১৯!!
-লিজা? প্লিজ শান্ত হও? আমাকে বলো কি হয়েছে। এভাবে কাঁদছ কেন তুমি? এই লিজা? তাকাও আমার দিকে?
লিজা মুখ না তুলেই দিহানকে আরো আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করলো। এই মানুষটাকে আজ নিজের একমাত্র অবলম্বন মনে হচ্ছে লিজার। অথচ এই লোকটাকে কত অপমানটাই না করেছে ও। লিজার এমন কান্না দেখে দিহানও রীতিমতো ভ্যাঁবাচ্যাঁকা খেয়ে গেছে। কি ঘটেছে সেটা বুঝতে না পারলেও ব্যাপারটা যে গুরুতর কিছু সেটা বেশ টের পাচ্ছে দিহান। নইলে লিজার মতো শান্ত মেজাজের একটা মেয়ে এভাবে ভেঙ্গে পড়তো না। লিজাকে এভাবে দেখতে একদমই ভালো লাগছে না দিহানের। ধীর হাতে আবার লিজার চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে ভাবনার রাজ্যে পাড়ি জমালো দিহান। এক বৃষ্টি ভেজা বিকেলে এই মেয়েটাকে প্রথমবার দেখেছিল দিহান। ওকে দেখার পরই দিহানের মনে হয়েছে এই বৃষ্টিবিলাসীটাকেই ওর সারাজীবনের জন্য পাশে চাই। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই মেয়েটা ভিড়ে হারিয়ে যায় সেদিন। অবশ্য ওকে খুঁজে পেতে তেমন বেগ পেতে হয়নি দিহানের। পাশেরই একটা কলেজে অনার্সের ছাত্রী ছিল তখন লিজা। কতদিন কতভাবে মেয়েটাকে ভালোবাসার কথা জানিয়েছে দিহান। অথচ বিন্দুমাত্রও আগ্রহ দেখায় নি এই মেয়েটা। অথচ সেদিনের সেই বৃষ্টিবিলাসীটা আজ দিহানের বুকে মুখ লুকিয়ে ফোঁপাচ্ছে। কান্নার দমকে যতবার মেয়েটার শরীরটা কেঁপে উঠছে ততবারই দিহানের বুকের ভেতরটা কেউ যেন ভেঙ্গেচুরে একাকার করে দিচ্ছে। দু বছর পরও সেই একই অনুভূতি হচ্ছে দিহানের। সাথে সেই একই হারানোর ভয়ও।
-বলুন তো পৃথিবীতে এমন কি কোনো জায়গা নেই যেখানে একটা মেয়েকে প্রতিদিন নিজেকে প্রমাণ করতে হয় না? প্রতিদিন কাজের জন্য বাসে চড়তে কারো বিশ্রি ছোঁয়া পাবার ভয় থাকে না। প্রমোশন দেয়ার নামে রাত কাটানোর প্রস্তাব শুনতে হয়। অথবা কাজে নিজের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার পরও তার পাশের একজনের ভালগার টন্ট শুনতে হয় না। এমন কি একটা দেশও নেই পৃথিবীতে? দেশ না হোক একটা শহর? একটা গ্রাম? এক টুকরো জমি? নেই একটাও?
-কে কি বলেছে তোমাকে লিজা? বলো আমাকে? কার এতো বড় সাহস আমার জানের দিকে বাজে নজর দেয়? তার চোখ জোড়া যদি আমি উপড়ে না ফেলি তো-----।
-আপনি জানেন? এর আগের দুটো অফিসেও এমনটাই হয়েছে। প্রথমবার একজন কাজ বোঝানোর নাম করে বিশ্রি করে ছুঁয়ে দিচ্ছিল বলে আমি তার গালে নিজের সব শক্তি দিয়ে চড় দিয়েছিলাম। তার কিছুই হয়নি জানেন? উল্টো আমাকেই বের করে দিয়েছে---।
-লিজা কোন কোম্পানি বলো আমাকে একবার। শালাদের পথে না বসালে আমার নামও দিহান শেখাওয়াত না। আর ওই হারামজাদার নামটাও বলো। ওকে তো আমি এই দুনিয়া থেকেই---।
-বহু কষ্টে আরেকটা জব জোগাড় করেছি। সেখানেও সেইম। সেখানে তো অফিসের বস নিজেই--। কি বিশ্রি প্রস্তাব দিয়েছিল জানেন? ওখানে নিজেই রেজিগনেশন দিয়ে দিয়েছিলাম। ফেরার পথে মরে যেতে ইচ্ছে করছিল জানেন? শুধু মা আর রিমনের কথা ভেবে আর মরতে পারি নি। এতোগুলো দিন ভয়ে ভয়ে কারো সামনেই বেশিক্ষণের জন্য দাঁড়াই নি পর্যন্ত। তবু আজ কিনা শুনতে হলো--।
-আজ কি হয়েছে লিজা? কি বলেছে সেটা বলতে না পারলে বলো না। শুধু তার নামটা বলো তুমি আমাকে---।
-ওরা কি ভাবে বলুন তো? একটা মেয়ে শুধু নিজের শরীর দেখিয়েই নিজের কাজ আদায় করে?
