার জন্য ব্যালকুনিতে বসে আছে শিকার ধরার জন্য।

হুম ব্যাটা এসে হাজির। হিনু মাহাদকে দেখিয়ে দিল। মাহাদ কোন কথা না বলে সোজা বাসা থেকে বের হতেই লোকটা এই দৌড় না সেই দৌড়। পিছনে মাহাদও দৌড়। এই দাড়া বলছি, আমায় যতটা দৌড় করাচ্ছিস সব পাই টু পাই হিসাব নিয়ে ছাড়ব কিন্তু। তোরে ধরলে মনে কর তুই আজ শেষ।

শেষে লোকটাকে মাহাদ ধরে ফেললো। তারপর শার্টের কলার ধরে টেনে হিঁচড়ে হিনুদের বাসার সামনে নিয়ে আসতেই হিনু বের হয়ে এল। রাস্তার আসেপাশে ততক্ষনে অনেক লোক সার্কাস দেখতে হাজির হয়েছে।

"এই হিনু দাড়িয়ে আছিস কেন! তোর কমান্ডো ট্রেনিং শুরু করে দে। আমি এখানেই দাড়িয়ে আছি।"

মাহাদের কথা শুনে হিনু পায়ের জুতা খুলে ফটফট করে লোকটার মুখে বাড়ি দিয়ে বলল," লুচ্চাব্যাটা, ঘরে বৌ রেখে অন্য মেয়ের পিছু নিয়েছিস? মানুষ বলে মেয়ে হয়ে নাকি মেয়েরাই অন্য মেয়ের সংসার ভাঙ্গে। তাহলে তোদের মত পুরুষ কি করে! শুধু গাঞ্জায় টান দেস?"

"হিনু ইচ্ছামত ফাটা ওরে। যাতে ওর নিজের চেহারা দেখে নিজেকে চিনতে না পারে। আজ তোর পিছু লাগছে কাল যদি আমার বৌয়ের পিছে লাগে? তাহলে আমার হাতে ও নির্ঘাত মাডারই হবে। তার আগে তুই সোজা কর।"

এদিকে মাহাদের সার্পোট পেয়ে হিনু ওর কারিশমা দেখাতে লাগল। পিটুনের উপর পিটুন। সেরের উপর সোয়া সেরের ম্যার।

♦♦♦♦

তিতির ক্লাস শেষে বাসায় চলে এল। গেটের কাছে রিক্সা থেকে নেমে দেখলো, মাহাদ একজন লোকের কলার ধরে আছে আর হিনু তাকে শায়েস্তা করছে।

আল্লাহ্ এরাতো লোকটাকে মেরেই ফেলবে। সবার সামনে গিয়ে মাহাদের হাত ধরে টেনে বাসায় আনলো। মাহাদকে চলে যাওয়া দেখে হিনুও বাসায় চলে আসলো।

তিতির রেগে গিয়ে বললো,"আপনার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে! কাউকে এভাবে কেউ মারে! চোরকেও তো এভাবে কেউ মারেনা। মরার উপর দেখছি দু'জনেই খরা দিচ্ছেন। "

" তিতির তুমি কিছুই জানোনা, ও হিনুকে প্রুচর টিজ করে। এখন আবার বাসার আসে-পাশে ঘুর ঘুর করতে শুরু করেছে। দু'দিন পরতো ওর দেখাদেখি অন্যরাও করতে সুযোগ পাবে।"

যদি মরে যায় তাহলে কি করতেন? সব কিছুতে বাড়াবাড়ি ভাল নয়। যথেষ্ঠ শায়েস্তা করেছেন। রুমে চলেন বলে তিতির মাহাদকে নিয়ে ওদের ফ্লাটে চলে গেল।

রুমে আসতেই আসমা বলে উঠলো," ব্যাটা খুবই খারাপ ছিল ভাইজান। ধোলাই দিছেন ভালো করছেন।"

