তিতির সামনের কড়ই গাছের সাথে হেলান দিয়ে দাড়াল। শরীরটা খুব দুর্বল লাগছে। চলার শক্তি নেই। কাঠফাটা রৌদ্দে দরদর করেই ঘেমেই চলছে। চোখের সামনে যা কিছু দেখছে সব কিছু আবছা দেখাচ্ছে। কিছু বই নিতে আসছিল লাইব্রেরী হতে। কিন্তু তার আগেই এমন একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেল।
তিতির অনেক কষ্টে ফোন বের করে মাহাদকে কল দিল। মাহাদ তখন মিটিং এ ব্যস্ত ছিল। ফোন ভাইব্রেশনে কেঁপে উঠতেই মাহাদ ফোন বের করে দেখলো তিতিরের কল। হাই এভরিবডি জাষ্ট ফাইভ মিনিট বলে মাহাদ রুম থেকে বের হয়ে গেল। ফোনটা রিসভ করতেই তিতিরের ক্লান্ত কন্ঠ শোনা গেল।
"মাহাদ আমার শরীরটা খুব খারাপ লাগছে। আপনি একটু আসবেন? আমি ভার্সিটিতে আছি।"
" মাহাদ সাথে সাথে ওর পিএ মি. মাহফুজুর রহমানকে বলল," আমি ওনাদের কাছে কাজ সম্পর্কে প্রস্তাব রেখেছি। বাঁকিটা সময় শুধু তাদের মতামত নেন। পুরো সময়টা ভিডিও করার ব্যবস্থা করেন। পুরো ভিডিও ক্লিপটা ইমেল করবেন আমাকে।"
মাহাদ আর এক মুহুত্বও দেরি না করে কিছুসময়ের মধ্যে ভার্সিটির গেটের সামনে এসে গাড়ী থামিয়ে ভিতরে যেতেই দেখলো দুরে একটি গাছের বেঁদিতে তিতির চুপ করে বসে আছে। মাহাদ তিতিরের কাছে গিয়ে বসে বলল," তিতির তুমি ঠিক আছো?"
" আমি কিছু বুঝতে পারছিনা। আমার এমন লাগছে কেন? আমার মাথাটা প্রচুর যন্ত্রনা করছে আর ঘুরছে। আমার চলার মত শক্তি নেই।"
" মাহাদ ভ্রু কুচকে বলল," কখন থেকে এই সমস্যা হচ্ছে!"
" ঘন্টা খানেকের মত হচ্ছে।"
মাহাদ তিতিরের হাত ধরে নিয়ে চলল। তিতিরকে গাড়ীতে উঠিয়ে মাহাদ ড. রফিককে কল দিলেন। ড. রফিক তিতিরের সব উপস্বর্গ শুনে বলল," ওকে আমার কাছে এখন একবার নিয়ে আসতে পারবেন?"
" ওকে ডক্টর আমি এখুনি নিয়ে আসছি। এই যেতে যতটুকু সময় লাগবে।"
মাঝ রাস্তায় তিতির বার বার মাহাদকে অস্পষ্ট স্বরে বলল," মাহাদ আপনি কি আমায় ছেড়ে যাবেন?"
মাহাদ তিতিরের কথার দিকে কান না দিয়ে গাড়ী ড্রাইভ করতে লাগল। আধা ঘন্টার ভিতর তিতিরকে নিয়ে হসপিটালে চলে গেল।
তিতিরের অবস্থা খারাপ। বার বার খিচুনি উঠছে। চোখে ঝাপসা দেখছে। মাথার পিছনে অসহ্য ব্যাথা করছে। এতকিছুর পরও তিতিরের মুখে একটাই কথা। মাহাদ আপনি কি আমাকে ছেড়ে যাবেন?