-লিজা? নাম বলো তুমি আমাকে। কে এসব বলেছে তোমাকে? তার কলিজাটা যদি আমি আজকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে না ফেলি--।
-ইন্টারভিউ দিতে এখানে যখন এসেছিলাম কত ভয় হচ্ছিল। রাহাত স্যার যখন জিজ্ঞেস করলেন 'আগের দুটো জব কেন ছেড়ে দিয়েছি' আমি ভয়ে একটা কথাও বলতে পারি নি। মায়া আপুকে পরে বলেছিলাম অবশ্য আলাদা করে। চাকরিটা ভিষণ দরকার আমার সেটাও বলেছিলাম। আপু থাকতে কখনো এতো বাজে পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়নি আমাকে। অথচ আজ কিনা আপুর নামেও লোকটা কত কথা বলছে---। বলে কিনা আপুও নাকি রাহাত স্যারের সাথে----।
-তুমি কান্না থামাবা লিজা? নামটা বলো তুমি আমাকে। বাকি সব পরে শুনবো। আগে লোকটার নাম বলো। নাম। কি হলো বলো?
দিহানের ধমক শুনে এবারে যেন ঘোর কেটে বাস্তবে ফিরে এলো লিজা। আর সাথে সাথেই দিহানকে ছেড়ে দিয়ে পিছিয়ে গেল। কাঁদতে কাঁদতে যে হেঁচকি উঠে গেছে সেটাও লিজা টের পায়নি এতোক্ষণ। এবারে লজ্জায়, ভয়ে, আতঙ্কে একেবারে চুপ করে গেল বেচারি। এতোক্ষণ কি করছিল ভেবে নিজেকেই মনে মনে বকলো। দিহানও ব্যাপারটা বুঝতে পেরে লিজার মুখটা দু হাতে তুলে ধরে চোখে চোখ স্থির করলো।
-এতো কিছু যখন বলে ফেলেছ এবার লোকটার নামটাও বলে দাও প্লিজ লিজা? প্রমিস করছি তোমার নামটা সামনেও আসবে না। শুধু আমাকে ওই অমানুষটার নাম বলো। বলো না প্লিজ?
-কিছু না স্যার। আপনি এখনও বসে আছেন অফিসে? স্যার তো আজও আসে নি। ইনফেক্ট পুরো সপ্তাহই স্যার আসেনি। আপনি প্লিজ উনার সাথে বাড়িতে গিয়েই দেখা করে নিন।
-তোমাকে এতো কথা কেউ জিজ্ঞেস করেছে? যেটা জানতে চাইছি সেটা বলো। নইলে কিন্তু এবার মাফ করবো না লিজা---।
-ছাড়ুন স্যার।
-তুমি প্রত্যেক বার কেন এতো লুকোচুরি করো আমার সাথে? আগের বার বললে আমাকে ভালোবাসো না। ভালোবাসবে না। কেন? কারণ অন্য কাউকে বিয়ে করে সেটেল্ড হবে। এই তোমার সেটেল্ড হওয়া? তোমার উপরে রাগ করে দেশ ছেড়েছিলাম। কিন্তু কি ভাবো? তোমার কোনো খোঁজ আমি রাখি নি? তুমি গত দু বছরে কোথায় কোথায় চাকরির এপ্লাই করেছ সেটার হিসেবও আমার কাছে আছে। তুমি শুধু নামগুলো বলো আমাকে। আমি পাতাল থেকে হলেও হারামজাদাগুলোকে তুলে আনবো। বলো?