আসমা, তুমিও ওনারে উৎসাহ দিচ্ছো! আর একটা কথা বললে এবার কিন্তু আমি তোমাদের দু'জনকেই শায়েস্তা করবো। তাই যত চুপ থাকবা ততই তোমাদের জন্য  মঙ্গল।

মাহাদ মুখে আঙ্গুল দিয়ে আসমাকে চুপ করতে ইশারা করল। কারন প্রাইম-মিনিষ্টার খেপে গেছে। মাহাদ সুড় সুড় করে রুমের ভিতর গিয়ে সোজা ওয়াসরুমে চলে গেল। এটাই আপাতত ওর জন্য সেভ জায়গা।

♦♦♦♦

দুপুরে সবাই একসাথে খাবার খেয়ে যখন তিতির আর মাহাদ রুমে আসল তখন তিতির ওর ফোন বের করে মাহাদকে কিছু পেপার্সের পিক দেখিয়ে বলল," আমার ক্লাস টেষ্ট গুলো খুব খারাপ হচ্ছে। গত কয়েকদিন ধরে কম মার্ক আসছে।"

মাহাদ ফোনে চোখ বুলিয়ে বলল," ঠিকি আছে তো! ফাইনালে এর থেকে ভাল করতে হবে।"

একটা কথা বলি কিছু মনে করেননা। আপনার জন্য আমার এমন রেজাল্ট আসছে। ২য় পজিশনের ছেলেটা আমার থেকে ৩ মার্ক কম। আমার আরো ভালো কিছু ট্রাই করতে হবে।

মাহাদ কিছুটা অবাক হয়ে বলল," আমার কারনে?"

হুম, আপনাকে নিয়ে আমি ভাবতে ভাবতে রাত-দিন কাবার করে ফেলি। আমি ডিসিশন নিয়েছি আপনার সাথে যোগাযোগ অনেক কম করে দিব। তাছাড়া আমার রেজাল্ট আরো খারাপ হবে।

তিতির অহেতুক কথাবার্তা বলো না। তোমার মতলব কি বলতো! কয়েকদিন যাবত তুমি আমার সাথে রাব ব্যবহার করেই চলছ। তোমার সমস্যা কি আমাকে বল, তাছাড়া আমি সমাধান করবো কিভাবে?

তিতির চিৎকার করে বলল," আমার সমস্যা আপনি। আমার স্ট্যাডির ক্ষতি হচ্ছে। আশাকরি আপনি  বুঝবেন।"

তিতিরের হঠাৎ এমন ক্ষেপে ওঠায় মাহাদ চুপ হয়ে গেল। ধীরে ধীরে তিতিরের কাছে গিয়ে  বলল," আমি কি তোমার কাছে এতটাই ঘৃনার পাত্র হয়ে গেলাম! তাই আমাকে আর তোমার সহ্যই হচ্ছেনা।"

মাহাদের কথাটা তিতিরের বুকে এসে বিঁধে গেল। মাহাদকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো তিতির। আল্লাহ্ সুবহানাতালার পরে আপনার স্থান আমার কাছে। কিভাবে আপনি আমাকে এতবড়  কথা বলতে পারলেন। আপনি যদি আমাকে শত টুকরোও করে ফেলেন তবুও আপনার প্রতি আমার ভালোবাসা বিন্দু পরিমানে কমবেনা। কারন আমি শুধু সব কিছুর উর্দ্ধে আপনাকেই ভালোবাসি। মানুষকে ভালোবেসে চাওয়া এক কথা আর শুধুই ভালোবেসে যাওয়া আরেক কথা। এখন কেউ যদি আপনাকে পৃথিবীর সবথেকে খারাপ মানুষ প্রমান করে তবুও আপনি আমার কাছে সবার উপরেই থাকবেন।"