ডাক্তার প্রথমেই স্যালাইন পুশ করলো। স্যালাইনের মধ্য আরও কয়েকটা ইনজেকশন দিল। একটু সময় নিয়ে তিতির ঘুমিয়ে পড়লো।
ড. রফিক মাহাদের সাথে বসলেন এবার। মাহাদ, ওর ব্রেনে তো প্রচুর পেসার পড়েছে। এই অবস্থায় এখনো ও স্বাভাবিক আছে কিভাবে আমি সেটা কিছুতেই বুঝতে পারছিনা। আমার মনে হয় এটা উপরওয়ালা প্রদত্ত একটা ক্ষমতা। আমাদের মাঝেই অনেক মানুষদের এমন ন্যাচারাল পাওয়ার রয়েছে। একেক জনের একেক রকম শক্তি। ভিষন মনের দিক হতে শক্তিশালী মেয়ে একজন আপনার স্ত্রী।
মাহাদ চুপ করে সব কথা শুনে যাচ্ছে। মাহাদের একটায় ভাবনা, এমন কি ঘটনা ঘটল যার জন্য তিতির অসুস্থ হয়ে পড়ল। এত দুঃশ্চিন্তা ওর কেন?
মাহাদ, স্যালাইন শেষ হয়ে গেলে ওকে নিয়ে যান। তারপর গোসল করিয়ে খাবার খাওয়াবেন। ওর শরীরের পেশার খুব লো। যে কয়টা মেডিসিন দিলাম সেগুলো ঠিকমত খেলে ঠিক হয়ে যাবে। আর হ্যাঁ ওর কিন্তু কিছুদিন আগে অনেক বড় এক্সিডেন্ট হয়েছে। সেই কথাটা সবসময় মাথায় রাখবেন।
মাহাদ কয়েকঘন্টা পর সেখান হতে তিতিরকে নিয়ে বাসায় চলে আসলো। তিতিরের ঘুম ভেঙ্গে গেলেও তখনো তিতিরের চোখে ঘুম ঢুলঢুল করছে। বাসায় এসে তিতিরকে বিছানায় বসিয়ে দিতেই আসমা তাড়াহুড়া করে এসে বলল," ভাইজান, আপার কি হয়েছে?"
তেমন কিছু না। আসমা খাবার রেডী করো তো! তুমি খেয়েছ? না খেয়ে থাকলে যাও খেয়ে নাও।
আসমা চলে গেলে মাহাদ টাওয়াল নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। একটু পর এসে তিতিরকেও নিয়ে গেল। ঝর্নার নিচে দু'জনেই একসাথে দাড়িয়ে আছে। ঝর্নার পানিতে এই প্রথম তারা একসাথে গোসল করছে। মাহাদের মন চাচ্ছে আজ বেহাপানা করতে। মন চাচ্ছে সব শর্তের বাধা ভেঙ্গে ফেলতে। নিজের শার্টের বোতাম খুলছে আর তিতির এক দৃষ্টিতে মাহাদের দিকে চেয়ে রয়েছে।
মাহাদ কিছু বলছেনা কিন্তু কাজ করে দেখাচ্ছে। মাহাদ, আপনি কি করতে চাইছেন?
" ফিলিংস উঠলে দমিয়ে রাখো তিতির। সব কিছু স্বাভাবিক ভাবে নাও। আমি কিছুই করতে চাচ্ছিনা।"
" কিন্তু আমি অনেক কিছু করতে চাচ্ছি বলেই তিতির মাহাদকে জড়িয়ে ধরল।"
মাহাদ প্রথমে তিতিরকে কয়েকবার ছাড়তে বললো, কিন্তু কাজ হল না। তিতির আজ মাহাদকে ছেড়ে দিতে একদম নারাজ। যে আগুন আজ ওর বুকে জ্বলছে সেটা এখন শুধু মাহাদই নিভে দিতে পারে। তিতির কারও কথার তোয়াক্কা করেনা। ওর কাছে শুধু মাহাদ থাকলেই যথেষ্ঠ।
"তিতির সব বিষয়ে তাড়াহুড়া করতে নেই। আর এমন বিষয়ে তো কখনই না। একটু রিলাক্স হও, তুমি যা চাচ্ছো তাই হবে।"
"আমি যা চাচ্ছি মানে? আপনি চান না! আপনি আমায় সব সময় দুরে রাখেন কেন? আপনার আরো কাউকে বিয়ে করার ইচ্ছা আছে নাকি!"