-লাগছে আমার। ছাড়ুন?
-আগেরবার তো তোমার কথায় ছেড়েছিলাম। কি লাভ হলো তাতে? বাচ্চা পেয়েছ আমাকে? তোমার ভালো না লাগলেও এবারে জোর করে হলেও তোমাকে নিজের করবো আমি। কথাটা মাথায় ঢুকিয়ে নাও। মিস লিজা নয়, এবার মিসেস দিহান শেখাওয়াত পরিচয়ে মাথা উঁচু করে চলার জন্য রেডি হও।
-ছাড়ুন। আপনাকে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব না। আপনাকে না। কাউকেই বিয়ে করা সম্ভব না আমার।
-তোমার ছোটভাইয়ের নাম রিমন রাইট? কোন ক্লাসে যেন পড়ে লিজা?
-মানে?
-না মানে বলছিলাম রিমন এইবার ক্লাস এইটে তো রাইট? ধরো কাল যদি ওকে স্কুল থেকে রাস্টিকেইট করা হয়? তাহলে কেমন হয় বলো তো?
-কি বলছেন এসব? ওকে কেন স্কুল থেকে---?
-আচ্ছা রিমনের কথাটা নাহয় বাদ দাও। তোমার মা তো রোজ সকালে বাজারে যায় তাই না? ধরো তখন যদি একটা গাড়ি এসে জোরে ধাক্কা দিয়ে চলে যায় মাকে? হসপিটালে নেয়ার জন্য একটা লোকও এগিয়ে না এলে---?
-দিহান?
লিজা দিহানকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে রাগে ফুঁসছে। এই লোকটা এমন করতে পারে স্বপ্নেও হয়তো ভাবতে পারে নি লিজা। দিহান ঠোঁটের কোণে মিষ্টি একটা হাসি ফুটিয়ে লিজার রাগে লাল মুখটার দিকে তাকিয়ে আছে দেখে লিজা এবারে দিহানের কলার চেপে ধরে তাকালো দিহানের মুখের দিকে। দিহানও মিষ্টি হেসে লিজার কোমড় জড়িয়ে ধরে সরাসরি লিজার থতমত চেহারার দিকে তাকালো।
-কি হলো ম্যাডাম? এখনই এভাবে কাছে টানছেন কেন এতো? আগে বিয়েটা তো হতে দাও? তারপর নাহয়---।
-আপনি মানুষ? অসভ্য লোক একটা। আমার মা আর ভাইয়ের কিছু করার কথা চিন্তা করলেও খুন করে ফেলবো আপনাকে আমি।
-আচ্ছা খুন করে ফেলো। তার আগে বলো লোকটা কে ছিল?
-ধ্যাত। কেউ ছিল না। ছাড়ুন?
-কেউ ছিল না তো? চলো তুমি? আমাকে যখন বলবেই না তাহলে রাহাতের বাসায় চলো। ও তো তোমার বস হয় না? ওকেই বলবা--।
-না না না। এই জবটা চলে গেলে মা আর ভাইকে নিয়ে হয়তো রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াতে হবে আমাকে। অসম্ভব। আমি কাউকে কিচ্ছু বলতে চাই না। যান আপনি এখন।
-লিজা? তোমার চাকরি করতে হলে আমার অফিসে জয়েন করবা। আমার সবকিছুতেই তোমার অধিকার আছে পাগলি। যদিও আমি জানি রাহাত তোমাকে ফায়ার্ড করবে না। তবু--।
-দেখুন এই চাকরিটা আমি নিজের যোগ্যতায় পেয়েছি। কারো দয়ার দান আমি চাই না। আপনি আসুন এখন। আমার কাজ আছে।
-দয়ার দান না কি সেটা কয়দিন পরেই টের পাবা। সবটা গুছিয়ে নিই আগে। তারপর তোমার এই তিড়িং বিড়িং করাও বন্ধ করছি আমি দাঁড়াও না।
-যান তো এখন? কাজ করতে দিন আমাকে।
দেখতে দেখতে আরো দুটো দিন কেটে গেছে। সেদিনের পর আর স্মৃতি সত্যিই আসে নি রাহাতের স্বপ্নে। অবশ্য রাহাতও হাজার ইচ্ছে স্বত্বেও একটা বারের জন্যও মায়ার সাথে কোনো যোগাযোগেরই চেষ্টা করে নি। দূরে গিয়ে যে ভালো থাকবে জানে, তাকে কেন আটকাবে রাহাত? কথাগুলো ভাবতে ভাবতে কাজে মন দেয়ার চেষ্টা করছিল রাহাত। হঠাৎ একটা নকের শব্দে চমকে মুখ তুলে দরজার দিকে তাকালো রাহাত। এই শব্দটা রাহাতের পরিচিত। প্রায় নিঃশব্দে রাহাতের রুমের দরজায় এসে দাঁড়ানো মায়াপরীটার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো রাহাত। মায়াবতীটা সত্যি এসেছে নাকি স্বপ্ন দেখছে সেটাই বুঝতে পারছে না বেচারা। মায়া কিছুটা ইতস্তত করে আবার দরজায় নক করলো।
-স্যার? আসবো?