তিতির আমি তোমাকে নিদিষ্ট সময় দিয়েছি। তারমানে এই নয় যে তুমি এর ফায়দা নিবে। আশাকরি তুমি এমন কিছু করবেনা যাতে বেলা শেষে আমি তোমার প্রতি কঠোর আচরন করি। বিশ্বাস করি, তাই বিশ্বাস নামক শব্দটির উত্তম মর্যাদা দিবা।
ছাড়ো আমায়, আমায় যেতে হবে।

তিতির বুঝে গেছে মাহাদ আর কখনো আসবেনা। তিতির মাহাদকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল," না না প্লিজ আর একটু থাকেন, আমি এমন করে বলতে চাইনি। সমস্যাগুলোর এমন ভাবে আমাকে আষ্টেপৃষ্টে ধরেছে, সেখান থেকে আমি বেরই হতে পারছিনা।"

সমস্যা যেমন আছে তেমনি প্রতিটা কাজের সমাধানও আছে। দু'জনে মিলেই সমাধান করতাম। কিন্তু........
মাহাদ তিতিরকে এক প্রকার জোড় করেই নিজের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেল।

তিতির ব্যালকুনিতে গিয়ে দাড়ালো। আজ মাহাদও উপরের ব্যালকুনির দিকে কিছুক্ষন চেয়ে তারপর গাড়ী নিয়ে বের হয়ে গেল।

তিতির রুমে এসে কাঁদতে লাগলো। কান্নার শব্দে আসমা তিতিরের কাছে এসে বলল," আপা, আপনি নিজেও কষ্ট পাচ্ছেন ভাইজানকেও কষ্ট দিলেন।"

তিতির কোন কথা বলছেনা। শুধু চোখের পানিই ফেলেছে। তিতিরের কান্না দেখে আসমা বলল," আপা আমি ভাইজানকে ফোন দিচ্ছি। আপনি এমন করে কাঁদেন না।"

তিতির আসমার হাত ধরে কাছে বসাল। তারপর ওর পেটের উপর হাত রেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। আসমা, এই জিনিসটা ওনাকে কিছু দিতে চায়না। আমি ওনাকে কিছু দিতে পারবনা। আমি একজন অক্ষম নারী। যে আমাকে এত কিছু দিয়েছে, তাকে আমি বাবার স্বাধ কোনদিনই দিতে পারবোনা। এর থেকে কষ্টের কিছু আছে একটার মেয়ের জিবনে বলেই ট্রী টেবিলের উপর গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে দু'হাতে বারি বসাল তিতির। 

বিকট শব্দে কাচ ফেটে গিয়ে দু'টা কাচের টুকরো তিতিরের হাতের মধ্য গেঁথে গেল। সাথে সাথে হাত দিয়ে রক্তের ফোয়ারা ছুটল।

আপা বলে আসমা রক্ত দেখে অস্থির হয়ে গেল। আসমা কাছে আসতেই তিতির চিৎকার করে বলল," একদম আমার কাছে আসবেনা, আমার বাঁচার ইচ্ছা নেই বুঝেছ। আমার আর বাঁচার স্বাধ নেই।"

আপা পাগলামি করেন না। প্রতিটা সমস্যার একটা করে সমাধান রয়েছে। আপনি এত টেনশন নিচ্ছেন কেন। আমার মনে হয় ভাইজানের সাথে আপনার এই বিষয়ে কথা বলা উচিত।