এমন কথায় তিতিরের ভেজা গালে ঠাস্ করে একটা থাপ্পড় পড়ল। দুর্বল শরীর নিয়ে এত জোড়ে থাপ্পড় সইতে পারলোনা তিতির। দেয়ালের সাথে শরীরটা ঘেঁসেই শাওয়ারের নিচে বসে পড়লো।
মাহাদ বুঝতে পারছে তিতির এসব নিয়েই বেশি চিন্তা করছে তার জন্য আজ এতবড় সমস্যা হয়েছে। তিতিরকে ফ্লোর থেকে তুলে মাহাদ ওকে বুকের ভিতর নিয়ে বলল," স্যরি, কেনো এসব কথা বলো, যেই কথাগুলো আমি সহ্য করতে পারিনা! তোমায় কি কেউ কিছু বলেছে তিতির?"
এবার তিতির ক্রোধে ফেটে পড়ল। আপনার এত ধৈর্য্য কই থেকে আসে? আমি তো আপনার স্ত্রী। কিভাবে আপনি আমার কাছ থেকে দুরে দুরে থাকেন? আমাকে দয়া দেখান? শুধু কর্তব্য পালন করেন! আমার দরকার নেই এসব। ছাড়েন আমাকে, আপনার এসবের আমার প্রয়োজন নেই। তিতির ওয়াসরুম থেকে বের হয়ে রুমে আসতেই গোলাবের সাউন্ড শুনল।
গোলাব দরজা ধাক্কাচ্ছে আর শব্দ করে ডাকছে। তিতির বিরক্ত হয়ে দরজা খুলে একটু পাশ করতেই গোলাব ঢুকে পড়লো। তিতির গোলাবের দিকে কঠোর চোখে তাকাতেই গোলাব আউউউউু বলে টুপ করে বসে পড়ল ফ্লোরে। তারপর অন্য দিকে চেয়ে রইল।
তোর বাপকে শাসন করেছি বলে তুই আমায় রাগ দেখাস? তোর বাপকে আগে সোজা করবো সাথে তোরেও করবো। বাপকে নিয়ে এই রুম থেকে এক্ষুনি দফা হয়ে যা।
মাহাদ ততক্ষনে রুমে চলে আসছে। তিতির, ওকে বকা দিচ্ছো কেন? মাহাদকে দেখতে পেয়েই গোলাব উঠেই দৌড় দিল। মাহাদকে সে নানা অভিযোগ করল।
মাহাদ গোলাবের গায়ে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, " তোর মা ক্ষেপে আছে। কেন রুমে আসতে গেলি? বাহিরে যা একটু পর আমি আসছি।"
গোলাব চলে যেতেই মাহাদ হাজার পাওয়ারের আক্রোশ নিয়ে তিতিরের কাছে গেল। যেটার জন্য এত সমস্যা সেই কাজটাই করে ওকে ঠান্ডা করতে হবে।
আয়নার সামনে দাড়িয়ে তিতির ওর ভেজা চুলগুলো মুছছিল। মাহাদ ঠিক তিতিরের পিছনে গা ঘেঁষে দাড়াতেই তিতির মাহাদের দিকে তাকালো। মাহাদের এমন আক্রোসময় চাহোনি দেখে তিতির ভয় পেয়ে গেল। এমন চাহোনি সে কখনো দেখেনি। মাহাদ আপনি কি করতে চাচ্ছেন?
" চুপপপ, একটা উফ্ শব্দও যেন মুখ থেকে না বের হয়। মাহাদের শ্বাস ঘন হতে গভীর ঘন হতে লাগে। মাহাদ তিতিরের কানের কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, " কেন এত আমাকে উত্তেজিত করো? আমার মনের বিরুদ্ধে কিছু করা আমি একদম পছন্দ করিনা। কিন্তু তোমার অবাধ্যতা আমাকে এই কাজ করতে বাধ্য করছে। তাই এর দহন যন্ত্রনা উপভোগ করো।"
" মাহাদ ওর মত করে কিছু প্রসেস করতেই তিতির মাহাদকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। আমার খারাপ লাগছে মাহাদ। আমি প্রচন্ড কষ্টে আছি। আমার কিছু ভালো লাগছেনা।"
মাহাদ কাজে সফল হল। এবার মাহাদ নিজেকে থামিয়ে বলল," আমি সেটাই জানতে চাচ্ছি, তোমার কি হয়েছে?"