মায়ার কণ্ঠ শুনে রাহাত তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়ালো।
-আরে মায়াবতী? এসো এসো? পারমিশন কেন নিচ্ছ? আমার রুমে আসতে তোমার পারমিশন লাগে নাকি?
-যখন বিনা পারমিশনে আসতাম তখন তো আপনার সেক্রেটারি ছিলাম স্যার। এখন তো কেউ না। না অফিসের না আপনার---।
-মায়া? আসলেই কি কেউ না?
-আপনাকে কয়েকটা জিনিস দিতে এলাম স্যার। একচুয়েলি দিতে না ফেরত দিতে এলাম।
-ফেরত? কি?
মায়ার হাতে থাকা শপিং ব্যাগটা এতোক্ষণ রাহাতের চোখে পড়ে নি। এবারে মায়া ব্যাগটা চেয়ারের উপরে রাখতেই রাহাত ভ্রু কুঁচকে মায়ার দিকে তাকালো।
-এতো কিছু? কি আছে ব্যাগটায় মায়া?
-আপনার দেয়া সেদিনের গাউন, নেকলেস, ব্রেসলেট এসব।
-এগুলো আমার গিফ্ট ছিল মায়াবতী। ফিরিয়ে কেন দিচ্ছ?
-কোন অধিকারে আপনার গিফ্ট নিজের কাছে রাখি বলুন তো স্যার? যদি পি.এ হওয়ার খাতিরে এসব দিয়ে থাকেন, তাহলে এখন জবটা তো নেই। আর ভালোবাসার খাতিরে দিলে, ভালোবাসাও তো নেই আমাদের। কখনো ছিলই না। আপনার ছোট ছোট কেয়ার, মুগ্ধতাগুলোকে বোকার মতো কতো কিছু ভেবে বসে ছিলাম আমি। এই সব জিনিস সেগুলো আরো বেশি করে মনে করিয়ে দিবে আমাকে। যদি কখনো আবার কাউকে ভালোবাসতে পারেন তাহলে তাকেই নাহয় দিবেন।
-তোমার জিনিস আমি অন্য কাউকে কি করে দিবো মায়া?
-না দিতে পারলে নাহয় ফেলে দিবেন।
-মায়া?
-আর পাঁচ দিন পর আমার বিয়ে স্যার। সবার আগে কার্ডটা আপনাকেই দিতে এলাম।
-ওহ! থ্যাংকস।
-আমার বিয়েতে কিন্তু অবশ্যই আসবেন স্যার। ও হ্যাঁ। গায়ে হলুদেও। আমি কিন্তু অপেক্ষা করবো আপনার।
-মায়া? আমি----।
-প্লিজ স্যার। কাজ আছে বলে এড়িয়ে যাবেন না। আসতেই হবে। আপনাকে না পাই, আপনার শুভকামনা নিয়েই নাহয় আমি আমার নতুন জীবনটা শুরু করবো।
-আসবো আমি মায়া। আসবো।
-ধন্যবাদ স্যার। আসছি। দ্বীপ অপেক্ষা করছে নিচে। আসছি।
-হুম।
মায়া আর একবারও পিছনের দিকে না তাকিয়ে সোজা রুম থেকে বেরিয়ে গেল। রাহাত থ হয়ে শুধু ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। কি মনে হতেই ধীর পায়ে কাঁচে ঢাকা জানলার দিকে এগিয়ে গেল রাহাত। জানালাটা দিয়ে অফিসের পার্কিংটা বেশ সুন্দর করেই দেখা যায়। সেখানে চকচকে সিলভার কালারের গাড়িটায় চোখ পড়তেই রাহাত পাশ থেকে কিছু একটা তুলে নিয়ে আক্রোশে নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে হাতের মুঠোর মধ্যে পিষে ফেলার চেষ্টা করলো। রাগটা সামলাতে না পেরে জিনিসটাকে রুমের ফ্লোরে আছড়ে ফেলতেই সেটা ঝনঝন শব্দে সারা ফ্লোর জুড়ে ছড়িয়ে পড়লো। রাহাত তবু ভাবলেশহীন হয়ে সোজা নিচের গাড়ির দিকেই তাকিয়ে আছে। এদিকে তার হাত কেটে যে রক্ত টুপটাপ করে ঝরছে সেই হুঁশও নেই লোকটার।
২০!!