সব সমস্যার সমাধান হয়না আসমা। কিছু সমস্যা ঐ উপরওয়ালার হাতে থাকে। আল্লাহ্ তুমি শুনতে পাচ্ছো! আমাকে কেন এত স্বপ্ন দেখিয়ে সব কিছু চোখের পলকে নিঃস্ব করে দিয়েছ? এমনটা কেন করলে ! আমার প্রতি এমন নিষ্ঠুর আচরন তুমি করতে পারলে?
আমার সমস্যার সমাধান নেই আসমা।  এইটুকু রক্ত দেখে তুমি কাঁপছ! এর থেকেও হাজার টন  আমার বুকের ভিতর রক্তক্ষরন হচ্ছে, আমি ভালো নেই আসমা, আমি কাউকে কিছু বলতে পারছিনা। আমার অত্যন্ত যন্ত্রনা হচ্ছে আসমা। আমি বাঁ..চ..তে চাইনা বলে দাঁতে দাঁত চেঁপে তিতির ঐ অবস্থায় হাত দিয়ে  আরো একবার আঘাত করল ঐ ভাঙ্গা ট্রী টেবিলের উপর। চোখের পলকে আরো বড় রকমের অঘটন ঘটে গেল। তিতির মেঝেতে পড়ে গেল। আমি বাঁচতে চাইনা আসমা, আমার সমাপ্তির মাধ্যমে সব কিছুর সমাধান হয়ে যাবে। মাহাদকে আর আমার কাছে আসার জন্য ওর মায়ের অবাধ্য সন্তান হতে হবেনা। আমিই সকল সমস্যার মূল।

আসমা ওখানেই দাড়িয়ে থেকে হিনু আপু হিনু আপু বলে গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিতে লাগল। মাহাদ চলে যাওয়ার পর আর দরজা বন্ধ করা হয়নি তাই আসমার চিৎকারে হিনু আর ওর মা দৌড়ে আসমার কাছে এসে দেখল, তিতির সেন্সলেস হয়ে পড়ে আছে। 

হিনু বড় বড় শ্বাস ফেলে বলল,"আসমা, এই একটু আগেই তো ও ঠিক ছিল। এর মধ্য এতসব হল কি করে! মাহাদ কই.....?"

ভাইজান চলে গেছে আপু।  আসমা এক দৌড়ে ওর রুমে গিয়ে মাহাদকে কল দিল।

মাহাদ এখনো বাসায় পৌছায়নি।  তিতিরের ব্যবহারে মাহাদ অত্যন্ত কষ্ট পেয়েছে। চোখ দু'টো লাল হয়ে আছে। মাহাদের ফোনে কল বেজে উঠতেই মাহাদ ফোন চেক করে দেখল, আসমা কল দিয়েছে। মাহাদ চোখের পানি মুছে  কলটা সাথে সাথে কেটে দিল। আবার বেজে উঠলো কল। আবার কেটে দিল। কয়েকবার কল কেটে দিয়ে পরে আবার ব্যাক করতেই আসমার কান্নার শব্দে মাহাদ গাড়ী কষে ব্রেক করল।

আপা বলেই আসমা চুপ করে গেল। ফোনটা সাথে সাথে কেটে গেল।

মাহাদ আর এক মুহুত্বও দেরি করলোনা। সমস্ত রাগ, অভিমান ঝেড়ে ফেলে মাঝরাস্তায় থেকে সাথে সাথে গাড়ী ঘুরিয়েই তিতিরের কাছে রওনা দিল।

♦♦♦♦

হিনু তিতিরের একটা কাঁচ খুলতেই সেখান থেকে আরও বেশি ব্লিডিং হতে লাগলো। হিনু তিতিরের কাছ থেকে দু'হাত দুরে সরে এল। মা আমার দ্বারা আর কিছু সম্ভব হবেনা। আমি সহ্য করতে পারছিনা। আসমা মাহাদকে কল দিয়েছ!