" আমরা পড়ে কথা বলি এ বিষয়ে?"
" ওকে, মাহাদ তিতিরকে ছেড়ে দিয়ে চেঞ্জড করে দ্রুত রুম থেকে বের হয়ে গেল।"
তিতিরের প্রচন্ড ঘুম আসছে। মনে হচ্ছে ঘুমের রেশ এখনো কাটেনি। কোনরকম চেঞ্জ করে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। আর সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়লো। মাহাদ খাবার নিয়ে এসে দেখে তিতির ঘুমিয়ে পড়েছে। বাধ্য হয়ে খাবারগুলো রেখে এসে বেডে বসে ল্যাপটপটা অন করতেই দেখলো অনেকগুলো ইমেইল এসেছে। একে একে সব ইমেল চেক করতে লাগলো মাহাদ। একজায়গায় চোখ আটকে গেল। যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত একটি ম্যাগাজিন প্রকাশনা সংস্থান ফোর্বস। তারা বিশ্বের ১০ জন সফল তরুন উদ্যক্তার তালিকা বের করেছেন। তার ভিতর মাহাদের নামও উঠেছে। মাহাদ ৪ নাম্বারে আছে। মাহাদের বিষয়টা এত ভালো লাগলো যে বলার বাহিরে। এর মধ্য মাহাদের বাবার কল এল।
মাহাদ ফোনটা নিয়ে ব্যালকুনিতে চলে গেল। রিসিভ করে সালাম জানিয়ে বলল," বাবা.......!"
" মাহাদ দেখেছিস কিছু?"
" নাহ্ তো! কিছু হয়েছে?"
" এতকিছু ঘটে গেছে কিন্তু আমার ছেলে কিছু জানেই না। কই আছিস, বাসায় কখন আসবি?"
" আজ মনে হয় বাসায় যাওয়া হবেনা বাবা। একটা জরুরি কাজে আটকে গেছি।"
" বাহিরে এই সময় থাকা ভালো। সবার কলের রিপ্লাই দিতেই হিমসিম খেয়ে যাচ্ছি। অফিসেও থাকিসনা। প্রেসের লোকজন সেখানেও গিয়ে হামলা করবে।"
" জ্বী বাবা, কাল বাসায় গিয়ে কথা হবে। "
বাসায় কথা বলে মাহাদ ওর ভাইকে কল দিল। ফুয়াদ ও নিধির সাথে কথা বলতেই নিসা ফোনটা কেড়ে নিয়ে বলল," মাহাদ কেমন আছিস?"
" জ্বী ভালো আছি।"
" তোর সব সাফল্যতে আমাদের সাথে সেলিব্রেট করতি। আজ আসবিনা?"
" আমি খুব বিজি আছি নিসা। বাই বলে কল কেটে দিল মাহাদ।"
" নিসার চোখ ভিজে এল। মাহাদ তুই অনেক বদলে গেছিস। আর সব ঐ মেয়েটার জন্য। আপন জনদের কাছ থেকে কিছু কেড়ে নিলে তাকে কতটা শাস্তি পেতে হয় সেটা ঐ মেয়ে হারে হারে টের পাবে। প্রতিটা কর্মর জন্য প্রস্তত থেক তিতির।"
♦♦♦♦
মাহাদ ফোনটা সুইচস্টপ করে রাখলো। এখন কলের উপর কল আসবে। মি. মাহফুজ রহমানের ইমেলে পাঠিয়ে দেওয়া ভিডিওটা মনযোগ সহকারে দেখে সেটার উপর রির্পোট তৈরি করে কমপ্লিট করে রাখলো। একটা ম্যাগাজিন থেকেও ইমেল এসেছে। তারা মাহাদকে নিয়ে কিছু কাজ করতে চায়। তাদের সাথেও কিছু কথা বলে আরও কিছু কাজ শেষ করে ল্যাপটপ বন্ধ করে দেখলে তিতিরের অপজিট পাশে গোলাব ঘুমিয়ে পড়েছে। মাহাদ তিতিরের কপালে একটা কিস করে সুয়ে তিতিরকে আরও নিজের কাছে টেনে আনলো। যাতে গোলাবের কোন অসুবিধা না হয়।
♦♦
এক ঘুমে সন্ধ্যার পর তিতিরের ঘুম ভাঙ্গলো। ঘুম ভেঙ্গে দেখলো মাহাদ নেই। তিতির ধড়পর করে উঠে বসল। ঘুমানোর আগের কথাগুলো মনে পড়লো। মাহাদ, মাহাদ বলে কয়েকবার ডাকতেই আসমা এসে বলল, আপা ভাইজানতো কই যেন চলে গেল মাগরিবের নামায পড়ে। কিছু বলে যায়নি তো!