রাহাত বেশ মনযোগ দিয়ে অফিসের পার্কিং এরিয়ায় দাঁড়িয়ে থাকা দ্বীপের গাড়িটার দিকে তাকিয়ে রইলো। এতোক্ষণে মায়ার নিচে পৌঁছে যাওয়ার কথা। তাহলে তো গাড়িটার বিল্ডিংয়ের নিচে দাঁড়িয়ে থাকার কথা নয়। মায়া কি তাহলে এখনো নিচে পৌঁছায় নি? নাকি দ্বীপের সাথে যায় নি? কথাটা খেয়াল হতেই অজান্তেই একটা তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠলো রাহাতের ঠোঁটের কোণে। পিছন থেকে আবার দরজায় নকের শব্দ শুনেও নিজের জায়গা থেকে ফিরেও তাকালো না রাহাত। তার দৃষ্টি এখনো মায়াবতীর খোঁজে ব্যস্ত। শফিককে আসতে বলেছিল রাহাত কিছুক্ষণ আগেই। তাই রাহাত ধরেই নিয়েছে শফিক এসেছে।
-ফ্লোরটা পরিষ্কার করে দিয়ে এক কাপ কফি দিয়ে যাও তো শফিক। আর লিজাকে বলে দিও আজ আমার সব মিটিং যেন ক্যান্সেল করে দেয়। আর কেউ যেন রুমে না আসে।
রাহাতের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা এক পা দু করে এগিয়ে এসে ফ্লোর থেকে গ্লাসের টুকরো পরিষ্কার করায় লেগে গেল। একটু পরে হাতে কিছুটা ব্যথা অনুভব করায় রাহাত কিছুটা বিরক্ত হয়েই হাত ঝাড়া দিয়ে পিছনের দিকে ঘুরে তাকালো। আর পিছনে ফিরতেই রীতিমতো চমকে উঠলো রাহাত। মায়াবতীটা ফ্লোরে বসে একমনে ভাঙ্গা গ্লাসের টুকরোগুলো এক পাশে জড়ো করছে। মায়াকে সামনে দেখে রাহাতের পুরো দুনিয়াটাই যেন কয়েক সেকেন্ডের জন্য সেখানেই থমকে গেল। যাকে এক নজর দেখার আশায় সে চাতক পাখির মতো নজর পেতে বসে আছে সেই কিনা রাহাতের সামনে ফ্লোরে বসে আছে। রাহাত এক পা দু পা করে এগিয়ে এসে মায়ার সামনে ফ্লোরেই ধপ করে বসে পড়লো। কিছু না ভেবেই মায়ার একটা হাতে হাত রাখলো। মায়াও চমকে উঠে হাত সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করতেই একটা তীক্ষ্ম কাঁচের টুকরোয় হাত লেগে হাতের তালু অনেকখানি কেটে গেল। রাহাত তাড়াতাড়ি মায়ার হাতটা চেপে ধরলো। ক্ষতটা গভীর না হলেও বেশ রক্ত বের হচ্ছে মায়ার হাত থেকে।
-আম সরি, আম সরি, আম সরি মায়া। কতখানি কেটে গেছে! ইশ! আম সরি মায়াবতী।
-আরে স্যার? আমার কিছু হয়নি। কিন্তু আপনার হাতে----?
রাহাত মায়ার কথা শেষ হওয়ার আগেই ছুটে গিয়ে ফাস্টএইড বক্স নিয়ে এলো। তারপর আলতো হাতে মায়ার হাতের কাটা অংশটা স্যাভলন দিয়ে মুছিয়ে দিয়ে ভালো করে ব্যান্ডেজ করে দিলো। লোকটার আতঙ্কিত মুখটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ভাবার চেষ্টা করছে মায়া। নিজের হাতে যে কাঁচের টুকরোগুলো এখনো গেঁথে আছে, সেখান থেকে যে এখনও ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত ঝরছে সেদিকে যেন বিন্দুমাত্রও খেয়াল নেই লোকটার। উল্টো মায়ার হাতের ব্যথাটাই যেন রাহাতের বেশি ফিল হচ্ছে। রাহাত কিছু বলার জন্য মুখ তুলতেই দুজনের চোখাচোখি হয়ে গেলে মায়া কিছুটা ইতস্তত করে চোখ নামিয়ে নিলো। রাহাত মায়ার হাতটা ছেড়ে দিয়ে মায়াকে টেনে ফ্লোর থেকে উঠানোর চেষ্টা করতে গিয়ে ব্যথায় কিছুটা কঁকিয়ে উঠলো। মায়া তাড়াতাড়ি রাহাতের হাতটা ধরে আটকালো। মায়াকে উঠাতে গিয়ে রাহাতের হাতে ভাঙ্গা কাঁচের টুকরোগুলো আরো কিছুটা গেঁথে গেছে।
-স্যার আপনি ঠিক আছেন?
-ইয়া আম ফাইন। তোমার হাতে কি বেশি ব্যথা করছে মায়াবতী? ইশ! কতোখানি কেটে গেছে! দাঁড়াও আমি এক্ষুণি ডাক্তারকে কল করছি।
-আরে? দাঁড়ান?
-উঠো তুমি। নইলে দেখা যাবে আবার পা কেটে বসে থাকবা। তোমাকে এসবে হাত দিতে কে বলেছে? আশ্চর্য! ফিরে এসেছ ভালো কথা। তাই বলে এভাবে বোকার মতো কাজ করবা নাকি?
-চুপ। দেখি আপনার হাতটা---?
-আরে! আমার কিছু হয়নি তো মায়াবতী---।
-হাত দেখাতে বলেছি না আপনাকে?
রাহাত নিজের হাতটা এগিয়ে দিতেই মায়া আঁতকে উঠলো। হাতের তালুতে গ্লাসের ভাংগা টুকরো গেঁথে কেমন বিভৎস হয়ে আছে। মায়া তাড়াতাড়ি রাহাতকে একটা চেয়ারে বসিয়ে গিয়ে খুব ধীরে কাঁচের টুকরোগুলো বের করলো। তারপর ভালো করে ড্রেসিং করে দিয়ে হাতে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়ে রাগী চোখে রাহাতের দিকে তাকালো। রাহাত ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে মায়াবতীর রাগী মুখটা দেখছে। আজ কেন জানি মায়াবতীর এই অধিকারের শাসনটা দেখতে ভালো লাগছে রাহাতের। কই এর আগে এমন অনুভূতি তো কখনো হয় নি রাহাতের! তবে আজ কেন এমন হচ্ছে? কেন মনে হচ্ছে এই মেয়েটার রাগে টুকটুকে লাল মুখটাতেও স্বর্গীয় সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে? মায়া এবারে রাগ করে রাহাতের হাতে জোরে একটা চিমটি কাটলো। রাহাত ভাবনার দুনিয়া থেকে বাস্তবে ফিরে এসে হাত ডলে মায়ার মুখের দিকে তাকালো।
-আউচ! আরে কি মুশকিল! চিমটি কাটলে কেন এতো জোরে?
-কানে শুনতে পান না আপনি? হাত কেটে যে বসে আছেন ইনফেকশন হলে কি করবেন হ্যাঁ? এভাবে ক্ষত জায়গা কেউ খোলা ফেলে রাখে?
-আরে! এতোটা কেটে গেছে বুঝতেই পারি নি।
-কেন? কি করছিলেন এতো মনযোগ দিয়ে? কাকে দেখছিলেন নিচে?
-আমম। নাহ। আসলে--। কিছু করছিলাম না। কাউকে দেখছিলাম না। তুমি আবার ফিরে এলে যে? কিছু রয়ে গেছে?
-হুম। রয়ে গেছেই তো।
-কি?
-মোবাইল। ভুলে আমার মোবাইলটা আপনার রুমেই রেখে চলে যাচ্ছিলাম।
-ওহ! আমি আরো ভাবলাম---।
-কি ভাবলেন শুনি?
-নাহ। কিছু না। এখন কোথায় যাবে?
-আরো পরিচিত কয়েকজনকে কার্ড দিতে যেতে হবে।
-ওহ!
-আসছি স্যার। মনে করে ডাক্তার দেখাবেন। আর সময় মতো ড্রেসিংটা চেইঞ্জ করবেন। নইলে কিন্তু ইনফেকশন হয়ে যেতে পারে। কতটা কেটেছে!
-হুম। আচ্ছা।
-বায় স্যার।
-বায় মায়াবতী।
মায়া আর কিছু না বলে চুপচাপ বেরিয়ে গেল রাহাতের রুম থেকে। মায়ার ঠোঁটের কোণে মিষ্টি একটা হাসি ফুটে উঠেছে বহুদিন পরে। রাহাতের মুখটা দেখেই মায়া বুঝতে পেরেছে এতোক্ষণ যে লোকটা উপর থেকে মায়াকেই দেখার চেষ্টা করছিল। অথচ মুখ ফুটে কিছুতেই বলবে না সে। মায়াও এবার নিজের মনেই পণ করলো। রাহাত সামনে এসে বিয়ে করার কথা না বলা পর্যন্ত, নিজের মনের কথা না জানানো পর্যন্ত মায়াও দ্বীপের সাথে বিয়ের এই খেলাটা চালিয়ে যাবে। দ্বীপকে যতই অসহ্য লাগুক না কেন রাহাতের জন্য মায়া নাহয় তাকেও কয়টা দিন সহ্য করে নিবে। নিজের মনেই ভাবলো মায়া। এবার তোমার পরীক্ষার পালা রাহাত। বিয়ের আসর পর্যন্ত আমি নাহয় তোমার অপেক্ষায় থাকবো। আমিও দেখি তুমি কতদিন নিজের সাথে এভাবে লুকোচুরি খেলাটা চালিয়ে যেতে পারো। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে মায়া অফিসের গেইট দিয়ে বড় রাস্তায় বের হলো।
মায়া চলে যেতেই রাহাত নিজের ব্যান্ডেজে বাঁধা হাতটা অন্য হাতে ছুঁয়ে দিয়ে হাসলো একবার। আবার এসে আগের জায়গাটায় দাঁড়িয়ে মায়াকে মেইন বিল্ডিংয়ের গেইটটা দিয়ে বেরিয়ে যেতে দেখে অবাক হলো নাকি খুশি হলো নিজেও জানে না রাহাত। দ্বীপের গাড়িটা নেই সেখানে। হয়তো কিছুক্ষণ আগেই চলে গেছে। কিন্তু মায়াকে একা যেতে দেখে এতো খুশি লাগছে কেন সেটাও রাহাত বুঝতে পারলো না। এর মধ্যেই পিয়ন শফিক রুমে এসে রুমের ফ্লোরটা পরিষ্কার করে দিয়ে গেছে। রাহাতও এবার উৎফুল্ল মনে নিজের কাজে মন দেয়ার চেষ্টা করলো। এই কয়দিনে বহু কাজ জমা হয়ে গেছে। সেগুলো রিকভার না করলে অনেক বড় লোকসান হয়ে যেতে পারে।
এদিকে, মায়া মেইন রোডে দাঁড়িয়ে ট্যাক্সির জন্য অপেক্ষা করছিল এমন সময় একটা সিলভার কালারের গাড়ি মায়ার সামনে এসে থামলো। মায়া চমকে কিছুটা পিছিয়ে যেতেই দ্বীপ গাড়ির জানলার কাঁচ নামিয়ে মায়ার দিকে তাকালো। হালকা গোলাপি রঙা একটা থ্রি পিস জামা পড়নে মেয়েটার। তেমন সাজ না থাকলেও এই জামাটায় মেয়েটাকে এতোটা স্নিগ্ধ লাগছে দেখেও দ্বীপের কেন যেন রাগ লাগছে প্রচন্ড। মায়ার হাতের নতুন ব্যান্ডেজটাও চোখ এড়ালো না দ্বীপের। মায়ার মাথা থেকে পা পর্যন্ত চোখ বুলিয়ে নিয়ে পাশের দরজাটা খুলে দিলো দ্বীপ। মেয়েটা যে দ্বীপকে একদমই আশা করে নি এখানে সেটা ওর মুখের ভঙ্গিটাই বলে দিচ্ছে। দ্বীপের তাতে অবশ্য কিছু যায় আসে কিনা কে জানে। মায়া কিছুটা ইতস্তত করে গাড়ির সামনে এগিয়ে এসে দাঁড়িয়ে রইলো। দ্বীপের সাথে এক গাড়িতে যাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে মায়ার নেই।
-কি হলো? রাস্তার মাঝখানে এমন সংয়ের মতো দাঁড়িয়ে আছো কেন? উঠে এসো? বাসায় পৌঁছে দিচ্ছি----।
-আম। আপনি চলে যান দ্বীপ। আমার একটু কাজ আছে। এখন বাসায় যাবো না আমি---।
-তাহলে কোথায় যাবে? ভরদুপুরে কি শুরু করেছ এসব? চুপচাপ উঠে এসো বলছি মায়া?
-আমার কাজ আছে বলছি তো। পরিচিত কয়েকজনকে কার্ড দিতে যাবো। ইনভাইট করা অলমোস্ট কমপ্লিট। উনারাই বাকি শুধু।
-বিয়ে নিয়ে তোমার এক পারসেন্টও আগ্রহ আছে বলে তো আমার মনেই হয় না। তা হঠাৎ বিয়ের কার্ড বিলি করায় এতো আগ্রহ কেন? নাটকটা কার সাথে করছ তুমি? নিজের সাথে? নাকি তোমার ওই রাহাত স্যারের সাথে?
-দেখুন দ্বীপ। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমি যাচ্ছি। আর আমার কাজগুলো নাটক মনে হলে আপনার জন্য অপশন তো খোলাই আছে। কেউ আপনার হাতে পায়ে ধরে তো আমাকে বিয়েটা করতে বাধ্য করায় নি না? তাহলে? এতোই যদি সমস্যা আপনার আমাকে নিয়ে তাহলে বাসায় বলে দিলেই তো পারেন যে বিয়েটা করবেন না।
-তাহলে তো তোমার খুব সুবিধা হয় না? স্যার বাধ্য হয়ে তোমাকে বিয়েটা করে নিবে তাই না? সেটা হচ্ছে না মায়াবতী। আমার স্যাটিসফেকশন না হওয়া পর্যন্ত তোমাকে আমি অন্য কারো হতেই দিবো না---।
-আপনার এসব আজাইরা আলাপ শোনার সময় আমার হাতে নেই। বাসায় ফিরতে হবে আমারও। আসি।
মায়া দ্বীপের গাড়িটার থেকে সরে আসার আগেই দ্বীপ মায়ার ব্যান্ডেজ করা হাতটা চেপে ধরে মায়াকে গাড়ির ভিতরে টেনে নিয়ে গাড়িটা স্টার্ট দিলো। মায়া ব্যথায় কঁকিয়ে উঠেও পরের মূহুর্তেই গাড়ির দরজা ধরে টানাটানি করে খোলার চেষ্টা করলো। এদিকে গাড়ির স্পিডও প্রতি সেকেন্ডেই বেড়ে চলেছে দেখে কিছুটা ভয় পেয়ে গেল মায়া।
-চুপচাপ বসে থাকো মায়া। অযথা লাফালাফি করে নিজের এনার্জি নষ্ট করার কোনো মানেই হয় না।
-আজব তো! এভাবে জোর করে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আপনি আমাকে?
-জোর করা কাকে বলে সেটা আজকে টের পাবে মায়া। তোমাকে বারণ করেছিলাম না রাহাতের কাছে যেতে? তবুও কোন সাহসে গেলে ওর কাছে? খুব পাখা গজিয়েছে না তোমার? আজ তোমার পাখা ছাঁটাই করবো আমি।
দ্বীপের শান্ত কিন্তু কর্কশ কণ্ঠটা শুনে রীতিমতো হাত পা কাঁপছে মায়ার। কি করতে চাইছে এই লোকটা সেটাই বুঝতে পারছে না বেচারি। তবু কেন জানি ভয় হচ্ছে মায়ার। প্রচন্ড ভয়।