আসমা কাঁদতে কাঁদতে বলল, " বলেছি ভাইজানকে।"

হিনু তিতিরের মুখে পানি ছিটিয়ে দিল। কিন্তু কাজ হচ্ছেনা। হিনুর এবার প্রচন্ড ভয় ধরে গেল।

মাহাদ যখন বাসার গেটের কাছে এসে হর্ন বাজাল তখন গোলাব গিয়ে গেটের সামনে দাড়িয়ে পড়ল। মাহাদ গাড়ী নিয়ে ভিতরে ঢুকে গাড়ী থেকে বের হয়ে গোলাবকে কোলে নিয়েই বলল," গোলাব, তোর মা ঠিক আছে তো?"
গোলাব সাথে সাথে চুপসে গিয়ে মাহাদের বুকে চুপটি করে রইল।

মাহাদ বুঝে গেল ওর তিতির ঠিক নেই। কি হল এর মধ্য! হাজারটা চিন্তা নিয়ে দ্রুত সিড়ি বেয়ে উপড়ে উঠে গেল। রুমের ভিতর এসে তিতিরকে দেখে মাথা খারাপ হয়ে গেল মাহাদের। 

মাহাদকে দেখে হিনু স্বস্তির শ্বাস ফেলালো। মাহাদ আমি কিছু করতে পারছিনারে। আমার খুব শ্বাস কষ্ট হচ্ছে। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে বলে হাপাতে লাগল হিনু।

আন্টি ওকে নিয়ে যান। ব্লিডিং দেখে ওর সমস্যা হচ্ছে।  ওর শ্বাস কষ্ট বেড়েই চলছে।

হিনুকে ওর মা ধরে নিয়ে গেলে আসমা গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়ে আবার মাহাদের কাছে আসল। মাহাদ চুপ করে ওর কাজ করে যাচ্ছে।

আসমা, এসব হল কিভাবে?

"আসমা শুধু কেঁদেই চলছে."

আসমা, কিছু বলছি জবাব দাও বলে চিৎকার দিয়ে উঠলো মাহাদ।

আসমা প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেল। আসমা এক দৌড়ে অন্য রুমে চলে গেল।

মাহাদ আর কিছু না বলে সব কাঁচ হাত থেকে বের করল। তারপর হাত দু'টো ব্যান্ডেজ করে দিল। রক্তে তিতিরের জামা নষ্ট হয়ে গেছে। সব কিছু বদলিয়ে দিয়ে ওকে বেডে সুয়ে দিয়ে ঙ্গান ফিরানোর চেষ্টা করল। কাজ হলনা তাই রুম থেকে বের হয়ে আসমাকে ডেকে বলল," রুমটা দ্রুত পরিষ্কার করো। সাবধানে কাজ করো। দেখ, হাত যেন না কাটে।"

মাহাদের এমন শান্ত স্বভাব আসমার সব ভয় কেটে গেল। মাহাদ মেডিসিন নিতে  চলে গেলে আসমা তিতিরের রুমে গিয়ে পুরো রুম পরিষ্কার করার কাজে লেগে গেল।

♦♦♦♦

রাত দশটা বাজে। তিতির ঘুম থেকে জেগে উঠেছে। এর মধ্য তিতিরের সেন্স ফিরেছিল। কিন্তু মাহাদ ওকে ঘুমের ইনজেকশন পুস করেছিল তাই তিতির ঘুমিয়ে পড়েছিল। ব্যাথার মেডিসিন ঘুমের ভিতর ভালো কাজ  করে। তাছাড়া তিতির জেগে থাকলে ব্যাথার জন্য খুব কষ্ট পেত।

তিতির সামনে চেয়ে দেখলো মাহাদ কিছুটা দুরে চিয়ার নিয়ে বসে আছে।  তিতির একটু উঠে আধাশোয়া অবস্থায় মাহাদ........ বলতেই মাহাদ উঠে এসে তিতিরের গাল বরাবর ঠাশশশ্ করে একটা চড় বসিয়ে দিল।

" তিতিরের দু'হাতেই বান্ডেজ। গাল লাল হয়ে গেছে মাহাদের হাতের বর্জ্য আলিঙ্গনে। তিতির মাথা নিচু করতেই টপ করে চোখের পানি হাতের বান্ডেজের উপর পড়ল।"