তিতিরের প্রচন্ড খারাপ লাগতে শুরু করলো। ফোন হাতে নিয়েই মাহাদের নাম্বার ডায়েল করলো। কিন্তু বার বার নাম্বার বন্ধ দেখাচ্ছে। এবার তিতিরে চোখ ভিজে এল। আমাকে না বলে উনি কেন চলে গেলেন? উনি জানেননা আমার কতটা কষ্ট হবে এতে।
রাত সাড়ে আটটার দিকে মাহাদ হাতে অনেকগুলো সপিং ব্যাগ নিয়ে আসলো। তিতির প্রচন্ড রাগ দেখিয়ে কিচেনে গিয়ে ভাত বসিয়ে দিয়ে ফ্রিজ থেকে তরকারি গুলো বের করে গরম করতে লাগল।
মাহাদ আসমার হাতে সাতটা প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে বলল, " আসমা, এখানে কিছু মিষ্টি আর বিরিয়ানি অছে। এগুলো হিনুদের বাসায় দিয়ে এসো। তোমার আপার রেজাল্ট বের হয়েছে সেই উপলক্ষে।"
মাহাদ বাঁকি প্যাকেটগুলো ডাইনিং টেবিলে রেখে রুমে চলে গেল। তিতির এসে আসমার হাতে আর একটা প্যাকেট তুলে দিয়ে বলল," আসমা, খালাম্মা না তোমাকে তার কাছে একদিন থাকতে বলেছিল! আজ তোমার ভাইজান আছে তাই সমস্যা হবেনা। তুমি চাইলে আজ থাকতে পারো। আর যদি না থাকতে চাও তাহলে প্যাকেটগুলো দিয়ে জলদি এসো। আমরা এক সাথে খাবো।"
" আপা, আজ যখন সুযোগ পেয়েছি তাহলে ওখানেই থাকি বলে আসমা চলে গেল।"
তিতির দরজা বন্ধ করে দিয়ে গোলাবকে খাবার দিয়ে নিজেদের জন্য খাবার বেড়ে নিয়ে গিয়ে দেখলো, মাহাদ ফাইল বের করে কাজ করছে।
তিতিরকে দেখে মাহাদ উঠে গিয়ে ফাইলগুলো সব গুছিয়ে আলমারিতে রাখতে লাগল।
তিতির হাতে প্লেট নিয়ে মাহাদের কাছে গিয়ে ভাত মেখে ওর মুখের সামনে ধরতেই মাহাদ তিতিরের দিকে চাইলো। তারপর কিছু না বলে ভাত মুখে নিয়ে খেতে লাগলো আর কাজ করতে লাগলো। তিতির এক হাতে মাহাদকে সরিয়ে আলমারি বন্ধ করে মাহাদকে টেনে এনে বেডে বসিয়ে দিয়ে বলল, " এখান হতে যেন নড়তে না দেখি।"
মাহাদ শুধু মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। তারপর বলল, " তিতির জানো, বাঁচার জন্য একটা অবল্মন থাকতে হয়। অবল্মন না থাকলে হয় সে পাগল হয়ে যাবে, না হয় মারা যাবে, না হয় জিবন্ত নষ্ট লাশ হয়ে বেঁচে থাকবে। আমার অবল্মন এখন তুমি।
দুঃখ হোক আর সুখ হোক, মন শুধু তোমাকেই চায়। আল্লাহ্ তোমাকে আমার ছায়া বানিয়ে দিছে। যেই পরিস্থিতে পরিনা কেন শুধু তোমাকে পাশে চাই তিতির। তাহলে সব কষ্ট দায়ক কাজগুলো খুঁশিতে করতে পারবো। তুমি আমার লাইফে না থাকলে আমি কোন জায়গায় পৌছাবো সেটা আমার জানা নেই। আমাদের কপালে যা কিছু কষ্টকর অধ্যায় আছে সেগুলো আমরা একসাথে মোকাবেলা করবো।"
মাহাদের মুখে আরো এক লোকমা ভাত তুলে দিয়ে তিতির বলল, "আপনাকে আমি এমন করে সব সময় পাশে পেলে, "আল্লাহর কসম" আমি চুপ করে সব সহ্য করতে প্রস্তুত থাকবো। শুধু আপনি আমার কাছ থেকে কখনো চলে যাবেন না দয়া করে।"
মাহাদ কথার প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বলল, " তুমি জানো, আমার কুইনের আজ রেজাল্ট প্রকাশিত হয়েছে?"
রেজাল্টের কথা শুনে তিতিরের মুখ শুকিয়ে এল।
মাহাদ তিতিরের ভয় পাওয়াকে খুব ইনজয় করছে।অবশেষে মুচকি হেঁসে মাহাদ ওর ভ্রু জোড়া নাচিয়ে বলল, " ডির্পাটমেন্ট অফ দ্যা ফাষ্ট মাই কুইন তিতির। কিন্তু সেকেন্ড পজিশনের ছেলেটা তোমার থেকে অনলি ১০ পয়েন্ট কম আছে। তাই বেশি খুঁশি হতে পারলামনা। পরের ইয়ারে যেন কোন বান্দা তোমার আশেপাশে না দেখি। কথাটা মনে থাকবে তো?
" জ্বী মনে থাকবে।"
দু'জনে খাবার শেষ করল। তিতির সব কিছু রেখে এসে দেখল, মাহাদ ল্যাপটপ নিয়ে বসেছে। তিতিরের নামায কাযা হয়ে গিয়েছিল। তাই অযু করে এসে নামাযে দাড়ালো। নামায শেষ করে কিছুক্ষন বসে থাকতেই এশারের আযান দিল। আযান শেষ হয়ে গেলে আবার নামাযে দাড়ালো। এর মধ্য মাহাদও এসে নামাযে দাড়িয়ে গেল।
রাত ন'টা বাজে। মাহাদ তিতিরকে ওর সব কাজ ল্যাপটপে দেখিয়ে দিল। কোথায় কি করেছে আর কিভাবে কাজগুলো করতে হবে সব কিছু। তিতির খুব ভালো করেই বুঝল মাহাদ কতটা বিজি থাকে। তারপরও সে তার জন্য কত কিছু করে। আজ তারে কষ্ট দেওয়া একদম ঠিক হয়নি।
তিতিরের মনে হঠাৎ একটা প্রশ্ন উদয় হল। আচ্ছা, ওরা মাহাদের কাছ থেকে আমাকে সরানোর জন্য এমনটা করেনি তো? হুম অবশ্যই ওর কাছ থেকে আমাকে সরানোর জন্যই কাজগুলো করেছে। যাতে আমি হয় নিঃশব্দে মাহাদের কাছ হতে সরে যাই না হয় মাহাদের সাথে এ নিয়ে ঝগড়া করি। যার পুরো ফায়দা টা তারা নেবে।
আর বাতাসি বিবি যে চতুর মহিলা তার পক্ষে এমন কাজ করা কোন ব্যপারই না। উফ্ তিতির কেন মাথা গরম করতে গিয়েছিলি। এই মানুষটাকে আর কত কষ্ট দিবি। কতটা ধর্য্যশীল হলে কেউ এমন সব কাজেকর্মে নিজেকে কন্টোল করে রাখে।
"মাহাদ কিছু খাবেন?"
" কয়বার খাবো? তোমার ক্ষিদে পেলে তুমি খাও।"
" মুখটা বেঁকিয়ে তিতির মাহাদের কথাগুলো আবার রিপিট করলো, তোমার ক্ষিদে পেলে তুমি খাও।"
মাহাদ কাজ বন্ধ রেখে তিতিরের দিকে কঠোর চোখে তাকালো। কারন এসব ব্যবহার মাহাদের একদম পছন্দ না।
মাহাদের ওমন তাকানো দেখে তিতির ভয়ে ভয়ে গোলাবকে ডাকল। গোলাব কই তুই! বাবা কাজ করছে, আমাদের এখানে থাকা একদম উচিত নয়। ওনার সমস্যা হচ্ছে।
মাহাদ আর কিছু না বলে কাজে মন দিল। তিতির গোলাবকে নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে এসে তিন কাপ কফি বানালো। এক কাপ মাহাদকে দিয়ে এল আর এক কাপে কয়েকটা আইস কিউব দিয়ে দুই কাপ আর গোলাবকে নিয়ে ছাদে চলে এল।
ছাদে ঝিরঝির বাতাস বইছে। মাহাদ থাকলে খুব ভালো হত। কিন্তু জনাব তো কাজ করছেন। গোলাবের দিকে কোল্ড কফিটা এগিয়ে দিয়ে বলল," গোলাব এটা তোর জন্য।"
গোলাব খুঁশি হয়ে চুকচুক করে কফি পান করতে লাগল। তিতির কফি নিয়ে রেলিং ঘেষে দাড়িয়ে রইল। প্রায় দু'ঘন্টার মত ছাদে থেকে গোলাবকে নিয়ে নিচে নেমে এসে দেখল, মাহাদ এখনো কাজ করছে। তিতিরের আর সাহস হলনা মাহাদকে বিরক্ত করা। গোলাবকে নিয়ে চুপটি করে সুয়ে পড়লো।
♦♦♦♦
পরের দিন কামরান সাহেব লাবীবাকে জিঙ্গেস করলো," লাবীবা, তিতির কি ওর বাবার বাসা থেকে আর আসবেনা? মেয়েটা সেই কবে চলে গিয়েছে। বাসাটা একদম ফাকা ফাকা লাগে। তাছাড়া ওর পড়াশুনার ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে তো!"
স্বামীর মুখে তিতিরের নাম শুনে লাবীবা চুপ করে রইল। কি বলবে সে! তিতিরকে সে নিজেই বের করে দিয়েছে বাসা থেকে। এই কথা যদি ভুলেও মাহাদের বাবা জানে তাহলে তাকে আর ক্ষমা করবেনা। কারন মাহাদের বাবা তিতিরকে খুব পছন্দ করে।
মেয়েটা খুব ভালো ছিল। আমার খুব কেয়ার নিত। ওর নাম্বারটাও আমার কাছে নেই। লাবীবা, আমাদের যদি ওমন একটা বলেই কামরান সাহেব থেমে গেল। সেদিন এই কথা বলার জন্য আম্মাজান তাকে আবার বিয়ে দিতে চেয়েছিল। থাক কথা টা না তোলাই বেটার।
আমি আপনার জন্য খাবার বেড়ে দিচ্ছি। আপনি নিচে আসুন বলে লাবীবা চলে গেল। কামরান সাহেব ভেবে পাচ্ছেনা। তিতিরের কথা বললে সবাই চুপ হয়ে যায় কেন?
মাহাদ অনেক সকাল সকালই বাসায় চলে এসেছে। মিষ্টির প্যাকেট গুলো সাবিনাকে দিয়ে বলল," সবার রুমে গিয়ে দিয়ে আয়। বাবাকে কিন্তু একটাই মিষ্টি দিবি। আর বাবা যদি বলে কিসের মিষ্টি তাহলে বলবি তিতির আপার রেজাল্টের মিষ্টি। মাহাদ একটা বাটিতে করে ৪ টা মিষ্টি আর এক গ্লাস পানি নিয়ে বাতাসির রুমে চলে গেল।
বাতাসি তখন চোখ বন্ধ করে রবীন্দ্র সংগীত শুনছিল আর সুরের তালে তালে পান ছাচার ঢুকনিতে বাড়ি দিচ্ছিল। মাহাদ এসে গান বন্ধ করতেই বাতাসি চোখ খুলে মাহাদের দিকে চাইলো।
বাতাসি পান পরে খেয়। দেখ, তোমার জন্য কি নিয়ে আসছি। তোমার প্রিয় মিষ্টি বলে মিষ্টিগুলো বাতাসির সামনে রাখলো।
আই তোর মিষ্টি খামু না। সরা এহান থাইকা। ইন্দুর মারা বিষ দিছোস এর ভিতর?
হুম দিয়েছি, আমার এত বড় সাফল্যতে তোমায় ইঁদুর মারার বিষই উপহার দিতে আসছি। বিষগুলো খেয়ে জলদি দুনিয়া থেকে বিদায় হও।
বাতাসি কি মনে করে টপ করে একখান মিষ্টি তুলে নিয়ে মুখে পুরে দিল। তারপর চোখ বন্ধ করে মিষ্টির সাধ নিতে লাগলো। মাহাদ হাসি মুখে আরো একটা মিষ্টি জোড় করে বাতাসির মুখে গুজে দিয়ে বলল," মিষ্টি গুলো কিন্তু আমার বৌয়ের হাতের ছোয়ায় বানানো হয়েছে। সকালে সে খুব কষ্ট করে তোমার জন্য এই কটা বানিয়েছে। আমি চাইলাম কিন্তু কি অবাক কান্ড সে আমাকে দিলই না। বরং বললো তোমাকে নিয়ে যেন একসাথে খাই।
বাতাসি মাহাদের কথা শুনে চোখ বড় বড় করে মাহাদের দিকে চাইলো। ইতিমধ্য দুইটা মিষ্টি বাতাসির পেটে চলে গেছে। বাতাসির মনে এখন নানা চিন্তা। শেষে ঐ মাইয়া আরে ইন্দুর মারার মিষ্টি দেয়নি তো? আই মরে যামু তাইলে?
মাহাদ কেবল মিষ্টিতে হাত দিতে যাবে এমন সময় বাতাসি খপ করে মাহাদের হাত ধরে করুন সুরে বলল," আই তো মরমু, কিন্তু তুই আর মরিস না। তোর বৌ আরে মারবার লাগি ইন্দুর মারার ঔষুধ দিয়ে মিষ্টি বানাইছে। তোর বৌরে কাল ঐ সব কথা বলার লাগি আরে মারবার লায় উঠি পরি লাগছে। এ রওম কইরা প্রতিশোধ লইবে তাই বলে? আর কি জিবনের মায়া নাই।"
মাহাদ চোখ কপালে তুলে জিঙ্গাসা করলো," কাল তুমি তিতিরকে কি বলছো?"
" বাতাসি জ্বিভে কামড় দিল। বুড়া হওয়ার সাথে সাথে বুদ্ধিও বুড়া হইছে। কথা পাল্টিয়ে বাতাসি বলল," তাইলে কাল রাতে তোর বৌয়ের লগে ছিলি? "
মাহাদ ওখানে বসেই তিতিরকে কল দিয়ে বলল," তিতির, গতকাল কি বাতাসির সাথে তোমার দেখা হয়েছিল! "
"আপনি দাদীর কাছে আছেন? যদি থাকেন তাহলে দাদীকে একটু ফোনটা দেন তো?"
মাহাদ বাতাসিকে ফোন দিয়ে বলল," কথা বল।"
বাতাসি মাহাদের ভয়ে হাতে ফোন নিয়ে হ্যালো বলতেই তিতির বলল," দাদী, আমি কি বলে দিব! আপনারা ৩জনে কাল আমার সাথে কিরকম ব্যবহার করেছেন? জানেন তো দাদী, আপনাদের মত আন্তজার্তিক মানের ৩ চুন্নির বিচার শুধু মাহাদ নামের ঐ একজনই সঠিক ভাবে এতদিন করে আসছে। তাই ভাবছি ওনাকে দিয়েই আমার নায্য বিচার পাবো।"
তিতিরের কথাগুলো শুনে বাতাসির কন্ঠনালী পর্যন্ত শুকিয়ে গেল। টুপ করে কলটা কেটে দিয়ে ফোনটা শাড়ীর আচল দিয়ে লুকিয়ে ফেলে ভাঙ্গা স্বরের মত কন্ঠে বলল," আই পানি খামু।"
বাতাসির কপালে ইতিমধ্য বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। ফান্দে পড়িয়া বাতাসি কান্দে তেমন একটা অবস্থা আর কি!