"ভাইজান দয়া করে আপাকে মারবেননা। উনি ভালো নেই। ওনারতো কষ্ট হচ্ছে।"

আসমার এমন কথায় মাহাদ কঠিন চোখে আসমার দিকে চেয়ে বলল," আসমা, আমার মনে হয় কি  জানো! তুমি, তোমার আপা আর গোলাব তোমরা তিনজনেই আমার সাথে সব থেকে কঠিন খেলায় মেতে আছো। সবচেয়ে বেঈমানীর কাজ করবে তোমরা। যা সহ্য করার মত আমার ক্ষমতা থাকবেনা। যার মাসুল আমি কোনদিনই দিতে পারবোনা।"

মাহাদের এমন কথায় আসমা আর কিছু বলতে পারলোনা। গোলাবকে নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল।

আসমা চলে যেতেই মাহাদ দরজা বন্ধ করে শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে তিতিরের কাছে এসে বলল," এই ওঠ বিছানা থেকে। আর এসে আমার শরীরের ক্ষুদা মিটা।"

 এমন কথায় তিতির বিষ্ফোরিত চোখে মাহাদের দিকে চেয়ে বলল," মা....নে!"

মানে!  মানে কি বুঝতে পারছিস না? না তোর বোঝার বয়সই হয়নি? তোকে অনেক ছাড় দিয়েছি যার ফলাফল আজকের এইদিন আমাকে দেখতে হল। আর কোন ছাড় নেই। বৌ হয়েই যখন আমার কাছে এসেছিস তখন আমার দেহের ক্ষুদা তো তোকেই মেটাতে হবে। 

মাহাদের কথায় তিতির অত্যান্ত ভয় পেয়ে গেল। পা দু'টি গুটিসুটি করে নিল।

হ্যাঁ আমি এমনই ভয় তোর চোখে দেখতে চাই যখন তুই নিজে নিজে ভুল ডিসিশন নিতে যাবি। ডিসিশন নেওয়ার নেতা হয়ে গেছিস? কোন সাহসে তুই সুইসাইড করতে গিয়েছিলি?

আ....মি সুইসাইড করতে কে..ন যাবো! আমিতো......

আমিতো কি! ভিমরতি জাগছে তোর? 
এই এমন করে ঠকঠক করে কাঁপছিস কেন? এই তোর দম! এইনা তুই মরতে গিয়েছিলি! তুই যদি মৃত্যুর জন্য ভয় না পাস তাহলে আমাকে দেখে ভয় কেন পাচ্ছিস? এখনো তো তোরে ধরিইনি তার আগেই এই অবস্থা! ভাব যখন তোকে ধরব তখন তোর কি হাল করেই না ছাড়বো। মাহাদ ওর শার্টটা সম্পূর্ন খুলে ফ্লোরে ছুড়ে মারল। তারপর তিতিরের শরীরের উপর চড়াও হল।

মাহাদ আমাকে ছাড়েন বলছি। আমার গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট  করার আগে এমন কাজ করার কথাতো ছিলনা!

মাহাদ একটা তাচ্ছিল্য সহকারে হেঁসে বলল," আমাকে এত কষ্ট দেওয়ার অধিকার তোকে কে দিয়েছে? তুই না চাইলেও তোকে আমার কাছেই থাকতে হবে। আর ওয়াদার কথা বলছিস? তুই নিজে তোর ওয়াদা রেখেছিস! তাহলে আমার ওয়াদা খেলাপ করাতো এক চুটকির ব্যাপার।"

মা..হাদ বলে তিতির কিছু বলতে চাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই ঠোট কামড়ে ধরল মাহাদ।  তিব্র যন্ত্রনায় কেঁপে কেঁপে উঠছিল তিতিরের সম্পূর্ন দেহ.........

মাহাদ নেশায় পড়ে গেছে। এটা যেন তেন নিশা নয়। এটা তার সুখপাখি তিতিরের নেশা♥........

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন